আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Sunday, March 25, 2012

কৃষ্ণনগর ভ্রমণ

কৃষ্ণনগর । কলকাতা থেকে রেলপথে দুরত্ব ঠিক ১০০ কিলোমিটার । আর সড়কপথে ১০৮ কিলোমিটার । মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কৃষ্ণনগর । গোপালভাঁড়ের কৃষ্ণনগর । মাটির পুতুলের কৃষ্ণনগর । সরপুরিয়া-সরভাজার কৃষ্ণনগর । বাংলার ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা কৃষ্ণনগর । সেই কৃষ্ণনগর ভ্রমণ নিয়েই আমার ব্লগের এবারের পোস্ট ।

২৫ শে মার্চ, ২০১২ রবিবার সকালে একটা 'কৃষ্ণনগর সিটি জংশন' লোকাল ট্রেন ধরে আমরা গেছিলাম । সঙ্গী আমার স্ত্রী অমৃতা । সারাদিনে শিয়ালদহ থেকে কৃষ্ণনগর যাওয়ার অনেকগুলো ট্রেন চলে । ভাড়া ২০ টাকা । সপ্তাহের অন্যদিনে এই ট্রেনগুলো গ্যালপিং হলেও রবিবার সব স্টেশনে থামে । শিয়ালদহ থেকে কৃষ্ণনগর যেতে লাগে প্রায় পৌনে তিন ঘন্টা । কাজেই ট্রেনে বসতে পাওয়াটা খুব দরকারি । তবে যদি প্রথমে বসতে নাও পাওয়া যায়, নৈহাটীর পর থেকে মোটামুটি ফাঁকা হয়ে যায়ই ।

আমরা ধরেছিলাম সকাল ৯:৩৫ এর ট্রেন যেটা কৃষ্ণনগর পৌঁছল বেলা ১২:২০ তে । ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে গিয়ে একটা সমস্যা হতে পারে যেটার সম্মুখীন আমরা হয়েছিলাম ।কৃষ্ণনগর জায়গাটা ঠিক ঘুরতে যাওয়ার জন্য প্রসিদ্ধ নয় । এর আগে ব্যান্ডেলে গিয়ে যেমন দেখেছিলাম রিক্সা আর অটোওয়ালারা আমাদের দেখেই 'চার্চ চার্চ' বা 'ইমামবাড়া ইমামবাড়া' বলে হেঁকেছিল, এবারে সেরকম হল না । আসলে কৃষ্ণনগর নদীয়া জেলার যাকে বলে সদর, এখানে প্রচুর লোক চাকরি করতে যায়, তাই এখানকার মানুষ অতিথিদের ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগী নয় ।

কিন্তু এরা আমাদের ব্যাপারে উদ্যোগী না হলে কি হবে, আমরা তো ঘুরতে গেছি । কাজেই উদ্যোগটা আমাদেরই নিতে হল । কৃষ্ণনগরে দেখার জায়গা বলতে প্রধানতঃ চারটে - রাজবাড়ি, ঘুর্ণি, ক্যাথলিক চার্চ আর কলেজ । এগুলো আমরা আগে থেকেই জেনে গেছিলাম । একজন স্থানীয় লোকের সঙ্গে কথা বলে এগুলোর কোনটা কিভাবে যাওয়া যায়, জেনে নিলাম । এদের মধ্যে কলেজটা 'কৃষ্ণনগর কলেজ' নামেই বিখ্যাত - এটা একটা বহু পুরনো কলেজ । কিন্তু রিক্সাওয়ালাকে বোঝাতেই পারলাম না আমরা ঠিক কোন কলেজটায় যেতে চাইছি । বারবারই বলতে থাকল "এখানে সব মিলিয়ে পাঁচটা কলেজ আছে, আপনারা কোথায় যেতে চান বলুন ।"

রাজবাড়ির প্রধান দরজা
কলেজ আমাদের লিস্ট থেকে বাদ দিতে হল । রিক্সা করে প্রথমে গেলাম রাজবাড়ি । নদীয়াধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বিখ্যাত রাজপ্রাসাদ । পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিরাট বড় রাজবাড়ি, কিন্তু ভেতরে ঢুকতে দেয় না । বাইরে থেকে ভেতরটা যতদূর দেখা যায় দেখলাম । রাজবাড়ি সংলগ্ন মাঠে কিছুদিনের মধ্যে একটা মেলা বসবে, তার প্রস্তুতি চলছে । এই মেলা হচ্ছে কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত মেলা, প্রতি বছর এপ্রিল মাসে ১৫ দিনের জন্য বসে । এই সময়ে রাজবাড়ির দরজা সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় । আরও জানলাম রাজবাড়িতে বর্তমানে কেউ থাকে না, রাজার বংশধর কলকাতায় থাকেন (কথা শুনে মনে হল এটা আন্দাজে বলছে, তবে এখানে সত্যি-মিথ্যে যাচাই করার কোনও উপায় নেই) আর মেলার সময়ে এখানে আসেন ।

দোকানে রাখা মাটির পুতুল
পরবর্তী গন্তব্য ঘুর্ণি । এখানেই কৃষ্ণনগরের জগদ্বিখ্যাত মাটির পুতুল তৈরি ও বিক্রি হয় । পাশাপাশি সার দেওয়া পরপর দোকান, সেখানে বসেই কারিগর তৈরি করছেন ও বিক্রি করছেন । সে এক দেখার মতো জিনিস ! কোনও ছাঁচ নেই, শুধু হাত ও নানারকম ছোটখাটো ছুরি চিমটে দিয়ে পরপর পুতুল তৈরি হয়ে চলেছে । দুর্গা, গণেশ, রাধাকৃষ্ণ, কালী, চৈতন্যদেব থেকে শুরু করে সাঁওতাল দম্পতি, গ্রামের ছেলে-বুড়ো, সব্জী বিক্রেতা, কামার, কুমোর সবার মুর্তিই তৈরি হয় । মাটির গয়নাও পাওয়া যায় । সব দোকানে প্রায় একই জিনিস পাওয়া যায়, কিন্তু তাও আমরা প্রত্যেকটা দোকান আলাদা আলাদা করে ঘুরে দেখলাম । হাতে অফুরন্ত সময় ছিলনা সেজন্য বেরিয়ে আসতে হল, তা না হলে আরও অনেকক্ষণ থাকতাম ।

এরপর রিক্সাওয়ালাকে বললাম আমাদের একটা খাবারের হোটেলে নিয়ে যেতে । ঘুর্ণির বাসস্ট্যান্ডটা বেশ বড়, রিক্সাওয়ালা আমাদের সেখানে একটা খাবারের হোটেলের সামনে ছেড়ে দিল । স্টেশন থেকে রাজবাড়ি হয়ে ঘুর্ণি ঘুরে এ'পর্যন্ত ছেড়ে দেওয়ার জন্য রিক্সাওয়ালা নিল মোট ৬০ টাকা । খাবারের হোটেলে ঢুকলাম । হোটেলটা সেরকম impressive কিছু নয়, পরিষ্কার - এ'টুকু বলা যায় । ভাত-ডাল আর একটা সব্জী - ১৫ টাকা । চিকেন ৬০ টাকা । একবারে যা ভাত দেয়, সেটা একজনের পক্ষে যথেষ্ট । আমাদের দু'জনের মোট বিল হল ১৫০ টাকা ।

এরপর আমাদের গন্তব্য চার্চ । হোটেলের সামনে থেকেই আরেকটা রিক্সা ধরে গেলাম চার্চে । এবারে ভাড়া নিল ১৫ টাকা । এই দুরত্বটার ভাড়া স্থানীয় লোকের জন্য ১০ টাকা, কিন্তু আমাদের থেকে ১৫ টাকাই নিল । একটা কথা এখানে লেখা দরকার যে কলকাতার তুলনায় কিন্তু কৃষ্ণনগরের রিক্সাভাড়া কম । ঘুর্ণির বাসস্ট্যান্ড থেকে চার্চের যা দুরত্ব, সেই দুরত্ব কলকাতায় কিছুতেই ১০ টাকায় যাওয়া যায় না ।

Christo Mandir এর ভেতরে
চার্চ দেখে মন ভরে গেল । এমনিতেই চার্চ জায়গাটা খুব পরিষ্কার আর শান্ত হয়, তাই চার্চের ভেতরে গেলে একটা অন্যরকম অনুভূতি হয় । সেটা ঈশ্বরে ভক্তি না থাকলেও হয় । এখানে প্রধান চার্চের পাশে আরেকটা ছোট চার্চ আছে, সেটার নাম Christo Mandir । প্রধান চার্চটা দুপুরে বন্ধ থাকে, বিকেল ৪ টের সময়ে খোলে । Christo Mandir সারাক্ষণ খোলা । এখানে জুতো পরে ঢোকা বা ছবি তোলার কোনও বিধিনিষেধ নেই, যেটা আছে সেটা একটা অনুরোধ - নীরবতা বজায় রাখার । বলাই বাহুল্য, সেটা অগ্রাহ্য করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না । বিশাল একটা ছ'কোণা হলঘরের মতো জায়গা যার সমস্ত দেওয়াল জুড়ে যীশুর জীবনী । সিলিংটা গম্বুজের মতো, সেখানে আবার আকাশের তারার মতো নক্সা করা আছে । সব মিলিয়ে খুব সুন্দর ।

Christo Mandir এর বাইরে - কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার
এই Christo Mandir এর বাইরেটাও খুব অভিনব । কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার থেকে শুরু করে গান্ধীজির ডান্ডি অভিযান - সব কিছুরই বিশাল বিশাল মূর্তি আছে । এছাড়া আছে বিভিন্ন Saint দের মূর্তি । একটা চার্চে এরকম জিনিস আমরা কখনও দেখিনি । কিন্তু এগুলোর বিশেষত্ব কী, সেটা জানার কোনও উপায় নেই, কারণ ত্রিসীমানার মধ্যে আমরা দু'জন ছাড়া আর কোনও লোক নেই ।


এই Christo Mandir থেকে বেরিয়ে প্রধান চার্চে গেলাম । চার্চ বন্ধ, তবে কম্পাউন্ডের ভেতরে ঢোকা যায় । খুব সুন্দর করে ঘাস ছাঁটা একটা মাঠ, আর একপাশে সুন্দর ফুলের বাগান ।

ধাপের একেবারে ওপরে
এখান থেকে বেরিয়ে আরেকটা জায়গা আছে, সেটাকে কি বলা উচিৎ সেটা বলা মুস্কিল । দু'দিকে সিঁড়ির মতো উঠে গেছে যার ধাপে ধাপে crucifiction এর ঘটনাটার মূর্তি রাখা আছে । সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেখানে পৌঁছনো যায়, সেখানে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর একটা মূর্তি আছে ।





স্টেশন - ফেরার পথে
এবার ফেরার পালা । ২০ টাকা রিক্সাভাড়া দিয়ে চার্চ থেকে সোজা স্টেশনে চলে এলাম । ঘোরা মোটামুটি ভালই হয়েছে, শুধু বাকি আছে কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত সরপুরিয়া-সরভাজা কেনা । স্টেশনের কাছে কোনও দোকান নেই, তাই আমাদের আবার কিছুটা হেঁটে শহরের দিকে যেতে হল । সেখানেও একটাই দোকান খোলা পাওয়া গেল । সরপুরিয়া-সরভাজা দু'টোরই দাম ৩০০ টাকা/কেজি ।


আমাদের ফেরার ট্রেনের সময় ছিল বিকেল ৪:২৫ ; মিষ্টি কিনে স্টেশনে এসে দেখলাম ট্রেন এসে গেছে । ট্রেন ছাড়ল যথাসময়ে । ফেরার পথে ট্রেনে সাংঘাতিক ভীড় হয়েছিল, সৌভাগ্যবশতঃ আমরা আগে থেকে উঠেছিলাম বলে বসতে পেয়েছিলাম । শিয়ালদহে ট্রেন পোঁছল সাতটার একটু পরে ।

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে রেলপথে ঠিক ১০০ কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণনগর একটা বেশ সুন্দর দেখার জায়গা । ট্রেনে যাওয়ার খরচ সবচেয়ে কম, এছাড়া কলকাতা থেকে বাসে বা গাড়ি ভাড়া করেও যাওয়া যেতে পারে ।
২. জায়গাটা ঠিক ঘোরার জায়গা হিসেবে প্রসিদ্ধ নয়, তাই আগে থেকে একটু জেনে যাওয়ার দরকার যে এখানে কি কি দেখার জিনিস আছে, সেগুলোর কোনটা কোথায় আর কিভাবে যেতে হয় ।
৩. ২ জন ঘোরার জন্য রিক্সা হচ্ছে সবচেয়ে সুবিধেজনক । তবে লোকসংখ্যা বেশি হলে অটো ভাড়া করে নেওয়া যেতে পারে ।
৪. এখানে দেখার জায়গা বলতে রাজবাড়ি, কলেজ, ঘূর্ণি আর চার্চ । এর মধ্যে রাজবাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেয় না ।
৫. ঘূর্ণি অবশ্যই দেখা উচিৎ । এখানকার মাটির পুতুল পৃথিবীবিখ্যাত আর তার কারণটা এখানে গেলে স্পষ্ট বোঝা যায় ।
৬. চার্চটা দুপুরে বন্ধ থাকে, বিকেল ৪ টেয় খোলে । চার্চের পাশে একটা Christo Mandir আছে যেটা সারাক্ষণ খোলা থাকে । এটা খুব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ।
৭. খাওয়াদাওয়া এককথায় চলনসই । সাধারণ ভাতের হোটেল আছে অনেক, তবে তার চেয়ে বেশি ভালো রেস্টুরেন্ট আশা না করাই উচিৎ ।

উপসংহারঃ


কৃষ্ণনগর
কৃষ্ণনগর দেখার জায়গা হিসেবে খুব আকর্ষণীয় কিছু নয়, কাজেই 'না দেখলে জীবন অসম্পূর্ণ' - তা নয় কখনওই । কিন্তু যদি ছোটখাটো জায়গায় ঘোরার নেশা থাকে আর তার সঙ্গে 'একদিনে ঘুরে আসতে হবে' এরকম বাধ্যবাধকতা থাকে তাহলে এখানে যাওয়া যেতে পারে । অল্প টাকা খরচ হবে, আর যেটা হবে সেটা উশুল হয়ে যাবে এটা জোর দিয়ে বলাই যায় । মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজধানী এই শহরে এমন অনেক কিছু আছে, যা দেখলে সেই সময়টাকে ছোঁওয়া যায় । কৃষ্ণনগর পর্যটককে হয়তো সেভাবে 'আকর্ষণ' করে না, কিন্তু beauty lies in the eyes of the beholder - এই কথাটা কৃষ্ণনগরের জন্য আশ্চর্যজনকভাবে সত্য !

কৃষ্ণনগর ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here: