আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Thursday, October 31, 2013

পুরী ভ্রমণ

প্রথমেই বলে রাখি আমার ব্লগের এই পোস্টটা বাকিগুলোর থেকে কিছুটা আলাদা হবে, কারণ যেদিন থেকে আমি এই ভ্রমণসর্বস্ব ব্লগ লেখা শুরু করেছিলাম, সেদিনই ঠিক করেছিলাম বাঙালির তিনটে ঘোরার জায়গা দী-পু-দা (অর্থাৎ দীঘা-পুরী-দার্জিলিঙ) সম্পর্কে কখনও লিখব না । কারণ এইসব জায়গা সম্পর্কে বাঙালিদের নতুন করে কিছু জানার নেই । তাই আমাদের এই 'পুরী ভ্রমণ' সম্পর্কে অল্প কিছু কথা লিখে রাখছি এই কারণে যে হয়তো এই তথ্যগুলো অন্য কারুর বা পরবর্তীকালে আমাদের নিজেদেরই কাজে লাগতে পারে ।

যাওয়া : ২৬শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১০:৩৫ - পুরী এক্সপ্রেস ।
ফেরা : ৩০শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১০:১৫ - পুরী হাওড়া গরীবরথ এক্সপ্রেস ।

সারসংক্ষেপঃ

১. পুরীতে আমরা ছিলাম ইন্ডিয়ান ওভারসিস্‌ ব্যাঙ্কের হলিডে হোমে । পুরীতে গিয়ে হলিডে হোমে থাকা এখনও পর্যন্ত বেশ কমন্‌ ব্যাপার । কিন্তু যদি নিজেরা রান্না করার পরিকল্পনা না থাকে, তাহলে হলিডে হোমে না থাকাই ভালো । কারণ পুরীতে অনেক হোটেল পাওয়া যায় যেখানে থাকার খরচ হলিডে হোমের খরচের সমান ।
২. হলিডে হোমের দ্বিতীয় অসুবিধে হল বেশিরভাগ হলিডে হোমের সঙ্গে কোনও একটা ট্রাভেল এজেন্সির যোগাযোগ আছে । ঘোরার জন্য সেই এজেন্সির থেকে গাড়ি বা বাস না নিলে এরা ঝামেলা করে । আমরা এই পদ্ধতির কথা জানতাম না, তাই 'নন্দী ঘোষ ট্রাভেল্‌স্‌' - এর লোকজন রীতিমতো আমাদের ঘরে ঢুকে আমাদের হুমকি দিয়ে যায় ।
৩. পুরীর লোক্যাল সাইট সিয়িং এর জন্য বিভিন্ন ধরনের গাড়ি পাওয়া যায়, যার মধ্যে টাটা ম্যাজিক খুব বেশি চলে । আমাদের দলে ন'জন ছিলাম এবং একটা ম্যাজিকের ভাড়া নিল ৪২৫/- ।
৪. কোণার্ক আর ভুবনেশ্বরের ঘোরাঘুরির জন্য গাড়িভাড়া করে ঘোরাই ভাল, কারণ ভিডিও কোচের বাসে ঘোরা কিছুটা কষ্টসাধ্য । সেইসঙ্গে নিজের ভাড়া করা গাড়িতে ঘোরার আরেকটা সুবিধে হল কোনও জায়গায় নিজের মতো যতক্ষণ ইচ্ছে দাঁড়ানো যায় ।

উপসংহারঃ

পুরী !
আমাদের চারপাশে এমন কোনও বাঙালি পরিবার বোধহয় নেই যারা জীবনে কখনও পুরী যায়নি । তাই পুরী সম্পর্কে কিছু জেনে নেওয়া ভীষণ সহজ ব্যাপার । আরেকটা মজার ব্যাপার "পুরী ঘুরে খুব ভালো লাগল" এটা আমি কখনও কারুর মুখে যেমন শুনিনি, তেমনই "দূর দূর, পুরী আবার একটা যাওয়ার মতো জায়গা হল ?" এরকম বলতেও কাউকে শোনা যায় না । কম পুঁজি আর খুব এফর্টলেস্‌লি ঘোরার জন্য পুরী একটা আদর্শ জায়গা । এখানে ঠকে যাওয়া খুব সহজ নয়, কারণ পুরী সম্পর্কে এখানকার লোকেরা যা জানে, বাঙালি ট্যুরিস্টরাও প্রায় তাইই জানে । পুরীর লোকেদের আর কোনও রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা নেই, পুরী চলে প্রধানতঃ কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের টাকায় - আমরা হচ্ছি ওদের সবচেয়ে বড় কাস্টমার ! কাজেই "কাস্টমার ইজ গড" - এই কথাটা পুরীতে গিয়ে সবসময়ে মাথায় রাখা উচিৎ । আমরা জগন্নাথদেবের দর্শন করার জন্য পুরী যাই বটে, কিন্তু পুরীর মানুষের কাছে আসলে আমরাই 'জগন্নাথ' !

পুরী ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

Thursday, October 24, 2013

রিশপ ও কোলাখাম ভ্রমণ

জানি না কেন লোকের একটা ধারণা আছে যে 'রিশপ' জায়গাটা সিকিম রাজ্যে । (আমি নিশ্চিত এই লাইনটা পড়েই অনেকের মনে হবে "আমি তো সিকিমেই জানতাম ! রিশপ সিকিমে নয় ? তাহলে কোথায়?") যারা জানে না তাদের সবাইকে জানাই রিশপ পশ্চিমবঙ্গেই পড়ে - দার্জিলিঙ জেলায় । নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট একটা গ্রাম । সেই গ্রামে আমাদের দু'দিন থাকার অভিজ্ঞতা দিয়েই আমার ব্লগের এবারের পোস্ট ।

১৯শে অক্টোবর, ২০১৩ শনিবার আমাদের বেরোনোর দিন । এটা লক্ষ্মীপুজোর পরেরদিন কাজেই অন্যান্য কোনও ট্রেনে বুকিং না পেয়ে আমরা বাধ্য হয়েছিলাম 'পাহাড়িয়া এক্সপ্রেস' নামক ট্রেনে টিকিট কাটতে । আমাদের এবারের টীমের সদস্যসংখ্যা পাঁচ - আমি, আমার স্ত্রী অমৃতা, আমার সহকর্মী সমীরণদা, বৌদি ও ওনাদের এগারো বছরের ছেলে ঋজু । পাহাড়িয়া এক্সপ্রেস ছাড়ে দীঘা থেকে, হাওড়ায় একটা পঞ্চাশ মিনিটের হল্ট দিয়ে এন জে পি র উদ্দেশ্যে রওনা হয় রাত ৯:৫৫ টায় । এখানে জানিয়ে রাখি এন জে পি যাওয়ার জন্য রাতের কোনও ট্রেনে একান্তই বুকিং পাওয়া না গেলে তবেই পাহাড়িয়া এক্সপ্রেসে যাওয়া উচিৎ, না হলে নয় । কামরার ভেতরের আলো পাখা স্যুইচ প্লাগ পয়েন্ট এবং সর্বোপরি বাথরুম - কোনওটাই আশানুরূপ নয় । (আমাদের কামরায় এক ভদ্রলোক বলেই ফেললেন "অন্যান্য ট্রেনের সব বাতিল হয়ে যাওয়া বগিগুলো এই ট্রেনে লাগিয়েছে ।")

সেভক-এ ব্রেকফাস্ট ব্রেক
তবে বগি যাইই হোক, পাহাড়িয়া এক্সপ্রেস এন জে পি পৌঁছল মাত্র একঘন্টা লেটে । এখান থেকে সিন্ডিকেটের একটা বোলেরো গাড়ি বুক করা ছিল - সেই গাড়ি করে রওনা দিলাম রিশপের উদ্দেশ্যে । গাড়িভাড়া ৩,২০০ টাকা । (এখন এই অঞ্চলে কার সিন্ডিকেট সমস্ত গাড়ির রেট বেঁধে দিয়েছে, ড্রাইভাররা আর ইচ্ছেমতো ভাড়া চাইতে পারে না) রাস্তায় সেভক রোডের ওপর তিস্তাব্রীজের কাছে ব্রেকফাস্টের জন্য দাঁড়ানো হল । এখান থেকে আলুর পরোটা আর কফি খেয়ে নেওয়া হল । মাথাপিছু খরচ পড়ল ৪০ টাকা ।

পথের দু'ধারে চা-বাগান
রিশপ যেতে হলে গরুবাথান হয়ে যেতে হয় - অর্থাৎ সেভক থেকে আমরা করোনেশন ব্রীজ পেরিয়ে এগিয়ে চললাম । এখানে রাস্তার দু'দিকে প্রচুর চা-বাগান পড়ে এবং অনেকটা পথ বলতে গেলে সমতলভূমিতেই । এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই সুন্দর । বেশ কিছুটা পথে পাশাপাশি চলতে থাকে রেল লাইন । এই রেলপথ চলে গেছে গুয়াহাটী পর্যন্ত ।
মেঘের মাঝে পথ - পথের মাঝে মেঘ

প্রায় ঘন্টাদেড়েক চলার পথে শুরু হল পাহাড়ী রাস্তা । পাহাড়ী রাস্তার বিবরণ দেওয়ার মানে হয় না, এটা আগেও বলেছি । পাহাড় আর খাদকে কখনও ডানদিকে আর কখনও বাঁদিকে রেখে আমরা এগিয়ে চললাম । রিশপ জায়গাটা 'লাভা' থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দূরে - লাভা হয়েই রিশপ যেতে হয় । প্রকৃতপক্ষে রিশপ লাভার ওপরেই নির্ভরশীল । রিশপের নিজস্ব কোনও বাজারও নেই, পুরোটাই আসে লাভা থেকে । আমরা লাভা পেরোলাম তখন দুপুর দু'টো ।

লাভা থেকে রিশপ রাস্তাটার একটু বিবরণ দেওয়া দরকার । ৫-৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তায় কোথাও পিচ্‌ নেই, পুরোটাই অসমান এবড়োখেবড়ো পাথরের । রাস্তা কখনও হঠাৎ করে উঁচু হয়ে যায়, কখনও হঠাৎ নিচু । এর ওপর দিয়ে যখন গাড়ি চলে তখন যাত্রীদের অবস্থা কি হয়, সেটা বোধহয় আর বিস্তারিত না বললেও চলবে । মোটকথা, এই অত্যন্ত জঘন্য রাস্তা দিয়ে (আমি 'অত্যন্ত জঘন্য' লেখামাত্রই সেটা নিজে থেকে strike out হয়ে গেল, এর একটাই মানে হতে পারে - অত্যন্ত জঘন্য জিনিসরাও এই রাস্তাকে নিজেদের দলে জায়গা দিতে অস্বীকার করছে !) যাওয়ার আগে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া ভাল, তাতে কষ্ট হয়তো কিছুটা কম হতে পারে ।

লাভলি রিসর্টে আমাদের কটেজ
দুপুর তিনটে নাগাদ আমরা পোঁছলাম আমার গন্তব্য - রিশপে । রিশপে পৌঁছে প্রথম যে বাড়িটা চোখে পড়ে সেটাই 'লাভলি রিসর্ট' - আমাদের থাকার জায়গা । পাহাড়ের ধাপে এর কটেজগুলো তৈরি করা হয়েছে । আপাতত এখানে আমরা ছাড়া আর কোনও গেস্ট নেই, একটা দোতলা কটেজের দোতলার দু'টো ঘর আমার জন্য বুক করা হয়েছে । ঘর আমাদের সবারই খুব পছন্দ হল । দেওয়াল মেঝে সবই কাঠের এবং খুব সুন্দর করে তৈরি করা । লাভলি রিসর্টের ঘরভাড়া ১,২০০ টাকা করে, তবে আমাদের চেনাজানা ছিল বলে ১,০০০ টাকা করে পড়েছে ।* (এই লেখার নিচে সারসংক্ষেপে বলা আছে কিভাবে যোগাযোগ করা যেতে পারে)

হাতমুখ ধুয়ে আমরা প্রথমেই গেলাম ডাইনিং রুমে । ভাত ডাল আলুপোস্ত আর ডিমের ডালনা নেওয়া হল । রান্নার মান অসাধারণ কিছু না হলেও বেশ ভাল । আমাদের মাথাপিছু খরচ পড়ল ১২০ টাকা মতো ।

আমাদের ঘর
খাওয়া যখন শেষ হল তখন বিকেল সাড়ে চারটে । রোদ পড়ে এসেছে । রিশপের উচ্চতা ৮,০০০ ফুট এবং একটা পাহাড়ের প্রায় মাথায় । স্বাভাবিকভাবেই এখানে ঠান্ডা বেশ বেশি । খাওয়া শেষ করে আমরা নিজেদের ঘরে ফিরে এসে গরম জামাকাপড় চাপালাম ।




চাঁদের আলোয় রিশপ থেকে প্রাকৃতিক দৃশ্য
বিকেল পাঁচটার একটু পরে এখানে সূর্য্যাস্ত হয় । আমাদের রিসর্টের ব্যালকনি থেকে সামনের পাহাড়ের ওপর অস্তগামী সূর্য্যের শেষ আলোকচ্ছটা দেখতে অসাধারণ লাগে । আমাদের আর কিছু করার নেই, তাই কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে বসে আড্ডা দিলাম । আস্তে আস্তে চারদিকের আলো কমে গিয়ে একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল । তারপর আস্তে আস্তে সামনের পাহাড়গুলোর গায়ে জোনাকীর মতো আলো জ্বলে উঠল । চা খেতে খেতে আমরা এই দৃশ্য দেখলাম । জায়গাটা এমনিতেই ফাঁকা আর সন্ধ্যের পরে যেন একেবারেই নিস্তব্ধ হয়ে যায় । যখন আমরা কথা বলছি না, সেই সময়ে ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না । সবমিলিয়ে একটা ভীষণ সুন্দর পরিবেশ ।

রিশপের দু'টো সমস্যা আছে, সেগুলোর কথা এখানে লিখে রাখি । এক, বিদ্যুতের সমস্যা । এখানে বিদ্যুতের সরবরাহ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম, কাজেই রিসর্টকে সন্ধ্যের পরে বেশিরভাগ সময়েই জেনারেটর জ্বালিয়ে রাখতে হয় । আমাদের ঘরে চারটে সি এফ এল ছিল, কিন্তু তাদের আলো এতটাই মিটমিটে যে সবসময়েই কমপক্ষে দু'টো জ্বালিয়ে রাখতে হয় ।

দ্বিতীয় সমস্যা হল জল, যদিও আমাদের এ'জন্য সেরকম কিছু ভুগতে হয়নি । রিশপে জলের খুব সঙ্কট - সে'জন্য ওখানকার লোকেরা বারবার বলে বাথরুমে বা অন্যান্য কোথাও জলের অপচয় না করতে । বিদ্যুতের সমস্যার জন্য গিজার চালানো যায় না, তবে বললে ওরা বালতি করে গরম জল দিয়ে যায় ।

রাতে খাওয়ার জন্য ডাইনিং রুমে গেলাম । (অবশ্য বললে ওরা ঘরেও দিয়ে যায়) যাওয়ার পথে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলাম । আকাশভরা সূর্য্য তারা ! এত তারা আমরা যারা কলকাতায় থাকি তাদের কখনও দেখার সুযোগ হয় না । একে একে কালপুরুষের প্রায় সবক'টা, সপ্তর্ষিমন্ডলের সবক'টা আর টাফা (যেখানে প্রোফেসর শঙ্কু থাকেন !) সবই দেখতে পেলাম ।

রাতে খাওয়া হল রুটি আর চিকেন কারি । মাথাপিছু দাম পড়ল ১৫০ টাকা মতো ।

সকালের আলোয় আমাদের রিসর্ট এবং বাগান
পরেরদিন সকালে উঠলাম তখন সাতটা । এইসময়ে রোদ উঠে যায় আর সকালে রোদে সমস্ত জায়গাটা চমৎকার লাগে । রোদের কিছুটা উত্তাপ থাকায় গরম জামা না পরলেও চলে । রিশপের একটা জিনিস উল্লেখযোগ্য - সেটা হল এখানকার ফুলের বাগান । আমাদের রিসর্টেরও নিজস্ব একটা বাগান আছে । এখানে নানা ধরনের ফুলগাছ এবং টব রাখা আছে । ফুলের মধ্যে গাঁদা চন্দ্রমল্লিকা জবা এবং আরও কয়েকটা নাম না জানা ফুল আছে । আর সবথেকে বেশি আছে গোলাপগাছ । সমস্ত গাছই অত্যন্ত ভালোভাবে পরিচর্যা করা হয় । (আমরা এখান থেকে কিছু গাছ কিনতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ওরা বলল এই গাছ আমাদের সমতলে নিয়ে গেলে বাঁচবে না ।) আমরা বেশ কিছুক্ষণ বাগানে ঘোরাঘুরি করে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম । এখানেও আলুর পরোটা । দাম পড়ল ৫০ টাকা করে ।

এরপর সাইট সিয়িং । আগেই বলে রাখি রিশপে সাইট সিয়িং করার মতো প্রায় কিছুই নেই, আর যেহেতু রিশপ এখনও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি, তাই এখানকার লোকেরা এখনও আজেবাজে জায়গাকে 'দেখার জায়গা' বলে টুপি পরায় না । আমাদের রিসর্টের লোকেদের থেকে জানলাম এখানে একটা মনাস্ট্রি আছে আর একটা বাচ্চাদের স্কুল আছে - যানবাহনের কোনও ব্যবস্থা নেই, চাইলে হেঁটে গিয়ে ঘুরে আসা যেতে পারে ।

রিশপে হেঁটে ঘোরার সময়ে
আমরা হাঁটতে শুরু করলাম । রিশপ গ্রামের মধ্যে দিয়েই হাঁটার রাস্তা - পথের দু'ধারে আরও কিছু রিসর্ট দেখতে পেলাম । মনাস্ট্রি যাওয়ার পথে চোখে পড়ল 'নেওড়াভ্যালি রিসর্ট' - এখানে 'শব্দ' নামক বাংলা ছবির শ্যুটিং হয়েছিল । রিশপে আলাদা করে কোনও ঘোরার জায়গা নেই ঠিকই, কিন্তু এখানে এমনি ঘুরতেই বেশ ভালো লাগে । ফাঁকা জায়গা, কম লোকজন, কিছুদূর অন্তর অন্তর একটা রিসর্ট আর তার চারপাশে ফুলের বাগান । সেইসঙ্গে পাহাড়ের গায়ে কখনও রোদ, কখনও ছায়া পড়ে অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য । কখনও আমাদের পাশে মেঘ, কখনও নিচে । কখনও হাওয়ার স্রোত এসে একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব, আবার কখনও রোদ এসে একটা আরামদায়ক আবহাওয়া ।

মনাস্ট্রি - দূর থেকে
প্রায় ২ কিলোমিটার পাহাড়ি চড়াই উৎরাই পেরিয়ে একটা জায়গায় পোঁছলাম যেখান থেকে মনাস্ট্রিটা স্পষ্ট দেখা যায় । আমাদের অবস্থান থেকে এই মনাস্ট্রিতে পৌঁছতে গেলে বেশ অনেকটা নিচে নামতে হবে । নিচে নামাটা কষ্টকর হবে না, কিন্তু ফেরাটা বেশ চাপের হবে - তাই আমরা দূর থেকেই মনাস্ট্রি দেখে ক্ষান্ত হলাম । বাচ্চাদের স্কুলটা মনাস্ট্রি পেরিয়ে আরও কিছুটা নিচে, তাই সেখানেও আর যাওয়ার ঝুঁকি নেওয়া হল না ।

রিশপ থেকে আরেকটা ঘোরার জায়গা আছে সেটা হল লাভা ট্রেকিং । পাহাড়ের গায়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ট্রেক করে রিশপ থেকে লাভা যাওয়া যায় । কিন্তু আমরা আর এই পথে হাঁটলাম না ।

আমাদের রিসর্টের সামনের রাস্তা
সাড়ে দশটায় বেরিয়ে লোক্যাল সাইট সিয়িং করে ফিরে এলাম তখন সাড়ে বারোটা । বস্তুতঃ আমাদের রিশপে ঘোরাঘুরি শেষ - এখানে বলতে গেলে আর কিছু দেখার নেই । আমাদের একমাত্র দেখা বাকি আছে 'টিফিনদাড়া' - যেটা আমরা পরেরদিন সকালে যাব বলে ঠিক করেছি । (টিফিন দাড়ায় কিন্তু কোনও টিফিনের ব্যবস্থা নেই !)


রিসর্টে ফিরে এসে চানটান করে লাঞ্চ করে নিলাম । আজও লাঞ্চে কালকের মেনুই নেওয়া হল । রিশপে মাছ পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম । লাভায় মাছ পাওয়া যায় কিন্তু রিসর্টে বেশি লোক না থাকলে ওদের খরচায় পোষায় না । আর উপস্থিত আমরা ছাড়া আর কোনও লোকও নেই । যদিও আমাদের তাতে কোনও আফসোস নেই, আমরা ডিম আর মাংসের ওপর বেশ আছি !

সূর্য্যাস্তের সময়ে
ঠান্ডা জায়গায় দুপুরে ভাত খাওয়ার পর শোওয়া যায় না, কারণ উঠলেই খুব শীত করে । খাওয়ার পরে আমরা আবার আমাদের বারান্দায় বসলাম আড্ডা দিতে । লাভলি রিসর্টের এই বারান্দাটা এতটাই সুন্দর যে এখানে বসে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায় ।





ক্যাপশনের প্রয়োজন নেই
সন্ধ্যেবেলা অর্ডার দিয়ে আমরা চিকেনমোমো খেলাম । প্লেটে ৫টা করে মোমো । দাম পড়ল ১০০ টাকা করে । এইসব পাহাড়ী অঞ্চল মোমোর জন্য বিখ্যাত, কাজেই মোমো যে অত্যন্ত সুস্বাদু সে'কথা বোধহয় আর আলাদা করে না বললেও চলবে । রাতে ডিনার । ডিনারে মিক্সড চাউমিন আর চিলি চিকেন খাওয়া হল । খরচ পড়ল ১৪০ টাকা করে ।


ডিনারের সময়ে আমাদের পরেরদিন টিফিনদাড়া যাওয়ার ব্যাপারটা ফাইনাল করে নেওয়া হল । টিফিনদাড়ায় গিয়ে সূর্য্যোদয় দেখা যায় । কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপরে সূর্য্যের প্রথম আলো - শুনে মনে হল ব্যাপারটা অনেকটা 'টাইগার হিল'-এর মতো । রিশপ থেকে টিফিনিদাড়া ট্রেক করে ওপরদিকে উঠতে হয় - প্রায় একঘন্টা লাগে । ভোর সাড়ে চারটের সময়ে অন্ধকারে বেরিয়ে এই রাস্তাটা যেতে হয় যাতে সূর্য্যোদয়ের আগেই টিফিনদাড়ায় পৌঁছনো যায় । পাহাড়ী পথে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা, কাজেই গাইড ছাড়া যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না । আমাদের রিসর্টের লোক বলল একজনকে ঠিক করে রাখবে যে সাড়ে চারটের সময়ে এসে আমাদের ডাকবে । আমরা যেন তৈরি হয়ে থাকি । লোকের রেট ৩০০ টাকা ।

পরেরদিন ২২শে অক্টোবর, ২০১৩ মঙ্গলবার । চারটের সময়ে অ্যালার্ম বাজিয়ে ঘুম থেকে উঠে সাড়ে চারটের মধ্যে রেডি হয়ে নিলাম । বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, কাছাকাছির মধ্যে আমাদের রিসর্টের আলোগুলো জ্বলছে । আর সেইসঙ্গে ঠান্ডা । তারই মধ্যে আমরা অপেক্ষা করছি আমাদের গাইডের জন্য । সাড়ে চারটে - চারটে পঁয়ত্রিশ - পৌনে পাঁচটা । গাইড আর আসে না । দেখতে দেখতে পাঁচটাও বেজে গেল । নাঃ, সে এল না । পাঁচটা বেজে যাওয়ার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে এরপর সে এলেও আমরা আর যাব না, কারণ আমাদের টিফিনদাড়ায় পৌঁছনোর আগেই সূর্য্যোদয় হয়ে যাবে ।

"জাগো - নতুন প্রভাত"
অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে ঘরে এসে আবার শুয়ে পড়লাম । আস্তে আস্তে অন্ধকারটা কেটে যেতে লাগল । আমি জেগেই ছিলাম আর এই সময়ে ঘরে বসে থাকার কোনও মানে হয় না । তাই আমাদের ব্যালকনিতে গিয়ে বসে রইলাম সেই ব্রাহ্মমূহুর্তে । (এটাকে ব্রাহ্মমূহুর্ত বলে কিনা ঠিক জানি না, কিন্তু এই শব্দটা ব্যবহার করতে খুব ইচ্ছে করছিল, তাই এটা এখানে লিখলাম !) দেখতে দেখতে সূর্য্য উঠল । যেন মনে হল "অন্তরে অন্তরে দাও আলো দাও / কালিমা কলুষ যত মুছে নিয়ে যাও" (এটা তখন মনে হয়নি, আসলে আজ ২৪শে অক্টোবর, মান্না দে মারা গেছেন, তাই এটা ওনার প্রতি একটা শ্রদ্ধার্ঘ্য !)

২২শে অক্টোবর আমাদের রিশপ ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন । আমাদের গন্তব্য কোলাখাম । আমাদের ট্রিপে আমরা দু'দিন রিশপ আর একদিন কোলাখামে থাকছি । সকাল দশটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট সেরে রিশপ থেকে কোলাখামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া হল । আবার সেই রাস্তা, কিন্তু একবার গিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছি ! রিশপ থেকে কোলাখাম যেতে প্রায় দু'ঘন্টা লাগে যদিও রাস্তা মাত্র ১৩ - ১৪ কিলোমিটার । কোলাখামও রিশপের মতোই লাভার ওপর নির্ভরশীল একটা গ্রাম । আমাদের যাওয়ার পথে স্বাভাবিকভাবেই পড়ল - লাভা ।

লাভা মনাস্ট্রি
আমাদের ড্রাইভার নিজের দরকারে লাভায় কিছুক্ষণ দাঁড়ালো - একেবারে লাভা মনাস্ট্রির সামনে । আমার আর অমৃতার লাভা মনাস্ট্রি দেখা নয়, তাই আমরা সেটা দেখতে গেলাম । মনাস্ট্রিটা খুব সুন্দর । অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং ঝকঝকে রঙ করা । দেখতে সবমিলিয়ে মিনিট পনেরো লাগল ।




এরপর লাভা থেকে কোলাখাম । এই রাস্তাটা একেবারেই লাভা থেকে রিশপের মতো - একমাত্র পার্থক্য হল এর দৈর্ঘ্য ৭ - ৮ কিলোমিটার । পথের বিবরণের পুনরাবৃত্তি না করে সোজা কোলাখামে চলে যাচ্ছি, যদিও আমাদের যাত্রা কোলাখামে শেষ হল না । আমরা পাহাড়ী পথে গাড়ি করে আরও ৮ কিলোমিটার নেমে গেলাম - আমাদের গন্তব্য চাঙ্গে ফল্‌স্‌ ।

চাঙ্গে ফল্‌স্‌
চাঙ্গের রাস্তায় শেষ কিছটা আর গাড়ি যায় না, হেঁটে নামতে হয় । হেঁটে হেঁটে একেবারে নিচে নেমে চাঙ্গে । আগেরবার কালুক ভ্রমণের সময়ে পেলিং এর কাছ থেকে চাঙ্গে ফল্‌স্‌ যা দেখেছিলাম এখানে তার থেকে অনেকটাই বড় দেখালো । কাছাকাছি গেলেই জলের ছিটেয় ভিজে যাচ্ছিলাম । আর সেইসঙ্গে অনেকটা ওপর থেকে জল পড়ার প্রচন্ড শব্দ - সবমিলিয়ে বর্ণনাতীত ।
ফল্‌স্‌ দেখে মন ভরে গেল ।

ফিরে এলাম কোলাখামে । রিশপ থেকে কোলাখামের গাড়িভাড়া ১,৪০০ টাকা, আমরা চাঙ্গে গেছিলাম বলে আরও ৮০০ টাকা বেশি পড়ল । কোলাখামে আমাদের রিসর্টের নাম 'ইকো গ্রীন হাটস্‌' - ঘরভাড়া ১,৭৬০ টাকা করে (ট্যাক্স সমেত) ।

আমাদের ঘরের ভেতর
ঘর আমাদের খুবই পছন্দ হল । ডাব্‌ল্‌ বেড রুমের মধ্যে একটা করে সিঁড়ি আছে যেটা দিয়ে রুমের দোতলায় যাওয়া যায় । এই দোতলায় আবার আরেকটা বিছানা পাতা আছে । অর্থাৎ তিনজন এই ঘরে আরামসে থাকতে পারে ।






আমরা চানটান করে দুপুরে খেতে গেলাম । আমাদের ঘরের নিচেরতলাতেই ডাইনিং রুম । এগকারি আর ভাত খাওয়া হল । এখানে মিল সিস্টেমে ফুড প্যাকেজ নিতে হয় । একদিনের খাওয়ার খরচ মাথাপিছু ৪৫০ টাকা আর ঘরের সঙ্গে ব্রেকফাস্টটা ফ্রি । আমরা যেহেতু এইদিন সকালের জলখাবার (যেটা ব্রেকফাস্টের থেকে আলাদা) নিইনি, তাই আমাদের ৩৫০ টাকা করে পড়ল ।

কোলাখাম গ্রাম
খাওয়ার পরে কোলাখাম ঘুরতে বেরোলাম । কোলাখাম রিশপের থেকেও ছোট জায়গা আর এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যই একমাত্র দেখার জিনিস । আমরা রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ঘরে এসে রেস্ট নিলাম । সন্ধ্যেবেলা সামনের পাহাড়ের ওপরে সূর্য্যাস্ত দেখলাম । কোলাখামের উচ্চতা ৬,২৫০ ফুট এখানে ঠান্ডা খুব কম । সারা সন্ধ্যে নিজেদের মতো আড্ডা দিয়ে সময় কেটে গেল । মাঝখানে একবার সিন্ডিকেটের অফিসে (যেটা আমাদের ঘর থেকে হেঁটে ৩০ সেকেন্ড লাগে) গিয়ে আমি আর সমীরণদা পরেরদিনের গাড়ি ঠিক করে এলাম ।

রাতে রুটি, আলুর তরকারি আর চিকেন কষা । এ'কথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে রিশপের থেকে কোলাখামের খাবারের মান অনেক ভালো ।

পরেরদিন ২৩শে অক্টোবর, ২০১৩ বুধবার - আমাদের ফেরার দিন । সকাল সকাল রেডি হয়ে ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে নিলাম । আটটার একটু পরে ব্রেকফাস্ট করে একটা বোলেরো গাড়িতে উঠলাম । কোলাখাম থেকে এন জে পি সরাসরি গাড়ি যায় না । আমাদের গাড়ি লাভা পর্যন্ত যাবে, আর তারপর লাভা থেকে সে আরেকটা গাড়ি ধরিয়ে দেবে । সেই গাড়ি আমাদের এন জে পি নিয়ে যাবে । কোলাখাম থেকে এন জে পি র গাড়িভাড়া ৩,৫০০ টাকা ।

আবার সেই ঝাঁকুনি রাস্তা ধরে ৮ কিলোমিটার - কিন্তু এবার একেবারেই বিরক্ত লাগছিল না কারণ এটা আমাদের ট্রিপের চতুর্থ তথা শেষ ঝাঁকুনি । লাভায় যখন পোঁছলাম তখন বেলা দশটা ।

ফেরার পথে
লাভায় আমাদের একটা সুমো ধরিয়ে দেওয়া হল । এই গাড়ির ড্রাইভার আসতে কিছুক্ষণ দেরি করায় আমাদের লাভা থেকে বেরোতে বেরোতে এগারোটা বেজে গেল । ফেরার পথে যখন গরুবাথানে লাঞ্চ করলাম তখন দুপুর আড়াইটে । এটা রাস্তার পাশের একটা সাধারণ ভাতের হোটেল - দাম স্বাভাবিকভাবেই কম । মাংসভাতের দাম আমাদের মাথাপিছু পড়ল ১০০ টাকা করে ।

এরপর আবার নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন আর সেখান থেকে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস ধরে ফেরা । ট্রেন খুব সামান্যই লেট ছিল, তাই শিয়ালদহে নেমে ছ'টার মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে গেলাম !

সারসংক্ষেপঃ

১. নিউ জলপাইগুড়িতে নেমে যেসব জায়গায় যাওয়া যায়, রিশপ তাদের মধ্যে আরেকটা । শান্ত নিরিবিলি জায়গায় ছুটি কাটানো যাদের উদ্দেশ্য, তাদের জন্য বিশেষ উপযোগী ।
২. নিউ জলপাইগুড়ি থেকে রিশপের দুরত্ব ১৪০ কিলোমিটারের মতো । সিন্ডিকেটের গাড়ির রেট ৩,২০০ টাকা ।
৩. উচ্চতা ৮,০০০ ফুট । স্বাভাবিকভাবেই অক্টোবরের মাঝে এখানকার আবহাওয়া ঠান্ডার দিকে ।
৪. রিশপে বেশ কিছু রিসর্ট আছে যাদের মধ্যে আমাদের 'লাভলি রিসর্ট' উল্লেখযোগ্য । West Bengal Tourism Development Corporation থেকে এদের বুকিং করা যায় অথবা এদের ওয়েবসাইট http://www.rishyap.com/ থেকেও বুকিং করা যেতে পারে ।
*এখানকার কেয়ারটেকার 'তারাপদ জ্ঞান' আমাদের পরিচিত । আমাদের মাধ্যমে এর সঙ্গে যোগাযোগ করলে বেশ কিছুটা কমে ঘর পাওয়া যাবে । অফ্‌ সিজনে খুব অল্প দামেই ঘর পাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় ।
৫. রিশপে বিশেষ কিছু দেখার নেই, তবে মনাস্ট্রিটা দেখে আসা যেতে পারে । আর ভোরবেলা উঠে টিফিনদাড়ায় গিয়ে সূর্য্যোদয় দেখাটা মিস্‌ করার কোনও মানেই হয় না ।
৬. রিশপ থেকে লাভা যাওয়ার একটা হাঁটা পথ আছে, সেই পথে লাভা ট্রেক করা যেতে পারে । তবে এটা এমনকিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয় ।
৭. রিশপে বিদ্যুতের একটু সমস্যা আছে, ঘরের আলো বেশিরভাগ সময়েই মিটমিট করে । রিসর্টে জেনারেটর থাকলেও নিজেদেরও কিছু ব্যবস্থা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া উচিৎ ।
৮. রিশপে কোনও দোকান বাজার নেই, সবথেকে কাছে লাভা ।
৯. রিশপে খাবারের দাম ঠিকঠাক । মাথাপিছু ৩৫০ - ৪০০ টাকা প্রতিদিন ।
১০. রিশপ থেকে কোলাখামের দুরত্ব ১৩ - ১৪ কিলোমিটারের মতো । গাড়িভাড়া ১,৪০০ টাকা ।
১১. কোলাখাম থেকে অবশ্যই চাঙ্গে ফল্‌স্‌ দেখতে যাওয়া উচিৎ । পাহাড়ের গা বেয়ে প্রবলবেগে আর প্রবল শব্দে নেমে আসা চাঙ্গে ফল্‌স্‌ এত কাছ থেকে এইভাবে দেখতে পাওয়া লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স !
১২. কোলাখামেও থাকার কিছু জায়গা আছে যার মধ্যে 'ইকো গ্রীন হাটস্‌' উল্লেখযোগ্য । এদের ওয়েবসাইট http://www.hammockshutsholidays.com/. এখানকার ভাড়া ১,৭৬০ টাকা ।
১৩. এখানে খাওয়ার খরচ মাথাপিছু ৪৫০ টাকা করে ।
১৪. কোলাখাম থেকে এন জে পি র গাড়িভাড়া ৩,৫০০ টাকা ।

উপসংহারঃ

রিশপ
প্রকৃতির মধ্যে যে একটা ঝকঝকে ব্যাপার আছে, আমরা যারা দূষণপ্রবণ জায়গায় থাকি, তারা সাধারণতঃ অনুভব করি না । রিশপে এই ঝকঝকে ব্যাপারটা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায় । এখানকার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য - এই সৌন্দর্য্যের টানেই রিশপ যাওয়া । এখানে সাইট সিয়িং করার কিছু নেই, শুধু দৈনন্দিন জীবন থেকে ছুটি নিয়ে পাহাড়ের কোলে দু'টো দিন বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রিশপ একেবারে আদর্শ জায়গা । শান্ত আর নিরিবিলি পরিবেশে প্রকৃতিকে উপভোগ করার সুযোগ রিশপের সবথেকে বড় আকর্ষণ । যদি এই পরিবেশ তোমাকে আকর্ষণ করে, তাহলে বেরিয়ে পড় রিশপ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে । শুধুমাত্র একটাই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ - পাহাড়িয়া এক্সপ্রেসে না যাওয়ার চেষ্টা কোরো !

রিশপের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

Tuesday, September 17, 2013

মুকুটমণিপুর ভ্রমণ

তুমি যদি কখনও 'মুকুটমণিপুর' যাওয়ার পরিকল্পনা কর আর সেটা তোমার আশেপাশের লোকজন জেনে ফেলে তাহলে তুমি সবচেয়ে বেশি যে কথাটা শুনবে তা হল "ও, মুকুটমণিপুর ! আমি সেই কোন্‌ ছোটবেলায় গেছি !" শুনে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় মুকুটমণিপুরে শুধু ছোটরাই যায় । কিন্তু আমি সেইসব লোকের মধ্যে পড়িনা - আমার 'সেই কোন্‌ ছোটবেলায়' মুকুটমণিপুর যাওয়া হয়নি । অন্যের মুখে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের কথা শুনতে শুনতেই জায়গাটায় যাওয়ার ইচ্ছে তৈরি হওয়া আর সেই সুবাদেই বেরিয়ে পড়া - আমাদের বেড়ানোর মুকুটে আরেকটা মণি যোগ করার জন্য ।

১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রবিবার সকাল ছ'টা পঁচিশে সাঁত্রাগাছি স্টেশন থেকে 'রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস' এ মুকুটমণিপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমি আর আমার স্ত্রী । (এখানে জানিয়ে রাখি, অনেকেরই ধারণা 'রূপসী বাংলা' 'ধৌলি'র সঙ্গে হাওড়া থেকে একসঙ্গে ছাড়ে, সেটা কিন্তু ঠিক নয় । রূপসী বাংলা ধরতে গেলে এখন সাঁত্রাগাছি থেকেই ধরতে হয়, হাওড়া থেকে ধরা যায় না ) মুকুটমণিপুরে ট্রেন যায় না, সবথেকে কাছের রেলস্টেশন হল বাঁকুড়া । এখান থেকে মুকুটমণিপুর আরও ৫৫ কিলোমিটার ।

বাঁকুড়া স্টেশন
বাঁকুড়া স্টেশন থেকে মুকুটমণিপুর যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া করা যেতে পারে আর নাহলে আছে লোক্যাল বাস । বাঁকুড়া স্টেশন থেকে বাঁকুড়া বাসস্ট্যান্ডটা বেশ কিছুটা দূরে - এখানে যাওয়ার জন্য আমাদের আরেকটা বাস ধরতে হল । বাঁকুড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে মুকুটমণিপুরের বাস সংখ্যায় খুবই কম তাই আমরা খাতড়ার বাস ধরলাম । এই বাস খুব সাধারণ ঝরঝরে মার্কা বাস । খাতড়া থেকে আরেকটা বাসে করে মুকুটমণিপুর । আমাদের টাইমিংগুলো হল - বাঁকুড়া স্টেশন সকাল ১০:১০ - বাঁকুড়া বাসস্ট্যান্ড সকাল ১০:৩০ - খাতড়ার বাস বেলা ১১ টা - খাতড়া দুপুর ১:৩০ - মুকুটমণিপুরের বাস দুপুর ১:৪৫ - মুকুটমণিপুর দুপুর ২:১৫ আর আমাদের হোটেল দুপুর ২:৩০ (এগুলো এত ডিটেলে লিখলাম একটাই কারণে - কলকাতা থেকে মুকুটমণিপুর যেতে হলে কেউ যেন ট্রেনে না যায় । এত কষ্ট করে না গিয়ে অনেক সহজে ধর্মতলা থেকে মুকুটমণিপুরের টানা বাসে যাওয়া যায় ।)

অনন্তমূল কটেজ
আমাদের বুকিং ছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্টের 'সোনাঝুরি রিসর্ট'এ । এটার বুকিং কলকাতা অফিস থেকে সরাসরি করা যায় - অথবা ওদের ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনও করা যায় । রিসর্টটা খুবই সুন্দর - একটা পাহাড়ের গায়ে গাছপালা ঘেরা বিরাট জায়গা জুড়ে আলাদা আলাদা কটেজ । 'শতমূল' আর 'অনন্তমূল' দু'টো পাশাপাশি কটেজ - এদের মধ্যে আমরা অনন্তমূল বুক করেছিলাম ।

ঘরের ভেতর
ঘরটা বেশ বড় - মাঝখান জুড়ে রয়েছে একটা ৭ X ৭ সাইজের খাট । এছাড়া টিভি চেয়ার টেবিল ইত্যাদি । ঘরের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা দেখবার মতো ! মেঝেটা এত পরিষ্কার যে আমরা ঘরে খালি পায়ে হেঁটেছি । বাথরুমটাও বেশ বড় এবং পরিষ্কার । ঘরের বাইরে একটা ছোট ব্যালকনি রয়েছে সেখানে চেয়ার নিয়ে বসে থাকা যায় । সবমিলিয়ে ব্যবস্থা খুবই ইম্প্রেসিভ ।


সোনাঝুরির ডাইনিং রুম
আমাদের লাঞ্চের অর্ডার দেওয়া ছিল না - কিন্তু ওরা বলল ব্যবস্থা করে দেবে । সেইমতো আমরা ঘরে এসে চানটান করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম । তারপর গেলাম ডাইনিং রুমে । এখানে রুমে খাবার দেওয়ার খুব একটা প্রচলন নেই - সবাই ডাইনিং রুমেই খায় । ডাইনিং রুমে একসঙ্গে ১৬ জন বসে খেতে পারে । খাবার সবই মিল সিস্টেম । আমরা দুপুরে নিলাম মাছভাত । রান্না অত্যন্ত সুস্বাদু ! আমাদের মাথাপিছু পড়ল ৭৫ টাকা করে ।

খাওয়ার পরে ঘরে এসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম । বিকেলে বেরোলাম চারপাশটা একটু এক্সপ্লোর করতে । মুকুটমণিপুরের প্রধান আকর্ষণ হল ড্যাম - কংসাবতী নদীর জলকে বাঁধের সাহায্যে ধরে রেখে সেচের কাজে ব্যবহার করা হয় । এই ড্যামটা বিশাল বড় আর বলতে গেলে এটা দেখতেই এখানে আসা ।

মুকুটমণিপুরে কংসাবতীর ড্যাম
সোনাঝুরি থেকে ড্যাম হেঁটে মিনিট পনেরো লাগে । ড্যামের পাঁচিলের ওপর দিয়ে রাস্তা চলে গেছে । আমরা এই রাস্তা ধরে কিছুদূর হেঁটে গেলাম । এখানকার সৌন্দর্য অসাধারণ । একদিকে কংসাবতীর বিশাল ড্যাম আর অন্যদিকে পাহাড় আর ছোট ছোট গ্রাম । আমরা বেশ কিছু ছবি তুললাম ঠিকই, কিন্তু জায়গাটার ব্যাপ্তি এতটাই বড় যে ক্যামেরায় একে বন্দী করা সম্ভব না । (ওয়াইড অ্যাঙ্গেলেও না) পাঁচিলের ওপর দিয়ে রাস্তা অনেক দূরে (৭ কিলোমিটার) চলে গেছে । পুরোটা হেঁটে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না আর আকাশে মেঘ করে ছিল - তাই হেঁটে খুব বেশি দূরে যাওয়ার সাহসও হল না । আস্তে আস্তে সন্ধ্যে হয়ে আসছিল আর পুরো জায়গাটায় আমরা ছাড়া আর লোকজনও বিশেষ ছিল না, তাই এবার ফেরার পথ ধরলাম । সোনাঝুরিতে যখন ফিরে এলাম তখন অন্ধকার হয়ে গেছে ।

সন্ধ্যেবেলা মুকুটমণিপুরে কিছু করার নেই । যতদূর সম্ভব সোনাঝুরিতে আমরা ছাড়া আর কোনও গেস্টও নেই কাজেই লোকজনের গলার শব্দও শোনা যাচ্ছিল না । ঘরের বাইরে শব্দ বলতে একমাত্র ঝিঁঝির ডাক । রিসর্টের বাইরে রাস্তা আছে, কিন্তু সেটা ঘর থেকে বেশি কিছুটা নিচে । আর সেই রাস্তা দিয়েও কদাচিৎ কখনও গাড়ি চলে । ফরে বাইরের আওয়াজও নেই । আমরা যারা কলকাতায় থাকি তারা এই নিস্তব্ধতার সঙ্গে পরিচিত নই । 'সাইলেন্স হ্যাজ ইট্‌স্‌ ওন ল্যাঙ্গুয়েজ' এই বিখ্যাত কথাটা মুকুটমণিপুরে গিয়ে আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম ।

রাতে চিকেন মিল বলা ছিল - শুধু ভাতের বদলে রুটি । মাংস ছাড়াও তরকারি, ডাল, আলুভাজা ইত্যাদি দেয় । খরচ পড়ল ৯০ টাকা করে ।

অনন্তমূল কটেজ থেকে সোনাঝুরির কিছুটা
পরেরদিন অর্থাৎ ১৬ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সোমবার । এই দিনটা আমাদের মুকুটমণিপুরের সাইট সিয়িং করার দিন । ঘোরার দু'রকম ব্যবস্থা আছে - অ্যাম্বাসাডর আর মোটর ভ্যান । মুকুটমণিপুরে সাইট সিয়িং এ খুব বেশি কিছু দেখার নেই - মোটরভ্যানে বড়োজোর ঘন্টা আড়াই লাগবে । অ্যাম্বাসাডরে গেলে সেটা আরও কমে যাবে । আর বাঁধের রাস্তা দিয়ে যখন যাব তখন অ্যাম্বাসাডরে গেলে সবদিক দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে না । সেইসব কিছু মাথায় রেখে আমরা মোটর ভ্যানটাই বেছে নিলাম ।

কিন্তু বেছে নিয়েই কি বেরিয়ে পড়লাম ? না রে বাবা, বেরোলাম তো দশটার সময়ে । তার আগে সকালে কি কি হল, সেগুলো বলি ?

সকালে রিসর্টে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম । পাঁউরুটি ডিমভাজা আর একটা মিস্টি মিলিয়ে পড়ল ৪০ টাকা করে । এখানে একটা মজার জিনিস বলি । প্রথমদিন ব্রেকফাস্টে পাঁউরুটি খেতে গিয়ে দেখলাম পাঁউরুটিতে জবজবে করে মাখন মাখানো । এত মাখন ? একটু অবাক লাগল । পরেরদিন ব্রেকফাস্টের সময়ে দেখতে পেলাম এত মাখনের কারণ কি । আমরা সাধারণতঃ মাখনের বার থেকে ছুরি বা চামচের সাহায্যে পাঁউরুটিতে মাখন মাখাই । আর ওরা গোটা বারটাকে নিয়েই পাঁউরুটিতে ঘষে ! আর সেইসঙ্গে পাঁউরুটি গরম থাকার হু হু করে মাখন অ্যাবসর্ব হয়ে যায় ! আর এই গোটা ব্যাপারটা ওরা পাঁউরুটির দু'পিঠে করে ! খেতে ভালো না হয়ে যায় কোথায় !

শাল-পিয়াল থেকে কংসাবতী ড্যাম
যাই হোক, ব্রেকফাস্টের পর সোনাঝুরির ভেতরে একটু ঘুরে বেড়ালাম । পাহাড়ের গায়ে গায়ে বিভিন্ন ধাপে আলাদা আলাদা করে একজোড়া কটেজ । তাদের নাম শাল-পিয়াল, তাল-তমাল (ইয়েস্‌ !) ইত্যাদি । এদের মধ্যে শাল-পিয়ালটা পাহাড়ের আরও কিছুটা ওপরে আর এখান থেকে ড্যামের অনেকটা দেখতে পাওয়া যায় । ওফ্‌, অসাধারণ ! সবমিলিয়ে জায়গাটা ওয়েল ডেকরেটেড, ওয়েল প্ল্যান্‌ড্‌, ওয়েল অর্গানাইজড্‌ অ্যান্ড ওয়েল মেইন্টেন্ড ! ওয়েল ... লেট্‌স্‌ স্টপ ইউজিং 'ওয়েল' ।

বাঁধের ওপর থেকে গ্রামের দৃশ্য
দশটার সময়ে বেরোলাম সাইট সিয়িং করতে । প্রথমে বাঁধের রাস্তার ওপর দিয়ে আমাদের নিয়ে গেল মোহনার দিকে । যাওয়ার পথটা অসাধারণ - একটু রোদ্দুরের তেজ থাকলেও সেটা সেরকম গায়ে লাগছিল না । একদিকে বিপুল জলরাশি আর অন্যদিকে দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেতের মাঝে মাঝে মাটির বাড়ি সম্বলিত গ্রাম - এ'জিনিসের সৌন্দর্য্য নিজের চোখে না দেখলে বলে বোঝানো সম্ভব নয় ।

পরেশনাথ পাহাড় থেকে
আমাদের প্রথম দাঁড়ানোর জায়গা পরেশনাথ পাহাড় । এখানে একটা ছোট্ট টিলার ওপরে একটা শিবলিঙ্গ আছে । টিলার ওপর থেকে বহুদূর পর্যন্ত চমৎকার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় । আমরা এখানে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুললাম ।



কংসাবতী ও কুমারীর মোহনা


এরপরের গন্তব্য মোহনা । এই মোহনার বৈশিষ্ট্য হল এখানে কংসাবতী (বা কাঁসাই) এবং কুমারী দু'টো নদী একসঙ্গে মিলিত হয়েছে । এখান থেকে নৌকো চড়ে নদীর ওপারে যাওয়া যায় আর সেখান থেকে ডিয়ার পার্কে যাওয়া যায় । তবে লোকজনের মতে ডিয়ারপার্কে সেরকম কিছু দেখার নেই, তাই আমরা আর ও'পথ ধরলাম না । মোহনায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে চলে এলাম ।

গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ
তৃতীয় যাওয়ার জায়গা অম্বিকানগর । এই জায়গাটা বলতে গেলে আমাদের রিসর্টের পাহাড়ের পেছন দিকে - তাই বলতে গেলে আমরা এবার ফেরার রাস্তা ধরলাম । কিন্তু আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড এবারে আর বাঁধের ওপর দিয়ে ফিরল না । তার বদলে বাঁধ থেকে গ্রামের পথে নেমে গিয়ে মেঠো পথে ফেরা হল । অর্থাৎ আসার পথে যেসব গ্রাম আর ধানজমি গুলো ওপর থেকে দেখছিলাম, এবার তাদের মধ্যে দিয়ে ফিরলাম । দু'ধারে ধানক্ষেত, ছোট ছোট জনবসতি, পুকুর ইত্যাদি । পথের দু'দিকে নানারকম গাছের শান্তশীতল ছায়া আর তার মাঝখান দিয়ে লালমাটির মেঠো পথটি দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি আর এক অজানার উদ্দেশ্যে - এর অনুভূতিই আলাদা ! (এত কাব্য করছি কেন ? আসলে আমরা আছি বাঁকুড়ায় আর বাঁকুড়ার পাশেই বীরভূম আর বীরভুম মানেই শান্তিনিকেতন আর শান্তিনিকেতন মানেই রবীন্দ্রনাথ !)

অম্বিকাদেবীর মন্দির
অম্বিকানগর একটা টাউনশিপ - এখানে দেখার জায়গা বলতে একমাত্র অম্বিকাদেবীর মন্দির । রাস্তার ধারে একটা ছোটখাটো মন্দির - সেরকম দূর্দান্ত কিছু নয় । চাইলে এখানে না যাওয়াও যেতে পারে ।





কংসাবতীর ব্যারেজ
এবার আবার মুকুটমণিপুরের রাস্তা ধরলাম । ফেরার পথে আমাদের রিসর্টের সামনের রাস্তা দিয়ে ফিরে এসে আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে গেলাম ব্যারেজের কাছে । এই ব্যারেজের থেকেই জল ছাড়া হয় যেটা সেচের কাজে ব্যবহার করা হয় । এখন আপাতত লক্‌গেট বন্ধ । সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ফিরে এলাম রিসর্টে । এই ঘোরাঘুরির জন্য আমাদের খরচ পড়ল ২৩০ টাকা (অ্যাম্বাসাডরে পড়ত ৪০০ টাকা) ।

ফিরে এসে চানটান করে নিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম । দুপুরে চিকেন মিল বলা ছিল । ভাত ডাল তরকারি আর চিকেন । এরপর ঘরে এসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে চারটে নাগাদ আবার বেরিয়ে গেলাম ড্যামের ধারে । এবার আমাদের উদ্দেশ্য নৌকাবিহার !

নৌভ্রমণের সময়ে
নৌকো করে এখানে ড্যামের মধ্যে ঘোরা যায় । চাইলে নৌকো করে মোহনা পর্যন্তও ঘুরে আসা যায় । নৌকোর রেট হচ্ছে ২৫০ টাকা - মোটামুটি ১০ - ১২ জন আরাম্‌সে বসতে পারে । কিন্তু আগেই বলেছি আমরা ছাড়া আর কোনও ট্যুরিস্ট নেই, কাজেই পুরো নৌকোটা আমাদেরই ভাড়া করতে হল ২০০ টাকা দিয়ে । নৌকো জলের মধ্যে আধঘন্টা মতো ঘোরায় । (আর ডাঙায় একমিনিটও ঘোরায় না) একবার একেবারে ব্যারেজের কাছে নিয়ে গেল । বেশ ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছিল । বিকেলের পড়ন্ত আলোয় এই নৌভ্রমণ বেশ সুন্দর একটা অভিজ্ঞতা ।

ড্যামের রাস্তার মুখে কিছু গিফ্‌ট্‌ আইটেমের দোকান আছে । সবমিলিয়ে দশ-বারোটা । জিনিসের দাম সস্তাই বলা যায় । বাঁকুড়ার প্রসিদ্ধ জিনিস হল বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত মাটির ঘোড়া - তবে মাটির ঘোড়া নিয়ে আসা রিস্কি বলে কাঠের ঘোড়া কেনা হল ।

কংসাবতীর গতিপথ - ব্যারেজের বিপরীত দিকে
সন্ধ্যে হতে তখনো কিছুটা দেরি আছে , তাই আমরা আরেকবার ব্যারেজের দিকটা গেলাম । আসলে হাতে সময় আছে আর সেরকম কিছু করার নেই, তাই বলতে গেলে একই জায়গা দু'বার করে ঘুরলাম আর কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ঘরে ফিরে এলাম ।





রাতে চিকেন মিল । খেয়েদেয়ে ঘরে চলে এলাম ।

১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ মঙ্গলবার । আমাদের ফেরার দিন । আমাদের ফেরার ট্রেন আবার সেই বাঁকুড়া থেকে । রিসর্টে খোঁজ নিয়ে জানলাম সকাল এগারোটা চল্লিশে একটা বাস আছে যেটা সরাসরি বাঁকুড়া যায় । কিন্তু ১৭ই সেপ্টেম্বর বিশ্বকর্ম্মা পুজো - কাজেই বাস চলবে কিনা জানা নেই । তাই ঝুঁকি না নিয়ে ৮০০ টাকায় একটা অ্যাম্বাসাডর ঠিক করা হল যেটা আমাদের একেবারে বাঁকুড়া স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে আসবে । ঠিক হল আমরা সাড়ে এগারোটায় বেরোব ।

হিল্‌টপ থেকে ড্যাম
চানটান করে ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে নিয়ে রেডি হয়ে নিয়ে একটা জায়গায় গেলাম যেটা আমাদের দেখা বাকি ছিল । সেটা হচ্ছে সোনাঝুরির হিল্‌টপ । আগেই বলেছি সোনাঝুরি রিসর্টটা একটা পাহাড়ের গায়ে । এই পাহাড়ের মাথায় ওঠার একটা সিঁড়ি আছে । পাহাড়ের মাথায় যখন পৌঁছলাম তখন মুখ দিয়ে আপনা আপনিই বেরিয়ে পড়ল 'বাঃ !' সত্যিই, মুকুটমণিপুরে এসে এখানে না এলে পুরো ঘোরাটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায় ! সামনে কিছুদূরে ড্যামের পাঁচিল আর তার ওপারে বহুদূরবিস্তৃত বিপুল জলরাশি । একটা বিরাট জায়গা একসঙ্গে দেখা যায় এই হিল্‌টপ থেকে । যারা মুকুটমণিপুরে গেছে তারা হয়তো আমার সঙ্গে একমত হবে যে এটাই মুকুটমণিপুরে শ্রেষ্ঠ পাওনা !

এবার ঘরে ফেরার পালা । স্টেশনে পোঁছলাম তখন সাড়ে বারোটা । স্টেশনসংলগ্ন একটা দোকানে ভাতটাত খেয়ে নেওয়া হল । (এটার আর ডিটেল দিচ্ছি না, কারণ খাবারের মান স্টেশনসংলগ্ন দোকানে যেরকম হয়, সেরকমই) আমাদের ট্রেন আরণ্যক এক্সপ্রেসের সময় দু'টো পঁয়তাল্লিশ - তাই স্টেশনে অপেক্ষা করলাম । ট্রেন এল নির্ধারিত সময়ের দশমিনিট পরে । পৌনে সাতটায় সাঁত্রাগাছি আর সেখান থেকে বাড়ি !

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে খুব কাছে দু'দিনের ঘোরার এবং রিল্যাক্স করার জন্য একটা আদর্শ জায়গা মুকুটমণিপুর । ট্রেনে যাওয়ার সুবিধে থাকলেও ধর্ম্মতলা থেকে বাসে যাওয়া অনেক সহজসাধ্য ।
২. মুকুটমণিপুরে অল্প কিছু হোটেল থাকলেও থাকার জন্য সবথেকে উপযোগী হল ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্টের সোনাঝুরি রিসর্ট । বুকিং অফিস  ঃ 6A, Raja Subodh Mullick Square, 7th - Floor, Kolkata-700013 Phone No: 033-2237-0060/ 2237-0061/2225-8549. এছাড়া ওদের ওয়েবসাইট থেকেও সরাসরি বুকিং করা যেতে পারে ঃ http://www.wbfdc.com/.
৩. রিসর্টের খাওয়াদাওয়া অত্যন্ত ভালো এবং সস্তা । এদের রুমে খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা নেই - ডাইনিং এ গিয়ে খেয়ে আসতে হয় ।
৪. এখানে সাইট সিয়িং এর জায়গা বলতে পরেশনাথ পাহাড়, মোহনা, অম্বিকানগর আর ব্যারেজ । সাইট সিয়িং এর জন্য মোটর ভ্যান পাওয়া যায় আর চাইলে রিসর্ট থেকে গাড়িরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে ।
৫. কংসাবতী নদীতে নৌকো করে ঘোরা যেতে পারে । নৌভ্রমণের আদর্শ সময় বিকেলবেলা ।
৬. ড্যামে যাওয়ার রাস্তায় কিছু দোকান আছে - এখান থেকে টুকিটাকি জিনিস কেনা যেতে পারে ।
৭. মুকুটমণিপুরে যাওয়ার জন্য ৬ - ৮ জনের গ্রুপ হচ্ছে সবচেয়ে ভালো - সেক্ষেত্রে মাথাপিছু ভ্যান বা নৌকোভাড়াটা অনেক কমে যাবে ।

উপসংহারঃ

মুকুটমণিপুর
পাহাড় আর জলের সহাবস্থানই হল মুকুটমণিপুরের প্রধান আকর্ষণ । শহরের কোলাহল, দূষণ আর যান্ত্রিক পরিবেশ থেকে যেন অনেক দূরে একটা শান্ত নিরিবিলি জায়গায় অবস্থিত এই ভ্রমণকেন্দ্রটি । এখানে খুব বেশি মানুষও বাস করে না আর ট্যুরিজ্‌ম্‌ এদের প্রধান জীবিকাও নয় । তাই কেউ চাইলে নিজের মতো করে জায়গাটা উপভোগ করতে পারে । এখানে বেড়ানোর সব উপকরণই বর্তমান, শুধু নেই বেড়াতে গিয়ে নিয়মের বেড়াজাল । মুকুটমণিপুরের আকর্ষণ থেকে এ'কথা বলাই যায় যে - প্রকৃতিপ্রেমী এবং ভ্রমণপিপাসু মানুষদের দু'ভাগে ভাগ করা যায় । এক, যারা মুকুটমণিপুরে গেছে আর দু'ই যারা মুকুটমণিপুরে যাবে !

মুকুটমণিপুরের আরও ছবি দেখতে হলে click here:

Friday, June 7, 2013

শিলং ভ্রমণ

'প্যারাডাইস্‌ আনএক্সপ্লোর্ড' কাকে বলে ? আমরা অনেকেই জানি না এর দ্বারা ভারতের নর্থ-ইস্টের সাতটা রাজ্যকে বোঝায় । সেই সাতটা রাজ্য যাদের নাম চট্‌ করে বলতে গেলে একটা-দু'টো বাদ চলে যায় । সেই সাতটা রাজ্য আমাদের কাছে যাদের অস্তিত্ব শুধু জঙ্গী হামলার খবরে । সেই সাতটা রাজ্যের দু'টোতে আমাদের এবারের ভ্রমণ - মেঘালয়ের শিলং আর আসামের গুয়াহাটি ।

গুয়াহাটী যাওয়ার পথে
১লা জুন, ২০১৩ - শনিবার । হাওড়া স্টেশন থেকে সরাইঘাট এক্সপ্রেস । শিলং পর্যন্ত ট্রেন যায় না, সবচেয়ে কাছের রেলস্টেশন গুয়াহাটি । হাওড়া বা কলকাতা থেকে গুয়াহাটি যাওয়ার সবথেকে ভালো ট্রেন সরাইঘাট এক্সপ্রেস । ছাড়ে দুপুর ৩ : ৫০ এ । আমি, আমার স্ত্রী, বাবা, মা, আমার বড়মাসি আর মেসোমশাই । ছ'জন থাকায় আমরা ট্রেনের একটা ছ'জনের জায়গার পুরোটাই পেয়েছিলাম । এরকম একটা জায়গায় হৈ হৈ করতে করতে যাওয়ার মজাই আলাদা ! গুয়াহাটি যাওয়ার পথটা কিন্তু খুব অন্যরকম । নিউ কোচবিহার পেরোনোর পর পথের দু'ধার জুড়ে মাঝে মাঝে পাহাড় । কখনও দূরে পাহাড়ের মাথায় মেঘ । রেললাইন কখনও মাটি থেকে অনেক ওপরে উঠে যাচ্ছে, কখনও সমতলে নেমে আসছে । মাঝে মাঝেই হিমালয় থেকে নেমে আসা নদীগুলো পায়ের নিচ দিয়ে চলে যাচ্ছে ।

ব্রহ্মপুত্রের উপর নরনারায়ণ সেতু
গুয়াহাটী যাওয়ার পথে একটা প্রধান আকর্ষণ হল ব্রহ্মপুত্রের ওপর দিয়ে রেলব্রীজ । এই ব্রীজের নাম নরনারায়ণ সেতু । ২.২ কিলোমিটার চওড়া এই ব্রীজের ওপর দিয়ে যখন ট্রেন যায় তখন নিচের ব্রহ্মপুত্রকে দেখতে অসাধারণ লাগে । এই ব্রীজের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল এটা ডাবল্‌ - ডেক ব্রীজ অর্থাৎ রেল ও সড়ক দু'রকম পরিবহনের ব্যবস্থা আছে ।


গুয়াহাটী স্টেশন
আমরা গুয়াহাটি পৌঁছলাম সকাল ন'টা নাগাদ । স্টেশন থেকে বেরিয়েই সামনে গাড়ির স্ট্যান্ড - এখান থেকে আসাম বা মেঘালয়ের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার জন্য গাড়ি পাওয়া যায় । শিলং যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়াও করা যেতে পারে অথবা শেয়ারেও যাওয়া যেতে পারে । আমরা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বাসের খোঁজ করে জানলাম ওই সময়ে ওখান থেকে শিলং-এর কোনও বাস নেই । আমরা একটা শেয়ারের সুমো নিলাম । মাথাপিছু পড়ল ১৭০/- ।

গাড়িতে শিলং যাওয়ার পথে
পশ্চিমবঙ্গ বা সিকিমের কোথাও বেড়াতে গেলে আমরা সাধারণতঃ ট্রেন থেকে নেমে আরও উত্তর দিকে এগিয়ে যাই । শিলং কিন্তু গুয়াহাটির দক্ষিণে । কাজেই, এখানে একটা আন-কনভেনশনাল ব্যাপার আছে । গুয়াহাটি থেকে শিলং-এর ১০৫ কিলোমিটার রাস্তা এমনিও খুব সুন্দর । আমি এর আগে পাহাড়ী রাস্তা যেরকম দেখেছি এই রাস্তাটা কিন্তু একেবারেই সেরকম নয় । প্রথমতঃ অনেকটা পর্যন্ত রাস্তাটা ডাবল্‌ওয়ে । রাস্তার দু'দিকের প্রকৃতি অত্যন্ত মনোরম । একেবারে শেষ অংশটা বাদ দিলে প্রায় কোথাওই রাস্তার একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে খাদ - এই চিরাচরিত ব্যাপারটা নেই ।

পুলিশ বাজার @ শিলং
আমাদের গাড়ি ছেড়েছিল সাড়ে দশটায় আর আমরা শিলং পৌঁছলাম দেড়টার একটু পরে । শিলং শহরের প্রাণকেন্দ্র বলা যেতে পারে পুলিশবাজার - এখানে প্রচুর হোটেল আছে । লোকজনকে জিজ্ঞেস করে আমরা আমাদের 'হিল স্টার হোটেল'- এ পৌঁছে গেলাম । আমাদের একটা টু-বেড আর একটা ফোর বেড রুম বুক করা ছিল । ভাড়া যথাক্রমে ৭০০/- ও ১,২০০/- ঘরগুলো দারুণ কিছু নয়, তবে দিব্যি থাকা যায় । ঘরে টিভি আর বাথরুমে গিজার আছে । হোটেলে পোঁছে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে নিলাম । হিল স্টার হোটেলের খাবার বেশ উন্নতমানের এবং দাম বেশ কম । ছ'জনের মিলিয়ে আমাদের পড়ল মোট ৫৩০/- ।

শিলং শহর - হোটেলের ব্যালকনি থেকে
প্রথমদিন কোথাও ঘোরার নেই - বিকেলে বেরোলাম পরেরদিনের ঘোরাঘুরির ব্যবস্থা করতে । শিলং থেকে যাওয়ার জায়গা বলতে প্রধানতঃ চেরাপুঞ্জি - এছাড়া নারটিয়াং-ও যাওয়া যেতে পারে । এর সঙ্গে আছে শিলং-এর লোক্যাল সাইটসিয়িং । ঘোরাঘুরির জন্য সবথেকে ভালো ব্যবস্থা হচ্ছে এম টি ডি সি-র (মেঘালয় ট্যুরিজম্‌ ডেভেলপ্‌মেন্ট কর্পোরেশন) বাস । পুলিশ বাজারেই এম টি ডি সি-র অফিস, এখান থেকে বিভিন্নদিন ঘোরাঘুরির জন্য বাসের টিকিট পাওয়া যায় । বড় গ্রুপ থাকলে এদের কাছ থেকে গাড়ি বা বাস বুকিং-ও করা যেতে পারে । আমরা পরেরদিন অর্থাৎ সোমবার চেরাপুঞ্জি যাওয়া আর মঙ্গলবার লোক্যাল সাইটসিয়িং করা ঠিক করলাম । চেরাপুঞ্জির জন্য টিকিটের দাম মাথাপিছু ২৩০/- আর লোক্যাল এর জন্য মাথাপিছু ২০০/- সবমিলিয়ে আমাদের পড়ল ২,৫৮০/- যেটা যথেষ্টই কম । পরে খোঁজ নিয়ে দেখেছিলাম যে নিজেরা গাড়ি ভাড়া করে এই ঘোরাঘুরি করতে গেলে আমাদের ৫,০০০/- পড়ে যেত ।

রাতের শিলং - হোটেলের ব্যালকনি থেকে
শিলং কিছুটা হলেও গন্ডগোলের জায়গা - চেনাজানা অনেকেই আমাদের সাবধান করে দিয়েছিল যে সন্ধ্যে সাতটার পরে যেন আর রাস্তায় না থাকি । আমাদের ফিরতে ফিরতে সাতটা বেজে গেল । খেয়াল করলাম এর মধ্যেই রাস্তায় লোকচলাচল কমে গেছে আর দোকানগুলোর অনেকগুলোই বন্ধ হয়ে গেছে । শিলং-এ সবথেকে বেশি যেটা চোখে পড়ে সেটা হচ্ছে রাস্তায় পুলিশ আর মিলিটারির লোকের আধিক্য । কলকাতায় বনধ্এর দিন বা পুজোর দিনে যেরকম পুলিশ প্রশাসনের লোক দেখতে পাওয়া যায়, শিলং-এ সবসময়েই তত পুলিশ থাকে । রাতে আমরা হোটেল থেকেই খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম ।

৩রা জুন, ২০১৩ - সোমবার । চেরাপুঞ্জি যাওয়ার জন্য এম টি ডি সি-র অফিসে রিপোর্টিং টাইম সকাল ৭:৪৫ আর বাস ছাড়ে ঠিক আটটায় । চেরাপুঞ্জি ট্রিপে এম টি ডি সি মোট আটটা জায়গায় ঘোরায় ।  পাহাড়ী পথে ওঠানামার মধ্যে দিয়ে ঘন্টাখানেক চলার পৌঁছলাম আমাদের প্রথম গন্তব্যে ।

(এখানে বলে রাখি, আমরা যে জায়গাগুলোয় ঘুরেছি, সেগুলোর নামের ইংরিজী বানানই আমার জানা আছে । বাংলা বানান লিখতে গেলে কিছু কিছু জায়গায় উচ্চারণগত ত্রুটির সম্ভাবনা আছে । এই ত্রুটি তোমার ক্ষমা করার কোনও দরকার নেই কারণ আমি ক্ষমা চাইছি না ।)

মাওক্‌ডক্‌ ভ্যালি
প্রথম দ্রষ্টব্যঃ মাওক্‌ডক্‌ ভ্যালি
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ১৫ মিনিট
টিকিটঃ লাগে না
এখানে পাহাড়ের গা বেয়ে সিঁড়ি বেয়ে বেশ কিছুটা নামতে হয় । নিচে নেমে রেলিং দিয়ে ঘেরা একটা চওড়া প্ল্যাটফর্ম আছে, সেখান থেকে দু'পাশের পাহাড়ের মাঝের জায়গাটা দেখতে খুব সুন্দর লাগে । এছাড়া সিঁড়ি  দিয়ে নামার সময়ে একটা ছোট্ট পাহাড়ী নদী দেখতে পাওয়া যায় । পুরোটা নামতে প্রায় পঞ্চাশটার মতো সিঁড়ি ভাঙতে হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সেটা পুষিয়ে দেয় ।

বাস যেখানে দাঁড়ায় সেখানে কিছু ছোট খাবারের দোকান আছে । সকালে ব্রেকফাস্ট না করা থাকলে এখানে মোমো, ডিমসেদ্ধ, চা খেয়ে নেওয়া যেতে পারে ।

ইকো পার্ক
দ্বিতীয় গন্তব্যঃ ইকো পার্ক
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ২০ মিনিট
টিকিটঃ মাথাপিছু ১০/-, ক্যামেরা ১৫/-
এখানেও কিছুটা সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়, তবে সিঁড়ির সংখ্যা বড়জোর ১৫ টা । নিচে নেমে একটা বিরাট সমতল জায়গা, সেখান দিয়ে একটা জলের ধারা গড়িয়ে পাহাড় থেকে বহুনীচে পড়ে যাচ্ছে । জায়গাটায় বেশ মেঘ ছিল আর দৃশ্য খুবই সুন্দর । ভালো করে দেখতে গেলে এই জায়গাটা কিছুতেই ২০ মিনিটে দেখে ফেলা সম্ভব নয়, কিছুটা বেশি সময় লাগবেই । তবে দেরি হলে বারবার হর্ণ দেওয়া ছাড়া বাস আর কিছু করে না !

মাওস্‌মাই কেভের ভেতরে
তৃতীয় গন্তব্যঃ মাওস্‌মাই কেভ
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ৩০ মিনিট
টিকিটঃ মাথাপিছু ১০/-, ক্যামেরা ১৫/-
চেরাপুঞ্জির সাইট সিয়িং-এর সবচেয়ে সুন্দর আর আকর্ষণীয় জায়গা ! যদি শরীর আর মনের জোর থাকে, তাহলে এই জায়গাটা দেখা অবশ্য কর্তব্য । পাহাড়ের মধ্যে একটা অসাধারণ সুন্দর প্রাকৃতিক গুহা যার ভেতরে স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইট । ভেতরে পুরোটাই বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করা আছে, কাজেই অন্ধকারে হাতড়ানোর কোনও ব্যাপার নেই । ভেতরের পথ কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু, কোথাও মাথা সোজা করে হাঁটতে হয়, কোথাও মাথা নিচু করে আবার কোথাও একেবারে হামাগুড়ি দিয়ে । একটা বিশেষ জায়গা আছে যেখান দিয়ে গলার পথটা এতটাই ছোট যে মনে হয় বোধহয় মোটা মানুষ গলতে পারবে না । কিন্তু শরীর ভাঁজ করে, মাথা আর পা আগুপিছু করে ঠিক গলে যাওয়া যায় । ভেতরে জুতো খুলে যাওয়াই ভালো কারণ অনেক জায়গাতেই গোড়ালিডোবা জল আছে । তাছাড়া জুতো পরে ভিজে পাথরের মধ্যে হাঁটতে গেলে পা হড়কানোর সম্ভাবনাও থাকবে ।

গুহাটা সবমিলিয়ে ১৫০ মিটার মতো লম্বা । পাথরের ওপর পা ফেলে, মাথায় পাথরের গুঁতো খেয়ে আর ভেতরের অসাধারণ দৃশ্য দেখতে দেখতে এই পথচলাটা - লাইফটাইম্‌ এক্সপেরিয়েন্স !

(বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ - কিছু লোক থাকে যারা প্রাকৃতিক আর কৃত্রিম জিনিসের মধ্যে কোনও ফারাক খুঁজে পায় না । যেমন আমাদের বাসে থাকা একজন ভদ্রলোককে বলতে শুনলাম "এ আর এমন কি, আমাদের কলকাতার নিক্কো পার্কেও এরকম আছে ।" তোমার মানসিকতা যদি এরকম হয়, তাহলে মাওস্‌মাই কেভ কিন্তু তোমার জন্য নয় !)

এই অঞ্চলে কিছু খাবারের দোকান ছাড়াও কিছু জিনিসপত্রের দোকানও আছে ।

সেভেন সিস্টার ফল্‌স্‌
চতুর্থ গন্তব্যঃ নসঙ্গিথিয়াং ফল্‌স্‌ (সেভেন সিস্টার ফল্‌স্‌ )
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ১০ মিনিট
টিকিটঃ লাগে না
পাহাড়ের ধারে একটা রেলিং দিয়ে ঘেরা জায়গা যেখান থেকে অন্য একটা পাহাড়ের গায়ের পাশাপাশি সাতটা ঝর্ণা দেখতে পাওয়া যায় । গুনলে সাতের বেশিই হবে, আর কোন সাতটা একই মায়ের সন্তান সেটা বোঝার কোনও উপায় নেই । তবে দৃশ্যটা সবমিলিয়ে বেশি সুন্দর ।

বাংলাদেশ !
পঞ্চম গন্তব্যঃ মাও ট্রপ্‌
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ১৫ মিনিট
টিকিটঃ লাগে না
এটা চেরাপুঞ্জির আরেকটা আকর্ষণীয় জায়গা । এখানে পাহাড়ের ওপরে একটা রেলিং ঘেরা জায়গা থেকে নিচে বাংলাদেশ দেখা যায় । দৃশ্যটা যে খুব স্পষ্ট তা নয়, কারণ জায়গাটা কিছুটা মেঘাচ্ছন্ন, আর সোজাসুজি দেখা গেলেও দূরত্বটা নেহাৎ কম নয় । আমরা পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে আছি, নিচে যতদূর চোখ যায় নদীনালা ঘেরা সমতলভূমি - বাংলাদেশ । 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' (এটা এমনি লিখলাম, অতকিছুও ইমোশনাল হয়ে পড়িনি !)

থাঙ্খারাং পার্ক
ষষ্ঠ গন্তব্যঃ থাঙ্খারাং পার্ক
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ২০ মিনিট
টিকিটঃ মাথাপিছু ৫/-, ক্যামেরা ১০/-
এটা একটা বটানিক্যাল গার্ডেন ধরনের জায়গা । অনেকরকম গাছ আছে, তবে ফুলগাছের সংখ্যাই বেশি । এখান থেকে অন্য একটা পাহাড়ের গায়ে একটা ঝর্ণা দেখতে পাওয়া যায় আর তার সঙ্গে দেখা যায় - বাংলাদেশ । 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' (এবারও এমনিই লিখলাম !)

রামকৃষ্ণ মিশন
সপ্তম গন্তব্যঃ রামকৃষ্ণ মিশন
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ২০ মিনিট
টিকিটঃ লাগে না
রামকৃষ্ণ মিশন আলাদা করে দেখার কিছু নেই, বিশেষ করে তাদের কাছে যারা বেলুড় মঠ, ব্যারাকপুর বা নরেন্দ্রপুর দেখেছে । তবে ভেতরে একটা মিউজিয়াম আছে যেটায় মেঘালয়ের মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের উৎসব-অনুষ্ঠানের কিছু মডেল রাখা আছে । এছাড়া এখানকার পাহাড়ী অধিবাসী গারো, খাসী, জয়ন্তিয়াদের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের একটা সংগ্রহশালা গোছেরও আছে ।

নোয়াকালিকাই ফল্‌স্‌ দেখার জায়গা - মেঘে ঢাকা
অষ্টম গন্তব্যঃ নোয়াকালিকাই ফল্‌স্‌
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ কমপক্ষে ১ ঘন্টা
টিকিটঃ মাথাপিছু ১০/-, ক্যামেরা ২০/-
এখানে বাস বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর একটা বড় কারণ হচ্ছে এখানেই দুপুরের খাওয়া সারতে হবে । এখানে দু'টো ভাতের হোটেল আছে, যেখানে ভাত-ডাল-তরকারি-মাছ-ডিম-মাংস সবই পাওয়া যায় । মান খুব একটা উন্নত নয়, কিন্তু এখানে এ'ছাড়া আর কোনও ব্যবস্থা নেই । বলা বাহুল্য, আমরা এখানেই দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম । খরচ পড়ল ৪৮০/-।

এরপর ফল্‌স্‌ দেখতে গেলাম । একেবারেই কিছু দেখা গেল না কারণ পুরো জায়গাটাই মেঘে ঢাকা । জায়গাটা কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে চলে এলাম ।

চেরাপুঞ্জি থেকে ফেরার পথে
ছোটবেলায় ভূগোল বই পড়ে চেরাপুঞ্জির সম্পর্কে আমাদের সকলেরই একটা ধারণা থাকে যে এখানে সারাবছরই বৃষ্টি হয় । কথাটা ভুল নয়, কিন্তু সারাবছর বৃষ্টি হয় এর মানে এই নয় যে ৩৬৫ X ২৪ ঘন্টাই বৃষ্টি হয় । আমরা চেরাপুঞ্জিতে যতক্ষণ ছিলাম তার মধ্যে একফোঁটাও বৃষ্টি পাইনি ।




চেরাপুঞ্জি ভ্রমণ শেষ - আমরা শিলং ফিরলাম তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে । কিছু খাবারদাবার কিনে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম । রাতে যথারীতি হোটেলেই খাওয়া হল । ৩৬০/- ।

৪ঠা  জুন, ২০১৩ - মঙ্গলবার । আমাদের শিলং সাইট সিয়িং করার দিন । এম টি ডি সি-র অফিসে আমাদের রিপোর্টিং টাইম সকাল ৮:১৫, তাই এই ফাঁকে আমরা একটা কাজ করে নিলাম । পরেরদিন আমাদের শিলং থেকে গুয়াহাটী ফেরার কথা, তাই আমরা গেলাম এম এস টি সি (মেঘালয় স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন) এর অফিসে । এটা এম টি ডি সি-র অফিসের ঠিক উল্টোদিকে । সেখানে গিয়ে জানা গেল শিলং থেকে গুয়াহাটী যাওয়ার জন্য আপাতত এম এস টি সি-র কোনও বাস নেই, আমরা যেন পরেরদিন সকালে গিয়ে খোঁজ নিই । এই অনিশ্চিতের ভরসায় থাকা মুস্কিল তাই আমরা এ এস টি সি-র (আসাম স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন) কাউন্টারে গেলাম, যেটা একই জায়গায় । সৌভাগ্যক্রমে এখান থেকে পরেরদিন গুয়াহাটী যাওয়ার বাসের টিকিট পাওয়া গেল । ভাড়া ১১০/- করে । বাস ছাড়ার সময় সকাল আটটা ।

এরপর এম টি ডি সি-র বাসে করে আমরা শিলং ঘুরতে বেরোলাম । আমাদের মোট সাতটা জায়গা দেখার আছে ।

লেডী হায়দারি পার্ক
প্রথম গন্তব্যঃ লেডী হায়দারি পার্ক
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ১৫ মিনিট
টিকিটঃ মাথাপিছু ৫/-, ক্যামেরা ১৫/-
একটা বেশ বড় পার্ক যার মধ্যে সুন্দর গার্ডেনিং এবং ফুলগাছ ছাড়াও আছে একটা মিনি চিড়িয়াখানা । সেখানে হরিণ ভাল্লুক বাঁদর সজারু ইত্যাদি আছে । পাখিদের মধ্যে আছে পেঁচা বাজ শালিক ঈগল্‌ ।


ক্যাথিড্রাল চার্চ
দ্বিতীয় গন্তব্যঃ ক্যাথিড্রাল চার্চ
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ১০ মিনিট
টিকিটঃ লাগে না
এই চার্চের বৈশিষ্ট্য হল এটা শিলং-এর সবথেকে বড় চার্চ । চার্চটা খুবই পরিষ্কার - সাধারণতঃ যেরকম হয় । চার্চটা রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা ওপরে - একটা অর্ধ-চন্দ্রাকার সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরের প্রার্থনাগৃহে যেতে হয় ।


এলিফ্যান্ট ফল্‌স্‌
তৃতীয় গন্তব্যঃ এলিফ্যান্ট ফল্‌স্‌
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ৩০ মিনিট
টিকিটঃ মাথাপিছু ১০/-, ক্যামেরা ২০/-
মাওস্‌মাই কেভ যেমন চেরাপুঞ্জির সবথেকে বড় আকর্ষণ ঠিক তেমনই শিলং-এর সবথেকে বড় আকর্ষণ হল এলিফ্যান্ট ফল্‌স্‌ । এই ফল্‌স্‌ না দেখলে শিলং ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে । পাহাড়ের গা বেয়ে একটা ঝর্ণা নেমে আসছে - পাহাড়ের ধাপে ধাপে তিনটে জায়গা থেকে সেটা ভালোভাবে দেখা যায় । এগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে ফার্স্ট ফল্‌স্‌, সেকেন্ড ফল্‌স্‌ আর থার্ড ফল্‌স্‌ । অদ্ভুত সুন্দর ! থার্ড ফল্‌স্‌ পর্যন্ত পৌঁছতে ৫০ টা মতো সিঁড়ি ভাঙতে হয়, তবে ভাঙাটা সার্থক । একেবারে নিচে দাঁড়িয়ে এলিফ্যান্ট ফল্‌সের যা সৌন্দর্য্য, তা নিজের চোখে না দেখলে জীবনে কিছু অদেখা থেকে যায় । 'ঝর্ণা ঝরঝরিয়ে জল ছড়িয়ে যেন নেচে নেচে যায়' (এবারে সত্যিই ইমোশনাল হয়ে পড়েছি !) ।

স্থানীয় পোষাকে অমৃতা
এলিফ্যান্ট ফল্‌স্‌ এর কাছে একটা লোক্যাল পোষাক পরে ছবি তোলার ব্যবস্থা আছে - মুলতঃ মেয়েরাই এগুলো করে থাকে । আমার স্ত্রী একবার পরলেন ।















এখানে চা-টা খেয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা আছে । আর আছে কিছু জিনিসপত্রের দোকান ।

মেঘে ঢাকা তারা মেঘালয় @ শিলং পীক
চতুর্থ গন্তব্যঃ শিলং পীক্‌
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ২০ মিনিট
টিকিটঃ মাথাপিছু ২০/-, ক্যামেরা ২০/-
শিলং-এর সবথেকে উঁচু জায়গা । এখান থেকে পুরো শিলং শহরটা দেখা যায় । কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা কিছুই দেখতে পেলাম না কারণ চারপাশটা সম্পূর্ণভাবে মেঘে ঢেকে গেল । একেবারে নিশ্ছিদ্র মেঘ - কোনও ফাঁক দিয়েই শিলং এর কোনও কোণাও দেখা গেল না ।


এখানেও কিছু খাবারের এবং জিনিসপত্রের দোকান আছে ।

বড়াপানি
পঞ্চম গন্তব্যঃ বড়াপানি (উমিয়াম লেক)
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ৪০ মিনিট
টিকিটঃ মাথাপিছু ২০/-, ক্যামেরা ৬০/-
পাহাড়ের মাঝখানে বৃষ্টির জলে পুষ্ট একটা লেক । তবে এটা কিছুটা হলেও কৃত্রিম কারণ লেকের একদিকে  বাঁধ দিয়ে এই জলকে ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে । বড়াপানির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য খুবই সুন্দর - বিরাট বড় লেকের মাঝে একটা পাহাড়ও আছে । এটার নাম লাংপেংডং । এখানে বোটিং এর ব্যবস্থাও রয়েছে - স্পীডবোটে করে পুরো লেকটা ঘোরানো হয় । বড়াপানিতে বাস বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর একটা বড় কারণ হল এখানে বাস থেকে নেমে বেশ কিছুটা ঢালুপথে নেমে যেতে হয় । ফেরার সময়ে স্বভাবতই বেশি সময় লাগে  ।

এখানে একটা ছোট খাবারের দোকান আছে, সেখানে চা কফি বা সামান্য স্ন্যাক্স খেয়ে নেওয়া যেতে পারে ।

গল্‌ফ্‌ কোর্স
ষষ্ঠ গন্তব্যঃ গল্‌ফ্‌ কোর্স
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ১০ মিনিট
টিকিটঃ লাগে না
একটা সাধারণ গল্‌ফ্‌ কোর্স । যারা কলকাতারটা দেখেছে, তাদের বাস থেকে নামারও দরকার নেই । বিরাট একটা সবুজ ঘাসে মোড়া উঁচুনিচু মাঠ - ব্যস ।



স্টেট মিউজিয়াম
সপ্তম গন্তব্যঃ স্টেট মিউজিয়াম
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ২০ মিনিট
টিকিটঃ মাথাপিছু ৫/-, ক্যামেরা ১০/-
রামকৃষ্ণ মিশনের মিউজিয়ামটার একটা বড় ভার্শান হল স্টেট মিউজিয়াম । ভেতরে সবকিছুরই ছবি তোলা যেতে পারে । গারো, খাসী, জয়ন্তিয়া জাতীর মানুষের জীবনযাত্রার মডেল, অস্ত্রশস্ত্র, গয়নাগাটি, রান্নার উপকরণ, পোষাক-পরিচ্ছদের একটা সংগ্রহশালা হল স্টেট মিউজিয়াম ।

আমাদের সাইট সিয়িং শেষ - এরপর বাস আমাদের পুলিশ বাজারে নামিয়ে দিল । প্রায় বিকেল চারটে বাজে - আমাদের এখনও দুপুরের খাওয়া হয়নি । পুলিশ বাজারের একটা ভাতের হোটেলে ঢুকলাম । এটা কলকাতার একটা সাধারণ ভাতের হোটেলেরই মতো, রান্নার মানও তথৈবচ । মাত্র ২৭০/- সবার পেট ভরল (?) ।

পুলিশ বাজারের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড
হোটেল থেকে বেরোনোর সময়ে পেলাম সেই জিনিস - মেঘালয় যার জন্য বিখ্যাত । বৃষ্টি । আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু হল - এবং টানা এক ঘন্টা চলল । পাহাড়ে বৃষ্টির একটা সুবিধে হচ্ছে এখানে জল দাঁড়ায় না, কিছুক্ষণের মধ্যেই সব জল সরে গেল । আমরা হোটেলে ফিরলাম । এটা আমাদের শিলং- এর শেষ রাত্রি - পরেরদিন সকালেই আমরা গুয়াহাটীর চলে যাব । সে'জন্য সন্ধ্যেবেলা বেরিয়ে কিছু কেনাকাটা করে নেওয়া হল । শিলং থেকে কেনার জন্য সবথেকে ভালো জিনিস হল এখানকার বেত ও বাঁশের কাজের জিনিসপত্র । পুলিশবাজারে এসব জিনিসের বেশ কিছু দোকান আছে - আর এরা ট্যুরিস্টদের জন্য দাম সেই অর্থে কিছু বাড়িয়ে রাখে না ।

শিলং-এ আমাদের শেষ ডিনারও হোটেলেই করা হল । খরচ পড়ল ২০০/-।

৫ই জুন, ২০১৩ - বুধবার । আমাদের হোটেলে বিল আগেরদিন রাতেই মেটানো ছিল, তাই সকালে আমরা মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে সোজা বাসস্ট্যান্ডে চলে এলাম । বাস ছাড়ল প্রায় সাড়ে আটটা । কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা শিলং ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম । শিলং ভ্রমণ শেষ !

গুয়াহাটী পৌঁছলাম তখন প্রায় দুপুর একটা । গুয়াহাটীতে আমাদের মেয়াদ একরাত্রি, তাই কোনও হোটেল বুকিং করা ছিল না । এবং এর কোনও প্রয়োজনও নেই কারণ গুয়াহাটীতে প্রচুর হোটেল আছে । তবে যেহেতু আমরা মাত্র চব্বিশ ঘন্টা গুয়াহাটীতে থাকছি, আমার মেসোমশাই বললেন - আমাদের আরেকটা অপশনও আছে, সেটা হল রেলওয়ে রিটায়ারিং রুম । স্টেশনের চীফ টিকিট চেকারের এই ঘর অ্যালট্‌ করার ক্ষমতা থাকে, তিনি তাঁর বেয়ারার কাছে আমাদের পাঠিয়ে দিলেন । আমরা একটা পাঁচবেডের রুম পেলাম - ভাড়া ৪৪০/- ('খুশি করার ট্যাক্স' সমেত আমাদের পড়ল ৬৫০/-) আমরা রেলওয়ে থেকে এর বিলও পেলাম । রুমের কন্ডিশন যথেষ্ট ভালো - দু'টো অ্যাটাচ্‌ড্‌ বাথরুম সমেত ঘরটা যথেষ্ট বড় । ফ্রেশ হয়ে নিয়ে আমরা রেলওয়ে ক্যান্টিনে খেয়ে নিলাম । ৪০৮/- পড়ল ।

এরপর গেলাম গুয়াহাটীতে আমাদের একমাত্র দেখার জায়গা দেখতে - কামাখ্যা মন্দির । আমরা যেহেতু স্টেশনেই ছিলাম তাই স্টেশনের লাগোয়া গাড়ি বা অটোর স্ট্যান্ডটা আমাদের খুবই কাছে ছিল । সেখান থেকে ৩২০/- দু'টো অটো ভাড়া করে কামাখ্যা মন্দিরে যাওয়া হল । যাওয়ার রাস্তাটা খুবই সুন্দর - বেশ কিছুটা ব্রহ্মপুত্রের পাশ দিয়ে । যেতে আধঘন্টা মতো লাগে ।

কামাখ্যা মন্দির
কামাখ্যা মন্দির ভারতের ৫১ পীঠের মধ্যে অন্যতম - তবে আর পাঁচটা সাধারণ হিন্দু মন্দিরের মতোই । পান্ডা আছে, তবে পান্ডাদের বাড়াবাড়িটা খুব বেশি নেই । মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকতে গেলে অবশ্য দীর্ঘ লাইন দিতে হয় । ফ্রি, ১০১/- র ৫০১/- এই তিনরকমের লাইন হয় । গর্ভগৃহে না ঢুকেও মন্দিরের চত্বরটায় ঘোরাঘুরি করতে অবশ্য ভালোই লাগে । কামাখ্যা মন্দিরে পাঁঠা ছাড়া পায়রাও বলি দেওয়া হয় - বলির আগের সেইসব প্রাণীগুলোকে এখানে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায় ।

মন্দিরের চত্বরের মধ্যে একটা 'রেন ওয়াটার হার্ভেস্টেশন প্রজেক্ট' আছে - সেটাকে মন্দিরের লোকজন অনায়াসে 'সৌভাগ্যকুন্ড' নাম দিয়ে দিয়েছে । সেখানে একটা ছোট মন্দির তৈরি করে অনায়াসে ইনকাম্‌ (পড় বুজরুকি) চলছে !

মন্দিরের বাইরে যথারীতি জিনিসপত্রের দোকান আছে । আমরা এখান থেকে লোকজনকে উপহার দেওয়ার জন্য কিছু জিনিস কিনে নিলাম ।

ফেরার পথে আমরা ২৫০/- টাকায় একটা মারুতি ওম্‌নি ভাড়া করলাম যেটা আমাদের স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিল । আমরা তক্ষুণি রুমে না এসে লাইন পেরিয়ে গুয়াহাটীর পল্টনবাজারে একটু ঘোরাঘুরি করলাম । আমাদের ভ্রমণের 'অদ্যই অন্তিম রজনী' - আমার নিয়ম অনুযায়ী আমরা এইদিনের ডিনারটা একটু স্পেশাল করি । স্টেশনের একেবারে কাছেই একটা বেশ ঝাঁ-চক্‌চকে রেস্ট্যুরেন্ট ছিল - নাম 'পুদিনা' - এখান থেকে ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন মাঞ্চুরিয়ান নিয়ে নেওয়া হল । দাম পড়ল ৮৩০/- ।

ব্রহ্মপুত্রের তীরে
৬ই জুন, ২০১৩ - বৃহস্পতিবার । আগেরদিন বিকেলে কামাখ্যা যাওয়ার সময়ে দেখেছিলাম স্টেশন থেকে ব্রহ্মপুত্রটা বেশি দূরে নয়, তাই আমি সকালে বেরোলাম জায়গাটা এক্সপ্লোর করতে । সকালে হেঁটে বেড়াতে বেশ ভালোই লাগছিল । ব্রহ্মপুত্রের ধারে কিছুক্ষণ ঘুরে ঘন্টাখানেক পরে আবার রুমে ফিরে এলাম ।



আমাদের ট্রেন দুপুর ১২:৪৫ এ - আর আমরা আছি রেলওয়ে রিটায়ারিং রুমে - তাই কোনও তাড়াহুড়ো নেই । ধীরেসুস্থে ফাইনাল প্যাকিং সেরে রেলওয়ে ক্যান্টিনে লাঞ্চ করে নিলাম । তখন দেখলাম ট্রেন এসে গেছে । তারপর রুমে গিয়ে মাল নিয়ে সবাই মিলে ট্রেনে উঠে বসলাম । কাঁটায় কাঁটায় ১২:৪৫ এ সরাইঘাট এক্সপ্রেস হাওড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হল ।

ফেরার পথে ব্রহ্মপুত্রকে দেখতে আরও সুন্দর লাগল । যাওয়ার সময়ে কিছুটা মেঘ ছিল - ফেরার সময়ে একেবারে পরিষ্কার । ব্রহ্মপুত্র ছাড়াও ফেরার পথে দূরে পাহাড়ের গায়ে মেঘের দৃশ্যও খুব চিত্তাকর্ষক । যতক্ষণ আকাশে আলো ছিল, দু'চোখ ভরে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখলাম ।

পরেরদিন হাওড়া পোঁছলাম সকাল ছ'টায় - প্রায় একঘন্টা লেটে । আটটায় বাড়ি !

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে ৪ - ৫ দিনের ঘুরতে যাওয়ার জায়গা হিসেবে শিলং একটা খুব ভালো অপশন । এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য পর্যটককে মুগ্ধ করবেই ।
২. শিলং যাওয়ার সবথেকে ভালো সময় হচ্ছে বর্ষার শুরু - যে সময়ে আমরা গেছিলাম । এই সময়ে এখানে প্রকৃতি সবথেকে বেশি ঝকঝকে থাকে ।
৩. যদিও আমরা শিলং-এ বেশি বৃষ্টি পাইনি, তবুও শিলং গেলে প্রত্যেকেরই সঙ্গে একটা করে ছাতা নিয়ে যাওয়া উচিৎ ।
৪. শিলং-এ তিনটে গোটা দিন থাকাই ভালো - চেরাপুঞ্জি, নারটিয়াং আর লোকাল সাইট সিয়িং এর জন্য । যদি হাতে দু'দিন থাকে তাহলে নারটিয়াং-টা বাদ দেওয়া উচিৎ ।
৫. শিলং-এ ঘোরাঘুরির জন্য সবথেকে ভালো হল এম টি ডি সি-র বাস । কম খরচে এত ভালো ঘোরা অন্য কোনওভাবে সম্ভব নয় ।
৬. চেরাপুঞ্জির জায়গাটা খুব সুন্দর তবে এখানে থাকার কোনও মানে হয় না । চেরাপুঞ্জি ঘুরতে মোটামুটি ৫ - ৬ ঘন্টা লাগে যার মধ্যে 'মাওস্‌মাই কেভ' মাস্ট ওয়াচ্‌ ।
৭. শিলং-এর লোকাল সাইট সিয়িং এর মধ্যে এলিফ্যান্ট ফল্‌স্‌ ও বড়াপানি মাস্ট ওয়াচ্‌ । শরীর অনুমতি দিলে এলিফ্যান্ট ফল্‌সের তিনটে ফল্‌স্‌ই দেখা উচিৎ ।
৮. শিলং-এর প্রাণকেন্দ্র হল পুলিশবাজার - এখানে সবই পাওয়া যায় । এখানে অনেক হোটেলও আছে । কলকাতা থেকে হোটেল বুক করে গেলে সবসময়েই পুলিশবাজারর কোনও হোটেলে চেষ্টা করা উচিৎ ।
৯. শিলং-এর খুব কাছে আসাম হওয়া সত্ত্বেও এখানে চায়ের দাম খুব বেশি (১০ - ১৫/- প্রতি কাপ), তাই চা-প্রেমীদের টী-ব্যাগ বা নিজস্ব চায়ের সরঞ্জাম বহন করাই শ্রেয় ।
১০. শিলং কিছুটা গন্ডগোলের জায়গা তাই সন্ধ্যের পর রাস্তায় লোক চলাচল কমে গেলে হোটেলে ফিরে আসাই শ্রেয় ।
১১. গুয়াহাটীতে কামাখ্যা মন্দির একটা দেখার জায়গা । সেটা ছাড়া বালাজী মন্দিরও দেখতে যাওয়া যেতে পারে ।

উপসংহারঃ

ঘরে ফেরার পালা !
কম খরচে ৪ - ৫ দিনের বেড়ানোর প্ল্যান করলে শিলং-এর মতো জায়গা কমই আছে । মাথাপিছু মাত্র ৩,৭০০/- টাকায় আমাদের পুরো ঘোরা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে । এটা ঠিক যে আমরা সেরকম কোনও ভালো হোটেলে থাকিনি, সেরকম হাই-ক্লাস খাওয়াদাওয়াও করিনি । কিন্তু আমি বেড়াতে যাই বেড়ানোর জন্য, ভালো থাকা-খাওয়ার জন্য নয় । শিলং-চেরাপুঞ্জির অনন্যসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য পর্যটককে ভীষণভাবে আকর্শন করে । পশ্চিমবঙ্গ আর সিকিমের পাহাড়ে ঘুরতে ঘুরতে যাদের একঘেয়ে লাগে, তারা আসাম-মেঘালয়ের এই জায়গাগুলো ঘুরে আসতে পারে । ভারতবর্ষের নর্থ-ইস্টের এই 'প্যারাডাইজ আনএক্সপ্লোর্ড' কে এক্সপ্লোর জীবনে একবার অবশ্যই করা উচিৎ !

শিলং-এর আরও ছবি দেখতে হলে click here: