আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Monday, January 27, 2014

দার্জিলিঙ ভ্রমণ

গেই বলেছি, দী-পু-দা সম্পর্কে আমার ভ্রমণসর্বস্ব ব্লগ মূলতঃ নীরবতাই পালন করবে । সেই সূত্র ধরেই এবারের দার্জিলিঙ ভ্রমণ এক নাতিদীর্ঘ শুধুমাত্র তথ্যসমৃদ্ধ রচনায় পরিণত হতে চলেছে । ভাষার এই গাম্ভীর্য্যের কারণ ? সম্প্রতি আমার জনৈকা পাঠিকা আমাকে এক বাজারচলতি পত্রিকায় একটি ভ্রমণকাহিনী পড়িয়ে বলেছেন "তুমি এ'রকম ভাষায় লিখতে পারো না ?" বলা বাহুল্য, সে'ভাষা এরকমই অ-চলিত । একটা পূর্ণদৈর্ঘ্যের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতাকে এই ভাষায় মুখর করে তোলা আমার মতো অপটু লেখকের কাছে শুধু পরিশ্রমসাপেক্ষই নয়, ক্লান্তিকরও বটে - তাই এই সংক্ষিপ্ত রচনায় আমার এই 'ছোট্ট' প্রয়াস ।

যাওয়া ঃ ২২শে জানুয়ারী, ২০১৪ রাত ৯:৪০ - কলকাতা ডিব্রুগড় এক্সপ্রেস (সাপ্তাহিক ট্রেন) ।
ফেরা ঃ ২৬শে জানুয়ারী, ২০১৪ বিকেল ৫:৪০ - উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস ।

আমাদের দলে আমি, আমার স্ত্রী অমৃতা, তার কলিগ্‌ নন্দিনীদি, দীপঙ্করদা আর ওঁদের যমজ ছেলে সায়ক ও সৌনক ।

সারসংক্ষেপঃ

১. দার্জিলিঙ-এর মরশুম প্রধানতঃ মে-জুন মাস বা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস । সেই অর্থে জানুয়ারী মাস মন্দা-মরশুম । আর সেই কারণেই আমরা বিভিন্নরকম ক্ষেত্রে বেশ কিছু আর্থিক ছাড় পেয়েছি ।
২. আমরা নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন সংলগ্ন 'নিউ সিকিম ট্রাভেল' থেকে প্যাকেজ গাড়ি নিয়েছিলাম । এই গাড়ি আমাদের নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিঙ পৌঁছে দেওয়া, দার্জিলিঙ-এর আশপাশ ঘোরা আর দার্জিলিঙ থেকে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে দেওয়া - পুরোটার জন্য মোট ৬,৫০০ টাকা নিয়েছে ।
৩. আমরা ছিলাম 'বেলভিউ হোটেল'-এ । বেলভিউ দার্জিলিঙ এর সর্ব্বোত্তম হোটেলগুলোর মধ্যে অন্যতম । এখানকার যে ঘরগুলো মরশুমে ২,০০০ টাকা ভাড়া - সেগুলো আমরা পেয়েছি ১,৪০০ টাকায় । বেলভিউ হোটেলের ওয়েবসাইট http://www.bellevuehotel-darjeeling.com/ এবং ফোনে যোগাযোগ করার উপায় - Tashi Pulger - 9800667148.
৪. দার্জিলিঙ-এর আশেপাশে ঘোরার জন্য অনেকগুলো জায়গা থাকলেও মূলতঃ দেখার জায়গা টাইগার হিল, বাতাসিয়া লুপ, চিড়িয়াখানা আর রোপওয়ে । কোনও কারণেই এরমধ্যে কোনওটা বাদ দেওয়ার মানে হয় না ।
৫. আমার মতে দার্জিলিঙ-এর সবথেকে বড় আকর্ষণ দু'টো - টয়ট্রেন (দার্জিলিঙ-হিমালয়ান রেলওয়ে) আর ম্যাল । (কাঞ্চনজঙ্ঘা লিখলাম না, কারণ কাঞ্চনজঙ্ঘা দার্জিলিঙ ছাড়াও অন্য জায়গা থেকে দেখা যায়) এদের মধ্যে ম্যালে সবসময়েই যাওয়া যায়, কিন্তু সবসময়ে পাওয়া যায় না টয়ট্রেনের দেখা । আমরা সৌভাগ্যবান - আমরা ১৩৩ বছরের প্রাচীন এই ঐতিহ্যে সামিল হতে পেরেছি ।
৬. নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিঙ পর্যন্ত টয়ট্রেনের পরিশেবা বর্তমানে বন্ধ আছে - এখন দার্জিলিঙ থেকে কার্সিয়াং পর্যন্ত ট্রেনে যাওয়া যায় । এছাড়া দার্জিলিঙ-ঘুম-দার্জিলিঙ এ একটা ট্রেন চলে যার নাম জয় ট্রিপ । https://www.irctc.co.in/ থেকে দার্জিলিঙ-হিমালয়ান রেলওয়ের টিকিট কাটা যায় ।
৭. ম্যাল থেকে মিনিটসাতেকের হাঁটা পথে দার্জিলিঙ-এর এক বিখ্যাত রেস্ট্যুরেন্ট কেভেন্টার্স । এখানকার খাবার যে খুব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তা নয় - কেভেন্টার্সে পাওয়া যায় এরকম সব খাবারই অন্যান্য জায়গায় লভ্য । এখানকার মূল আকর্ষণ হল এর ছাদে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে খাবার খাওয়া । কেভেন্টার্স ১০০ বছরের পুরোনো দোকান এবং সত্যজিৎ রায়ের একাধিক লেখায় এর উল্লেখ পাওয়া যায় । 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' ছবির শ্যুটিং-এর সময়ে এখানে সত্যজিৎ রায় এসেছিলেন - সেই ছবি কেভেন্টার্সের দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে ।
৮. দার্জিলিঙ-এ দুপুরের বা রাতের খাওয়ার জন্য অনেক ছোটোখাটো হোটেল আছে, কিন্তু সবথেকে ভালো রেস্ট্যুরেন্ট হল - গ্লেনারিজ । ম্যাল থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা দূরত্বে এই রেস্ট্যুরেন্টের খাবার নিঃসন্দেহে খুব ভালো কিন্তু যেটা একেবারেই সন্তোষজনক নয় সেটা হল এদের পরিশেবা । এরা অর্ডার নিতে দেরি করে - আর সেই দেরি করার প্রথাটা বজায় রাখে একেবারে বিল দেওয়া পর্যন্ত ! মাঝখানের কথা আর নাই বা উল্লেখ করলাম ।

উপসংহারঃ

টয়ট্রেন থেকে দার্জিলিঙ শহর
বাংলার তথা ভারতের সবচেয়ে পুরনো শৈলশহরগুলো মধ্যে দার্জিলিঙ বিশেষ উল্লেখযোগ্য । দু'শো বছরের শাসনকালের মধ্যে ইংরেজরা ভারতে অনেক ভালো কাজও করেছিল - তাদের মধ্যে একটা হল এই পর্যটনকেন্দ্রটি নির্মাণ করা । ম্যাল অক্সফোর্ড টয়ট্রেন কেভেন্টার্স কাঞ্চনজঙ্ঘা - এইসব মিলিয়ে দার্জিলিঙের ঐতিহ্যগত গুরুত্ব অপরিসীম । দার্জিলিঙে যেতে হলে মরশুমে না যাওয়াই ভাল, তাতে অবাঞ্ছিত ভীড়ের কবলে পড়তে হয় না । পর্যটকের ভীড়, দোকানদারদের ডাকাডাকি, হোটেলওয়ালা আর গাড়িওয়ালাদের হাত ধরে টানাটানি সহ্য করার সহিষ্ণুতা যদি না থাকে তাহলে তাহলে ডিসেম্বর-জানুয়ারী হল দার্জিলিঙ যাওয়ার পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী সময় । যদি আয়েস করা উদ্দেশ্য হয় তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাত হাজার ফুটেরও বেশি ওপরে এই প্রাচীন শহরটি সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য অনবদ্য ভূমিকা পালন করবে - বিশ্বাস রাখি !

দার্জিলিঙের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

Thursday, January 2, 2014

মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ

ছোটবেলায় ইতিহাস বইতে পড়া বাংলার ইতিহাসের কথা বলতে গেলে সবচেয়ে বেশি করে কোন্‌ জায়গাটার কথা মনে পড়ে ? (আমার এই প্রশ্নের উত্তর 'মুর্শিদাবাদ'ই হবে যেহেতু এই লেখা 'মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ' সম্পর্কে । তা নাহলে গৌড়, নদীয়া, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর - এসবও হতে পারত !) হ্যাঁ, মুর্শিদাবাদ । মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে নবাব সিরাজ-উদ্‌-দৌলা পর্যন্ত বাংলার নবাবদের স্মৃতি যেখানে জড়িয়ে আছে, তাঁদের ব্যবহৃত সরঞ্জাম আর জীবনযাপনের ইয়ে যেখানে ছড়িয়ে আছে - সেই মুর্শিদাবাদ । নবাব পরবর্তী যুগের হাজারদুয়ারি যেখানে আছে - সেই মুর্শিদাবাদ । ইতিহাস যেখানে জীবন্ত হয়ে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ার মতো চলতে থাকে - সেই মুর্শিদাবাদ ।

মুর্শিদাবাদ স্টেশন
২০১৩ সালটা  ইতিহাস হয়ে যাওয়ার কয়েকমূহুর্ত আগে আমাদের যাত্রা শুরু হল এই ঐতিহাসিক জায়গার উদ্দেশ্যে । ৩১শে ডিসেম্বর সকাল ৬:৫০ এ কলকাতা স্টেশন থেকে হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেসে আমরা মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । এবারে আমাদের দল আটজনের - আমি আমার স্ত্রী, বাবা, মা ছাড়া আমার স্ত্রীর কলিগ নন্দিনীদি, দীপঙ্করদা আর ওঁদের যমজ ছেলে সায়ক ও সৌনক । (নন্‌-আইডেন্টিক্যাল ট্যুইন্স)  পৌঁছনোর নির্ধারিত সময় বেলা ১১:১৮ হলেও আমরা পৌঁছলাম দুপুর দেড়টায় । এর কারণ হল ঐদিন সকালের লালগোলা প্যাসেঞ্জার বাতিল থাকায় আমাদের  ট্রেনটা রাণাঘাটের পর থেকে অল্‌ স্টপ্‌ হয়ে গেল (পরে অবশ্য জেনেছিলাম এটা শুধু ঐদিন হয়েছে এমন নয়, এই ব্যাপারটা ওই লাইনের প্রায় রোজকার ঘটনা) ।

যে টাঙ্গা আমরা চড়েছি
মুর্শিদাবাদ স্টেশনটা খুব সুন্দর দেখতে - হাজারদুয়ারীর আদলে তৈরি করা । স্টেশন থেকে আমাদের 'হোটেল মঞ্জুষা' প্রায় দু'কিলোমিটার দূরে, তাই টাঙ্গা নেওয়া হল । আটজনের জন্য দু'টো টাঙ্গা । এই টাঙ্গায় চড়াটা আমার মনে হয় সবার কাছেই বেশ উপভোগ্য আর এই সুযোগ খুব বেশি জায়গায় পাওয়াও যায় না । পিচের রাস্তার ওপর দিয়ে ঘোড়ার 'খুট্‌ খুট্‌' শব্দ তুলে এগিয়ে চলা আর তার সঙ্গে সহিসের মাঝে মাঝে ছড়ি দিয়ে ঘোড়াকে আল্‌তো করে মারা আদর করা - সবমিলিয়ে ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগে । আমাদের হোটেল হাজারদুয়ারির একেবারে সামনে গঙ্গার পাশে, তাই হোটেলে পৌঁছনোর পথে টুক্‌ করে একবার হাজারদুয়ারি দেখা হয়ে গেল । টাঙ্গাওয়ালারা আমাদের থেকে মাথাপিছু ১০ টাকা করে নিল ।

আমাদের ঘর থেকে গঙ্গার দৃশ্য
'হোটেল মঞ্জুষা' মুর্শিদাবাদের ভালো হোটেলগুলোর একটা । ডিসেম্বর-জানুয়ারি হচ্ছে মুর্শিদাবাদের যাকে বলে 'পীক্‌ সিজন্‌' কাজেই আগে থেকে বুক করে না এলে ঘর পাওয়া অসম্ভব, অন্ততঃ মঞ্জুষার মতো হোটেলে । আমরা দো'তলায় তিনটে ঘর নিয়েছিলাম যার ভাড়া ৮০০ টাকা/প্রতিদিন । (আমাদের একটু চেনা থাকায় ৫০ টাকা করে ছাড় পেয়েছি) ঘর যে খুব কিছু ভালো তা নয়, আয়তনে বেশ ছোট । ঘরে খাট, টিভি, একটা টেবিল, দু'টো চেয়ার আর সেইসঙ্গে অ্যাটাচ্‌ড বাথ সবই আছে কিন্তু যেটা প্রায় নেই সেটা হল হাঁটাচলার জায়গা । কিন্তু আগেই বলেছি, এর থেকে ভালো হোটেল মুর্শিদাবাদে বিশেষ পাওয়া যাবে না, পয়সা ফেললেও না । তবে প্রত্যেকটা ঘরের সঙ্গে একটা করে সুন্দর বারান্দা আছে, আমাদের তিনটে ঘরের মধ্যে দু'টো গঙ্গার দিকে । সেদিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই সুন্দর ।

আমরা দুপুরে খেয়ে নিলাম । এখানে ভাত মিল্‌ সিস্টেমে - ভাত ডাল ভাজা তরকারি আর সেইসঙ্গে মাছ বা মাংস । আমাদের সবমিলিয়ে পড়ল মোট ৯৪০ টাকা ।

এরপর আমরা হোটেলে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নিলাম আমরা কবে কোথায় ঘুরব । আমরা ফিরে যাব পরশুদিন দুপুরের ট্রেনে, তাই আমাদের হাতে আজ বিকেল, কাল সারাদিন আর পরশু সকাল । এর মধ্যে আগামীকাল ১লা জানুয়ারি এবং এইদিন হাজারদুয়ারি তথা মুর্শিদাবাদে প্রচন্ড ভীড় হয় । তাই ঠিক হল আমরা আগামীকাল গঙ্গার ও'পারের মুর্শিদাবাদ ঘুরব আর পরশুদিন সকালে এ'পারের মুর্শিদাবাদ ঘুরব । তাহলে আজ বিকেলে আমরা কি করব ? প্রকৃতিকে দেখবো !

হোটেল মঞ্জুষার বাগান
এ'বার সেই বিশেষ ব্যাপারটার সম্পর্কে লিখি । হোটেল মঞ্জুষার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এর বাগান ।হোটেলের চারদিকে নানারকম গাছ লাগিয়ে একটা অসাধারণ বাগান তৈরি করা হয়েছে । আর এর সম্পূর্ণ কৃতিত্বই হল ম্যানেজার মৃদুল সরকার-এর । (এই প্রথম আমার লেখায় কোনও হোটেলের ম্যানেজারের নাম লিখলাম - এর থেকে বোঝা যাবে ভদ্রলোক কতটা বিশিষ্ট) আমাদের পরিচিত প্রায় সব গাছ উনি লাগিয়েছেন তো বটেই, সেইসঙ্গে এমন কিছু গাছ লাগিয়েছেন যেগুলো আমরা যারা শহরে থাকি তারা শুধু নামই শুনেছি, কোনওদিন চোখে দেখিনি । এমনকি এরকম গাছও ওনার বাগানে আছে যেগুলো প্রকৃতপক্ষে সমতলের গাছই নয়, পার্বত্য অঞ্চলের গাছ ! শুধুমাত্র মৃদুলবাবুর আদর আর যত্নে এরা এই পরিবেশে সবার সঙ্গে একসঙ্গে যে শুধু বেঁচেই আছে তাই নয়, দিব্যি ফুল-ফল ফলাচ্ছে । সব দেখে অরণ্যদেবের নন্দনকাননের কথা মনে পড়ে যায় যেখানে বিভিন্নধরনের প্রাণীরা সহাবস্থান করে।
মৃদুল সরকারের নন্দন কাননের ফুল
আমি এখানে কোনও গাছের নাম আলাদা করে লিখছি না, কারণ ওনার বাগানের সব গাছই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, স্ব-স্ব মহিমায় বিদ্যমান, তাই কয়েকটা নাম লিখলে আমার মতে বাকিদের প্রতি অবিচার করা হবে আর সবার নাম এখানে লেখা সম্ভব নয় । এখানে শুধু একটা বিশেষ গাছেরই উল্লেখ করছি (আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লেখার অভ্যেস আছে শুনে মৃদুলবাবু আমাকে বারবার সেই গাছের ব্যাপারে উল্লেখ করতে বারণ করেছেন, তাই নামটা আর লিখলাম না) যে গাছ ওনার বাগানে তিন-চারটে আছে । এই গাছ যে শুধু দুষ্প্রাপ্য তাই নয়, দুর্মূল্যও । মৃদুলবাবু সবাইকে এই গাছ দেখান না, আমাদের গাছের সম্পর্কে আগ্রহ আছে বলে দেখালেন ।

মঞ্জুষার বাগান থেকে গঙ্গার ওপারে সূর্য্যাস্ত
বাগান দেখা শেষ হলে আমরা গঙ্গার ধারে গিয়ে বসলাম । এই বসার জায়গাও হোটেল মঞ্জুষার নিজস্ব । এখানে আমরা বসে বসে সূর্য্যাস্ত দেখলাম । তারপর ঘরে এসে সন্ধ্যেবেলা চা-টা খেয়ে একটু হাঁটতে বেরোলাম । মৃদুলবাবুর দৌলতে এই সান্ধ্যভ্রমণে আমাদের আরও একটা জায়গা দেখা হয়ে গেল কিন্তু সেটার কথাও ওনার অনুরোধেই আর লিখছি না । শুধু এ'টুকু বলে রাখি মুর্শিদাবাদে এসে এই জায়গাটা দেখার সুযোগ প্রায় কেউই পায় না, আমরা মৃদুলবাবুর সৌজন্যেই পেয়েছি, যিনি ওখানকার একজন বেশ 'ইনফ্লুয়েন্সিয়াল' লোক । হোটেল মঞ্জুষায় উঠে মৃদুল সরকারের সঙ্গে ভাব জমাতে পারলে উনি এই সুযোগ করে দিলেও দিতে পারেন !

রাতের আলোয় হাজারদুয়ারি
আমরা রাতের আলোয় হাজারদুয়ারি দেখলাম । অন্ধকার হয়ে গেছে, আর হাজারদুয়ারি বিকেল ৫টায় বন্ধ হয়ে যায় । হাজারদুয়ারির চারদিকে হলুদ আলো জ্বালিয়ে রাখে আর সবমিলিয়ে খুব সুন্দর লাগে । আমরা কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে কিছু কেনাকাটা করে নিলাম । এখানে একটা বিশেষ জিনিসের কথা উল্লেখ করি । সেটা হল একটা দোকানে ডাবের খোলা দিয়ে নানারকম মূর্তি তৈরি করে সাজিয়ে রাখা রয়েছে । শিল্পী নিজেই বিক্রেতা, আর মূর্তিগুলো খুবই সুন্দর । শুধুমাত্র নানারকম সাইজের ছুরির সাহায্যে পুরোপুরি হাতে তৈরি করা হয়েছে হনুমান, গনেশ, বুদ্ধের মুখ, রবীন্দ্রনাথের মুখ আরও কত কি ! শিল্পীর হাতের কাজের তারিফ না করে পারলাম না আর সেইসঙ্গে দু'টো কিনেও ফেললাম । একেকটা ১৮০ টাকা করে নিল ।

হোটেলের ছাদ থেকে ইমামবাড়ার অংশ
কর্কটক্রান্তিরেখার কাছাকাছি বলে মুর্শিদাবাদের গরম আর ঠান্ডা দু'টোই খুব বেশি পড়ে (এটা লেখার যে বিশেষ দরকার ছিল তা নয়, তবে নন্দিনীদি ভূগোলের শিক্ষিকা কিনা, আমাকে যেন ভূগোলে একেবারে অজ্ঞ না ভাবেন তাই এই জ্ঞানটা ফলালাম !) আর এই ঠান্ডাটা বেশ মালুম পড়ছিল যত রাত বাড়ছিল । সাড়ে সাতটা নাগাদ আমরা হোটেলে ফিরে এসে যে'যার ঘরে গুটিশুটি মারলাম । রাত্রিবেলা আমি একবার ছাদে গেলাম । আমাদের হোটেলের ছাদ থেকে হাজারদুয়ারি আর ইমামবাড়ার বেশ কিছুটা দেখা যায় আর রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে দেখতে বেশ লাগে । কিচ্ছুক্ষণ ছাদে কাটিয়ে নেমে এসে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম । রাতেও মোটামুটি দুপুরের মতো একই মেনু - শুধু এ'বেলা ভাতের বদলে রুটি নেওয়া হল । এবারে মাথাপিছু ১২০ টাকা করে পড়ল ।

ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম ।

হোটেলের ছাদ থেকে সকালের আলোয় হাজারদুয়ারি
Happy New Year, 2014! নতুন বছর - নতুন দিন - নতুন সকাল - "নতুন সূর্য্য আলো দাও আলো দাও" (না, এটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল !) সকালে উঠে প্রথমেই গেলাম ছাদে । সকালের রোদে ছাদ থেকে চারপাশের দৃশ্য মুগ্ধ করে দিল ! বিশেষ করে - হ্যাঁ হাজারদুয়ারি । মনে হতে পারে আমি হাজারদুয়ারি নিয়ে বাড়াবাড়ি করছি, কিন্তু এই বাড়াবাড়িটা লোকে দার্জিলিঙ-সিকিমে গেলে কাঞ্চনজঙ্ঘা নিয়েও করে আর দীঘা-পুরীতে গেলে সমুদ্র নিয়েও করে । কাজেই, এটাও চলতে পারে ।

ভট্‌ভটিতে আমাদের গাড়ি উঠছে
আমাদের গাড়ি আগেই ঠিক করা ছিল, গঙ্গার ওপারের মুর্শিদাবাদ ঘোরার জন্য । সুমো - ভাড়া ১,৫০০ টাকা (গঙ্গা পারাপারের ১২০ টাকা নিয়ে) গাড়ি করে প্রথমে একজায়গায় গিয়ে রাধাবল্লভী দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম আর তারপর বেরিয়ে পড়লাম আমাদের গন্তব্যের দিকে । এখানে গঙ্গা পেরোনোর কোনও ব্রীজ নেই, ভট্‌ভটি নৌকো করে মানুষ এবং গাড়ি পারাপার করে । পাশের ছবি থেকে এর সম্পর্কে বোঝা যাচ্ছে, তাই আর ডিটেলে লিখলাম না ।

খোসবাগে সিরাজ-উদ-দৌলার সমাধি
আমাদের প্রথম দেখার জায়গা 'খোসবাগ' - সিরাজ-উদ্‌-দৌলার সমাধি । এখানে সিরাজ ছাড়াও তাঁর পত্নী লুৎফান্নিসা, দাদু আলিবর্দী খাঁ এবং তাঁদের পরিবারের অনেকের সমাধি রয়েছে । তবে কোন্‌টা কার সমাধি নিজে থেকে জানার কোনও উপায় নেই কারণ সমাধির ওপরে আরবিতে লেখা । শুধুমাত্র সিরাজ-এর সমাধিটাই চিনতে পারা যায় এর কেন্দ্রীয় অবস্থান দেখে । সমাধি ছাড়াও এখানে রয়েছে খোসবাগ মস্‌জিদ যেটা নবাব আলিবর্দী খাঁ তৈরি করিয়েছিলেন । জায়গাটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় ।







রানীভবানীর তৈরি চারমন্দিরের একটা
এরপর আমাদের দ্বিতীয় গন্তব্য - রানীভবানীর মন্দির । রানীভবানী ছিলেন অনেকটা দক্ষিণেশ্বরের রানী রাসমণির মতো । তিনি এখানে চারটি মুখোমুখি মন্দির তৈরি করান । এই মন্দিরের গায়ে পুরাণের বহুঘটনার ছবি খোদিত আছে । বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল এই সৌন্দর্য্য দেখতে । এই মন্দিরগুলো থেকে সামান্য কিছু দূরে রানীভবানীর মন্দিরও আছে ।

জগদ্বন্ধু ধাম
এরপর আমরা গেলাম 'জগদ্বন্ধু ধাম' দেখতে । এই জায়গার কোনও ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেই, এখানে জগদ্বন্ধুর জন্ম হয়েছিল । এখানকার মন্দিরটা দেখতে খুব সুন্দর - যেটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে সেটা হল মন্দিরের গায়ে-মাথায় খোল আর কর্তালের ছবি আর মডেল । মন্দিরের লাগোয়া নাটমন্দিরটা বেশ বড় আর পরিষ্কার ।



কিরীটেশ্বরী মন্দির
জগদ্বন্ধুধামের পরে আমাদের চতুর্থ গন্তব্য কিরীটেশ্বরী মন্দির । পুরাণ মতে এখানে সতীর কিরীট পড়েছিল - সেই থেকেই নাম কিরীটেশ্বরী মন্দির । যদিও মন্দির হিসেবে খুব ঘ্যাম কিছু না আর সেইজন্যই পুজো-টুজো দেওয়ার কোনও ব্যাপার নেই । আমরা কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে এগিয়ে চললাম আমাদের আজকের পঞ্চম তথা শেষ গন্তব্যের দিকে ।

রোশনবাগ
রোশনবাগ । জায়গাটা অনেকটা খোসবাগের মতোই তবে খোসবাগের থেকে এর গুরুত্ব কম । এখানে সুজাউদ্দীন খাঁ-এর সমাধি এবং মসজিদ রয়েছে ।








আমাদের প্রথমদিনের ঘোরা শেষ - দুপুর একটা বাজে । রোশনবাগটা একেবারেই গঙ্গার ধারে । আবার একইভাবে নৌকো করে গঙ্গার এ'পারে এলাম । গাড়ি আমাদের একটা ভাতের হোটেলের সামনে নামিয়ে দিল । এখান থেকে আমাদের হোটেল বেশ কাছে - খাওয়ার পরে আমরা হেঁটে ফিরে যাব ।

সেই মিল্‌সিস্টেমের ভাত, সেই ডাল, সেই তরকারি আর সেই মাছ বা মাংস । এবারে আটজনের জন্য মোট খরচ হল ৬৪০ টাকা ।

এরপর হোটেলে ফিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম । সন্ধ্যেবেলা আলাদা করে কিছু করার নেই, আড্ডা মেরে দিব্যি কেটে গেল । রাতের খাবার আজ একটা অন্য হোটেল থেকে খাওয়া হল । এটার রান্না আগের সবগুলোর চেয়ে ভালো আর এখানকার খাবার সবচেয়ে সস্তা । এখানে আমাদের খরচ পড়ল মাথাপিছু ৬০ টাকার মতো । রাতে শুয়ে পড়লাম । পরেরদিন আমরা মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের প্রধান জিনিসগুলো দেখব আর সব দেখে টেখে ফিরেও যাব !

২ রা জানুয়ারি, ২০১৪ - বৃহস্পতিবার । আমাদের আজ ফিরে যাওয়ার দিন, সকাল ন'টায় হোটেল ছেড়ে দিতে হবে । সেইমতো ব্যাগ প্যাক করে সেগুলো ম্যানেজারের জিম্মায় রেখে হোটেলের পাওনাগন্ডা মিটিয়ে আমরা যখন হাজারদুয়ারির উদ্দেশ্যে বেরোলাম তখন বেলা দশটা বাজে । যাওয়ার পথে একটা হোটেলে ব্রেকফাস্ট করে নেওয়া হল । মুর্শিদাবাদে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি যে এখানকার কোনও হোটেলেই মাটন্‌ পাওয়া যায় না । এদিকে আমি আর দীপঙ্করদা বাকিদের তুলনায় একটু বেশিই মাংসাশী । তাই প্রথম দিন থেকে মাংসের খোঁজে ব্যর্থ হতে হতে শেষ পর্যন্ত মাটন্‌ পাওয়া গেল এই হোটেলেই । এরা এমনিতে মাংস করে না, তবে আমাদের আটজনের জন্য আজ দুপুরে করে দেবে । বাকিসব একই মিলসিস্টেম্‌ - শুধু মাছ বা মুরগীর বদলে মাটন্‌ । মাথাপিছু পড়বে ২০০ টাকা করে ।

এরপর আমরা এগিয়ে গেলাম হাজারদুয়ারির দিকে । হাজারদুয়ারি খোলে সকাল ন'টায় । হাজারদুয়ারিতে ঢোকার টিকিট ১০ টাকা করে আর পনেরো বছরের নিচে টিকিট লাগে না । ভেতরে কোনও ক্যামেরা এমনকি মোবাইল ক্যামেরাও নিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই আর লুকিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও লাভ নেই । গেটে খুব খুঁটিয়ে সিকিউরিটি চেকিং হয় আর এমনকি সঙ্গে যদি ছবি-তোলা-যায়-না মোবাইল থাকে, সেটাকেও এরা ভালোভাবে দেখে নেয় ।

মুর্শিদাবাদের ইমামবাড়া
"হাজারদুয়ারি ভালোভাবে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব" বলে এখানে অনেক গাইড্‌ ঘোরাঘুরি করে । মুর্শিদাবাদে যেকোনো জায়গাতেই এই গাইড্‌দের পাওয়া যায় আর আমার মতে সবজায়গাতেই একজনকে নিয়ে নেওয়া ভালো । কারণ মুর্শিদাবাদ প্রধানতঃ ঐতিহাসিক জায়গা, তাই দেখার সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসটা একটু জেনে নিলে ভালোই লাগবে । 'মতিঝিল'-এ আমাদের গাইড একটা খুব সুন্দর কথা বলেছিল - "জানলে ইতিহাস আর না জানলে মাটির দেওয়াল !" যাই হোক, হাজারদুয়ারিতে আমরা একজন গাইড ঠিক করলাম যে আমাদের হাজারদুয়ারির মাঠে 'বাচ্চাওয়ালী কামান', 'সিরাজের মদিনা', 'ইমামবাড়া' ইত্যাদি দেখাল । আর সেইসঙ্গে হাজারদুয়ারির বাইরে থেকে কিছু জিনিস দেখাল । এর জন্য সে নিল ১০০ টাকা । পরে বুঝলাম যে এইসব গাইডরা কেউই ভেতরে ঢুকে কিছু দেখায় না, কিন্তু সেটা এরা প্রথমে বলে না । আমরা না জেনে ১০০ টাকা দিয়ে ঠকেছি । এদেরকে কোনওভাবেই ৫০ টাকার বেশি দেওয়ার মানে হয় না ।

হাজারদুয়ারি
হাজারদুয়ারির সঙ্গে কিন্তু সিরাজ-উদ্‌-দৌলার কোনও সম্পর্ক নেই । সিরাজের মৃত্যুর অনেক পরে হাজারদুয়ারি তৈরি করা হয় । হাজারদুয়ারির সঙ্গে কলকাতার টাউনহলের আকৃতির সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় - কারণ দু'টোই একই কোম্পানীর ডিজাইন করা । আমরা হাজারদুয়ারির ভেতরে ঢুকলাম । হাজারদুয়ারিতে এক হাজারের মতো দরজা আছে, সেই থেকেই এই নাম, দরজাগুলোর মধ্যে কিছু আসল আর কিছু নকল - এসব মোটামুটি সবাই জানে । কিন্তু যেটা নিয়ে মতানৈক্য শুনেছি সেটা হল কতগুলো আসল আর কতগুলো নকল । বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিরে লিখছি ১০০ নকল আর ৯০০ আসল । এই নকল দরজাগুলো চট্‌ করে দেখে বোঝা যায়
হাজারদুয়ারির নকল দুয়ার
না, তবে কাছে গিয়ে নিরিক্ষণ
করলে ধরতে পারা যায় । জানলাম ইঁট-চুন-সুরকির সঙ্গে খয়ের জল, আখের গুড়, ডিমের কুসুম ইত্যাদি ব্যবহার করে এই দরজা তৈরি হয়েছিল । (খুবই সুস্বাদু দরজা, তাতে আর সন্দেহ কি !) হাজারদুয়ারির ভেতরে আরেকটা আকর্ষণীয় জিনিস হল সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার উপহার দেওয়া ১০১ বাতির একটা সুদৃশ্য ঝাড়লন্ঠন । এছাড়া হাজারদুয়ারির ভেতরে রয়েছে নবাব আর ইংরেজদের ব্যবহৃত বহু অস্ত্রসস্ত্র, জিনিসপত্র, বাসনপত্র, আসবাবপত্র, শুধু পত্র, বহু বিখ্যাত শিল্পীদের হাতে আঁকা ছবি, বিলিয়ার্ড বোর্ড, পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত সরঞ্জাম ইত্যাদি । হাজারদুয়ারি ভালোভাবে দেখতে গেলে কমপক্ষে দু-আড়াইঘন্টা সময় নিয়ে যাওয়া উচিৎ । হাজারদুয়ারি শুক্রবার বন্ধ থাকে ।

হাজারদুয়ারির ঠিক মুখোমখি রয়েছে ইমামবাড়া - এটা বাংলার সবচেয়ে বড়ো ইমামবাড়া । এটা বছরের মধ্যে শুধুমাত্র মহরমের সময়ে ১০ দিন খোলা থাকে, বাকি সারাবছর বন্ধ থাকে ।

হাজারদুয়ারি থেকে বেরোলাম তখন ঠিক বেলা বারোটা । আমাদের আজকের ঘোরার জন্য একটা ট্রেকার ঠিক করা ছিল । ঘোরাঘুরির জন্য ৮০০ টাকা আর এই ট্রেকারই আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দেবে সে'জন্য ১০০ টাকা । ট্রেকারে চড়ে গেলাম আমাদের আজকের দ্বিতীয় গন্তব্যে ।

কামানের আঘাতে গর্ত
মোতিঝিল । গাইড - ৫০ টাকা ।
মোতিঝিল তৈরি করান নবাব আলিবর্দীর জামাই । এখানে একটা অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ আছে যেখানে একসময়ে মোতি বা মুক্তোর চাষ হতো । এখানে একটা মসজিদ আছে । সেগুলোর ইতিহাসের ডিটেলে আর যাচ্ছি না, শুধু একটা ইন্টারেস্টিং গল্প বলছি । মোতিঝিলের মসজিদের পাশে একটা ঘর আছে যার কোনও দরজা বা জানালা নেই । চারদিকে দেওয়াল আর ছাদটাও ঢাকা । কথিত আছে সিরাজ এক ফৈজীর ওপর রেগে গিয়ে তাঁকে মাঝখানে রেখে এই ঘর তৈরি করান । অনেকে মনে করতেন এইঘরে অনেক মণিমুক্তোও আছে । কিন্তু এর আশ্চর্য শক্ত ইঁটের গাঁথনি কেউ কোনওভাবে ভাঙতে পারেনি । পরবর্তীকালে কোনও একজন সাহেব এইঘরের দেওয়াল কামানের গোলা দিয়ে ভাঙার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন এবং সেইদিন রাতেই সাহেব মারা যান । তারপর থেকে এইঘরের দেওয়াল ভাঙার চেষ্টা আর কেউ কখনও করেনি । দেওয়ালে কামানের আঘাতের চিহ্ন আজও স্পষ্ট দেখা যায় ।

জাহানকোষা কামান
তৃতীয় গন্তব্য - জাহান কোষা কামান । গাইড লাগে  না ।
কাটরা মসজিদের ভেঙ্গে পড়া ছাদ
সাড়ে পাঁচ মিটার লম্বা আর চারফুটের মতো পরিধিবিশিষ্ট 'জাহান কোষা কামান' আরেকটা দূর্দান্ত দর্শনীয় বস্তু । এর ওজন সাত টনের বেশি । এটা শাহজাহানের রাজত্বকালে তৈরি হয়েছিল আর তৈরি করেছিলেন একজন বাঙালি ধাতুবিদ্‌ জনার্দন কর্মকার । এর বেশি বিশেষ কিছু জানি না ।

চতুর্থ গন্তব্য - কাটরা মসজিদ । গাইড - ৫০ টাকা ।
এখানে আমরা ৫০ টাকা দিয়ে একজন গাইড নিলাম যাকে না নিলে কাটরা মসজিদ ভালোভাবে দেখা হতো না । মসজিদের পিছন দিয়ে দিক ঢুকতে হয় কারণ সেখান দিয়েই প্রধান রাস্তা চলে গেছে । কাটরা মসজিদে উপাসনা ছাড়াও ছাত্রাবাস ছিল, যেখানে একসঙ্গে বহু আবাসিক একসঙ্গে থেকে পড়াশোনা করতে পারত । মসজিদের সামনের দিকে একটা বিশাল চাতাল আছে যেখানে একসময়ে অনেক মানুষ একসঙ্গে নামাজ পড়তেন । কাটরা মসজিদের সবচেয়ে আগ্রহজনক বিষয় হল এর প্রবেশসিঁড়ির নিচে রয়েছে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-র সমাধি । নবাবের ইচ্ছানুযায়ী মৃত্যুর পরে তাঁকে এখানে কবর দেওয়া হয় । নবাব বলেছিলেন "মসজিদমে প্রবেশ করনে কে লিয়ে লোগ যব মেরে উপর সে গুজরেঙ্গে, তব যাকে মেরে পাপ ধোনে লাগেঙ্গে" । (আমার ধারণা এইভাবে শুদ্ধ হিন্দীতে বলেননি, কিন্তু মনে হল মুর্শিদাবাদ সম্পর্কে লেখার মধ্যে স্বয়ং মুর্শিদকুলি খাঁ-র একটা ডায়ালগ্‌ থাকলে বেশ হয় - তাই এটা লাগালাম) কাটরা মসজিদের প্রধান উপাসনা গৃহের ছাদে পাঁচটা গম্বুজ ছিল, যার তিনটে ভূমিকম্পে ভেঙ্গে পড়েছে । এখন এর ছাদটা পুরোপুরি অনাবৃত । ভূমিকম্প কাটরা মসজিদের আরও কিছু ক্ষতিও করেছে । মসজিদের চারকোণে চারটে মিনার ছিল যাদের মধ্যে দু'টো ভূমিকম্পে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে ।

কাটরা মসজিদ থেকে আমরা আমাদের খাবার জায়গায় এলাম । আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল বহু প্রতিক্ষিত পাঁঠার মাংসের ঝোল আর ভাত । মাংসগুলো একটু কম সেদ্ধ হলেও ঝোলটা খেতে ভীষণ সুন্দর হয়েছিল । খাওয়া শেষ করে আমাদের পরের দর্শনীয় জায়গার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম তখন দুপুর আড়াইটে বেজে গেছে । আমাদের ট্রেন বিকেল ৪:৪০ এ ।

কাঠগোলা বাগানে দুগারদের বাড়ি
পঞ্চম গন্তব্য - কাঠগোলা বাগান । গাইড - ৫০ টাকা ।
কাঠগোলা বাগানের মধ্যে আসলে রয়েছে দুগার পরিবারের বাড়ি । সম্ভবতঃ রাজস্থান নিবাসী এই দুগার পরিবার অত্যন্ত ধনী ছিলেন এবং এই বাড়িতে তাঁদের ব্যবহৃত সামগ্রী এবং আসবাবপত্র রয়েছে । এই দুগার পরিবারের বংশধর আজও জীবিত আছেন এবং কলকাতায় থাকেন । নিজেদের এই আদিবাড়ি আর সংগ্রহশালাকে সাধারণের উদ্দেশ্যে খুলে দিয়েছেন মাথাপিছু ১৫ টাকা প্রবেশমুল্যের বিনিময়ে । এই হচ্ছে মারোয়াড়ি বুদ্ধি ! দুগারদের বাড়িতে বেশ কিছু দেখার জিনিস থাকলেও খুব আগ্রহজনক কিছু নয় বরং বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে ফুলের বাগানটা খুব সুন্দর । তাছাড়া আছে একটা জৈন মন্দির যার দেওয়ালে নানারকম ভাস্কর্য্য দেখা যায় । একটা কথা বলতে পারি, সবকিছুর পরে দুগারদের বাড়ি বা কাঠগোলা বাগানের সঙ্গে ইতিহাসের কোনও সম্পর্ক নেই, কাজেই হাতে সময় কম থাকলে এই জায়গাটা না দেখলেও চলবে ।

দুপুর ৩:৩৫ বাজে ।

জগৎ শেঠের বাড়ি
ষষ্ঠ গন্তব্য - জগৎ শেঠের বাড়ি । গাইড - ৫০ টাকা ।
যদিও আমরা গাইড নিইনি । সবকিছু দেখে বুঝে নেওয়া আমাদের পক্ষে সময় আমাদের হাতে এখন আর নেই । জগৎ শেঠের বাড়িতে প্রবেশমূল্য মাথাপিছু ১০ টাকা । আমাদের সামনে সামনে একটা গ্রুপ এগোচ্ছিল, তারা একটা গাইড নিয়েছিল । আমরা সেই গ্রুপের সঙ্গে সঙ্গে চললাম আর আমাদের মোটামুটি যা দেখার-জানার তা হয়ে গেল । জগৎ শেঠের বাড়িও কিছুটা দুগারদের মতোই - পার্থক্য হল জগৎ শেঠ হলেন একজন যিনি সিরাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন । ইনি একজন ধনকুবের ছিলেন - সেটা ওনার বাড়ির নানারকম সরঞ্জাম থেকেই বোঝা যায় । এখানে মাটির নিচে একটা মিউজিয়াম আছে । এই মিউজিয়ামে বাংলার বিখ্যাত মসলিন্‌ দেখতে পাওয়া যায় । এই মসলিন নাকি এতই নরম যে একে আংটির ভেতর দিয়ে চালান করা যায় । সেটা প্রমাণ করার জন্যই এখানে একটা মসলিন্‌কে তিনটে আংটির ভেতর দিয়ে চালান করে দেখানো আছে । বাড়ির সঙ্গে একটা মন্দির আছে ।

বিকেল ৪ টে ।

এরপর আমাদের পক্ষে আর কিছু দেখা সম্ভব নয় কারণ আমাদের হোটেলে ফিরে মালপত্র নিয়ে স্টেশনের দিকে রওনা হতে হবে । ড্রাইভার বলল - পথে দু'তিনটে জায়গা পড়বে সেগুলো আমরা গাড়ি থেকে না নেমেও দেখতে পারি ।

নসিপুর রাজবাড়ি
সেইমতো প্রথম পড়ল নসিপুর রাজবাড়ি । এর বৈশিষ্ট্য হল এটা হাজারদুয়ারির আদলে তৈরি করা । ভেতরে ঢোকার প্রশ্নই ওঠে না, বাইরে থেকে দেখেই এগিয়ে চললাম ।







বিকেল ৪:০৫ ।

নিমকহারাম দেওড়ী
এরপর পড়ল নিমকহারাম দেওড়ী । এটা আসলে বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের প্রাসাদ । এখানে মীরজাফরের বংশধররা এখনও বাস করেন । আগে একসময়ে এটা একটা দেখার জায়গা ছিল । পরবর্তীকালে বাসিন্দাদের আপত্তির কারণে এখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয় । (ব্যাপারটা ওনাদের পক্ষে কতদূ্র বিরক্তিকর সেটা বুঝতে পারছিলাম । নানারকম লোকজন ওনাদের বাড়ি দেখতে যেত মনে ওনাদের সম্পর্কে একরাশ ঘৃণা নিয়ে !)

বিকেল ৪:০৮ ।

আজিমুন্নেসার সমাধি
পথে শেষ দেখার জায়গা পড়ল আজিমুন্নেসার সমাধি । ইনি মুর্শিদকুলি খাঁ-র কন্যা আর এনাকেও তাঁর বাবার মতো মসজিদের সিঁড়ির নিচে সমাধিস্থ করা হয় । আমাদের মুর্শিদাবাদ দেখা শেষ - এবার আমাদের ফেরার পালা । লেকিন দিল্লী স্টেশন আবভি দূর হ্যায় !




বিকেল ৪:২০ - আমরা হোটেলে ফিরলাম । ম্যানেজারের জিম্মা থেকে আমাদের মালপত্র নিয়ে হোটেল থেকে বেরোতে সাড়ে চারটে বেজে গেল । ট্রেকারে মঞ্জুষা থেকে স্টেশনে পৌঁছতে মিনিট দশেক লাগার কথা - অর্থাৎ ৪:৪০ বাজবে । আবার এও শুনলাম ট্রেন এখানে মোটামুটি ঠিক সময়েই আসে !

আমাদের ট্রেকার স্টেশনের দিকে এগিয়ে চলেছে । পুরো রাস্তাটাই শহরের মধ্যে দিয়ে, খুব জোরে চালানো যায় না । ঘড়ি এগিয়ে চলেছে । এটা এমন একটা সময় যখন একেকটা মিনিট গুরত্বপূর্ণ । স্টেশনে পৌঁছলাম ৪:৩৭ বাজে । কোনওমতে গাড়ির ছাদ থেকে মালগুলো নামিয়ে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দেখি ট্রেন ঢুকছে । সৌভাগ্যক্রমে আমাদের কামরা একেবারে আমাদের সামনের থামল । প্রচন্ড ভীড়ে ঠেলাঠেলি করে ট্রেনে ওঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ট্রেন ছেড়ে দিল । "সী ইউ সুন, মুর্শিদাবাদ !"

ফেরার সময়েও একই বিভ্রাট । লালগোলা প্যাসেঞ্জার বাতিল কাজেই আমাদের ট্রেন রাণাঘাট পর্যন্ত সব স্টেশনে থামবে । আমরা কলকাতা স্টেশনে পৌঁছলাম তখন রাত সাড়ে দশটা আর তার আধঘন্টা পরে বাড়ি !

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে দু'তিনদিনের জন্য ঘোরার পক্ষে মুর্শিদাবাদ একটা আদর্শ জায়গা । তবে যদি ইতিহাসে একেবারেই আগ্রহ না থাকে, তাহলে বোধহয় না যাওয়াই শ্রেয় !
২. মুর্শিদাবাদে ট্রেনে যাওয়ার জন্য হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস বা লালগোলা প্যাসেঞ্জারে যাওয়া যেতে পারে । এছাড়া বাসেও যাওয়া সম্ভব ।
৩. মুর্শিদাবাদে যাওয়ার সবথেকে ভালো সময় হল শীতকাল কারণ অন্যান্য সময়ে এখানে কলকাতার থেকে অনেক বেশি গরম থাকে । শীতকালে গেলেও বড়দিনের ছুটি বা বিশেষ করে ১লা জানুয়ারি না যাওয়াই ভালো কারণ এই সময়ে এখানে সাংঘাতিক ভীড় হয় ।
৪. গঙ্গার দু'পাশেই নবাবদের নানারকম কীর্তি আর তাদের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে । এগুলো চাইলে গাড়িতে বা টাঙায় ঘোরা যেতে পারে ।
৫. মুর্শিদাবাদের সবথেকে আকর্ষণীয় জায়গা হল হাজারদুয়ারি । এটা বর্তমানে প্রকৃতপক্ষে একটা মিউজিয়াম যেখানে অনেক সময় নিয়ে দেখার মতো অনেক জিনিস আছে ।
৬. মুর্শিদাবাদে হোটেলের সংখ্যা খুব বেশি নয় আর ভালো হোটেল নেই বললেই চলে । আমাদের 'হোটেল মঞ্জুষা' সেই অর্থে একটা ভালো হোটেলের পর্যায়েই পড়ে । মঞ্জুষায় যোগাযোগের নম্বর : 0348-2270321.
৭. মুর্শিদাবাদে খুব ভালো খাবারের রেস্টুরেন্ট নেই, বেশিরভাগই সাধারণ ভাতের হোটেল । সেখানকার খাবারের মানও সাধারণ ।

উপসংহারঃ

গঙ্গার ওপরে হাজারদুয়ারি !
বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুর্শিদাবাদ একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করে । আর এই ইতিহাসই মুর্শিদাবাদের আকর্ষণ । ইতিহাস এখানে যেন সত্যিই কথা বলে । মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ ভালো লাগার জন্য ইতিহাসের ছাত্র হওয়ার প্রয়োজন নেই, কিন্তু ইতিহাসকে সম্মান করার প্রয়োজন আছে । মুর্শিদাবাদে প্রাকৃতিক কোনও আকর্ষণ নেই - এখানকার আকর্ষণের সবকিছুই হয় মানুষের তৈরি না হয় মানুষের ধ্বংস । মানুষের চরিত্রের যে ভালো বা খারাপ দিকগুলো থাকে, সেগুলোই যেন বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা আর গল্পের মধ্যে দিয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে মুর্শিদাবাদে । মুর্শিদকুলি খাঁ, নবাব আলিবর্দী, সিরাজ-উদ্‌-দৌলা বা মীরজাফর - এরা কি নিজেদের মতো করে আমাদের চারপাশে আজও বেঁচে নেই ? সেটা উপলব্ধি করার জন্য আগে ভালোভাবে জানার দরকার এরা কে কিরকম লোক ছিল । আর সে'জন্য - জীবনে অন্ততঃ একবার - মুর্শিদাবাদ যাওয়া উচিৎ !

মুর্শিদাবাদের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

এই লেখায় যে সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ আছে, তার বেশিরভাগই আমি মুর্শিদাবাদে গিয়ে বা অন্য কোথাও কারুর মুখ থেকে শুনেছি । যদি এই ঘটনা বা তথ্যের মধ্যে কারুর কোনও ভ্রান্তি নজরে আসে, ধরিয়ে দিলে বিশেষ উপকৃত হব ।