আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Monday, June 2, 2014

মহারাষ্ট্র ভ্রমণ

মি আমার বেড়ানোর ব্লগ যেদিন থেকে লেখা শুরু করেছি, তারপরে মহারাষ্ট্র ভ্রমণই সবচেয়ে দীর্ঘ । শনিবার ২৪শে মে, ২০১৪ রাতে বেরিয়ে আমরা ফিরেছি সোমবার ২রা জুন, ২০১৪ । এটা ঠিক যে সময়ের এই পরিসরে গোটা মহারাষ্ট্র রাজ্যটা দেখা সম্ভব নয়, আমরা দেখিও নি । আমরা মহারাষ্ট্রের কয়েকটা বিশেষ জায়গায় ভ্রমণ করেছি, তাই এই লেখার নাম মহারাষ্ট্র ভ্রমণ । এই ৯ - ১০ দিনে আমরা যা ঘুরেছি, তা একসঙ্গে লিখে পোস্ট করতে অনেকদিন সময় লাগবে শুধু তাইই নয়, লেখার পরিমানও দীর্ঘ হবে যা একসঙ্গে পড়ে ওঠা ক্লান্তিকর লাগতে পারে । তাই এবারে একটু অন্যভাবে লিখব । আমাদের ভ্রমণের একেকটা জায়গা লিখে পোস্ট করে দেব । তারপরে আবার পরের ভ্রমণের জায়গাটা যোগ করব । এই পরিকল্পনা মাথায় রেখে আমাদের ভ্রমণের প্রথম জায়গা থেকে শুরু করছি - মুম্বই ।

মুম্বই ভ্রমণঃ

২৪শে মে, ২০১৪ হাওড়া থেকে মুম্বই মেলের এসি থ্রি-টীয়ারে আমাদের যাত্রা শুরু । এবারে দলে একজন শিশুসহ মোট ১৪ জন - আমি, আমার স্ত্রী, বাবা, মা, আমার অফিসের কলিগ্‌ সমীরণদা, বৌদি, ঋজু, আমার আরেক কলিগ্‌ কঙ্কনাদি, অমিতদা, মিনকা (শিশুশিল্পী), কাকু, কাকিমা (কঙ্কনাদির বাবা-মা), আমার আরেক কলিগ্‌ বৈশাখী ও কাকিমা । মুম্বই মেল ছাড়ে রাত ৮ : ১৫ য় । ট্রেনে রাতের খাবার আমরা নিয়েই উঠেছিলাম রুটি আর বৈশাখীর রান্না করা চিকেন । খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম ।

নাগপুরে রেললাইনের ক্রসিং
দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ২৫শে মে, আমরা সারাদিনই ট্রেনে । আমাদের সবার সীট্‌ একসঙ্গে পড়েনি, জায়গা আর মানুষজন পারমুটেশন করে সবার সঙ্গে সবাই আড্ডা দিচ্ছিলাম । দূরে কোথাও গেলে বড় দলে যাওয়ার এই হচ্ছে সুবিধে - না হলে একটু বোরই লাগে । যাই হোক, ট্রেনের পথে একটা উল্লেখযোগ্য জায়গা হল নাগপুর । নাগপুর স্টেশনে ঢোকার ঠিক আগে একটা রেল লাইনের ক্রসিং আছে যেখানে আমাদের দু'জোড়া লাইন অন্য দু'জোড়া লাইনকে প্রায় ৯০ ডিগ্রিতে ক্রস করে । এই জিনিস সারা ভারতের মধ্যে শুধু এখানেই আছে । এখানে ট্রেন খুব ধীরে চলে, তাই বেশ ভালোভাবেই জিনিসটা দেখতে পেলাম ।

দুপুরে রেলের ক্যান্টিন থেকে চিকেন ভাত নেওয়া হল । রান্না বেশ বাজে । বিকেলে আকোলা-য় ট্রেন থামার পর আমরা এখানকার 'কাম সাম' এ খাবারের খোঁজ করলাম । মুস্কিল হল এখানে আবার নিরামিষ ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না । কিন্তু এরা আমাদের একটা ভালো উপদেশ দিল । বলল - আমরা চাইলে ওদের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে জলগাঁও এর 'কাম সাম' এ খাবারের অর্ডার দিয়ে রাখতে পারি । আমাদের কোচ আর সীট্‌ নম্বর বলে দিলে ওরা নিজেরা আমাদের খাবার পৌঁছে দিয়ে যাবে । সেইমতো জলগাঁও এর কাম সামে ফোন করে মিক্সড্‌ চাউমিন অর্ডার দেওয়া হল । ট্রেন জলগাঁও পৌঁছয় রাত পৌনে দশটায় - দাঁড়ায় এক মিনিট । এরই মধ্যে কাম সামের লোক এসে আমাদের খাবার দিয়ে গেল (আর অবশ্যই টাকা নিয়ে গেল) । দুপুরের ওই বাজে রান্না খাওয়ার পর এই খাবার সত্যিই অমৃত মনে হচ্ছিল । গপ্‌গপ্‌ করে খেয়ে ফেললাম ।

সি এস টি স্টেশনে আমাদের দল
২৬শে মে, ২০১৪ সোমবার । মুম্বই মেল মুম্বই পৌঁছয় ভোর ৫ : ২৫ এ আর আমাদের ট্রেন একটুও লেট না করে আমাদের পৌঁছে দিল । মুম্বই ! মানুষের স্বপ্নের শহর মুম্বই ! ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস, গেটওয়ে অফ্‌ ইন্ডিয়া, মেরিন ড্রাইভ, তাজ হোটেল, বান্দ্রা, জুহু, সি-লীঙ্ক সম্বলিত মুম্বই ! শচীন গাভাসকার অমিতাভ আমীর খান শাহরুখের মুম্বই ! যে শহর সারারাত জেগে থাকে, সেই মুম্বই ! যে শহরের মানুষের প্রধান প্রিয় খাবার বড়াপাও, সেই মুম্বই ! তাজ হোটেলে জঙ্গী হামলার মুম্বই ! রেল বিস্ফোরণের মুম্বই ! আবার সেই বিস্ফোরণ থেকে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরতে পারে যে শহর - সেই মুম্বই !

আমাদের 'হোটেল নিউ বেঙ্গল' ক্রওফর্ড মার্কেটে - স্টেশন থেকে হেঁটে মিনিটদশেক । তবে সঙ্গে মালপত্র থাকায় আর রাস্তায় লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে হওয়ায় এই পথটা যেতে আমাদের আধঘন্টার বেশি লেগে গেল । হোটেলটা সবমিলিয়ে বেশ ভালো । ভেতরটা একটু গোলকধাঁধার মতো - হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও হোটেলের ঘরের বিন্যাস বেশ জটিল । সেসব বাদ দিলে এমনিতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ।

আমরা চানটান করে রেডী হয়ে নিলাম । আমাদের এখানে বিশ্রাম নেওয়ার সময় নেই - প্রথমদিনই আমাদের গন্তব্য 'আলিবাগ' । তার আগে হোটেলের লাগোয়া রেস্ট্যুরেন্টে কম্‌প্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়া হল ।

গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া
আলিবাগ মুম্বই থেকে দু'ভাবে যাওয়া যায় । এক, মুম্বই থেকে মান্ডোয়া (হ্যাঁ, সেই মান্ডোয়া - ভিজয় দীননাথ চৌহান !) পর্যন্ত লঞ্চে গিয়ে মান্ডোয়া থেকে বাসে আলিবাগ । আর দুই, পুরোটাই গাড়িতে । সেক্ষেত্রে সময় এবং খরচ অনেক বেশি । যাদের জলপথ পরিবহনে সমস্যা আছে, তাদের জন্য দ্বিতীয়টাই শ্রেয় ।



ক্যাটামেরনে যাওয়ার সময়ে ফেলে আসা মুম্বই শহর
আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে কয়েকটা ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছে গেলাম গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ায় - এখান থেকেই আলিবাগের লঞ্চ ছাড়ে । পি এন পি, অজন্তা আর মালদার - এই তিনটে বেসরকারি সংস্থার লঞ্চ চলে । লঞ্চের পরিষেবা খুবই ঘনঘন, কাজেই তাড়াহুড়ো না করলেও চলবে । আমরা পি এন পি র ক্যাটামেরন এ চড়লাম । এর নিচের ডেকটা এসি এবং নীল কাচে ঢাকা । চাইলে ওপরের ডেকে গিয়েও দাঁড়ানো যায় । ক্যাটামেরন ছাড়ামাত্রই আমরা ওপরে গিয়ে হাজির হলাম । শুধু আমরাই নয়, আরও বহু যাত্রীই এটা করল । ওপরের ডেকে দাঁড়িয়ে আরব সাগরের ওপর দিয়ে যেতে যেতে মুম্বই শহরের ক্রমশঃ দূরে সরে যাওয়া দেখতে অসাধারণ লাগে ! ক্যাটামেরনের টিকিট আগে থেকে কাটা না থাকলে কোনও ক্ষতি নেই, এরা যাওয়ার পথেই টিকিট কেটে নেয় । ভাড়া মাথাপিছু ১৫০ টাকা । এটা একটা ফেরি-কাম-বাস সার্ভিস, অর্থাৎ টিকিটের ভাড়াটা মুম্বই থেকে মান্ডোয়া পর্যন্ত ক্যাটামেরন আর মান্ডোয়া থেকে আলিবাগ পর্যন্ত বাস যোগ করে (না, ফেরারটা একসঙ্গে নয়, অত আবদার করে না !) ।

মান্ডোয়া জেটী
মান্ডোয়া পোঁছলাম দুপুর একটার একটু পরে । জেটীর কাছ থেকেই বাস ছাড়ে - আমরা বাসে উঠে পড়লাম । মান্ডোয়া থেকে আলিবাগ যাওয়ার রাস্তাটাও খুব সুন্দর । রাস্তার দু'ধারে পাহাড়ের সারি, আর গাছপালা ।






আমরা আলিবাগ পোঁছলাম তখন দুপুর পৌনে দু'টো । আলিবাগের প্রধান আকর্ষণ হল সমুদ্রের বীচ আর আলিবাগ কেল্লা । বাস কিন্তু বীচ্‌ পর্যন্ত নিয়ে যায় না । বাস থেকে নেমে আমরা ঠিক করলাম আগে লাঞ্চ করে তারপর সমুদ্রের ধারে যাব । এখানে একটা মুস্কিল হল । আলিবাগ শহরে আমিষ রেস্ট্যুরেন্ট প্রায় নেই বললেই চলে । অনেক খুঁজে বেশ অনেকটা হেঁটে তবে একটা পাওয়া গেল (নিরামিষই খেয়ে নিতে পারতাম ? কেন ??? আমি কি উন্মাদ ???) । সেখানে আমরা ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেন ইত্যাদি খেয়ে আলিবাগ বীচের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম দু'টো বড়ো অটো নিয়ে । অটোপিছু ১০০ টাকা করে পড়ল ।

আলিবাগ বীচ থেকে কেল্লা
আলিবাগ বীচে কিন্তু সমুদ্র বিশেষ ঘ্যাম কিছু না । ঢেউ ফেউ কিস্যু নেই । এখানকার প্রধান দেখার জায়গা হল শিবাজীর কেল্লা । এই কেল্লা সমুদ্রের জলের মধ্যে - ভাঁটার সময়ে হেঁটে যাওয়া গেলেও জোয়ারের সময়ে যাওয়া যায় না । সমুদ্রের পাড় থেকে এই কেল্লা প্রায় এক কিলোমিটারের মতো । আমরা দু'টো ঘোড়ার গাড়ি নিলাম যাওয়ার জন্য । যাতায়াত মিলিয়ে পড়ল মাথাপিছু ১০০ টাকা করে ।

আলিবাগ কেল্লার মাথা থেকে ভেতরের দৃশ্য
আলিবাগে ঢুকতে মাথাপিছু ৫ টাকা করে টিকিট লাগে । কেল্লার ভেতরটা বেশ বড়, যদিও অনেক জায়গাই ভেঙ্গে গেছে । তবে কেল্লাটা দেখে বোঝা যায় যে এখানে সুরক্ষা ব্যবস্থা বেশ ভালো ছিল । সাধারণতঃ বাইরের শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এবং দূর থেকে শত্রুকে দেখতে পেয়ে যুদ্ধ করার জন্য এই জাতীয় কেল্লা তৈরি করা হয়, আলিবাগ কেল্লা দেখে মনে হয় এটা সে'ব্যাপারে বেশ উপযুক্তই ছিল । কেল্লার ভেতরে একটা মন্দির আছে যেটা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় । কেল্লার সামনের দিকে একটা দরজা আছে যেটা দিয়ে বেরিয়ে পাথরে পাথরে পা দিয়ে সমুদ্রের ধারে যাওয়া যায় । জায়গাটায় ঘুরতে বেশ লাগে ।

ফেরার সময়ে আলিবাগ জেটী থেকে
আলিবাগ কেল্লায় বেশ অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আমরা আবার সমুদ্রের পাড়ে ফিরে এলাম । সেখানে প্রথমে গোলা খাওয়া হল । তারপর আরও কিছুক্ষণ পরে আবার অটো ধরে বাসস্ট্যান্ডে এলাম । এখানে এসে আবার আখের রস খাওয়া হল । তখন বাজে বিকেল পৌনে ছটা । ফেরার পথেও আমরা পি এন পি র বাস ধরলাম । ৬ : ৩০ টায় পি এন পি র শেষ বাস আর সাড়ে সাতটায় শেষ ফেরি । মান্ডোয়া জেটি থেকে যখন আমাদের ক্যাটামেরন ছাড়ল, তখন আকাশের আলো দেখে বিকেল বলা না গেলেও রাত বলা যায় না কখনওই, বরং সন্ধ্যে বলা যেতে পারে ।

রাতের আলোয় গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া
গেটওয়ে অফ্‌ ইন্ডিয়া ফিরতে ফিরতে রাত ৮ : ৩০ বাজল । আমাদের অফিসের কয়েকজন প্রাক্তন সহকর্মী তাদের বর্তমান কর্মসূত্রে মুম্বইতে থাকে, আমরা আগে থেকেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঠিক করেছিলাম আজ সন্ধ্যেয় দেখা করব । সেইমতো সবার সঙ্গে দেখা করে আমরা ডিনার করতে গেলাম মুম্বইয়ের বিখ্যাত রেস্ট্যুরেন্ট 'বড়েমিঞা'য় । এটা গেটওয়ে অফ্‌ ইন্ডিয়া থেকে হেঁটে বড়জোর মিনিট দশেক । এখানে অত্যন্ত সুস্বাদু বিরিয়ানি, ব্রেন ফ্রাই, ভুনা ইত্যাদি ইত্যাদি খাওয়া হল ।

বান্দ্রা বীচ্‌
রাত সাড়ে দশটা বাজে, কিন্তু মুম্বইতে এটা কিছুই না । আমাদের দলের কয়েকজন হোটেলে ফিরে গেল আর বাকিরা ট্যাক্সি নিয়ে গেলাম বান্দ্রা । জায়গাটা বিশেষ কিছু না, সমুদ্রের ধারে পাথরের ওপর বসার জায়গা । কিন্তু যাওয়ার পথটা সুন্দর - বিশেষ করে বান্দ্রা-ওর্লি সী-লিঙ্ক । এই সী-লিঙ্ক সম্পর্কে বিস্তারিত বলছি না, গুগল্‌ সার্চ করলে অনেক বেশি তথ্য জানা যাবে । যেটা গুগল্‌ থেকে জানা যাবে না সেটা হল এর ওপর দিয়ে যাওয়ার অসাধারণ অভিজ্ঞতা, যা আমাদের হল । গাড়ির স্পীড প্রায় একশ' র কাছাকাছি রেখে আলোকোদ্ভাসিত ৫.৬ কিলোমিটার লম্বা এই ব্রীজে চড়ে সমুদ্রের ওপর দিয়ে যাওয়া আর সেইসঙ্গে ডানদিকে চোখ রেখে মুম্বই শহরের স্কাইস্ক্যাপার এর দৃশ্য দেখা - এ জিনিস নিজের চোখে না দেখলে ভালোলাগাটা অনুভব করা শক্ত । বান্দ্রায় শাহরুখের বাড়ি মান্নাত-এর সামনে আমরা ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসলাম (বাড়ির ভেতরে আর গেলাম না কারণ গেলে আমাদের ডিনার করার জন্য জোর করত আর আমাদের পেটে তখন একেবারেই জায়গা ছিল না) । সমুদ্রের ধারে বসে থাকতেও খুব ভালো লাগছিল । ফেরার সময়েও একই পথ । হোটেলে ফিরলাম তখন রাত প্রায় একটা ।

২৭শে মে, ২০১৪ মঙ্গলবার । আমাদের 'এলিফ্যান্টা কেভ' যাওয়ার দিন । সকালটা মোটামুটি আগেরদিনের মতোই, ব্রেকফাস্ট করে ট্যাক্সি নিয়ে গেটওয়ে অফ্‌ ইন্ডিয়া যাওয়া আর সেখান থেকে 'এলিফ্যান্টা' র লঞ্চ ধরা । এটা আগেরদিনের মতো ক্যাটামেরন নয়, পাতি লঞ্চ । লঞ্চের ভাড়া মাথাপিছু ১৫০ টাকা, তবে এটা যাতায়াত মিলিয়ে । জলপথের বিবরণ প্রায় আগেরদিনের মতোই, পার্থক্য হল মান্ডোয়া বা আলিবাগ মূল ভূখন্ডের মধ্যেই আর এলিফ্যান্টা একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ।

এলিফ্যান্টা যাওয়ার টয়ট্রেন
এলিফ্যান্টা দ্বীপে লঞ্চ জেটী থেকে একটা টয়ট্রেন চলে যেটা পাহাড়ের নিচ পর্যন্ত নিয়ে যায় । পথটা হেঁটে যাওয়ার পক্ষেও বেশি নয়, তবে ট্রেনে যাতায়াতের জন্য ১০ টাকাটা একেবারেই কম, তাই সবাই ট্রেনেই যায় । ট্রেন থেকে নেমে আমরা সিঁড়ি দিয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠলাম ।




এলিফ্যান্টার ১ নং গুহা
এলিফ্যান্টা 'ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ' রক্ষণাবেক্ষণ করে । ঢোকার টিকিট মাথাপিছু ১০ টাকা আর ১৫ বছরের নিচে কোনও টিকিট লাগে না । এলিফ্যান্টা পাহাড় খোদাই করে তৈরি করা গুহামন্দির । এখানে সবমিলিয়ে মোট পাঁচটা গুহা আছে যার মধ্যে প্রথমটাই সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে সুন্দর । সম্পূর্ণভাবে পাহাড় কেটে তৈরি এই গুহামন্দিরের ভেতরে পাথরে খোদাই করে প্রচুর মূর্তি আর ছবি । জিনিসগুলো দেখে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় ! কোনও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির সাহায্য ছাড়াই শুধুমাত্রা ছেনি আর হাতুড়ির সাহায্যের এই অসাধারণ ভাস্কর্য সৃষ্টি করেছিলেন সে'যুগের শিল্পীরা । এই গুহা তৈরির সময়কাল আনুমানিক পঞ্চম থেকে অষ্টম শতাব্দী যদিও কে বা কারা তৈরি করেছিলেন সেটা সঠিকভাবে জানা যায় না । বাইরে প্রবল গরম হলেও গুহার ভেতরটা বেশ ঠান্ডা । এখানে আমরা বেশ অনেকক্ষণ ধরে এই সৌন্দর্য্য উপভোগ করলাম ।

এরপর আমরা একে একে ২, ৩, ৪ ও ৫ নম্বর কেভে গেলাম । এগুলো তুলনামূলকভাবে ছোট আর শেষেরটা অসম্পূর্ণ । সবকিছু দেখা শেষ হলে আমরা এলিফ্যান্টা গুহা থেকে বেরিয়ে আবার পাহাড়ের নিচে নেমে এলাম ।

গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ার সামনে আমাদের দল
দুপুর দু'টো বাজে, এখন মুম্বই গিয়ে লাঞ্চ করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে তাই ঠিক হল এখানেই খেয়ে নেওয়া হবে । সেইমতো একটা ভাতের হোটেলে ঢুকে খেয়েদেয়ে নেওয়া হল । তারপর এলিফ্যান্টা থেকে ফেরা । প্রথমে টয়ট্রেন আর তারপর লঞ্চ । ফেরার সময়ে বোধহয় জোয়ার ছিল, আমাদের লঞ্চটা বেশ দুলছিল আর মাঝে মাঝেই সমুদ্রের জলের ঝাপ্টা লঞ্চের মধ্যে ঢুকে আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছিল । সে এক মজার অভিজ্ঞতা । যাই হোক, মুম্বই পৌঁছলাম তখন বিকেল সাড়ে চারটে । এখান থেকে আমাদের হ্যাঙ্গিং গার্ডেন বা ঝুলন্ত উদ্যানে (না না, ব্যাবিলনের নয়, মুম্বইতেও একট আছে) যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেটা পাঁচটায় বন্ধ তাই আর গিয়ে লাভ নেই । সবাই হোটেলে ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল । বাকিরা ট্যাক্সিতে চলে গেল আর আমি হেঁটে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম । গেটওয়ে অফ্‌ ইন্ডিয়া থেকে আমাদের হোটেল হেঁটে আধঘন্টার বেশি লাগবে না, তাই শহরটাকে একটু পরিক্রমা করার জন্য হাঁটা শুরু করলাম ।

ফ্লোরা ফাউন্টেন
রাস্তায় যে উল্লেখযোগ্য জিনিসগুলো দেখলাম সেগুলো আগে লিখে নিই । মুম্বই মিউজিয়াম, বি এস ই বা বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ এর বিশাল ঢ্যাঙা বাড়িটা, মুম্বই ইউনিভার্সিটি, ফ্লোরা ফাউন্টেন, ওরিয়েন্টাল বিল্ডিং এবং অবশ্যই সি এস টি । একটা কথা স্বীকার না কর উপায় নেই যে মুম্বইয়ের রাস্তাঘাট বেশ পরিষ্কার এবং লোকজনও রাস্তায় নিয়ম মেনে চলে বা গাড়ি চালায় । রাস্তায় হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিল ।

হোটেলে ফিরে এসে আবার তৈরি হলাম বেরোনোর জন্য । আমাদের মুম্বই ভ্রমণ প্রায় শেষের দিকে, এবার আমরা গেলাম মুম্বইয়ের বিখ্যাত মেরিন ড্রাইভের দিকে । হোটেল থেকে ট্যাক্সি নিয়ে মেরিন ড্রাইভের ওপর দিয়ে আমরা পৌঁছলাম চৌপাট্টি-তে । রাস্তাটা অনবদ্য । বহু হিন্দী ছবিতে মেরিন ড্রাইভ দেখানো হয় তাই মেরিন ড্রাইভ কেমন দেখতে সেটা আর কাউকে বলে দিতে হয় না । তবে জায়গাটা দিয়ে যেতে বা দাঁড়িয়ে থাকতে অসাধারণ লাগে সেটা বলতেই হবে ।

চৌপাট্টি
চৌপাট্টিতে আমরা সমুদ্রের ধারে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম । সূর্য্যাস্ত হয়ে গেছে, আকাশের আলোটা দেখবার মতো হয়েছে । দেখতে পেলাম মেরিন ড্রাইভের আলোগুলো জ্বলে উঠল । এই জিনিসটাকে 'কুইন্স নেকলেস' বলে । চৌপাট্টিতে প্রচুর খাবারের দোকান আছে । আমরা সেখান থেকে বড়াপাও খেলাম । যারা খেতে ভালোবাসে তাদের উদ্দেশ্যে জানাই, মুম্বই বা মহারাষ্ট্রের লোকজন বড়াপাওকে একটা প্রচন্ড ঘ্যাম খাবার মনে করলেও জিনিসটা আদপেও তা নয় । দু'টো বান-পাঁউরুটি র মধ্যে একটা বড় সাইজের ডালবড়া - ব্যাস । এবং খেতে সেরকম ভালো কিছু নয় । যাই হোক, এরপর আমরা ফুচকা, কুলফি ইত্যাদি খেয়ে আবার ফেরার পথ ধরলাম ।

হোটেলে ফিরে জিনিসপত্র গুছিয়ে হোটেল থেকে বেরোলাম তখন সাড়ে ন'টা । আমাদের পরবর্তী গন্তব্য 'গণপতিপুলে' । সেখানে যাওয়ার জন্য আমরা সি এস টি থেকে ট্রেন ধরে নামব রত্নগিরি । রত্নগিরি থেকে গণপতিপুলে গাড়িতে প্রায় একঘন্টা ।

আমাদের মুম্বই ভ্রমণ শেষ । এটা ঠিক যে আমরা আমাদের এই দু'দিনের সফরে মুম্বই শহরের প্রায় কিছুই দেখিনি । তবে যা দেখেছি সেই আলিবাগ বা এলিফ্যান্টা আমাদের খুবই ভালো লেগেছে । সেই ভালোলাগার অনুভূতি সঙ্গে নিয়েই শেষ করছি ব্লগের 'মুম্বই ভ্রমণ' ।

সারসংক্ষেপঃ

১. হাওড়া থেকে মুম্বই যাওয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্রেন হল মুম্বই মেল । এছাড়া হাওড়া-মুম্বই দুরন্ত আছে কিন্তু এটা সপ্তাহে প্রতিদিন চলে না ।
২. যদি ট্রেনের ক্যান্টিনের খাবার ভালো না লাগে, তাহলে কাম-সাম থেকে নেওয়া যেতে পারে । এদের সুবিধে হল যেকোনও বড় স্টেশনেই এদের কাউন্টার আছে, আর ফোন করে অর্ডার দিলে আর সেইসঙ্গে কোচ নম্বর আর বার্থ নম্বর বলে দিলে এরা ট্রেনে এসে খাবার দিয়ে যায় ।
৩. মুম্বইতে অসংখ্য হোটেল আছে, তবে কম দামে হোটেল পাওয়া প্রায় অসম্ভব । আমরা ছিলাম ক্রওফর্ড মার্কেটের 'নিউ বেঙ্গল হোটেল'-এ । হোটেলের মান দারুণ কিছু না হলেও মোটামুটি দামের মধ্যে চলনসই । এদের ওয়েবসাইট http://www.hotelnewbengal.net/ থেকে সরাসরি বুকিং করা যেতে পারে বা এদের কলকাতার অফিস থেকেও বুকিং করা যেতে পারে । যোগাযোগ 033-22486664.
৪. মুম্বইতে বেশ কিছু ঘোরার জায়গা আছে তাদের মধ্যে গেটওয়ে অফ্‌ ইন্ডিয়া, মেরিন ড্রাইভ, হ্যাঙ্গিং গার্ডেন, চৌপাট্টি, জুহু, মিউজিয়াম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । যদিও আমাদের সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আমরা এর মধ্যে শুধুমাত্র মেরিন ড্রাইভ আর চৌপাট্টিই দেখতে পেরেছি ।
৫. মুম্বই থেকে জলপথে আলিবাগে যাওয়া যেতে পারে । এখানকার শিবাজীর কেল্লা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ।
৬. মুম্বই থেকে জলপথে এলিফ্যান্টা দ্বীপে গিয়ে এলিফ্যান্টা গুহা অবশ্যই দেখা উচিৎ । পাহাড় কেটে তৈরি প্রায় ছ'শ - ন'শ বছরের পুরনো এই গুহার ভেতরের ভাস্কর্য ভীষণরকমই চিত্তাকর্ষক ।
৭. মুম্বই গেলে একবার অন্তত মেরিন ড্রাইভে যাওয়াই উচিৎ । দিন বা রাত যেকোনও সময়েই এর দৃশ্য অনবদ্য ।

মুম্বই ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

গণপতিপুলে ভ্রমণঃ

মুম্বই থেকে রত্নগিরি যাওয়ার জন্য রাত ১১ : ০৫ এ ছাড়ে কোঙ্কন কন্যা এক্সপ্রেস । এবারে আমরা স্লীপার ক্লাসের টিকিট কেটেছিলাম । রত্নগিরি পৌঁছনোর সময় হল পরেরদিন সকাল ৫ : ৩০ । আমরা হোটেল থেকে ডিনার প্যাক করে নিয়েছিলাম, ট্রেনে বসে সেগুলো খেয়ে ফেললাম । মেনু ছিল রুটি আর চিকেন বাটার মশালা ।

রত্নগিরি যাওয়ার এই রেলপথের নাম হল ‘কোঙ্কন রেলওয়ে’ । আমি আগেই শুনেছিলাম কোঙ্কন রেলওয়ের পথটা খুব সুন্দর, অনেকটা অংশই পাহাড় ও নদীর মধ্যে দিয়ে । যেহেতু আমরা পুরো পথটাই রাতে যাচ্ছি, কাজেই সেসব দেখার সুযোগ আপাতত নেই । শুয়ে পড়লাম ।

আমার ট্রেনে সাধারণতঃ ঘুম হয় না, আলো ফোটার পর দরজার ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম । বাইরের দৃশ্য সত্যিই খুব সুন্দর । রেলপথটা পুরোটাই পাহাড়ের ভেতর দিয়ে, মাঝে মাঝে পাশে নদী চলেছে । পথটা অনেকটা উঁচু । মাঝে মাঝে ট্রেন টানেলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে । একেকটা টানেল বেশ লম্বা । রত্নগিরি পৌঁছনোর কিছুক্ষণ আগে একটা টানেল পড়ল সেটা যেন শেষই হতে চাইছিল না । আমার ধারণা সেটা প্রায় ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ । আমরা যারা সমতলে থাকি, পাহাড়ের টানেলের মধ্যে দিয়ে ট্রেনে যাওয়ার সুযোগ যাদের কদাচিৎ হয়, তারা এই জিনিস দেখে যে অভিভূত হয়ে পড়বে তাতে আর সন্দেহ কি ?

এই সুন্দর পথে চলতে চলতেই সুন্দর স্টেশন রত্নগিরি এসে গেল । আমাদের ট্রেন আধঘন্টা মতো লেট ছিল । রত্নগিরি স্টেশনটা বলতে গেলে একটা পাহাড়ের মাথায়, স্টেশন থেকে বেরোতে গেলে আরও কিছুটা ওপরে উঠতে হয় । এবার আমাদের কাজ গণপতিপুলে যাওয়ার গাড়ি জোগাড় করা ।

রত্নগিরির পথ ধরে
রত্নগিরি থেকে গাড়ি পাওয়াটা খুব একটা সহজ নয় । প্রথমতঃ স্টেশনটা খুব বড় কিছু নয়, তাই স্টেশনে কোনও গাড়ির স্ট্যান্ড নেই । যেটা আছে সেটা অটোর স্ট্যান্ড । এখান থেকে অটো গণপতিপুলে যায় কিন্তু আমাদের মালপত্র নিয়ে সেভাবে যাওয়া সম্ভব নয় । অনেক খোঁজাখুঁজি করে শেষপর্যন্ত্য দু’টো গাড়ি পাওয়া গেল । দু’টো গাড়ি মিলিয়ে পড়ল ২,৮০০ টাকা ।

গণপতিপুলের পথে সমুদ্রের দৃশ্য

রত্নগিরি জায়গাটা বেশ সুন্দর । বেশ ফাঁকা ফাঁকা মালভূমি ধরনের জায়গা । রাস্তাগুলো মাঝে মাঝে অনেকটা ওপরে উঠে গেছে আবার কখনও কখনও নেমে গেছে । এইভাবে প্রায় মিনিট চল্লিশেক চলার পরে হঠাৎ আমাদের পাশে চলে এল সমুদ্র । পাহাড়ের ওপর থেকে এভাবে আমি কখনও সমুদ্র দেখিনি । জলে প্রচন্ড ঢেউ না থাকলেও পরিষ্কার জলটা দেখতে দারুণ লাগছিল । এই দৃশ্যই রত্নগিরি থেকে গণপতিপুলে যাওয়ার পথে সবথেকে বড় পাওনা ।

গণপতিপুলে পোঁছলাম তখন সকাল ৭ : ৪৫ । এখানে আমাদের বুকিং ছিল এম টি ডি সি-র (মহারাষ্ট্র ট্যুরিজম্‌ ডেভেলপ্‌মেন্ট কর্পোরেশন) রিসর্টে । আমাদের বুকিং সকাল ১০ টা থেকে । এরা বলল তার আগে কোনও ঘরই ফাঁকা হবে না, তাই আমাদের ১০ টা পর্যন্ত বসে থাকতে হবে । তবে ঘর না পেলেও একটা কমন্‌ রেস্ট রুম আছে সেখানে ফ্রেশ হয়ে নেওয়া যেতে পারে ।

গণপতিপুলে রিসর্টের ভেতর
রিসর্টের ভেতরটা খুব সুন্দর – গাছপালা বা বাগানের নিয়মিত পরিচর্যা করা হয় । একেকটা দোতলা বিল্ডিং-এ মোট বারোটা করে ঘর । জায়গাটা সবমিলিয়ে বেশ বড় । প্রত্যেকটা বিল্ডিং-এর সামনে একটা ছোট পার্কের মতো জায়গা, সেখানে স্লীপ, দোলনা, ঢেঁকি, বসার জায়গা ইত্যাদি আছে ।

রিসর্টে আমাদের কটেজ
এরকমই একটা বিল্ডিং-এর দোতলায় আমাদের চারটে ঘর দেওয়া হল । একটায় আমরা চারজন, একটায় কঙ্কনাদিরা চারজন, আর বাকি দু’টোয় বৈশাখী ও সমীরণদারা । ঘরগুলো খুবই সুন্দর এবং বেশ বড় । চারজন থাকার জন্য একটা করে ডাবল্‌ বেড আর দু’টো করে গদি দেয় । প্রত্যেকটা ঘরের লাগোয়া একটা ব্যালকনি আছে সেখান থেকে সমুদ্র দেখা যায় । সামনের নারকোল গাছের মধ্যে দিয়ে এই দৃশ্য অসাধারণ !

গণপতিপুলে বীচ্‌
আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে সমুদ্রের গেলাম চান করতে । আমি এর যতবার সমুদ্রে গেছি, বঙ্গোপসাগরেই গেছি - কখনও আরব সাগরে চান করিনি, এবারেই প্রথম করলাম (না, আলাদা কিছু লাগল না !) । আরব সাগরে এমনিতে ঢেউ কম, তবে গণপতিপুলে অঞ্চলে সমুদ্রের ঢাল বেশ বেশি, তাই এখানে ঢেউ বেশি আর সেই সঙ্গে সঙ্গে আন্ডার কারেন্টও বেশি । আর এখানকার জলের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল জলটা বেশ নীল, বিশেষ ঘোলা নয় । জলে চালানোর জন্য আবার ওয়াটারক্র্যাফটও ভাড়া পাওয়া যায় ।

প্রায় ঘন্টাখানেক চানটান করে জল থেকে উঠে এলাম । সমুদ্রে চান করলেই প্রচন্ড খিদে পায় আর ঠিক পাড়েই যখন শাঁসালো ডাব বিক্রি করে, তখন খিদেটা আরও বেড়ে যায় । যাই হোক, ডাব টাব (টাব মানে ডাবের শাঁস) খেয়ে ঘরে এসে আবার চান করে নিলাম ।

এখানে একটা বেশ বড় ডাইনিং এরিয়া আছে । দুপুরে ভাত, ডাল, তরকারি, মাংস, ফ্রাইড রাইস, চিলি চিকেন ইত্যাদি খাওয়া হল । খাবারের মান ভালো, কিন্তু এদের একটা সমস্যা হল এরা খাবার সার্ভ করতে ভীষণ দেরি করে । খাওয়ার পরে যে যার ঘরে এসে বিশ্রাম নিলাম ।

সমুদ্রের ওপর মেঘের আড়ালে সূর্য্যাস্ত
বিকেলে আরেকবার সমুদ্রের ধারে যাওয়া হল । গণপতিপুলেতে সমুদ্র ছাড়া আর কিছুই নেই, তবে এখানকার বীচটা খুব সুন্দর, বসে থাকতে ভালোই লাগে । বীচে তিনচাকার মোটরবাইক, টয়ট্রেন ইত্যাদি চলে । বসে বসে সূর্য্যাস্ত দেখলাম । এটা আমার দেখা আরেকটা বিশেষ জিনিস – সমুদ্রের ওপর সূর্য্যাস্ত । সাধারণতঃ বঙ্গোপসাগরে বীচগুলোয় অর্থাৎ দীঘা, পুরী, তাজপুর, মন্দারমণি, শঙ্করপুরে আমরা সূর্য্যোদয়ই দেখি, সূর্য্যাস্ত দেখা যায় না কারণ এইসব জায়গায় সমুদ্রের ওপর সূর্য্যাস্ত হয় না । গণপতিপুলেতে ঠিক এটাই দেখা গেল কারণ আরব সাগর ভারতের পশ্চিমে । অবশ্য পুরোটা দেখা গেল না, কারণ শেষটা সূর্য্য মেঘে ঢেকে গেছিল ।  তবে দিনের শেষ আলোয় যে বর্ণচ্ছটা, সেই পাওনাটাই বা কম কি ?

এরপরে আর কিছু করার নেই – কিছু দেখারও নেই । সন্ধ্যেবেলা চা-টা খেয়ে আড্ডা মেরে সময় কাটল । রাতে খাওয়ার সময়ে মোটামুটি দুপুরের মেনুই নেওয়া হল আর এরা দুপুরের মতোই দিতে দেরিও করল । আমরা পরেরদিন সকালে এখান থেকে বেরিয়ে যাব – আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ‘সির্ডি’ । সেইমতো রাতেই ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে রেখে শুয়ে পড়লাম । আমাদের চারজনের মধ্যে আমি ব্যালকনিতে শুলাম । এখানে নিরাপত্তার কোনও সমস্যা নেই, তাই ব্যালকনির দিকের দরজা খুলেই রাখলাম । মজার ব্যাপার, সমুদ্রের একেবারে ধারে হওয়া সত্ত্বেও বারান্দার হাওয়া একেবারেই দিচ্ছিল না । তবে বাইরেটা খুব গরম না হওয়ায় শুয়ে থাকতে ভালোই লাগছিল ।

আমাদের ব্যালকনি থেকে সমুদ্র
পরেরদিন সকালে আমাদের গাড়ি এল তখন ছ’টা । এটা একটা ১৮ সীটের টেম্পো-ট্রাভেলর । সেই গাড়ি আমাদের আবার রত্নগিরি পৌঁছে দিল তখন সাতটা বাজে । রত্নগিরি থেকে আমরা নাসিকের ট্রেন ধরব । নাসিক থেকে আবার গাড়ি করে সির্ডি । সেখানে ভ্রমণটা আসবে আমার ‘মহারাষ্ট্র ভ্রমণ’-এর পরবর্তী অংশে । আপাতত ‘গণপতিপুলে ভ্রমণ’ এই পর্যন্তই ।

সারসংক্ষেপঃ

১. মহারাষ্ট্রের সমুদ্র সৈকতে গণপতিপুলে একটা সুন্দর ঘোরার জায়গা । কলকাতা থেকে শুধু গণপতিপুলে যাওয়ার কোনও মানে না হলেও মুম্বই গেলে এখানে একবার যাওয়া যেতেই পারে । বিশেষ করে যারা মুম্বইতে বা মহারাষ্ট্রের উপকূল এলাকায় থাকে, তারা একবার এখানে ঘুরে আসতেই পারে ।
২. গণপতিপুলের নিকটতম রেলওয়ে স্টেশন রত্নগিরি । এখান থেকে গণপতিপুলে যাওয়ার জন্য গাড়ি বা অটোরিক্সা পাওয়া যায় । রত্নগিরি থেকে গণপতিপুলে যেতে একঘন্টার মতো লাগে ।
৩. গণপতিপুলেতে কিছু হোটেল থাকলেও এম টি ডি সি র রিসর্টটাই সবচেয়ে সুন্দর এবং সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় । ভাড়া একটু বেশি হলেও এখানেই থাকা শ্রেয় । এদের ওয়েবসাইট http://mtdcrrs.maharashtratourism.gov.in/Account/Login.aspx থেকে সরাসরি বুকিং করা যেতে পারে ।
৪. এম টি ডি সি-র রিসর্টটা সমুদ্রের একেবারে ধারেই । ঘর থেকেই সমুদ্র দেখতে পাওয়া যায় ।
৫. এখানকার সমুদ্রের রঙ বেশ নীল । এখানে সমুদ্রে ঢেউও বেশ ভালো, তাই চান করেও আনন্দ পাওয়া যায় ।
৬. এম টি ডি সি-র খাওয়াদাওয়া ভালোই, তবে দাম একটু বেশি ।

গণপতিপুলে ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

সির্ডি ভ্রমণঃ

রত্নগিরি থেকে নাসিক যাওয়ার জন্য মঙ্গলা – লাক্ষাদ্বীপ এক্সপ্রেস ছাড়ে সকাল ৭ :  ৪০ এ । আমাদের ট্রেন এল মিনিট দশেক দেরিতে । এই রেলপথও কোঙ্কন রেলওয়ে – আমরা আগেরদিন যে পথ দিয়ে এসেছি সেই পথেই পানভেল পর্যন্ত্য ফিরে যাব । পানভেল থেকে পথ আলাদা হবে । অর্থাৎ এখন যেতে যেতে আমরা দিনের আলোয় দেখতে পাব কোঙ্কন রেলওয়ের অসাধারণ সৌন্দর্য্য ।

কোঙ্কন রেলওয়ে
গেলাম – দেখলাম – এনজয় করলাম । সত্যিই অনবদ্য দৃশ্য । আগেরদিন সকালে যে দৃশ্য অল্পক্ষণের জন্য দেখতে পেয়েছিলাম সেই দৃশ্যই অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম । একের পর এক পাহাড়, তার মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের ট্রেন । একটা পাহাড়ের টানেল থেকে বেরোচ্ছে তো আরেকটায় ঢুকে পড়ছে । পুরো রাস্তাটাই পাহাড়ের ওপর দিয়ে, নিচে – বহুনিচে মাঝে মাঝে মানুষজন বসতি দেখা যাচ্ছে । চাষের ক্ষেত, নদী, জলাশয় সবমিলিয়ে এত সুন্দর লাগছিল যে সেটা লিখে বোঝানো কঠিন । এটুকু বলতেই পারি সির্ডিতে গিয়ে সাঁইবাবার মন্দির দেখে কার কিরকম ভালো লাগবে জানি না তবে আমাদের সির্ডি ভ্রমণের ষোলো আনার মধ্যে বারো আনা উশুল এই যাত্রাপথেই ।

কোঙ্কন রেলওয়ের আরও দৃশ্য
ট্রেনটা পাহাড়ী পথে বেশ ঠিকঠাক সময়ে চললেও সমতলে নামবার পর বেশ লেট করা শুরু করল । এছাড়া আমরা আরেকটা সমস্যায় পড়লাম আর সেটা হল লাঞ্চ নিয়ে । ট্রেনের ক্যান্টিনের যা লাঞ্চ তা আমাদের কারুরই পছন্দ হল না । কিন্তু ট্রেন সেরকম কোনও বড় স্টেশন দিয়েও যায় না যেখান থেকে লাঞ্চ তুলে নেওয়া যেতে পারে । এই পরিস্থিতিতে আমরা ক্যান্টিন থেকে কিছু ব্রেকফাস্ট নিয়ে নিলাম – পাঁউরুটি টোস্ট, ধোসা, বঢ়া ইত্যাদি । সেগুলোই লাঞ্চে খেয়ে নেওয়া হল ।

ট্রেনের নাসিক রোড পৌঁছনোর সময় হল বিকেল ৪ :  ৩৫ আর লেট করে সে পৌঁছল তখন সাড়ে পাঁচটা । নাসিক থেকে সির্ডি আরও ১০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি, গাড়িতে প্রায় তিনঘন্টা লাগে । আমরা দু’টো গাড়ি বুক করে এগিয়ে চললাম সাঁইবাবার ডাকে সাড়া দিতে !

নাসিক থেকে সির্ডি - পথের বিবরণ দেওয়ার কিছু নেই । এটা একটা হাইওয়ে – আর পাঁচটা হাইওয়ের মতোই । মাঝে একবার একজায়গায় থেমে কিছু খেয়েদেয়ে নেওয়া হল । শেষপর্যন্ত্য আমরা সির্ডিতে আমাদের হোটেলে যখন পৌঁছলাম তখন রাত ন’টা ।

হোটেল অশোকা এক্সিকিউটিভের ঘর
সির্ডিতে আমাদের হোটেলের নাম হোটেল ‘অশোকা এক্সিকিউটিভ’ । শুধু আমি নয়, আমাদের দলের সকলের মতেই এই হোটেলটা আমাদের মহারাষ্ট্র ভ্রমণের মধ্যে সবচেয়ে ভালো হোটেল । ঘরগুলো প্রসস্ত, সুন্দরভাবে পরিচর্যা করা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । এবং সেই অনুপাতে ভাড়া সেরকম কিছু বেশি নয় । এখানেও আমরা একটা চারবিছানার ঘর নিয়েছিলাম । সির্ডিতে আমাদের থাকার মেয়াদ খুব অল্প সময়, পরেরদিন সকালেই আমরা রওনা হয়ে যাব ঔরঙ্গাবাদ তথা ইলোরার উদ্দেশ্যে । বারবারই মনে হচ্ছিল এরকম সুন্দর একটা হোটেলে আরও কিছুক্ষণ থাকতে পারলে মন্দ হত না !

অশোকা এক্সিকিউটিভের নিজস্ব কোনও খাওয়ার ব্যবস্থা নেই । এবং সির্ডিতে আরেকটা অসুবিধে হল এখানে আমিষ রেস্ট্যুরেন্ট খুব কম । যাই হোক, বেশ খুঁজে পেতে একটা পাওয়া গেল যেটা আমাদের হোটেল থেকে যেদিকে সাঁই মন্দির, তার উল্টোদিকে মিনিট সাতেক হাঁটা দূরত্বে । এখানেও যেটা ভালো লাগল যে খাবারের মান বেশ ভালো এবং সেই অনুপাতে দাম বেশ কম । আমরা নানারকম খাবার ভাগাভাগি করে নিয়েছিলাম এবং তাতে মাথাপিছু খরচ পড়ল ১৫০ টাকা ।

৩০শে মে, ২০১৪ শুক্রবার । আমাদের সাঁই মন্দির দেখে ঔরঙ্গাবাদ যাওয়ার দিন । সাঁই মন্দির খোলে সকাল ছ’টায় । আমরা সকালে বেরিয়ে কয়েকটা অটো করে মন্দিরে গেলাম । এখান থেকে মন্দিরের অটোভাড়া মাথাপিছু ১০ টাকা করে, তবে সেটা আগে থেকে জানা না থাকলে অটোওয়ালারা যা খুশি তাই বলে । আমাদের হোটেল থেকে এটা আমাদের আগেই জানা ছিল ।

সাঁই মন্দিরে কোনও বৈদ্যুতিন দ্রব্য নিয়ে ঢোকা নিষিদ্ধ । আমাদের সঙ্গে থাকা ক্যামেরা মোবাইল চটি (হ্যাঁ, আমি জানি চটি বৈদ্যুতিন দ্রব্য নয়) সবই মন্দিরের গেটের উল্টোদিকে একটা দোকানে রেখে দিলাম । এই দোকান থেকেই আমাদের পুজোর সামগ্রী কেনা হল । তারপর মন্দিরের গেটের ভেতরে ঢুকে লাইন দেওয়া । মন্দিরের লাইনের একটা বৈশিষ্ট্য হল এখানে পুরো জায়গাটাই লোহার বেড়া দিয়ে চ্যানেল মতো করা আছে, সেখান দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে । এইভাবে এগিয়ে যেতে যেতে একজায়গায় দেখলাম একটা বিশাল হলঘরের মতো জায়গায় টাকা গোনা হচ্ছে । বুঝলাম সাইঁবাবার প্রণামী বাক্সে যা জমা পড়ে সেগুলোর হিসেব করা হচ্ছে । আরেকটু এগোতে একটা কাউন্টারের সামনে দিয়ে আমাদের লাইনটা গেল সেখানে একটা ছোটো প্যাকেটে দু’টো করে লাড্ডু বিতরণ করা হচ্ছে (একজনকে একটা প্যাকেটই দেয়, আমি দু’টো পাওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই লোকটা আমার দিকে কট্‌মট্‌ করে তাকালো) । সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হল পুজো দেব কি দেব না, তার ওপর এই লাড্ডু প্রাপ্তি নির্ভর করে না, এটা এরা সকল দর্শনার্থীদেরই দেয় । একটু এগোতেই দেখলাম একজায়গায় এই লাড্ডু পাকানো হচ্ছে (আহাঃ, দুর্দান্ত ঘিয়ের গন্ধের কথা মনে পড়ে আমার এখনও জিভে জল এসে যাচ্ছে) ।

যাই হোক, এইভাবে এগোতে এগোতে একসময়ে সাঁইবাবার মর্মরনির্মিত মূর্তির সামনে পৌঁছলাম এবং দেখে দর্শন করে বেরিয়েও এলাম । মন্দিরটা সবমিলিয়ে বেশ ভালো – সবচেয়ে বড় কথা হল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, মারামারি ঠেলাঠেলি নেই, পান্ডা/পূজারীদের হম্বিতম্বি নেই এবং অবশ্যই বিনামূল্যে দুর্দান্ত লাড্ডু আছে । সবমিলিয়ে দেখতে আমাদের লাগল ঘন্টা দেড়েক আর এখানকার লোকের মতে ফাঁকা থাকার জন্যই এত কম সময়ে হয়ে গেছে !

আমাদের গাড়ি আগেই ঠিক করা ছিল, অটোয় হোটেলে ফিরে এসে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব রেডী হয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঔরঙ্গাবাদের উদ্দেশ্যে । এবারেও দু’টো গাড়ি । কিছুদূর এগিয়ে একজায়গায় রাস্তার ধারে একটা হোটেলে আমরা আলুর পরোটা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম । সবমিলিয়ে খরচ পড়ল ৭৫০ টাকা ।

‘সির্ডি ভ্রমণ’ এখানেই শেষ । এরপর আসবে আমাদের ভ্রমণের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ‘ইলোরা ভ্রমণ’ ।

সারসংক্ষেপঃ

১. সির্ডি জায়গাটা সাঁইবাবার মন্দিরের জন্যই বিখ্যাত । মনে ভক্তি থাকুক বা না থাকুক, মন্দিরটা একবার দেখে আসা যেতেই পারে ।
২. সাঁইবাবার মন্দির ছাড়া সির্ডিতে দেখার আর কিছুই নেই । তাই এখানে কোনও কারণেই একদিনের বেশি থাকার মানে হয় না কারণ জায়গাটা বেশ ঘিঞ্জি, বিশ্রাম নেওয়ার জন্যও এখানে থাকার মানে হয় না ।
৩. সির্ডিতে আমিষ রেস্ট্যুরেন্টের একটু অভাব রয়েছে । খুঁজলে পাওয়া যায় না তা নয়, তবে না খুঁজে পাওয়া কঠিন ।
৪. নিজের জানাশোনা কোনও হোটেলে যদি না থাকে, তাহলে সির্ডিতে গিয়ে ‘অশোকা এক্সিকিউটিভ’এ থাকার জন্য বলব । এই ভাড়ায় এত ভালো হোটেলে পাওয়া সত্যিই সহজ নয় । এদের ওয়েবসাইট http://hotelashokaexecutive.com/ থেকে বুকিং করা যেতে পারে অথবা http://hotel.makemytrip.com/ থেকেও বুকিং করা যেতে পারে ।

(লেখার সঙ্গের ছবি ছাড়া সির্ডিতে আর কোনও ছবি তোলা হয়নি, তাই সির্ডি ভ্রমণের আরও ছবির কোনও লিঙ্ক দেওয়া হল না ।)

ইলোরা ভ্রমণঃ

সির্ডি থেকে ঔরঙ্গাবাদ যাওয়ার পথেই পড়ে ইলোরা । সে’জন্য সির্ডি থেকে যেতে হলে পথেই ইলোরা দেখে ঔরঙ্গাবাদ যাওয়া উচিত কারণ ঔরঙ্গাবাদ থেকে ইলোরা বেশ অনেকটাই দূরে । আমরা যে গাড়িগুলো ঠিক করেছিলাম, সেগুলোর সঙ্গে কথা ছিল তারা আমাদের সির্ডি থেকে ঔরঙ্গাবাদ পৌঁছে দেবে এবং পথে চারটে জায়গা দেখাবে । সেই জায়গাগুলো হল – গৃষ্মেশ্বর মন্দির, ইলোরা গুহা, ভদ্রমূর্তি মন্দির এবং বিবি কা মক্‌বারা । গাড়িওয়ালারা জোর করলেও এদের মধ্যে গৃষ্মেশ্বর মন্দির আর ভদ্রমূর্তি মন্দিরে গিয়ে সময় নষ্ট করার একেবারেই মানে হয় না ।

সির্ডি থেকে প্রায় ৯৫ কিলোমিটার দূরে আর ঔরঙ্গাবাদ থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে আমাদের প্রথম দেখার জায়গা গৃষ্মেশ্বর মন্দির । এটা একটা অত্যন্ত সাধারণ মন্দির তবে লোকজনের লাইন পড়ে মোটামুটি । এখানে দর্শনের জন্য প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লেগে যাবে বলে আমরা সেই উদ্দেশ্য ত্যাগ করলাম । এখানে আসার প্রধান লক্ষ্য হল ইলোরা গুহা দেখা – সেখানে যতটা সম্ভব বেশি সময় কাটানো ।

গৃষ্মেশ্বর মন্দির থেকে ইলোরা গুহা খুবই কাছে । ইলোরাও ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের তত্বাবধানে এবং ১০ টাকা করে টিকিট । গেটে ঢোকার পর আরও বেশ কিছুটা পাহাড়ের ওপর উঠে প্রথম দেখার জায়গায় পৌঁছনো যায় ।

ইলোরার গুহা
এখানে বলে রাখি ইলোরায় সবমিলিয়ে যা দেখার আছে, তার জন্য এখানে একদিন থাকলে ভালো হয় । ইলোরার গুহার কাছেই মহারাষ্ট্র ট্যুরিজম এর থাকার ব্যবস্থা আছে, চাইলে এখানে থাকা যেতে পারে । আর একটু ভালোভাবে দেখে বোঝার জন্য কিছুটা পড়াশোনা করে নিলে ভালো হয় । তবে বেশি আগ্রহ না পেলে শুধুমাত্র প্রধান প্রধান গুহাগুলো দেখে নেওয়া যেতে পারে । আমাদের ভালোভাবে দেখার ইচ্ছে থাকলেও সময় বেশি ছিল না, তাই প্রধান গুহাগুলো দেখেই ফিরে আসতে হল ।

গাড়ি যেখানে দাঁড় করায় সেখান থেকে কিছুটা পায়ে হেঁটে ওপরে উঠে ৩০ – ৩৪ নম্বর গুহা । আমি ঐতিহাসিক বিস্তারিত তথ্যে যাচ্ছি না, ইন্টারনেটে খুঁজলে এই সম্পর্কে অনেক জানা যায় । তার চেয়ে আমরা কি দেখলাম আর আমাদের কিরকম লাগল, সেগুলো লিখি ।

ইলোরার গুহায় ইন্দ্রের মূর্তি
ইলোরার প্রধান বৈশিষ্ট্য এই গুহাগুলো সম্পূর্ণভাবেই পাহাড় কেটে তৈরি করা । আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে আমাদের দেশের শিল্পকীর্তি যে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, সেটা আমরা ছোটোবেলায় ইতিহাস বইতে অনেকবার পড়েছি । কিন্তু সেগুলো নিজের চোখে দেখার অভিজ্ঞতাই আলাদা । ডিনামাইট বা কোনওরকম বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের সাহায্য ছাড়া শুধুমাত্র ছেনি আর হাতুড়ির সাহায্যে এত নিপুনভাবে পাহাড় কেটে তৈরি এই গুহা এবং সেইসঙ্গে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মূর্তি এবং কারুকার্যের কথা ভাবতেই অবাক লাগে আর সেগুলো চোখের সামনে দেখলে বিস্ময় জাগে (অবাক হওয়া আর বিস্মিত হওয়ার মধ্যে আভিধানিক কোনও পার্থক্য নেই কিন্তু আমি এখানে বিস্ময় >> অবাক হিসেবে ব্যবহার করছি !) । দেবদেবী মানুষ পশুপাখি গাছপালা কি নেই সেই কারুকার্যের মধ্যে ! তখনকার দিনের মানুষের জীবনযাত্রা, ব্যবহারের সামগ্রী সবকিছুরই নিখুঁত প্রতিরূপ রয়েছে এই কারুকার্যের মধ্যে । এছাড়া রয়েছে গুহার দেওয়ালে আঁকা ছবি । ছবিতে রঙের ব্যবহার বিশেষ প্রশংসার দাবী রাখে । আমরা একজন গাইড নিয়েছিলাম । এরা যে অনেককিছু জানে বা দেখায় তা নয়, কিন্তু কিছু কিছু মূর্তি বা ছবি দেখিয়ে কিছু কিছু গল্প বলে যেগুলো শুনতে ভালো লাগে (মুর্শিদাবাদের মতিঝিলের গাইডের সেই কথাটা আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছিল
গুহার দেওয়ালে জীবনযাত্রার ছবি
– “জানলে ইতিহাস আর না জানলে মাটির দেওয়াল”) । আমাদের গাইড আমাদের অনেককিছু দেখালো আর বলে গেল – সবগুলো মনে নেই । তবে দু’টো জিনিসের কথা এখানে উল্লেখ করছি ।







হলঘর
এক, একটা থাম দেখাল যেটায় হাত দিয়ে জোরে মারলে তবলার মতো আওয়াজ বেরোয় ! গাইড আমাদের সেটা বাজিয়ে শোনাল - তারপর আমরা নিজেরাও ব্যাপারটা করে দেখলাম এবং মুগ্ধ হলাম । একটা নিরেট পাথরের থামের মধ্যে থেকে কিকরে এরকম শব্দ বেরোনো সম্ভব সেটা বেশ অদ্ভুত । গাইডও জানে না কারণ এই পুরো জিনিসটা একটা পাহাড় কেটে তৈরি – থামটা না ভেঙ্গে এর ভেতরে কি আছে, কিভাবে তবলার মতো শব্দ তৈরি হচ্ছে জানা সম্ভব নয় ।

দুই, একটা হলঘরের মতো ঘর । গাইড বলল – এটা ছিল উপাসনাগৃহ । ঘরটা বেশ বড়, জায়গায় জায়গায় পাথর কেটে থাক বসানো আছে । এই ঘরের সাউন্ড সিস্টেম হল এখানকার বৈশিষ্ট্য । তখনকার দিনে মাইক বা লাউড স্পীকারের ব্যবস্থা ছিল না, তাই এই ঘরে এমন ব্যবস্থা করা আছে যে ঘরের কেন্দ্রস্থলে বসে না চেঁচিয়ে কথা বললেও ঘরের সবাই সেটা শুনতে পাবে । আমাদের গাইড সেই জায়গাটায় গিয়ে ব্যাপারটা আমাদের করে দেখাল । আমরা আবার মুগ্ধ হলাম ।

এই গুহাগুলো দেখে আমরা আবার গাড়ি করে পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে এলাম । এবার আমাদের দ্রষ্টব্য হল ইলোরার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ – কৈলাস মন্দির ।

কৈলাস মন্দির
অষ্টম শতকে রাষ্ট্রকূট বংশের রাজত্বকালে তৈরি হয় এই কৈলাস মন্দির । এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এটা একটা পাথর কেটে তৈরি করা । মন্দিরটা দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে বেশ বড় । আমরা ভেতরে ঢুকে সব জায়গাটা ভালোভাবে ঘুরলাম । প্রধান মন্দিরটা দোতলা – দোতলাতেই মন্দিরের সামনে একটা চাতাল আর তারও সামনে একটা জায়গা যেখান থেকে অনেকটা জায়গা দেখা যায় । মন্দিরটা ঘিরে একটা বেশি বড় চাতাল আছে আর তাকে ঘিরে আবার আরেকদফা বারান্দার মতো । বড় চাতালটায় হাতির মূর্তি, ওবেলিস্ক-এর মতো বিশাল স্তম্ভ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।

আমাদের ইলোরার গুহা দেখা শেষ । আগেই বলেছি ইলোরার সবকিছু এত অল্প সময়ে দেখা অসম্ভব তবে এটাও ঠিক আমরা প্রধান জায়গাগুলোর সবই দেখেছি । ঘড়ি বলছে দুপুর সাড়ে তিনটে আর ইলোরা দেখার পরে মনের মধ্যে মুগ্ধতা ছাড়া আর যে অনুভূতিটা কাজ করছে তা হল খিদে – প্রচন্ড খিদে ।

ইলোরার অসুবিধে হল এখানে রেস্ট্যুরেন্ট খুব কম আর যাও বা আছে, সেগুলো আবার নিরামিষ । কিন্তু আর কোনও উপায় না থাকায় ঐ খেয়েই গর্ত বোজানো হল । তবে দু’একটা আইটেম খেতে বেশ ভালো হয়েছিল এটা না বললেই নয় । তবে – আফটার অল্‌ নিরামিষ, তাই কি কি খেলাম সেগুলো আর বিস্তারিত লিখছি না । সবমিলিয়ে খরচ পড়ল ২,১০০ টাকা ।

ভদ্রমূর্তি মন্দির
খাওয়ার পর আমাদের পরবর্তী দ্রষ্টব্য স্থান – ভদ্রমূর্তি মন্দির । ইলোরা থেকে এর দূরত্ব ৫ কিলোমিটারের মতো । এটাও একটা সাধারণ মন্দির – হনুমানের । এখানে হনুমানের একটা শোওয়ানো মূর্তি আছে । আগেই বলেছি এটাও না দেখলে চলবে ।





এরপর আমাদের দিনের শেষ গন্তব্য – বিবি কা মক্‌বারা । ঘড়িতে প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে আর ড্রাইভার বলল বিবি কা মক্‌বারা ছ’টায় বন্ধ হয়ে যায় তাই এই জায়গাটা আমাদের লিস্ট থেকে বাদ দিতে হল ।

এবার আসি একটা বিশেষ দরকারি ঘটনার ব্যাপারে । ভদ্রমূর্তি মন্দির থেকে বেরিয়ে আমাদের ড্রাইভাররা আমাদের সঙ্গে হঠাৎ খারাপ ব্যবহার করা শুরু করে দিল । আমাদের গাড়ির জন্য মোট দেওয়ার কথা ৬,৮০০ টাকা যার মধ্যে ৫,৫০০ টাকা আমরা ইতিমধ্যেই দিয়ে দিয়েছি । ড্রাইভারদের বক্তব্য হল বাকি টাকাও তাদের তখনই দিতে হবে, নাহলে তারা গাড়ি নিয়ে যাবে না । সেইসঙ্গে এদের আরও দাবী এরা আমাদের হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দেবে না কারণ ঔরঙ্গাবাদ শহরে ঢুকলে এদের নাকি পুলিশকে টাকা দিতে হবে । এই পুলিশকে টাকা দেওয়ার ব্যাপারটা আমরা গাড়ি বুক করার সময়েই শুনেছিলাম এবং সেইজন্য গাড়িপিছু পুলিশভাড়া ২০০ টাকা করে মোট ৪০০ টাকা ধরেই আমাদের ৬,৮০০ টাকা । কিন্তু ড্রাইভাররা কিছুই শুনতে রাজী নয় । ব্যাপারটা এরকম জায়গায় পৌঁছে গেল যে এদের দাবী না মানলে এরা এখান থেকে গাড়ি নিয়ে এগোবেই না । শেষপর্যন্ত ফয়সালা হল কিছু স্থানীয় লোকের মধ্যস্থতায় (যদিও মধ্যস্থতা বলছি কিন্তু আসলে লোকগুলো আমাদের হয়েই কথা বলেছিল) । এরাও গাড়ির ড্রাইভার – অন্য ট্যুরিস্ট নিয়ে এসেছে । এরা আমাদের কথা শুনে বুঝল যে আমরা যা বলছি তার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই, তাই এরা সবাইমিলে একরকম জোর করেই আমাদের ড্রাইভারকে আমাদের দাবী মেনে নিতে রাজী করালো । শেষমেশ গাড়ি চলল আর আমরা ঔরঙ্গাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । পরে আমাদের ঔরঙ্গাবাদের হোটেলের ম্যানেজারের কাছ থেকে শুনেছিলাম সির্ডির প্রত্যেক গাড়িওয়ালারাই নাকি এরকম । এরা একরকম কথা বলে সির্ডি থেকে বেরোয় আর এখানে এসে আরেক ঝামেলা করে । এদের উদ্দেশ্য থাকে ঔরঙ্গাবাদ থেকে সির্ডি ফেরার পথে যাত্রী নিয়ে যাওয়া আর সেইজন্য বেশিরভাগ সময়েই এরা ইচ্ছে করে ঝামেলা করে যাতে লোকে সব জায়গাগুলো না দেখতে পারে । আমরা পরেরদিন যখন বিবি কা মক্‌বারা দেখতে গেলাম, তখন আমি কাউন্টার থেকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম বিবি কা মক্‌বারা আসলে রাত দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে ।

ঔরঙ্গাবাদ যাওয়ার পথে রাস্তা থেকে আরেকটা জিনিস দেখতে পেলাম আর সেটা হল দৌলতাবাদ কেল্লা । এটা একটা পাহাড়ের মাথায় এবং এখানে কিছুদূর যাওয়ার পরে আর গাড়ি যায় না – বাকিটা হেঁটে উঠতে হয় । বলা বাহুল্য আমরা এখানে যাইনি, তবে যদি ঔরঙ্গাবাদ বা ইলোরায় একদিন থাকা যায়, তাহলে মহম্মদ-বিন-তুঘলকের আমলে তৈরি এই বিশেষ কেল্লাটা অবশ্যই দেখা উচিৎ (মহম্মদ-বিন-তুঘলক – পাগলা রাজা – দাক্ষিণাত্যে শাসনব্যবস্থা জোরদার করার জন্য রাজধানী দিল্লী থেকে দৌলতাবাদে স্থানান্তরণ – সেখানে দু’বছর থাকার পর ফের দিল্লীতে ফেরৎ আসা – মনে পড়ছে ?) ।

ঔরঙ্গাবাদের তোরণদ্বার
ঔরঙ্গাবাদ শহরের আরেকটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এর শহরে ঢোকার মুখের তোরণদ্বার । একসময়ে মোট ৫২ টা দ্বার থাকলেও বর্তমানে ছোটবড় মিলিয়ে মাত্র ১৩ টাই অবশিষ্ট আছে । এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে পুরনো হল ‘ভাদকাল দ্বার’ । আসলে দাক্ষিণাত্যে শাসনব্যবস্থা জোরদার করার জন্য ঔরঙ্গজেব যখন এখানে থাকা শুরু করেন তখনই নিরাপত্তার কারণে পুরো ঔরঙ্গাবাদ শহরটাকে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয় । সেই পাঁচিলের মাঝেই এই গেটগুলো । এখন অবশ্য পাঁচিলের খুব সামান্যই অবশিষ্ট আছে ।

আমরা হোটেল প্রীতম-এ পৌঁছলাম তখন তখন সাড়ে ছ’টা । হোটেলটা অসাধারণ কিছু না হলেও মোটের ওপর মন্দ নয় । এখানেও আমাদের মেয়াদ পরেরদিন সকাল পর্যন্ত, তাই রাতটা কাটানো নিয়ে কথা ।

ঔরঙ্গাবাদ মহারাষ্ট্রে হলেও মুম্বই বা উপকূলবর্তী জায়গা থেকে অনেকটাই পুবদিকে, তাই এখানে মুম্বইয়ের মতো অত বেশিক্ষণ আলো থাকে না । মোটামুটি সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে সন্ধ্যে হয়ে যায় ।

হোটেল প্রীতমের নিজস্ব খাওয়ার ব্যবস্থা নেই, তবে আশেপাশেই একাধিক খাবারের হোটেল আছে । সেরকমই একটা হোটেল থেকে রুটি, চিকেন, চাউমিন, ফ্রাইড রাইস ইত্যাদি নেওয়া হল । খরচ হল ১,১৮০ টাকা । অবশ্য আমাদের দলের দু’একজন অবশ্য দুপুরে দেরিতে খাওয়া হয়েছে বলে রাতে আর কিছু খেলো না । খাওয়া শেষ করে হোটেলে ফিরলাম তখন সাড়ে দশটা বেজে গেছে । সাড়ে দশটা ঔরঙ্গাবাদের পক্ষে বেশ ভালোই রাত । রাস্তায় লোক চলাচল কমে যায়, গাড়িও খুব বেশি দেখা যায় না, আর দোকানপাটও বন্ধ হয়ে যায় । আমাদের হোটেলের ম্যানেজার বলল – এখানে সকাল তাড়াতাড়ি হয় আর রাত দশটার বেজে গেলে আর বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না ।

ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম । পরেরদিন আমাদের গন্তব্য অজন্তা – আমাদের মুম্বই ভ্রমণের পঞ্চম তথা শেষ জায়গা । যাওয়ার পথে আমরা বিবি কা মক্‌বারা দেখে যাব ।

৩১শে মে, ২০১৪ শনিবার । সকাল আটটার সময়ে হোটেল থেকে মালপত্র নিয়ে দু’টো গাড়িতে করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম । আমরা প্রথমে যাব বিবি কা মক্‌বারা আর তারপর সোজা অজন্তা ।

বিবি কা মক্‌বারা
ঔরঙ্গাবাদ শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ‘বিবি কা মক্‌বারা’ বা মিনি তাজমহল । আগ্রায় মায়ের সমাধি আসল তাজমহল এর আদলে ঔরঙ্গজেব এটা তৈরি করান নিজের পত্নীর সমাধিস্থলে । বিবি কা মক্‌বারা দেখতে একেবারেই তাজমহলের মতো তবে আকারে কিছুটা ছোট । আর তাজমহলের সঙ্গে এর আরেকটা পার্থক্য হল এটা তাজমহলের মতো পুরোপুরি মার্বেল দিয়ে তৈরি নয়, নিচের দিকে কিছুটা মার্বেল দেওয়ার পর ওপরের দিকটা সারা রঙ করা । আর ঠিক সেইজন্যই তাজমহলের মতো এটা জলবায়ুর কারণে দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না ।

আমি ব্যক্তিগতভাবে তাজমহলের থেকে বিবি কা মক্‌বারাকে বেশি নম্বর দেব আর সেটা ঐতিহাসিক কারণে । আকবরের তৈরি করা অর্থভান্ডার শাহজাহান প্রায় নিঃশেষ করেছিলেন নিজের বিলাসিতা এবং শিল্পনির্মাণে । আর এই বিপুল অর্থভান্ডারের একটা বড় অংশ ব্যয় হয় তাজমহল তৈরিতে । সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে বিবি কা মকবারা যখন ঔরঙ্গজেব তৈরি করান, তখন মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থভান্ডার তলানিতে । সেইজন্যই হয়তো বিবি কা মক্‌বারার শুধু নিচের দিকটাই মার্বেল দিয়ে তৈরি । মুঘল সাম্রাজ্যের সেই ভরাডুবির সময়ে তাজমহলের আদলে আরেকটা স্মৃতিসৌধ তৈরি করার চেষ্টা করাটা রীতিমতো দুঃসাহসের পরিচয় !

ঔরঙ্গজেবের পত্নীর সমাধি
বিবি কা মক্‌বারাও ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ দেখাশোনা করে । এখানে গেটে ৫ টাকার টিকিট কেটে ঢুকতে হয় । জায়গাটা বেশ ফাঁকাই থাকে আর সকালের আলোয় দেখতে খুব সুন্দর লাগে । আমরা চাতালে কিছুক্ষণ বসে ভেতরে ঢুকে ঔরঙ্গজেবের পত্নীর সমাধি দেখে বেরিয়ে এলাম । বিবি কা মক্‌বারা ভালো করে ঘুরে দেখতে আধঘন্টার বেশি লাগে না ।


এরপর আমরা এগিয়ে চললাম অজন্তার দিকে । পথে আমাদের গাড়ি খারাপ হওয়ার জন্য প্রায় দেড় ঘন্টা দেরি হয়ে গেল । তারপর রাস্তায় এক জায়গায় পুরি-সবজী দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নেওয়া হল । এরপর সোজা অজন্তা । সেখানে ঘোরাটা আসবে এই পোস্টের শেষ অংশে ‘অজন্তা ভ্রমণ’ ।

সারসংক্ষেপঃ

১. ঐতিহাসিক স্থাপত্যকীর্তির জন্য ভারতের যে কয়েকটা জায়গা পৃথিবীবিখ্যাত ইলোরা তাদের মধ্যে অন্যতম । ছেনি আর হাতুড়ির সাহায্যে একটা গোটা পাহাড়কে কেটে ফেলে শিল্পের এই নিদর্শন পর্যটকদের বিস্ময়ের বিষয় ।
২. ইলোরার কাছাকাছি বড় শহর ঔরঙ্গাবাদে থেকে ইলোরায় যাওয়া যায় । তাছাড়া ইলোরায় মহারাষ্ট্র ট্যুরিজমের নিজস্ব থাকার ব্যবস্থা রয়েছে ।
৩. ইলোরা ভালোভাবে এবং সম্পূর্ণভাবে দেখতে গেলে একদিন যথেষ্ট নয় । তবে মোটামুটিভাবে প্রধান গুহাগুলো এবং সেইসঙ্গে কৈলাস মন্দির দেখার জন্য হাতে ঘন্টা তিনেক থাকলেই চলবে ।
৪. ইলোরা খোলে সকাল ন’টায় আর বন্ধ হয় বিকেল সাড়ে পাঁচটায় । এছাড়া প্রতি মঙ্গলবার ইলোরা বন্ধ থাকে ।
৫. ইলোরা ছাড়া এখানে কাছাকাছির মধ্যে আরও দু’টো মন্দির রয়েছে । গাড়ির ড্রাইভার হাজার পীড়াপীড়ি করলেও এগুলোর কোনওটাতেই যাওয়ার একেবারেই মানে হয় না ।
৬. ইলোরার কাছে সেরকম কোনও ভালো খাওয়ার জায়গা নেই । দু’তিনটে চলনসই নিরামিষ হোটেল আছে ।
৭. ইলোরা ছাড়া ঔরঙ্গাবাদের অন্যতম দর্শনীয় স্থান বিবি কা মকবারা । আগ্রায় তাজমহলের আদলে তৈরি এই স্মৃতিসৌধটা দেখতে খুবই সুন্দর । ঔরঙ্গাবাদ গেলে এখানে অবশ্যই যাওয়া উচিৎ ।
৮. কাছাকাছির মধ্যে দৌলতাবাদ কেল্লা আছে । পায়ের আর মনের জোর থাকলে পাহাড়ের ওপরে এই কেল্লাটা একবার গিয়ে দেখে আসা যেতেই পারে ।
৯. আমাদের হোটেল প্রীতমের নিজস্ব ওয়েবসাইট http://www.hotelpreetamaurangabad.com/ থেকে এখানে সরাসরি বুকিং করা যায় । এছাড়া http://www.goibibo.com/ থেকেও এখানে বুকিং করা যায় ।
বিশেষ সতর্কীকরণ – সির্ডি থেকে গাড়ি নিয়ে ঔরঙ্গাবাদে এলে ড্রাইভার ঝামেলা করার সম্ভাবনা প্রবল । সেক্ষেত্রে সির্ডি থেকেই গাড়ির সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলে নেওয়ার দরকার । আর গন্তব্যস্থানে না পৌঁছে কখনওই ড্রাইভারকে পুরো টাকা দেওয়া চলবে না, যা কথা হয়েছে কমপক্ষে তার ২০ - ২৫% বাকি রাখতেই হবে ।

ইলোরা ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

অজন্তা ভ্রমণঃ

অজন্তা যাওয়ার পথে
ছোটবেলা থেকে অজন্তা-ইলোরা একসঙ্গে শুনে মনে হয় এগুলো বুঝি পাশাপাশি, কিন্তু বাস্তবে তা একেবারেই নয় । ইলোরা বা ঔরঙ্গাবাদ থেকে অজন্তার দূরত্ব প্রায় ১১০ কিলোমিটার আর যেতে তিনঘন্টার মতো লাগে । আগেই বলেছি আমাদের গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ায় আমরা ঘন্টা দেড়েক দেরিতে চলছিলাম । ফলে শেষ পর্যন্ত যখন অজন্তায় পৌঁছলাম তখন প্রায় দুপুর দু’টো । অজন্তায় আমাদের বুকিং ছিল হোটেল কে পি পার্কে । হোটেলটা বেশ নতুন এবং ছিমছাম আর বেশ ছোটখাটো । আমরা হোটেলে ঢুকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রেডী হয়ে নিলাম কারণ আজই আমাদের অজন্তা গুহা দেখতে যেতে হবে । কে পি পার্ক একটা নিরামিষ হোটেল এবং এই অঞ্চলেও নাকি আমিষ হোটেল পাওয়া যায় না (ব্যাপার কি ? এরা এত নিরামিষভোজী কেন ?) । স্বাভাবিকভাবেই খাবারের দাম বেশ কম । আমরা নিরামিষ থালি নিলাম আর এর জন্য আমাদের সবমিলিয়ে ৯২০ টাকা খরচ হল ।

অজন্তার গুহা দেখার জন্য টি-জাংশন বলে একটা জায়গা আছে সেটা আমাদের হোটেল থেকে ২ কিলোমিটার মতো দূরে (টি-জাংশনের সঙ্গে চায়ের কোনও সম্পর্ক নেই, জায়গাটা T অক্ষরের মতো দেখতে বলে এই নাম) । বাইরের গাড়ি এই পর্যন্তই যেতে পারে আর এখান থেকে এম টি ডি সি-র বাস ধরতে হয় । আমাদের হোটেল থেকে টি-জাংশন পর্যন্ত ফ্রি ড্রপ আর পিক্‌আপ ছিল, সেই গাড়ি আমাদের যখন টি-জাংশনে নামালো তখন বেলা তিনটে বেজে গেছে ।

এম টি ডি সি-র বাসস্ট্যান্ড
টি-জাংশন থেকে এম টি ডি সি-র বাস প্রতি দশ মিনিট অন্তর ছাড়ে । এসি বাসের ভাড়া মাথাপিছু ২০ টাকা করে । এই বাস আমাদের পাহাড়ি রাস্তা ধরে দশ মিনিট চলার পর এক জায়গায় নামিয়ে দেয় যেখান থেকে পদব্রজে অজন্তা দেখা শুরু হয় । অজন্তাও ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ দেখাশোনা করে । অজন্তা বন্ধ হয়ে যায় বিকেল সাড়ে পাঁচটায় – তাই আমরা আর সময় নষ্ট না করে মাথাপিছু ১০ টাকার টিকিট কেটে উঠতে শুরু করে দিলাম ।

অজন্তায় ওঠার ঢালু পথ
অজন্তায় হেঁটে ঘোরা ছাড়াও ডুলি পাওয়া যায় যা একটা গুহা থেকে অন্য গুহায় পৌঁছে দেয় । তবে এখানে বলে রাখি অজন্তায় পাহাড়ে ওঠার জন্য প্রথমটাই যা একটু কষ্ট করতে হয়, বেশ অনেকগুলো সিঁড়ি ভাঙতে হয় (অবশ্য সিঁড়ি না ভেঙ্গে ঢালু পথেও ওঠার ব্যবস্থা করা আছে) । কিন্তু একবার এখানে উঠে পড়তে পারলে তারপর বাকিটা সমতল ।


অজন্তার গুহাচিত্র
আমরা একে একে গুহাগুলো দেখা শুরু করলাম । অজন্তাতেও ইলোরার মতোই – পাহাড় কেটে গুহা তৈরি করা । পার্থক্য হল এখানে গুহাগুলোর মধ্যে মূর্তির তুলনায় চিত্রের সংখ্যা বেশি । প্রাচীন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা নিজেদের থাকার জন্য পাহাড় কেটে এই গুহাগুলো তৈরি করেছিলেন এবং ভেতরের দেওয়ালে নানারকম ছবি এঁকেছিলেন । আবার সেই অবাক আর বিস্ময় – সেযুগের মানুষের ধৈর্য্য, অধ্যাবসায়, নৈপুণ্য, ছেনি আর হাতুড়ি ক্ষমতা দেখে । সেইসঙ্গে রঙের ব্যবহার আরও প্রশংসনীয় । আমরা একের পর এক গুহা দেখে চললাম ।

গুহার ছাদে চিত্র
গুহার ভেতরগুলো দেখার জন্য বাইরে থেকে যা আলো ঢোকে, তাতেই দেখতে হয় । শুধুমাত্র দু’টো গুহার ভেতরে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করা আছে । গুহার ভেতরে, যেখানে ছবি আঁকা আছে সেখানে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ব্যবহার করে ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ যদিও ফ্ল্যাশ ব্যবহার না করে ছবি তোলা যেতেই পারে । আসলে ফ্ল্যাশের জোরালো আলো ছবিকে নষ্ট করে দেয় । বেশ কিছু কিছু জায়গার ছবি ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে, বাকিটাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে । এখানে অনেক সিকিউরিটি গার্ড আছে যারা সারাক্ষণ এটা বলতে থাকে যে ফ্ল্যাশ ব্যবহার না করতে । এবং সেটা যথেষ্ট ভালোভাবেই বলে । এবং আমার নিজেরও মনে হয় নিজেদের দেশের এই অত্যাশ্চর্য্য সম্পদকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এটা না করা আমাদের সবারই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে ।

অজন্তার গুহা
প্রায় সবক’টা গুহার ভেতরেই বুদ্ধদেবের মূর্তি আছে আর সেইসঙ্গে আরও নানারকম মূর্তি আছে যেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত লিখছি না । রাস্তাটা মোটামুটি সমতল হলেও মাঝে মাঝে কোনও কোনও গুহায় যেতে গেলে কিছু সিঁড়ি ভাঙতে হয় । এখানে কিছুদূর অন্তর অন্তর শীতল পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে । আমরা যেসময়ে গেছি তখন মোটামুটি তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রির কাছাকাছি, তাই সেখানে এই জলটা একটা আশীর্ব্বাদের মতো মনে হচ্ছিল ।

অজন্তার মডেল
গুহাগুলোর মধ্য কোনও একটা গুহায় অজন্তার একটা ছোট মডেল রাখা রয়েছে । এটা অবশ্য এ’যুগের মানুষের সৃষ্টি । এটা ভালোভাবে দেখে নিলে আমরা নিজেরা কোথায় আছি, কোথায় কোথায় কিভাবে যাওয়া যেতে পারে এগুলো সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করা যায় ।





মহাপরিনির্বাণ
বাকিগুহাগুলো দেখে আমরা শেষ গেলাম ২৬ নম্বর গুহায় । এটায় হল সর্বশেষ গুহা এবং এই গুহাটার সম্পর্কে একটু লেখা দরকার । এটা বাকিগুলোর থেকে একটু আলাদা এবং বৌদ্ধ স্থাপত্যকীর্তির মধ্যে বিশেষ ব্যতিক্রমী । সাধারণতঃ বৌদ্ধ গুহার মধ্যে স্তূপ অথবা মূর্তি দেখা যায় । এই গুহার ভেতরে একটা স্তূপ আছে যেটা আবার একটা বেশ বড় মূর্তিও । এরকম কীর্তি বৌদ্ধস্থাপত্যে বিরল । এছাড়া এই গুহার ভেতরে আছে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ – যেটা এই গুহার মূল আকর্ষণ । দেওয়ালে একটা ১০ – ১২ ফুট দীর্ঘ শোওয়ানো বুদ্ধিমূর্তি খোদাই করা আছে । বুদ্ধদেবের মুখে একটা স্মিত হাসি । এত বড় শোওয়ানো বুদ্ধমূর্তি আর কোথাও নেই ।

এরপরে আর এগোনো যায় না । গুহা দেখা ছাড়াও অজন্তায় পাহাড়ের ওপর ওঠা যায় কিন্তু বর্তমানে বন্ধ আছে । তাছাড়া আমাদের হাতে আর সময়ও ছিল না । তবে সেই নিয়ে আমাদের কোনও আক্ষেপ নেই কারণ এখানকার মূল জিনিসগুলো আমাদের দেখা হয়ে গেছে ।

বাইরে বেরিয়ে এখানে একটা এম টি ডি সি-র রেস্ট্যুরেন্ট আছে, সেখান থেকে আমের জুস খাওয়া হল । এটা খেতে খুবই ভালো, সম্পূর্ণভাবে আম থেকে শাঁস বের করে তার সঙ্গে জল বরফ মিশিয়ে তৈরি করা – কোনও ভেজাল নেই । খেয়ে প্রাণ জুড়িয়ে গেল । তবে বেরোনো আগে যখন ১২৯০ টাকার একটা বিল মেটাতে হল তখন বুকে একটা ছোটোখাটো ধাক্কা লাগল । হ্যাঁ, আমের সরবতের একেকটা গ্লাসের দাম ৭০ টাকা করে !

অজন্তা
আবার ফেরার পথে বাস ধরলাম – সেই বাস আমাদের টি-জাংশনে নামিয়ে দিল । ফেরার সময়ে এসি বাস নয়, তাই ভাড়া ১৫ টাকা করে । টি-জাংশনে একটা বাজার আছে, সেখানে হার চুড়ি থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর জিনিস সবই পাওয়া যায় । ঠিকমতো দরদাম করতে পারলে এখানে ঠিকঠাক দামে জিনিস পাওয়া যেতে পারে ।



টি-জাংশনে আমাদের জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছিল । সেই গাড়ি ধরে আবার হোটেলে ফিরে এলাম তখন প্রায় সাতটা ।

অজন্তা ভ্রমণ বলত গেলে এখানেই শেষ – এবার মহারাষ্ট্র ভ্রমণের শেষ অংশ ।

সন্ধ্যেবেলা ঘরে বসে সবাই মিলে আড্ডা দিলাম । আজই শেষ দিন – আগামীকাল এই সময়ে আমরা থাকব ট্রেনে আর পরশু এই সময়ে যে যার বাড়িতে । গত সাতদিনের অভিজ্ঞতা, সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া, কিছু পাওয়া – কিছু না পাওয়া এইসব নিয়ে গল্প হচ্ছিল । হোটেল কে পি পার্ক এমনিতে নিরামিষ তবে আমরা অনেক লোক থাকায় বলল – চিকেনের ব্যবস্থা করে দেবে । রাতে রুটি দিয়ে সেই চিকেন খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম ।

১লা জুন ২০১৪, রবিবার । আমাদের ফেরার ট্রেন ধরার দিন । আমাদের সকালবেলাই বেরিয়ে পড়তে হবে । অজন্তা থেকে আমাদের যেতে হবে জলগাঁও – সেখান থেকে আমাদের ফেরার ট্রেন গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস দুপুর ১২ টায় । সকালে লুচি সবজী দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে একেবারে বেরোনোর জন্য রেডী হয়ে নিলাম । আমাদের গাড়ি বলা ছিল সকাল সাড়ে ন’টায় । এখানে একটা সমস্যা হয়েছিল, স্টেশন যাওয়ার জন্য হোটেল থেকে গাড়ি না নেওয়ায় হোটেলের লোকেরা কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েছিল । না নেওয়ার কারণ খুব স্পষ্ট – আমরা আরও কম টাকায় গাড়ি পেয়ে গেছিলাম । কিন্তু এখানে এদের লবির ব্যাপার থাকে – এরা চাইলে এমন কিছু করতে পারে যাতে আমাদের গাড়ি আমাদের স্টেশনে না নিয়ে যেতে পারে এবং নিজেদের গাড়ি নেওয়ার জন্য আমাদের বাধ্য করতে পারে । দশটার সময়েও যখন গাড়ি এসে পৌঁছল না, তখন একটু চিন্তাই হচ্ছিল । যদিও অজন্তা থেকে জলগাঁও যেতে একঘন্টা লাগে, কিন্তু এখানে ঝামেলা হলে আমরা মুস্কিলে পড়ব । যাই হোক, সোয়া দশটার একটু পরে দু’টো গাড়ি এসে পৌঁছল আর আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাড়িতে উঠে এলাকা ত্যাগ করলাম ।

জলগাঁও স্টেশনে পৌঁছলাম তখন বেলা এগারোটা । দু’টো গাড়ি মিলিয়ে আমাদের পড়ল ৩,২০০ টাকা । এরপর স্টেশনে পৌঁছে আমরা কাম-সাম থেকে দুপুরের খাবার নিয়ে নিলাম । তারপর নির্ধারিত সময়ের আধঘন্টা পরে ট্রেন এলে উঠে পড়লাম ।

ফেরার পথের বিবরণ দেওয়ার আর কিছু নেই তবে যেটা বলার সেটা হল গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসে ফেরার জঘন্য অভিজ্ঞতার কথা । আমরা জলগাঁও থেকে সবক’টা এসি-র টিকিট পাইনি, অনেকগুলোই স্লীপারে নিতে হয়েছিল । গীতঞ্জলি এক্সপ্রেসে স্লীপারে পুরো কামরা জুড়ে প্রচুর লোক বসে থাকে যাদের টিকিট হয় কনফার্মড হয়নি অথবা তাদের কাছে জেনারেলের টিকিট আছে । এই ভীড়টা এতই বেশি যে কামরার ভেতরে চলাচল করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে । নাগপুরের টি.টি.ই.কে এটা বলা হলেও স্বাভাবিকভাবেই তিনি কোনও ব্যবস্থা নিলেন না । পরেরদিন টাটানগর পর্যন্ত্য আমাদের এই ভীড়ের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল ।

রাতের খাবার আমরা নাগপুর স্টেশনের কাম-সাম থেকে নিলাম । সেগুলো খেয়েদেয়ে রাতে শুয়ে পড়লাম । কিছুক্ষণের মধ্যেই লোয়ার বাঙ্কদু’টোর মাঝের মেঝেটায় দু’জন লোক এসে শুয়ে পড়ল ।

গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস হাওড়ায় পৌঁছল তখন বেলা একটা । সবাই সবাইকে টাটা বলে যে যার বাড়ির পথ ধরলাম !

সারসংক্ষেপঃ

১. ভারতের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তিগুলোর মধ্যে অজন্তা ইলোরার মতোই আরেকটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য নাম । এখানকার গুহার বৈশিষ্ঠ হল এগুলোর ভেতরে মূর্তির থেকে ছবির প্রাধান্যই বেশি ।
২. অজন্তা দেখতেও ইলোরার মতোই সারাদিন লাগে, তবে এখানকার সুবিধেটা হল সবটাই প্রায় একই জায়গায় । খুব ভালোভাবে খুঁটিয়ে না দেখলে গুহাগুলো দেখার জন্য হাতে ঘন্টা তিনেক সময় থাকলেই চলবে ।
৩. যেসব গুহার ভেতরে ছবি আছে, সেখানে ফ্ল্যাশ ব্যবহার করে ছবি তোলা একেবারেই উচিৎ নয় । এতে ছবিগুলোর মারাত্মক ক্ষতি হয় ।
৪. অজন্তার গুহা খোলে সকাল ন'টা থেকে । প্রতি সোমবার অজন্তা বন্ধ থাকে ।
৫ অজন্তার গুহা পর্যন্ত্য গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না, টি-জাংশন থেকে এম টি ডি সি-র বাস ধরতে হয় । এই টি-জাংশন অজন্তার গুহার সবথেকে কাছে এবং এখানেই এম টি ডি সি-র রিসর্টটা রয়েছে ।
৬. আমাদের হোটেল কে পি পার্কটা এই টি-জাংশন থেকে দু’তিন কিলোমিটার মতো দূরে । অজন্তায় খুব বেশি হোটেল নেই, সেই হিসেবে এই হোটেলটা মোটের ওপর মন্দ নয় । এদের ওয়েবসাইট http://www.newkppark.com/ থেকে সরাসরি বুকিংও করা যেতে পারে ।
৭. অজন্তার নিকটবর্তী রেলওয়ে স্টেশন জলগাঁও যেতে অজন্তা থেকে ঘন্টাখানেক লাগে । মুম্বই যাতায়াতের প্রায় সব ট্রেনই এখানে দাঁড়ায় ।

অজন্তা ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

উপসংহারঃ

আমাদের মহারাষ্ট্র ভ্রমণের সময়টা পুরোপুরিই গরমের সময়ে – সেইজন্য অনেকেই বলেছিল যে ভালোভাবে ঘুরতে পারব না । আমাদের গরম লেগেছে এটা অস্বীকার করব না তবে সেটা কখনওই ঘোরার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি – এটা জোর দিয়ে বলতে পারি । মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় কলকাতার মতই গরম, তবে শুকনো গরম হওয়ায় সেরকম ঘাম হয়না । আর সেই কারণেই গায়ে গরম লাগলেও শরীরে ক্লান্তি লাগে না । আমাদের এই সাতদিন ব্যাপী ভ্রমণে আমরা ঘুরেছি – মুম্বই, গণপতিপুলে, সির্ডি, ইলোরা ও অজন্তা । আমাদের এই ভ্রমণসূচীর মধ্যে আরেকটা জায়গা চাইলে ঢোকানো যেতে পারত – সেটা হল মহাবালেশ্বর । জায়গাটা সেরকম দারুণ কিছু নয়, এটা প্রকৃতপক্ষে মহারাষ্ট্রের একটা হিল স্টেশন । বলা বাহুল্য, এই জায়গাগুলো ছাড়া মহারাষ্ট্রে অনেক জায়গা আছে, তবে আমাদের ঘোরা এই জায়গাগুলো পারলে একবারেই ঘুরে আসা ভালো । পুরো ঘোরাঘুরিটা কিছুটা হলেও অস্থির, কিন্তু সবমিলিয়ে খুবই আনন্দদায়ক । সাতদিনের ঘোরাঘুরি নিয়ে আমাদের মাথাপিছু খরচ হয়েছে ১৩,০০০ টাকার মতো, যেটা এই ঘোরাঘুরিটার পক্ষে বেশ সস্তাই । কোনও বিশেষ জায়গা সম্পর্কে আলাদা করে এখানে লিখছি না – সেগুলো লেখার মধ্যেই আছে । প্রত্যেকটা জায়গা তাদের নিজের মাহাত্ম্যের জন্য সুন্দর – স্বতন্ত্র – বিশিষ্ট । যদি বেরিয়ে পড়ার জন্য এই পুঁজি আর সেইসঙ্গে ছুটি - দু’টো জিনিস একসঙ্গে হাতে থাকে তাহলে মহারাষ্ট্রের এই জায়গাগুলো ভ্রমণের জন্য বেরিয়ে পড়া যেতেই পারে ।