আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Tuesday, October 25, 2016

তাকদা ভ্রমণ

তাকদা । নামটা শুনে প্রথমেই লোকজন জিজ্ঞেস করে "কি ? চাকদা? চাকদায় আবার বেড়াতে যাওয়ার কি আছে ?" তাদের বলতে হয় - না, এই জায়গাটার নাম তাকদা । দার্জিলিঙ জেলার ছোট্ট একটা গ্রাম । দার্জিলিঙ জেলায় 'ততটা বিখ্যাত নয়' এরকম যে বেড়ানোর জায়গাগুলো আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম । সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫,৫০০ ফুট উচ্চতায় আর শিলিগুড়ি থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই সুন্দর জায়গায় তিনদিনের বেড়ানো নিয়ে আমার ব্লগের এবারের পোস্ট ।

২০শে অক্টোবর, ২০১৬ বৃহস্পতিবার শিয়ালদহ থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে রাত সাড়ে আটটায় আমাদের যাত্রা শুরু - গন্তব্য নিউ জলপাইগুড়ি । কাঞ্চনকন্যার সমস্যা হল এর স্টপেজ খুব বেশি । তবে এটা সকাল সাড়ে সাতটায় নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছয় শুধুমাত্র এই কারণেই আমরা এই ট্রেনটা পছন্দ করেছিলাম ।

এটা আমাদের দরকার ছিল কারণ আমরা নিউ জলপাইগুড়ি থেকে তাকদা যাওয়ার জন্য 'দার্জিলিঙ হিমালয়ান রেলওয়ে' (টয়ট্রেন) বুকিং করেছিলাম । টয়ট্রেন ছাড়ে সকাল ৮ঃ৩০ -এ । টয়ট্রেন তাকদা যায় না, ঠিক ছিল আমরা 'ঘুম' পর্যন্ত্য টয়ট্রেনে গিয়ে সেখান থেকে গাড়িতে তাকদা যাব । কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ভারতীয় রেল কিছুদিনের জন্য টয়ট্রেনের পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে, তাই আমাদের এই কাঞ্চনকন্যায় যাওয়াটা অর্থহীন হয়ে গেল ।

কাঞ্চনকন্যা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা
আমাদের এবারের দল ৩ জন শিশুসমেত ১৩ জনের । বাবা, মা, আমি, অমৃতা, কথা, কলি, আমার বড়মাসি, কঙ্কনাদি, অমিতদা, মিঙ্কা, বৈশাখী, কাকিমা আর সমীরণদা - এককথায় বলতে গেলে আমাদের নিয়মিত দলের প্রায় সবাই আর সেইসঙ্গে আমার বড়মাসি । আমাদের ট্রেন প্রথমদিকে কিছুটা দেরিতে চললেও নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে দিল প্রায় সঠিক সময়ে । ট্রেন যখন প্রায় নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ঢুকছে, ট্রেন থেকে দেখা গেল কাঞ্চনজঙ্ঘা । এটা আমাদের একটা খুব বড় প্রাপ্তি । আমি নিজে এই জিনিস আগে দেখে থাকলেও জানি খুব বেশি লোকের এটা দেখার সৌভাগ্য হয় না । তাকদায় আমরা যেখানে থাকব, সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার কোনও ভিউ নেই, তাই এখান থেকেই যা দেখার দেখে নিলাম ।

তিস্তা ব্রীজের কাছে ব্রেকফাস্ট ব্রেক
একটা ১০৫ বছরের পুরনো ব্রিটিশ হেরিটেজ বাংলো তাকদায় থাকার জন্য সুপরিচিত (এই ১০৫ সংখ্যাটা অবশ্য অনেকদিন আপডেট হয়নি !) - এছাড়া আর দু'একটা থাকার জায়গা আছে । টয়ট্রেন না থাকায় আমরা বাংলো থেকেই একটা গাড়ি বুক করে রেখেছিলাম কারণ নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে তাকদা যাওয়ার গাড়ি পাওয়া সহজ নয় । স্টেশন থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে রওনা দিতে দিতে সাড়ে আটটা বেজে গেল । আমাদের দলে পূর্ণবয়স্ক লোকের সংখ্যা ১০ আর সবাই একটা টাটা সুমোতে (একটু হয়তো বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে কিন্তু পাহাড়ে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় । যেভাবেই হোক সবার জায়গা হয়েও গেল )। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে তাকদা হিলকার্ট রোডে হয়েও যাওয়া যায় আবার সেভক হয়েও যাওয়া যায় - আমরা দ্বিতীয়টা ধরলাম । ঘন্টাখানেক চলার পর তিস্তা ব্রীজের কাছে ব্রেকফাস্টের জন্য দাঁড়ানো হল । চিকেন চাউমিন, ভেজ মোমো, চিকেন থুকপা, ছোলে-বাটুরে এইসব দিয়ে ভালো করে ব্রেকফাস্ট করে নেওয়া হল । খরচ হল মোট ১,৪০০/- টাকা ।

তাকদায় পৌঁছনোর রাস্তার শেষের দিকটা বেশ খারাপ । গাড়িতে ১০ জন বসে এতক্ষণ একটু চাপাচাপি হচ্ছিল কিন্তু এই রাস্তায় এসে গাড়ির ভেতরে এমন 'মুড়ির টিন' ঝাঁকানি শুরু হল যে একসময়ে মনে হচ্ছিল গাড়িতে বোধহয় চাইলে আরও একজনের জায়গা হয়ে যাবে !

তাকদায় ব্রিটিশ হেরিটেজ বাংলো
তাকদা পৌঁছলাম দুপুর একটা নাগাদ । আমরা থাকার জন্য ব্রিটিশ বাংলোয় দু'টো ডাবল বেড আর দু'টো ট্রিপল বেড ঘর বুক করেছিলাম । বাংলোটা একটা L আকৃতির বাড়ি । এর একটা দিকে চারটে ব্রিটিশ আমলের ঘর । অন্যদিকে দু'টো ঘর যেগুলো পরবর্তীকালে তৈরি । ব্রিটিশ আমলের ঘরগুলোর ভেতরে ফায়ারপ্লেস আছে, চাইলে ব্যবহার করা যায় (অবশ্যই অর্থের বিনিময়ে) । তাকদায় ঠান্ডা খুব বেশি নয়, দিনের বেলা সোয়েটার লাগে না আর রাত্রিবেলা ঘরের বাইরে বেরোলে একটা জাম্পার বা জ্যাকেট থাকলেই চলে । তবে এমনিতে ঠান্ডা সেরকম না লাগলেও একটা ঠান্ডা হাওয়া মাঝে মাঝে দিচ্ছিল যেটা বেশ আরামদায়ক ।

আমরা চানটান সেরে নিলাম । বাথরুমে গিজারের ব্যবস্থা আছে । এখানে আগেই আমরা দুপুরের খাবারের কথা বলে রেখেছিলাম । সেইমতো দুপুরে এরা আমাদের ভাত, ডাল, স্কোয়াশের তরকারি, ডাবল ডিমের এগ্‌কারি দিল । এই ব্রিটিশ বাংলোয় খাওয়ার জন্য মাথাপিছু প্রতিদিন ৬০০/- লাগে । এর মধ্যে পাওয়া যায় -
সকালে ঃ বেড-টি, ব্রেকফাস্ট (লুচি-তরকারী/পরোটা-তরকারী/পাঁউরুটি টোস্ট), আবার চা
দুপুরে ঃ ভাত, ডাল, তরকারী, ডাবল ডিমের এগ্‌কারি
বিকেলে ঃ চা, পপকর্ণ
রাতে ঃ ভাত/রুটি, চিকেন

বাংলোর ব্যালকনিতে - রাতের বেলায়
দুপুরে খাওয়ার পর বাংলোর লনে এসে বসলাম । এখান থেকে সামনের পাহাড়ের ভিউ চমৎকার । দলে বেশি লোকজন থাকার সুবিধে হচ্ছে স্রেফ আড্ডা মেরে সময় কেটে যায় । দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল, আমাদের বাংলোর পিছনের পাহাড়ের ওপরে একসময়ে সূর্য্যাস্ত হয়ে গেল । এইসময়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য্য সত্যিই অসাধারণ । আশেপাশের পাহাড়গুলোর ওপর ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসার দৃশ্য দেখতে দেখতে কিভাবে যেন সময় কেটে যায় । একসময়ে সেইসব পাহাড়গুলোর ওপরের জনবসতিগুলোয় একটু একটু করে আলো জ্বলে উঠল । আমরা বাংলোর ব্যালকনিতে বসে সন্ধ্যের চা খেলাম আর আড্ডা চলতেই থাকল । শতাধিক পুরনো ব্রিটিশ বাংলোয় কোনও ভূতের গল্প আছে কিনা জানি না তাই আমরা নিজেরাই কিছু তৈরি করে নিলাম (ভেবেছিলাম ভূত নিয়ে আলোচনা করলে হয়তো তাদের দেখা মিললেও মিলতে পারে, কিন্তু সে গুড়ে বালি !) । রাত্রি ন'টা নাগাদ খাওয়ার ঘরের ডাকে সাড়া দিয়ে দেখলাম আমাদের জন্য রুটি আর চিকেন কারি রেডি ।

পরেরদিন ২২শে অক্টোবর, ২০১৬ শনিবার । তাকদায় প্রকৃতপক্ষে দেখার খুব বেশি কিছু নেই, আমাদের বাংলোর ম্যানেজার তাই আগেই বলে রেখেছিলেন কালিম্পং-এর দিকটা যাওয়ার জন্য । সেইমতো সকাল সাড়ে ন'টা নাগাদ আমরা বেরোলাম । ঘন্টাখানেক যাওয়ার পর পড়ল আমাদের প্রথম গন্তব্য - 'তিনচুলে ভিউ পয়েন্ট' ।

তিনচুলে ভিউ পয়েন্ট থেকে ভিউ
তিনচুলে ভিউ পয়েন্ট থেকে অনেকগুলো পাহাড়ের দৃশ্য দেখা যায় । এখানে একটা ছোট টাওয়ার গোছের আছে, তার ওপরে বসার জায়গাও আছে । এখানে ওঠার জন্য অল্প কয়েকটা সিঁড়ি ভাঙ্গতে হয় আর সেটা করা সার্থক । আমরা ভিউপয়েন্ট থেকে বেশি কিছু ছবি তুললাম । এখানে সবমিলিয়ে মিনিট পনেরো থাকার পর এগিয়ে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য 'ছোটামাঙ্গয়া অরেঞ্জ গার্ডেন'-এর দিকে ।

অরেঞ্জ গার্ডেন
তিনচুলে ভিউ পয়েন্ট থেকে অরেঞ্জ গার্ডেন আরও ৪৫ মিনিট মতো লাগল । দূরত্ব খুব বেশি না, তবে রাস্তা খারাপ হওয়ায় সময় লাগে । অরেঞ্জ গার্ডেনে ঢুকতে মাথাপিছু ৩০/- টাকা করে টিকিট লাগে । পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে এখানে কমলালেবুর চাষ করা হয়, তবে কমলালেবু ছাড়াও বাগানে আরও অনেক গাছ আছে (কি কি গাছ তখন জেনেছিলাম, এখন আর সেভাবে মনে নেই) । একটা বাঁশগাছ দেখলাম, সেটা হচ্ছে জাপানি বাঁশ গাছ । এর বৈশিষ্ট্য হল এর গা ভীষণ মসৃণ । এছাড়া বাগানটার মধ্যে দিয়ে একটা ছোট ঝর্ণা নেমে গেছে সেটাও খুব সুন্দর । সম্পূর্ণভাবে মানুষের হাতের তৈরি হলেও বাগানটায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য স্পষ্ট ।

অরেঞ্জ গার্ডেনের ভেতরে একটা ফ্যাক্টরি আছে, এখানে অরেঞ্জ জুস, অরেঞ্জ স্কোয়াশ তৈরি হয় । এখানে বিক্রির ব্যবস্থাও আছে । আমরা সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ বসলাম । এখানে অরেঞ্জ জুস, স্কোয়াশ ছাড়াও লঙ্কা ইত্যাদি পাওয়া যায় । আমরা অবশ্য কিছু কিনিনি । বাগান থেকে বেরিয়ে এসে আমরা রওনা দিলাম কালিম্পং এর দিকে ।

কালিম্পং শহর
ছোটামাঙ্গয়া থেকে কালিম্পং পৌঁছতে আরও একঘন্টা মতো লাগল । কালিম্পং দার্জিলিঙ-এর মতো একটা হিলস্টেশন - অনেক পুরনো । এখানকার রাস্তাঘাট, দোকানপাট একেবারেই দার্জিলিঙ এর মতো, ভীড়ও দার্জিলিঙ-এর মতো । আমাদের প্ল্যানে কালিম্পং-এ সেভাবে দেখার কিছু ছিলনা, এখানে আমরা থামলাম লাঞ্চের জন্য । কালিম্পং-এ বাঙালি গিজগিজ করছে - আমরা 'মাসিমার হোটেল' দেখে সেখানে থামলাম । এটা কলকাতার একটা সাধারণ ভাতের হোটেলের মতোই - ভাত মাছ মাংস ডিম ডাল তরকারি সবই পাওয়া যায় । এখানে সবার লাঞ্চ করতে খরচ পড়ল ৯৭০/- টাকা ।

ডেলো পার্ক
এরপর আমরা এগিয়ে গেলাম আমাদের শেষ গন্তব্য ডেলো-র দিকে (হ্যাঁ, এই সেই ডেলো !) । কালিম্পং শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা পাহাড়ের মাথায় একটা রিসর্ট আছে আর তার চারপাশটা নানারকমভাবে সাজানো হয়েছে । ডেলোয় ঢুকতে মাথাপিছু ১০/- টাকা করে টিকিট লাগে । আমরা এখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ছবিটবি তুলে চলে এলাম । এখানে চাইলে প্যারা-গ্লাইডিং করা যেতে পারে । সাধারণভাবে ৩,০০০/- টাকা আর হাই-গ্লাইডিং এর জন্য ৫,০০০/- টাকা । আমরা কেউই করিনি তবে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছি ব্যাপারটা অনেকেই করে ।

এবার আমরা তাকদা ফেরার পথ ধরলাম । পাহাড়ে অন্ধকার খুব তাড়াতাড়ি নেমে আসে, কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পরেই এমন অবস্থা হল যে হেডলাইট-এর আলোয় যেটুকু রাস্তা দেখা যাচ্ছে তার বাইরে আর কোথাও কিছু দৃশ্যমান নয় । একজায়গায় দাঁড়িয়ে চা খাওয়া হল । তারপর আবার চলা । অন্ধকারে পাহাড়ী পথে গাড়িতে চলার অভিজ্ঞতা বেশ সুন্দর । এর প্রধান কারণ হয়তো পাহাড়ে বেড়াতে গেলে রাতেরবেলা গাড়ি চড়ার সুযোগ কমই হয় । আমরা যখনই পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে সাইট-সিয়িং এ বেরোই, সাধারণতঃ সকাল সকাল বেরিয়ে বিকেল বা বড়জোর সন্ধ্যের মধ্যে হোটেলে ফিরে আসি । অন্ধকার হয়ে গেলে পাহাড়ে গাড়ি, লোকজন সবই কমে যায় আর সেইজন্যই হয়তো ব্যাপারটা রোমাঞ্চকর লাগে । অন্ধকার রাস্তায় গাড়ি চলেছে, হেডলাইটের আলো রাস্তায়, রাস্তার ধারে পড়ছে আর সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে সামান্য গাড়ির ভেতরে ঢুকে গাড়ির ভেতরটাকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার হতে দিচ্ছে না - এই পরিবেশের যেন কোনও তুলনা হয় না । রাত্রির নিস্তব্ধতার একটা নিজস্ব সৌন্দর্য্য আছে আর সেটা এইসব সময়ে আরও বেশি করে বোঝা যায় । চলতে চলতে আমরা একটা পাশের পাহাড়ে অনেকটা ওপরদিকে একটা আলো জ্বলতে দেখলাম । আমাদের ড্রাইভার বলল সেটা 'স্যামড্রুপসে' । কালুক ভ্রমণের সময়ে আমরা এখানে গিয়েছিলাম ।

বাংলোয় ফিরলাম সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ । আবার আগেরদিনের মতোই - সন্ধ্যের পরে আর কিছু করার নেই । কিন্তু আমাদের বড় দল থাকায়, কিছু করার নেই বললেও অনেক কিছু করার থাকে । আবার আগেরদিনের মতোই ন'টার সময়ে ডিনার করে নিলাম । আমাদের কথা অনুযায়ী এরা ডিনারে চিলি-চিকেন রান্না করেছিল যদিও সেটা খুব ভালো কিছু হয়নি । এরা সাধারণভাবে এখানে চিকেন কারি রান্না করে আর সেটাই ভালো করতে পারে । অন্যরকম কিছু রান্না করতে বলার এক্সপেরিমেন্টটা এদের সঙ্গে না করাই ভালো !

তাকদায় সূর্য্যোদয়
পরেরদিন সকালে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম - পাঁচটার সময়ে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে লনে চলে এলাম । আকাশ এখনও অন্ধকার । সূর্য্যোদয় হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে । এই সময়ে বেশ ঠান্ডা লাগে । আমাদের বাংলোর পিছনে কয়েকধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠলে তাকদা মনাস্ট্রি - এখান থেকে সূর্য্যোদয়ের দৃশ্য আরও সুন্দর । আমরা ক্যামেরা নিয়ে সেখানে গিয়ে বসে রইলাম । এই সময়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকাটাই একটা অভিজ্ঞতা - প্রতি মূহুর্তেই রঙ পাল্টাতে থাকে । পিছন দিকে তাকালে দেখা যায় দূরে একটা উঁচু পাহাড়ের ওপর থেকে ফ্লাশের ঝলকানি দেখা যাচ্ছে । জেনেছিলাম ওটা দার্জিলিঙ এর টাইগার হিল ।

সূর্য্যোদয় হল । আমি লেখক নই - এই দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়ার মতো বিশেষণ আমার জানা নেই । শুধু এককথায় বলছি - অসাধারণ !

চা-বাগান
২৩শে অক্টোবর, ২০১৬ - রবিবার আমাদের তাকদার লোক্যাল সাইট-সিয়িং এর দিন । আগেই বলেছি তাকদায় দেখার সেরকম অনেক কিছু নেই, তাই আমরা বেরোলাম বেলা দশটা নাগাদ । এই যাওয়ার রাস্তাটা খুব সুন্দর । প্রথমে রাস্তাটা একটা পাইনফরেস্ট-এর মধ্যে দিয়ে চলল । কিছুক্ষণ চলার পর একটা অর্কিড গার্ডেন পড়ল । এখানে আমরা থামলাম না, ঠিক হল যদি ফেরার পথে সময় থাকে তাহলেই থামব । আরও এগিয়ে চলার পর শুরু হল রাস্তার দু'পাশের চা-বাগান । এখানকার 'রাংলি-রাংলিওট চা-বাগান' খুব বিখ্যাত । এই চা-বাগানের দৃশ্যও খুব সুন্দর - বিশেষ করে এরকম রাস্তার দু'পাশে চা-বাগান খুব বেশি দেখা যায় না । এই চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতেই পৌঁছে গেলাম আমাদের প্রথম স্টপেজ - 'তিস্তা ভ্যালি দূরবীন ভিউ পয়েন্ট'-এ ।

তিস্তা ভ্যালি ভিউ পয়েন্ট থেকে তিস্তার ভিউ
প্রথমেই বলে রাখি এটাও একটা চা-বাগান । এই চা-বাগানের মধ্যেই একটা চাতাল মতো করা আছে - সেখানে দাঁড়িয়ে তিস্তা নদী আর তিস্তার ভ্যালি দেখা যায় । বেলা পৌনে বারোটা বাজে, আকাশে রোদের তেজও বেশ বেশী । কিন্তু এই ভিউ পয়েন্টে একটা চমৎকার ঠান্ডা হাওয়া দেয় যাতে খুব আরাম লাগছিল । এটা একটা ছবি তোলার জন্য আদর্শ জায়গা আর আমরা আমাদের সঙ্গে থাকা মোট পাঁচটা ক্যামেরার যথোপযুক্ত ব্যবহার করলাম । জায়গাটা এতটাই সুন্দর যে আমরা এখানে নির্ধারিত সময়ের অনেক বেশি সময় কাটিয়ে ফেললাম । কিন্তু তাতে আফশোসের কিছু নেই কারণ সব সুন্দর জায়গা কখনও দেখা হয়ে ওঠে না, তাই যেটা দেখছি সেটাকেই সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করার নামই জীবন । (কাব্য করে ফেললাম ! তবে এটাকে স্থানমাহাত্ম্য ছাড়া আর কিছু বলার নেই)

হ্যাঙ্গিং ব্রীজে যাওয়ার রাস্তা
এরপরের জায়গার নাম হল 'বারবাটে হ্যাঙ্গিং ব্রীজ' । তিস্তা ভ্যালি থেকে প্রায় একঘন্টা গাড়িতে যাওয়ার পর এখানে পৌঁছলাম । এখানে একটা শতবর্ষ পুরনো ঝুলন্ত সেতু আছে । একসময়ে এর ওপর দিয়ে জিপ চললেও এখন বাইক ছাড়া কোনও গাড়ি চলে না । আমাদের গাড়ি যেখানে আমাদের নামিয়ে দিল সেখান থেকে ঢালু পথে কিছুটা নেমে গেলে সেতুতে পৌঁছনো যায় । এই ঢালু পথটা বেশ ঢালু এবং চকচকে পাথর দিয়ে তৈরি । তাই চটি পরে এই রাস্তা দিয়ে না নামাই ভালো কারণ ফিরতি পথে ওঠার সময়ে অসুবিধে হতে পারে । তবে এই পথে না ফিরে অন্য একটা পথ দিয়েও ফেরা যায়, সেক্ষেত্রে একটা ঝর্ণার ওপর পাথরে পা দিয়ে ফিরতে হবে । দু'টোই কিছুটা কঠিন - সেইসঙ্গে থ্রিলিং-ও ।

বারবাটে হ্যাঙ্গিং ব্রীজ
আমাদের দলের কয়েকজন ব্রীজটা দেখতে গেলাম । হেঁটে পেরোতে বেশ ভালো লাগে - বিশেষ করে মাঝখানে পৌঁছে নিচের দিকে দেখতেও খুব ভালো লাগে । নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে একটা ঝর্ণা । বর্ষার পরে এই সময়ে পাহাড়ী ঝর্ণাগুলো বেশ পরিপুষ্ট থাকে তাই দেখতেও খুব ভালো লাগে । আমরা এখানে আবার অনেকটা সময় ব্যয় করলাম । ব্রীজটা পেরিয়ে একটা পায়ে চলা পথ আছে যেটা দিয়ে অন্য ফেরার পথটা ধরতে হয় । এখানে আমরা নিজেরাই আমাদের গাইড, যে পথে চলেছি আদৌ সেটা দিয়ে কোথাও পৌঁছনো যায় কিনা জানিনা কিন্তু ওই অজানার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলাই আনন্দের । ফেরার পথের একটাই সুবিধে যে কোনও চড়াই চড়তে হয় না, কিন্তু এক জায়গায় এসে ওই ঝর্ণাটা আবার পেরোতে হয় (এখানে একটা সিমেন্টের ব্রীজ তৈরি হচ্ছে, কিন্তু সেটা এখনও অসম্পূর্ণ, তাই পায়ে হেঁটে ঝর্ণা পেরোনো ছাড়া উপায় নেই) । এখানে পাথরের ওপর পা দিয়ে ঝর্ণা পেরোলাম । কাজটা খুব সহজ নয় বিশেষ করে কোনও কারণে পা হড়কালে মৃত্যু না হলেও গুরুতর চোটের সম্ভাবনা । যাই হোক, কোনওরকম চোট না পেয়ে আমরা এপারে চলে এসে গাড়িতে উঠলাম ।

তাকদা চার্চ
দুপুর দু'টো বাজে - এখান থেকে বাংলোয় ফিরতে প্রায় একঘন্টা লাগবে তাই আমরা ফেরার পথে অর্কিড গার্ডেন দেখার ইচ্ছে ত্যাগ করলাম । বাংলোয় ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে নেওয়া হল । বিকেলে কিছু করার নেই, তাই আমাদের বাংলোর চারপাশটা হেঁটে ঘোরার প্ল্যান করলাম । বাংলো থেকে নিচে নেমে এসে একটা রাস্তা ধরে কিছুটা উঠলে একটা চার্চ দেখতে পাওয়া যায় । এটা আগে আরেকটা বাংলোই ছিল, পরবর্তীকালে একে চার্চে পরিণত করা হয়েছে ।

তাকদার বাড়িঘর
চার্চ থেকে আমরা আরও এগোতে থাকলাম । রাস্তাটা প্রকৃতপক্ষে আমাদের বাংলোকে ঘিরে পাহাড়ের গা দিয়ে একটা পায়ে চলা পথ । এখানে আরও কিছু লোকজনের বাড়ি ইত্যাদি রয়েছে । এইভাবে চলতে চলতে একসময়ে গ্রামটা শেষ হয়ে পথটা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল । বিকেল শেষ হয়ে আসছে, এইসময়ে জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করা বিভিন্ন কারণেই নিরাপদ নয়, তাই জঙ্গলের মধ্যে কিছুদূর গিয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম । তবে এইটুকুর মধ্যেই যতটা ট্রেকিং করলাম সেটা মনে রাখার মতো । ফেরার পথটা তাকদা মনাস্ট্রির পাশ দিয়ে । ঘরে ফিরে গিয়ে সেরকম কিছু করার নেই, তাই আমি আর বৈশাখী এখানে কিছুক্ষণ বসে রইলাম । সূর্য্যাস্ত হয়ে গেছে, পাহাড়ের ওপরে ক্রমশঃ আলো কমে আসছে - এই সময়টা এখানে বসে থাকতে খুব ভালো লাগে । এরপর একেবারে অন্ধকার হয়ে গেলে আমরা বাংলোয় ফিরে এলাম ।

আমাদের বেড়ানো এখানেই প্রায় শেষ কারণ পরেরদিন আমরা ফেরার ট্রেন ধরব । তাকদায় শেষ রাত্রিটা একইরকম সুন্দরভাবে কাটল ।

পরেরদিন আবার সকাল সকাল উঠলাম সূর্য্যোদয় দেখব বলে । এবারে আর বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছি না কারণ সেটা প্রায় একই কথার পুনরাবৃত্তি হয়ে যাবে । শুধু এ'টুকু বলছি আগেরদিনের থেকে আকাশ আরও বেশি পরিষ্কার থাকায় সূর্য্যোদয়টা আরও সুন্দর লাগল ।

পাইন ফরেস্টের রাস্তা
সাতটা নাগাদ আমরা তিনজন বেরোলাম হেঁটে পাইন ফরেস্ট দেখার জন্য । তাকদা জায়গাটা খুবই ছোট একটা গ্রাম - মিনিট দশেক হাঁটলেই গ্রাম শেষ হয়ে গিয়ে পাইনের জঙ্গল শুরু হয়ে যায় । আমরা যে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, আগেরদিন সেই রাস্তা দিয়েই গাড়ি করে গেছি । হাঁটতে বেশ ভালো লাগছিল । রাস্তার দু'পাশে ঘন পাইনের জঙ্গল আর গাছগুলোর মধ্যে দিয়ে সূর্য্যের আলো পড়ছে - এই দৃশ্য সত্যিই খুব সুন্দর । আমরা হেঁটে হেঁটে অর্কিড গার্ডেন পর্যন্ত্য গিয়ে আবার ফিরে এলাম ।

তাকদায় আর কিছু ঘোরার নেই - আমরা ব্রেকফাস্ট করে ব্যাগ প্যাক করে নিলাম । পাহাড় থেকে নামার সময়ে সবসময়েই হাতে সময় নিয়ে বেরোতে হয়, বিশেষ করে দুপুরের পর থেকে সেভক রোডে ভীষণ জ্যাম হয় আর একবার সেই জ্যামে পড়লে ট্রেন ফেল হয়ে যেতে পারে । তাই আমরা বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম তাকদা থেকে । ঘন্টা দু'য়েক চলার পর লোহাপুল বলে একটা জায়গায় গাড়ি থামল লাঞ্চের জন্য । এখানে আমরা চিকেন মোমো, ভাত, এগ-কারী আর চিকেন দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিলাম । খরচ পড়ল ১,০৫০/- টাকা ।

আবার গাড়ি এগিয়ে চলল । আমরা সেভকের জ্যাম না পেলেও রাস্তা বেশ খারাপ হওয়ায় নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছতে বিকেল সাড়ে চারটে বেজে গেল । স্টেশন থেকে আমরা ডিনারের মিক্সড চাউমিন আর চিলি চিকেন কিনে নিলাম । আমাদের ফেরার ট্রেন ছিল উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস যার স্টেশনে ঢোকার নির্ধারিত সময় বিকেল ৫:৪০ । ট্রেন ঢুকল প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিট লেটে আর আমাদের শিয়ালদহে পৌঁছে দিল পরেরদিন সকাল সাড়ে পাঁচটা । ভ্রমণ শেষ !

সারসংক্ষেপঃ

১. শিলিগুড়ি বা নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ঘন্টাতিনেকের গাড়ির দূরত্বে একটা তুলনামূলক কম বিখ্যাত জায়গা তাকদা । এখানকার উচ্চতা ৫,৫০০ ফুট - ঠান্ডা মাঝারি ধরনের ।
২. স্টেশন থেকে তাকদা যাওয়ার জন্য গাড়ি পাওয়া সহজ নয়, তাই আগে থেকে বুক করে রাখাই ভাল । সুমো বা ওই জাতীয় বড় গাড়ির তাকদা যাওয়ার ভাড়া ৩,০০০/- টাকা ।
৩. তাকদায় থাকার জায়গা হল 'ব্রিটিশ হেরিটেজ বাংলো' (এর অন্য নাম 'সাইনো হেরিটেজ গেস্ট হাউস') । এদের ওয়েবসাইট http://heritagebungalows.com/takdah-british-bungalow-west-bengal/ থেকে এদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় । কলকাতা থেকে এদের বুকিং করার ফোন নম্বর ঃ (033)25299689, 8902232559 ।
৪. তাকদার ব্রিটিশ বাংলো একটা পাহাড়ের ওপরে । এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই মনোরম ।
৫. ব্রিটিশ বাংলোয় সারাদিনের খাওয়াদাওয়ার জন্য মাথাপিছু প্রতিদিন ৬০০/- টাকা করে লাগে । এতে সকালে ব্রেকফাস্ট, দুপুরে লাঞ্চ, বিকেলে চা আর রাতের ডিনার পাওয়া যায় । এর বাইরে খাবার নিলে তার জন্য আলাদা চার্জ লাগে ।
৬. এখানকার খাবারের মান বেশ ভালো । এরা একেবারেই ঘরোয়া রান্না করে যার ফলে খেয়ে কখনও শরীর খারাপ করার সম্ভাবনা থাকে না ।
৭. বাংলোর ঠিক পিছনেই কয়েকধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠলে তাকদা মনাস্ট্রি । এখান থেকে সূর্য্যোদয় বা সূর্য্যাস্তের দৃশ্য অত্যন্ত সুন্দর । তবে এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার কোনও ভিউ পাওয়া যায় না ।
৮. বাংলো থেকে পায়ে হাঁটা পথে মিনিটদশেক হাঁটলে পৌঁছনো যায় একটা চার্চে । এটা আগে একটা বাংলো ছিল -বর্তমানে চার্চে পরিণত করা হয়েছে ।
৯. বাংলোর পিছনে পায়ে হাঁটা পথ দিয়ে ইচ্ছে করলে ট্রেকিং করা যায় । কিছুদূর এগোলে পাহাড়ী পথে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়া যায়, তবে সঠিক জুতো না পরে এখানে যাওয়া ঠিক হবে না ।
১০. বাংলো থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে পাইন ফরেস্ট আছে । এখানে দেখা যায় নানারকম নাম-না-জানা পাহাড়ী ফুলের গাছ যা দেখতে খুব ভালো লাগে ।
১১. তাকদার লোক্যাল সাইট সিয়িং-এর মধ্যে আছে 'অর্কিড গার্ডেন', 'রাংলি-রাংলিওট টি-গার্ডেন', 'তিস্তা ভ্যালি দূরবীন ভিউ পয়েন্ট', 'বারবাটে হ্যাঙ্গিং ব্রীজ' । এগুলোর কোনওটাই খুব বেশি দূরে নয়, তাই গাড়িতে হাফ-ডে ট্যুরেই ঘুরে আসা যায় । গাড়ি এরজন্য নেয় ২,০০০/- টাকা ।
১২. তাকদা থেকে সারাদিনের সাইট-সিয়িং এর জন্য কালিম্পং বা দার্জিলিঙ যাওয়া যেতে পারে । গাড়ি এরজন্য নেয় ৩,০০০/- টাকা ।
১৩. তাকদা থেকে কালিম্পং যাওয়ার পথে 'তিনচুলে ভিউ পয়েন্ট', 'ছোটামাঙ্গয়া অরেঞ্জ গার্ডেন' দেখার মতো জায়গা । তাকদা থেকে কালিম্পং যেতে ঘন্টা দুয়েক লাগে ।
১৪. কালিম্পং শহরে একটা ক্যাকটাস গার্ডেন আছে যেটা দেখার মতো । এছাড়া কালিম্পং থেকে অনতিদূরে ডেলো পার্ক আছে যেখানে যাওয়া যেতে পারে ।

উপসংহারঃ

তাকদা
দার্জিলিঙ-কার্শিয়ং-কালিম্পং এর ভীড়ভাট্টা যাদের পছন্দ নয়, তাদের জন্য প্রায় একই দূরত্বে আরেকটা ঘোরার জায়গা - তাকদা । আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা - তাকদার সবকিছুই ভালো । ভালো থাকার জায়গা, ভালো খাওয়া, ভালো প্রাকৃতিক দৃশ্য, ভালো ঘোরা সবমিলিয়ে তাকদা অনবদ্য । এটা আসলে একটা ছোট গ্রাম, খুব বেশি লোকের বসতিও নেই । ট্যুরিস্টদের কেনাকাটা করার মতো সেরকম কোনও দোকান নেই আর তাই ট্যুরিস্টদের নিয়ে এখানকার মানুষের কোনও বাড়াবাড়িও নেই । আর এই বৈশিষ্ট্যই জায়গাটাকে আরও মনোরম করে তুলেছে । এখানে সূর্য্যোদয় আর সূর্য্যাস্ত দু'টোই ভীষণ সুন্দর হয় - যা খুব কম পাহাড়ী জায়গাতেই দেখা যায় । এখানে এসে যদি আর কোথাও ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা নাও করা হয়, শুধুমাত্র দু'তিন দিন এখানে বসে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিতেও দারুণ লাগবে । একটা ছোট্ট পরিসরে ততধিক ছোট্ট একটা গ্রাম - কিন্তু সৌন্দর্য্যের দিক থেকে বিশালাকার । প্রকৃতি এখানে নিজেকে মেলে ধরেছে স্বমহিমায় আর সেই জন্যই কৃত্রিমতার ছাপ খুব কম । তাই এইরকম জায়গা এবং পরিবেশ যাদের পছন্দ, তাকদায় একবার ঘুরে আসাটা তাদের জন্য একটা লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স - এটা বলা যেতেই পারে !

তাকদা ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

Sunday, June 5, 2016

শঙ্করপুর ভ্রমণ

০১৪ সালে তাজপুর ভ্রমণের পর অফিস থেকে আমরা এবারে গেলাম শঙ্করপুর । পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলায় অবস্থিত এই জায়গাটা তাজপুরের মতোই, তবে তাজপুরের তুলনায় বেশি ফাঁকা । সপ্তাহান্তে কলকাতা থেকে একদিনের জন্য ঘুরতে যেতে হলে যে যে অপশনগুলো আছে, শঙ্করপুর তাদের মধ্যে অন্যতম ।

রামনগর স্টেশনে পুরো দল (ফোটোগ্রাফার বৈশাখী বাদে)
৪ঠা জুন, ২০১৬ শনিবার সকালে হাওড়া স্টেশন থেকে তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেসে আমাদের যাত্রা শুরু । ট্রেন ছাড়ে সকাল ৬:৪০ এ আর রামনগর পৌঁছয় ৯:৪৪ এ । এবারে আমাদের দল তিনজন শিশুসহ মোট একুশ জনের - বলা বাহুল্য তিনজনের মধ্যে দু'জন আমাদের যমজ মেয়ে কথা-কলি । এছাড়া অন্যজন কঙ্কনাদির মেয়ে মিঙ্কা । বড়দের নাম আর লিখলাম না । এখানে উল্লেখ করা দরকার আমাদের ট্রিপটার সম্পূর্ণ খরচ আমাদের অফিস বহন করেছে - হাওড়া থেকে হাওড়া পর্যন্ত আমাদের একপয়সাও লাগেনি । ট্রেনে ব্রেকফাস্টের জন্য কুকিজারের চিকেন স্যান্ডউইচ কেনা হয়েছিল, ট্রেন ছাড়ার একটু পরে সেগুলো খেয়ে নেওয়া হল । ট্রেন মাত্র পাঁচমিনিট লেট করে আমাদের পৌঁছে দিল রামনগর স্টেশনে ।

রামনগর থেকে শঙ্করপুর যাওয়ার জন্য ভ্যান, অটো, ট্রেকার পাওয়া যায় আর এখানে এদের একটা রেটচার্ট টাঙানো আছে । কিন্তু আমাদের হোটেল থেকে আগেই দু'টো বড় ট্রেকার ভাড়া করে রেখেছিলাম, সেগুলো আমাদের শঙ্করপুর পৌঁছে দিল সওয়া দশটার একটু পরে ।

অশোকা হোটেলের সামনে সমুদ্র
আমাদের হোটেলের নাম 'অশোকা হোটেল' । এটা একেবারে বিচের ধারেই - ঘর থেকে সমুদ্র দেখা যায় । আমরা মোট আটটা নন-এসি ঘর নিয়েছিলাম আর ঘরভাড়া ৭৫০/- টাকা করে (ডিসকাউন্ট দিয়ে) । ঘরগুলো খুব বড় নয়, তবে আমাদের মেয়াদ মাত্র একরাত, তাই কোনও অসুবিধে হয়নি । ঘরে এসে একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম । তারপর এগারোটা নাগাদ গেলাম সমুদ্র দেখতে ।


শঙ্করপুরের বাঁধানো পাড়
শঙ্করপুরে একটা বড় জায়গা জুড়ে সমুদ্রের পাড় বাঁধানো । অশোকার সামনের পুরোটাই এরকম । এইরকম জায়গায় চান করা যায় না, তাই চান করার জন্য আমাদের আরও কিছুটা এগিয়ে যেতে হল । বাঁধানো পাড় শেষ হওয়ার পর চান করার জায়গাটা খুবই সুন্দর । দুপুরের দিকে জোয়ার ছিল বলে চান করতে আরও আরাম । সঙ্গে বাচ্চা থাকায় অমৃতা আর আমি চান করলাম না, পাড়ে বসেই এনজয় করলাম । এছাড়া সমুদ্রের ধারে গেলে যা করতেই হয় - ডাব খেলাম ।

দুপুরে হোটেলে ফিরে এসে চান করে লাঞ্চ করতে গেলাম । অশোকার ডাইনিং হলটা বেশ বড় - একসঙ্গে ৩০ জন বসে খাওয়া যায় । দুপুরের মেনুতে ছিল ভাত, ডাল, আলুভাজা, পোস্ত, পারসে মাছ, ভেটকি মাছ, চাটনি, পাঁপড় ইত্যাদি । খাবারের কথা উল্লেখ করলাম কারণ এখানকার রান্না অদ্ভুত সুন্দর । প্রত্যেকটা আইটেমই খেতে অত্যন্ত ভালো হয়েছিল আর সেইজন্যই কিছুটা বেশি খাওয়া হয়ে গেল । খাওয়ার পরে দুপুরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম ।

সমুদ্রের ধারে কথা-কলির সঙ্গে আমরা
বিকেলে আবার সমুদ্রের ধারে । শঙ্করপুর তাজপুর মন্দারমণি - এই ্জায়গাগুলোয় সমুদ্র ছাড়া আর কিছুই নেই, তাই হোটেলে থাকা অথবা সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসা এছাড়া আর কিছু করার নেই । শঙ্করপুরে সমুদ্রের ঢেউ ভালোই, আর বাঁধানো পাড়ে একটু নিচের দিকে গিয়ে বসলে জল এসে পায়ে আছড়ে পড়ে, তাই এখানে বসে থাকলে দিব্যি সময় কেটে যায় । সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার সময়ে হোটেল থেকে ইভনিং স্ন্যাক্স দিল - চা, ভেজ পকোড়া আর চিকেন পকোড়া । আমরা সমুদ্রের ধারে বসেই এগুলোর সদ্ব্যবহার করলাম । সাড়ে আটটার পরে আমরা আবার হোটেলে ফিরে এলাম ।

ডিনারের মেনু ছিল রুটি, চিকেন কারি আর আইসক্রিম । খাওয়ার পরে ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম । আমাদের ঘরটা ছিল একেবারে সামনের দিকের ঘর, তাই সমুদ্রের হাওয়া খুবই দিচ্ছিল । গরমকাল হওয়া সত্ত্বেও ঘরের মধ্যে বেশ আরাম লাগছিল ।

শঙ্করপুরের সূর্য্যোদয় - সমুদ্রের ওপরে হচ্ছে না
পরেরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন সূর্য্যোদয় হয়ে গেছে । এখন জুনমাস, আর শঙ্করপুরে সমুদ্রের ওপর থেকে সূর্য্যোদয় হয় না । তবে সকালে সমুদ্রের ধারে ঘুরতে ভালোই লাগে । বেলা সাড়ে আটটা নাগাদ আমাদের ব্রেকফাস্ট দিয়ে দিল । লুচি আর আলুর তরকারি । আগেরদিনের লাঞ্চ থেকে শুরু করে এই ব্রেকফাস্ট পর্যন্ত্য পুরোটা খাওয়ার প্যাকেজের মধ্যে - মাথাপিছু খরচ ৬২৫/- টাকা । আমরা দুপুরের লাঞ্চটা এদের থেকে প্যাক করিয়ে নিলাম কারণ সেটা আমাদের ফেরার পথে লাগবে । মেনু হল ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন । এর দাম ১৫০/- টাকা করে । আমাদের ফেরার ট্রেন সেই তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেস যেটা রামনগর থেকে ১০:৩৮ এ ছাড়ে ।

হোটেল থেকে চেক্-আউট করে বেরোলাম তখন সাড়ে ন'টা । আবার ট্রেকার আমাদের স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিল । নির্ধারিত সময়ে ট্রেন এল আর আমাদের নিয়ে ছেড়েও দিল । তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেসের হাওড়া পৌঁছনোর নির্ধারিত সময় দুপুর ১:৫০ আর ট্রেন লেট করল পঁচিশ মিনিট মতো । এখান থেকে ট্যাক্সি ধরে বাড়ি !

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে একদিনের জন্য কোথাও যেতে চাইলে শঙ্করপুর একটা ভালো অপশন । জায়গাটা মোটামুটি ফাঁকা, বিশ্রাম নেওয়ার পক্ষে খুব সুন্দর ।
২. হাওড়া থেকে ট্রেনে রামনগর পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে গাড়ি করে শঙ্করপুর যাওয়া যায় । এছাড়া সরাসরি গাড়ি নিয়েও এখানে যাওয়া যেতে পারে ।
৩. শঙ্করপুরে অল্পসংখ্যকই হোটেল আছে । 'অশোকা হোটেল' তাদের মধ্যে অন্যতম । এখানকার যোগাযোগের নম্বর - 03220-264275 । এছাড়া ইন্টারনেটের মাধ্যমে এদের বুকিং করা যেতে পারে ।
৪. শঙ্করপুরের প্রায় সব হোটেলই সমুদ্রের ধারে । এখানে সমুদ্রের পাড় বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে বাঁধানো - কিছুটা জায়গা আছে যেখানে চান করা যায় ।
৫. শঙ্করপুরের সমুদ্রে ঢেঊ বেশ ভালো - চান করে ভালই লাগবে । সমুদ্রের ধারে অল্প কিছু দোকান আছে ।

উপসংহারঃ

শঙ্করপুর
কলকাতা থেকে সপ্তাহান্তে অর্থাৎ শনিবার গিয়ে রবিবার ফিরে আসার মতো জায়গা কমই আছে - শঙ্করপুর এদের মধ্যে অন্যতম । তাজপুর মন্দারমণি তালসারি বক্‌খালি উদয়পুরের মতো শঙ্করপুরেও সমুদ্র ছাড়া দেখার কিছুই নেই । তাই ঘুরতে যাওয়ার জন্য না গিয়ে বরং বলা যেতে পারে রিল্যাক্স করার জন্য শঙ্করপুর যাওয়া যেতে পারে । এখানে সমুদ্র বেশ সুন্দর - ভালো ঢেউ আছে । সমুদ্রে চান করা যেতে পারে আবার পাড়ে বসে সমুদ্রের দৃশ্যও উপভোগ করা যেতে পারে । আমাদের কোলাহলপূর্ণ দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে একটা শান্ত-সুন্দর পরিবেশে একটা দিন কাটানোর এই অভিজ্ঞতা অর্জন করার জন্যই শঙ্করপুর । এখানে হয়তো দেখার অনেক কিছু নেই, কিন্তু যা আছে তা সময় কাটানোর জন্য যথেষ্ট । সবমিলিয়ে খরচও খুব বেশি না । তাই যদি হাতে একদিনের ছুটিও না থাকে, শুধুমাত্র সপ্তাহান্তে একটা দিন কোথাও চলে যাওয়ার জন্য শঙ্করপুর অবশ্যই একটা দূর্দান্ত জায়গা !

শঙ্করপুর ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

ফোটোগ্রাফার যখন ক্যামেরার সামনে
কৃতজ্ঞতা স্বীকার - শঙ্করপুরে অমৃতা বা আমি ক্যামেরা নিয়ে যাইনি কারণ আমাদের ছবি তোলার বিশেষ অবকাশ ছিল না । লেখার সঙ্গের সবক'টা ছবিই আমাদের অফিসের বৈশাখীর তোলা । এছাড়া উপরের লিঙ্কে আরও যা যা ছবি আছে, সেগুলোও ওরই তোলা । কথায় বলে প্রত্যেক সফল পুরুষের পিছনে একজন নারীর অবদান থাকে । শঙ্করপুরের প্রত্যেক সফল ছবির পিছনেও যে একজন নারীরই অবদান ছিল, এই ছবিগুলো তারই প্রমাণ !

Sunday, March 13, 2016

দেওঘর ভ্রমণ

দীঘা-পুরী-দার্জিলিঙ এই তিনটে জায়গা বাদ দিলে বাঙালির সবচেয়ে কমন্‌ ঘোরার জায়গা বোধহয় 'দেওঘর' (আমার নিজেরই এই নিয়ে চারবার হয়ে গেল । তবে আগেরবারগুলো যখন গেছি, তখন ব্লগ লিখতাম না) । কলকাতা থেকে মাত্র ঘন্টা ছয়েকের রেলদূরত্বে ছোটনাগপুর মালভূমির মধ্যে অবস্থিত এই প্রাচীন শহরে বহুকাল ধরেই নানাধরণের মানুষের যাতায়াত । বলা বাহুল্য এদের মধ্যে বাঙালিই বেশি । আগেকার দিনে একটা রেওয়াজ ছিল - একটু অবস্থাপন্ন বাঙালিরা দেওঘরে একটা করে বাড়ি কিনে রাখতেন আর মাঝে মাঝে হাওয়া বদলাতে সেখানে যেতেন । আমরা অবশ্য হাওয়া বদলাতে যাইনি, সত্যি বলতে কি হাওয়া যাতে বেশি বদলে না যায়, সে'জন্যই আমাদের দেওঘর যাওয়া ।

এবারে আমাদের দল বারোজনের । আমি, আমার স্ত্রী অমৃতা, আমাদের যমজ মেয়ে কথা-কলি (শিশুশিল্পী), বাবা, মা, আমার অফিসের কলিগ্‌ সমীরণদা, বৌদি, ঋজু, আমার আরেক কলিগ্‌ কঙ্কনাদি, অমিতদা, মিনকা (শিশুশিল্পী) । আমাদের সঙ্গে ছোট বাচ্চা আছে, তাই আমাদের এমন জায়গায় যেতে হবে যেখানকার আবহাওয়া কলকাতার থেকে বেশি আলাদা নয় । আবার এমন জায়গা হতে হবে যেটা খুব অফ্‌বীট নয় অর্থাৎ যেকোনও ধরনের পরিষেবা যেখানে সহজেই উপলব্ধ । আবার সেইসঙ্গে খরচেরও একটা সামঞ্জস্য থাকা চাই । আবার ... থাক আর 'আবার'-এর দরকার নেই এককথায় সবদিক থেকে দেওঘর আমাদের পক্ষে উপযোগী হয়েছে বলে আমরা সেখানেই গেছি ! হয়েছে ?

হাওড়া-শিয়ালদা-কলকাতা স্টেশন থেকে দেওঘর যাওয়ার একগুচ্ছ ট্রেন আছে । প্রকৃতপক্ষে কোনও দূরপাল্লার ট্রেন দেওঘর যায় না, দেওঘর যাওয়ার জন্য জসিডি-তে নামতে হয় । আমরা ১০ই মার্চ, ২০১৬ বৃহস্পতিবার সকালে কলকাতা স্টেশন থেকে 'কলকাতা-নাঙ্গাল ড্যাম এক্সপ্রেস' ধরলাম । ট্রেন ছাড়ার সময় সকাল ৭ : ৪০ আর পৌঁছনোর সময় দুপুর ১২ : ১৩ । এই ট্রেনটার সুবিধে হল এর স্টপেজ খুব কম - কলকাতা, আসানসোল আর তারপরেই জসিডি (এটা অবশ্য খাতায়-কলমে, আসলে এর মাঝেও কয়েকটা জায়গায় দাঁড়িয়ে যায়) । আর যেহেতু সঙ্গে ছোট বাচ্চা রয়েছে, তাই আমরা দিনেরবেলা যাওয়াই স্থির করেছিলাম ।

ট্রেন জসিডি পৌঁছলো দুপুর ১ টার পরে । জসিডি থেকে দেওঘর অটোরিক্সায় যেতে হয়, অথবা চাইলে লোক্যাল ট্রেনেও যাওয়া যায় (দেওঘর স্টেশনের নাম 'বৈদ্যনাথধাম') । এখানে বড় সাইজের অটো চলে, যেগুলোয় একটু চেপেচুপে ন'জন পর্যন্ত বসে যাওয়া যায় । প্রায় আধঘন্টা চলার পরে অটো আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিল আর ১০০/- টাকা নিল ।

হোটেল যশোদা ইন্টারন্যাশনালের ঘর
'হোটেল যশোদা ইন্টারন্যাশনাল' । দেওঘরের প্রাণকেন্দ্র 'টাওয়ার চক্‌'- থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটাদূরত্বে এই হোটেলটা অপেক্ষাকৃত নতুন । বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং ভাড়া বেশ কম । নন-এসি ঘরের ভাড়া ৬০০/- টাকা আর Cleartrip থেকে বুকিং করায় আমরা আবার এর ওপর ৫০% ছাড় পেয়েছিলাম । ঘরগুলো বাইরের রাস্তার সঙ্গে যুক্ত নয়, তাই ঘর থেকে রাস্তা দেখার যেমন সুযোগ নেই, তেমনই রাস্তার কোলাহলও ঘরে এসে পৌঁছয় না ।

আমরা চানটান করে গেলাম হোটেলের ডাইনিং রুমে । ডাইনিং রুমটা খুব বড় নয়, তিনটে বড় টেবিলে খুব বেশি হলে ২০ - ২৫ জন একসঙ্গে খেতে পারে । আমরা ভাত-ডাল-আলুভাজা-চিকেন ইত্যাদি খেলাম । সবমিলিয়ে খরচ পড়ল মোট ১,৭৮৯/- টাকা ।

টাওয়ার চক্‌
খাওয়া শেষ করে ঘরে এসে বিশ্রাম নিলাম । আমরা দু'টো পুরো দিন দেওঘরে থাকছি - তাতে দেওঘর আমাদের সম্পূর্ণভাবে দেখা হয়ে যাবে । প্রথমদিন তাই কোথাও বেরোনোর প্ল্যান ছিল না, তাও সন্ধ্যেবেলা একবার বেরিয়ে টাওয়ার চক্‌ হয়ে মার্কেটের দিকে গেলাম । সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে চা-টা খেয়ে আবার হোটেলে ফিরে এলাম । রাতে ডিনারে রুটি-ডিম-চিকেন খাওয়া হল । খরচ পড়ল মোট ৯৭১/- টাকা ।









পরেরদিন ১১ই মার্চ, ২০১৬ শুক্রবার আমাদের দেওঘরে সাইট-সিয়িং এর দিন । যশোদা ইন্টারন্যাশনালের আরেকটা সুবিধে হল গাড়ির স্ট্যান্ডটা একেবারেই এর সামনে । ন'জনের জন্য একটা বড় অটো নেওয়া যেত কিন্তু তাতে সারাদিন ঘোরাঘুরি করা বেশ চাপের (আক্ষরিক অর্থেই) । আমরা ১,০০০/- টাকায় একটা পুরনো মডেলের সুমো পেয়ে গেলাম যেগুলোর সামনে দু'জনের সীট্‌ থাকে । তাতে করে শুরু হল আমাদের দেওঘরের সাইট সিয়িং ।

নওলাখা মন্দির
প্রথম দ্রষ্টব্য : নওলাখা মন্দির
কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়ির রাণী চারুশিলা এই মন্দিরটি তৈরি করান । ন'লাখ টাকা দিয়ে তৈরি হয়েছিল বলে এর এই নাম । কিছুটা বেলুড়মঠের আদলে তৈরি এই মন্দিরে গোপাল আর রাধাকৃষ্ণের মূর্তি আছে । সিঁড়ি দিয়ে উঠে মন্দিরের চত্বরটা খুব বড় আর চারপাশটা খোলা বলে খুব সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল (আমাদের দলের কেউ কেউ তো বলল আর সাইট সিয়িং-এ যাওয়ার দরকার নেই, এখানেই বিকেল পর্যন্ত বসে থাকি !) । মন্দিরে কোনও ভীড় নেই, নিজের ইচ্ছেমতো সময় নিয়ে দেখা যেতে পারে ।

তপোবন পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ি
দ্বিতীয় দ্রষ্টব্য : তপোবন পাহাড়
দেওঘর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দুরত্বে অবস্থিত তপোবন পাহাড় । এখানে বালানন্দ ব্রহ্মচারীর আশ্রম রয়েছে । এখানে আমরা পৌঁছলাম তখন বেলা সাড়ে এগারোটা । আমাদের ড্রাইভারের কথা শুনে আমরা এখানে ব্রেকফাস্ট করলাম । পাহাড়ের সামনে কয়েকটা ছোটো ছোটো দোকান আছে । খাবার হল ছাতুর পুরী আর সঙ্গে ডাল-তরকারী । সকালের জলখাবার হিসেবে একেকজনের জন্য দু'টো করেই যথেষ্ট । খাওয়া শেষ করে আমরা তপোবন পাহাড়ে চড়তে শুরু করলাম । পাহাড়ের ধাপে ধাপে নানারকম মন্দির রয়েছে । ওঠা-নামার সময়ে সবসময়েই সেখানে পয়সা দেওয়ার জন্য বলতে থাকে । সেগুলো না দিয়েও অনায়াসে যাওয়া যায়, কিন্তু এখানকার বাঁদরের থেকে সাবধান ! এখানকার (ট্রেনিংপ্রাপ্ত) বাঁদররা খুব ক্ষিপ্রতার সঙ্গে যাত্রীদের হাতে থাকা ছোটখাটো জিনিস, যেমন সানগ্লাস, ক্যামেরা, মোবাইল ইত্যাদি নিয়ে নেয় । আবার তাদের সঙ্গে থাকা দুপেয়ে বাঁদররা হাতে ছোলা-কলা নিয়ে বসে থাকে, যদি কোনওভাবে সেই ছোলা-কলায় হাতও লেগে যায়, তাহলেও তারজন্য পয়সা দিতে হবে । তাই তপোবনে সর্বস্তরের বাঁদরদের থেকে সাবধান ।

তপোবনের ছাদ থেকে
আমরা পাহাড়ের ধাপে ধাপে উঠে একেবারে মাথায় চলে গেলাম । এখান থেকে চারদিকের দৃশ্য খুবই মনোরম আর একটা ঠান্ডা হাওয়া সারাক্ষণ দিতে থাকে বলে দুপুরের প্রখর রোদেও খুব গরম লাগে না ।

তপোবন পাহাড় থেকে নামার রাস্তাটা সবথেকে বেশি রোমাঞ্চকর । চাইলে সিঁড়ি দিয়ে ভদ্রভাবে নেমে আসা যায়, আবার চাইলে পাহাড় ভেঙ্গে বিপদের ঝুঁকি নিয়েও নামা যায় । পাহাড়ের একেকটা ছোটো ছোটো খাঁজ দিয়ে পুরো শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত আনন্দ আছে । একটা জায়গা আবার ভীষণ ঢালু । সেখান দিয়ে নামার সময়ে খুব সাবধানে নামতে হয় কারণ কোনওকারণে পা-হড়কালে ... না মৃত্যু নয়, তবে বেশ ভালোরকম জখম হওয়ার সম্ভাবনা । একেকটা জায়গায় গিয়ে মনে হয় "আর এগোতে পারব তো ?" আমরা কিন্তু কোনও গাইড নিইনি আর নামার সময়ে অন্য কোনও ট্যুরিস্টের দলও আমাদের সঙ্গে ছিল না । পাহাড়ের মাঝে মানুষের পায়ে চলা পথের দাগ দেখেই আমরা নিজেদের পথ খুঁজে বের করেছি । যখন নেমে এলাম, তখন বেশ উত্তেজিত লাগছিল । একটা কথা অবশ্যই বলব ব্যাপারটা যে কঠিন তা নয়, তবে করার জন্য মনের জোরের দরকার আছে আর গাইডের দরকার একেবারেই নেই ।

ত্রিকূট পাহাড়ের রোপওয়ে
তৃতীয় দ্রষ্টব্য : ত্রিকূট পাহাড়
দেওঘর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই ত্রিকূট পাহাড়ের বৈশিষ্ট্য হল এটা দেওঘরের সবথেকে উঁচু জায়গা । এর উচ্চতা ১,৫০০ ফুট । চাইলে ট্রেকিং করে এর ওপরে ওঠা যায়, তবে এখনকার দিনে রোপওয়ে হয়ে যাওয়ায় সেভাবে ওঠার আর কোনও মানে হয় না । ওঠানামা মিলিয়ে মাথাপিছু ১০০ টাকার টিকিটে ত্রিকূট পাহাড়ে উঠতে সময় লাগে মিনিট দশেক । রোপওয়েতে এই জার্ণিটা খুবই সুন্দর । রোপওয়ে যখন ওপরের দিকে ওঠে, তখন পায়ের অনেক তলায় পাহাড়ের নিচের দিকটা দেখতে দারুণ লাগে । মাথায় ওঠার পর হেঁটে এদিক-ওদিক ঘুরে আসা যায় । ত্রিকূট পাহাড়ের ওপর থেকে দেওঘরের দৃশ্য অত্যন্ত মনোরম । এখানে গাইডের উৎপাতও আছে, তবে আমরা তাদেরকে উপেক্ষা করেছি । আধঘন্টা পাহাড়ের মাথায় হাঁটাহাঁটি করে আমরা নেমে একই পথে নেমে এলাম । ত্রিকূট পাহাড়ে গেলে এই রোপওয়েটা অবশ্যই চড়া উচিৎ । এটা একটা বেশ দারুণ অভিজ্ঞতা যেটা কলকাতার সায়েন্স সিটি বা নিক্কোপার্কের রোপওয়েতে হবে না !

নিচে নেমে আখের রস খেতে হল (মানে এটা বাধ্যতামূলক নয়, আমরা খেলাম আর কি !) । দুপুর আড়াইটে বাজে, কিন্তু এখানে কোনও ভালো ভাতের হোটেল নেই । তাছাড়া সকালের ছাতুর পুরী তখনও পেটে গজগজ করছিল তাই আমরা খাওয়ার পেছনে সময় নষ্ট না করে এগিয়ে গেলাম আমাদের চতুর্থ তথা শেষ গন্তব্যের দিকে ।

নন্দন পাহাড়ের সিঁড়ি
চতুর্থ দ্রষ্টব্য : নন্দন পাহাড়
নন্দন পাহাড় কে পাহাড় না বলে ঢিপিও বলা যায়, এটা দেওঘর শহরের সবথেকে উঁচু জায়গা (আগেরটা ছিল দেওঘরের সবথেকে উঁচু জায়গা । অর্থাৎ এটা আগেরটার সাবসেট্‌ ।) । এখান থেকে দেওঘরের পানীয় জলের সাপ্লাই হয় । পাহাড়ে উঠতে (এবং নামতেও) ১৪০ টা সিঁড়ি আছে (এটা আমাদের ড্রাইভার বলল, আমি নিজে গুণে দেখিনি) । পাহাড়ের ওপরে যথারীতি কিছু মন্দির আছে আরে পাহাড়ে ওঠার পথে একটা বাচ্চাদের পার্ক আছে । এছাড়া একটা টয়ট্রেনও আছে যেটা পাহাড়ের গা-বেয়ে ওপরে ওঠানামা করে । আমরা পাহাড়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ফিরে এলাম ।

আমাদের দেওঘরের সাইট সিয়িং এই চারটে জায়গা ঘুরেই শেষ, তবে চাইলে এই একই প্যাকেজের মধ্যে এরা আরও দু'টো জায়গা দেখায় । একটা হল 'বৈদ্যনাথের মন্দির' । সেখানে আমরা পরে নিজেরা যাব । আর অন্যটা 'অনুকূল ঠাকুরের সৎসঙ্গ আশ্রম' । এখানে যাওয়ার ব্যাপারে একটা বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ আছে - 'দিস থিংস আর পারফর্মড বাই এক্সপার্টস । ডু নট ট্রাই দিস ইফ ইউ ডোন্ট হ্যাভ এনাফ ভক্তি ফর অনুকূল ঠাকুর' । আমাদের একেবারেই নেই, তাই আমাদের গাড়ি আমাদের হোটেলের সামনে নামিয়ে দিল ।

বিকেল সাড়ে চারটে বাজে, খিদেও পেয়েছে । আমাদের হোটেলে কোনও খাবার পাওয়া গেল না, তাই আমাদের হোটেলের ঠিক মুখোমুখি একটা হোটেলে আমরা লাঞ্চ করে নিলাম । ভাত, ফ্রায়েড রাইস, চাউমিন, চিকেন মিলিয়ে খরচ পড়ল ১,৪০০/- টাকা ।

হোটেলে ফিরে এসে বিশ্রাম নিলাম । খুব যে কিছু ক্লান্ত ছিলাম তা নয়, তবে আর কিছু করারও ছিল না । দেওঘরে সন্ধ্যেবেলা বিশেষ কিছু করার থাকে না, চাইলে ওই টাওয়ার চক্‌-মার্কেট-মন্দির । বৈদ্যনাথের মন্দির রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে । আমাদের দল বেশ বড়, তাই কিছু করার না থাকলেও কিছু করার থাকেই । হোটেলের ঘরে আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যেটা কাটিয়ে দিলাম । রাতে হোটেলের ডিনারে রুটি-ডিম-চিকেন নিয়ে খরচ পড়ল ৮৪১/- টাকা ।

গিরিডি যাওয়ার পথে
১২ই মার্চ ২০১৬, শনিবার । আমাদের গিরিডিতে উশ্রী যাওয়ার দিন ("উশ্রী নদীর ঝরণা দেখতে যাব । দিনটা বড় বিশ্রী । শুনছ বজ্রের শব্দ ? ..." - সহজপাঠ, দ্বিতীয় ভাগ । মনে পড়ছে ? এছাড়া প্রোফেসর শঙ্কুর বাড়িও ছিল গিরিডিতে - উনি মাঝে মাঝে উশ্রীর ধারে হেঁটে বেড়াতে যেতেন) । এটা আমার ব্যক্তিগত ফেভারিট - দেওঘর বা মধুপুর গেলে গিরিডি যাওয়ার জন্য আমি বিশেষভাবে বলব । সকালে আমাদের দলের কয়েকজন বৈদ্যনাথের মন্দিরে গিয়েছিল, তাই ব্রেকফাস্ট করে আমাদের বেরোতে বেরোতে বেলা সাড়ে এগারোটা বেজে গেল । এবারেও একটা ন'জন বসার সুমো । দেওঘর থেকে উশ্রীর দুরত্ব ৭৫ কিলোমিটারের মতো এবং গাড়িভাড়া নিল ২,৪০০/- টাকা । গিরিডি থেকে উশ্রীর দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার । যাওয়ার রাস্তাটা বেশ সুন্দর । রাস্তার দু'পাশের দৃশ্যও বেশ চিত্তাকর্ষক । আমরা বসন্তকালে গিয়েছিলাম বলে রাস্তার দু'ধারে "রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে" দেখতে পেয়েছি । রোদের তাপ বিশেষ ছিল না আর একটা সুন্দর হাওয়া সারাক্ষণ দিচ্ছিল বলে বেশ ফুরফুরে লাগছিল । আমরা উশ্রী পৌঁছলাম তখন দুপুর দু'টো ।

উশ্রী নদীর ঝর্ণা
উশ্রীর ঝর্ণা দেখে একটু হতাশ হলাম । আমি এর আগে দু'বার উশ্রীতে এসেছি - একবার অক্টোবর মাসে আরে আরেকবার আগস্ট মাসে । স্বভাবতই তখন উশ্রীতে জল বেশি ছিল । এখন এই মার্চ মাসে জলের স্রোত বেশ কম - চান করার সুবিধেও বিশেষ নেই । পাথরের ওপর পা দিয়ে ধাপে ধাপে এদিক ওদিক যাওয়া যায় । আমরা সেরকমই একটা জায়গায় গিয়ে কিছুক্ষণ জলে পা-টা দিয়ে ছবি তুললাম । পাথরের ওপর পিছল থাকায় একবার আছাড়ও খেয়েছি । ঝর্ণার জল বেশ ঠান্ডা, জায়গাটা গাছপালা ঘেরা হওয়ার বসে থাকতে বেশ ভালোই লাগছিল । ঘন্টাখানেক জলকেলি করে আমরা ফেরার পথ ধরলাম ।

গিরিডিতে ভাতের ভালো হোটেল বেশি নেই - তাই আমাদের গাড়ি যখন একটা নিরামিষ হোটেলের সামনে গতি কমালো, তখন বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল । কিন্তু পরমূহুর্তেই যখন দেখলাম গাড়ি সেখানে না থেমে এগিয়ে চলল, তখন কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম । শেষে একটা বেশ ঝাঁ চকচকে হোটেলে আমরা লাঞ্চ করলাম । এখানকার রান্নার মান খুবই ভালো আর সেইসঙ্গে দামও । ড্রাইভার সমেত আমাদের খাওয়ার খরচ পড়ল ১,৮৫০/- টাকা ।

খান্ডোলি ড্যাম
গিরিডি থেকে দেওঘর ফেরার পথে আরেকটা দেখার জায়গা আছে - সেটা হল খান্ডোলি ড্যাম । গিরিডি থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে এই জায়গায় একটা জলাধার আছে । এর পাশেই একটা ছোট পাহাড় । আমরা এখানে পৌঁছলাম তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা - তখন সূর্য্যের আলো কমে এসেছে । তা সত্ত্বেও এখানে বসে থাকতে ভীষণ ভালো লাগছিল । সারাক্ষণ একটা হাওয়া দেয় আর জায়গাটা এমনিতে একেবারেই ফাঁকা হওয়ায় সবমিলিয়ে খুব ভালো লাগে । একটা পার্কও আছে, চাইলে সেখানে গিয়েও দোলনা-টোলনা চড়া যেতে পারে । আমাদের হাতে সময় বেশি ছিল না, থাকলে খান্ডোলিতে ঘন্টাখানেক বেশ ভালোভাবে কাটানো যেত ।

ফেরার সময়ে অন্ধকার হয়ে গেল । গিরিডি থেকে দেওঘর ফেরার এই জার্ণিটা অনেকদিন মনে থাকবে । অন্ধকার ফাঁকা রাস্তায় হু হু করে গাড়ি ছুটছে আর সেইসঙ্গে দিচ্ছে ঝড়ের মতো হাওয়া । গাড়ির ভেতরে বসে এত আরাম লাগছিল, যে মনে হচ্ছিল জার্ণিটা শেষ না হলেই ভালো হয় । কিন্তু তা হয় না, প্রকৃতির নিয়ম মেনেই যা শুরু হয়, তা শেষও হয় (এই কাব্যটা বোধহয় ওই সুন্দর যাত্রার অনুভূতি থেকে এল !) । আমরা দেওঘরে আমাদের হোটেলের সামনে এসে পৌঁছলাম তখন রাত সাড়ে আটটা ।

এটাই আমাদের দেওঘরে শেষ রাত্রিবাস - পরেরদিন সকালে আমাদের ফেরার ট্রেন ধরতে হবে । তাই কেনাকাটা করার জন্য রাতে একবার বেরোতেই হল । অন্যকিছু না কিনলেও এখানকার ভারতবিখ্যাত প্যাঁড়া কিনতেই হবে । এখানে প্যাঁড়ার অনেক দোকান আছে তার মধ্যে 'শিবম্‌' থেকে আমরা কিনে থাকি । ২৬০/- টাকা কিলো আর ১ কিলোতে ৪০ টা মতো প্যাঁড়া পাওয়া যায় । সবার জন্য সবমিলিয়ে আমাদের কেনা প্যাঁড়ার ওজন হল ৬.৭৫ কিলো ।

হোটেলে ফিরে এসে ডিনার করে মালপত্র গুছিয়ে নিলাম । পরেরদিন সকাল ১০:১০ এ জসিডি থেকে আমাদের ফেরার ট্রেন ।

আমাদের পুরো দল - ফেরার পথে
১৩ই মার্চ ২০১৬, রবিবার সকাল সাড়ে ন'টার সময়ে হোটেল থেকে আমরা চেক্‌-আউট করে রওনা দিলাম জসিডি স্টেশনের উদ্দেশ্যে । আবার সেই অটো - তবে এবারে নিল ১৫০/- টাকা । আমাদের ফেরার ট্রেন সেই একই 'নাঙ্গাল ড্যাম - কলকাতা এক্সপ্রেস' । ট্রেন এল একঘন্টা দেরিতে আর কখনওই সেটা আর মেক্‌আপ হল না । দুপুরে আমরা হোটেল থেকে প্যাক করানো আলুর পরোটা খেলাম । সাড়ে চারটে নাগাদ পৌঁছলাম কলকাতায় । সমাপ্ত !

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে খুব কাছের এবং বাঙালিদের সবচেয়ে কমন্‌ ঘোরার জায়গাগুলোর মধ্যে দেওঘর অন্যতম । সারা দিনে-রাতে অনেক ট্রেন আছে যাতে চড়ে দেওঘর যাওয়া যায় ।
২. দেওঘর যাওয়ার জন্য জসিডিতে নামতে হয় । সেখান থেকে লোক্যাল ট্রেনে বা অটোয় করে দেওঘর যেতে হয় ।
৩. দেওঘরে নানারকম দামের ও স্ট্যান্ডার্ডের অনেক হোটেল আছে । আমাদের হোটেল 'যশোদা ইন্টারন্যাশনাল' মাঝারি ধরনের । এদের ওয়েবসাইট http://www.yashodainternational.com/ বা cleartrip থেকে বুকিং করা যায় । যোগাযোগ : 09051211105, (033)22365588 ।
৪. দেওঘরে ঘোরার জায়গাগুলোর মধ্যে তপোবন পাহাড়, ত্রিকূট পাহাড় উল্লেখযোগ্য । রোপওয়ে চড়ে ত্রিকূট পাহাড়ের পাথায় ওঠাটা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা ।
৫. দেওঘর থেকে গিরিডিতে উশ্রী নদীর ঝর্ণা দেখতে যাওয়া যেতে পারে । বর্ষার পরে গেলে এই ঝর্ণা দেখতে আরও ভালো লাগবে । এখানে চান করা সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি হাতে ঘন্টাদুয়েক সময় না নিয়ে গেলে আফসোস করতে হবে ।
৬. গিরিডি থেকে ফেরার পথে খান্ডোলি ড্যাম আরেকটা অবশ্য গন্তব্য । একটা ছোট পাহাড়ের পাশে এই ড্যাম - জায়গাটা ভীষণই সুন্দর । এখানেও ঘন্টাখানেক সময় হাতে নিয়ে যাওয়া উচিৎ ।
৭. দেওঘরের প্যাঁড়া ভারতবিখ্যাত । টাওয়ার চক্‌ থেকে মন্দিরের দিকে যাওয়ার পথে যে মার্কেট পড়ে, সেখানেই সারি দিয়ে পরপর দেখা যায় এই প্যাঁড়ার দোকান ।
৮. দেওঘরের বৈদ্যনাথের মন্দির সুপ্রসিদ্ধ । পুজো দেওয়ার ইচ্ছে থাকলে হাতে ঘন্টাতিনেক সময় নিয়ে যেতে হবে ।
৯. দেওঘরে খাওয়ার খরচ একেবারেই বেশি না । দৈনিক মাথাপিছু ৩০০ - ৩৫০/- টাকায় এখানে ভালোভাবে খাওয়াদাওয়া করা যায় ।
১০. দেওঘরের আবহাওয়া একেবারেই কলকাতার মতো, তবে শীতকালে ঠান্ডাটা কিছুটা বেশি । বছরের যেকোনও সময়েই দেওঘর যাওয়া যেতে পারে ।

উপসংহারঃ

দেওঘর
প্রধানতঃ বাঙালি ট্যুরিস্টদের ওপর নির্ভর করে যেসব জায়গার মানুষ জীবিকানির্বাহ করেন, দেওঘর তাদের মধ্যেই একটা । এখানে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনও সময় নেই বলে সারাবছরই বাঙালিরা যেতে থাকে । আবার সেই একই কারণে শিবের পার্বণের সময়গুলো ছাড়া বছরের কোনও সময়েই অতিরিক্ত ভিড় হয় না । দেওঘরে থাকাখাওয়ার খরচ বেশি না, মাথাপিছু ৩,০০০/- টাকায় ৩-৪ দিন অনায়াসে ঘোরা যায় । দেওঘরের জলহাওয়া খুব স্বাস্থ্যকর, খাবার হজম হয় ভালোভাবে আবার খিদেও হয় খুব । মালভূমি এলাকায় অবস্থিত বলে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য একটু অন্যরকম । দেওঘরে গেলে একটা মন-ভালো করা ব্যাপার কাজ করে । মূল শহরটা একটু ঘিঞ্জি হলেও শহরের বাইরে বেরোলে বেশ ফাঁকাফাঁকা জায়গার আমেজ অনুভব করা যায় । দেওঘর থেক গিরিডিতে উশ্রীর ঝর্ণা এখানকার আরেকটা আকর্ষণ । পকেটে অল্প রেস্ত আর সপ্তাহান্তে দিনদুয়েকের ছুটি পুঁজি করে অনায়াসে ঘুরে আসা যেতে পারে বাঙালিদের এই ঘরের বাইরে ঘর !

দেওঘর ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

Sunday, January 3, 2016

গাদিয়াড়া ভ্রমণ

৯৯৩ সালে 'প্রতিদিন' পত্রিকায় 'ঘরের পাশেই গাদিয়াড়া' শিরোনামে সরিৎ দত্তের একটা প্রবন্ধ বেরিয়েছিল (যেটার নাম আবার সূচীপত্রে ভুল করে 'হাতের কাছেই গাদিয়াড়া' ছাপা হয়েছিল !) । এই সরিৎ দত্ত সম্পর্কে আমার জেঠু হন । ওনার লেখা পড়ে আর ওনার মুখে শুনেই আমার গাদিয়াড়া যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ জেগেছিল । আমাদের গাড়ি কেনার পর থেকে কখনও কোনও লং-ড্রাইভে যাওয়া হয়নি, তাই একদিনের জন্য গাড়ি নিয়ে কোথায় যাওয়া যায় এটা যখনই ভাবলাম, মাথায় গাদিয়াড়া এল কারণ 'ঘরের পাশেই গাদিয়াড়া' !

জেঠু গেছিলেন তাঁর দুই ভাইজির সঙ্গে আর আমরা গেলাম আমাদের দুই মেয়ের সঙ্গে । 'কথা' আর 'কলি' আমাদের যমজ মেয়ে - ওদের বয়স ৬ মাস । ওদের সঙ্গে ওদের মা-বাবা অর্থাৎ অমৃতা আর আমি । আমার সঙ্গে আমার মা-বাবা, বড়মাসি-মেসোমশাই । সেইসঙ্গে মিনকা আর তার সঙ্গে তার মা-বাবা অর্থাৎ কঙ্কনাদি আর অমিতদা । কঙ্কনাদির সঙ্গে ওর মা-বাবা অর্থাৎ কাকিমা আর কাকু । কথাকলি-র এটাই প্রথম ভ্রমণ - প্রকৃতপক্ষে নার্সিংহোম থেকে আসার পর এই প্রথম বাড়ির বাইরে রাতে থাকা । বাচ্চা নিয়ে বেড়াতে গেলে নানারকম প্রস্তুতি নিতে হয়, সেসব যথাসম্ভব নিয়ে ২রা জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল সাড়ে আটটায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম গাদিয়াড়ার উদ্দেশ্যে । বলা বাহুল্য, আমাদের গাড়ির চালকের আসনে আমি । গাদিয়াড়ার রাস্তা চিনি না, ভরসা মোবাইলের জি পি এস ।

মোটামুটিভাবে জানি গাদিয়াড়ার দুরত্ব ৯০ - ৯৫ কিলোমিটারের মতো, তাই ঘন্টা তিনেকের বেশি লাগার কথা নয় । তবে সঙ্গে বাচ্চা থাকলে সময় বেশিই লাগে । এছাড়া রাস্তায় ব্রেকফাস্ট করার দরকার ছিল । গাদিয়াড়া যেতে হয় হুগলী সেতু - কোণা এক্সপ্রেসওয়ে - বোম্বে রোড ধরে । উলুবেড়িয়া থেকে গড়চুমুক হয়ে যাওয়া যায় আবার বাগনান থেকে শ্যামপুর হয়েও যাওয়া যায় । রাস্তায় ব্রেকফাস্ট করার জন্য ভাল জায়গা হল উলুবেড়িয়ার 'আজাদ-হিন্দ ধাবা' । কিন্তু উলুবেড়িয়া থেকে গড়চুমুক হয়ে গাদিয়াড়া গেলে 'আজাদ-হিন্দ' পড়বে না কারণ তার আগেই বাঁদিকে বেঁকে যেতে হবে । যাই হোক, আমাদের সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করার মতো লুচি আর আলুরদম ছিল, আমরা এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে সেগুলোর সদ্ব্যবহার করে ফেললাম । জি পি আর এস আর রাস্তার লোকের সাহায্যে আমরা গাদিয়াড়ায় পৌঁছলাম দুপুর পৌনে একটায় ।

রূপনারায়ণ ট্যুরিস্ট লজ
গাদিয়াড়ায় 'পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগম' এর 'রূপনারায়ণ ট্যুরিস্ট লজ' আছে । গাদিয়াড়ার বৈশিষ্ট্য হল এটা গঙ্গা আর রূপনারায়ণের মিলনস্থল আর ট্যুরিস্ট লজটা রূপনারায়ণ নদের একেবারে পাড়ে । লজটা বিশাল জায়গা জুড়ে এবং ভেতরে পার্কিং-এর ব্যবস্থাও আছে । আমরা চেক্‌ইন করার সময়ে দুপুরের খাবারের অর্ডারও দিয়ে দিলাম ।


ট্রিপল বেড রুম
আমরা পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগম বা WBTDC-এর ওয়েবসাইট থেকে অন্‌লাইন বুকিং করেছিলাম । ডাবল্‌ আর ট্রিপল্‌ বেড রুমের ভাড়া যথাক্রমে ৮৭৫/- টাকা এবং ১,১২৫/- টাকা (এরসঙ্গে সার্ভিস ট্যাক্স যোগ হবে) । ঘরগুলোর সবগুলোই বেশ বড় এবং রূপনারায়ণ ফেসিং । প্রত্যেকটা ঘরের সামনেই কিছুটা করে ব্যালকনি আছে । বাথরুমও বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, তবে বাথরুমে গরম জলের কোনও ব্যবস্থা নেই । গরম জলের দরকার হলে সেটা পেছনের টানা বারান্দায় লাগানো গিজার থেকে নিজে গিয়ে নিতে হয় ।

ডাইনিং হল
আমরা ঘরে এসে চান সেরে নিয়ে লাঞ্চ করতে গেলাম । রিসর্টে একটা বেশ বড় ডাইনিং হল আছে, তবে চাইলে ঘরে খাবার আনিয়েও খাওয়া যায় (সেক্ষেত্রে মাথাপিছু ১৫/- টাকা করে বেশি দিতে হয়) । এখানে 'থালি' সিস্টেমে খাবার পাওয়া যায় । আমরা কয়েকটা মাছ, মাংস আর চিকেন থালির অর্ডার দিয়েছিলাম । কাকু-কাকিমা হোটেলের রান্না খেলেন না, ওনাদের ড্রাইভারসমেত আমাদের ন'জনের খাবারের মোট খরচ পড়ল ১,৫৩০/- টাকা (ট্যাক্সসমেত) ।

কুয়াশায় ঘেরা রূপনারায়ণের পাড়
খাওয়ার পর আমরা কয়েকজন বেরোলাম চারপাশটা দেখতে । রিসর্টের সামনে দিয়েই বয়ে চলেছে রূপনারায়ণ নদ আর অনতিদূরেই মিলিত হয়েছে গঙ্গার সঙ্গে । কিন্তু পুরো জায়গাটাই কুয়াশায় ঢাকা - কিছুই দেখা যাচ্ছে না । রিসর্টের সামনের রাস্তাটা বেশ সরু, একটা গাড়ি কোনওমতে যেতে পারে । এই রাস্তার একপাশে রিসর্ট আর অন্যপাশ ঢালু - সোজা রূপনারায়ণ । কুয়াশার এমনই বহর, এই ঢালুর পরে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না, এমনকি জলও না, নদের ওপাশ-টোপাশ তো দূরের কথা । ওই ঢালুর ওপরে কয়েকটা ছাগল চরছিল, রূপনারায়ণের বদলে তাদের দেখেই (আর ফ্যান্টাসাইজ করেও !) সন্তুষ্ট থাকতে হল । কুয়াশার জন্য রোদের তেজও বিশেষ ছিল না, সন্ধ্যে হয়ে আসছিল । আমরা কিছুক্ষণ রিসর্টের ভেতরে ঘোরাঘুরি করে ঘরে ফিরে এলাম ।

রিসর্টের ভেতরে
সন্ধ্যের পর গাদিয়াড়ায় কিছু করার নেই । ভেতরে ঘোরাঘুরি করার জায়গা আছে, তবে গাছপালা ঘেরা আর 'সন্ধ্যের পর গাছের কাছে না যাওয়াই ভাল' । আমাদের সঙ্গে বাচ্চা আছে কাজেই সময় কাটানোটা আমাদের কাছে কোনও সমস্যা নয় (সত্যি বলতে কি আমাদের সাধারণতঃ সময়ের অভাবই হয়), তবে রিসর্টের ঘরে টিভি আছে, চাইলে সেটা নিয়ে সময় কাটানো যেতে পারে । আমরা সন্ধ্যেবেলা চা-টা খেলাম । এরা চাইলে চা ঘরে দিয়ে যায় আর তার জন্য কোনও অতিরিক্ত চার্জ লাগে না । রাতের খাবার খাওয়া জন্য আবার ডাইনিং হলে যেতে হল । রাতে আমরা রুটি চিকেন ডিম ইত্যাদি নিয়েছিলাম । খরচ পড়ল মোট ৮২৫/- টাকা । ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম ।

সকালের আলোয় রূপনারায়ণের পাড়
পরেরদিন সকালে ঘুম ভাঙল ৭ টা নাগাদ । জানালা দিয়ে দেখলাম বাইরেটা কুয়াশায় ঢাকা - কুয়াশার ঘনত্ব আগেরদিন বিকেলের থেকেও বেশি । সূর্য্যোদয় দেখার কোনও সম্ভাবনা নেই, কিন্তু কোনও জায়গায় বেড়াতে এসে জায়গাটা হেঁটে ঘুরে দেখা আমার অভ্যেস, তাই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম । রূপনারায়ণের পাড় ধরে হেঁটে যেতে ভালোই লাগছিল । খুব একটা বেশি ঠান্ডা নেই । জায়গাটা একেবারেই গ্রাম - মাটির বাড়ি, মাটির উনুন এসব দেখতে পাওয়া যায় । গাদিয়াড়ার খেজুর গুড়ের নাম আছে, যদিও আমাদের কেনা হয়ে ওঠেনি । রূপনারায়ণের পাড়ে এখানে অনেকে পিকনিক করতে আসে, সেরকম দু'তিনটে দলকে দেখলাম । কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ছবিটবি তুলে আবার রিসর্টে ফিরে এলাম ।

পার্ক-এ অভিভাবকদের সঙ্গে কথা-কলি আর মিনকা
রূপনারায়ণ ট্যুরিস্ট লজে 'কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট' আছে - লুচি-তরকারি । ফিরে এসে ব্রেকফাস্ট করতে করতে ন'টা বেজে গেল । এই সময়ে এখানে খুব ট্যুরিস্টের ভীড়, তাই লজের লোকেরা আমাদের বারবার বলে দিল আমরা যেন ১১টায় ঘর ছেড়ে দিই । তাই ব্রেকফাস্টের পরেই আমরা রেডি হতে শুরু করলাম । এগারোটায় ঘর ছেড়ে দিয়ে হোটেলের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে আমরা লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে দিলাম । রিসর্টের ভেতরে একটা পার্ক আছে, সেখানে বাচ্চাদের দোলনা, ঢেঁকি এসব আছে । দোলনা দেখলে লোকজনের আর নিজের বয়সটা মনে থাকে না এটা আগেও দেখেছি, এখানেও দেখলাম । আমাদের দলেরই কেউ কেউ কিছুক্ষণ করে দোলনায় চড়ে নিল ।

লাঞ্চ পেলাম তখন দুপুর ১টা বেজে গেছে । আজ আমরা কয়েকজনের জন্য আলা-কার্টে চিকেন আর ভাত নিয়েছিলাম আর বাকিদের জন্য ডিম বা মাছের থালি । খরচ হল ১,২৯১/- টাকা । গাদিয়াড়া থেকে আমাদের গাড়ি রওনা দিল তখন দুপুর ২ : ১৫ বাজে ।

আটান্ন গেট
আগেই বলেছি গাদিয়াড়া যাওয়ার দু'টো রাস্তা আছে । ফেরার সময়ে ঠিক করলাম গড়চুমুক হয়ে 'আটান্ন গেট' দেখে ফিরব । জায়গাটা সেরকম কিছু নয়, দামোদর নদের ওপরে আটান্নটা লক্‌ গেট । জি পি আর এস-এর গাইডেন্স ফলো করে পৌঁছতে সময় লাগল ঘন্টাখানেক । এই জায়গাটাও একটা পিকনিক-স্পট, আর সেটা বুঝতে পারলাম এখানকার ভীড় দেখে । কলকাতার কোনও বড় পুজোর থেকে কম নয় !

আটান্নগেট থেকে ফেরার রাস্তা ধরলাম । উলুবেড়িয়া পর্যন্ত্য এসে বোম্বে রোড ধরতে হয় । শেষের কিছুটা রাস্তা বেশ খারাপ, তবে দুরত্ব হিসেবে এটা যাওয়ার রাস্তার থেকে কম । বোম্বে রোডের ওপরে আমরা একজায়গায় দাঁড়িয়ে চা খেলাম । তারপর সোজা বাড়ি !

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে হাওড়া জেলায় রূপনারায়ণ আর গঙ্গার মিলনস্থলে গাদিয়াড়া । জায়গাটা এমনিতে নিরিবিলি, তবে শীতকালে বেশ ভীড় হয় ।
২. গাদিয়াড়া যাওয়ার জন্য ধর্মতলা থেকে বাস পাওয়া যায় । ট্রেনে গেলে হাওড়া থেকে উলুবেড়িয়া বা বাগনান স্টেশনে নেমে সেখান থেকে বাসে বা গাড়িতে যাওয়া যায় । নিজেরা গাড়ি নিয়ে গেলে কোণা এক্সপ্রেসওয়ে - উলুবেড়িয়া হয়ে অথবা কোণা এক্সপ্রেসওয়ে - বাগনান হয়ে যেতে হয় ।
৩. গাদিয়াড়ায় WBTDC-র রূপনারায়ণ ট্যুরিস্ট লজে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে । এদের ওয়েবসাইট http://www.wbtdc.gov.in/ থেকে বুকিং করা যায় অথবা ডালহৌসিতে এদের অফিসে গিয়েও বুকিং করা যায় ।
৪. এখানকার খাবারের মান চলনসই । প্রতিদিন মাথাপিছু ৩০০/- টাকায় মোটামুটি ভালোই খাওয়া হয়ে যায় ।
৫. এখানে রিসর্টের বাইরে ঘোরাঘুরির সেরকম কিছু নেই । রূপনারায়ণের পাড় ধরে হেঁটে ঘোরা যেতে পারে ।
৬. রাতে থাকার ইচ্ছে না থাকলে এখানে দিনের দিন গিয়ে পিকনিকও করা যেতে পারে । পিকনিক করার জন্য রিসর্টের আলাদা ব্যবস্থা আছে আর সেটাও এদের ওয়েবসাইট থেকে বুকিং করা যায় ।
৭. গাদিয়াড়া যাওয়া বা ফেরার পথে গড়চুমুক যাওয়া যেতে পারে । এখানে দামোদরের ওপরে লক্‌গেট দেখা যায় ।
৮. গাদিয়াড়া থেকে লঞ্চে করে রূপনারায়ণ পার হয়ে গেলে যেখানে যাওয়া যায় সেই জায়গার নাম 'গেঁওখালি' আর গঙ্গা পার হয়ে গেলে পৌঁছনো যায় 'নূরপুর'-এ । এই দু'টোই একেকটা ট্যুরিস্ট স্পট ।

উপসংহারঃ

ঘরের পাশেই গাদিয়াড়া
কলকাতা থেকে ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে ট্যুরিস্ট স্পট গাদিয়াড়া । এখানে দেখার সেরকম কিছু না থাকলেও বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বেশ ভালো । আবহাওয়া ভালো থাকলে রূপনারায়ণের দৃশ্য বেশ মনোরম (এটা আমি গুগল্‌ ইমেজ থেকে জেনেছি, নিজে দেখার সুযোগ পাইনি) । গাদিয়াড়ায় একদিনের বেশি থাকার মানে হয় না, বোর লাগতে পারে । গাড়িভাড়া বাদ দিলে আমাদের মাথাপিছু খরচ পড়েছিল ৯৩৫/- টাকা মতো, যেটা একদিনের ঘোরার পক্ষেও বেশ কম । আমাদের মতো যাদের মাঝে মাঝেই একটা স্যাক নিয়ে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে আর 'একদিনের জন্য কোথায় যাওয়া যায়' এই দিয়ে গুগল সার্চ করতে হয়, তাদের জন্যই গাদিয়াড়া । গাদিয়াড়া ভ্রমণকারীদের 'অবশ্য গন্তব্য'-এর তালিকায় পড়ে না, তবে জায়গাটার একটা সুবিধে হল ছ'মাসের বাচ্চা থেকে শুরু করে একশ বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত (এমনকি চাইলে তার বেশিও !) সবাই এখানে যেতে পারে । এখানে যাওয়ার কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই । তাই বছরের যেকোনও সময়ে কম খরচ, কম সময়সীমা আর কম দুরত্বের মধ্যে কোথায় যাওয়া যায় - এটা যদি প্রশ্ন হয় তাহলে উত্তর হল 'ঘরের পাশেই গাদিয়াড়া' !

গাদিয়াড়ার আরও ছবি দেখতে হলে click here.