আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Sunday, March 13, 2016

দেওঘর ভ্রমণ

দীঘা-পুরী-দার্জিলিঙ এই তিনটে জায়গা বাদ দিলে বাঙালির সবচেয়ে কমন্‌ ঘোরার জায়গা বোধহয় 'দেওঘর' (আমার নিজেরই এই নিয়ে চারবার হয়ে গেল । তবে আগেরবারগুলো যখন গেছি, তখন ব্লগ লিখতাম না) । কলকাতা থেকে মাত্র ঘন্টা ছয়েকের রেলদূরত্বে ছোটনাগপুর মালভূমির মধ্যে অবস্থিত এই প্রাচীন শহরে বহুকাল ধরেই নানাধরণের মানুষের যাতায়াত । বলা বাহুল্য এদের মধ্যে বাঙালিই বেশি । আগেকার দিনে একটা রেওয়াজ ছিল - একটু অবস্থাপন্ন বাঙালিরা দেওঘরে একটা করে বাড়ি কিনে রাখতেন আর মাঝে মাঝে হাওয়া বদলাতে সেখানে যেতেন । আমরা অবশ্য হাওয়া বদলাতে যাইনি, সত্যি বলতে কি হাওয়া যাতে বেশি বদলে না যায়, সে'জন্যই আমাদের দেওঘর যাওয়া ।

এবারে আমাদের দল বারোজনের । আমি, আমার স্ত্রী অমৃতা, আমাদের যমজ মেয়ে কথা-কলি (শিশুশিল্পী), বাবা, মা, আমার অফিসের কলিগ্‌ সমীরণদা, বৌদি, ঋজু, আমার আরেক কলিগ্‌ কঙ্কনাদি, অমিতদা, মিনকা (শিশুশিল্পী) । আমাদের সঙ্গে ছোট বাচ্চা আছে, তাই আমাদের এমন জায়গায় যেতে হবে যেখানকার আবহাওয়া কলকাতার থেকে বেশি আলাদা নয় । আবার এমন জায়গা হতে হবে যেটা খুব অফ্‌বীট নয় অর্থাৎ যেকোনও ধরনের পরিষেবা যেখানে সহজেই উপলব্ধ । আবার সেইসঙ্গে খরচেরও একটা সামঞ্জস্য থাকা চাই । আবার ... থাক আর 'আবার'-এর দরকার নেই এককথায় সবদিক থেকে দেওঘর আমাদের পক্ষে উপযোগী হয়েছে বলে আমরা সেখানেই গেছি ! হয়েছে ?

হাওড়া-শিয়ালদা-কলকাতা স্টেশন থেকে দেওঘর যাওয়ার একগুচ্ছ ট্রেন আছে । প্রকৃতপক্ষে কোনও দূরপাল্লার ট্রেন দেওঘর যায় না, দেওঘর যাওয়ার জন্য জসিডি-তে নামতে হয় । আমরা ১০ই মার্চ, ২০১৬ বৃহস্পতিবার সকালে কলকাতা স্টেশন থেকে 'কলকাতা-নাঙ্গাল ড্যাম এক্সপ্রেস' ধরলাম । ট্রেন ছাড়ার সময় সকাল ৭ : ৪০ আর পৌঁছনোর সময় দুপুর ১২ : ১৩ । এই ট্রেনটার সুবিধে হল এর স্টপেজ খুব কম - কলকাতা, আসানসোল আর তারপরেই জসিডি (এটা অবশ্য খাতায়-কলমে, আসলে এর মাঝেও কয়েকটা জায়গায় দাঁড়িয়ে যায়) । আর যেহেতু সঙ্গে ছোট বাচ্চা রয়েছে, তাই আমরা দিনেরবেলা যাওয়াই স্থির করেছিলাম ।

ট্রেন জসিডি পৌঁছলো দুপুর ১ টার পরে । জসিডি থেকে দেওঘর অটোরিক্সায় যেতে হয়, অথবা চাইলে লোক্যাল ট্রেনেও যাওয়া যায় (দেওঘর স্টেশনের নাম 'বৈদ্যনাথধাম') । এখানে বড় সাইজের অটো চলে, যেগুলোয় একটু চেপেচুপে ন'জন পর্যন্ত বসে যাওয়া যায় । প্রায় আধঘন্টা চলার পরে অটো আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিল আর ১০০/- টাকা নিল ।

হোটেল যশোদা ইন্টারন্যাশনালের ঘর
'হোটেল যশোদা ইন্টারন্যাশনাল' । দেওঘরের প্রাণকেন্দ্র 'টাওয়ার চক্‌'- থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটাদূরত্বে এই হোটেলটা অপেক্ষাকৃত নতুন । বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং ভাড়া বেশ কম । নন-এসি ঘরের ভাড়া ৬০০/- টাকা আর Cleartrip থেকে বুকিং করায় আমরা আবার এর ওপর ৫০% ছাড় পেয়েছিলাম । ঘরগুলো বাইরের রাস্তার সঙ্গে যুক্ত নয়, তাই ঘর থেকে রাস্তা দেখার যেমন সুযোগ নেই, তেমনই রাস্তার কোলাহলও ঘরে এসে পৌঁছয় না ।

আমরা চানটান করে গেলাম হোটেলের ডাইনিং রুমে । ডাইনিং রুমটা খুব বড় নয়, তিনটে বড় টেবিলে খুব বেশি হলে ২০ - ২৫ জন একসঙ্গে খেতে পারে । আমরা ভাত-ডাল-আলুভাজা-চিকেন ইত্যাদি খেলাম । সবমিলিয়ে খরচ পড়ল মোট ১,৭৮৯/- টাকা ।

টাওয়ার চক্‌
খাওয়া শেষ করে ঘরে এসে বিশ্রাম নিলাম । আমরা দু'টো পুরো দিন দেওঘরে থাকছি - তাতে দেওঘর আমাদের সম্পূর্ণভাবে দেখা হয়ে যাবে । প্রথমদিন তাই কোথাও বেরোনোর প্ল্যান ছিল না, তাও সন্ধ্যেবেলা একবার বেরিয়ে টাওয়ার চক্‌ হয়ে মার্কেটের দিকে গেলাম । সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে চা-টা খেয়ে আবার হোটেলে ফিরে এলাম । রাতে ডিনারে রুটি-ডিম-চিকেন খাওয়া হল । খরচ পড়ল মোট ৯৭১/- টাকা ।









পরেরদিন ১১ই মার্চ, ২০১৬ শুক্রবার আমাদের দেওঘরে সাইট-সিয়িং এর দিন । যশোদা ইন্টারন্যাশনালের আরেকটা সুবিধে হল গাড়ির স্ট্যান্ডটা একেবারেই এর সামনে । ন'জনের জন্য একটা বড় অটো নেওয়া যেত কিন্তু তাতে সারাদিন ঘোরাঘুরি করা বেশ চাপের (আক্ষরিক অর্থেই) । আমরা ১,০০০/- টাকায় একটা পুরনো মডেলের সুমো পেয়ে গেলাম যেগুলোর সামনে দু'জনের সীট্‌ থাকে । তাতে করে শুরু হল আমাদের দেওঘরের সাইট সিয়িং ।

নওলাখা মন্দির
প্রথম দ্রষ্টব্য : নওলাখা মন্দির
কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়ির রাণী চারুশিলা এই মন্দিরটি তৈরি করান । ন'লাখ টাকা দিয়ে তৈরি হয়েছিল বলে এর এই নাম । কিছুটা বেলুড়মঠের আদলে তৈরি এই মন্দিরে গোপাল আর রাধাকৃষ্ণের মূর্তি আছে । সিঁড়ি দিয়ে উঠে মন্দিরের চত্বরটা খুব বড় আর চারপাশটা খোলা বলে খুব সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল (আমাদের দলের কেউ কেউ তো বলল আর সাইট সিয়িং-এ যাওয়ার দরকার নেই, এখানেই বিকেল পর্যন্ত বসে থাকি !) । মন্দিরে কোনও ভীড় নেই, নিজের ইচ্ছেমতো সময় নিয়ে দেখা যেতে পারে ।

তপোবন পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ি
দ্বিতীয় দ্রষ্টব্য : তপোবন পাহাড়
দেওঘর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দুরত্বে অবস্থিত তপোবন পাহাড় । এখানে বালানন্দ ব্রহ্মচারীর আশ্রম রয়েছে । এখানে আমরা পৌঁছলাম তখন বেলা সাড়ে এগারোটা । আমাদের ড্রাইভারের কথা শুনে আমরা এখানে ব্রেকফাস্ট করলাম । পাহাড়ের সামনে কয়েকটা ছোটো ছোটো দোকান আছে । খাবার হল ছাতুর পুরী আর সঙ্গে ডাল-তরকারী । সকালের জলখাবার হিসেবে একেকজনের জন্য দু'টো করেই যথেষ্ট । খাওয়া শেষ করে আমরা তপোবন পাহাড়ে চড়তে শুরু করলাম । পাহাড়ের ধাপে ধাপে নানারকম মন্দির রয়েছে । ওঠা-নামার সময়ে সবসময়েই সেখানে পয়সা দেওয়ার জন্য বলতে থাকে । সেগুলো না দিয়েও অনায়াসে যাওয়া যায়, কিন্তু এখানকার বাঁদরের থেকে সাবধান ! এখানকার (ট্রেনিংপ্রাপ্ত) বাঁদররা খুব ক্ষিপ্রতার সঙ্গে যাত্রীদের হাতে থাকা ছোটখাটো জিনিস, যেমন সানগ্লাস, ক্যামেরা, মোবাইল ইত্যাদি নিয়ে নেয় । আবার তাদের সঙ্গে থাকা দুপেয়ে বাঁদররা হাতে ছোলা-কলা নিয়ে বসে থাকে, যদি কোনওভাবে সেই ছোলা-কলায় হাতও লেগে যায়, তাহলেও তারজন্য পয়সা দিতে হবে । তাই তপোবনে সর্বস্তরের বাঁদরদের থেকে সাবধান ।

তপোবনের ছাদ থেকে
আমরা পাহাড়ের ধাপে ধাপে উঠে একেবারে মাথায় চলে গেলাম । এখান থেকে চারদিকের দৃশ্য খুবই মনোরম আর একটা ঠান্ডা হাওয়া সারাক্ষণ দিতে থাকে বলে দুপুরের প্রখর রোদেও খুব গরম লাগে না ।

তপোবন পাহাড় থেকে নামার রাস্তাটা সবথেকে বেশি রোমাঞ্চকর । চাইলে সিঁড়ি দিয়ে ভদ্রভাবে নেমে আসা যায়, আবার চাইলে পাহাড় ভেঙ্গে বিপদের ঝুঁকি নিয়েও নামা যায় । পাহাড়ের একেকটা ছোটো ছোটো খাঁজ দিয়ে পুরো শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত আনন্দ আছে । একটা জায়গা আবার ভীষণ ঢালু । সেখান দিয়ে নামার সময়ে খুব সাবধানে নামতে হয় কারণ কোনওকারণে পা-হড়কালে ... না মৃত্যু নয়, তবে বেশ ভালোরকম জখম হওয়ার সম্ভাবনা । একেকটা জায়গায় গিয়ে মনে হয় "আর এগোতে পারব তো ?" আমরা কিন্তু কোনও গাইড নিইনি আর নামার সময়ে অন্য কোনও ট্যুরিস্টের দলও আমাদের সঙ্গে ছিল না । পাহাড়ের মাঝে মানুষের পায়ে চলা পথের দাগ দেখেই আমরা নিজেদের পথ খুঁজে বের করেছি । যখন নেমে এলাম, তখন বেশ উত্তেজিত লাগছিল । একটা কথা অবশ্যই বলব ব্যাপারটা যে কঠিন তা নয়, তবে করার জন্য মনের জোরের দরকার আছে আর গাইডের দরকার একেবারেই নেই ।

ত্রিকূট পাহাড়ের রোপওয়ে
তৃতীয় দ্রষ্টব্য : ত্রিকূট পাহাড়
দেওঘর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই ত্রিকূট পাহাড়ের বৈশিষ্ট্য হল এটা দেওঘরের সবথেকে উঁচু জায়গা । এর উচ্চতা ১,৫০০ ফুট । চাইলে ট্রেকিং করে এর ওপরে ওঠা যায়, তবে এখনকার দিনে রোপওয়ে হয়ে যাওয়ায় সেভাবে ওঠার আর কোনও মানে হয় না । ওঠানামা মিলিয়ে মাথাপিছু ১০০ টাকার টিকিটে ত্রিকূট পাহাড়ে উঠতে সময় লাগে মিনিট দশেক । রোপওয়েতে এই জার্ণিটা খুবই সুন্দর । রোপওয়ে যখন ওপরের দিকে ওঠে, তখন পায়ের অনেক তলায় পাহাড়ের নিচের দিকটা দেখতে দারুণ লাগে । মাথায় ওঠার পর হেঁটে এদিক-ওদিক ঘুরে আসা যায় । ত্রিকূট পাহাড়ের ওপর থেকে দেওঘরের দৃশ্য অত্যন্ত মনোরম । এখানে গাইডের উৎপাতও আছে, তবে আমরা তাদেরকে উপেক্ষা করেছি । আধঘন্টা পাহাড়ের মাথায় হাঁটাহাঁটি করে আমরা নেমে একই পথে নেমে এলাম । ত্রিকূট পাহাড়ে গেলে এই রোপওয়েটা অবশ্যই চড়া উচিৎ । এটা একটা বেশ দারুণ অভিজ্ঞতা যেটা কলকাতার সায়েন্স সিটি বা নিক্কোপার্কের রোপওয়েতে হবে না !

নিচে নেমে আখের রস খেতে হল (মানে এটা বাধ্যতামূলক নয়, আমরা খেলাম আর কি !) । দুপুর আড়াইটে বাজে, কিন্তু এখানে কোনও ভালো ভাতের হোটেল নেই । তাছাড়া সকালের ছাতুর পুরী তখনও পেটে গজগজ করছিল তাই আমরা খাওয়ার পেছনে সময় নষ্ট না করে এগিয়ে গেলাম আমাদের চতুর্থ তথা শেষ গন্তব্যের দিকে ।

নন্দন পাহাড়ের সিঁড়ি
চতুর্থ দ্রষ্টব্য : নন্দন পাহাড়
নন্দন পাহাড় কে পাহাড় না বলে ঢিপিও বলা যায়, এটা দেওঘর শহরের সবথেকে উঁচু জায়গা (আগেরটা ছিল দেওঘরের সবথেকে উঁচু জায়গা । অর্থাৎ এটা আগেরটার সাবসেট্‌ ।) । এখান থেকে দেওঘরের পানীয় জলের সাপ্লাই হয় । পাহাড়ে উঠতে (এবং নামতেও) ১৪০ টা সিঁড়ি আছে (এটা আমাদের ড্রাইভার বলল, আমি নিজে গুণে দেখিনি) । পাহাড়ের ওপরে যথারীতি কিছু মন্দির আছে আরে পাহাড়ে ওঠার পথে একটা বাচ্চাদের পার্ক আছে । এছাড়া একটা টয়ট্রেনও আছে যেটা পাহাড়ের গা-বেয়ে ওপরে ওঠানামা করে । আমরা পাহাড়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ফিরে এলাম ।

আমাদের দেওঘরের সাইট সিয়িং এই চারটে জায়গা ঘুরেই শেষ, তবে চাইলে এই একই প্যাকেজের মধ্যে এরা আরও দু'টো জায়গা দেখায় । একটা হল 'বৈদ্যনাথের মন্দির' । সেখানে আমরা পরে নিজেরা যাব । আর অন্যটা 'অনুকূল ঠাকুরের সৎসঙ্গ আশ্রম' । এখানে যাওয়ার ব্যাপারে একটা বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ আছে - 'দিস থিংস আর পারফর্মড বাই এক্সপার্টস । ডু নট ট্রাই দিস ইফ ইউ ডোন্ট হ্যাভ এনাফ ভক্তি ফর অনুকূল ঠাকুর' । আমাদের একেবারেই নেই, তাই আমাদের গাড়ি আমাদের হোটেলের সামনে নামিয়ে দিল ।

বিকেল সাড়ে চারটে বাজে, খিদেও পেয়েছে । আমাদের হোটেলে কোনও খাবার পাওয়া গেল না, তাই আমাদের হোটেলের ঠিক মুখোমুখি একটা হোটেলে আমরা লাঞ্চ করে নিলাম । ভাত, ফ্রায়েড রাইস, চাউমিন, চিকেন মিলিয়ে খরচ পড়ল ১,৪০০/- টাকা ।

হোটেলে ফিরে এসে বিশ্রাম নিলাম । খুব যে কিছু ক্লান্ত ছিলাম তা নয়, তবে আর কিছু করারও ছিল না । দেওঘরে সন্ধ্যেবেলা বিশেষ কিছু করার থাকে না, চাইলে ওই টাওয়ার চক্‌-মার্কেট-মন্দির । বৈদ্যনাথের মন্দির রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে । আমাদের দল বেশ বড়, তাই কিছু করার না থাকলেও কিছু করার থাকেই । হোটেলের ঘরে আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যেটা কাটিয়ে দিলাম । রাতে হোটেলের ডিনারে রুটি-ডিম-চিকেন নিয়ে খরচ পড়ল ৮৪১/- টাকা ।

গিরিডি যাওয়ার পথে
১২ই মার্চ ২০১৬, শনিবার । আমাদের গিরিডিতে উশ্রী যাওয়ার দিন ("উশ্রী নদীর ঝরণা দেখতে যাব । দিনটা বড় বিশ্রী । শুনছ বজ্রের শব্দ ? ..." - সহজপাঠ, দ্বিতীয় ভাগ । মনে পড়ছে ? এছাড়া প্রোফেসর শঙ্কুর বাড়িও ছিল গিরিডিতে - উনি মাঝে মাঝে উশ্রীর ধারে হেঁটে বেড়াতে যেতেন) । এটা আমার ব্যক্তিগত ফেভারিট - দেওঘর বা মধুপুর গেলে গিরিডি যাওয়ার জন্য আমি বিশেষভাবে বলব । সকালে আমাদের দলের কয়েকজন বৈদ্যনাথের মন্দিরে গিয়েছিল, তাই ব্রেকফাস্ট করে আমাদের বেরোতে বেরোতে বেলা সাড়ে এগারোটা বেজে গেল । এবারেও একটা ন'জন বসার সুমো । দেওঘর থেকে উশ্রীর দুরত্ব ৭৫ কিলোমিটারের মতো এবং গাড়িভাড়া নিল ২,৪০০/- টাকা । গিরিডি থেকে উশ্রীর দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার । যাওয়ার রাস্তাটা বেশ সুন্দর । রাস্তার দু'পাশের দৃশ্যও বেশ চিত্তাকর্ষক । আমরা বসন্তকালে গিয়েছিলাম বলে রাস্তার দু'ধারে "রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে" দেখতে পেয়েছি । রোদের তাপ বিশেষ ছিল না আর একটা সুন্দর হাওয়া সারাক্ষণ দিচ্ছিল বলে বেশ ফুরফুরে লাগছিল । আমরা উশ্রী পৌঁছলাম তখন দুপুর দু'টো ।

উশ্রী নদীর ঝর্ণা
উশ্রীর ঝর্ণা দেখে একটু হতাশ হলাম । আমি এর আগে দু'বার উশ্রীতে এসেছি - একবার অক্টোবর মাসে আরে আরেকবার আগস্ট মাসে । স্বভাবতই তখন উশ্রীতে জল বেশি ছিল । এখন এই মার্চ মাসে জলের স্রোত বেশ কম - চান করার সুবিধেও বিশেষ নেই । পাথরের ওপর পা দিয়ে ধাপে ধাপে এদিক ওদিক যাওয়া যায় । আমরা সেরকমই একটা জায়গায় গিয়ে কিছুক্ষণ জলে পা-টা দিয়ে ছবি তুললাম । পাথরের ওপর পিছল থাকায় একবার আছাড়ও খেয়েছি । ঝর্ণার জল বেশ ঠান্ডা, জায়গাটা গাছপালা ঘেরা হওয়ার বসে থাকতে বেশ ভালোই লাগছিল । ঘন্টাখানেক জলকেলি করে আমরা ফেরার পথ ধরলাম ।

গিরিডিতে ভাতের ভালো হোটেল বেশি নেই - তাই আমাদের গাড়ি যখন একটা নিরামিষ হোটেলের সামনে গতি কমালো, তখন বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল । কিন্তু পরমূহুর্তেই যখন দেখলাম গাড়ি সেখানে না থেমে এগিয়ে চলল, তখন কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম । শেষে একটা বেশ ঝাঁ চকচকে হোটেলে আমরা লাঞ্চ করলাম । এখানকার রান্নার মান খুবই ভালো আর সেইসঙ্গে দামও । ড্রাইভার সমেত আমাদের খাওয়ার খরচ পড়ল ১,৮৫০/- টাকা ।

খান্ডোলি ড্যাম
গিরিডি থেকে দেওঘর ফেরার পথে আরেকটা দেখার জায়গা আছে - সেটা হল খান্ডোলি ড্যাম । গিরিডি থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে এই জায়গায় একটা জলাধার আছে । এর পাশেই একটা ছোট পাহাড় । আমরা এখানে পৌঁছলাম তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা - তখন সূর্য্যের আলো কমে এসেছে । তা সত্ত্বেও এখানে বসে থাকতে ভীষণ ভালো লাগছিল । সারাক্ষণ একটা হাওয়া দেয় আর জায়গাটা এমনিতে একেবারেই ফাঁকা হওয়ায় সবমিলিয়ে খুব ভালো লাগে । একটা পার্কও আছে, চাইলে সেখানে গিয়েও দোলনা-টোলনা চড়া যেতে পারে । আমাদের হাতে সময় বেশি ছিল না, থাকলে খান্ডোলিতে ঘন্টাখানেক বেশ ভালোভাবে কাটানো যেত ।

ফেরার সময়ে অন্ধকার হয়ে গেল । গিরিডি থেকে দেওঘর ফেরার এই জার্ণিটা অনেকদিন মনে থাকবে । অন্ধকার ফাঁকা রাস্তায় হু হু করে গাড়ি ছুটছে আর সেইসঙ্গে দিচ্ছে ঝড়ের মতো হাওয়া । গাড়ির ভেতরে বসে এত আরাম লাগছিল, যে মনে হচ্ছিল জার্ণিটা শেষ না হলেই ভালো হয় । কিন্তু তা হয় না, প্রকৃতির নিয়ম মেনেই যা শুরু হয়, তা শেষও হয় (এই কাব্যটা বোধহয় ওই সুন্দর যাত্রার অনুভূতি থেকে এল !) । আমরা দেওঘরে আমাদের হোটেলের সামনে এসে পৌঁছলাম তখন রাত সাড়ে আটটা ।

এটাই আমাদের দেওঘরে শেষ রাত্রিবাস - পরেরদিন সকালে আমাদের ফেরার ট্রেন ধরতে হবে । তাই কেনাকাটা করার জন্য রাতে একবার বেরোতেই হল । অন্যকিছু না কিনলেও এখানকার ভারতবিখ্যাত প্যাঁড়া কিনতেই হবে । এখানে প্যাঁড়ার অনেক দোকান আছে তার মধ্যে 'শিবম্‌' থেকে আমরা কিনে থাকি । ২৬০/- টাকা কিলো আর ১ কিলোতে ৪০ টা মতো প্যাঁড়া পাওয়া যায় । সবার জন্য সবমিলিয়ে আমাদের কেনা প্যাঁড়ার ওজন হল ৬.৭৫ কিলো ।

হোটেলে ফিরে এসে ডিনার করে মালপত্র গুছিয়ে নিলাম । পরেরদিন সকাল ১০:১০ এ জসিডি থেকে আমাদের ফেরার ট্রেন ।

আমাদের পুরো দল - ফেরার পথে
১৩ই মার্চ ২০১৬, রবিবার সকাল সাড়ে ন'টার সময়ে হোটেল থেকে আমরা চেক্‌-আউট করে রওনা দিলাম জসিডি স্টেশনের উদ্দেশ্যে । আবার সেই অটো - তবে এবারে নিল ১৫০/- টাকা । আমাদের ফেরার ট্রেন সেই একই 'নাঙ্গাল ড্যাম - কলকাতা এক্সপ্রেস' । ট্রেন এল একঘন্টা দেরিতে আর কখনওই সেটা আর মেক্‌আপ হল না । দুপুরে আমরা হোটেল থেকে প্যাক করানো আলুর পরোটা খেলাম । সাড়ে চারটে নাগাদ পৌঁছলাম কলকাতায় । সমাপ্ত !

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে খুব কাছের এবং বাঙালিদের সবচেয়ে কমন্‌ ঘোরার জায়গাগুলোর মধ্যে দেওঘর অন্যতম । সারা দিনে-রাতে অনেক ট্রেন আছে যাতে চড়ে দেওঘর যাওয়া যায় ।
২. দেওঘর যাওয়ার জন্য জসিডিতে নামতে হয় । সেখান থেকে লোক্যাল ট্রেনে বা অটোয় করে দেওঘর যেতে হয় ।
৩. দেওঘরে নানারকম দামের ও স্ট্যান্ডার্ডের অনেক হোটেল আছে । আমাদের হোটেল 'যশোদা ইন্টারন্যাশনাল' মাঝারি ধরনের । এদের ওয়েবসাইট http://www.yashodainternational.com/ বা cleartrip থেকে বুকিং করা যায় । যোগাযোগ : 09051211105, (033)22365588 ।
৪. দেওঘরে ঘোরার জায়গাগুলোর মধ্যে তপোবন পাহাড়, ত্রিকূট পাহাড় উল্লেখযোগ্য । রোপওয়ে চড়ে ত্রিকূট পাহাড়ের পাথায় ওঠাটা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা ।
৫. দেওঘর থেকে গিরিডিতে উশ্রী নদীর ঝর্ণা দেখতে যাওয়া যেতে পারে । বর্ষার পরে গেলে এই ঝর্ণা দেখতে আরও ভালো লাগবে । এখানে চান করা সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি হাতে ঘন্টাদুয়েক সময় না নিয়ে গেলে আফসোস করতে হবে ।
৬. গিরিডি থেকে ফেরার পথে খান্ডোলি ড্যাম আরেকটা অবশ্য গন্তব্য । একটা ছোট পাহাড়ের পাশে এই ড্যাম - জায়গাটা ভীষণই সুন্দর । এখানেও ঘন্টাখানেক সময় হাতে নিয়ে যাওয়া উচিৎ ।
৭. দেওঘরের প্যাঁড়া ভারতবিখ্যাত । টাওয়ার চক্‌ থেকে মন্দিরের দিকে যাওয়ার পথে যে মার্কেট পড়ে, সেখানেই সারি দিয়ে পরপর দেখা যায় এই প্যাঁড়ার দোকান ।
৮. দেওঘরের বৈদ্যনাথের মন্দির সুপ্রসিদ্ধ । পুজো দেওয়ার ইচ্ছে থাকলে হাতে ঘন্টাতিনেক সময় নিয়ে যেতে হবে ।
৯. দেওঘরে খাওয়ার খরচ একেবারেই বেশি না । দৈনিক মাথাপিছু ৩০০ - ৩৫০/- টাকায় এখানে ভালোভাবে খাওয়াদাওয়া করা যায় ।
১০. দেওঘরের আবহাওয়া একেবারেই কলকাতার মতো, তবে শীতকালে ঠান্ডাটা কিছুটা বেশি । বছরের যেকোনও সময়েই দেওঘর যাওয়া যেতে পারে ।

উপসংহারঃ

দেওঘর
প্রধানতঃ বাঙালি ট্যুরিস্টদের ওপর নির্ভর করে যেসব জায়গার মানুষ জীবিকানির্বাহ করেন, দেওঘর তাদের মধ্যেই একটা । এখানে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনও সময় নেই বলে সারাবছরই বাঙালিরা যেতে থাকে । আবার সেই একই কারণে শিবের পার্বণের সময়গুলো ছাড়া বছরের কোনও সময়েই অতিরিক্ত ভিড় হয় না । দেওঘরে থাকাখাওয়ার খরচ বেশি না, মাথাপিছু ৩,০০০/- টাকায় ৩-৪ দিন অনায়াসে ঘোরা যায় । দেওঘরের জলহাওয়া খুব স্বাস্থ্যকর, খাবার হজম হয় ভালোভাবে আবার খিদেও হয় খুব । মালভূমি এলাকায় অবস্থিত বলে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য একটু অন্যরকম । দেওঘরে গেলে একটা মন-ভালো করা ব্যাপার কাজ করে । মূল শহরটা একটু ঘিঞ্জি হলেও শহরের বাইরে বেরোলে বেশ ফাঁকাফাঁকা জায়গার আমেজ অনুভব করা যায় । দেওঘর থেক গিরিডিতে উশ্রীর ঝর্ণা এখানকার আরেকটা আকর্ষণ । পকেটে অল্প রেস্ত আর সপ্তাহান্তে দিনদুয়েকের ছুটি পুঁজি করে অনায়াসে ঘুরে আসা যেতে পারে বাঙালিদের এই ঘরের বাইরে ঘর !

দেওঘর ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.