আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Tuesday, September 17, 2013

মুকুটমণিপুর ভ্রমণ

তুমি যদি কখনও 'মুকুটমণিপুর' যাওয়ার পরিকল্পনা কর আর সেটা তোমার আশেপাশের লোকজন জেনে ফেলে তাহলে তুমি সবচেয়ে বেশি যে কথাটা শুনবে তা হল "ও, মুকুটমণিপুর ! আমি সেই কোন্‌ ছোটবেলায় গেছি !" শুনে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় মুকুটমণিপুরে শুধু ছোটরাই যায় । কিন্তু আমি সেইসব লোকের মধ্যে পড়িনা - আমার 'সেই কোন্‌ ছোটবেলায়' মুকুটমণিপুর যাওয়া হয়নি । অন্যের মুখে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের কথা শুনতে শুনতেই জায়গাটায় যাওয়ার ইচ্ছে তৈরি হওয়া আর সেই সুবাদেই বেরিয়ে পড়া - আমাদের বেড়ানোর মুকুটে আরেকটা মণি যোগ করার জন্য ।

১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রবিবার সকাল ছ'টা পঁচিশে সাঁত্রাগাছি স্টেশন থেকে 'রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস' এ মুকুটমণিপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমি আর আমার স্ত্রী । (এখানে জানিয়ে রাখি, অনেকেরই ধারণা 'রূপসী বাংলা' 'ধৌলি'র সঙ্গে হাওড়া থেকে একসঙ্গে ছাড়ে, সেটা কিন্তু ঠিক নয় । রূপসী বাংলা ধরতে গেলে এখন সাঁত্রাগাছি থেকেই ধরতে হয়, হাওড়া থেকে ধরা যায় না ) মুকুটমণিপুরে ট্রেন যায় না, সবথেকে কাছের রেলস্টেশন হল বাঁকুড়া । এখান থেকে মুকুটমণিপুর আরও ৫৫ কিলোমিটার ।

বাঁকুড়া স্টেশন
বাঁকুড়া স্টেশন থেকে মুকুটমণিপুর যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া করা যেতে পারে আর নাহলে আছে লোক্যাল বাস । বাঁকুড়া স্টেশন থেকে বাঁকুড়া বাসস্ট্যান্ডটা বেশ কিছুটা দূরে - এখানে যাওয়ার জন্য আমাদের আরেকটা বাস ধরতে হল । বাঁকুড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে মুকুটমণিপুরের বাস সংখ্যায় খুবই কম তাই আমরা খাতড়ার বাস ধরলাম । এই বাস খুব সাধারণ ঝরঝরে মার্কা বাস । খাতড়া থেকে আরেকটা বাসে করে মুকুটমণিপুর । আমাদের টাইমিংগুলো হল - বাঁকুড়া স্টেশন সকাল ১০:১০ - বাঁকুড়া বাসস্ট্যান্ড সকাল ১০:৩০ - খাতড়ার বাস বেলা ১১ টা - খাতড়া দুপুর ১:৩০ - মুকুটমণিপুরের বাস দুপুর ১:৪৫ - মুকুটমণিপুর দুপুর ২:১৫ আর আমাদের হোটেল দুপুর ২:৩০ (এগুলো এত ডিটেলে লিখলাম একটাই কারণে - কলকাতা থেকে মুকুটমণিপুর যেতে হলে কেউ যেন ট্রেনে না যায় । এত কষ্ট করে না গিয়ে অনেক সহজে ধর্মতলা থেকে মুকুটমণিপুরের টানা বাসে যাওয়া যায় ।)

অনন্তমূল কটেজ
আমাদের বুকিং ছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্টের 'সোনাঝুরি রিসর্ট'এ । এটার বুকিং কলকাতা অফিস থেকে সরাসরি করা যায় - অথবা ওদের ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনও করা যায় । রিসর্টটা খুবই সুন্দর - একটা পাহাড়ের গায়ে গাছপালা ঘেরা বিরাট জায়গা জুড়ে আলাদা আলাদা কটেজ । 'শতমূল' আর 'অনন্তমূল' দু'টো পাশাপাশি কটেজ - এদের মধ্যে আমরা অনন্তমূল বুক করেছিলাম ।

ঘরের ভেতর
ঘরটা বেশ বড় - মাঝখান জুড়ে রয়েছে একটা ৭ X ৭ সাইজের খাট । এছাড়া টিভি চেয়ার টেবিল ইত্যাদি । ঘরের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা দেখবার মতো ! মেঝেটা এত পরিষ্কার যে আমরা ঘরে খালি পায়ে হেঁটেছি । বাথরুমটাও বেশ বড় এবং পরিষ্কার । ঘরের বাইরে একটা ছোট ব্যালকনি রয়েছে সেখানে চেয়ার নিয়ে বসে থাকা যায় । সবমিলিয়ে ব্যবস্থা খুবই ইম্প্রেসিভ ।


সোনাঝুরির ডাইনিং রুম
আমাদের লাঞ্চের অর্ডার দেওয়া ছিল না - কিন্তু ওরা বলল ব্যবস্থা করে দেবে । সেইমতো আমরা ঘরে এসে চানটান করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম । তারপর গেলাম ডাইনিং রুমে । এখানে রুমে খাবার দেওয়ার খুব একটা প্রচলন নেই - সবাই ডাইনিং রুমেই খায় । ডাইনিং রুমে একসঙ্গে ১৬ জন বসে খেতে পারে । খাবার সবই মিল সিস্টেম । আমরা দুপুরে নিলাম মাছভাত । রান্না অত্যন্ত সুস্বাদু ! আমাদের মাথাপিছু পড়ল ৭৫ টাকা করে ।

খাওয়ার পরে ঘরে এসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম । বিকেলে বেরোলাম চারপাশটা একটু এক্সপ্লোর করতে । মুকুটমণিপুরের প্রধান আকর্ষণ হল ড্যাম - কংসাবতী নদীর জলকে বাঁধের সাহায্যে ধরে রেখে সেচের কাজে ব্যবহার করা হয় । এই ড্যামটা বিশাল বড় আর বলতে গেলে এটা দেখতেই এখানে আসা ।

মুকুটমণিপুরে কংসাবতীর ড্যাম
সোনাঝুরি থেকে ড্যাম হেঁটে মিনিট পনেরো লাগে । ড্যামের পাঁচিলের ওপর দিয়ে রাস্তা চলে গেছে । আমরা এই রাস্তা ধরে কিছুদূর হেঁটে গেলাম । এখানকার সৌন্দর্য অসাধারণ । একদিকে কংসাবতীর বিশাল ড্যাম আর অন্যদিকে পাহাড় আর ছোট ছোট গ্রাম । আমরা বেশ কিছু ছবি তুললাম ঠিকই, কিন্তু জায়গাটার ব্যাপ্তি এতটাই বড় যে ক্যামেরায় একে বন্দী করা সম্ভব না । (ওয়াইড অ্যাঙ্গেলেও না) পাঁচিলের ওপর দিয়ে রাস্তা অনেক দূরে (৭ কিলোমিটার) চলে গেছে । পুরোটা হেঁটে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না আর আকাশে মেঘ করে ছিল - তাই হেঁটে খুব বেশি দূরে যাওয়ার সাহসও হল না । আস্তে আস্তে সন্ধ্যে হয়ে আসছিল আর পুরো জায়গাটায় আমরা ছাড়া আর লোকজনও বিশেষ ছিল না, তাই এবার ফেরার পথ ধরলাম । সোনাঝুরিতে যখন ফিরে এলাম তখন অন্ধকার হয়ে গেছে ।

সন্ধ্যেবেলা মুকুটমণিপুরে কিছু করার নেই । যতদূর সম্ভব সোনাঝুরিতে আমরা ছাড়া আর কোনও গেস্টও নেই কাজেই লোকজনের গলার শব্দও শোনা যাচ্ছিল না । ঘরের বাইরে শব্দ বলতে একমাত্র ঝিঁঝির ডাক । রিসর্টের বাইরে রাস্তা আছে, কিন্তু সেটা ঘর থেকে বেশি কিছুটা নিচে । আর সেই রাস্তা দিয়েও কদাচিৎ কখনও গাড়ি চলে । ফরে বাইরের আওয়াজও নেই । আমরা যারা কলকাতায় থাকি তারা এই নিস্তব্ধতার সঙ্গে পরিচিত নই । 'সাইলেন্স হ্যাজ ইট্‌স্‌ ওন ল্যাঙ্গুয়েজ' এই বিখ্যাত কথাটা মুকুটমণিপুরে গিয়ে আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম ।

রাতে চিকেন মিল বলা ছিল - শুধু ভাতের বদলে রুটি । মাংস ছাড়াও তরকারি, ডাল, আলুভাজা ইত্যাদি দেয় । খরচ পড়ল ৯০ টাকা করে ।

অনন্তমূল কটেজ থেকে সোনাঝুরির কিছুটা
পরেরদিন অর্থাৎ ১৬ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সোমবার । এই দিনটা আমাদের মুকুটমণিপুরের সাইট সিয়িং করার দিন । ঘোরার দু'রকম ব্যবস্থা আছে - অ্যাম্বাসাডর আর মোটর ভ্যান । মুকুটমণিপুরে সাইট সিয়িং এ খুব বেশি কিছু দেখার নেই - মোটরভ্যানে বড়োজোর ঘন্টা আড়াই লাগবে । অ্যাম্বাসাডরে গেলে সেটা আরও কমে যাবে । আর বাঁধের রাস্তা দিয়ে যখন যাব তখন অ্যাম্বাসাডরে গেলে সবদিক দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে না । সেইসব কিছু মাথায় রেখে আমরা মোটর ভ্যানটাই বেছে নিলাম ।

কিন্তু বেছে নিয়েই কি বেরিয়ে পড়লাম ? না রে বাবা, বেরোলাম তো দশটার সময়ে । তার আগে সকালে কি কি হল, সেগুলো বলি ?

সকালে রিসর্টে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম । পাঁউরুটি ডিমভাজা আর একটা মিস্টি মিলিয়ে পড়ল ৪০ টাকা করে । এখানে একটা মজার জিনিস বলি । প্রথমদিন ব্রেকফাস্টে পাঁউরুটি খেতে গিয়ে দেখলাম পাঁউরুটিতে জবজবে করে মাখন মাখানো । এত মাখন ? একটু অবাক লাগল । পরেরদিন ব্রেকফাস্টের সময়ে দেখতে পেলাম এত মাখনের কারণ কি । আমরা সাধারণতঃ মাখনের বার থেকে ছুরি বা চামচের সাহায্যে পাঁউরুটিতে মাখন মাখাই । আর ওরা গোটা বারটাকে নিয়েই পাঁউরুটিতে ঘষে ! আর সেইসঙ্গে পাঁউরুটি গরম থাকার হু হু করে মাখন অ্যাবসর্ব হয়ে যায় ! আর এই গোটা ব্যাপারটা ওরা পাঁউরুটির দু'পিঠে করে ! খেতে ভালো না হয়ে যায় কোথায় !

শাল-পিয়াল থেকে কংসাবতী ড্যাম
যাই হোক, ব্রেকফাস্টের পর সোনাঝুরির ভেতরে একটু ঘুরে বেড়ালাম । পাহাড়ের গায়ে গায়ে বিভিন্ন ধাপে আলাদা আলাদা করে একজোড়া কটেজ । তাদের নাম শাল-পিয়াল, তাল-তমাল (ইয়েস্‌ !) ইত্যাদি । এদের মধ্যে শাল-পিয়ালটা পাহাড়ের আরও কিছুটা ওপরে আর এখান থেকে ড্যামের অনেকটা দেখতে পাওয়া যায় । ওফ্‌, অসাধারণ ! সবমিলিয়ে জায়গাটা ওয়েল ডেকরেটেড, ওয়েল প্ল্যান্‌ড্‌, ওয়েল অর্গানাইজড্‌ অ্যান্ড ওয়েল মেইন্টেন্ড ! ওয়েল ... লেট্‌স্‌ স্টপ ইউজিং 'ওয়েল' ।

বাঁধের ওপর থেকে গ্রামের দৃশ্য
দশটার সময়ে বেরোলাম সাইট সিয়িং করতে । প্রথমে বাঁধের রাস্তার ওপর দিয়ে আমাদের নিয়ে গেল মোহনার দিকে । যাওয়ার পথটা অসাধারণ - একটু রোদ্দুরের তেজ থাকলেও সেটা সেরকম গায়ে লাগছিল না । একদিকে বিপুল জলরাশি আর অন্যদিকে দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেতের মাঝে মাঝে মাটির বাড়ি সম্বলিত গ্রাম - এ'জিনিসের সৌন্দর্য্য নিজের চোখে না দেখলে বলে বোঝানো সম্ভব নয় ।

পরেশনাথ পাহাড় থেকে
আমাদের প্রথম দাঁড়ানোর জায়গা পরেশনাথ পাহাড় । এখানে একটা ছোট্ট টিলার ওপরে একটা শিবলিঙ্গ আছে । টিলার ওপর থেকে বহুদূর পর্যন্ত চমৎকার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় । আমরা এখানে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুললাম ।



কংসাবতী ও কুমারীর মোহনা


এরপরের গন্তব্য মোহনা । এই মোহনার বৈশিষ্ট্য হল এখানে কংসাবতী (বা কাঁসাই) এবং কুমারী দু'টো নদী একসঙ্গে মিলিত হয়েছে । এখান থেকে নৌকো চড়ে নদীর ওপারে যাওয়া যায় আর সেখান থেকে ডিয়ার পার্কে যাওয়া যায় । তবে লোকজনের মতে ডিয়ারপার্কে সেরকম কিছু দেখার নেই, তাই আমরা আর ও'পথ ধরলাম না । মোহনায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে চলে এলাম ।

গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ
তৃতীয় যাওয়ার জায়গা অম্বিকানগর । এই জায়গাটা বলতে গেলে আমাদের রিসর্টের পাহাড়ের পেছন দিকে - তাই বলতে গেলে আমরা এবার ফেরার রাস্তা ধরলাম । কিন্তু আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড এবারে আর বাঁধের ওপর দিয়ে ফিরল না । তার বদলে বাঁধ থেকে গ্রামের পথে নেমে গিয়ে মেঠো পথে ফেরা হল । অর্থাৎ আসার পথে যেসব গ্রাম আর ধানজমি গুলো ওপর থেকে দেখছিলাম, এবার তাদের মধ্যে দিয়ে ফিরলাম । দু'ধারে ধানক্ষেত, ছোট ছোট জনবসতি, পুকুর ইত্যাদি । পথের দু'দিকে নানারকম গাছের শান্তশীতল ছায়া আর তার মাঝখান দিয়ে লালমাটির মেঠো পথটি দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি আর এক অজানার উদ্দেশ্যে - এর অনুভূতিই আলাদা ! (এত কাব্য করছি কেন ? আসলে আমরা আছি বাঁকুড়ায় আর বাঁকুড়ার পাশেই বীরভূম আর বীরভুম মানেই শান্তিনিকেতন আর শান্তিনিকেতন মানেই রবীন্দ্রনাথ !)

অম্বিকাদেবীর মন্দির
অম্বিকানগর একটা টাউনশিপ - এখানে দেখার জায়গা বলতে একমাত্র অম্বিকাদেবীর মন্দির । রাস্তার ধারে একটা ছোটখাটো মন্দির - সেরকম দূর্দান্ত কিছু নয় । চাইলে এখানে না যাওয়াও যেতে পারে ।





কংসাবতীর ব্যারেজ
এবার আবার মুকুটমণিপুরের রাস্তা ধরলাম । ফেরার পথে আমাদের রিসর্টের সামনের রাস্তা দিয়ে ফিরে এসে আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে গেলাম ব্যারেজের কাছে । এই ব্যারেজের থেকেই জল ছাড়া হয় যেটা সেচের কাজে ব্যবহার করা হয় । এখন আপাতত লক্‌গেট বন্ধ । সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ফিরে এলাম রিসর্টে । এই ঘোরাঘুরির জন্য আমাদের খরচ পড়ল ২৩০ টাকা (অ্যাম্বাসাডরে পড়ত ৪০০ টাকা) ।

ফিরে এসে চানটান করে নিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম । দুপুরে চিকেন মিল বলা ছিল । ভাত ডাল তরকারি আর চিকেন । এরপর ঘরে এসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে চারটে নাগাদ আবার বেরিয়ে গেলাম ড্যামের ধারে । এবার আমাদের উদ্দেশ্য নৌকাবিহার !

নৌভ্রমণের সময়ে
নৌকো করে এখানে ড্যামের মধ্যে ঘোরা যায় । চাইলে নৌকো করে মোহনা পর্যন্তও ঘুরে আসা যায় । নৌকোর রেট হচ্ছে ২৫০ টাকা - মোটামুটি ১০ - ১২ জন আরাম্‌সে বসতে পারে । কিন্তু আগেই বলেছি আমরা ছাড়া আর কোনও ট্যুরিস্ট নেই, কাজেই পুরো নৌকোটা আমাদেরই ভাড়া করতে হল ২০০ টাকা দিয়ে । নৌকো জলের মধ্যে আধঘন্টা মতো ঘোরায় । (আর ডাঙায় একমিনিটও ঘোরায় না) একবার একেবারে ব্যারেজের কাছে নিয়ে গেল । বেশ ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছিল । বিকেলের পড়ন্ত আলোয় এই নৌভ্রমণ বেশ সুন্দর একটা অভিজ্ঞতা ।

ড্যামের রাস্তার মুখে কিছু গিফ্‌ট্‌ আইটেমের দোকান আছে । সবমিলিয়ে দশ-বারোটা । জিনিসের দাম সস্তাই বলা যায় । বাঁকুড়ার প্রসিদ্ধ জিনিস হল বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত মাটির ঘোড়া - তবে মাটির ঘোড়া নিয়ে আসা রিস্কি বলে কাঠের ঘোড়া কেনা হল ।

কংসাবতীর গতিপথ - ব্যারেজের বিপরীত দিকে
সন্ধ্যে হতে তখনো কিছুটা দেরি আছে , তাই আমরা আরেকবার ব্যারেজের দিকটা গেলাম । আসলে হাতে সময় আছে আর সেরকম কিছু করার নেই, তাই বলতে গেলে একই জায়গা দু'বার করে ঘুরলাম আর কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ঘরে ফিরে এলাম ।





রাতে চিকেন মিল । খেয়েদেয়ে ঘরে চলে এলাম ।

১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ মঙ্গলবার । আমাদের ফেরার দিন । আমাদের ফেরার ট্রেন আবার সেই বাঁকুড়া থেকে । রিসর্টে খোঁজ নিয়ে জানলাম সকাল এগারোটা চল্লিশে একটা বাস আছে যেটা সরাসরি বাঁকুড়া যায় । কিন্তু ১৭ই সেপ্টেম্বর বিশ্বকর্ম্মা পুজো - কাজেই বাস চলবে কিনা জানা নেই । তাই ঝুঁকি না নিয়ে ৮০০ টাকায় একটা অ্যাম্বাসাডর ঠিক করা হল যেটা আমাদের একেবারে বাঁকুড়া স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে আসবে । ঠিক হল আমরা সাড়ে এগারোটায় বেরোব ।

হিল্‌টপ থেকে ড্যাম
চানটান করে ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে নিয়ে রেডি হয়ে নিয়ে একটা জায়গায় গেলাম যেটা আমাদের দেখা বাকি ছিল । সেটা হচ্ছে সোনাঝুরির হিল্‌টপ । আগেই বলেছি সোনাঝুরি রিসর্টটা একটা পাহাড়ের গায়ে । এই পাহাড়ের মাথায় ওঠার একটা সিঁড়ি আছে । পাহাড়ের মাথায় যখন পৌঁছলাম তখন মুখ দিয়ে আপনা আপনিই বেরিয়ে পড়ল 'বাঃ !' সত্যিই, মুকুটমণিপুরে এসে এখানে না এলে পুরো ঘোরাটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায় ! সামনে কিছুদূরে ড্যামের পাঁচিল আর তার ওপারে বহুদূরবিস্তৃত বিপুল জলরাশি । একটা বিরাট জায়গা একসঙ্গে দেখা যায় এই হিল্‌টপ থেকে । যারা মুকুটমণিপুরে গেছে তারা হয়তো আমার সঙ্গে একমত হবে যে এটাই মুকুটমণিপুরে শ্রেষ্ঠ পাওনা !

এবার ঘরে ফেরার পালা । স্টেশনে পোঁছলাম তখন সাড়ে বারোটা । স্টেশনসংলগ্ন একটা দোকানে ভাতটাত খেয়ে নেওয়া হল । (এটার আর ডিটেল দিচ্ছি না, কারণ খাবারের মান স্টেশনসংলগ্ন দোকানে যেরকম হয়, সেরকমই) আমাদের ট্রেন আরণ্যক এক্সপ্রেসের সময় দু'টো পঁয়তাল্লিশ - তাই স্টেশনে অপেক্ষা করলাম । ট্রেন এল নির্ধারিত সময়ের দশমিনিট পরে । পৌনে সাতটায় সাঁত্রাগাছি আর সেখান থেকে বাড়ি !

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে খুব কাছে দু'দিনের ঘোরার এবং রিল্যাক্স করার জন্য একটা আদর্শ জায়গা মুকুটমণিপুর । ট্রেনে যাওয়ার সুবিধে থাকলেও ধর্ম্মতলা থেকে বাসে যাওয়া অনেক সহজসাধ্য ।
২. মুকুটমণিপুরে অল্প কিছু হোটেল থাকলেও থাকার জন্য সবথেকে উপযোগী হল ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্টের সোনাঝুরি রিসর্ট । বুকিং অফিস  ঃ 6A, Raja Subodh Mullick Square, 7th - Floor, Kolkata-700013 Phone No: 033-2237-0060/ 2237-0061/2225-8549. এছাড়া ওদের ওয়েবসাইট থেকেও সরাসরি বুকিং করা যেতে পারে ঃ http://www.wbfdc.com/.
৩. রিসর্টের খাওয়াদাওয়া অত্যন্ত ভালো এবং সস্তা । এদের রুমে খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা নেই - ডাইনিং এ গিয়ে খেয়ে আসতে হয় ।
৪. এখানে সাইট সিয়িং এর জায়গা বলতে পরেশনাথ পাহাড়, মোহনা, অম্বিকানগর আর ব্যারেজ । সাইট সিয়িং এর জন্য মোটর ভ্যান পাওয়া যায় আর চাইলে রিসর্ট থেকে গাড়িরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে ।
৫. কংসাবতী নদীতে নৌকো করে ঘোরা যেতে পারে । নৌভ্রমণের আদর্শ সময় বিকেলবেলা ।
৬. ড্যামে যাওয়ার রাস্তায় কিছু দোকান আছে - এখান থেকে টুকিটাকি জিনিস কেনা যেতে পারে ।
৭. মুকুটমণিপুরে যাওয়ার জন্য ৬ - ৮ জনের গ্রুপ হচ্ছে সবচেয়ে ভালো - সেক্ষেত্রে মাথাপিছু ভ্যান বা নৌকোভাড়াটা অনেক কমে যাবে ।

উপসংহারঃ

মুকুটমণিপুর
পাহাড় আর জলের সহাবস্থানই হল মুকুটমণিপুরের প্রধান আকর্ষণ । শহরের কোলাহল, দূষণ আর যান্ত্রিক পরিবেশ থেকে যেন অনেক দূরে একটা শান্ত নিরিবিলি জায়গায় অবস্থিত এই ভ্রমণকেন্দ্রটি । এখানে খুব বেশি মানুষও বাস করে না আর ট্যুরিজ্‌ম্‌ এদের প্রধান জীবিকাও নয় । তাই কেউ চাইলে নিজের মতো করে জায়গাটা উপভোগ করতে পারে । এখানে বেড়ানোর সব উপকরণই বর্তমান, শুধু নেই বেড়াতে গিয়ে নিয়মের বেড়াজাল । মুকুটমণিপুরের আকর্ষণ থেকে এ'কথা বলাই যায় যে - প্রকৃতিপ্রেমী এবং ভ্রমণপিপাসু মানুষদের দু'ভাগে ভাগ করা যায় । এক, যারা মুকুটমণিপুরে গেছে আর দু'ই যারা মুকুটমণিপুরে যাবে !

মুকুটমণিপুরের আরও ছবি দেখতে হলে click here:

8 comments:

  1. Darun hoiche...:) ar Khub informatic o.

    ReplyDelete
  2. Tomar blog borabor e interesting r informative,tai ai niye notun kore r kichhu bolar nei. :) kintu jeta amar sob cheye bhalo laglo seta holo, ager bar Shilong blog a je byapartar proti ami tomar drishti akorshon korechhilam sei byapare tumi amay nirash koroni,byaparta proti jothesto jotno niyechho :) amar motamot k ato ta gurutto dewar jonno thanx.. :D I'm feeling honoured :D r ai lekha te jeta notice korlam seta holo,tomar nijossyo touch a besh kichhu hasyo rasatmak comments :D khub e monorom! tomar lekhar style k r o beshi samridho korechhe. tomar lekha sobsomay perfect :) bhul dhorar dhrishtota ami korbo na... :D anek bok bok kore phellam... :D

    ReplyDelete
  3. dear sir ,, apnar tola Mukutmanipur er photo gulo darun hoyeche....nice photography with nice concept....amar Bankura District e bari and Mukutmanipurer khub samney bari....Bankura District er most popular facebook page er ami admin....apnar tola koto gulo Mukutmanipur er photos amader Bankura District er page e dichhi....and thank you veru much :) abar asben Mukutmanipur....aro notun kore sajano hoye6e apnar pochonder Mukutmanipur ke :) Facebook Page Link : https://www.facebook.com/bankura.ranga.matir.desh

    ReplyDelete
  4. Khub valo laglo apnar blog pore

    ReplyDelete
  5. বেশ ভাল লাগল। আমরা বাঁকুড়া থেকে গিয়েছিলাম। অল্প সময় ছিলাম। ভবিষ্যতে শুধু এখানেই যাওয়ার ইচ্ছে রইল।

    ReplyDelete
  6. বিশদে সব বর্ননা করা হয়েছে।খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete