যাওয়ার দিন ১২ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ - আমরা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি পৌঁছলাম তখন দুপুর ১২ টা। ঠাকুরবাড়ি সোমবার বন্ধ থাকে। বাকি দিনগুলো সকাল ১০ঃ৩০ মিনিট থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জন্য খোলা থাকে। এবারে আমাদের দল সাতজনের - আমরা ছ'জন ছাড়া আমাদের সঙ্গে টুটুন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ভৌগোলিক অবস্থান জানেনা এরকম মানুষ বোধহয় কলকাতায় নেই, তবে আমার ব্লগের কলকাতার বাইরের (বা পশ্চিমবঙ্গের বাইরের বা ভারতবর্ষের বাইরের !) পাঠক/পাঠিকাদের জন্য জানাচ্ছি জায়গাটা গণেশটকি বা সিংহীবাগান অঞ্চলে আর গিরীশপার্ক মেট্রো স্টেশন থেকে খুবই কাছে। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ঢোকার দরজাটা চিৎপুর রোডের উপরে। এখানে গাড়ি পার্কিং-এর জায়গাও আছে। তবে ভীড়ের দিনে গেলে পার্কিং-এর জায়গা পাওয়া সহজ হবে না কারণ এখানে জায়গা সীমিত।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। গেটের পাশে টিকিট কাউন্টার। মাথাপিছু ২০/- টাকা করে টিকিট কেটে (বাচ্চাদের লাগে না) আমরা ভিতরে ঢুকলাম। এখানে জানিয়ে রাখি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ছবি তুলতে গেলে তার জন্য আলাদা করে টাকা দিতে হয়। আর এঁরা সেই ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। ভিতরে কোথাও লুকিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করাও উচিৎ নয় কারণ সর্বত্র সি সি ক্যামেরা লাগানো আছে। আমরা ভিতরে কোনও ছবি তুলিনি, কারণ আমরা টাকা দিইনি।
ঠাকুরবাড়িতে ঢোকার আগে |
ঠাকুরবাড়ির একতলায় কিছু দেখার নেই, সব দর্শনীয় জায়গাগুলো দোতলা আর তিনতলায়। তাছাড়া চারতলার ছাদেও যাওয়া যায়, যদিও সেখানে দেখার কিছু নেই। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে আমরা একের পর এক ঘরগুলো দেখতে থাকলাম। ঠাকুরবাড়ি প্রকৃতপক্ষে একটা অত্যন্ত ধনী জমিদারবাড়ি, তাই এখানে তাঁদের ব্যবহৃত সবকিছুর মধ্যেই আভিজাত্য ও বিলাসিতার ছাপ সুস্পষ্ট। কোনঘরে গিয়ে কি দেখলাম সেটা আর আলাদা করে লিখছি না, তবে এটা বলতেই হবে যে বিশ্বভারতী এখানকার সবকিছু অত্যন্ত সুন্দরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করে। রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর, শোওয়ার ঘর, বসার ঘর ইত্যাদি দেখে আমরা একটা ঘরে ঢুকলাম যেখানে রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল (ডাক্তারদের মধ্যে ছিলেন স্বয়ং বিধানচন্দ্র রায়)।
ভিতরের বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আরও কয়েকটা ঘর দেখলাম যেখানে নানারকম ছবি ইত্যাদি সংগ্রহ করা হয়েছে। তারপর আরও কয়েকটা ঘর দেখলাম যেখানে একটা ঘরের মধ্যে দিয়ে আরেকটা ঘরে যেতে হয়, সেটার ভিতর দিয়ে আরেকটা ঘরে যাওয়া যায় আর সেটার ভিতরে দিয়ে আরেকটা ঘরে যাওয়া যায়। সত্যি বলতে কি, বাড়িটা এতটাই বড় আর সেইসঙ্গে ভিতরের ম্যাপটাও বেশ জটিল। হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই, কিন্তু ভিতরে ঢুকে "কোন ঘরটা দেখলাম আর কোনটা বাকি রয়ে গেল" এটা হিসেব রাখা সহজ নয়। এই শেষের ঘরগুলো রবীন্দ্রনাথের বিদেশভ্রমণ সংক্রান্ত। রবীন্দ্রনাথ বেশ অনেকবার বিদেশে গিয়েছিলেন - এই ঘরগুলোতে প্রধানতঃ তাঁর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ভ্রমণের সময়কার ছবি ও তথ্য রাখা আছে। সব ছবির লাগোয়া সবলেখা পড়া সম্ভব হয়নি, কারণ গেটে ঢোকার সময়ে আমাদের বলা হয়েছে একঘন্টার মধ্যে পুরোটা দেখে নেমে আসতে।
এরপর আমরা গেলাম একটা ঘরে সেখানে ঠাকুরবাড়ি বিভিন্ন ব্যক্তিদের পূর্ণ তৈলচিত্র আঁকা রয়েছে। আর এখানেই দেখতে পেলাম সেই মহান ব্যক্তির তৈলচিত্র - যিনি ঠাকুরবাড়িতে আমার আসার মূল অনুপ্রেরণা। তিনি এই বাড়ির নির্মাতা না হলেও আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট বাড়িটিকে তিনিই সুবিশাল জমিদারবাড়ির আকার দিয়েছিলেন। একজন সাধারণ জমিদার হিসেবে জীবন শুরু করে আজ থেকে প্রায় দু'শো বছর আগে যিনি বাঙালিদের মধ্যে তো বটেই, সম্ভবতঃ ভারতবর্ষেরও সবথেকে ধনী ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিলেন। জমিদারী, কয়লা, ব্যাঙ্কিং, ইন্সিওরেন্স, চটকল, চা, আফিম, জাহাজ ইত্যাদি আরও নানারকম জিনিসের ব্যবসা করে সেই যুগে যাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল কোটি টাকার উপরে (আজকালকার দিনের টাটা-আম্বানীদের থেকেও বেশি !)। যিনি রাজা রামমোহন রায়ের প্রায় সমস্ত সমাজসংস্কারমূলক কাজে ছিলেন তাঁর ছায়াসঙ্গী। যিনি মেডিক্যাল কলেজ, হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠার মতো যেকোনও উন্নয়নমূলক আর সৃজনশীল কাজে সবসময়ে অকাতরে অর্থব্যয় করেছেন কিন্তু নিজে থেকেছেন প্রচারবিমুখ। যিনি ব্রাহ্মসমাজের শুরু থেকে ছিলেন তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। যিনি পরাধীন দেশের একজন নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও ইংল্যান্ডে স্বয়ং মহারাণী ভিক্টোরিয়ার আমন্ত্রণে তাঁর প্রাসাদে গিয়ে তাঁর আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন - যে সম্মান সেই যুগে খোদ ইংল্যান্ডের বহু অভিজাত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরাও পেতেন না। যিনি ছিলেন ফ্রান্সের সম্রাটের বন্ধু ও প্রিয়পাত্র। আমার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি যাওয়ার প্রধান কারণ সেই ব্যক্তির বাসস্থান দর্শন করা - তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর - এমন একজন 'প্রিন্স' যাঁর বাবা কোনও 'কিং' ছিলেন না !
এই শেষ লাইনটার জন্য আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই রাজা ভট্টাচার্য রচিত 'দ্বারকানাথ' বইটির নাম। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর সম্পর্কে কিছু তথ্য আমি জানতে পারি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সেই সময়' উপন্যাসে। মাস ছয়েক আগে রাজা ভট্টাচার্যের এই 'দ্বারকানাথ' বইটা থেকে আমি দ্বারকানাথ ঠাকুর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি। 'সেই সময়' পড়ে যে মানুষটির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা জন্মেছিল, 'দ্বারকানাথ' পড়ে তাঁকে মনে মনে ঠাকুরের আসনে বসিয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথ কারুর কারুর কাছে ঠাকুর, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কারুর কারুর কাছে ঠাকুর। ঠিক সেভাবেই প্রিন্স দ্বারকানাথ আমার কাছে ঠাকুর - 'বাঙালির দ্বারা ব্যবসা হয়না' প্রচলিত এই ধারণার গালে যিনি নিজেই একটি সপাট চড় ! আমার ব্লগের পাঠক/পাঠিকাদের মধ্যে যাঁদের বই পড়ার একটুআধটু অভ্যেস আছে, রাজা ভট্টাচার্যের 'দ্বারকানাথ' বইটা অবশ্যই পড়ার জন্য তাঁদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। অত্যন্ত যত্নসহকারে পড়ে অক্ষত অবস্থায় ফেরৎ দেওয়ার অঙ্গীকার করলে আমি বইটা ধার দিতেও রাজী আছি।
দ্বারকানাথের তৈলচিত্র আর তাঁর ব্যবহৃত কিছু জিনিস দেখার পরে বাকি সবকিছু কেমন ফিকে লাগছিল। এরপর আমরা দোতলা থেকে তিনতলায় গিয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পকলার কিছু নমুনা দেখলাম। তিনতলার বারান্দা থেকে সামনের মাঠের দৃশ্য দেখতে বেশ সুন্দর লাগে। ঠাকুরবাড়ির একটা অংশে কিছু লোকজন থাকে আর কিছু অংশে বিশ্বভারতীর কাজকর্ম হয় বলে সেই অংশগুলোতে সাধারণ মানুষকে যেতে দেওয়া হয় না। আমরা ছাদটা একবার দেখে নিয়ে নিচে নেমে এলাম।
বাড়ির ভিতরের উঠোন |
উপসংহারঃ
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি |
Besh bhalo laglo lekhata...obosso ei barite MFA te ek bochhor katanor souvagyo hoechhilo amar
ReplyDeleteKhub valo laglo tomar lekha pore sabsamoy mone hoy amra o ghurlam,
DeleteDhonyobad
Delete