বিশেষ সতর্কীকরণ ঃ
১. এই ভ্রমণে আমরা জনবহুল স্থানে, বিশেষতঃ স্টেশনে, ট্রেনে ইত্যাদি জায়গায় সারাক্ষণ মাস্ক পরে থেকেছি এবং দূরত্ববিধি যথাসম্ভব মেনে চলার চেষ্টা করেছি । সেইসঙ্গে প্রয়োজনমতো হ্যান্ড স্যানিটাইজারও ব্যবহার করেছি ।
২. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও অবস্থাতেই কোনও পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার করিনি । অর্থাৎ প্লাস্টিকের ব্যবহার না করেও এই ভ্রমণ অনায়াসে করা যায় ।
৩. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও কাগজ ব্যবহার বা নষ্ট করিনি । হোটেল বুকিং-এর রশিদ-এর প্রিন্ট আউট ব্যবহারের কোনও প্রয়োজন হয় না ।
৪. এই পুরো ভ্রমণে আমাদের দলের কেউ ধূমপান করেনি । ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর ।
আমার ব্লগের সমস্ত পাঠকদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে করোনা ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করার জন্য সরকারী বিধিনিষেধ মেনে চলার জন্য । সেইসঙ্গে অনুরোধ করছি প্লাস্টিক, অপ্রয়োজনীয় কাগজের ব্যবহার আর ধূমপান বর্জন করার জন্য ।
ভ্রমণপথ ঃ
শনিবার ১৩ই মার্চ, ২০২১ঃ হাওড়া থেকে সকাল ৮ টায় হাওড়া নিউ দিল্লী স্পেশাল ট্রেন - সকাল ১০ঃ৪০ মিনিটে আসানসোল । আসানসোল থেকে একঘন্টা গাড়িতে বরন্তি । বরন্তিতে রাত্রিবাস ।
রবিবার ১৪ই মার্চ, ২০২১ঃ বরন্তির লোক্যাল সাইট সিয়িং । বরন্তিতে রাত্রিবাস ।
সোমবার ১৫ই মার্চ, ২০২১ঃ বরন্তি থেকে গাড়িতে আসানসোল । আসানসোল থেকে সকাল ১০ঃ৪৩ মিনিটে পাটনা হাওড়া স্পেশাল ট্রেন - দুপুর ১ঃ১০ মিনিটে হাওড়া ।
বরন্তি (স্থানীয় মানুষের উচ্চারণে বড়ন্তিও বলা যেতে পারে, কিন্তু কোনওভাবেই বারান্তি নয় !)। কলকাতা থেকে ঘন্টা তিনেকের দূরত্বে পুরুলিয়া জেলায় পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একটা গ্রাম । করোনার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সুদীর্ঘদিন বাড়িতে বসে থাকার পরে ট্রেনে করে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা যখনই করলাম, এই জায়গাটার কথা মাথায় এল । তার একটা কারণ এখানে যাতায়াতটা বেশ সহজসাধ্য, আর অন্য কারণ হল জায়গাটা ফাঁকা ফাঁকা । এই বরন্তিতে দু'দিনের অভিজ্ঞতা নিয়েই আমার ব্লগের এবারের পোস্ট ।
কলকাতা থেকে বরন্তির দূরত্ব ২৪০ কিলোমিটারের মতো - গাড়িতে ঘন্টা চারেক । টানা গাড়িতেও যাওয়া যায় (যেটা অনেকেই করেন) আবার ট্রেনেও যাওয়া যায় । আমরা অবশ্য ট্রেনেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম । কাঁটায় কাঁটায় সকাল আটটার সময়ে হাওড়া থেকে হাওড়া - নিউ দিল্লী স্পেশাল ট্রেন যখন ছাড়ল, তখন সত্যিই ভালো লাগছিল । ভাইজ্যাগ-আরাকু ভ্রমণের দীর্ঘ দু'বছর পাঁচ মাস পরে আমরা আবার ট্রেনে করে কোথাও গেলাম । আমরা বলতে আমরা ছ'জন অর্থাৎ আমি, অমৃতা, বাবা, মা, কথা-কলি । ট্রেনে এই প্রথমবার কথা-কলির টিকিট লেগেছে - ওরা নিজেদের আলাদা বসার সিট্ পেয়েছে, এতে ওরাও খুব খুশি ।
বৃষ্টির মধ্যে আসানসোল স্টেশন |
দামোদর নদ |
আসানসোল স্টেশন থেকে বরন্তি গাড়িতে ঘন্টাখানেক লাগে - ভাড়া ১,১০০/- টাকা । ছোট বা বড় সব গাড়ির ভাড়াই সমান - আমাদের লোকসংখ্যা ৬ হওয়ায় আমাদের একটা স্কর্পিও গাড়ি নেওয়া হয়েছিল । পশ্চিম বর্ধমান আর পুরুলিয়ার জেলার সীমারেখা নির্ধারণ করে বয়ে চলেছে দামোদর নদ । তার উপরের ব্রীজ পেরোনোর সময়ে একটা পুলিশের চেক্ পয়েন্ট আছে যেখানে পুলিশ গাড়ির ভিতরে ব্যাগ খুলিয়ে সবকিছু ভালোভাবে চেক্ করে (যারা বেআইনি অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে যাতাযাত করে, তাদের জন্য বলছি এই জায়গাটায় কিন্তু খুব সাবধান !)। দামোদর ব্রীজটা খুব সুন্দর আর আকাশ মেঘলা থাকায় দৃশ্য আরও সুন্দর লাগছিল । পুলিশ যতক্ষণ আমাদের গাড়ি চেকিং করল, আমি সেই সময়ে গাড়ি থেকে নেমে ব্রীজের উপর থেকে বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম ।
ঝোড়ো হাওয়ায় বরন্তি লেক |
আরণ্যক বননিবাস |
আমরা চেক্ইন করে চানটান করে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম । এখানে জানিয়ে রাখি বরন্তি একটা প্রত্যন্ত গ্রাম - এখানে ত্রিসীমানার মধ্যে কোনও দোকানপাট নেই । তাই রিসর্টের বাইরে খাওয়া দাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না । এখানে সব রিসর্টেই খাওয়ার প্যাকেজ পাওয়া যায় - সকালের চা, ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, সন্ধ্যের চা ও স্ন্যাক্স আর রাতের ডিনার । 'আরণ্যক রিসর্ট' - এ এই প্যাকেজের মূল্য মাথাপিছু ৪৫০/- টাকা । দুপুরের লাঞ্চের মেনু ভাত, ডাল, আলুভাজা, আলুপোস্ত, মাছের ঝোল, চাটনি, পাঁপড় । এখানকার রান্না একেবারেই ঘরোয়া আর সেইসঙ্গে অত্যন্ত সুস্বাদু ।
লাঞ্চ করে আমরা দুপুর ২ঃ১৫ নাগাদ গাড়ি নিয়ে বেরোলাম । বৃষ্টি একেবারেই থেমে গেছে, অল্প রোদও উঠেছে । আমাদের গন্তব্য শুশুনিয়া ও বিহারীনাথ পাহাড় । বরন্তি থেকে এগুলো ঘুরে আসতে ঘন্টা চারেক লাগে - গাড়িভাড়া ১,৭০০/- টাকা । আমাদের প্রথম গন্তব্য শুশুনিয়া পাহাড় । বরন্তি থেকে দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটারের মতো আর যেতে লাগে একঘন্টা ।
৩০০ মিটার উচ্চতায় খুদে চ্যাম্পিয়ন ! |
বিহারীনাথ পাহাড়ের সামনে |
বিহারীনাথ মন্দির |
বিহারীনাথ পাহাড় থেকে রিসর্টের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার - আমাদের ফিরতে লাগল ৪৫ মিনিটের মতো । যখন ফিরলাম তখন অন্ধকার হয়ে গেছে । বরন্তিতে রাস্তায় আলোর কোনও ব্যবস্থা নেই, রাস্তার উপর কিছু দূরে দূরে একেকটা রিসর্ট রয়েছে, যা আলো শুধু সেখানেই আছে । রিসর্টে ফেরার পরে আমাদের চা ও সন্ধ্যের জলখাবার মুড়ি-চানাচুর-আলুর চপ দিল (যারা ভাবছে আমার মতো আমিষাশী এগুলো কিকরে খেল তাদের জানিয়ে রাখি আমি এগুলোর সবই খাই এবং পরিস্থিতিবিশেষে ভালোওবাসি !)।
আরণ্যক রিসর্টের ফুলের বাগান |
রিসর্টের ভাড়ার ব্যাপারে বললেন এখানে উনি শুধুমাত্র ফ্যামিলি হলে তবেই ভাড়া দেন । বুকিং-এর সময়ে বারবার জিজ্ঞেস করে সেটা ভালোভাবে জেনে নেন এবং কিছুমাত্র সন্দেহ হলে তখন আর তাদের ভাড়া দেন না । বরন্তির মতো জায়গায় এই বিধিনিষেধটা আরোপ করে উনি যে একটা বেশ বড়সংখ্যক কাস্টমার হারান, সেটা উনি নিজেও জানেন কিন্তু এটাই ওনার বিজনেস এথিক্স, কাজেই এতে কারুর কিছু বলার থাকতে পারে না । তবে অতিথিদের প্রতি ওনার এবং ওনার কর্মচারীদের ব্যবহার বিশেষভাবে প্রশংসা করার মতো । আমরা ছাড়াও আরেকটি পরিবার এখানে ছিল, তাঁরাও এঁদের আতিথেয়তার বিশেষ প্রশংসা করছিলেন । আমার ব্লগের পাঠকদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি বরন্তিতে পরিবারের সঙ্গে গেলে 'আরণ্যক রিসর্ট'-এই ওঠার জন্য । দায়িত্ব নিয়ে বলছি এখানে থাকলে খুব ভালো লাগবে (না, এগুলো লেখার জন্য মিঃ মুকুল দাস বা অন্য কেউ আমাদের ঘুষ দেননি বা অন্য কোনও বিশেষ পরিষেবা দেননি । খুব ভালো ব্যবহার পেলে নিজের থেকেই এগুলো অন্যদের বলতে ইচ্ছে করে, যেমন বলেছিলাম মুর্শিদাবাদ বা পাঁচমারির হোটেলের সম্পর্কে ।)
রাতে ডিনারের মেনু ছিল ভাত/রুটি, তরকারি আর চিকেন কারি । রান্না অত্যন্ত সুস্বাদু । খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম ।
মাঠের ওপর সূর্য্যোদয় |
আরণ্যকের ভিতরে |
সকালে চায়ের পরে ব্রেকফাস্টে লুচি আর তরকারি দিল । সেগুলো খেয়ে মা-বাবা, কথা-কলি রিসর্ট থেকে বেরিয়ে একবার বরন্তি লেকটা ঘুরে এল । দুপুরে লাঞ্চের মেনু আগেরদিনের মতোই । খাওয়ার পরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেল ৪ঃ১৫ নাগাদ সবাই মিলে বেরোলাম বরন্তি লেকের উদ্দেশ্যে ।
বরন্তি লেকের উপর সূর্য্যাস্ত (প্যানোরমিক ভিউ) |
সূর্য্যাস্তের পরে ফেরার পথ ধরলাম । পথে একজায়গায় খেজুর গুড় বিক্রি হচ্ছিল, সেখান থেকে আমরা কিছুটা গুড় কিনলাম । এখানকার দাম কলকাতার থেকে বেশি তবে এর বৈশিষ্ট্য হল এতে কোনও চিনির ভেজাল নেই । বরন্তিতে গণপরিবহনের খুব অভাব - রিক্সা, ভ্যান, টোটো খুব কম চলে । তবে আমাদের বিশেষ কিছু ক্লান্তি নেই, ফিরতি পথে আধঘন্টা হেঁটে আবার রিসর্টে পৌঁছে গেলাম । আজকের সন্ধ্যের জলখাবারও গতকালেরই মতো তফাৎ শুধু আলুর চপের বদলে পিঁয়াজী । মিঃ মুকুল দাস ও তাঁর স্ত্রী গত তিনসপ্তাহ একটানা বরন্তিতে থাকার পরে আজ দুপুরে কলকাতা চলে গেছেন, কাজেই সন্ধ্যেবেলা তাঁর সঙ্গে গল্প করার সুযোগ আর নেই । আমরা বাকি সময়টা যথারীতি বারান্দায় বসেই কাটিয়ে দিলাম । রাতের মেনুও গতকালেরই মতো, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম ।
ফেরার পথে আসানসোল স্টেশন |
ফেরার পথে পাটনা হাওড়া স্পেশাল ট্রেন কাঁটায় কাঁটায় সকাল ১০ঃ৩৯ মিনিটে আসানসোল স্টেশনে এল আর কাঁটায় কাঁটায় ১০ঃ৪৩ মিনিটে ছাড়ল । ট্রেনের হাওড়া পৌঁছনোর কথা দুপুর ১ঃ২৫ মিনিটে আর ট্রেন নির্ধারিত সময়ের পনেরো মিনিট আগে আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিল । স্টেশন থেকে ট্যাক্সি করে বাড়ি !
সারসংক্ষেপ ঃ
১. কলকাতা থেকে ২-৩ দিনের ঘোরার জন্য একটা দূর্দান্ত জায়গা পুরুলিয়া জেলার বরন্তি । এখানকার প্রধান আকর্ষণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ।
২. বরন্তি যাওয়ার জন্য হাওড়া, শিয়ালদহ বা কলকাতা থেকে ট্রেনে আসানসোল পর্যন্ত্য গিয়ে সেখান থেকে গাড়িতে যেতে হয় । আসানসোল থেকে বরন্তির দূরত্ব ৩৭ কিলোমিটারের মতো, যেতে ঘন্টাখানেক সময় লাগে ।
৩. গাড়ির রাস্তায় কলকাতা থেকে বরন্তির দূরত্ব ২৪০ কিলোমিটার - টানা গাড়িতে গেলে ঘন্টা চারেক লাগে । রাস্তা জানা না থাকলে যাওয়ার জন্য গুগ্ল্ ম্যাপের সাহায্য নেওয়াই সুবিধেজনক ।
৪. বরন্তিতে থাকার অনেক হোটেল বা রিসর্ট আছে তবে 'আরণ্যক বননিবাস'-এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এখানকার ঘরভাড়া এবং খাবার খরচ বেশ কম এবং পরিষেবা অত্যন্তু উন্নতমানের । আরণ্যকের ওয়েবসাইট http://aaronnok.in/ থেকে এখানকার সম্পর্কে আরও তথ্য জানা যেতে পারে । যোগাযোগের নম্বর - 9830024052 / 8240283452 / 9836099007 / 8910398217.
৫. এখানে আলাদাভাবে খাবারের কোনও জায়গা নেই, হোটেল/রিসর্টের খাবারের উপরেই নির্ভর করতে হবে । এখানে প্রায় সব হোটেলেই প্যাকেজ সিস্টেমে সারাদিনের খাবার পাওয়া যায় ।
৬. বরন্তিতে ঘোরাঘুরির জন্য কোনও গাড়ির ব্যবস্থা করা দুষ্কর, তাই হোটেল থেকেই গাড়ির ব্যবস্থা করা শ্রেয় । কাছাকাছি যাতায়াতের জন্য টোটো বা রিক্সাও এখানে সহজে পাওয়া যায় না ।
৭. এখানে সেভাবে কোনও দোকানপাট নেই তাই সাধারণ দরকারি জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে যাওয়াই ভালো । এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক বেশ ভালো, 4G-ও দিব্যি কাজ করে ।
৮. বরন্তিতে দেখবার একমাত্র জায়গা বরন্তি লেক । বিকেলের দিকে গেলে লেকের ওপরে সূর্য্যাস্তের দৃশ্য দেখতে খুবই ভালো লাগবে ।
৯. এখান থেকে গাড়ি নিয়ে শুশুনিয়া ও বিহারীনাথ পাহাড় দেখতে যাওয়া যেতে পারে । এই দু'টো পাহাড়েরই উপর পর্যন্ত্য হেঁটে ওঠা যায় ।
১০. বরন্তি থেকে ডে-আউটে গড়পঞ্চকোট, পাঞ্চেৎ, মাইথন, কল্যাণেশ্বরী মন্দির দেখে আসা যেতে পারে । তবে জায়গাগুলো কোনওটাই বরন্তি থেকে খুব কাছে নয় ।
১১. বরন্তি যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হল শীতকাল, তাছাড়া বর্ষাকালে গেলেও ভালোই লাগবে । গরমের সময়ে না যাওয়াই ভালো।
উপসংহার ঃ
বরন্তি |
বরন্তি ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.
valo lagloo :) sundar
ReplyDeleteDhonyobad :)
Deleteখুব ভালো লাগলো।কথা কলি পাহাড়ে উঠছে নিজেরাই। অবাক লাগছে।
ReplyDeleteধন্যবাদ। হ্যাঁ, কথা কলি নিজেরাই পাহাড়ে উঠছে। বড় হয়ে গেছে। :)
DeleteKhub valo
ReplyDeleteDhonyobad :)
Delete