আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Tuesday, March 29, 2022

বরন্তি ও গড় পঞ্চকোট ভ্রমণ

বিশেষ সতর্কীকরণঃ

১. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও অবস্থাতেই কোনও পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার করিনি। অর্থাৎ প্লাস্টিকের ব্যবহার না করেও এই ভ্রমণ অনায়াসে করা যায়।

২. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও কাগজ ব্যবহার বা নষ্ট করিনি। হোটেল বুকিং-এর রশিদ-এর প্রিন্ট আউট ব্যবহারের কোনও প্রয়োজন হয় না।

৩. এই পুরো ভ্রমণে আমাদের দলের কেউ ধূমপান করেনি। ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।

আমার ব্লগের সমস্ত পাঠকদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি প্লাস্টিক, অপ্রয়োজনীয় কাগজের ব্যবহার আর ধূমপান বর্জন করার জন্য।

ভ্রমণপথঃ

শুক্রবার ২৫শে মার্চ, ২০২২ঃ সকাল ৬ঃ৩০ মিনিটে বাড়ি থেকে গাড়িতে যাত্রা করে দুপুর ১২ঃ৩০ মিনিটে বরন্তি। দুপুরে বরন্তি থেকে গাড়িতে শুশুনিয়া - বরন্তিতে রাত্রিবাস। 

শনিবার ২৬শে মার্চ ২০২২ঃ সকাল ৯টায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে দুপুরে অযোধ্যা পাহাড় - বরন্তিতে রাত্রিবাস।

রবিবার ২৭শে মার্চ, ২০২২ঃ সকাল ১০ঃ৩০ মিনিটে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পঞ্চকোট গড় - দুপুর ১ টায় গড়পঞ্চকোট প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্র - গড়পঞ্চকোটে রাত্রিবাস ।

সোমবার ২৮শে মার্চ, ২০২২ঃ সকাল ১০টায় বেরিয়ে সাইট সিয়িং - বিকেল ৪ঃ৩০ মিনিটে গড়পঞ্চকোট - গড়পঞ্চকোটে রাত্রিবাস।

মঙ্গলবার ২৯শে মার্চ, ২০২২ঃ সকাল ১০ঃ৩০ মিনিটে গড়পঞ্চকোট থেকে বেরিয়ে দুপুর ১২টায় আসানসোল - আসানসোল থেকে দুপুর ১২ঃ৩০ মিনিটে বেরিয়ে বিকেল ৫ঃ৩০ মিনিটে কলকাতা।

মরা আজ পর্যন্ত যতবার যত জায়গায় বেড়াতে গিয়েছি, তার মধ্যে কখনও এরকম হয়নি যে একই জায়গায় মাত্র একবছরের ব্যবধানে দু'বার গিয়েছি। এবারে বরন্তি গিয়ে সেটাই হল। গতবছর এই মার্চ মাসেই করোনার অতিমারী অতিক্রান্ত হওয়ার পরে আমরা গিয়েছিলাম বরন্তিতে। আর তার ঠিক একবছর পরেই আবার গেলাম বরন্তি - এবারে সঙ্গে যোগ হল গড় পঞ্চকোট। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার এই দু'টো জায়গায় পাঁচদিনের ঘোরার অভিজ্ঞতা নিয়েই আমার ব্লগের এবারের পোস্ট।

শুক্রবার ২৫শে মার্চ, ২০২২ সকাল সাড়ে ছ'টার সময়ে বাড়ি থেকে আমরা ছ'জন বেরোলাম গাড়ি নিয়ে। হাওড়ার সাঁত্রাগাছির কাছে বেতোর থেকে সোনামাসি আর মশাই গাড়িতে উঠল। আমাদের নতুন গাড়ি মারুতি সুজুকি আরটিগা কেনার পরে এই প্রথম কোনও ভ্রমণ করা হল - এই গাড়িতে আমাদের আটজনেরই সচ্ছন্দে জায়গা হয়ে যায়। এরপর ডানকুনির মোড় থেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল দিদিভাইদের গাড়ি - গাড়িতে দিদিভাই, রাজীবদা, মোম, মেশোমশাই আর মাসিমা। বেলা আটটা নাগাদ আমরা ডানকুনি থেকে রওনা দিলাম বরন্তির উদ্দেশ্যে। রাস্তায় দু'বার দাঁড়ানো হল খাওয়াদাওয়া করার জন্য। শেষ পর্যন্ত আমরা দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ বরন্তি পৌঁছলাম।

গতবছর বরন্তিতে গিয়ে আমাদের খুবই ভালো লেগেছিল, সেটা আগের গতবারের পোস্টেই লিখেছি। শুধু জায়গাটা নয়, আমাদের 'আরণ্যক রিসর্ট'-টাও ছিল দুর্দান্ত। সেই কারণে এবারেও সেই একই জায়গায় বুকিং করা হয়েছিল। এবারে আমাদের লোকসংখ্যা বেশি, তাই তিনটে ত্রিশয্যার ঘর আর একটা দোতলার চতুর্শয্যার ঘর নেওয়া হয়েছিল। আরণ্যক রিসর্টের বিস্তারিত বিবরণ আর এখানে দেব না, সেটা জানার জন্য গতবছরের পোস্টটা পড়লেই চলবে কারণ রিসর্টে গত একবছরে কোনও পরিবর্তন হয়নি। ঘরে ঢুকে চানটান করে আমরা লাঞ্চ করে নিলাম। আগে থেকেই বলা ছিল প্রথমদিন দুপুরে আমরা মাটন খাব। এখানে এমনিতে খাওয়ার খরচ মাথাপিছু ৫০০/- টাকা প্রতিদিন। মাটন নেওয়ার জন্য সেটা বেড়ে ৫৭৫/- হল।

লাঞ্চ করেই পৌনে তিনটে নাগাদ আমরা কয়েকজন বেরিয়ে পড়লাম আমাদের প্রথমদিনের গন্তব্য শুশুনিয়া পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। আমাদের সঙ্গে কোনও স্থানীয় ড্রাইভার নেই, পুরোটাই গুগ্‌ল্‌ ম্যাপের ভরসা। ম্যাপ অনেক সময়েই সঠিক রাস্তা বলতে পারে না, এটা আগেও দেখেছি। ম্যাপ আমাদের শুশুনিয়া পাহাড়ের যেদিকটায় পৌঁছে দিল, সেখান দিয়ে পাহাড়ে ওঠা যায় না। তারপর কিছুটা অনুমানের ভিত্তিতে পৌঁছে গেলাম আসল জায়গায় - যেখান থেকে ট্রেকিং করে পাহাড়ে ওঠা যায়।  পৌঁছতে প্রায় চারটে বেজে গেল। পৌঁছে গিয়ে পাহাড়ের উপরে উঠতে শুরু করলাম আমি, কথা, কলি আর মোম।

৩০০ মিটার উচ্চতায় (আরেক) খুদে চ্যাম্পিয়ন !
ওঠার পথের বিবরণও আর এবারে দেব না কারণ সেটাও আগেরবার বিস্তারিত দিয়েছি। এবারে ওঠার পিছনে আসল উৎসাহ ছিল কলির কারণ গতবছর কথা ৩০০ মিটার উঠেছিল আর ও উঠতে পারেনি - এটা ওর কাছে বিশেষ দুঃখজনক ব্যাপার। এই প্রবল উৎসাহের ফলে দেখলাম আমার সাহায্য ছাড়াই পুরো রাস্তাটাই ও প্রায় একাই উঠল। কথাকলি সবচেয়ে আগে, তার পিছনে আমি আর তার কিছুটা পিছনে মোম। রাস্তাটা একবছর আগেই চেনা হয়ে গিয়েছিল, ফলে ৩০০ মিটার পর্যন্ত উঠতে আগেরবারের চেয়ে কম সময় লাগল। ৩০০ মিটার উচ্চতায় একটা চওড়া জায়গা আছে, সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছবিটবি তোলা হল।

অ্যাট দ্য সামিট !
এরপরের বাকি ১৫০ মিটার পথটা নতুন। আমার মনে হল একেবারে শেষের ১০ মিটার বাদ দিলে এই বাকি পথটা অপেক্ষাকৃত কম দুর্গম। সমস্তরকম প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে বিকেল পৌনে পাঁচটা নাগাদ আমরা ৪৫০ মিটার উঁচু শুশুনিয়া পাহাড়ের মাথায় পৌঁছলাম। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি ! স্বভাবতই আমার থেকে অনেক বেশি উৎফুল্ল কথা-কলি। গতবছর ৩০০ মিটার পর্যন্ত উঠে কথা আমাকে বেশ অবাক করে দিয়েছিল। এবারে আমার অবাক হওয়ার অবকাশ ছিল না, কিন্তু ওরা পুরোটা উঠেছে বলে আমি খুব খুশি হয়েছি। মাত্র ছ'বছর নয় মাস বয়সে এই ট্রেকিং-টা করা মোটেই সহজ নয় - সত্যি বলতে কি অত্যন্ত কঠিন (আমি নিশ্চিত আমি নিজে ওই বয়সে পারতাম না)। মোম আমাদের কিছুটা পিছনে ছিল - ইতিমধ্যে ওও পৌঁছে গেছে। আমরা এদিক ওদিক খানিকটা হাঁটাচলা করে ছবি তুলে নামার পথ ধরলাম। এই ওঠানামার কাজটা পরিশ্রমসাধ্য সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। নামার পথে দু'জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা লেবুর সরবৎ খেয়ে ক্লান্তি দূর করলাম।

সন্ধ্যেবেলা রিসর্টে
নিচে যখন নামলাম তখন প্রায় অন্ধকার নেমে এসেছে। এইসময়ে আর বিহারীনাথের দিকে যাওয়ার মানে হয় না, তাই আমরা আবার বরন্তিতে ফেরার পথ ধরলাম। রিসর্টে ফিরে সন্ধ্যের জলখাবার মুড়ি আর পিঁয়াজি দিল। সন্ধ্যের পরে এখানে আর কিছু করার নেই, তবে গরমকালের সন্ধ্যেবেলা বাগানটায় বসে থাকতে ভালোই লাগে আর আমাদের দল বড় হওয়ায় স্রেফ গল্প করেই সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। রাত দশটা নাগাদ ডিনার দিল। মেনু রুটি আর চিকেন।





পরেরদিন শনিবার ২৬শে মার্চ, ২০২২ - আমাদের অযোধ্যা যাওয়ার দিন। ব্রেকফাস্ট করে আমরা সকাল ন'টা নাগাদ বেরোলাম দু'টো গাড়ি নিয়ে। বরন্তি থেকে অযোধ্যা পাহাড়ের দূরত্ব ১১০ কিলোমিটারের মতো, যেতে ঘন্টা তিনেক লাগার কথা। এবারেও ভরসা সেই গুগ্‌ল্‌ ম্যাপ। আর সেই ম্যাপই আমাদের ডোবালো। পুরুলিয়া শহর পেরোনোর একটু পরে ম্যাপ যেখানে রাস্তা দেখালো, সেখানে আদপেই কোনও রাস্তা নেই। আরও কিছুক্ষণ ম্যাপের উপর ভরসা করে এগিয়েও যখন কোনও রাস্তার সন্ধান পাওয়া গেল না, তখন বাধ্য হয়ে স্থানীয় লোকের সাহায্য নিতে হল। তাদের কথা অনুযায়ী ওই অঞ্চল থেকে অযোধ্যা পাহাড় যাওয়ার কোনও রাস্তা নেই, আমাদের আরও অনেকটা এগিয়ে গিয়ে ঘুরে যেতে হবে। সেইমতো গিয়ে আমরা শেষপর্যন্ত যখন অযোধ্যা পাহাড়ের কাছে পৌঁছলাম, তখন দুপুর একটা বেজে গেছে।

পাখি পাহাড়
 আমাদের যাওয়ার পথে 'পাখি পাহাড়' পড়ল, সেটা দেখে নিলাম। রাস্তাটা 'মাথা ফরেস্ট'-এর মধ্যে দিয়ে আর দু'পাশের দৃশ্য খুবই সুন্দর। পুরুলিয়া জেলা পলাশ ফুলের জন্য বিখ্যাত। একেক জায়গায় রাস্তার দুদিকে পরপর বহুসংখ্যক পলাশ গাছ রয়েছে আর তাতে ফুটে রয়েছে থোকা থোকা পলাশ ফুল। এই ফুলের জৌলুস দেখে মনে হয় গাছের গায়ে বুঝি আগুন ধরেছে। বরন্তি জায়গাটা গ্রাম হওয়ায় সেখানে এই পলাশের বনের ঘনত্ব খুব বেশি। অযোধ্যা পাহাড়ের কাছেও আবার এই গাছের আধিক্য দেখা গেল।

অযোধ্যা পাহাড়ের ড্যামের সামনে দাদুর সঙ্গে নাতনীরা
অযোধ্যা পাহাড়ের কাছে পৌঁছে দেখলাম চাইলে গাড়ি নিয়ে উপরে ওঠা যায়। আমি এর আগে কখনও পাহাড়ী পথে গাড়ি চালাইনি, এটা একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। তবে জিনিসটা করতে দুর্দান্ত লাগল। আমাদের গাড়িতে সবমিলিয়ে লোকসংখ্যা ন'জন (দিদিভাই আমাদের গাড়িতে ছিল), যাকে বলে ওভারলোডেড, কিন্তু তাও ১৫০০ সিসি-র ইঞ্জিন (আর সেইসঙ্গে ড্রাইভারের দুর্দান্ত দক্ষতা !) অনায়াসে আমাদের পাহাড়ের উপরে পৌঁছে দিল। অযোধ্যা পাহাড়ের উপরে একটা জলাধার আছে, পাহাড়ের নিচ থেকে এখানে পাম্প করে জল তুলে ধরে রাখা হয়। আমরা সেই ড্যামের পাশে গাড়ি রেখে রিসর্ট থেকে নিয়ে আসা পরোটা আর ডিমের কারী দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিলাম। এখানে পাশেই নানারকম মুখোশ, ঘর সাজানোর জিনিস বিক্রি হচ্ছিল। সেখান থেকে কিছু কেনাকাটা করে দুপুর তিনটে নাগাদ আমরা নামতে শুরু করলাম।

এদিকে আমাদের গাড়ির পেট্রোল বেশ কিছুক্ষণ ধরেই তলানিতে এসে ঠেকেছে। অযোধ্যা পাহাড়ের ত্রিসীমানার মধ্যে কোনও পেট্রোল পাম্প নেই - এই প্রথমবার গুগ্‌ল্‌ ম্যাপ আর স্থানীয় লোকজনকে একটা বিষয়ে একমত হতে দেখলাম ! অযোধ্যা পাহাড়ের কাছাকাছি অনেকগুলো দেখার জায়গা আছে, কিন্তু জ্বালানী অন্বেষণের কারণে সেদিকে আর মনোযোগ দেওয়া গেল না। মোটামুটিভাবে যা জানা গেল তাতে এখানকার সবথেকে কাছের পেট্রোল পাম্পও এখান থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে। সেখানে যাওয়ার জন্য যেদিকে যেতে হয়, সেদিকে গেলে দেখার জায়গাগুলো দেখার আশা ত্যাগ করতে হবে - কিন্তু অগত্যা। আগে থেকে সুযোগমতো গাড়িতে পেট্রোল ভর্তি করে না নেওয়াটা নির্বুদ্ধিতার কাজ হয়েছে সেটা অস্বীকার করব না, কিন্তু এটাও ঠিক অযোধ্যা পাহাড় ঠিক গন্ডগ্রাম নয় - এখানে কাছাকাছির মধ্যে একটা পেট্রোল পাম্প পাওয়া যাবে না, এটা একেবারেই আমাদের ধারণার বাইরে ছিল। ত্রিশ কিলোমিটার মতো এসে বলরামপুরে পৌঁছে দু'টো গাড়িকে পেট ভর্তি করে খাওয়ানো হল।

কংসাবতীর উপরে সূর্যাস্তের কিছু আগে
বিকেল প্রায় সাড়ে চারটে বাজে, তাই আমরা ফেরার পথ ধরলাম। অযোধ্যা পাহাড়ের কাছে যে যে জায়গাগুলো আমাদের অদেখা থেকে গেল সেগুলো হল - বামনি ফল্‌স্‌, লোহারিয়া মন্দির, তুগরা ফল্‌স্‌ আর তুগরা ড্যাম, খৈরবেরা ড্যাম, মুরুগুমা ড্যাম আর দেউলঘাটা মন্দির। ফেরার পথে পুরুলিয়া শহরে ঢোকার কিছুক্ষণ আগে কংসাবতী নদীর উপরে ব্রীজ পড়ে। নদীতে সেরকম জল নেই, তবে ব্রীজের উপরে দাঁড়িয়ে সুর্যাস্তের দৃশ্য দেখতে খুব সুন্দর লাগল। রাত্রি আটটা নাগাদ আমরা রিসর্টে পৌঁছলাম। তারপর যথারীতি - মুড়ি-পিঁয়াজি, বাগানে বসে আড্ডা আর রাতে রুটি আর চিকেন কারী।

পলাশবাড়ি রিসর্টের ভিতরে
রবিবার ২৭শে মার্চ, ২০২২ - সকাল দশটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট করে আমরা বরন্তি থেকে চেক্‌আউট করে বেরিয়ে পড়লাম। আরণ্যক রিসর্টের পাশেই রয়েছে 'পলাশবাড়ি রিসর্ট' - সম্ভবতঃ বরন্তির সবথেকে বেশি বিখ্যাত রিসর্ট। এর বিশেষত্ব হল রিসর্টের কম্পাউন্ডটা বিরাট বড় আর ভিতরে ভর্তি পলাশ গাছ। রিসর্টটা আপাতত বন্ধ রয়েছে কিন্তু এর প্রধান ফটকটা খোলা। তাই আমরা ভিতরে ঢুকে দেখেটেখে নিলাম আর সেইসঙ্গে অনেক ছবিও তোলা হল।

পঞ্চকোট গড়ের ধ্বংসাবশেষের কিছু অংশ
পলাশবাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম বরন্তি লেক দেখতে। এটারও বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছি না - গতবারেই দিয়েছি। বরন্তি লেক দেখে আমরা এবার রওনা দিলাম আমাদের গন্তব্য গড় পঞ্চকোটের উদ্দেশ্যে। পথের দূরত্ব ২৩ কিলোমিটারের মতো। ১২ কিলোমিটার যাওয়ার পরে একটা জায়গা পড়ে যেটার নাম পঞ্চকোট গড় - যার থেকেই এই জায়গার নাম। এটা একটা গড়ের ধ্বংসাবশেষ, সত্যি বলতে কি অবশিষ্ট আর বিশেষ কিছুই নেই। এর লাগোয়া একটা মন্দির আছে, নাম পঞ্চরত্ন মন্দির। জায়গাটায় মোটামুটি ভীড় হয়েছে, কিন্তু দোকানপাটও আছে। আমরা কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে রওনা দিলাম গড় পঞ্চকোটে আমাদের থাকার জায়গার উদ্দেশ্যে যেটা এখান থেকে আরও ১১ কিলোমিটারের মতো।

গড় পঞ্চকোট প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্র
পঞ্চকোট গড়টা প্রকৃতপক্ষে পঞ্চকোট পাহাড়ের গায়ে আর এই পাহাড়ের অন্যদিকেই ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্টের প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্র যেখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আমরা দুপুর সওয়া একটা নাগাদ এখানে পৌঁছলাম। জায়গাটা দুর্দান্ত ! একেবারে পাহাড়ের পায়ের কাছে এই পুরো রিসর্টটা তৈরি করা হয়েছে। পুরোটা গাছপালা ঘেরা একটা জায়গা আর তার মাঝে মাঝে একেকটা আলাদা আলাদা বিল্ডিং-এ কয়েকটা করে ঘর। মোটামুটি মাঝামাঝি জায়গায় একটা গোলমতো হলঘর, এটাই ডাইনিং রুম। জায়গাটা সঙ্গে মুকুটমনিপুরের সোনাঝুরি রিসর্টের যথেষ্ট মিল আছে কারণ ওটাও ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্টের তৈরি। এখানে আগে থেকেই আমাদের দুপুরের খাবারের অর্ডার দেওয়া ছিল। ঘরে ঢুকে চেক্‌ইন করে চানটান করে আমরা খেতে চলে গেলাম। ভাত মাছ ইত্যাদি নিয়ে খরচ হল ১৮০০/- টাকা।

সন্ধ্যেবেলা - রিসর্টের বাগানে
দিদিভাইদের ঘোরা এইপর্যন্তই তাই ওরা এখান থেকে বাড়ি ফিরে যাবে। আমরা গড় পঞ্চকোটে দু'রাত্রি থেকে তারপর ফিরব। সেইমতো দুপুরের লাঞ্চের পরে দিদিভাইরা ওদের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল আর আমরা হোটেলের ঘরে ঢুকে বসে রইলাম। আমাদের আটজনের জন্য মোট তিনটে ঘর নেওয়া ছিল। গড় পঞ্চকোটের সব ঘরেই এ.সি. আছে আর মার্চ মাসের গরমে এখানে দিনের বেলায় এ.সি. ছাড়া থাকা বেশ কষ্টকর। বিকেলেও আমাদের কিছু করার ছিল না, তাই ঘরে বসেই গল্প করে চা আর সঙ্গে আনা খাবারদাবার খেয়ে কাটিয়ে দিলাম। রাতে ডাইনিং রুমে গিয়ে ডিনার খেয়ে নিলাম। ভাত ডাল রুটি চিকেন নিয়ে খরচ হল ৭৩০/- টাকা।

পরেরদিন সোমবার ২৮শে মার্চ, ২০২২ - গড় পঞ্চকোট সাইট সিয়িং-এর দিন। গড় পঞ্চকোটে ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি। মেনু লুচি তরকারী অথবা পাঁউরুটি টোস্ট আর সেইসঙ্গে একটা ডিম (ভাজা বা সিদ্ধ) আর একটা আপেল বা কলা। ব্রেকফাস্ট করে সকাল সাড়ে দশটার সময়ে আমরা গাড়ি নিয়ে বেরোলাম সাইট সিয়িং-এ।

পাঞ্চেৎ ড্যাম
পাঞ্চেৎ ড্যাম - গড় পঞ্চকোট প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্র থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে আমাদের প্রথম গন্তব্য পাঞ্চেৎ ড্যাম। দামোদর নদের জল ধরে রেখে এই জলাধার বা ড্যাম তৈরি হয়েছে। এর ভৌগলিক বিশেষত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত লিখব না, শুধু যেটা দেখলাম সেটাই লিখছি। ড্যামের পুরো রাস্তাটা তিন কিলোমটারের মতো আর পুরো রাস্তাটাই মাখনের মতো মসৃণ। যাওয়ার পথে বাঁদিকে ড্যামটা পড়ে। রাস্তায় চাইলে গাড়ি দাঁড় করানোই যায়, কিন্তু সেটা করে আলাদা করে বিশেষ কিছু দেখা যাবে না। বরং চলন্ত গাড়ি থেকে ক্রমপরিবর্তনশীল দৃশ্যই বোধহয় বেশি উপভোগ্য। মাঝে ডানদিকে একটা রাস্তা দিয়ে চাইলে ড্যামের একেবারে নিচ পর্যন্ত নেমে যাওয়া যায়, এখানে ডিভিসি-এর একটা অফিস আর কোয়ার্টার্স আছে। স্বভাবতই তার ভিতরে বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। ড্যামের একটা জায়গায় ব্যারেজ আর লক্‌গেট আছে - এখান দিয়েই দামোদর নদের জল ছাড়া হয়। অন্যভাবে বলতে গেলে পশ্চিমবঙ্গে দামোদর নদের প্রবেশদ্বার এটাই। এর উপরের ব্রীজটা পেরোতেই আমরা ঢুকে পড়লাম ঝাড়খন্ড রাজ্যে।

কথা-কলির সঙ্গে মোবারক আনসারি
মোবারক স্নেক সেভার পার্ক - পাঞ্চেৎ ড্যাম থেকে ২ কিলোমিটার দূরে মোবারক স্নেক সেভার পার্ক। জায়গাটা ঝাড়খন্ড রাজ্যে। গুগ্‌ল্‌ ম্যাপে সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে অথবা এখানকার স্থানীয় লোককে জিজ্ঞেস করেও পৌঁছনো যেতে পারে। এটাকে একটা সুন্দরভাবে সাজানো গোছানো পার্ক ভাবলে ভুল ভাবা হবে কারণ এটা প্রকৃতপক্ষে মোবারক আনসারি নামক এক ব্যক্তির বাড়ি এবং সংলগ্ন জমিতে উনি সর্পোদ্যান করেছেন। ইউটিউবের দৌলতে মোবারক আনসারি এখন অনেকের কাছেই পরিচিত নাম কিন্তু যারা জানে না তাদের জন্য বলছি ইনি একজন সর্পবিশেষজ্ঞ এবং সর্পরক্ষক। উনি পেশায় একজন বাইক মেকানিক আর সেইসঙ্গে সাপের ব্যাপারে ওনার বিস্তর জ্ঞান ও পড়াশোনা। কোথাও সাপ বেরোলে উনি নিজে সেখানে চলে যান সাপ ধরতে এবং তাদের যথার্থ রক্ষণাবেক্ষণ করতে। এর জন্য উনি কোনও সরকারি সাহায্যও পাননা বা কারুর কাছ থেকে কোনও আর্থিক সহায়তাও নেন না। ওনার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে ভিউয়ারের সংখ্যা কুড়ি লক্ষের বেশি এবং ইউটিউবে উনি সাপসংক্রান্ত প্রচুর ভিডিও নিয়মিত পোস্ট করেন। কলকাতার কাছে মধ্যমগ্রামের বাদুতে দীপক মিত্রের যে বিখ্যাত সর্পোদ্যানটা আছে, এটা অনেকটা সেইরকম। মোবারক আনসারি দীপক মিত্রের কাছ থেকে সাপসম্পর্কিত অনেক কিছু শিখেছেন।

গোখরো সাপ
স্নেক সেভার পার্কের এন্ট্রি ফি মাথাপিছু ২০/- টাকা। আমরা টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকলাম। মোবারক আনসারি নিজেই পুরো পার্কটা আমাদের ঘুরে দেখালেন। আলাদা আলাদা খাঁচা বা কাচের বাক্সে আলাদা আলাদা সাপ রাখা রয়েছে। প্রত্যেকটা খাঁচার নিচে সেই সাপের হিন্দী, বাংলা, ইংরিজী ও ল্যাটিন (বিজ্ঞানসম্মত) নাম, তার বিষ আছে কিনা আর সে কি খায় এইগুলো লেখা আছে। ওনার সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে গোখরো, কাল নাগিনী, লাউডগা, বালিবোড়া, তুতুব, চন্দ্রবোড়া, দাঁড়াস, শাঁখামোতি, অজগর ইত্যাদি। সাপগুলো দেখাতে দেখাতে উনি
অমৃতার সাপের গায়ে হাত দেওয়া

আমাদের প্রচুর তথ্য দিচ্ছিলেন যেগুলো আমার খুবই ভালো লাগছিল। আমি এমনিতে সাপ জিনিসটাকে একেবারেই পছন্দ করি না, কিন্তু এই জাতীয় তথ্যগুলো জানতে আমার বেশ ভালো লাগে (মধ্যমগ্রামের দীপক মিত্রের সর্পোদ্যানে গিয়েও এইরকমই ভালো লেগেছিল)। ওনার কাছে যা সাপ আছে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ সাপেরই বিষ নেই। বাস্তবেও তাইই হয় - প্রকৃতিতে পাওয়া বেশিরভাগ সাপেরই বিষ থাকে না। মোবারক আনসারি বললেন - এটা আসলে কিন্তু ভুল কথা। যেহেতু সাপের দাঁত নেই, তাই ওরা খাবার গিলে খায়
আর সেই খাবার হজম করার জন্য ওদের বিষ দরকার হয়। তাই বিষ সব সাপেরই আছে। কিন্তু সব বিষ মানুষের জন্য ক্ষতিকারক নয়। যেসব সাপের বিষে মানুষের ক্ষতি হয়, শুধুমাত্র সেইসব সাপকেই বিষধর সাপ বলে ধরা হয়। পৃথিবীতে যত সাপ পাওয়া যায় তার মধ্যে মাত্র ১০% সাপের বিষ আছে আর ভারতবর্ষে এটা ১৫% এর মতো। ভদ্রলোক আমাদের দেখানোর জন্য প্রায় প্রত্যেকটা সাপকেই একবার করে খাঁচা বা বাক্সের বাইরে নিয়ে আসছিলেন।
মোবারক আনসারির হাতে কাঁকড়া বিছে

আমাদের হাত দেওয়ার জন্য বলছিলেনও যদিও এ'ব্যাপারে আমার শখ বা সাহস কোনওটাই নেই। অমৃতার সাপে ভয়টয় নেই, ও একবার একটা সাপের গায়ে হাত দিল (আমার এই দৃশ্য দেখেই গা শিরশির করছিল !)। সাপ ছাড়াও ভদ্রলোকের একটা কাঁকড়া বিছে আছে, সেটাও উনি হাতে নিয়ে আমাদের দেখালেন। তোপ্‌সে দেখে যা, এই জিনিস এত কাছের থেকে দেখার আর সুযোগ পাবি না। ... বাচ্চা বা বুড়ো হলে নির্ঘাৎ মৃত্যু, আমরা আধমরা ... (মনে পড়ছে ? এটা সেই জিনিসই !)

মোবারক আনসারির কাছ থেকে আমরা সাপ সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে পেরেছি, কিন্তু সবকিছু এখানে লেখা সম্ভব নয়। আমার ব্লগের পাঠকদের মধ্যে কারুর যদি কোনও কারণে ওই অঞ্চলে যাওয়ার কোনও পরিকল্পনা থাকে, তাহলে তাকে অবশ্যই বলব একবার এই স্নেক সেভার পার্কটা ঘুরে আসতে।

কল্যাণেশ্বরী মন্দির - মোবারক স্নেক পার্ক থেকে বেরিয়ে আরও ১৭ কিলোমিটার যাওয়ার পরে কল্যাণেশ্বরী মন্দির। মাঝখানে একটা জায়গায় বরাকর নদ পেরোতে হয়, আর সেটা পেরিয়ে আমরা আবার পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়লাম। কল্যাণেশ্বরী মন্দিরটা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে পড়ে। মন্দিরটা বিশাল কিছু বড় নয়, তবে এর বেশ নাম আছে। আমি আর ভিতরে ঢুকিনি, গাড়ি নিয়ে বাইরেই অপেক্ষা করছিলাম।

মাইথন ড্যাম
মাইথন ড্যাম - কল্যাণেশ্বরী মন্দির থেকে আরও ৩ কিলোমিটার দূরে মাইথন ড্যাম। এই ড্যামের পাশের রাস্তাটা আবার ঝাড়খন্ডের মধ্যে পড়ে। সীমান্তবর্তী এলাকা বলেই বোধহয় একবার আমাদের গাড়িটার চেকিং হল। শুধু তাই নই, আমাদের নামধাম, কোথা থেকে এসেছি, কী দেখব - এই সবই সীমান্তরক্ষীরা খাতায় টুকে নিল। তারপর আমরা গেলাম মাইথন ড্যামের দিকে। মাইথন ড্যামটা পাঞ্চেৎ ড্যামের থেকে বেশ কিছুটা বড় আর এর পাশের রাস্তাটাও অনেকটা দীর্ঘ। এবারে যাওয়ার পথে ড্যামটা পড়ে ডানদিকে আর দৃশ্য অসাধারণ ! যেমন দামোদর নদের জল ধরে রেখে পাঞ্চেৎ ড্যাম তৈরি হয়েছে, সেরকমই মাইথন ড্যাম তৈরি হয়েছে বরাকর নদের জল ধরে রেখে। আমরা ড্যামের পাশের রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুটা গিয়ে জলের পাশে একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। জায়গাটা দারুণ - গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ ভালো লাগে। ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছিল আর জলের পাশে হওয়াতে হাওয়াটা বিশেষ মনোরম। আমরা এখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।

দুপুর দু'টো বাজে তাই কল্যাণেশ্বরী মন্দিরের পাশের একটা ভাতের হোটেল থেকে ভাত, মাছ, চিকেন ইত্যাদি খাওয়া হল। খরচ হল ৭৮০/- টাকা। আমাদের সাইট সিয়িং শেষ, তাই লাঞ্চ করে রওনা দিলাম গড় পঞ্চকোটের দিকে। হোটেলে ফিরতে ফিরতে বিকেল সাড় চারটে হল।

সন্ধ্যেবেলা কিছুই করার নেই, তাই আগের দিনের মতোই সন্ধ্যেটা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করে কাটানো হল। রাতে ডিনারে আজ চাউমিন, ফ্রাইড রাইস, চিলি চিকেন খাওয়া হল। খরচ হল ৯৮০/- টাকা।

মঙ্গলবার ২৯শে মার্চ, ২০২২ - আমাদের বাড়ি ফেরার দিন। নিজেদের গাড়ি থাকার একটা মস্ত সুবিধে - ট্রেন ধরার তাড়া নেই। কোনও জায়গায় যাওয়ার সময়ে ট্রেন ধরার তাড়া থাকলে অসুবিধে হয় না, কারণ একে তো সেটা নিজের শহর আর দ্বিতীয়তঃ যাওয়ার একটা স্বাভাবিক উত্তেজনা কাজ করে। ফলে সবকিছুই বেশ ঝট্প‌ট্‌ হয়ে যায়। ফেরার সময়ে এই দুটোর একটাও নেই (না, নিজের বাড়ি ফেরার সময়ে আমি অন্ততঃ উত্তেজনা অনুভব করি না)। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ আমরা ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের ভ্রমণের একটা ছোট্ট অংশ এখনও বাকি আছে, আপাতত সেটাই গন্তব্য।

ঘন্টাখানেক লাগল আসানসোলে পৌঁছতে। আমাদের গন্তব্য 'সুশান্ত রায়ের মোমের মিউজিয়াম ও শীশমহল'। জায়গাটা আসানসোল শহরের বেশ ভিতর দিকে আর জায়গায় জায়গায় রাস্তা বেশ সরু। ফলে ম্যাপ দেখে আমরা যখন মিউজিয়ামে পৌঁছলাম, তখন দুপুর বারোটা বেজে গেছে।

দ্য লেজেন্ড - বাই অ্যানাদার লেজেন্ড !
সুশান্ত রায় ওয়্যাক্স মিউজিয়াম আর শীশমহল আসলে একই জায়গায় - একটা বাড়ির একতলায় মোমের মিউজিয়াম আর দোতলায় শীশমহল। ঢোকার টিকিট বড়দের মাথাপিছু ১০০/- টাকা আর ছোটদের মাথাপিছু ৫০/- টাকা। একতলা আর দোতলা পুরোটা ঘুরে দেখতে মিনিট কুড়ির বেশি লাগে না। একতলায় যেসব বিখ্যাত মানুষের মূর্তি রয়েছে তাদের মধ্যে - অমিতাভ বচ্চন (একটা কেবিসি-র হট সিট্‌-এ বসে আর অন্য একটা দাঁড়িয়ে), উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, ছোটা ভীম আর তার দলবল, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ চক্রবর্তী, ভিরাট কোহলি, উৎপল দত্ত, সুশান্ত সিং রাজপুত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতি বসু, রোনাল্ডিন্‌হো, শৈলেন মান্নার নাম উল্লেখযোগ্য।

শীশমহলে সিংহাসনে রাজাধিরাজ !
দোতলায় শীশমহলটা আমার মোমের মিউজিয়ামের থেকেও বেশি সুন্দর লাগল। অজস্র ছোটো ছোটো  নানান সাইজের, নানান আকৃতির, নানান রঙের কাচের টুকরো দিয়ে একটা রাজসভার মতো করা হয়েছে। ঘরের মেঝে, দেওয়াল, ছাদ, থাম সবকিছুই কাচের তৈরি। মেঝেটা স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত মসৃণ তবে পা-হড়কে পড়ার সম্ভাবনা নেই। ঘরের একদিকের দেওয়ালে পাশে একটা কাঠের কারুকার্য করা চেয়ার - রাজসিংহাসন। এটা প্রকৃতপক্ষে দর্শনার্থীদের বসে ছবি তোলার জন্যই রাখা রয়েছে।

দেখা শেষ হলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম মিউজিয়াম থেকে। আমাদের যা যা দর্শনীয় ছিল, সবই দেখা হয়ে গেছে, এবার বাড়ি ফেরার পালা। এন এইচ ১৯ ধরে আমরা ফেরার পথে দুপুর আড়াইটে নাগাদ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে লাঞ্চ করে নিলাম। তারপরে আবার রওনা দিলাম। বিকেল সাড়ে পাঁচটার একটু পরে বাড়ি !

সারসংক্ষেপঃ

(এখানে বরন্তির সম্পর্কে আর আলাদা করে লিখব না। তার জন্য ব্লগের গতবারের বরন্তি ভ্রমণের সারসংক্ষেপটা পড়লেই সব জানা যাবে।)

১. কলকাতা থেকে ২-৩ দিনের ঘোরার জন্য পুরুলিয়ার গড় পঞ্চকোট একটা খুব সুন্দর জায়গা। গরমকালটা বাদ দিয়ে বছরের যেকোনও সময়ে এখানে যাওয়া যেতে পারে।

২. কলকাতা থেকে গড় পঞ্চকোটের দূরত্ব ২৫০ কিলোমিটারের মতো। ১৯ নং জাতীয় সড়ক নিয়ে বর্ধমান-দুর্গাপুর-আসানসোল হয়ে গড় পঞ্চকোটে পৌঁছতে হয়।

৩. হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে আসানসোলগামী যেকোনও ট্রেনে গড় পঞ্চকোট যাওয়া যেতে পারে। আসানসোল, কুমারডুবি, বরাকর বা আদ্রা স্টেশনে নেমে সেখান থেকে গাড়িতে গড় পঞ্চকোট যেতে হয়।

৪. গড় পঞ্চকোটে থাকার একাধিক জায়গা আছে তার মধ্যে ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্টের প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্র উল্লেখযোগ্য। এদের ওয়েবসাইট https://wbfdc.net/ থেকে সরাসরি বুকিং করা যায় অথবা এদের সল্টলেকের অফিস থেকেও বুকিং করা যায়। এদের যোগাযোগের নম্বর 7604044479.

৫. গড় পঞ্চকোটে বেশ কিছু হোটেল বা রিসর্ট থাকলেও জায়গাটা খুব একটা বড় নয়, খাওয়ার জন্য হোটেলই প্রধান ভরসা। প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্রের খাবার দারুণ কিছু না হলেও মোটের উপর মন্দ নয়।

৬. গড় পঞ্চকোটে দেখার মধ্যে পঞ্চকোট গড়ের ধ্বংসাবশেষ আছে, যদিও সেটা খুব কিছু আকর্ষক জায়গা নয়। এর লাগোয়া একটা পঞ্চরত্ন মন্দির আছে, কিন্তু সেটাও বিশেষ কিছু দ্রষ্টব্য নয়।

৭. গড় পঞ্চকোট থেকে সাইট সিয়িং-এর জন্য গাড়ি নিয়ে পাঞ্চেৎ ও মাইথন ড্যাম, মোবারক স্নেক সেভার পার্ক আর কল্যাণেশ্বরী মন্দির যাওয়া যেতে পারে। এদের মধ্যে মোবারক স্নেক সেভার পার্কটা অবশ্য দ্রষ্টব্য।

৮. গড় পঞ্চকোটে সন্ধ্যের পর থেকে কিছু করার নেই, তাই হোটেলে নিজের ঘরেই বসে থাকতে হয়। প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্রের ভিতরটা খুব সুন্দর তাই চাইলে এখানে ঘোরাঘুরি করা যেতে পারে।

৯. যাতায়াতের পথে আসানসোল গেলে সেখানে সুশান্ত রায়ের মোমের মিউজিয়াম ও শীশমহলটা অবশ্যই দেখে আসা উচিৎ। এই দুটো একই বাড়িতে। জায়গাটার দূরত্ব আসানসোল স্টেশন থেকে ২.৫ কিলোমিটারের মতো।

উপসংহারঃ

পঞ্চকোট পাহাড়
বরন্তি বা গড় পঞ্চকোট - এই দুটো জায়গাই দুদিন করে থাকার জন্য দারুণ অপশন। যদি এই দুটো জায়গাতেই যাওয়ার পরিকল্পনা থাকে, তাহলে পুরো ঘোরাটা 4N/5D হিসেবে হওয়া উচিৎ - তার কমে নৈব নৈব চ। কারণ আমার মনে হয় সাইট সিয়িং-এর ব্যাপারগুলো না ধরলেও এই জায়গাগুলোর প্রধান আকর্ষণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আমরা যারা শহরের কোলাহলের মধ্যে থাকি তাদের কাছে এই শান্ত, নিরিবিলি বৈচিত্রহীন জায়গাগুলো বোধহয় ভীষণরকমভাবে টানে। এখানে সারাক্ষণ গাড়ির হর্ণ নেই, বাতাসভরা কার্বন মনোক্সাইড নেই, রাতের ঝলমলে বৈদ্যুতিক আলো দিয়ে আকাশের মিট্‌মিটে তারার আলোকে ঢেকে দেওয়া নেই, সারাক্ষণ ফেরিওয়ালার হাঁকডাক নেই, কৌতুহলী প্রতিবেশির অন্যের বাড়ির অন্দরমহলে উঁকি মারা নেই, গোমড়া মুখ করে যন্ত্রচালিত হয়ে যন্ত্রের পিছনে যন্ত্রের মতো ছুটে চলা নেই। "ক্ষেতে ফসল আছে, গাছে ফল আছে, ফুল আছে, পাখি আছে, দেশে শান্তি আছে, সুখ আছে, হাসি আছে ..." (এটা গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবি থেকে দিলাম, সাহিত্য বা ভাষার উপর এত দখল আমার নিজের নেই !)। এইগুলোই পুরুলিয়া জেলার নিজস্বতা। অযোধ্যা, বরন্তি, গড় পঞ্চকোট যেখানেই যাওয়া হোক, প্রধান প্রাপ্তি এই নিজস্বতাই !

বরন্তি ও গড় পঞ্চকোট ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

No comments:

Post a Comment