আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Wednesday, June 20, 2018

টাকি ভ্রমণ

মাদের ছোটবেলায় একধরনের অ্যাডভেঞ্চার ছিল - কোনও একটা অচেনা অজানা রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুটা গেলে কোথায় পৌঁছনো যায় সেটা পরীক্ষা করে দেখা । ছোটবেলায় আমাদের পরিধিটা থাকে ছোট, তাই খুব বেশি দূরে গিয়ে পড়ার সৌভাগ্য সেভাবে হয় না (সবথেকে দূরে যাওয়ার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটা হল ই এম বাইপাসটা কোথায় শেষ হয় সেটা দেখার জন্য সুভাষ সরোবর থেকে কামালগাজী পর্যন্ত্য বাইপাস ধরে সাইকেল করে চলে গেছিলাম । ব্যস, ঐ পর্যন্ত্যই !) বড় হওয়ার পরে এখন পরিধিটা বেড়েছে, সাইকেল ছেড়ে গাড়ি চালাই কিন্তু সেই 'অচেনা রাস্তা ধরে এগিয়ে যাওয়ার' অ্যাডভেঞ্চারের নেশাটা চলে গেছে । আর তার প্রধান কারণ হল গুগ্‌ল্‌ ম্যাপ । কোনও রাস্তা কোথায় যাচ্ছে, সেই রাস্তা ধরে কতক্ষণ বা কতদূর গেলে কোথায় পোঁছনো যায় এগুলো জানার জন্য এখন আর কোথাও যেতে হয় না, বাড়িতে বসে গুগ্‌লকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায় । তাই আমাদের তথাকথিত অচেনা রাস্তা বাসন্তী হাইওয়ে ধরে যখন এগিয়ে যাওয়ার কথা মাথায় এল, তখনই জানতাম আমাদের গন্তব্য টাকি - দূরত্ব ৬৫ কিলোমিটার (পরমা আইল্যান্ড থেকে) আর যেতে ঘন্টা দুয়েক ।

বসিরহাট-মালঞ্চ রোড
বুধবার ২০শে জুন, ২০১৮ সকাল দশটার একটু পরে আমি আর অমৃতা গাড়ি নিয়ে বেরোলাম । শুরুর দিকের কিছুটা রাস্তা জানা - আমাদের বাড়ি থেকে বাইপাস - পরমা আইল্যান্ড - সেখান থেকে বাসন্তী হাইওয়ে । এই বাসন্তী হাইওয়েটা কিন্তু 'হাইওয়ে' বলতে আমরা সাধারণতঃ যা বুঝি তার থেকে অনেকটাই আলাদা । এখানে রাস্তায় কোনও রোড ডিভাইডার নেই আর কিছুদূর ছাড়া ছাড়াই একটা করে জনপদ । সেখানে দোকানপাট বাস লরি অটো রিক্সা ভ্যান সাইকেল লোকজন সবমিলিয়ে এমন একটা অবস্থা যে গাড়ির স্পীড কুড়ি কিলোমিটারের বেশি তোলা যায় না । তবে ঘন্টা দেড়েক চলার পরে একটা জায়গা আসে যেখান থেকে পরবর্তী রাস্তাটা বেশ সুন্দর । এই জায়গাটার নাম 'মালঞ্চ' । এখান থেকে বাসন্তী হাইওয়ে ছেড়ে আমরা বসিরহাট-মালঞ্চ রোড
বৃষ্টির বেগ কমে আসার পর
ধরলাম । কিছুক্ষণ ধরেই আকাশে মেঘ করেছিল, এখন প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হল । সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা ! দু'পাশে ধানক্ষেত, পুকুর, জলাশয় আর তার মাঝখানের রাস্তা দিয়ে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে আমরা গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চলেছি । বৃষ্টির জন্য গাড়ির স্পীড চল্লিশের বেশি তোলা যাচ্ছে না । উইন্ডস্ক্রীনের ওয়াইপার সর্বোচ্চ গতিতে যাতায়াত করে সামনেটা দৃশ্যমান করার চেষ্টা করছে । তবে বেশিক্ষণ এইভাবে চলল না । মিনিট কুড়ি চলার পর বৃষ্টি একটু কমল আর একেবারে কমতে কমতে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্য - টাকি ।

এখানে জানিয়ে রাখি টাকি জায়গাটার প্রতি আমার ব্যক্তিগতভাবে একটা বিশেষ শ্রদ্ধার জায়গা আছে । আমি টাকী হাউস (বয়েজ) এর ছাত্র আর শুনেছি এই টাকির এক জমিদার আমাদের আর টাকি গার্লস স্কুলের জমিটা স্কুল তৈরির জন্য দান করেছিলেন । সেই জমিদারমশাই এর বাড়ি কোথায় জানিনা, তাঁর বংশধররা কেউ আছেন কিনা তাও জানি না । কিন্তু জানি তাঁর দান করা জমিটা রয়ে গেছে আর সেই উর্বর জমিতে প্রতি বছর তৈরি হচ্ছে আমাদের মতো 'উৎকৃষ্ট ফসল' ! (এই 'উৎকৃষ্ট ফসল' কথাটা কিন্তু আত্মশ্লাঘা নিয়ে লিখলাম, ব্যঙ্গ করে নয়)

ইচ্ছামতীর তীরে বাঁধানো বসার জায়গা
টাকিতে আমাদের বিশেষ কোনও জায়গায় যাওয়ার ছিল না, তাই সোজা গিয়ে হাজির হলাম ইচ্ছামতী নদীর ধারে । এখানে নদীর ধারে পিকনিক স্পট আছে, তাই গাড়ি পার্কিং-এর জায়গাও রয়েছে । আমরা গাড়ি পার্ক করে নদীর ধারে গেলাম । এখানে নদীর পাড়ে দিব্যি বাঁধানো ছাউনি দেওয়া বসার জায়গা রয়েছে । আমরা সেখানে কিছুক্ষণ বসে ছবিটবি তুললাম । ইচ্ছামতী নদী হল পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষ আর বাংলাদেশের সীমানা । নদীর ওপারে বাংলাদেশ । নদীর মাঝবরাবর জলের ওপর একটা দড়ি টাঙানো রয়েছে, বোধহয় সেটা দুই দেশের সীমান্ত । নদী
বসার জায়গায়
বেশ চওড়া, ওপারে গাছপালা দেখা যাচ্ছে । এর আগে শিলং ভ্রমণের সময়ে মাও ট্রপ থেকে বাংলাদেশ দেখেছিলাম কিন্তু তার থেকে এটা ঢের বেশি কাছে । আমরা নদীর এ'পারে দাঁড়িয়ে আছি, ওপারে গাছপালার পিছনে - বাংলাদেশ । 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' (এটা এমনি লিখলাম, অতকিছুও ইমোশনাল হয়ে পড়িনি !) (এই অংশটা শিলং এর পোস্ট থেকেই কপি পেস্ট করলাম )

আমরা নদীর ধারের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম । এই অঞ্চলে কয়েকটা দোকান আছে আর সেইসঙ্গে কিছু সাধারণ ভাতের হোটেলও রয়েছে । দিনটা বুধবার আর কোনও ছুটির দিনও নয় তাই স্বাভাবিকভাবেই এখানে ট্যুরিস্টের কোনও ভিড় নেই । দুপুর একটা বাজে, তাই একটা হোটেলে গিয়ে ভাতের কথা জিজ্ঞেস করাতে জানা গেল এখানে শুধুমাত্র বোর্ডারদের জন্য রান্না হয় । আমরা চাইলেই খাবার পাওয়া যাবে না, খেতে চাইলে খাবারের টাকা আগে থেকে দিয়ে একঘন্টা পরে আসতে হবে । সেই সময়ের মধ্যে খাবার রেডি হয়ে যাবে । আমরা ভাত, ডাল, আলুভাজা ইত্যাদি আর ভেটকি মাছের ঝাল অর্ডার দিলাম । দাম নিল মাথাপিছু ১৫০/- টাকা ।

ইচ্ছামতীর তীরে
হাতে ঘন্টাখানেক সময় আছে, তাই আমরা হেঁটে কাছাকাছি ঘুরতে গেলাম । এখানে যে অনেক কিছু দেখার আছে তা নয় তবে নদীর ধার ধরে হাঁটতে বেশ ভালো লাগে । আর মেঘলা আবহাওয়া থাকায় গরম সেরকম লাগছিল না । বেশ জোরে হাওয়া দিচ্ছিল যেটায় আরামই লাগছিল । আমরা নদীকে বাঁদিকে রেখে কিছুদূর হাঁটলাম । সেখানে একটা অনেক পুরনো ভাঙ্গা বাড়ি দেখা গেল যেটা দেখে বোঝাই যায় এটা অন্ততঃ দেড়শ বছরের পুরনো । এছাড়া কিছু গ্রাম্য পাকা বাড়ি দেখা গেল ।

হাঁটাহাঁটির পথে
এরপর আমরা বিপরীত দিকে হেঁটে কিছুদূর গেলাম । হেঁটে খুব বেশি দূর যাওয়া সম্ভব নয় । আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে ঠিকই কিন্তু এই রাস্তাটা গাড়ি চলার পক্ষে একেবারেই চওড়া নয় । এখানে সাইকেল ভ্যান চলে যারা লোক্যাল সাইট সিয়িং করার জন্য বলে কিন্তু আমরা জানি এখানে দেখার সেরকম কিছু নেই যার জন্য এদের সঙ্গে যাওয়ার কোনও মানে হয় । কিছুদূর গিয়ে একটা মিলিটারি ওয়াচ্‌ টাওয়ার দেখতে পেলাম । কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আমাদের খাবার হোটেলে ফিরে এলাম ।







দোতলায় খাবার ঘরে বসার পর আমাদের খাবার দিল । এখানকার রান্না বেশ ভালো - বেশ তৃপ্তি করে খাওয়া গেল । খাবার পরে আর কিছু করার নেই, তাই আমরা গাড়িতে এসে কিছুক্ষণ দিবানিদ্রা দিলাম । তারপর ফেরার পথ ধরলাম ।

ফেরার সময়ে আবার একদফা বৃষ্টি হল যদিও সেটা খুব একটা জোরে নয় । সন্ধ্যে ছ'টার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে গেলাম । ভ্রমণ শেষ !

সারসংক্ষেপ ঃ

১. কলকাতা থেকে পূর্বদিকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে ভারত-বাংলাদেশ সীমানায় ইচ্ছামতী নদীর তীরে টাকি শহর । ডে-আউট ট্রিপে বা ওয়ান নাইট স্টে করার জন্য এটা বেশ সুন্দর একটা জায়গা ।
২. নিজেদের গাড়ি অথবা বাসে করেও কলকাতা থেকে টাকি যাওয়া যায় । এছাড়া শিয়ালদহ থেকে হাসনাবাদ লোক্যালে চড়ে টাকি রোড স্টেশনে নেমেও যাওয়া যায় । ট্রেনে যেতে আড়াই ঘন্টা মতো লাগে ।
৩. এখানে থাকার জন্য কয়েকটা হোটেল আছে । এখানকার সিজন টাইম হল দুর্গাপুজোর দশমীর সময়, তাই সেই সময়টা বাদ দিলে অন্যান্য সময়ে হোটেলে ঘর পাওয়া কঠিন নয় ।
৪. টাকিতে প্রধান দেখার জায়গা হল ইচ্ছামতী নদীর ধার । এখানে বসার সুবন্দোবস্ত আছে ।
৫. ইচ্ছামতী নদীর ধার দিয়ে হেঁটে বা ভ্যানে করে বা বাইক নিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত্য যাওয়া যায় । তবে এই রাস্তা গাড়ি চলাচলের উপযোগী চওড়া নয় ।
৬. নদীর ধারের এই এলাকায় কিছু দোকানপাট থাকলেও সেগুলোয় গেলেই খাবার পাওয়া যায় না । তাই ডে-আউটের পরিকল্পনা থাকলে আগেই গিয়ে দোকানে খাবারের অর্ডার দিয়ে দিতে হবে ।

উপসংহার ঃ

ইচ্ছামতীর তীরে - টাকি
কলকাতা থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে ইচ্ছামতী নদীর তীরে টাকি শহর । ডে-আউট বা একরাত্রি যাপনের জন্য বিশেষ উপযোগী । টাকির একটা বিশেষ আকর্ষণ হল দুর্গাপুজোর দশমীর দিনের বিসর্জন । দু'টো নৌকোর ওপর একটা কাঠের পাটাতন আড়াআড়িভাবে রেখে তার উপর ঠাকুর বসিয়ে মাঝনদীতে নিয়ে গিয়ে দু'টো নৌকো দু'দিকে সরিয়ে দিয়ে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়ার এই প্রাচীন পদ্ধতি অনুসরণ করে এখানে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় । ইচ্ছামতী নদীর দুই পারের দুই বাংলার শত শত প্রতিমা এইভাবে বিসর্জন দেওয়া হয় আর তা দেখতে আসে হাজার হাজার মানুষ । আমার নিজের ব্যক্তিগতভাবে এই অভিজ্ঞতা না থাকলেও শুনেছি এ এক অনন্য সাধারণ দৃশ্য । টাকিতে এমনিতে দেখার বিশেষ কিছু না থাকলেও এর সৌন্দর্য্যের মধ্যে একটা আকর্ষণ আছে । শহরের রোজনামচার মধ্যে থেকে আমাদের মনের যে সূক্ষ্ম দিকগুলো ক্রমশঃ ভোঁতা হয়ে যায়, সেগুলোকে শান দিয়ে নেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে এইধরনের ট্রিপের প্রয়োজন । কোনও চোখ ঝলসানো দেখার জায়গায় ঘোরাঘুরি করা নয়, শান্ত, নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে শরীর আর মনকে বিশ্রাম দেওয়াই এই ভ্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য । আর সেই বিশ্রাম যদি হয় অসীম জলরাশির সামনে তাহলে তো আরও ভাল । এখানে রাতে থাকলে ভোরবেলা অনবদ্য সূর্য্যোদয় দেখার সুযোগ মিলতে পারে । তাই যারা যাব যাব করছে কিন্তু জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না, তাদের জন্য এই টাকি ভ্রমণ !

টাকি ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

No comments:

Post a Comment