আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Friday, May 18, 2018

কালনা ভ্রমণ

মরা যেখানে থাকি, খুঁজে দেখলে তার চারপাশেই অনেক মণিমুক্তোর সন্ধান পাওয়া যায় - এ'কথা হয়তো আগেও কখনও লিখেছি । এই মণিমুক্তোগুলো খোঁজার সুবিধে হল এরজন্য বেশি কিছু পরিকল্পনা করতে হয় না, প্রস্তূতি নিতে হয় না, অর্থব্যয় করতে হয় না - শুধু একটু খুঁজে দেখার মানসিকতা থাকলেই চলে । সবসময়েই এই খোঁজার পরিশ্রমের অসামান্য ফল পাওয়া যায় না এ'কথা যেমন সত্যি তেমনি এটাও সত্যি কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই প্রাপ্তি হয়ে ওঠে প্রত্যাশার তূলনায় অনেক - অনেক বেশি । সেইসব দিনগুলোতে নিজেকে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের থেকে কম বলে মনে হয় না । সেইরকমই একটা দিন হল শুক্রবার ১৮ই মে, ২০১৮ । আমাদের ভ্রমণস্থান কালনা - পূর্ব বর্ধমান জেলার ছোট্ট একটা শহরতলী ।

রাস্তার ধারের ধানক্ষেত ও গরু
সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ গাড়ি নিয়ে বেরোলাম আমি আর অমৃতা । আমাদের বাড়ি থেকে কালনা যাওয়ার একাধিক রাস্তা থাকলেও সবথেকে কম সময়ে পৌঁছনো যায় ডানকুনি হয়ে এন-এইচ ১৯ বা দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গেলে । এই রাস্তাটা গাড়ি চালানোর পক্ষে অসাধারণ - অনায়াসে ঘন্টায় ১২০ - ১৪০ কিলোমিটার স্পীড তোলা যায় । ডানকুনি টোল প্লাজা থেকে একসঙ্গে যাওয়া এবং ফেরার টোল ট্যাক্স দিয়ে আরও ৪০ কিলোমিটার গেলে গুড়াপ এর ক্রসিং । (এখানে জানিয়ে রাখি চাইলে এই টোল ট্যাক্সটা বাইপাস করা সম্ভব । সেটা করতে হলে টোল প্লাজার কিছুটা আগে এন-এইচ ১৯ এর পাশে সার্ভিস রোডে ঢুকে পড়তে হবে আর এই রাস্তা দিয়ে গেলে গাড়ির স্পীড কখনওই ঘন্টায় ৪০ কিলোমিটারের বেশি তোলা সম্ভব হবে না) এই ক্রসিং থেকে হাইওয়ে ছেড়ে আমরা নেমে পড়লাম মগরা-গুড়াপ রোডে । দু'দিকের ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে প্রথমে মগরা-গুড়াপ রোড, তারপর বৈঁচি-ধনিয়াখালি রোড আর সবশেষে বৈঁচি-কালনা রোড ধরে মোট ৩৬ কিলোমিটার মতো গিয়ে আমরা পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্যস্থলে ।

দুপুর প্রায় একটা বাজে তাই আমরা আগেই লাঞ্চ করার সিদ্ধান্ত নিলাম । কালনা-কাটোয়া রোডের উপর একাধিক ভাতের হোটেল আর রেস্ট্যুরেন্ট আছে, তাদের মধ্যে 'পথের সাথী' হল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের । আমরা এখানে ফ্রাইড রাইস আর চিকেন মাঞ্চুরিয়ান খেয়ে নিলাম । মোট খরচ হল ২২০/- টাকা ।

কালনার বিখ্যাত ১০৮ শিবমন্দির (ক্যামেরায়
প্যানরামিক ভিউ এর সুযোগ না থাকায় দু'টো
আলাদা ছবি পাশাপাশি জোড়া হয়েছে)
এরপর আমরা গেলাম কালনার প্রধান আকর্ষণ ১০৮ শিব মন্দির দেখতে । শেষের রাস্তাটুকু বিশেষ চওড়া নয় তবে দুপুরবেলা গাড়ি বেশি না থাকায় সেরকম অসুবিধে হল না । শিব মন্দিরের বাইরে একটা ফাঁকা জায়গায় গাড়ি রেখে আমরা মন্দিরের ঢোকার গেটের সামনে গেলাম । গেট দুপুর বারোটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত্য বন্ধ থাকে তাই ভিতরে ঢুকতে পারলাম না । তবে বাইরে থেকে ভিতরের যতটা দেখা যায় সেটাও খুব কম নয় । পুরো জায়গাটা মন্দিরনির্মিত দু'টো সমকেন্দ্রীক বৃত্ত যার বাইরের বৃত্তে ৭৪ টা আর ভিতরের বৃত্তে ৩৪ টা শিবের মন্দির মিলিয়ে মোট ১০৮ টা মন্দির আছে । প্রত্যেকটা মন্দির শিবের একেকটা আলাদা নামে (যারা জানে না তাদের জানাচ্ছি শুধু নারায়ণের নয়, মহাদেবেরও ১০৮ টা নাম আছে - বিস্তারিত জানতে চাইলে click here (তথ্য যাচাই করা হয়নি)) মন্দিরগুলো ১৮০৯ সালে মহারাজ তেজ চন্দ্র বাহাদুর তৈরি করেন । ভিতরে ঢুকতে না পারলেও আমরা পুরো জায়গাটা একবার বৃত্তাকারে চক্কর দিলাম । এর আগে একজায়গায় অনেকগুলো করে শিবের মন্দির থাকতে দেখেছি, যেমন দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর মন্দিরের সঙ্গে দ্বাদশ শিবমন্দির বা খড়দহে ছাব্বিশ শিবমন্দির, কিন্তু তার চেয়ে বেশি কখনও দেখিনি । একজায়গায় ১০৮ শিবমন্দির শুধুমাত্র ভারতবর্ষে নয়, আমার ধারণা সারা বিশ্বেই নজিরবিহীন ।

রাজবাড়ির বাগান ও মন্দির
১০৮ শিবমন্দিরের ঠিক বিপরীত দিকেই কালনা রাজবাড়ির চত্বর । সৌভাগ্যক্রমে এটা খোলা ছিল । ভিতরে ঢুকে দেখলাম জায়গাটা প্রকৃতপক্ষে বেশ কিছু মন্দির আর বাগানের সমাহার । বাগানটা যে নিয়মিত পরিচর্যা করা হয় সেটা দেখেই বোঝা যায় । মন্দিরগুলোর মধ্যে বদ্রীনারায়ণ, পঞ্চরত্ন, প্রতাপেশ্বর, গিরি গোবর্ধন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । মন্দিরের গায়ের ইঁটের গাঁথনি দেখে মনে হয় সেগুলো আলাদা আলাদা সময়ে তৈরি । এখানেও কয়েকটা ছোট ছোট শিবমন্দির আছে । মন্দিরগুলোর সামনে আলোর ব্যবস্থা দেখে মনে হয় সন্ধ্যের পরে আলো জ্বললে খুব সুন্দর দেখতে লাগবে । এই চত্বরটা পেরিয়ে গেলে রাজবাড়ির মাঠ ।  মেঘলা আবহাওয়া হওয়াতে রোদের তেজ অনুভব করছিলাম না, তাই সবকিছু বেশ ভালো করে ঘুরে দেখে নিলাম ।

মদন গোপাল মন্দির
রাজবাড়ির গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে আমরা বাঁদিকে কিছুটা হেঁটে গিয়ে আরেকটা মন্দির দেখতে পেলাম । এটার নাম মদন গোপাল মন্দির । এই মন্দিরটা একটা ছোট পাঁচিল দিয়ে ঘেরা । এটা সেরকম কিছু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নয়, আমরা এখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ছবি তুলে চলে এলাম ।












দুপুর প্রায় তিনটে বাজে আর আমাদের আর বিশেষ কিছু দেখারও নেই, তাই আমরা ফেরার পথ ধরলাম । ফেরা একই পথ ধরে । বিকেল সাড়ে পাঁচটার একটু পরে বাড়ি পৌঁছে গেলাম ।

সারসংক্ষেপ ঃ

১. কলকাতা থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে পূর্ব বর্ধমান জেলায় হুগলী নদীর তীরে কালনা শহর । মন্দির ও অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপত্যের জন্য এই জায়গাটি বিখ্যাত ।
২. কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে ছাড়া ট্রেনেও কালনা যাওয়া যায় । হাওড়া থেকে প্রতি দু'ঘন্টা ছাড়া ছাড়া কাটোয়া লোক্যাল পাওয়া যায় অথবা শিয়ালদহ থেকেও কাটোয়া লোক্যালে যাওয়া যায় । এখানকার নিকটবর্তী স্টেশন হল অম্বিকা কালনা । স্টেশন থেকে টোটো বা রিক্সা পাওয়া যায় ।
৩. কালনার প্রধান আকর্ষণ হল ১০৮ শিবমন্দির । একজায়গায় একসঙ্গে এতগুলো শিবমন্দির এক নজিরবিহীন স্থাপত্য । দুপুর বারোটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত্য মন্দিরের গেট বন্ধ থাকে ।
৪. শিবমন্দিরের ঠিক উল্টোদিকেই আছে রাজবাড়ির বাগান, সংলগ্ন মন্দির আর খেলার মাঠ । এই গেট সারাদিনই খোলা থাকে ।
৫. রাজবাড়ি আর ১০৮ শিবমন্দির ছাড়াও এই অঞ্চলে আরও কয়েকটা মন্দির আছে । এগুলো খুব কিছু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ না হলেও ঘুরে দেখতে ভালো লাগবে ।
৬. মন্দির বা রাজবাড়ির খুব কাছে সেরকম কোনও ভালো খাবার হোটেল নেই । খাবারের জন্য স্টেশন বা সংলগ্ন কালনা-কাটোয়া রোডের ওপর একাধিক হোটেল পাওয়া আছে । এদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের 'পথের সাথী' উল্লেখযোগ্য । এখানে খাবারের দাম কম আর মান বেশ ভালো ।
৭. কালনা ডে-ট্রিপ করার পক্ষেই উপযোগী, কোনও কারণেই এখানে রাত্রিযাপনের কোনও মানে হয় না । তা সত্ত্বেও করতে চাইলে এই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের 'পথের সাথী'তে থাকার ব্যবস্থা আছে ।

উপসংহার ঃ

কালনা রাজবাড়ির মন্দির
কলকাতা থেকে ডে-আউট ট্রিপে ছোট্ট শহর - কালনা । ঐতিহাসিক দিক থেকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । হুগলী নদীর একেবারে তীরে হওয়ায় সপ্তম খ্রীষ্টাব্দে বাংলার সম্রাট শশাঙ্কের আমলে এই কালনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল একটি উন্নতমানের নৌবহর । আবার শ্রী চৈতন্যর জীবদ্দশায় একমাত্র চৈতন্য মন্দির নির্মিত হয়েছিল এই কালনাতেই । অষ্টাদশ শতাব্দীতে বর্ধমানের রাজাদের আমলে কালনা সর্ব্বোচ্চ খ্যাতি অর্জন করে - এখানকার বেশিরভাগ মন্দির আর স্থাপত্য এই সময়েই নির্মিত হয় । না, এগুলো আমাদের ইতিহাসে পড়ানো হয় না । আমাদের স্কুলের ইতিহাস বই থেকে আমরা জানতে পারি না যে আমাদের 'ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া'ই দেখতে পাওয়া যায় শুধুমাত্র শিবমন্দির দিয়ে নির্মিত দু'টো সমকেন্দ্রিক বৃত্ত । এখানেই দেখতে পাওয়া যায় বাংলার সেরা কিছু স্থাপত্য-ভাস্কর্য্য । দোষ আমাদেরই - আমরাই আমাদের ইতিহাসকে কখনও গুরুত্বপূর্ণভাবে পরিবেশন করতে পারিনি । আর সেই কারণেই হয়তো আমরা আমাদের ইতিহাসের প্রতি কখনও সেভাবে টানও অনুভব করিনি - করিনা । ইতিহাস শুধু পাঠ্যবই আর পরীক্ষার নম্বরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে - আমাদের জ্ঞানের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়নি । কখনও উপলব্ধি করিনি এগিয়ে চলার জন্য পিছনদিকে রাস্তাটা কোথা থেকে এসেছে সেটাও জানার দরকার । তাই যদি এই জানা সত্যিই দরকার বলে মনে হয় তাহলে - 'কালনা', আজই যেতে হবে !

কালনা ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

No comments:

Post a Comment