আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Friday, January 22, 2021

কলকাতা ভ্রমণ : পর্ব - ৩ (বটানিক্যাল গার্ডেন)

'আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বোস ভারতীয় উদ্ভিদ উদ্যান' বা 'বটানিক্যাল গার্ডেন' জায়গাটা ভৌগলিকভাবে যদিও কলকাতার মধ্যে পড়ে না, কিন্তু কলকাতা ও হাওড়াকে একসঙ্গে যমজ শহর বলা হয় অর্থাৎ যা এখানকার তাইই ওখানকার । সেই কারণে বটানিক্যাল গার্ডেন ভ্রমণের কথা কলকাতা ভ্রমণের মধ্যেই লিখছি । হাওড়া জেলার শিবপুরে অবস্থিত এই বটানিক্যাল গার্ডেন ভারতবর্ষের মধ্যে শুধু বৃহত্তমই নয়, প্রাচীনতমও বটে । জায়গাটা আমার মাসির বাড়ির খুব কাছে হওয়ায় ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার গিয়েছি । তারপর যা হয় - বড় হওয়ার পরে সেভাবে কখনও যাওয়া হয়ে ওঠেনি । করোনা পরিস্থিতির মধ্যে যখন ডে-আউট ট্রিপের মাধ্যমে নিজের শহরটাকে আরেকটু ভালোভাবে দেখে নেওয়ার কথা ভাবলাম, তখন সেই লিস্টে ওপরের দিকেই রাখা হল বটানিক্যাল গার্ডেনের নাম ।

গেট দিয়ে ভিতরে ঢোকার পর
২২শে জানুয়ারী, ২০২১ শুক্রবার । দুপুর বারোটা নাগাদ আমি, অমৃতা, বাবা, মা আর কথা-কলি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে বটানিক্যাল গার্ডেন পৌঁছলাম তখন সাড়ে বারোটা । গুগ্‌ল্‌ ম্যাপের যুগে পথনির্দেশ দেওয়া নিষ্প্রয়োজন শুধু এইটুকু জানিয়ে রাখি নিজেদের গাড়ি নিয়ে গেলে পার্কিং-এর জন্য বটানিক্যাল গার্ডেনের ১ নং গেটে যেতে হবে । কলকাতা থেকে গেলে দ্বিতীয় হুগলী সেতু পেরিয়ে আন্দুল রোড ধরে শিবপুরের ইন্ডিয়ান ইনিস্টিটিউট অফ্‌ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (পূর্বতন শিবপুর বি ই কলেজের)-এর সামনে দিয়ে গিয়ে ১ নং গেটে গাড়ি পার্কিং করার জায়গা । এখানে ৫০ টাকা দিয়ে সারাদিনের জন্য গাড়ি পার্কিং করা যায় । পার্কিং করে আমরা ভিতরে ঢোকার টিকিট কাটলাম । টিকিটের দাম মাথাপিছু ১০/- টাকা (বাচ্চাদের টিকিট লাগে না)।

এখানে আরও একটা দরকারী তথ্য জানিয়ে রাখি । বটানিক্যাল গার্ডেন ভালোভাবে ঘুরে দেখতে কমপক্ষে ৪ - ৫ ঘন্টা সময় লাগে, তাই সঙ্গে খাবারদাবার ও পর্যাপ্ত পরিমাণ পানীয় জল রাখা ভালো কারণ ভিতরে এইদু'টোর কোনওটারই ব্যবস্থা নেই । গতবছরের আমফানের ফলে ভিতরের জল সরবরাহব্যবস্থা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বর্তমানে এখানে হাতধোওয়ার নূন্যতম জলের যোগানও নেই । যদিও বটানিক্যাল গার্ডেনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে ভিতরে খাবার নিয়ে ঢোকার নিয়ম নেই, কিন্তু আমরা গেটের সিকিউরিটি গার্ডকে জিজ্ঞেস করেই সঙ্গে খাবার নিয়ে ঢুকেছি । ভিতরে বসে স্বচ্ছন্দে খাবার খাওয়া যেতে পারে, তবে এইটুকু খেয়াল রাখতেই হবে কোনওভাবেই যেন ভিতরের পরিবেশ নোংরা না হয় । আরও একটা কথা - রবিবার বা ছুটির দিনে এখানে কিছুটা ভীড় হয়, তাই সেরকম বাদ দিয়ে যেতে পারলে ঘুরতে সুবিধে হবে বলে আমার ধারণা ।

বটানিক্যাল গার্ডেনের ভিতরে
বটানিক্যাল গার্ডেনের ভিতরে ঘোরার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ করে দিচ্ছি না কারণ গাছপালা লতাগুল্ম ছোটবড় লেক জলাশয় বাগান গ্রিন হাউস মিলিয়ে ভিতরটা সবকিছুর একটা সাড়ে বত্রিশভাজা যেখানে এ বলে আমার দ্যাখ, ও বলে আমায় দ্যাখ ! আমি বটানির ছাত্র নই, আমাদের চারপাশের কিছু পরিচিত গাছপালার বাইরে খুব বেশি কোনও গাছ চিনি না কিন্তু আমি গাছ খুব ভালোবাসি আর সেই কারণে বটানিক্যাল গার্ডেনের পরিবেশ আমার কাছে খুবই চিত্তাকর্ষক । ভিতরের রাস্তা খুবই পরিপাটি আর জায়গায় জায়গায় টাঙানো ম্যাপ দেখে এগোতে কোনওই অসুবিধে হয় না । বিশেষ কিছু দেখার উদ্দেশ্যে নয়, পুরো জায়গাটা শুধু হাঁটতেই খুব ভালো লাগে (ভিতরে এমনিতেও কোনও যানবাহনের ব্যবস্থা নেই, কাজেই ঘোরার একমাত্র উপায় হল হাঁটা !)।

বিশাল বটবৃক্ষ (প্যানোরমিক ভিউ)

তবে একেবারে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে হাঁটা নয়, বটানিক্যাল গার্ডেনে এসে এখানকার বিখ্যাত 'বিশাল বটবৃক্ষ'টা দেখার আগ্রহ আমার সবসময়েই থাকে । যারা জানে না, তাদের উদ্দেশ্যে জানাচ্ছি বটানিক্যাল গার্ডেনের এই সুবিশাল বটগাছটা পৃথিবীর সবথেকে বড় বটগাছ । প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো এই গাছের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর বিপুল সংখ্যক বায়বীয় মূল বা এরিয়াল রুট (উইকিপিডিয়া অনুযায়ী বর্তমানে এই মূলের সংখ্যা ৩,৭৭২)। পরপর দু'টো ঘূর্ণিঝড়ে এর মূল কান্ড ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পর ১৯২৫ সালে এই মূল কান্ডটাকে সরিয়ে ফেলা হয় । কিন্তু তারপরেও গাছটি অনায়াসে বেঁচে রয়েছে এবং নিজের শাখা-প্রশাখা ও মূল বিস্তার করে চলেছে । দর্শকরা যাতে গাছের একেবারে কাছে যেতে না পারে সে'জন্য এই গাছের চারদিকে একটা লোহার জালঘেরা পাঁচিল করে দেওয়া হয়েছে এবং সেই পাঁচিলের চারদিকে একটা হাঁটার রাস্তা রয়েছে যার দৈর্ঘ্য ৩৩০ মিটার । গাছ অবশ্য এই পাঁচিলের বাইরেও নিজের ডালপালা বিস্তার করে চলেছে । দূর থেকে গাছটাকে একটা গাছের বদলে একটা ছোটখাটো বন বলে মনে হয় । আমরা গাছের কাছে গিয়ে ভালোভাবে দেখলাম ও ছবি তুললাম । বটানিক্যাল গার্ডেনে যাওয়ার একটা প্রধান আকর্ষণ যে এই 'বিশাল বটবৃক্ষ' দর্শন সেটা অস্বীকার করব না ।

গোলাপ বাগান
বটগাছ দর্শনের পরে ডানদিকে সামান্য কিছুটা এগোলে একটা ঘেরা জায়গায় গোলাপের বাগান । লাল, গোলাপী, হলুদ, সাদা ইত্যাদি নানারঙের গোলাপের এক অপূর্ব সমারোহ এই বাগান । এখানেও অত্যুৎসাহী জনতাকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না, তাই বাইরে থেকে দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে ।





এই গোলাপ বাগানের কাছেই রাস্তার ধারে একটা জায়গায় বসে আমরা সঙ্গে আনা লুচি, আলুরদম, সীতাভোগ, মিহিদানা দিয়ে আমাদের দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম । এখানে জায়গায় জায়গায় ডাস্টবিন রয়েছে, তাই খাওয়ার পর আবর্জনা ফেলার জায়গার অভাব নেই । তাই আবারও বলছি যেখানে সেখানে জিনিস ফেলে নোংরা করা একেবারেই চলবে না ।

বটানিক্যাল গার্ডেন থেকে গঙ্গার দৃশ্য
খাওয়ার পরে আবার হাঁটতে শুরু করলাম । এবারে আমাদের উদ্দেশ্য গঙ্গার ধারে যাওয়া । বটগাছটা বাগানের একদিকে আর গঙ্গার ধারটা অন্যদিকে । এই দুইয়ের ব্যবধানটা হেঁটে মেটাতে আমাদের লাগল প্রায় চল্লিশ মিনিট । গঙ্গার ধারে বসার কয়েকটা জায়গা আছে, সেখানে আমরা কিছুক্ষণ বসে রইলাম । বিকেল পৌনে চারটে বাজে, সূর্য পশ্চিম আকাশে গিয়ে আজকের মতো দিনের ইতি ঘোষণা করার তোড়জোড় শুরু করেছে । গঙ্গার ওপরে আমাদের সামনে দিয়ে একটা লঞ্চ চলে গেল । ওপারে কলকাতার মেটিয়াবুরুজ এলাকায় কারখানার চিমনি থেকে ধোঁওয়া বেরোচ্ছে । আমরা যেখানে বসে আছি সেখানে গাছের পাতার শিরশির শব্দ আর পাখির ডাক ছাড়া কোনও অপ্রাকৃতিক শব্দ নেই । এই পরিবেশে চুপচাপ বসে বসে প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে খুব ভালো লাগে - মনটা চলে যায় কোনও এক সুদূর অতীতে - মনের মণিকোঠায় ঘুরেফিরে আসে কতই না পুরনো স্মৃতি !

ফেরার পথে
সম্বিৎ ফিরল (না এটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল, অতও কিছু আত্মনিমগ্ন হয়ে পড়িনি !) সিকিউরিটি গার্ডদের ডাকাডাকিতে । বটানিক্যাল গার্ডেন পাঁচটায় বন্ধ, চারটে থেকেই এরা লোকজনকে তাড়িয়ে বের করার কাজ শুরু করে । এত বড় জায়গায় এ'ছাড়া আর উপায় নেই । আমরা এদের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করে বেরোনোর পথ ধরলাম । গঙ্গার ধারে যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে ১ নং গেটে পৌঁছতে আমাদের প্রায় আধঘন্টা সময় লাগল ।

বাগানের সময়সূচী
গেটের ঠিক পাশেই বাগান খোলা-বন্ধের সময়ের একটা ফলক লাগানো আছে । সময়ের তালিকাটা লেখার মধ্যে দেওয়ার বদলে এখানে সেই ফলকেরই একটা ছবি দিয়ে দিলাম (যদি কেউ বাংলা না পড়তে পারে তাহলে অন্ততঃ সে হিন্দী বা ইংরিজীতে বাগানের সময়সীমাটা দেখে নিতে পারবে যদিও বাংলা না পড়তে পারলে ব্লগটা পড়তে পারবে কিনা সেই নিয়ে আমার সন্দেহ আছে !)।


উপসংহারঃ

বটানিক্যাল গার্ডেন
১৭৮৭ সালে তৈরি এই বটানিক্যাল গার্ডেন প্রাথমিকভাবে মূলতঃ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তৈরি হলেও পরবর্তীকালে জায়গাটা দেশবিদেশের গাছের সংগ্রহশালায় পরিণত হয় । বর্তমানে পৃথিবীর সাতটি মহাদেশের সবক'টির কিছু কিছু গাছের নমূনা রয়েছে এই বটানিক্যাল গার্ডেনে । শুধুমাত্র পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বটবৃক্ষের জন্য নয়, এই বটানিক্যাল গার্ডেনের সৌন্দর্য এর অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশে । গাছপালা লতাগুল্ম সম্বলিত এত সুবিশাল পরিবেশ আমাদের চারপাশে দুর্লভ - বিশেষ করে আমরা যারা শহরের 'জাংগল অফ্‌ কনক্রিট'-এর মধ্যে থাকি । কনক্রিটের জঙ্গল ছেড়ে উদ্ভিদের এই জঙ্গলে কয়েক ঘন্টা কাটানো আমাদের কাছে তাই এক অসামান্য অভিজ্ঞতা । যেদিকেই তাকানো যায়, শুধু সবুজের সমারোহ - চোখের পক্ষে এক অত্যন্ত আরামদায়ক অনুভূতি । এই অনুভূতির টানেই যাওয়া - প্রকৃতির হাতে কয়েকঘন্টার জন্য নিজেকে সঁপে দেওয়ার টান । এই টানটা যারা অনুভব করে, তাদের জন্য বটানিক্যাল গার্ডেন অবশ্য গন্তব্য !

বটানিক্যাল গার্ডেনের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

No comments:

Post a Comment