আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Sunday, September 12, 2021

কলকাতা ভ্রমণ : পর্ব - ৫ (নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম)

লকাতা ভ্রমণের প্রথম পর্ব চিড়িয়াখানা ভ্রমণের পোস্টে লিখেছিলাম "কলকাতার চিড়িয়াখানা প্রায় সব্বাই ছোটবেলায় একবার করে যায় আর বহু লোকের ক্ষেত্রে দেখেছি বড় হয়ে আর কিছুতেই যাওয়া হয়ে ওঠে না"। কলকাতার নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামের ক্ষেত্রেও বোধহয় একই কথাই প্রযোজ্য, যদিও চিড়িয়াখানায় যত লোক ছোটবেলায় যায় তত লোক বোধহয় নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামে যায় না। আমি  এখানে ছোটবেলায় বারদুয়েক গেছি আর তারপর বড় হয়ে কখনও যাওয়া হয়নি। এবারে গেলাম - প্রধানতঃ আমার দুই কন্যাকে তাদের ছোটবেলার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করাতে (যাতে বড় হয়ে ওরাও একই ধরনের কথা বলতে পারে !)। কলকাতা ভ্রমণের এই পর্বে থাকছে সেই নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামে আমাদের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।

১২ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ - রবিবার আমরা নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম পৌঁছলাম দুপুর চারটে পনেরো নাগাদ। নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে (সোমবার বন্ধ)। এবারে আমরা সাতজন - আমরা ছ'জন ছাড়া আমাদের সঙ্গে টুটুন। নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামের অবস্থান জওহরলাল নেহেরু রোডে - এক্সাইডের মোড় থেকে এস্‌প্ল্যানেডের দিকের রাস্তা অর্থাৎ জওহরলাল নেহেরু রোড ধরে মিনিট খানেক হাঁটলে বাঁদিকে মিউজিয়ামটা পড়ে। এখানে রাস্তার উপরেই গাড়ি পার্কিং করা যায়।

নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামের ঢোকার টিকিট বড়দের মাথাপিছু ২০/- টাকা আর ছোটদের (১৬ বছরের নিচে) মাথাপিছু ১০/- টাকা। টিকিট কেটে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। পুরো বাড়িটা ছ'তলা যদিও দেখার জিনিস শুধুমাত্র দোতলা, তিনতলা আর চারতলায়। এখানকার দেখার জিনিসগুলোকে মোটামুটি চারভাগে ভাগ করা যায় - পুতুলের গ্যালারি, গণেশের গ্যালারি, রামায়ণ আর মহাভারত। এর মধ্যে পুতুলের গ্যালারি সবতলাতেই আছে, মহাভারত আছে তিনতলায় আর রামায়ণ আর গণেশ চারতলায়।

পুতুলের গ্যালারি
পুতুলের গ্যালারি -
 নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামের পুতুলের গ্যালারিতে পুতুলের সম্ভার দেখে তাজ্জব বনে যেতে হয় ! ঘরের চারদিকের দেওয়ালে এবং মাঝখানে বিশাল কাচের শোকেসে এই পুতুলগুলো রাখা হয়েছে। দেশ-বিদেশের নানারকমের পুতুল রয়েছে এই গ্যালারিতে। বিভিন্ন আকারের, বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়ানো বসা শোওয়া এইসব পুতুলগুলো বিভিন্ন দেশের বা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের শিল্পকলার অসাধারণ নিদর্শন। দুর্গার মূর্তি থেকে ইংরেজ বণিক, ব্রাহ্মণ পুরোহিত থেকে মিজোরামের রাজকন্যা, জার্মান থেকে রাশিয়ার পুতুল - সবই রয়েছে এইসব পুতুলের ঘরগুলোতে। একটা একটা করে সবকটা পুতুল দেখা সম্ভব নয়, তবে প্রত্যেকটা পুতুলই দেখতে যে খুবই সুন্দর - সেটা বলতেই হবে। এখানে চাইলে নিজের কাছে থাকা পুতুল দিয়েও দেওয়া যায়, এরা সেগুলো এই সংগ্রহের মধ্যে রেখে দেবে। বিভিন্ন দেশের সরকার থেকে এখানে বিভিন্ন পুতুল উপহার দেওয়া হয়েছে, সেগুলো এখানে লেখাও রয়েছে।

অর্জুনের লক্ষ্যভেদ
মহাভারত -
 দোতলা আর তিনতলার পুতুলের গ্যালারির পরে আমরা গেলাম তিনতলার মহাভারত গ্যালারি দেখতে। এখানে একটা বিশাল ঘরের মধ্যে মহাভারতের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনার মডেল তৈরি করে কাচের শোকেসের মধ্যে রাখা রয়েছে। শোকেসের সামনে দেওয়ালের উপরদিকে সেই ঘটনার বিবরণ লেখা হয়েছে। এইসব ঘটনার মধ্যে পাশা খেলা, পান্ডবদের বনবাস, অর্জুনের লক্ষ্যভেদ, মহাভারতের যুদ্ধ, ভীষ্মের শরসজ্জা ইত্যাদি অনেক কিছুই রয়েছে। আমার মতে মহাভারত সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য - এর মতো এত ঘটনাবহুল কাব্যগ্রন্থ পৃথিবীতে আর আছে বলে আমার জানা নেই। সেই মহাভারতের ঘটনাবলীর এত সুন্দর মডেল দেখতে খুবই ভালো লাগছিল। শুধু আমরা বড়রা নই, মহাভারতের বিস্তারিত গল্প কথা-কলিও জানে, তাই ওরাও মডেলগুলো দেখে নিজেরাই কোনটা কি বলে যাচ্ছিল।

রাবণের সীতাহরণ
রামায়ণ -
 চারতলায় রামায়ণ গ্যালারি। মহাভারতের মতো এখানেও বিশেষ বিশেষ ঘটনাবলীর মডেল তৈরি করে কাচের শোকেসে রাখা রয়েছে। রামের হরধনু ভঙ্গ, রাবণের সীতাহরণ, হনুমানের লঙ্কাকান্ড ইত্যাদি নানারকম ঘটনার মডেল রয়েছে এখানে। ব্যক্তিগতভাবে আমার রামায়ণ যদিও সেরকম কিছু ভালো লাগে না (বলতে চাইছি পোষায় না), কিন্তু তাও গ্যালারিটা খুবই ভালো লাগল।









গণেশের গ্যালারি
গণেশ গ্যালারি -
 চারতলায় রামায়ণ গ্যালারি থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার আগে বাঁদিকে গণেশের গ্যালারি। এখানে অনেকগুলো ছোট ছোট নানাধরনের গণেশের মূর্তি রয়েছে। অনেকগুলোই বেশ মজাদার, যেমন - ফুটবলার গণেশ, ব্রাহ্মণ গণেশ, স্কুলবয় গণেশ, পুলিশ গণেশ ইত্যাদি। এছাড়া কয়েকটা চিরাচরিত গনেশের মূর্তিও রয়েছে। এইসব দেখে আমরা নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে এলাম।

উপসংহারঃ

মিউজিয়ামের পুতুলের সামনে আমার দুই পুতুল !
কলকাতা শহরে ছোটদের দেখার মতো যে কয়েকটা জায়গা রয়েছে, তার মধ্যে নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এখনকার দিনের মা-বাবারা বাচ্চাদের এখানে কতটা নিয়ে যান জানি না, তবে গেলে বাচ্চাদের ভালো লাগারই কথা। আমার ছোটবেলায় আমার ভালো লাগত, কথা-কলির ছোটবেলায় ওদেরও ভালো লেগেছে। পুরো মিউজিয়ামটা দেখতে ঘন্টাদেড়েকের মতো লাগে, তাই কোনও একটা ছুটির দিনে এখানে গেলে সময়টা ভালোই কাটবে। নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামে শুধুমাত্র চারধরনের গ্যালারি ছাড়াও ছোটদের আঁকা, আবৃত্তি, নাচ, গান, ম্যাজিক, নাটক শেখানো হয়। কেউ নিজের ছেলেমেয়েকে এসব শেখাতে চাইলে এখানে যোগাযোগ করতে পারেন (নাও পারেন, আপনার ইচ্ছে !)। তবে ছোটবড় নির্বিশেষে এই মিউজিয়ামটা একবার দেখে আসার জন্য সবাইকেই অনুরোধ করছি।

নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

No comments:

Post a Comment