জানি না কেন লোকের একটা ধারণা আছে যে 'রিশপ' জায়গাটা সিকিম রাজ্যে । (আমি নিশ্চিত এই লাইনটা পড়েই অনেকের মনে হবে "আমি তো সিকিমেই জানতাম ! রিশপ সিকিমে নয় ? তাহলে কোথায়?") যারা জানে না তাদের সবাইকে জানাই রিশপ পশ্চিমবঙ্গেই পড়ে - দার্জিলিঙ জেলায় । নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট একটা গ্রাম । সেই গ্রামে আমাদের দু'দিন থাকার অভিজ্ঞতা দিয়েই আমার ব্লগের এবারের পোস্ট ।
১৯শে অক্টোবর, ২০১৩ শনিবার আমাদের বেরোনোর দিন । এটা লক্ষ্মীপুজোর পরেরদিন কাজেই অন্যান্য কোনও ট্রেনে বুকিং না পেয়ে আমরা বাধ্য হয়েছিলাম 'পাহাড়িয়া এক্সপ্রেস' নামক ট্রেনে টিকিট কাটতে । আমাদের এবারের টীমের সদস্যসংখ্যা পাঁচ - আমি, আমার স্ত্রী অমৃতা, আমার সহকর্মী সমীরণদা, বৌদি ও ওনাদের এগারো বছরের ছেলে ঋজু । পাহাড়িয়া এক্সপ্রেস ছাড়ে দীঘা থেকে, হাওড়ায় একটা পঞ্চাশ মিনিটের হল্ট দিয়ে এন জে পি র উদ্দেশ্যে রওনা হয় রাত ৯:৫৫ টায় । এখানে জানিয়ে রাখি এন জে পি যাওয়ার জন্য রাতের কোনও ট্রেনে একান্তই বুকিং পাওয়া না গেলে তবেই পাহাড়িয়া এক্সপ্রেসে যাওয়া উচিৎ, না হলে নয় । কামরার ভেতরের আলো পাখা স্যুইচ প্লাগ পয়েন্ট এবং সর্বোপরি বাথরুম - কোনওটাই আশানুরূপ নয় । (আমাদের কামরায় এক ভদ্রলোক বলেই ফেললেন "অন্যান্য ট্রেনের সব বাতিল হয়ে যাওয়া বগিগুলো এই ট্রেনে লাগিয়েছে ।")
|
সেভক-এ ব্রেকফাস্ট ব্রেক |
তবে বগি যাইই হোক, পাহাড়িয়া এক্সপ্রেস এন জে পি পৌঁছল মাত্র একঘন্টা লেটে । এখান থেকে সিন্ডিকেটের একটা বোলেরো গাড়ি বুক করা ছিল - সেই গাড়ি করে রওনা দিলাম রিশপের উদ্দেশ্যে । গাড়িভাড়া ৩,২০০ টাকা । (এখন এই অঞ্চলে কার সিন্ডিকেট সমস্ত গাড়ির রেট বেঁধে দিয়েছে, ড্রাইভাররা আর ইচ্ছেমতো ভাড়া চাইতে পারে না) রাস্তায় সেভক রোডের ওপর তিস্তাব্রীজের কাছে ব্রেকফাস্টের জন্য দাঁড়ানো হল । এখান থেকে আলুর পরোটা আর কফি খেয়ে নেওয়া হল । মাথাপিছু খরচ পড়ল ৪০ টাকা ।
|
পথের দু'ধারে চা-বাগান |
রিশপ যেতে হলে গরুবাথান হয়ে যেতে হয় - অর্থাৎ সেভক থেকে আমরা করোনেশন ব্রীজ পেরিয়ে এগিয়ে চললাম । এখানে রাস্তার দু'দিকে প্রচুর চা-বাগান পড়ে এবং অনেকটা পথ বলতে গেলে সমতলভূমিতেই । এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই সুন্দর । বেশ কিছুটা পথে পাশাপাশি চলতে থাকে রেল লাইন । এই রেলপথ চলে গেছে গুয়াহাটী পর্যন্ত ।
|
মেঘের মাঝে পথ - পথের মাঝে মেঘ |
প্রায় ঘন্টাদেড়েক চলার পথে শুরু হল পাহাড়ী রাস্তা । পাহাড়ী রাস্তার বিবরণ দেওয়ার মানে হয় না, এটা আগেও বলেছি । পাহাড় আর খাদকে কখনও ডানদিকে আর কখনও বাঁদিকে রেখে আমরা এগিয়ে চললাম । রিশপ জায়গাটা 'লাভা' থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দূরে - লাভা হয়েই রিশপ যেতে হয় । প্রকৃতপক্ষে রিশপ লাভার ওপরেই নির্ভরশীল । রিশপের নিজস্ব কোনও বাজারও নেই, পুরোটাই আসে লাভা থেকে । আমরা লাভা পেরোলাম তখন দুপুর দু'টো ।
লাভা থেকে রিশপ রাস্তাটার একটু বিবরণ দেওয়া দরকার । ৫-৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তায় কোথাও পিচ্ নেই, পুরোটাই অসমান এবড়োখেবড়ো পাথরের । রাস্তা কখনও হঠাৎ করে উঁচু হয়ে যায়, কখনও হঠাৎ নিচু । এর ওপর দিয়ে যখন গাড়ি চলে তখন যাত্রীদের অবস্থা কি হয়, সেটা বোধহয় আর বিস্তারিত না বললেও চলবে । মোটকথা, এই
অত্যন্ত জঘন্য রাস্তা দিয়ে (আমি 'অত্যন্ত জঘন্য' লেখামাত্রই সেটা নিজে থেকে strike out হয়ে গেল, এর একটাই মানে হতে পারে - অত্যন্ত জঘন্য জিনিসরাও এই রাস্তাকে নিজেদের দলে জায়গা দিতে অস্বীকার করছে !) যাওয়ার আগে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া ভাল, তাতে কষ্ট হয়তো কিছুটা কম হতে পারে ।
|
লাভলি রিসর্টে আমাদের কটেজ |
দুপুর তিনটে নাগাদ আমরা পোঁছলাম আমার গন্তব্য - রিশপে । রিশপে পৌঁছে প্রথম যে বাড়িটা চোখে পড়ে সেটাই 'লাভলি রিসর্ট' - আমাদের থাকার জায়গা । পাহাড়ের ধাপে এর কটেজগুলো তৈরি করা হয়েছে । আপাতত এখানে আমরা ছাড়া আর কোনও গেস্ট নেই, একটা দোতলা কটেজের দোতলার দু'টো ঘর আমার জন্য বুক করা হয়েছে । ঘর আমাদের সবারই খুব পছন্দ হল । দেওয়াল মেঝে সবই কাঠের এবং খুব সুন্দর করে তৈরি করা । লাভলি রিসর্টের ঘরভাড়া ১,২০০ টাকা করে, তবে আমাদের চেনাজানা ছিল বলে ১,০০০ টাকা করে পড়েছে ।* (এই লেখার নিচে সারসংক্ষেপে বলা আছে কিভাবে যোগাযোগ করা যেতে পারে)
হাতমুখ ধুয়ে আমরা প্রথমেই গেলাম ডাইনিং রুমে । ভাত ডাল আলুপোস্ত আর ডিমের ডালনা নেওয়া হল । রান্নার মান অসাধারণ কিছু না হলেও বেশ ভাল । আমাদের মাথাপিছু খরচ পড়ল ১২০ টাকা মতো ।
|
আমাদের ঘর |
খাওয়া যখন শেষ হল তখন বিকেল সাড়ে চারটে । রোদ পড়ে এসেছে । রিশপের উচ্চতা ৮,০০০ ফুট এবং একটা পাহাড়ের প্রায় মাথায় । স্বাভাবিকভাবেই এখানে ঠান্ডা বেশ বেশি । খাওয়া শেষ করে আমরা নিজেদের ঘরে ফিরে এসে গরম জামাকাপড় চাপালাম ।
|
চাঁদের আলোয় রিশপ থেকে প্রাকৃতিক দৃশ্য |
বিকেল পাঁচটার একটু পরে এখানে সূর্য্যাস্ত হয় । আমাদের রিসর্টের ব্যালকনি থেকে সামনের পাহাড়ের ওপর অস্তগামী সূর্য্যের শেষ আলোকচ্ছটা দেখতে অসাধারণ লাগে । আমাদের আর কিছু করার নেই, তাই কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে বসে আড্ডা দিলাম । আস্তে আস্তে চারদিকের আলো কমে গিয়ে একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল । তারপর আস্তে আস্তে সামনের পাহাড়গুলোর গায়ে জোনাকীর মতো আলো জ্বলে উঠল । চা খেতে খেতে আমরা এই দৃশ্য দেখলাম । জায়গাটা এমনিতেই ফাঁকা আর সন্ধ্যের পরে যেন একেবারেই নিস্তব্ধ হয়ে যায় । যখন আমরা কথা বলছি না, সেই সময়ে ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না । সবমিলিয়ে একটা ভীষণ সুন্দর পরিবেশ ।
রিশপের দু'টো সমস্যা আছে, সেগুলোর কথা এখানে লিখে রাখি । এক, বিদ্যুতের সমস্যা । এখানে বিদ্যুতের সরবরাহ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম, কাজেই রিসর্টকে সন্ধ্যের পরে বেশিরভাগ সময়েই জেনারেটর জ্বালিয়ে রাখতে হয় । আমাদের ঘরে চারটে সি এফ এল ছিল, কিন্তু তাদের আলো এতটাই মিটমিটে যে সবসময়েই কমপক্ষে দু'টো জ্বালিয়ে রাখতে হয় ।
দ্বিতীয় সমস্যা হল জল, যদিও আমাদের এ'জন্য সেরকম কিছু ভুগতে হয়নি । রিশপে জলের খুব সঙ্কট - সে'জন্য ওখানকার লোকেরা বারবার বলে বাথরুমে বা অন্যান্য কোথাও জলের অপচয় না করতে । বিদ্যুতের সমস্যার জন্য গিজার চালানো যায় না, তবে বললে ওরা বালতি করে গরম জল দিয়ে যায় ।
রাতে খাওয়ার জন্য ডাইনিং রুমে গেলাম । (অবশ্য বললে ওরা ঘরেও দিয়ে যায়) যাওয়ার পথে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলাম । আকাশভরা
সূর্য্য তারা ! এত তারা আমরা যারা কলকাতায় থাকি তাদের কখনও দেখার সুযোগ হয় না । একে একে কালপুরুষের প্রায় সবক'টা, সপ্তর্ষিমন্ডলের সবক'টা আর টাফা (যেখানে প্রোফেসর শঙ্কু থাকেন !) সবই দেখতে পেলাম ।
রাতে খাওয়া হল রুটি আর চিকেন কারি । মাথাপিছু দাম পড়ল ১৫০ টাকা মতো ।
|
সকালের আলোয় আমাদের রিসর্ট এবং বাগান |
পরেরদিন সকালে উঠলাম তখন সাতটা । এইসময়ে রোদ উঠে যায় আর সকালে রোদে সমস্ত জায়গাটা চমৎকার লাগে । রোদের কিছুটা উত্তাপ থাকায় গরম জামা না পরলেও চলে । রিশপের একটা জিনিস উল্লেখযোগ্য - সেটা হল এখানকার ফুলের বাগান । আমাদের রিসর্টেরও নিজস্ব একটা বাগান আছে । এখানে নানা ধরনের ফুলগাছ এবং টব রাখা আছে । ফুলের মধ্যে গাঁদা চন্দ্রমল্লিকা জবা এবং আরও কয়েকটা নাম না জানা ফুল আছে । আর সবথেকে বেশি আছে গোলাপগাছ । সমস্ত গাছই অত্যন্ত ভালোভাবে পরিচর্যা করা হয় । (আমরা এখান থেকে কিছু গাছ কিনতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ওরা বলল এই গাছ আমাদের সমতলে নিয়ে গেলে বাঁচবে না ।) আমরা বেশ কিছুক্ষণ বাগানে ঘোরাঘুরি করে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম । এখানেও আলুর পরোটা । দাম পড়ল ৫০ টাকা করে ।
এরপর সাইট সিয়িং । আগেই বলে রাখি রিশপে সাইট সিয়িং করার মতো প্রায় কিছুই নেই, আর যেহেতু রিশপ এখনও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি, তাই এখানকার লোকেরা এখনও আজেবাজে জায়গাকে 'দেখার জায়গা' বলে টুপি পরায় না । আমাদের রিসর্টের লোকেদের থেকে জানলাম এখানে একটা মনাস্ট্রি আছে আর একটা বাচ্চাদের স্কুল আছে - যানবাহনের কোনও ব্যবস্থা নেই, চাইলে হেঁটে গিয়ে ঘুরে আসা যেতে পারে ।
|
রিশপে হেঁটে ঘোরার সময়ে |
আমরা হাঁটতে শুরু করলাম । রিশপ গ্রামের মধ্যে দিয়েই হাঁটার রাস্তা - পথের দু'ধারে আরও কিছু রিসর্ট দেখতে পেলাম । মনাস্ট্রি যাওয়ার পথে চোখে পড়ল 'নেওড়াভ্যালি রিসর্ট' - এখানে 'শব্দ' নামক বাংলা ছবির শ্যুটিং হয়েছিল । রিশপে আলাদা করে কোনও ঘোরার জায়গা নেই ঠিকই, কিন্তু এখানে এমনি ঘুরতেই বেশ ভালো লাগে । ফাঁকা জায়গা, কম লোকজন, কিছুদূর অন্তর অন্তর একটা রিসর্ট আর তার চারপাশে ফুলের বাগান । সেইসঙ্গে পাহাড়ের গায়ে কখনও রোদ, কখনও ছায়া পড়ে অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য । কখনও আমাদের পাশে মেঘ, কখনও নিচে । কখনও হাওয়ার স্রোত এসে একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব, আবার কখনও রোদ এসে একটা আরামদায়ক আবহাওয়া ।
|
মনাস্ট্রি - দূর থেকে |
প্রায় ২ কিলোমিটার পাহাড়ি চড়াই উৎরাই পেরিয়ে একটা জায়গায় পোঁছলাম যেখান থেকে মনাস্ট্রিটা স্পষ্ট দেখা যায় । আমাদের অবস্থান থেকে এই মনাস্ট্রিতে পৌঁছতে গেলে বেশ অনেকটা নিচে নামতে হবে । নিচে নামাটা কষ্টকর হবে না, কিন্তু ফেরাটা বেশ চাপের হবে - তাই আমরা দূর থেকেই মনাস্ট্রি দেখে ক্ষান্ত হলাম । বাচ্চাদের স্কুলটা মনাস্ট্রি পেরিয়ে আরও কিছুটা নিচে, তাই সেখানেও আর যাওয়ার ঝুঁকি নেওয়া হল না ।
রিশপ থেকে আরেকটা ঘোরার জায়গা আছে সেটা হল লাভা ট্রেকিং । পাহাড়ের গায়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ট্রেক করে রিশপ থেকে লাভা যাওয়া যায় । কিন্তু আমরা আর এই পথে হাঁটলাম না ।
|
আমাদের রিসর্টের সামনের রাস্তা |
সাড়ে দশটায় বেরিয়ে লোক্যাল সাইট সিয়িং করে ফিরে এলাম তখন সাড়ে বারোটা । বস্তুতঃ আমাদের রিশপে ঘোরাঘুরি শেষ - এখানে বলতে গেলে আর কিছু দেখার নেই । আমাদের একমাত্র দেখা বাকি আছে 'টিফিনদাড়া' - যেটা আমরা পরেরদিন সকালে যাব বলে ঠিক করেছি । (টিফিন দাড়ায় কিন্তু কোনও টিফিনের ব্যবস্থা নেই !)
রিসর্টে ফিরে এসে চানটান করে লাঞ্চ করে নিলাম । আজও লাঞ্চে কালকের মেনুই নেওয়া হল । রিশপে মাছ পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম । লাভায় মাছ পাওয়া যায় কিন্তু রিসর্টে বেশি লোক না থাকলে ওদের খরচায় পোষায় না । আর উপস্থিত আমরা ছাড়া আর কোনও লোকও নেই । যদিও আমাদের তাতে কোনও আফসোস নেই, আমরা ডিম আর মাংসের ওপর বেশ আছি !
|
সূর্য্যাস্তের সময়ে |
ঠান্ডা জায়গায় দুপুরে ভাত খাওয়ার পর শোওয়া যায় না, কারণ উঠলেই খুব শীত করে । খাওয়ার পরে আমরা আবার আমাদের বারান্দায় বসলাম আড্ডা দিতে । লাভলি রিসর্টের এই বারান্দাটা এতটাই সুন্দর যে এখানে বসে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায় ।
|
ক্যাপশনের প্রয়োজন নেই |
সন্ধ্যেবেলা অর্ডার দিয়ে আমরা চিকেনমোমো খেলাম । প্লেটে ৫টা করে মোমো । দাম পড়ল ১০০ টাকা করে । এইসব পাহাড়ী অঞ্চল মোমোর জন্য বিখ্যাত, কাজেই মোমো যে অত্যন্ত সুস্বাদু সে'কথা বোধহয় আর আলাদা করে না বললেও চলবে । রাতে ডিনার । ডিনারে মিক্সড চাউমিন আর চিলি চিকেন খাওয়া হল । খরচ পড়ল ১৪০ টাকা করে ।
ডিনারের সময়ে আমাদের পরেরদিন টিফিনদাড়া যাওয়ার ব্যাপারটা ফাইনাল করে নেওয়া হল । টিফিনদাড়ায় গিয়ে সূর্য্যোদয় দেখা যায় । কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপরে সূর্য্যের প্রথম আলো - শুনে মনে হল ব্যাপারটা অনেকটা 'টাইগার হিল'-এর মতো । রিশপ থেকে টিফিনিদাড়া ট্রেক করে ওপরদিকে উঠতে হয় - প্রায় একঘন্টা লাগে । ভোর সাড়ে চারটের সময়ে অন্ধকারে বেরিয়ে এই রাস্তাটা যেতে হয় যাতে সূর্য্যোদয়ের আগেই টিফিনদাড়ায় পৌঁছনো যায় । পাহাড়ী পথে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা, কাজেই গাইড ছাড়া যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না । আমাদের রিসর্টের লোক বলল একজনকে ঠিক করে রাখবে যে সাড়ে চারটের সময়ে এসে আমাদের ডাকবে । আমরা যেন তৈরি হয়ে থাকি । লোকের রেট ৩০০ টাকা ।
পরেরদিন ২২শে অক্টোবর, ২০১৩ মঙ্গলবার । চারটের সময়ে অ্যালার্ম বাজিয়ে ঘুম থেকে উঠে সাড়ে চারটের মধ্যে রেডি হয়ে নিলাম । বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, কাছাকাছির মধ্যে আমাদের রিসর্টের আলোগুলো জ্বলছে । আর সেইসঙ্গে ঠান্ডা । তারই মধ্যে আমরা অপেক্ষা করছি আমাদের গাইডের জন্য । সাড়ে চারটে - চারটে পঁয়ত্রিশ - পৌনে পাঁচটা । গাইড আর আসে না । দেখতে দেখতে পাঁচটাও বেজে গেল । নাঃ, সে এল না । পাঁচটা বেজে যাওয়ার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে এরপর সে এলেও আমরা আর যাব না, কারণ আমাদের টিফিনদাড়ায় পৌঁছনোর আগেই সূর্য্যোদয় হয়ে যাবে ।
|
"জাগো - নতুন প্রভাত" |
অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে ঘরে এসে আবার শুয়ে পড়লাম । আস্তে আস্তে অন্ধকারটা কেটে যেতে লাগল । আমি জেগেই ছিলাম আর এই সময়ে ঘরে বসে থাকার কোনও মানে হয় না । তাই আমাদের ব্যালকনিতে গিয়ে বসে রইলাম সেই ব্রাহ্মমূহুর্তে । (এটাকে ব্রাহ্মমূহুর্ত বলে কিনা ঠিক জানি না, কিন্তু এই শব্দটা ব্যবহার করতে খুব ইচ্ছে করছিল, তাই এটা এখানে লিখলাম !) দেখতে দেখতে সূর্য্য উঠল । যেন মনে হল "অন্তরে অন্তরে দাও আলো দাও / কালিমা কলুষ যত মুছে নিয়ে যাও" (এটা তখন মনে হয়নি, আসলে আজ ২৪শে অক্টোবর, মান্না দে মারা গেছেন, তাই এটা ওনার প্রতি একটা শ্রদ্ধার্ঘ্য !)
২২শে অক্টোবর আমাদের রিশপ ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন । আমাদের গন্তব্য কোলাখাম । আমাদের ট্রিপে আমরা দু'দিন রিশপ আর একদিন কোলাখামে থাকছি । সকাল দশটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট সেরে রিশপ থেকে কোলাখামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া হল । আবার সেই রাস্তা, কিন্তু একবার গিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছি ! রিশপ থেকে কোলাখাম যেতে প্রায় দু'ঘন্টা লাগে যদিও রাস্তা মাত্র ১৩ - ১৪ কিলোমিটার । কোলাখামও রিশপের মতোই লাভার ওপর নির্ভরশীল একটা গ্রাম । আমাদের যাওয়ার পথে স্বাভাবিকভাবেই পড়ল - লাভা ।
|
লাভা মনাস্ট্রি |
আমাদের ড্রাইভার নিজের দরকারে লাভায় কিছুক্ষণ দাঁড়ালো - একেবারে লাভা মনাস্ট্রির সামনে । আমার আর অমৃতার লাভা মনাস্ট্রি দেখা নয়, তাই আমরা সেটা দেখতে গেলাম । মনাস্ট্রিটা খুব সুন্দর । অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং ঝকঝকে রঙ করা । দেখতে সবমিলিয়ে মিনিট পনেরো লাগল ।
এরপর লাভা থেকে কোলাখাম । এই রাস্তাটা একেবারেই লাভা থেকে রিশপের মতো - একমাত্র পার্থক্য হল এর দৈর্ঘ্য ৭ - ৮ কিলোমিটার । পথের বিবরণের পুনরাবৃত্তি না করে সোজা কোলাখামে চলে যাচ্ছি, যদিও আমাদের যাত্রা কোলাখামে শেষ হল না । আমরা পাহাড়ী পথে গাড়ি করে আরও ৮ কিলোমিটার নেমে গেলাম - আমাদের গন্তব্য চাঙ্গে ফল্স্ ।
|
চাঙ্গে ফল্স্ |
চাঙ্গের রাস্তায় শেষ কিছটা আর গাড়ি যায় না, হেঁটে নামতে হয় । হেঁটে হেঁটে একেবারে নিচে নেমে চাঙ্গে । আগেরবার
কালুক ভ্রমণের সময়ে পেলিং এর কাছ থেকে চাঙ্গে ফল্স্ যা দেখেছিলাম এখানে তার থেকে অনেকটাই বড় দেখালো । কাছাকাছি গেলেই জলের ছিটেয় ভিজে যাচ্ছিলাম । আর সেইসঙ্গে অনেকটা ওপর থেকে জল পড়ার প্রচন্ড শব্দ - সবমিলিয়ে বর্ণনাতীত ।
ফল্স্ দেখে মন ভরে গেল ।
ফিরে এলাম কোলাখামে । রিশপ থেকে কোলাখামের গাড়িভাড়া ১,৪০০ টাকা, আমরা চাঙ্গে গেছিলাম বলে আরও ৮০০ টাকা বেশি পড়ল । কোলাখামে আমাদের রিসর্টের নাম 'ইকো গ্রীন হাটস্' - ঘরভাড়া ১,৭৬০ টাকা করে (ট্যাক্স সমেত) ।
|
আমাদের ঘরের ভেতর |
ঘর আমাদের খুবই পছন্দ হল । ডাব্ল্ বেড রুমের মধ্যে একটা করে সিঁড়ি আছে যেটা দিয়ে রুমের দোতলায় যাওয়া যায় । এই দোতলায় আবার আরেকটা বিছানা পাতা আছে । অর্থাৎ তিনজন এই ঘরে আরামসে থাকতে পারে ।
আমরা চানটান করে দুপুরে খেতে গেলাম । আমাদের ঘরের নিচেরতলাতেই ডাইনিং রুম । এগকারি আর ভাত খাওয়া হল । এখানে মিল সিস্টেমে ফুড প্যাকেজ নিতে হয় । একদিনের খাওয়ার খরচ মাথাপিছু ৪৫০ টাকা আর ঘরের সঙ্গে ব্রেকফাস্টটা ফ্রি । আমরা যেহেতু এইদিন সকালের জলখাবার (যেটা ব্রেকফাস্টের থেকে আলাদা) নিইনি, তাই আমাদের ৩৫০ টাকা করে পড়ল ।
|
কোলাখাম গ্রাম |
খাওয়ার পরে কোলাখাম ঘুরতে বেরোলাম । কোলাখাম রিশপের থেকেও ছোট জায়গা আর এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যই একমাত্র দেখার জিনিস । আমরা রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ঘরে এসে রেস্ট নিলাম । সন্ধ্যেবেলা সামনের পাহাড়ের ওপরে সূর্য্যাস্ত দেখলাম । কোলাখামের উচ্চতা ৬,২৫০ ফুট এখানে ঠান্ডা খুব কম । সারা সন্ধ্যে নিজেদের মতো আড্ডা দিয়ে সময় কেটে গেল । মাঝখানে একবার সিন্ডিকেটের অফিসে (যেটা আমাদের ঘর থেকে হেঁটে ৩০ সেকেন্ড লাগে) গিয়ে আমি আর সমীরণদা পরেরদিনের গাড়ি ঠিক করে এলাম ।
রাতে রুটি, আলুর তরকারি আর চিকেন কষা । এ'কথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে রিশপের থেকে কোলাখামের খাবারের মান অনেক ভালো ।
পরেরদিন ২৩শে অক্টোবর, ২০১৩ বুধবার - আমাদের ফেরার দিন । সকাল সকাল রেডি হয়ে ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে নিলাম । আটটার একটু পরে ব্রেকফাস্ট করে একটা বোলেরো গাড়িতে উঠলাম । কোলাখাম থেকে এন জে পি সরাসরি গাড়ি যায় না । আমাদের গাড়ি লাভা পর্যন্ত যাবে, আর তারপর লাভা থেকে সে আরেকটা গাড়ি ধরিয়ে দেবে । সেই গাড়ি আমাদের এন জে পি নিয়ে যাবে । কোলাখাম থেকে এন জে পি র গাড়িভাড়া ৩,৫০০ টাকা ।
আবার সেই ঝাঁকুনি রাস্তা ধরে ৮ কিলোমিটার - কিন্তু এবার একেবারেই বিরক্ত লাগছিল না কারণ এটা আমাদের ট্রিপের চতুর্থ তথা শেষ ঝাঁকুনি । লাভায় যখন পোঁছলাম তখন বেলা দশটা ।
|
ফেরার পথে |
লাভায় আমাদের একটা সুমো ধরিয়ে দেওয়া হল । এই গাড়ির ড্রাইভার আসতে কিছুক্ষণ দেরি করায় আমাদের লাভা থেকে বেরোতে বেরোতে এগারোটা বেজে গেল । ফেরার পথে যখন গরুবাথানে লাঞ্চ করলাম তখন দুপুর আড়াইটে । এটা রাস্তার পাশের একটা সাধারণ ভাতের হোটেল - দাম স্বাভাবিকভাবেই কম । মাংসভাতের দাম আমাদের মাথাপিছু পড়ল ১০০ টাকা করে ।
এরপর আবার নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন আর সেখান থেকে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস ধরে ফেরা । ট্রেন খুব সামান্যই লেট ছিল, তাই শিয়ালদহে নেমে ছ'টার মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে গেলাম !
সারসংক্ষেপঃ
১. নিউ জলপাইগুড়িতে নেমে যেসব জায়গায় যাওয়া যায়, রিশপ তাদের মধ্যে আরেকটা । শান্ত নিরিবিলি জায়গায় ছুটি কাটানো যাদের উদ্দেশ্য, তাদের জন্য বিশেষ উপযোগী ।
২. নিউ জলপাইগুড়ি থেকে রিশপের দুরত্ব ১৪০ কিলোমিটারের মতো । সিন্ডিকেটের গাড়ির রেট ৩,২০০ টাকা ।
৩. উচ্চতা ৮,০০০ ফুট । স্বাভাবিকভাবেই অক্টোবরের মাঝে এখানকার আবহাওয়া ঠান্ডার দিকে ।
৪. রিশপে বেশ কিছু রিসর্ট আছে যাদের মধ্যে আমাদের 'লাভলি রিসর্ট' উল্লেখযোগ্য । West Bengal Tourism Development Corporation থেকে এদের বুকিং করা যায় অথবা এদের ওয়েবসাইট
http://www.rishyap.com/ থেকেও বুকিং করা যেতে পারে ।
*এখানকার কেয়ারটেকার 'তারাপদ জ্ঞান' আমাদের পরিচিত । আমাদের মাধ্যমে এর সঙ্গে যোগাযোগ করলে বেশ কিছুটা কমে ঘর পাওয়া যাবে । অফ্ সিজনে খুব অল্প দামেই ঘর পাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় ।
৫. রিশপে বিশেষ কিছু দেখার নেই, তবে মনাস্ট্রিটা দেখে আসা যেতে পারে । আর ভোরবেলা উঠে টিফিনদাড়ায় গিয়ে সূর্য্যোদয় দেখাটা মিস্ করার কোনও মানেই হয় না ।
৬. রিশপ থেকে লাভা যাওয়ার একটা হাঁটা পথ আছে, সেই পথে লাভা ট্রেক করা যেতে পারে । তবে এটা এমনকিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয় ।
৭. রিশপে বিদ্যুতের একটু সমস্যা আছে, ঘরের আলো বেশিরভাগ সময়েই মিটমিট করে । রিসর্টে জেনারেটর থাকলেও নিজেদেরও কিছু ব্যবস্থা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া উচিৎ ।
৮. রিশপে কোনও দোকান বাজার নেই, সবথেকে কাছে লাভা ।
৯. রিশপে খাবারের দাম ঠিকঠাক । মাথাপিছু ৩৫০ - ৪০০ টাকা প্রতিদিন ।
১০. রিশপ থেকে কোলাখামের দুরত্ব ১৩ - ১৪ কিলোমিটারের মতো । গাড়িভাড়া ১,৪০০ টাকা ।
১১. কোলাখাম থেকে অবশ্যই চাঙ্গে ফল্স্ দেখতে যাওয়া উচিৎ । পাহাড়ের গা বেয়ে প্রবলবেগে আর প্রবল শব্দে নেমে আসা চাঙ্গে ফল্স্ এত কাছ থেকে এইভাবে দেখতে পাওয়া লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স !
১২. কোলাখামেও থাকার কিছু জায়গা আছে যার মধ্যে 'ইকো গ্রীন হাটস্' উল্লেখযোগ্য । এদের ওয়েবসাইট
http://www.hammockshutsholidays.com/. এখানকার ভাড়া ১,৭৬০ টাকা ।
১৩. এখানে খাওয়ার খরচ মাথাপিছু ৪৫০ টাকা করে ।
১৪. কোলাখাম থেকে এন জে পি র গাড়িভাড়া ৩,৫০০ টাকা ।
উপসংহারঃ
|
রিশপ |
প্রকৃতির মধ্যে যে একটা ঝকঝকে ব্যাপার আছে, আমরা যারা দূষণপ্রবণ জায়গায় থাকি, তারা সাধারণতঃ অনুভব করি না । রিশপে এই ঝকঝকে ব্যাপারটা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায় । এখানকার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য - এই সৌন্দর্য্যের টানেই রিশপ যাওয়া । এখানে সাইট সিয়িং করার কিছু নেই, শুধু দৈনন্দিন জীবন থেকে ছুটি নিয়ে পাহাড়ের কোলে দু'টো দিন বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রিশপ একেবারে আদর্শ জায়গা । শান্ত আর নিরিবিলি পরিবেশে প্রকৃতিকে উপভোগ করার সুযোগ রিশপের সবথেকে বড় আকর্ষণ । যদি এই পরিবেশ তোমাকে আকর্ষণ করে, তাহলে বেরিয়ে পড় রিশপ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে । শুধুমাত্র একটাই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ - পাহাড়িয়া এক্সপ্রেসে না যাওয়ার চেষ্টা কোরো !
রিশপের আরও ছবি দেখতে হলে click
here.