আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Sunday, January 10, 2021

কলকাতা ভ্রমণ : পর্ব - ২ (স্বামীনারায়ণ মন্দির)

শ দিন আগে নতুন বছর শুরু হয়েছে । আমাদের রাজ্যে তথা দেশে লক্‌ডাউন না থাকলেও করোনার অতিমারী পরিস্থিতি বর্তমান । এই পরিস্থিতিতে কোথাও বেড়াতে গিয়ে রাত্রিযাপন নিরাপদ নয় (যদিও চারপাশে অনেককেই এটা করতে দেখছি । সৌভাগ্যের বিষয় সেরকম কারুর সামাজিক সংস্পর্শে এখনও পর্যন্ত আমাকে আসতে হয় নি !), তাই আমরা ঠিক করেছি আপাতত শুধু ডে-আউট ট্রিপ করব । আর সেটা করার জন্য আমাদের প্রিয় শহর কলকাতার চেয়ে উপযুক্ত কিছু আছে কি ? তাও ভাবতে অবাক লাগে যে কলকাতা ভ্রমণের দ্বিতীয় পর্ব আজ লিখতে বসেছি, সেই কলকাতা ভ্রমণের পর্ব ১ লিখেছিলাম আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে ! সত্যিই, আমাদের এই প্রিয় শহরটার কত কি যে আজও আমাদের দেখা বাকি । এইরকম অদেখা দ্রষ্টব্যের লিস্টে একটা টিক্‌ দেওয়ার জন্য আমাদের এবারের সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ - স্বামীনারায়ণ মন্দির ।

১০ই জানুয়ারী ২০২১, রবিবার । দুপুরের খাবার খেয়ে বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে বেরোলাম আমি, অমৃতা, বাবা, মা আর কথা-কলি । কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে জোকা পেরিয়ে অল্প কিছুদূর গেলেই স্বামীনারায়ণ মন্দিরের অবস্থান - আমাদের বাড়ি থেকে দূরত্ব ২৮ কিলোমিটারের মতো (রাজভবন থেকে দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার) । পৌঁছতে লাগল ঠিক এক ঘন্টা ।

পার্কিং লট থেকে স্বামীনারায়ণ মন্দির
স্বামীনারায়ণ মন্দিরটা ডায়মন্ড হারবার রোডের উপরেই । গেট দিয়ে ঢুকে সুবিশাল পার্কিংলটে ৪০ টাকা দিয়ে গাড়ি রেখে আমরা মন্দিরের দিকে গেলাম । শীতকালের রবিবার বিকেল - তাই মন্দিরে ভীড় হয়েছে ভালোই । তবে চত্বরটা বিশেষ বড় হওয়ায় আর লোকসমাগম প্রচন্ডরকমের না হওয়ায় ঠাসাঠাসিটা হয়নি । পার্কিং লট থেকে মন্দিরে যাওয়ার পথে চোখে পড়ল এখানকার খাবারের জায়গা । 


এখানে সেইসঙ্গে একটা তালিকা চোখে পড়ল যেটা আমি এর আগে কখনও কোনও মন্দিরে দেখিনি । তালিকাটা হল গো-পালনের অর্থদানের । সেই তালিকা অনুযায়ী সবচেয়ে কম একটি গরু একদিন পালনের জন্য দানের অর্থ ৫০০/- থেকে সবচেয়ে বেশি ২৫টি গরু একবছর পালনের জন্য ২১ লক্ষ টাকা দেওয়া যেতে পারে (আমি নিশ্চিত এর বেশিও দেওয়া যায় !)। 

মন্দিরের সামনের চত্বর
খাবারের জায়গাটা পেরিয়ে মূল মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলাম । পুরো জায়গাটা খোলামেলা হওয়াতে সুবিশাল মন্দিরটা সব জায়গা থেকেই দেখা যায় । মন্দিরের সামনে একটা বিরাট মার্বেলের চত্বর, সেখানে লোকজন ইতস্ততঃ ঘোরাঘুরি করছে । মূল মন্দিরে ছবি তোলা নিষেধ, তাই এখানে দাঁড়িয়ে মন্দিরকে ডাইনে বাঁয়ে ওপরে নিচে রেখে বা আদৌ না রেখে নানারকম অ্যাঙ্গেলে লোকজন ছবি বা সেল্‌ফি বা গ্রুপফি তুলছে । এখানে বসার জায়গা নেই, তবে চত্বরের দু'পাশে ইঞ্চিআটেক উঁচু আর ফুটখানেক চওড়া ছোট্ট পাঁচিলের মতো করা আছে, সেখানে চাইলে বসা যেতে পারে ।

মন্দিরে ওঠার সিঁড়ি
এই চত্বরটা যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে মূল মন্দিরের ওঠার সিঁড়ি । এখানে ওঠার আগে অবশ্যই জুতো খুলতে হয় আর এখান থেকেই ছবি না তোলার এলাকা শুরু । পুরো জায়গাটায় প্রচুর সংখ্যক সিকিউরিটি গার্ড আর সেইসঙ্গে মন্দিরের কর্মীরা রয়েছেন, তাই কারুর চোখকে ফাঁকি দিয়ে কিছু করার চেষ্টা না করাই ভালো ! আমরা সিঁড়ি দিয়ে মূল মন্দিরের উপরে উঠলাম । উপর থেকে চারপাশের দৃশ্য খুবই সুন্দর । পুরো জায়গাটা ফাঁকা হওয়াতে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায় । বিকেল পৌনে পাঁচটা বাজে, এখান থেকে অস্তগামী সূর্যের দৃশ্যও বেশ ভালো লাগল ।

এখানে পাশাপাশি তিনটে প্রকোষ্ঠে তিনরকম মূর্তি রয়েছে । একটাতে ভগবান স্বামীনারায়ণ ও অক্ষরব্রাহ্মণ গুণতিআনন্দ স্বামী, একটাতে শ্রী ঘনশ্যাম মহারাজ আর তৃতীয়টায় শ্রী হরিকৃষ্ণ মহারাজ ও শ্রী রাধাকৃষ্ণদেব । মূর্তিগুলো খুব সুন্দরভাবে কারুকার্য করা আর সাজানো । আমরা কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে আবার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলাম ।

করোনা পরিস্থিতির জন্য কিনা জানি না, তবে মন্দির কর্তৃপক্ষ পুরো জায়গাটায় একমুখী জনতার স্রোত বজায় রেখেছে । অর্থাৎ আমরা যেদিক দিয়ে মন্দিরে উঠেছিলাম, সেদিক দিয়ে নামলাম না । নিচে নেমে বেরোনোর পথ মন্দিরের ভিতর দিয়ে । এখানে ভিতরের দেওয়ালে স্বামীনারায়ণ মহারাজের জীবনের নানারকম ঘটনাবলীর আঁকা ছবি টাঙানো রয়েছে । ঘরের মাঝখানে একটা কাচের ঘরের মধ্যে নীলকান্ত বর্ণির (ওরফে স্বামীনারায়ণ) একটা সোনার মূর্তি রয়েছে । এই ঘর ঘিরে দর্শনার্থীদের ভিড় রয়েছে । তাছাড়া এখানে মন্দির, স্বামীনারায়ণ ইত্যাদির সম্পর্কে বইও পাওয়া যায় । এখানেও ছবি তোলা নিষেধ, তাই আমরা কিছুক্ষণ দেখে বেরিয়ে এলাম ।

এখানে জানিয়ে রাখি মন্দির খোলা থাকার সময় সকাল ৭ঃ৩০ থেকে দুপুর ১২ টা এবং বিকেল ৪ টে থেকে রাত ৮ঃ১৫ । কিন্তু এর মাঝেও বিভিন্ন সময়ে মন্দির দর্শনের জন্য বন্ধ থাকে, তাই যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলে মন্দিরের ওয়েবসাইট থেকে দর্শনের সময়টা জেনে নিয়ে যাওয়াই ভালো । বর্তমান সময়সূচীটা আমি এখানে দিয়ে দিলাম (সৌজন্যে মন্দিরের ওয়েবসাইট)।










সন্ধ্যের আলোয় স্বামীনারায়ণ মন্দির
মন্দিরের সামনের চত্বরে পৌঁছে আমরা আরও কিছুক্ষণ বসে রইলাম । সন্ধ্যে হয়ে গেছে, মন্দিরের আলোগুলো সব জ্বলে গেছে । এইসময়ে মন্দিরটা দেখতে বেশ সুন্দর লাগে । তাই যদি মন্দিরে বিকেলের দিকে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকে, তাহলে সন্ধ্যে পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর বেরোলেই ভালো লাগবে । সন্ধ্যে ছ'টা নাগাদ আমরা মন্দির থেকে বেরিয়ে পড়লাম ।



উপসংহার ঃ

স্বামীনারায়ণ মন্দির
ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে কলকাতার দর্শনীয় জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম স্বামীনারায়ণ মন্দির । এর ভৌগোলিক অবস্থান এই জায়গাকে কিছু স্বাভাবিক বাড়তি সুবিধে দিয়েছে । নিজের গাড়ি নিয়ে গেলে যেমন এখানে পার্কিং-এর সুব্যবস্থা আছে, তেমনই পাবলিক ট্রান্সপোর্টে গেলে মন্দিরের গেটের একেবারে সামনে পর্যন্ত পৌঁছনোর সুবিধেও রয়েছে । এই মন্দিরের সবকিছুই ভীষণভাবে নিউ দিল্লীর অক্ষরধাম স্বামীনারায়ণের মন্দিরকে মনে করিয়ে দেয়, যদিও ওখানে কিছু বাড়াবাড়ি আছে যেগুলো এখানে নেই । এখানে না গেলে যে বিরাট কিছু অদেখা থেকে যাবে এমন নয়, কিন্তু সময় করে একদিন দেখে এলে ভালই লাগবে । পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখতে ঘন্টাখানেকের বেশি লাগবে না আর আমার মনে হয় স্বামীনারায়ণ মন্দির আমাদের সে'টুকু সময় লগ্নি করার যোগ্য !

স্বামীনারায়ণ মন্দিরের নিজস্ব ওয়েবসাইট https://www.baps.org/Global-Network/India/Kolkata.aspx থেকে এখানকার সম্পর্কে আরও তথ্য জানা যেতে পারে ।

No comments:

Post a Comment