আমার ব্লগের প্রথম পোস্ট হল বক্খালি ভ্রমণ । আজ থেকে ৮ বছর আগে যখন বক্খালি গিয়েছিলাম, তখন যাওয়ার পথে ডায়মন্ড হারবারে কিছুক্ষণের জন্য চা-বিরতি নেওয়া হয়েছিল । সময়টা ছিল ২০১০ সালের আগস্ট মাস - বর্ষাকাল - তখন ডায়মন্ড হারবারে নদীর রূপ দেখে আমাদের সকলেরই খুব ভালো লেগেছিল । যে পাঁচজন বন্ধুর সঙ্গে বক্খালি গিয়েছিলাম, কালের নিয়মে তাদের অনেকের সঙ্গেই আজ আর সেভাবে যোগাযোগ নেই । কিন্তু যেটা থেকে গেছে সেটা হল ডায়মন্ড হারবারকে ভালো লাগার সেই রেশটা - যেটাকে সম্বল করেই আমার এই তৃতীয়বার ডায়মন্ড হারবার পাড়ি দেওয়া (প্রথমবার গিয়েছিলাম বাবার সঙ্গে ২০০৪ সালে, তখন ব্লগ লিখতাম না)।
২রা অক্টোবর, ২০১৮ সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ গাড়ি নিয়ে বেরোলাম আমি আর অমৃতা । ডায়মন্ড হারবার আমাদের বাড়ি থেকে দু'ভাবে যাওয়া যায় । এক, বাইপাস - মা ফ্লাইওভার - হেস্টিংস - ডায়মন্ড হারবার রোড, এই পথে দূরত্ব ৫৮ কিলোমিটারের মতো । দুই, বাইপাস - এক্সটেন্ডেড বাইপাস - বারুইপুর আমতলা রোড - আমতলা মোড় - ডায়মন্ড হারবার রোড, এই পথে দূরত্ব ৬৭ কিলোমটারের মতো । রাস্তা বেশি হলেও আমরা এই দ্বিতীয়টাই পছন্দ করলাম কারণ এই রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম কম হয় । আমতলার মোড়টা একটু জ্যাম হয়, তবে সেটা পেরোনোর পর গাড়ির স্পীড নামানোর আর বিশেষ দরকার পড়ে না ।
ডায়মন্ড হারবার যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর প্রায় একটা বাজে । আমরা সবথেকে আগে লাঞ্চ করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম । ডায়মন্ড হারবারে হোটেল রেস্ট্যুরেন্ট অনেক আছে, তাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন দপ্তরের 'সাগরিকা'র লোকেশন বেশ ভালো । আমরা এখানে ঢুকে লাঞ্চ সেরে নিলাম । চিকেন বিরিয়ানি, ফ্রাইড রাইস আর চিকেন কারি নিয়ে মোট খরচ পড়ল ৪৩১/- টাকা ।
লাঞ্চ করে আমরা নদীকে ডানদিকে রেখে গাড়ি নিয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে গেলাম । নদীর পাড়টা খুব সুন্দর করে বাঁধানো, অনেক বসার জায়গাও আছে কিন্তু দুপুর রোদে সেখানে বসতে যাওয়াটা তসরিফের পক্ষে খুব আরামদায়ক হবে না, তাই সেটা আর করলাম না । (তসরিফ শব্দের মানে আমি জানি না । তবে উর্দুতে একটা কথা আছে 'তসরিফ রাখিয়ে' যার মানে 'বসুন' । তার থেকে তসরিফের যা মানে দাঁড়াচ্ছে, সেটাই এখানে ব্যবহার করলাম) রাস্তটা যেখানে নদীর ধার থেকে একটু ভিতরের দিকে ঢুকে গেছে, সেখান থেকে আরেকটা সরু রাস্তা নদীর পাড়ের দিকে এগিয়ে গেছে । আমরা এই রাস্তা ধরে কিছুটা চলে গেলাম । রাস্তাটা তিনশ' মিটার মতো গিয়ে মাঠের মধ্যে শেষ হয়ে গেছে । একটা গাছের ছায়ায় গাড়িটা রেখে আমরা নদীর ধারে গেলাম । এখানেও রোদ তবে বেশ কিছু গাছ থাকার জন্য তার ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ ভালো লাগছিল । আমরা এখানে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম ।
ডায়মন্ড হারবার জায়গাটা হুগলী নদীর ধারে । বৃটীশ আমলে যখন হুগলী নদী দিয়ে জাহাজ চলাচল করত, তখন সমুদ্রে পড়ার আগে এখানে জাহাজ শেষবারের মতো বিশ্রাম নিত । এই অঞ্চলে হুগলী নদী প্রায় ৪.৫ কিলোমিটার চওড়া - খালি চোখে শুধু অন্যপারের সীমারেখাটা দেখা যায় আর ক্যামেরার জুম লেন্সের সাহায্যে অন্যপারের কিছু কারখানার চিমনি ইত্যাদি দেখা যায় । অন্যপারটা হল পূর্ব মেদিনীপুর জেলা । হুগলী নদী ধরে ডায়মন্ড হারবার থেকে উত্তর দিকে গেলে রায়চক্ আর আরও উত্তরে গেলে গঙ্গা আর রূপনারায়ণের মিলনস্থল যার তিন পাড়ে তিনটে ছোট ছোট ট্যুরিস্ট স্পট - নূরপূর, গাদিয়াড়া আর গেঁওখালি । (এই তথ্যগুলো সাধারণ জ্ঞান বাড়ানোর জন্য দিচ্ছি, এর আর কোনও উদ্দেশ্য নেই বা আমাদের ডায়মন্ড হারবার ভ্রমণের সঙ্গেও বিশেষ সম্পর্ক নেই)
ডায়মন্ড হারবারের একটা প্রধান খ্যাতি হল পিকনিক স্পট হিসেবে । শীতকালে যখন পিকনিকের সিজ্ন চলে, তখন ছুটির দিনে এখানে পিকনিক স্পটে জায়গা পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে । আমরা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির শোভা উপভোগ করছিলাম, সেইসব জায়গাই লোকে গিজগিজ করে । আপাতত কিছু ছাগল, কিছু লোক্যাল ছেলে ছোকরা আর আইসক্রিমওয়ালা ছাড়া বিশেষ কেউ নেই । আমরা আইসক্রিমওয়ালার কাছ থেকে আইসক্রিম খেলাম ।
আর কিছু দেখার নেই, তাই ঘরে ফেরার পথে পা বাড়ালাম । ফেরার সময়েও একই রাস্তা আর সেই রাস্তা ধরে বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বাড়ি !
সারসংক্ষেপ ঃ
১. কলকাতার দক্ষিণে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায় ডায়মন্ড হারবার । কলকাতা থেকে দূরত্ব ৬০ কিলোমিটারের মতো ।
২. কলকাতার বিভিন্ন জায়গা থেকে ডায়মন্ড হারবার যাওয়ার প্রচুর বাস পাওয়া যায় । তাছাড়া শিয়ালদহ থেকে প্রত্যেক এক ঘন্টা অন্তর ডায়মন্ড হারবার লোক্যাল পাওয়া যায় যাতে করে ডায়মন্ড হারবার যেতে পৌনে দু'ঘন্টা মতো লাগে । ডায়মন্ড হারবার স্টেশন থেকে নদীর ধারের দূরত্ব অতি সামান্য যা অনায়াসে হেঁটেই যাওয়া যায় ।
৩. ডায়মন্ড হারবারে প্রচুর সংখ্যক খাবার হোটেল আর রেস্ট্যুরেন্ট আছে যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন বিভাগের সাগরিকা উল্লেখযোগ্য । এখানকার খাবারের মান বেশ ভালো এবং দামও বেশি নয় ।
৪. ডায়মন্ড হারবারে রাত্রিযাপনের খুব একটা মানে হয় না, তবে থাকতে চাইলে পূর্ণিমার রাতে থাকা শ্রেয় আর নদীর ধারের কোনও হোটেল বা রিসর্টে থাকতে পারলে ভালো । নদীর জলে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার প্রতিফলনের দৃশ্য চিত্তাকর্ষক হওয়া উচিৎ ।
৫. ডায়মন্ড হারবারে একটা পুরানো কেল্লার ভগ্নাবশেষ আছে যেখানে দেখতে গেলে শুধুই ভগ্ন - অবশেষ বিশেষ কিছুই নেই । এটা দেখতে যাওয়ার জন্য টাকা খরচ করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না ।
৬. এখানে একটা পরিত্যক্ত লাইট হাউস আছে যেটা দেখতে যাওয়া যেতে পারে । এছাড়া এখানে দেখবার সেরকম কিছুই নেই ।
৭. দুপুরের রোদের তেজ কমে যাওয়ার পর নদীর ধারে বসে থাকতে ভালো লাগবে । এখানে প্রায় ৫০০ মিটার নদীর পাড়ে বসার ব্যবস্থা করা আছে যা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় ।
৮. দুপুরের দিকে গেলে সূর্য্যাস্তের আগে ফিরে আসাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না । নদীর ওপরে সূর্য্যাস্তের দৃশ্য অবশ্যই দর্শনীয় ।
উপসংহার ঃ
কলকাতা থেকে খুব কাছাকাছি ঘোরার জায়গা যেগুলো আছে, ডায়মন্ড হারবার তার মধ্যে বেশ বিখ্যাত এবং চর্চিত । পিকনিক স্পট হিসেবে বা সপ্তাহান্তে ঘুরতে যাওয়ার জায়গা হিসেবে ডায়মন্ড হারবারের কথা জানে না, এরকম বাঙালি পাওয়া কঠিন । কিন্তু সেইসঙ্গে আবার 'ডায়মন্ড হারবারে আবার দেখার কি আছে !' এরকম একটা উন্নাসিকতাও দেখা যায় অনেক লোকজনের মধ্যে । না, ডায়মন্ড হারবার কোনও ট্যুরিস্ট প্লেস নয় । এখানে 'ফাইভ পয়েন্ট', 'সেভেন পয়েন্ট' দেখার জায়গা নেই । এখানে যেটা আছে সেটাই এখানকার ইউ এস পি । চোখের সামনে দিগন্তবিস্তৃত ভাগীরথী-হুগলী নদী যে তার ২,৬০০ কিলোমিটারের যাত্রা শেষ করে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে মিলিত হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই । এই বিশালত্বের সামনে গিয়ে পড়লে একটা বিশেষ অনুভূতিটা হয় সেটা লিখে বোঝানো বেশ মুস্কিল । এই অনুভূতির টানেই গিয়ে পড়া । সৌন্দর্য্য দৃশ্যের উপর নির্ভর করে না, দর্শকের দৃষ্টির উপর নির্ভর করে - বহুল প্রচলিত এই প্রবাদটার সত্যতা ডায়মন্ড হারবারে গেলে উপলব্ধি করা যায় । খ্যাপা সারা পৃথিবী ঘুরে পরশপাথর খুঁজে ফেরে যেখানে সত্যিকারের হীরে আমাদের মুঠোর মধ্যেই পাওয়া সম্ভব !
ডায়মন্ড হারবার ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.
২রা অক্টোবর, ২০১৮ সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ গাড়ি নিয়ে বেরোলাম আমি আর অমৃতা । ডায়মন্ড হারবার আমাদের বাড়ি থেকে দু'ভাবে যাওয়া যায় । এক, বাইপাস - মা ফ্লাইওভার - হেস্টিংস - ডায়মন্ড হারবার রোড, এই পথে দূরত্ব ৫৮ কিলোমিটারের মতো । দুই, বাইপাস - এক্সটেন্ডেড বাইপাস - বারুইপুর আমতলা রোড - আমতলা মোড় - ডায়মন্ড হারবার রোড, এই পথে দূরত্ব ৬৭ কিলোমটারের মতো । রাস্তা বেশি হলেও আমরা এই দ্বিতীয়টাই পছন্দ করলাম কারণ এই রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম কম হয় । আমতলার মোড়টা একটু জ্যাম হয়, তবে সেটা পেরোনোর পর গাড়ির স্পীড নামানোর আর বিশেষ দরকার পড়ে না ।
সাগরিকার জানালা থেকে নদীর দৃশ্য |
দাঁড়ানোর জায়গা |
নদীর উপর জাহাজ চলা |
পিকনিক স্পট |
আর কিছু দেখার নেই, তাই ঘরে ফেরার পথে পা বাড়ালাম । ফেরার সময়েও একই রাস্তা আর সেই রাস্তা ধরে বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বাড়ি !
সারসংক্ষেপ ঃ
১. কলকাতার দক্ষিণে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায় ডায়মন্ড হারবার । কলকাতা থেকে দূরত্ব ৬০ কিলোমিটারের মতো ।
২. কলকাতার বিভিন্ন জায়গা থেকে ডায়মন্ড হারবার যাওয়ার প্রচুর বাস পাওয়া যায় । তাছাড়া শিয়ালদহ থেকে প্রত্যেক এক ঘন্টা অন্তর ডায়মন্ড হারবার লোক্যাল পাওয়া যায় যাতে করে ডায়মন্ড হারবার যেতে পৌনে দু'ঘন্টা মতো লাগে । ডায়মন্ড হারবার স্টেশন থেকে নদীর ধারের দূরত্ব অতি সামান্য যা অনায়াসে হেঁটেই যাওয়া যায় ।
৩. ডায়মন্ড হারবারে প্রচুর সংখ্যক খাবার হোটেল আর রেস্ট্যুরেন্ট আছে যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন বিভাগের সাগরিকা উল্লেখযোগ্য । এখানকার খাবারের মান বেশ ভালো এবং দামও বেশি নয় ।
৪. ডায়মন্ড হারবারে রাত্রিযাপনের খুব একটা মানে হয় না, তবে থাকতে চাইলে পূর্ণিমার রাতে থাকা শ্রেয় আর নদীর ধারের কোনও হোটেল বা রিসর্টে থাকতে পারলে ভালো । নদীর জলে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার প্রতিফলনের দৃশ্য চিত্তাকর্ষক হওয়া উচিৎ ।
৫. ডায়মন্ড হারবারে একটা পুরানো কেল্লার ভগ্নাবশেষ আছে যেখানে দেখতে গেলে শুধুই ভগ্ন - অবশেষ বিশেষ কিছুই নেই । এটা দেখতে যাওয়ার জন্য টাকা খরচ করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না ।
৬. এখানে একটা পরিত্যক্ত লাইট হাউস আছে যেটা দেখতে যাওয়া যেতে পারে । এছাড়া এখানে দেখবার সেরকম কিছুই নেই ।
৭. দুপুরের রোদের তেজ কমে যাওয়ার পর নদীর ধারে বসে থাকতে ভালো লাগবে । এখানে প্রায় ৫০০ মিটার নদীর পাড়ে বসার ব্যবস্থা করা আছে যা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় ।
৮. দুপুরের দিকে গেলে সূর্য্যাস্তের আগে ফিরে আসাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না । নদীর ওপরে সূর্য্যাস্তের দৃশ্য অবশ্যই দর্শনীয় ।
উপসংহার ঃ
ডায়মন্ড হারবার ! |
ডায়মন্ড হারবার ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.
valo laglo
ReplyDeleteThank you!
Delete