আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Sunday, January 31, 2021

ক্ষীরাই ভ্রমণ

ক্ষীরাই জায়গাটার নাম বছরখানেক আগেও জানতাম না। বারবার লক্‌ডাউন আর আন্‌লকের অনিশ্চয়তার জেরে ৩-৪ দিনের বেড়ানোর পরিকল্পনা করা যখন খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন কাছাকাছির মধ্যে কোথায় ডে-আউট ট্রিপ করা যায় সেটা খুঁজতে গিয়ে ইউটিউবে ক্ষীরাই-এর সম্পর্কে একটা ভিডিও পেলাম। ক্ষীরাই পূর্ব মেদিনীপুর জেলার একটা গ্রাম যেখানে ফুলের চাষ হয়। এখানে বহুসংখ্যক সুবিশাল আকৃতির ক্ষেত আছে, যে ক্ষেতের ফুল পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানী করা হয়। ভিডিওটা বেশ তথ্যসমৃদ্ধ আর সবটা ভালো করে দেখে এবং সেইসঙ্গে নিজে ইন্টারনেটে কিছুটা ঘাঁটাঘাঁটি করে জায়গাটা সম্পর্কে মোটামুটি জেনে ফেললাম। তারপর প্ল্যান করা আর সেই প্ল্যানের এক্সিকিউশন। গন্তব্য ক্ষীরাই - আমার ব্লগের এবারের পোস্ট।

৩১শে জানুয়ারী, ২০২১ রবিবার - সকাল ৮টা নাগাদ গাড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোলাম আমরা ছ'জন অর্থাৎ আমি, অমৃতা, বাবা, মা, কথা, কলি। যাওয়ার পথে সোনামাসিকেও তুলে নিলাম। আমাদের যাত্রাপথ বিদ্যাসাগর সেতু - কোনা এক্সপ্রেসওয়ে - এন এইচ ১৬ - পাঁশকুড়া পুরাতন বাজার রোড - বাকিটা জিজ্ঞেস করে অথবা গুগ্‌ল্‌ ম্যাপ দেখে। বিদ্যাসাগর সেতু থেকে মোট রাস্তা ৮৫ কিলোমিটার। ধুলাগোড়ীর কাছে একটা পাঞ্জাবী রেস্ট্যুরেন্ট থেকে আলুর পরোটা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম।

দুপুর সাড়ে বারোটার একটু পরে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে আমরা অবশেষে ক্ষীরাই পৌঁছলাম। এখানে জানিয়ে রাখি, ক্ষীরাই বলতে কিন্তু বিশেষ কোনও একটা জায়গা বা ফুলের ক্ষেতকে বোঝায় না। এখানে অনেক জায়গাতেই এই ক্ষেত দেখা যায়, তবে সবথেকে বেশি বিখ্যাত যে জায়গাটা সেটা হল রেলব্রীজের নিচে। শেষের পথটা বেশ সরু, দু'টো গাড়ি পাশাপাশি চলতে বেশ অসুবিধে হয়। যাই হোক, উঁচুনীচু পথ দিয়ে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে ... একটা বড় ধাক্কা খেলাম !

রেলব্রীজের নিচে গাড়ির মেলা
এর আগে ক্ষীরাই সম্পর্কে যা জানা ছিল তাতে জানতাম জায়গাটায় খুব বেশি লোক যায় না। আমরা গিয়ে দেখলাম হাজার হাজার লোক ! জানলাম জানুয়ারী মাসের একটা রবিবারের আনন্দবাজার পত্রিকায় ক্ষীরাই সম্পর্কে একটা লেখা বেরিয়েছে আর তাতেই অনেকে জায়গাটার সম্পর্কে জানতে পেরেছে। আর আমাদেরই মতো এই লক্‌ডাউনে দূরে কোথাও যেতে না পেরে এখানে এসে জুটেছে। যতদূর চোখ যায়, ফুলগাছের চেয়ে মানুষের সংখ্যা বেশি। রেলব্রীজের নিচে যেন মেলা বসেছে। মেলা যে শুধু মানুষের তাইই নয়, গাড়িরও। পুরো জায়গাটায় যত গাড়ি এসে উপস্থিত হয়েছে তত গাড়ি শুধু রবিবার বিকেলে কলকাতার শপিং মলের পার্কিং লটেই দেখা যায় ! আর এখানে পার্কিং ম্যানেজ করার কেউ নেই, যে যার সুবিধেমতো গাড়ি রাখছে। আমরাও সেরকমই করলাম। ব্যতিক্রমই যেখানে নিয়ম, সেখানে আলাদা করে নিয়ম মানার চেষ্টা করা বৃথা (এটা দারুণ দিলাম, তাই না ? এটা একেবারে মৌলিক - আমার নিজস্ব - কপিরাইট প্রোটেক্টেড !)।

রেলব্রীজের পাশে গাঁদাফুলের ক্ষেত
রেলব্রীজটা আসলে কংসাবতী নদীর উপরে যদিও এখন নদীতে জল নেই। নদীর উপরেও অনেকে গাড়ি পার্কিং করেছে, ফেরিওয়ালারা নানারকম জিনিস নিয়ে বসে গেছে। রেলব্রীজের নিচ দিয়ে ব্রীজটা পেরিয়ে গেলে কয়েকটা বিশাল গাঁদাফুলের ক্ষেত রয়েছে, কিন্তু ভীড় দেখে আমরা আর সেদিকে এগোলাম না। বরং স্থানীয় লোকের কাছে জানা গেল এখান থেকে মিনিট দশেকের টোটো দূরত্বে আরেকটা এরকম বড় ক্ষেত রয়েছে, সেখানে চাইলে যাওয়া যেতে পারে। আমরা হেঁটে নদী পেরিয়ে ওপারে গিয়ে একটা টোটো ধরে গেলাম সেই ক্ষেতে।

চন্দ্রমল্লিকার ক্ষেত
এই ক্ষেতটা বিশেষ করে চন্দ্রমল্লিকার। সাদা হলুদ কমলা সবুজ ইত্যাদি নানারঙের চন্দ্রমল্লিকার দিগন্তবিস্তৃত ক্ষেত। এর মধ্যে সাদাটাই বেশি। দেখে মনে হয় সুবিশাল মাঠের মধ্যে যেন বরফ পড়েছে। এই ক্ষেতের মধ্যে ঢুকে গিয়ে ফুলের গায়ে হাত দিতে বারণ নেই, তবে সেটা না দেওয়াই ভালো। ক্ষেতের মধ্যে বাঁশের বেড়া দিয়ে পাঁচিল করা রয়েছে, তার মধ্যে দিয়ে হাঁটার পথ। আমরা হেঁটে হেঁটে ক্ষেতের অনেকটা ভিতরে চলে গেলাম। এখানেও লোকজনের সংখ্যা খুব কম নয়, তবে অনেকটা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ফুলের ক্ষেতের মধ্যে কয়েকটা স্থানীয় বাচ্চা ছেলেমেয়ে ফুলের মুকুট বিক্রি করছে। সরু তার দিয়ে ফুল গেঁথে তৈরি, দাম ১০/- টাকা। আমরা কয়েকটা কিনলাম।

ফুলের ক্ষেতে ফুলের মুকুট পরে ফুলেরা আর ফুলকি
ফুলের ক্ষেতে আমরা আরও কিছুক্ষণ কাটালাম, তবে এর বিবরণ আলাদা করে দেওয়ার আর কিছু নেই। ক্ষেতগুলো সব একইরকম, ফুলগুলো আলাদা। আরও কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে একজায়গায় দেখলাম ক্ষেতের মধ্যেই একটা ছাউনি ধরনের করে সেখানে একটা অস্থায়ী ভাতের হোটেল খুলে ফেলেছে। ক্ষীরাই এর ফুলের ক্ষেতের মধ্যে খাবারের ব্যবস্থা কিছুই নেই, তাই আমরা এখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। রান্না বেশ ভালো। ভাত, ডাল, ডিমের কারি, চিকেন ইত্যাদি নিয়ে খরচ হল ৩৫০/- টাকা।

রেললাইনের উপরে
খাওয়ার পরে আমরা আরও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে টোটো ধরে রেলব্রীজের নিচ পর্যন্ত ফিরে এলাম। এই রাস্তাটায় কিছু গাড়ি নিয়ে চলাচল করা একেবারেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না কারণ এখানে রাস্তা পিচের নয় আর একটামাত্র গাড়িই চলাচল করতে পারে। উল্টোদিক থেকে একটা বাইক এসে গেলেও রাস্তায় যানজট হয়ে যাবে। রেলব্রীজের নিচে পৌঁছে আমি, কথা আর কলি একবার ব্রীজের উপরটা ঘুরে এলাম। এখানে পাশেই দক্ষিণপূর্ব রেলওয়ের ক্ষীরাই স্টেশন। এই লাইনে বেশ ঘনঘন ট্রেন চলাচল করে, কয়েকটা ট্রেন দেখারও সুযোগ হয়ে গেল।

দুপুর সাড়ে তিনটে বাজে, ক্ষীরাইতে আর কিছু করার নেই তাই আমরা গাড়ি নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। যে পথে যাওয়া, সেই পথেই ফেরা। ফেরার পথে কোলাঘাট পেরোনোর একটু পরে একজায়গায় দাঁড়িয়ে একটু চা খেয়ে নেওয়া হল। তারপর আবার বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম।

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় পাঁশকুড়ার কাছে একটা গ্রাম ক্ষীরাই। ফুলচাষ ও ফুলের রপ্তানীর জন্য এই গ্রাম বিখ্যাত।
২. ক্ষীরাই যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হল ফ্রেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি থেকে মার্চের মাঝামাঝি। এই সময়ে এখানকার ক্ষেতে অন্যান্যফুলের সঙ্গে গোলাপও দেখা যায়।
৩. গাড়ি করে যাওয়ার রাস্তা হল বিদ্যাসাগর সেতু - কোনা এক্সপ্রেসওয়ে - এন এইচ ১৬ - পাঁশকুড়া পুরাতন বাজার রোড। শেষের পথটা গুগ্‌ল্‌ ম্যাপ দেখে বা স্থানীয় লোককে জিজ্ঞেস করে যেতে হবে। 
৪. ট্রেনে গেলে হাওড়া থেকে দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের লোক্যাল ট্রেন ধরে (এক্সপ্রেস ট্রেন এখানে থামে না) পাঁশকুড়ার পরের স্টেশন ক্ষীরাইতে নামতে হবে। হাওড়া থেকে ক্ষীরাই ট্রেনে ১ঃ৫০ মিনিট সময় লাগে।
৫. গাড়ি অথবা ট্রেন যাতেই যাওয়া হোক, ঘুরে ঘুরে ফুলের ক্ষেত দেখার জন্য টোটো ভাড়া করে নেওয়াই ভালো। তাতে আরেকটা সুবিধে এই যে টোটোর ড্রাইভাররা ফুলের ক্ষেতের জায়গাগুলো ভালোভাবে চেনে।
৬. ক্ষীরাইতে নানারকম ফুলের বাগান আছে, যার মধ্যে গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিকার প্রাধান্য বেশি। এখানে বিভিন্ন ফুলগাছের চারা বিক্রিও হয়।
৭. ক্ষীরাইতে খাওয়াদাওয়ার বিশেষ কোনও জায়গা নেই, তাই সঙ্গে অবশ্যই কিছু শুকনো খাবার রাখা উচিৎ। ছুটির দিনে ভিড় বেশি হলে এখানে কিছু অস্থায়ী খাবারের ব্যবস্থা হয় ঠিকই, কিন্তু তার উপর নির্ভর না করাই ভালো।

উপসংহারঃ

ক্ষীরাই
কলকাতার বেশ কাছে একটা ছোটখাটো ডে-আউট প্ল্যানের জন্য ক্ষীরাই বেশ ভালো একটা জায়গা। নানারকমের ফুলের ক্ষেতের সমারোহে জায়গাটায় একটা নয়নাভিরাম ব্যাপার আছে, সেটা বলতেই হবে। দিগন্তবিস্তৃত জমিতে যতদূর দু'চোখ যায়, মনে হয় নানারঙের চাদর বিছানো রয়েছে। যদিও এখানকার সৌন্দর্য প্রকৃতির স্বাভাবিক সৃষ্টি নয়, বরং বলা যায় প্রকৃতির দাক্ষিণ্যে মানুষের সৃষ্টি, কিন্তু তাও এখানকার সৌন্দর্য বিশেষ মনোরম। ক্ষীরাইতে অনেককিছু দেখার আছে তা নয়, তবে ঘোরাঘুরি করে সারাদিনটা বেশ কেটে যায়। গাড়িতে বা ট্রেনে যেভাবেই যাওয়া হোক, যাতায়াতের রাস্তাটাও বেশ সুন্দর। করোনার লক্‌ডাউনের মধ্যে বাড়িতে বসে থাকার একঘেয়েমি কাটানোর জন্য এখানে যাওয়া যেতেই পারে। আর করোনা পরবর্তী সময়েও এখানে একটা দিন কাটাতে ভালো লাগবে বলেই আমার ধারণা। তবে রবিবার বা ছুটির দিনগুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করাই ভালো, কারণ 'মানুষ' জীবটা যতই প্রকৃতির সৃষ্টি হোক, ফুলের ভীড়ের মাঝে তাদের ভীড়টা শুধু অনভিপ্রেতই নয়, বিরক্তির উদ্রেককারীও বটে !

ক্ষীরাই ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

4 comments: