আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Friday, June 7, 2013

শিলং ভ্রমণ

'প্যারাডাইস্‌ আনএক্সপ্লোর্ড' কাকে বলে ? আমরা অনেকেই জানি না এর দ্বারা ভারতের নর্থ-ইস্টের সাতটা রাজ্যকে বোঝায় । সেই সাতটা রাজ্য যাদের নাম চট্‌ করে বলতে গেলে একটা-দু'টো বাদ চলে যায় । সেই সাতটা রাজ্য আমাদের কাছে যাদের অস্তিত্ব শুধু জঙ্গী হামলার খবরে । সেই সাতটা রাজ্যের দু'টোতে আমাদের এবারের ভ্রমণ - মেঘালয়ের শিলং আর আসামের গুয়াহাটি ।

গুয়াহাটী যাওয়ার পথে
১লা জুন, ২০১৩ - শনিবার । হাওড়া স্টেশন থেকে সরাইঘাট এক্সপ্রেস । শিলং পর্যন্ত ট্রেন যায় না, সবচেয়ে কাছের রেলস্টেশন গুয়াহাটি । হাওড়া বা কলকাতা থেকে গুয়াহাটি যাওয়ার সবথেকে ভালো ট্রেন সরাইঘাট এক্সপ্রেস । ছাড়ে দুপুর ৩ : ৫০ এ । আমি, আমার স্ত্রী, বাবা, মা, আমার বড়মাসি আর মেসোমশাই । ছ'জন থাকায় আমরা ট্রেনের একটা ছ'জনের জায়গার পুরোটাই পেয়েছিলাম । এরকম একটা জায়গায় হৈ হৈ করতে করতে যাওয়ার মজাই আলাদা ! গুয়াহাটি যাওয়ার পথটা কিন্তু খুব অন্যরকম । নিউ কোচবিহার পেরোনোর পর পথের দু'ধার জুড়ে মাঝে মাঝে পাহাড় । কখনও দূরে পাহাড়ের মাথায় মেঘ । রেললাইন কখনও মাটি থেকে অনেক ওপরে উঠে যাচ্ছে, কখনও সমতলে নেমে আসছে । মাঝে মাঝেই হিমালয় থেকে নেমে আসা নদীগুলো পায়ের নিচ দিয়ে চলে যাচ্ছে ।

ব্রহ্মপুত্রের উপর নরনারায়ণ সেতু
গুয়াহাটী যাওয়ার পথে একটা প্রধান আকর্ষণ হল ব্রহ্মপুত্রের ওপর দিয়ে রেলব্রীজ । এই ব্রীজের নাম নরনারায়ণ সেতু । ২.২ কিলোমিটার চওড়া এই ব্রীজের ওপর দিয়ে যখন ট্রেন যায় তখন নিচের ব্রহ্মপুত্রকে দেখতে অসাধারণ লাগে । এই ব্রীজের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল এটা ডাবল্‌ - ডেক ব্রীজ অর্থাৎ রেল ও সড়ক দু'রকম পরিবহনের ব্যবস্থা আছে ।


গুয়াহাটী স্টেশন
আমরা গুয়াহাটি পৌঁছলাম সকাল ন'টা নাগাদ । স্টেশন থেকে বেরিয়েই সামনে গাড়ির স্ট্যান্ড - এখান থেকে আসাম বা মেঘালয়ের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার জন্য গাড়ি পাওয়া যায় । শিলং যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়াও করা যেতে পারে অথবা শেয়ারেও যাওয়া যেতে পারে । আমরা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বাসের খোঁজ করে জানলাম ওই সময়ে ওখান থেকে শিলং-এর কোনও বাস নেই । আমরা একটা শেয়ারের সুমো নিলাম । মাথাপিছু পড়ল ১৭০/- ।

গাড়িতে শিলং যাওয়ার পথে
পশ্চিমবঙ্গ বা সিকিমের কোথাও বেড়াতে গেলে আমরা সাধারণতঃ ট্রেন থেকে নেমে আরও উত্তর দিকে এগিয়ে যাই । শিলং কিন্তু গুয়াহাটির দক্ষিণে । কাজেই, এখানে একটা আন-কনভেনশনাল ব্যাপার আছে । গুয়াহাটি থেকে শিলং-এর ১০৫ কিলোমিটার রাস্তা এমনিও খুব সুন্দর । আমি এর আগে পাহাড়ী রাস্তা যেরকম দেখেছি এই রাস্তাটা কিন্তু একেবারেই সেরকম নয় । প্রথমতঃ অনেকটা পর্যন্ত রাস্তাটা ডাবল্‌ওয়ে । রাস্তার দু'দিকের প্রকৃতি অত্যন্ত মনোরম । একেবারে শেষ অংশটা বাদ দিলে প্রায় কোথাওই রাস্তার একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে খাদ - এই চিরাচরিত ব্যাপারটা নেই ।

পুলিশ বাজার @ শিলং
আমাদের গাড়ি ছেড়েছিল সাড়ে দশটায় আর আমরা শিলং পৌঁছলাম দেড়টার একটু পরে । শিলং শহরের প্রাণকেন্দ্র বলা যেতে পারে পুলিশবাজার - এখানে প্রচুর হোটেল আছে । লোকজনকে জিজ্ঞেস করে আমরা আমাদের 'হিল স্টার হোটেল'- এ পৌঁছে গেলাম । আমাদের একটা টু-বেড আর একটা ফোর বেড রুম বুক করা ছিল । ভাড়া যথাক্রমে ৭০০/- ও ১,২০০/- ঘরগুলো দারুণ কিছু নয়, তবে দিব্যি থাকা যায় । ঘরে টিভি আর বাথরুমে গিজার আছে । হোটেলে পোঁছে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে নিলাম । হিল স্টার হোটেলের খাবার বেশ উন্নতমানের এবং দাম বেশ কম । ছ'জনের মিলিয়ে আমাদের পড়ল মোট ৫৩০/- ।

শিলং শহর - হোটেলের ব্যালকনি থেকে
প্রথমদিন কোথাও ঘোরার নেই - বিকেলে বেরোলাম পরেরদিনের ঘোরাঘুরির ব্যবস্থা করতে । শিলং থেকে যাওয়ার জায়গা বলতে প্রধানতঃ চেরাপুঞ্জি - এছাড়া নারটিয়াং-ও যাওয়া যেতে পারে । এর সঙ্গে আছে শিলং-এর লোক্যাল সাইটসিয়িং । ঘোরাঘুরির জন্য সবথেকে ভালো ব্যবস্থা হচ্ছে এম টি ডি সি-র (মেঘালয় ট্যুরিজম্‌ ডেভেলপ্‌মেন্ট কর্পোরেশন) বাস । পুলিশ বাজারেই এম টি ডি সি-র অফিস, এখান থেকে বিভিন্নদিন ঘোরাঘুরির জন্য বাসের টিকিট পাওয়া যায় । বড় গ্রুপ থাকলে এদের কাছ থেকে গাড়ি বা বাস বুকিং-ও করা যেতে পারে । আমরা পরেরদিন অর্থাৎ সোমবার চেরাপুঞ্জি যাওয়া আর মঙ্গলবার লোক্যাল সাইটসিয়িং করা ঠিক করলাম । চেরাপুঞ্জির জন্য টিকিটের দাম মাথাপিছু ২৩০/- আর লোক্যাল এর জন্য মাথাপিছু ২০০/- সবমিলিয়ে আমাদের পড়ল ২,৫৮০/- যেটা যথেষ্টই কম । পরে খোঁজ নিয়ে দেখেছিলাম যে নিজেরা গাড়ি ভাড়া করে এই ঘোরাঘুরি করতে গেলে আমাদের ৫,০০০/- পড়ে যেত ।

রাতের শিলং - হোটেলের ব্যালকনি থেকে
শিলং কিছুটা হলেও গন্ডগোলের জায়গা - চেনাজানা অনেকেই আমাদের সাবধান করে দিয়েছিল যে সন্ধ্যে সাতটার পরে যেন আর রাস্তায় না থাকি । আমাদের ফিরতে ফিরতে সাতটা বেজে গেল । খেয়াল করলাম এর মধ্যেই রাস্তায় লোকচলাচল কমে গেছে আর দোকানগুলোর অনেকগুলোই বন্ধ হয়ে গেছে । শিলং-এ সবথেকে বেশি যেটা চোখে পড়ে সেটা হচ্ছে রাস্তায় পুলিশ আর মিলিটারির লোকের আধিক্য । কলকাতায় বনধ্এর দিন বা পুজোর দিনে যেরকম পুলিশ প্রশাসনের লোক দেখতে পাওয়া যায়, শিলং-এ সবসময়েই তত পুলিশ থাকে । রাতে আমরা হোটেল থেকেই খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম ।

৩রা জুন, ২০১৩ - সোমবার । চেরাপুঞ্জি যাওয়ার জন্য এম টি ডি সি-র অফিসে রিপোর্টিং টাইম সকাল ৭:৪৫ আর বাস ছাড়ে ঠিক আটটায় । চেরাপুঞ্জি ট্রিপে এম টি ডি সি মোট আটটা জায়গায় ঘোরায় ।  পাহাড়ী পথে ওঠানামার মধ্যে দিয়ে ঘন্টাখানেক চলার পৌঁছলাম আমাদের প্রথম গন্তব্যে ।

(এখানে বলে রাখি, আমরা যে জায়গাগুলোয় ঘুরেছি, সেগুলোর নামের ইংরিজী বানানই আমার জানা আছে । বাংলা বানান লিখতে গেলে কিছু কিছু জায়গায় উচ্চারণগত ত্রুটির সম্ভাবনা আছে । এই ত্রুটি তোমার ক্ষমা করার কোনও দরকার নেই কারণ আমি ক্ষমা চাইছি না ।)

মাওক্‌ডক্‌ ভ্যালি
প্রথম দ্রষ্টব্যঃ মাওক্‌ডক্‌ ভ্যালি
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ১৫ মিনিট
টিকিটঃ লাগে না
এখানে পাহাড়ের গা বেয়ে সিঁড়ি বেয়ে বেশ কিছুটা নামতে হয় । নিচে নেমে রেলিং দিয়ে ঘেরা একটা চওড়া প্ল্যাটফর্ম আছে, সেখান থেকে দু'পাশের পাহাড়ের মাঝের জায়গাটা দেখতে খুব সুন্দর লাগে । এছাড়া সিঁড়ি  দিয়ে নামার সময়ে একটা ছোট্ট পাহাড়ী নদী দেখতে পাওয়া যায় । পুরোটা নামতে প্রায় পঞ্চাশটার মতো সিঁড়ি ভাঙতে হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সেটা পুষিয়ে দেয় ।

বাস যেখানে দাঁড়ায় সেখানে কিছু ছোট খাবারের দোকান আছে । সকালে ব্রেকফাস্ট না করা থাকলে এখানে মোমো, ডিমসেদ্ধ, চা খেয়ে নেওয়া যেতে পারে ।

ইকো পার্ক
দ্বিতীয় গন্তব্যঃ ইকো পার্ক
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ২০ মিনিট
টিকিটঃ মাথাপিছু ১০/-, ক্যামেরা ১৫/-
এখানেও কিছুটা সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়, তবে সিঁড়ির সংখ্যা বড়জোর ১৫ টা । নিচে নেমে একটা বিরাট সমতল জায়গা, সেখান দিয়ে একটা জলের ধারা গড়িয়ে পাহাড় থেকে বহুনীচে পড়ে যাচ্ছে । জায়গাটায় বেশ মেঘ ছিল আর দৃশ্য খুবই সুন্দর । ভালো করে দেখতে গেলে এই জায়গাটা কিছুতেই ২০ মিনিটে দেখে ফেলা সম্ভব নয়, কিছুটা বেশি সময় লাগবেই । তবে দেরি হলে বারবার হর্ণ দেওয়া ছাড়া বাস আর কিছু করে না !

মাওস্‌মাই কেভের ভেতরে
তৃতীয় গন্তব্যঃ মাওস্‌মাই কেভ
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ৩০ মিনিট
টিকিটঃ মাথাপিছু ১০/-, ক্যামেরা ১৫/-
চেরাপুঞ্জির সাইট সিয়িং-এর সবচেয়ে সুন্দর আর আকর্ষণীয় জায়গা ! যদি শরীর আর মনের জোর থাকে, তাহলে এই জায়গাটা দেখা অবশ্য কর্তব্য । পাহাড়ের মধ্যে একটা অসাধারণ সুন্দর প্রাকৃতিক গুহা যার ভেতরে স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইট । ভেতরে পুরোটাই বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করা আছে, কাজেই অন্ধকারে হাতড়ানোর কোনও ব্যাপার নেই । ভেতরের পথ কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু, কোথাও মাথা সোজা করে হাঁটতে হয়, কোথাও মাথা নিচু করে আবার কোথাও একেবারে হামাগুড়ি দিয়ে । একটা বিশেষ জায়গা আছে যেখান দিয়ে গলার পথটা এতটাই ছোট যে মনে হয় বোধহয় মোটা মানুষ গলতে পারবে না । কিন্তু শরীর ভাঁজ করে, মাথা আর পা আগুপিছু করে ঠিক গলে যাওয়া যায় । ভেতরে জুতো খুলে যাওয়াই ভালো কারণ অনেক জায়গাতেই গোড়ালিডোবা জল আছে । তাছাড়া জুতো পরে ভিজে পাথরের মধ্যে হাঁটতে গেলে পা হড়কানোর সম্ভাবনাও থাকবে ।

গুহাটা সবমিলিয়ে ১৫০ মিটার মতো লম্বা । পাথরের ওপর পা ফেলে, মাথায় পাথরের গুঁতো খেয়ে আর ভেতরের অসাধারণ দৃশ্য দেখতে দেখতে এই পথচলাটা - লাইফটাইম্‌ এক্সপেরিয়েন্স !

(বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ - কিছু লোক থাকে যারা প্রাকৃতিক আর কৃত্রিম জিনিসের মধ্যে কোনও ফারাক খুঁজে পায় না । যেমন আমাদের বাসে থাকা একজন ভদ্রলোককে বলতে শুনলাম "এ আর এমন কি, আমাদের কলকাতার নিক্কো পার্কেও এরকম আছে ।" তোমার মানসিকতা যদি এরকম হয়, তাহলে মাওস্‌মাই কেভ কিন্তু তোমার জন্য নয় !)

এই অঞ্চলে কিছু খাবারের দোকান ছাড়াও কিছু জিনিসপত্রের দোকানও আছে ।

সেভেন সিস্টার ফল্‌স্‌
চতুর্থ গন্তব্যঃ নসঙ্গিথিয়াং ফল্‌স্‌ (সেভেন সিস্টার ফল্‌স্‌ )
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ১০ মিনিট
টিকিটঃ লাগে না
পাহাড়ের ধারে একটা রেলিং দিয়ে ঘেরা জায়গা যেখান থেকে অন্য একটা পাহাড়ের গায়ের পাশাপাশি সাতটা ঝর্ণা দেখতে পাওয়া যায় । গুনলে সাতের বেশিই হবে, আর কোন সাতটা একই মায়ের সন্তান সেটা বোঝার কোনও উপায় নেই । তবে দৃশ্যটা সবমিলিয়ে বেশি সুন্দর ।

বাংলাদেশ !
পঞ্চম গন্তব্যঃ মাও ট্রপ্‌
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ১৫ মিনিট
টিকিটঃ লাগে না
এটা চেরাপুঞ্জির আরেকটা আকর্ষণীয় জায়গা । এখানে পাহাড়ের ওপরে একটা রেলিং ঘেরা জায়গা থেকে নিচে বাংলাদেশ দেখা যায় । দৃশ্যটা যে খুব স্পষ্ট তা নয়, কারণ জায়গাটা কিছুটা মেঘাচ্ছন্ন, আর সোজাসুজি দেখা গেলেও দূরত্বটা নেহাৎ কম নয় । আমরা পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে আছি, নিচে যতদূর চোখ যায় নদীনালা ঘেরা সমতলভূমি - বাংলাদেশ । 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' (এটা এমনি লিখলাম, অতকিছুও ইমোশনাল হয়ে পড়িনি !)

থাঙ্খারাং পার্ক
ষষ্ঠ গন্তব্যঃ থাঙ্খারাং পার্ক
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ২০ মিনিট
টিকিটঃ মাথাপিছু ৫/-, ক্যামেরা ১০/-
এটা একটা বটানিক্যাল গার্ডেন ধরনের জায়গা । অনেকরকম গাছ আছে, তবে ফুলগাছের সংখ্যাই বেশি । এখান থেকে অন্য একটা পাহাড়ের গায়ে একটা ঝর্ণা দেখতে পাওয়া যায় আর তার সঙ্গে দেখা যায় - বাংলাদেশ । 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' (এবারও এমনিই লিখলাম !)

রামকৃষ্ণ মিশন
সপ্তম গন্তব্যঃ রামকৃষ্ণ মিশন
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ২০ মিনিট
টিকিটঃ লাগে না
রামকৃষ্ণ মিশন আলাদা করে দেখার কিছু নেই, বিশেষ করে তাদের কাছে যারা বেলুড় মঠ, ব্যারাকপুর বা নরেন্দ্রপুর দেখেছে । তবে ভেতরে একটা মিউজিয়াম আছে যেটায় মেঘালয়ের মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের উৎসব-অনুষ্ঠানের কিছু মডেল রাখা আছে । এছাড়া এখানকার পাহাড়ী অধিবাসী গারো, খাসী, জয়ন্তিয়াদের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের একটা সংগ্রহশালা গোছেরও আছে ।

নোয়াকালিকাই ফল্‌স্‌ দেখার জায়গা - মেঘে ঢাকা
অষ্টম গন্তব্যঃ নোয়াকালিকাই ফল্‌স্‌
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ কমপক্ষে ১ ঘন্টা
টিকিটঃ মাথাপিছু ১০/-, ক্যামেরা ২০/-
এখানে বাস বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর একটা বড় কারণ হচ্ছে এখানেই দুপুরের খাওয়া সারতে হবে । এখানে দু'টো ভাতের হোটেল আছে, যেখানে ভাত-ডাল-তরকারি-মাছ-ডিম-মাংস সবই পাওয়া যায় । মান খুব একটা উন্নত নয়, কিন্তু এখানে এ'ছাড়া আর কোনও ব্যবস্থা নেই । বলা বাহুল্য, আমরা এখানেই দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম । খরচ পড়ল ৪৮০/-।

এরপর ফল্‌স্‌ দেখতে গেলাম । একেবারেই কিছু দেখা গেল না কারণ পুরো জায়গাটাই মেঘে ঢাকা । জায়গাটা কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে চলে এলাম ।

চেরাপুঞ্জি থেকে ফেরার পথে
ছোটবেলায় ভূগোল বই পড়ে চেরাপুঞ্জির সম্পর্কে আমাদের সকলেরই একটা ধারণা থাকে যে এখানে সারাবছরই বৃষ্টি হয় । কথাটা ভুল নয়, কিন্তু সারাবছর বৃষ্টি হয় এর মানে এই নয় যে ৩৬৫ X ২৪ ঘন্টাই বৃষ্টি হয় । আমরা চেরাপুঞ্জিতে যতক্ষণ ছিলাম তার মধ্যে একফোঁটাও বৃষ্টি পাইনি ।




চেরাপুঞ্জি ভ্রমণ শেষ - আমরা শিলং ফিরলাম তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে । কিছু খাবারদাবার কিনে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম । রাতে যথারীতি হোটেলেই খাওয়া হল । ৩৬০/- ।

৪ঠা  জুন, ২০১৩ - মঙ্গলবার । আমাদের শিলং সাইট সিয়িং করার দিন । এম টি ডি সি-র অফিসে আমাদের রিপোর্টিং টাইম সকাল ৮:১৫, তাই এই ফাঁকে আমরা একটা কাজ করে নিলাম । পরেরদিন আমাদের শিলং থেকে গুয়াহাটী ফেরার কথা, তাই আমরা গেলাম এম এস টি সি (মেঘালয় স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন) এর অফিসে । এটা এম টি ডি সি-র অফিসের ঠিক উল্টোদিকে । সেখানে গিয়ে জানা গেল শিলং থেকে গুয়াহাটী যাওয়ার জন্য আপাতত এম এস টি সি-র কোনও বাস নেই, আমরা যেন পরেরদিন সকালে গিয়ে খোঁজ নিই । এই অনিশ্চিতের ভরসায় থাকা মুস্কিল তাই আমরা এ এস টি সি-র (আসাম স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন) কাউন্টারে গেলাম, যেটা একই জায়গায় । সৌভাগ্যক্রমে এখান থেকে পরেরদিন গুয়াহাটী যাওয়ার বাসের টিকিট পাওয়া গেল । ভাড়া ১১০/- করে । বাস ছাড়ার সময় সকাল আটটা ।

এরপর এম টি ডি সি-র বাসে করে আমরা শিলং ঘুরতে বেরোলাম । আমাদের মোট সাতটা জায়গা দেখার আছে ।

লেডী হায়দারি পার্ক
প্রথম গন্তব্যঃ লেডী হায়দারি পার্ক
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ১৫ মিনিট
টিকিটঃ মাথাপিছু ৫/-, ক্যামেরা ১৫/-
একটা বেশ বড় পার্ক যার মধ্যে সুন্দর গার্ডেনিং এবং ফুলগাছ ছাড়াও আছে একটা মিনি চিড়িয়াখানা । সেখানে হরিণ ভাল্লুক বাঁদর সজারু ইত্যাদি আছে । পাখিদের মধ্যে আছে পেঁচা বাজ শালিক ঈগল্‌ ।


ক্যাথিড্রাল চার্চ
দ্বিতীয় গন্তব্যঃ ক্যাথিড্রাল চার্চ
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ১০ মিনিট
টিকিটঃ লাগে না
এই চার্চের বৈশিষ্ট্য হল এটা শিলং-এর সবথেকে বড় চার্চ । চার্চটা খুবই পরিষ্কার - সাধারণতঃ যেরকম হয় । চার্চটা রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা ওপরে - একটা অর্ধ-চন্দ্রাকার সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরের প্রার্থনাগৃহে যেতে হয় ।


এলিফ্যান্ট ফল্‌স্‌
তৃতীয় গন্তব্যঃ এলিফ্যান্ট ফল্‌স্‌
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ৩০ মিনিট
টিকিটঃ মাথাপিছু ১০/-, ক্যামেরা ২০/-
মাওস্‌মাই কেভ যেমন চেরাপুঞ্জির সবথেকে বড় আকর্ষণ ঠিক তেমনই শিলং-এর সবথেকে বড় আকর্ষণ হল এলিফ্যান্ট ফল্‌স্‌ । এই ফল্‌স্‌ না দেখলে শিলং ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে । পাহাড়ের গা বেয়ে একটা ঝর্ণা নেমে আসছে - পাহাড়ের ধাপে ধাপে তিনটে জায়গা থেকে সেটা ভালোভাবে দেখা যায় । এগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে ফার্স্ট ফল্‌স্‌, সেকেন্ড ফল্‌স্‌ আর থার্ড ফল্‌স্‌ । অদ্ভুত সুন্দর ! থার্ড ফল্‌স্‌ পর্যন্ত পৌঁছতে ৫০ টা মতো সিঁড়ি ভাঙতে হয়, তবে ভাঙাটা সার্থক । একেবারে নিচে দাঁড়িয়ে এলিফ্যান্ট ফল্‌সের যা সৌন্দর্য্য, তা নিজের চোখে না দেখলে জীবনে কিছু অদেখা থেকে যায় । 'ঝর্ণা ঝরঝরিয়ে জল ছড়িয়ে যেন নেচে নেচে যায়' (এবারে সত্যিই ইমোশনাল হয়ে পড়েছি !) ।

স্থানীয় পোষাকে অমৃতা
এলিফ্যান্ট ফল্‌স্‌ এর কাছে একটা লোক্যাল পোষাক পরে ছবি তোলার ব্যবস্থা আছে - মুলতঃ মেয়েরাই এগুলো করে থাকে । আমার স্ত্রী একবার পরলেন ।















এখানে চা-টা খেয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা আছে । আর আছে কিছু জিনিসপত্রের দোকান ।

মেঘে ঢাকা তারা মেঘালয় @ শিলং পীক
চতুর্থ গন্তব্যঃ শিলং পীক্‌
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ২০ মিনিট
টিকিটঃ মাথাপিছু ২০/-, ক্যামেরা ২০/-
শিলং-এর সবথেকে উঁচু জায়গা । এখান থেকে পুরো শিলং শহরটা দেখা যায় । কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা কিছুই দেখতে পেলাম না কারণ চারপাশটা সম্পূর্ণভাবে মেঘে ঢেকে গেল । একেবারে নিশ্ছিদ্র মেঘ - কোনও ফাঁক দিয়েই শিলং এর কোনও কোণাও দেখা গেল না ।


এখানেও কিছু খাবারের এবং জিনিসপত্রের দোকান আছে ।

বড়াপানি
পঞ্চম গন্তব্যঃ বড়াপানি (উমিয়াম লেক)
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ৪০ মিনিট
টিকিটঃ মাথাপিছু ২০/-, ক্যামেরা ৬০/-
পাহাড়ের মাঝখানে বৃষ্টির জলে পুষ্ট একটা লেক । তবে এটা কিছুটা হলেও কৃত্রিম কারণ লেকের একদিকে  বাঁধ দিয়ে এই জলকে ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে । বড়াপানির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য খুবই সুন্দর - বিরাট বড় লেকের মাঝে একটা পাহাড়ও আছে । এটার নাম লাংপেংডং । এখানে বোটিং এর ব্যবস্থাও রয়েছে - স্পীডবোটে করে পুরো লেকটা ঘোরানো হয় । বড়াপানিতে বাস বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর একটা বড় কারণ হল এখানে বাস থেকে নেমে বেশ কিছুটা ঢালুপথে নেমে যেতে হয় । ফেরার সময়ে স্বভাবতই বেশি সময় লাগে  ।

এখানে একটা ছোট খাবারের দোকান আছে, সেখানে চা কফি বা সামান্য স্ন্যাক্স খেয়ে নেওয়া যেতে পারে ।

গল্‌ফ্‌ কোর্স
ষষ্ঠ গন্তব্যঃ গল্‌ফ্‌ কোর্স
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ১০ মিনিট
টিকিটঃ লাগে না
একটা সাধারণ গল্‌ফ্‌ কোর্স । যারা কলকাতারটা দেখেছে, তাদের বাস থেকে নামারও দরকার নেই । বিরাট একটা সবুজ ঘাসে মোড়া উঁচুনিচু মাঠ - ব্যস ।



স্টেট মিউজিয়াম
সপ্তম গন্তব্যঃ স্টেট মিউজিয়াম
বাস দাঁড়ানোর সময়ঃ ২০ মিনিট
টিকিটঃ মাথাপিছু ৫/-, ক্যামেরা ১০/-
রামকৃষ্ণ মিশনের মিউজিয়ামটার একটা বড় ভার্শান হল স্টেট মিউজিয়াম । ভেতরে সবকিছুরই ছবি তোলা যেতে পারে । গারো, খাসী, জয়ন্তিয়া জাতীর মানুষের জীবনযাত্রার মডেল, অস্ত্রশস্ত্র, গয়নাগাটি, রান্নার উপকরণ, পোষাক-পরিচ্ছদের একটা সংগ্রহশালা হল স্টেট মিউজিয়াম ।

আমাদের সাইট সিয়িং শেষ - এরপর বাস আমাদের পুলিশ বাজারে নামিয়ে দিল । প্রায় বিকেল চারটে বাজে - আমাদের এখনও দুপুরের খাওয়া হয়নি । পুলিশ বাজারের একটা ভাতের হোটেলে ঢুকলাম । এটা কলকাতার একটা সাধারণ ভাতের হোটেলেরই মতো, রান্নার মানও তথৈবচ । মাত্র ২৭০/- সবার পেট ভরল (?) ।

পুলিশ বাজারের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড
হোটেল থেকে বেরোনোর সময়ে পেলাম সেই জিনিস - মেঘালয় যার জন্য বিখ্যাত । বৃষ্টি । আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু হল - এবং টানা এক ঘন্টা চলল । পাহাড়ে বৃষ্টির একটা সুবিধে হচ্ছে এখানে জল দাঁড়ায় না, কিছুক্ষণের মধ্যেই সব জল সরে গেল । আমরা হোটেলে ফিরলাম । এটা আমাদের শিলং- এর শেষ রাত্রি - পরেরদিন সকালেই আমরা গুয়াহাটীর চলে যাব । সে'জন্য সন্ধ্যেবেলা বেরিয়ে কিছু কেনাকাটা করে নেওয়া হল । শিলং থেকে কেনার জন্য সবথেকে ভালো জিনিস হল এখানকার বেত ও বাঁশের কাজের জিনিসপত্র । পুলিশবাজারে এসব জিনিসের বেশ কিছু দোকান আছে - আর এরা ট্যুরিস্টদের জন্য দাম সেই অর্থে কিছু বাড়িয়ে রাখে না ।

শিলং-এ আমাদের শেষ ডিনারও হোটেলেই করা হল । খরচ পড়ল ২০০/-।

৫ই জুন, ২০১৩ - বুধবার । আমাদের হোটেলে বিল আগেরদিন রাতেই মেটানো ছিল, তাই সকালে আমরা মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে সোজা বাসস্ট্যান্ডে চলে এলাম । বাস ছাড়ল প্রায় সাড়ে আটটা । কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা শিলং ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম । শিলং ভ্রমণ শেষ !

গুয়াহাটী পৌঁছলাম তখন প্রায় দুপুর একটা । গুয়াহাটীতে আমাদের মেয়াদ একরাত্রি, তাই কোনও হোটেল বুকিং করা ছিল না । এবং এর কোনও প্রয়োজনও নেই কারণ গুয়াহাটীতে প্রচুর হোটেল আছে । তবে যেহেতু আমরা মাত্র চব্বিশ ঘন্টা গুয়াহাটীতে থাকছি, আমার মেসোমশাই বললেন - আমাদের আরেকটা অপশনও আছে, সেটা হল রেলওয়ে রিটায়ারিং রুম । স্টেশনের চীফ টিকিট চেকারের এই ঘর অ্যালট্‌ করার ক্ষমতা থাকে, তিনি তাঁর বেয়ারার কাছে আমাদের পাঠিয়ে দিলেন । আমরা একটা পাঁচবেডের রুম পেলাম - ভাড়া ৪৪০/- ('খুশি করার ট্যাক্স' সমেত আমাদের পড়ল ৬৫০/-) আমরা রেলওয়ে থেকে এর বিলও পেলাম । রুমের কন্ডিশন যথেষ্ট ভালো - দু'টো অ্যাটাচ্‌ড্‌ বাথরুম সমেত ঘরটা যথেষ্ট বড় । ফ্রেশ হয়ে নিয়ে আমরা রেলওয়ে ক্যান্টিনে খেয়ে নিলাম । ৪০৮/- পড়ল ।

এরপর গেলাম গুয়াহাটীতে আমাদের একমাত্র দেখার জায়গা দেখতে - কামাখ্যা মন্দির । আমরা যেহেতু স্টেশনেই ছিলাম তাই স্টেশনের লাগোয়া গাড়ি বা অটোর স্ট্যান্ডটা আমাদের খুবই কাছে ছিল । সেখান থেকে ৩২০/- দু'টো অটো ভাড়া করে কামাখ্যা মন্দিরে যাওয়া হল । যাওয়ার রাস্তাটা খুবই সুন্দর - বেশ কিছুটা ব্রহ্মপুত্রের পাশ দিয়ে । যেতে আধঘন্টা মতো লাগে ।

কামাখ্যা মন্দির
কামাখ্যা মন্দির ভারতের ৫১ পীঠের মধ্যে অন্যতম - তবে আর পাঁচটা সাধারণ হিন্দু মন্দিরের মতোই । পান্ডা আছে, তবে পান্ডাদের বাড়াবাড়িটা খুব বেশি নেই । মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকতে গেলে অবশ্য দীর্ঘ লাইন দিতে হয় । ফ্রি, ১০১/- র ৫০১/- এই তিনরকমের লাইন হয় । গর্ভগৃহে না ঢুকেও মন্দিরের চত্বরটায় ঘোরাঘুরি করতে অবশ্য ভালোই লাগে । কামাখ্যা মন্দিরে পাঁঠা ছাড়া পায়রাও বলি দেওয়া হয় - বলির আগের সেইসব প্রাণীগুলোকে এখানে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায় ।

মন্দিরের চত্বরের মধ্যে একটা 'রেন ওয়াটার হার্ভেস্টেশন প্রজেক্ট' আছে - সেটাকে মন্দিরের লোকজন অনায়াসে 'সৌভাগ্যকুন্ড' নাম দিয়ে দিয়েছে । সেখানে একটা ছোট মন্দির তৈরি করে অনায়াসে ইনকাম্‌ (পড় বুজরুকি) চলছে !

মন্দিরের বাইরে যথারীতি জিনিসপত্রের দোকান আছে । আমরা এখান থেকে লোকজনকে উপহার দেওয়ার জন্য কিছু জিনিস কিনে নিলাম ।

ফেরার পথে আমরা ২৫০/- টাকায় একটা মারুতি ওম্‌নি ভাড়া করলাম যেটা আমাদের স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিল । আমরা তক্ষুণি রুমে না এসে লাইন পেরিয়ে গুয়াহাটীর পল্টনবাজারে একটু ঘোরাঘুরি করলাম । আমাদের ভ্রমণের 'অদ্যই অন্তিম রজনী' - আমার নিয়ম অনুযায়ী আমরা এইদিনের ডিনারটা একটু স্পেশাল করি । স্টেশনের একেবারে কাছেই একটা বেশ ঝাঁ-চক্‌চকে রেস্ট্যুরেন্ট ছিল - নাম 'পুদিনা' - এখান থেকে ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন মাঞ্চুরিয়ান নিয়ে নেওয়া হল । দাম পড়ল ৮৩০/- ।

ব্রহ্মপুত্রের তীরে
৬ই জুন, ২০১৩ - বৃহস্পতিবার । আগেরদিন বিকেলে কামাখ্যা যাওয়ার সময়ে দেখেছিলাম স্টেশন থেকে ব্রহ্মপুত্রটা বেশি দূরে নয়, তাই আমি সকালে বেরোলাম জায়গাটা এক্সপ্লোর করতে । সকালে হেঁটে বেড়াতে বেশ ভালোই লাগছিল । ব্রহ্মপুত্রের ধারে কিছুক্ষণ ঘুরে ঘন্টাখানেক পরে আবার রুমে ফিরে এলাম ।



আমাদের ট্রেন দুপুর ১২:৪৫ এ - আর আমরা আছি রেলওয়ে রিটায়ারিং রুমে - তাই কোনও তাড়াহুড়ো নেই । ধীরেসুস্থে ফাইনাল প্যাকিং সেরে রেলওয়ে ক্যান্টিনে লাঞ্চ করে নিলাম । তখন দেখলাম ট্রেন এসে গেছে । তারপর রুমে গিয়ে মাল নিয়ে সবাই মিলে ট্রেনে উঠে বসলাম । কাঁটায় কাঁটায় ১২:৪৫ এ সরাইঘাট এক্সপ্রেস হাওড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হল ।

ফেরার পথে ব্রহ্মপুত্রকে দেখতে আরও সুন্দর লাগল । যাওয়ার সময়ে কিছুটা মেঘ ছিল - ফেরার সময়ে একেবারে পরিষ্কার । ব্রহ্মপুত্র ছাড়াও ফেরার পথে দূরে পাহাড়ের গায়ে মেঘের দৃশ্যও খুব চিত্তাকর্ষক । যতক্ষণ আকাশে আলো ছিল, দু'চোখ ভরে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখলাম ।

পরেরদিন হাওড়া পোঁছলাম সকাল ছ'টায় - প্রায় একঘন্টা লেটে । আটটায় বাড়ি !

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে ৪ - ৫ দিনের ঘুরতে যাওয়ার জায়গা হিসেবে শিলং একটা খুব ভালো অপশন । এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য পর্যটককে মুগ্ধ করবেই ।
২. শিলং যাওয়ার সবথেকে ভালো সময় হচ্ছে বর্ষার শুরু - যে সময়ে আমরা গেছিলাম । এই সময়ে এখানে প্রকৃতি সবথেকে বেশি ঝকঝকে থাকে ।
৩. যদিও আমরা শিলং-এ বেশি বৃষ্টি পাইনি, তবুও শিলং গেলে প্রত্যেকেরই সঙ্গে একটা করে ছাতা নিয়ে যাওয়া উচিৎ ।
৪. শিলং-এ তিনটে গোটা দিন থাকাই ভালো - চেরাপুঞ্জি, নারটিয়াং আর লোকাল সাইট সিয়িং এর জন্য । যদি হাতে দু'দিন থাকে তাহলে নারটিয়াং-টা বাদ দেওয়া উচিৎ ।
৫. শিলং-এ ঘোরাঘুরির জন্য সবথেকে ভালো হল এম টি ডি সি-র বাস । কম খরচে এত ভালো ঘোরা অন্য কোনওভাবে সম্ভব নয় ।
৬. চেরাপুঞ্জির জায়গাটা খুব সুন্দর তবে এখানে থাকার কোনও মানে হয় না । চেরাপুঞ্জি ঘুরতে মোটামুটি ৫ - ৬ ঘন্টা লাগে যার মধ্যে 'মাওস্‌মাই কেভ' মাস্ট ওয়াচ্‌ ।
৭. শিলং-এর লোকাল সাইট সিয়িং এর মধ্যে এলিফ্যান্ট ফল্‌স্‌ ও বড়াপানি মাস্ট ওয়াচ্‌ । শরীর অনুমতি দিলে এলিফ্যান্ট ফল্‌সের তিনটে ফল্‌স্‌ই দেখা উচিৎ ।
৮. শিলং-এর প্রাণকেন্দ্র হল পুলিশবাজার - এখানে সবই পাওয়া যায় । এখানে অনেক হোটেলও আছে । কলকাতা থেকে হোটেল বুক করে গেলে সবসময়েই পুলিশবাজারর কোনও হোটেলে চেষ্টা করা উচিৎ ।
৯. শিলং-এর খুব কাছে আসাম হওয়া সত্ত্বেও এখানে চায়ের দাম খুব বেশি (১০ - ১৫/- প্রতি কাপ), তাই চা-প্রেমীদের টী-ব্যাগ বা নিজস্ব চায়ের সরঞ্জাম বহন করাই শ্রেয় ।
১০. শিলং কিছুটা গন্ডগোলের জায়গা তাই সন্ধ্যের পর রাস্তায় লোক চলাচল কমে গেলে হোটেলে ফিরে আসাই শ্রেয় ।
১১. গুয়াহাটীতে কামাখ্যা মন্দির একটা দেখার জায়গা । সেটা ছাড়া বালাজী মন্দিরও দেখতে যাওয়া যেতে পারে ।

উপসংহারঃ

ঘরে ফেরার পালা !
কম খরচে ৪ - ৫ দিনের বেড়ানোর প্ল্যান করলে শিলং-এর মতো জায়গা কমই আছে । মাথাপিছু মাত্র ৩,৭০০/- টাকায় আমাদের পুরো ঘোরা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে । এটা ঠিক যে আমরা সেরকম কোনও ভালো হোটেলে থাকিনি, সেরকম হাই-ক্লাস খাওয়াদাওয়াও করিনি । কিন্তু আমি বেড়াতে যাই বেড়ানোর জন্য, ভালো থাকা-খাওয়ার জন্য নয় । শিলং-চেরাপুঞ্জির অনন্যসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য পর্যটককে ভীষণভাবে আকর্শন করে । পশ্চিমবঙ্গ আর সিকিমের পাহাড়ে ঘুরতে ঘুরতে যাদের একঘেয়ে লাগে, তারা আসাম-মেঘালয়ের এই জায়গাগুলো ঘুরে আসতে পারে । ভারতবর্ষের নর্থ-ইস্টের এই 'প্যারাডাইজ আনএক্সপ্লোর্ড' কে এক্সপ্লোর জীবনে একবার অবশ্যই করা উচিৎ !

শিলং-এর আরও ছবি দেখতে হলে click here: