আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Monday, April 2, 2018

গ্যাংটক ভ্রমণ

ভ্রমণপথঃ

বুধবার ২৮শে মার্চ, ২০১৮ঃ শিয়ালদহ - রাত ১১ঃ১৫ মিনিটে পদাতিক এক্সপ্রেস
বৃহস্পতিবার ২৯শে মার্চ, ২০১৮ঃ সকাল ১০ঃ৩০ মিনিট - নিউ জলপাইগুড়ি - গ্যাংটক - গ্যাংটকে রাত্রিবাস
শুক্রবার ৩০শে মার্চ, ২০১৮ঃ গ্যাংটকে সাইট সিয়িং - গ্যাংটকে রাত্রিবাস
শনিবার ৩১শে মার্চ, ২০১৮ঃ গ্যাংটক - ছাঙ্গু লেক - বাবামন্দির - গ্যাংটকে রাত্রিবাস
রবিবার ১লা এপ্রিল, ২০১৮ঃ গ্যাংটক - নিউ জলপাইগুড়ি - দুপুর ২ঃ৪০ মিনিটে ক্যাপিটাল এক্সপ্রেস - বিকেল ৫ঃ১৫ মিনিট - বারসোই - সন্ধ্যে ৭ঃ১০ মিনিটে রাধিকাপুর এক্সপ্রেস
সোমবার ২রা এপ্রিল, ২০১৮ঃ সকাল ৬ টা - কলকাতা

গ্যাংটক । দীঘা-পুরী-দার্জিলিঙ আর তার সঙ্গে দেওঘর বাদ দিলে বাঙালির সবথেকে পরিচিত ঘোরার জায়গা (আমার এই নিয়ে দ্বিতীয়বার হল) । আমাদের প্রতিবেশী সিকিম রাজ্যের রাজধানী এই শহর বহুদিন ধরেই পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় । সিকিম ভারতের সবথেকে পরিচ্ছন্ন রাজ্য আর গ্যাংটকে গেলে সেটা ভালোভাবেই বোঝা যায় । এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ অত্যন্ত মনোরম আর সেটাই আমাদের এই ভ্রমণের অন্যতম কারণ । হিমালয়ের কোলে এই জনবহুল শহরে তিনদিনের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়েই আমার ব্লগের এবারের পোস্ট ।

এবারের দলে মোট ১৪ জন । আমি, অমৃতা, কথা-কলি, বাবা, মা, সমীরণদা, বৌদি, ঋজু, কঙ্কনাদি, অমিতদা, মিঙ্কা, কাকু ও কাকিমা (অমিতদার বাবা ও মা) । ঘোরার জন্য সংখ্যাটা একেবারে যাকে বলে আইডিয়াল কারণ দুটো গাড়ি ভাড়া করতে হবে আর সেগুলো সম্পূর্ণভাবে ব্যবহারও হবে । ২৮শে মার্চ, ২০১৮ বুধবার শিয়ালদহ থেকে পদাতিক এক্সপ্রেসের এ সি থ্রি টিয়ারে আমাদের যাত্রা শুরু হলো । ট্রেন ছাড়ার সময় রাত্রি ১১:১৫ বলে আমরা বাড়ি থেকে ডিনার করেই বেরিয়েছিলাম, তাই ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই শুয়ে পড়লাম ।

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে সবাই
পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্টে সঙ্গে নিয়ে আসা কুকিজারের চিকেন স্যান্ডউইচ খাওয়া হল । ট্রেনের নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছনোর কথা ছিল সকাল ৯ঃ৩০ মিনিটে । আমরা একঘন্টা লেট করে পৌঁছলাম ১০ঃ৩০ মিনিটে । নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে গ্যাংটক যাওয়ার অনেক গাড়ি পাওয়া যায় । সেরকমই একটা ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে রফা করে আমরা দুটো সুমো বুক করলাম । তবে গাড়ি বুকিং যে শুধু আমাদের নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গ্যাংটক যাওয়ার জন্য করা হল তা নয়, আমাদের গ্যাংটকের যাবতীয় ঘোরাঘুরি আর ফেরার দিন গ্যাংটক থেকে নিউ জলপাইগুড়ি আসার বুকিংও একইসঙ্গে করে ফেলা হল । সবমিলিয়ে একটা প্যাকেজ যার জন্য আমাদের মোট দিতে হবে ২৮,৩০০/- টাকা । বলা বাহুল্য এর কিছুটা আমাদের নিউ জলপাইগুড়িতেই দিতে হল ।

গাড়ি নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলাম । নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গ্যাংটক যাওয়ার জন্য সেভক দিয়েই যেতে হয় । এই রাস্তা দিয়ে এর আগে আমরা অনেকবার গেছি । দুপুর দেড়টা নাগাদ তিস্তা ব্রীজের কাছে আমাদের পরিচিত রেস্ট্যুরেন্টে থামা হল লাঞ্চের জন্য । আমরা এই রাস্তা দিয়ে গেলে সাধারণতঃ এখানেই খাওয়াদাওয়া করি । ভাত, ফ্রাইড রাইস আর চিকেন নিয়ে মোট খরচ হল ১,৯১০/- টাকা ।

আবার এগিয়ে চলা । পাহাড়ী রাস্তার বিবরণ দেওয়ার খুব একটা মানে হয় না কারণ এই রাস্তা সবসময়ে একই থাকে । আমার আগের যেকোনও পাহাড় ভ্রমণের যাত্রাপথের বিবরণ পড়লে দেখা যাবে ব্যাপারটা একইরকম । কিন্তু একইরকম হলেও একঘেয়ে নয় । বারবার দেখেও এই রাস্তা পুরনো হয় না, প্রত্যেকবারই একইরকমভাবে ভালো লাগে । রাস্তায় বিকেলবেলা আরেকবার থামা হল চায়ের জন্য । আমরা গ্যাংটক পৌঁছলাম তখন প্রায় সন্ধ্যে সাতটা । গাড়ির ভেতরে যতক্ষণ ছিলাম টের পাইনি, গাড়ি থেকে নেমে বুঝলাম বাইরে বেশ ঠান্ডা । আমাদের হাতের কাছেই কিছু গরম জামাকাপড় রাখা ছিল, সেগুলোর সদ্ব্যবহার করা হল ।

ব্রাদার্স গেস্ট হাউসের ঘর (সৌজন্যেঃ ব্রাদ্রার্স গেস্ট হাউস)
গ্যাংটকে আমাদের হোটেল 'ব্রাদার্স গেস্ট হাউস' । হোটেলটা এম জি মার্গের ওপরে । এই হোটেলের একটা সুবিধে হল একেবারে দরজা পর্যন্ত্য গাড়ি যায় । হোটেলটা বেশ সুন্দর এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । আমরা দু'টো ট্রিপল বেড রুম আর একটা সিক্স বেড রুম নিয়েছিলাম । সিক্স বেড রুমটা একটু অন্যরকম, একটা দরজা দিয়ে ঢুকে প্রথমে একটা ঘরে দুটো বেড, তারপর একটা প্যাসেজের লাগোয়া আরও দুটো বেড । সেই প্যাসেজের শেষে একটা দরজা আর তার পিছনে আরেকটা ঘরে আরও দুটো বেড ।

ব্রাদার্স গেস্ট হাউসে ডাইনিংএর ব্যবস্থা নেই, তবে ব্রেকফাস্ট বা চায়ের ব্যবস্থা আছে । সেইসঙ্গে যদি আমরা বাইরে থেকে খাবার নিয়ে এসে খেতে চাই, তাহলে এরা বাসনপত্রও দেয় । এই হোটেলের সামনেই গ্যাংটকের তথাকথিত ম্যাল আর সেখানে সারি সারি দোকান রয়েছে । আমরা এখানকার একটা বাঙালি দোকান থেকে ডিনারের জন্য ভাত, রুটি, ডাল, আলুভাজা, ডিম, চিকেন ইত্যাদি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম ।

হোটেলের ছাদ থেকে ম্যালের ভিউ
পরেরদিন ৩০শে মার্চ, ২০১৮ শুক্রবার - আমাদের গ্যাংটকের লোক্যাল সাইট সিয়িং-এর দিন । আমি সকালে উঠে হোটেলের ছাদে গেলাম । এখানে সূর্য্যোদয় দেখতে পাওয়া যায় না, আর সেভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউও পাওয়া যায় না । আমি ছাদে উঠে খুব অল্প সময়ের জন্য কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পেলাম । তবে এটা আমি আগেও বলেছি আমার কাঞ্চনজঙ্ঘা নিয়ে বাড়াবাড়িটা নেই, তাই না দেখতে পেলে বেড়ানোটা ব্যর্থ বলে মনে করিনা ! ছাদ থেকে ম্যালের ভিউটা খুব সুন্দর । সকাল সাড়ে সাতটার সময়ে দোকানপাট প্রায় সবই বন্ধ, তবে রাস্তাটা দেখতেও বেশ ভালো লাগে ।

সকালে হোটেল থেকেই ব্রেকফাস্ট নেওয়া হল । পাঁউরুটি আর ডাবল্‌ ডিমের ওমলেট । এখানে খাবারের দাম একটু বেশি, ব্রেকফাস্টে আমাদের সবমিলিয়ে খরচ হল ৮৬০/- টাকা । সাড়ে ন'টার একটু পরে দু'টো সুমো নিয়ে আমরা বেরোলাম সাইট সিয়িং-এর জন্য । আমাদের প্রথম গন্তব্য রুমটেক মনাস্ট্রি ।

রুমটেক মনাস্ট্রির পথে প্রার্থনা চক্র
রুমটেক মনাস্ট্রি - গ্যাংটকের সাইট সিয়িংএর মধ্যে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল রুমটেক মনাস্ট্রি - এটা সিকিমের সবথেকে বড় মনাস্ট্রি । গ্যাংটক থেকে রুমটেকের দূরত্ব অনেক, আমাদের পৌঁছতে লাগল প্রায় পৌনে দু'ঘন্টা । গাড়ি আমাদের মনাস্ট্রির মেইন গেটে নামিয়ে দিল । বাকি পথটা পাহাড়ী পথে চড়াইয়ে হেঁটে উঠতে হবে । এমনিতে গাড়ির গেটের ভিতরে যাওয়ার অনুমতি নেই, তবে বয়স্ক মানুষের জন্য এরা অ্যালাও করে । সেইভাবে আমাদের দলের চারজন গাড়িতে উঠল আর বাকিরা হেঁটে উঠলাম । ওঠার পথের পাশে পরপর রয়েছে বেবিফুডের টিনের মতো সেই জিনিসগুলো যেগুলোকে 'প্রার্থনা চক্র' বলে । এগুলোর গায়ে তিব্বতী মহামন্ত্র 'ওম্‌ মণিপদ্মে হুম্‌' লেখা থাকে আর সেইজন্য এগুলোকে ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘোরাতে হয়, তাতে লেখাটা পড়া যায় । এগুলো ঘোরালে পুণ্য অর্জন হয় তাই এই পথে ওঠার সময়ে আমরা প্রভূত পরিমাণ পুণ্য সঞ্চয় করে ফেললাম !

রুমটেক মনাস্ট্রি
পাহাড়ের মাথায় একটা সমতল জায়গায় মনাস্ট্রিটা রয়েছে । ঢোকার টিকিট মাথাপিছু ১০/- টাকা আর বাচ্চাদের টিকিট লাগে না । মনাস্ট্রি জিনিসটা আমার খুব ভালো লাগে আর তার একটা কারণ এর রঙের বৈচিত্র্য । অন্য কোনও ধর্মীয় স্থানে রঙের এই বৈচিত্র্য সাধারণতঃ দেখতে পাওয়া যায় না । গেট দিয়ে ঢুকে একটা বিশাল চত্বর আর তার মাঝখানে একটা স্তম্ভ । এই চত্বরের একদিকে মনাস্ট্রি আর অন্যদিকে আবাসিকদের ঘর । আমরা এখানে কিছুক্ষণ থেকে ডানদিকের একটা গেট দিয়ে বাইরে বেরোলাম ।

এই গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে একটা রাস্তা আছে যেটা দিয়ে গিয়ে একটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে মনাস্ট্রির উপাসনাগৃহে পৌঁছনো যায় । মনাস্ট্রির ভিতরটাও আমার খুব ভালো লাগে - জায়গায় জায়গায় প্রদীপ জ্বলছে, প্রার্থনা বা উপাসনার নানারকম সরঞ্জাম রাখা আর সেইসঙ্গে গৌতম বুদ্ধের বিশাল মূর্তি । ভিতরটা খুব শান্ত আর নিস্তব্ধ হয় আর এই কারণেই এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে ভালো লাগে । ভিতরে ক্যামেরা নিয়ে ঢোকা বারণ তবে মোবাইলে ছবি তুললে কিছু বলে না । আমরা ভালো করে দেখে বেরিয়ে এলাম ।

মনাস্ট্রির পিছনে কলেজ
এই উপাসনাগৃহের ঠিক পিছনেই মনাস্ট্রির কলেজ । স্বাভাবিকভাবেই সেখানে ঢোকার নিয়ম নেই । আমরা এখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ফিরে এলাম । নামার সময়েও একই নিয়ম - যারা পারবে তারা হেঁটে আর যারা পারবে না তারা গাড়িতে ।






শান্তি ভিউ পয়েন্ট থেকে ভিউ
শান্তি ভিউ পয়েন্ট - রুমটেক মনাস্ট্রি থেকে নামার পথে ড্রাইভার একটা জায়গায় গাড়ি দাঁড় করাল, সেটার নাম শান্তি ভিউ পয়েন্ট । এখান থেকে গ্যাংটক শহরের ভিউ দেখতে পাওয়া যায় । এখানে একটা চায়ের দোকান দেখে সবাই সেখানে চা খাওয়া হল ।





বনজাকরি ওয়াটার ফলসের লাগোয়া বোটিং-এর ব্যবস্থা
বনজাকরি ওয়াটার ফলস্‌ - শান্তি ভিউ পয়েন্ট থেকে প্রায় সোয়া একঘন্টা মতো চলার পর আমরা পৌঁছলাম বনজাকরি ফলসে । এটাও গ্যাংটকের একটা অন্যতম সেরা দ্রষ্টব্য স্থান । এখানে ঢোকার টিকিট মাথাপিছু ৫০/- টাকা আর বাচ্চাদের টিকিট লাগে না । ভেতরে কয়েকটা রেস্ট্যুরেন্ট আছে । দুপুর আড়াইটে বাজে আর বেশ খিদেও পেয়ে গেছিল তাই আমরা এদের মধ্যে একটা রেস্ট্যুরেন্টে খেতে বসলাম । খেতে লাগল পনেরো মিনিট আর আগে খাবার আসতে লাগল পঁয়তাল্লিশ মিনিট ! হ্যাঁ, সেটাই । আমরা এদের মেনু থেকে অতি সাধারণ ভাত, ফ্রাইড রাইস, চিকেন ইত্যাদিই অর্ডার দিয়েছিলাম আর অর্ডার নেওয়ার সময়ে এদের বক্তব্যও ছিল সেটা পেতে মিনিট দশেকের বেশি লাগবে না, কিন্তু সবমিলিয়ে আমরা খাবার পেলাম অনেকটা দেরিতে । খাবারের মান যে খুব ভালো তা নয়, তবে খেয়ে নেওয়া যায় । আমাদের বিল হল ১,৪০০/- টাকা ।

বনজাকরি ফলস্‌
এবার আমরা গেলাম মূল ফলস্‌ বা জলপ্রপাতটা দেখতে । পুরো এলাকাটা বেশ বড় আর সেখানে ফলস্‌ ছাড়াও একটা পার্ক, বোটিং এর ব্যবস্থা, বসে বিশ্রাম নেওয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদি রয়েছে । ফলস্‌টা যেখানে পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে নামছে, সেখানে যেতে গেলে কিছু সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় । সেই জায়গাটায় গিয়ে চাইলে জলে নামা যেতে পারে । আমি পা দিয়ে দেখলাম জলটা বেশ ঠান্ডা । এখানে পাথরে পাথরে পা দিয়ে জলের ধারার অন্যপারেও যাওয়া যায় । আমি একবার অন্যপারে গিয়ে ফিরে এলাম । জলের স্রোত সাংঘাতিক কিছু না হলেও একবার পা হড়কালে নির্ঘাত মৃত্যু হাত-পা ভাঙা ।
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ These actions are performed by experts. Please do not try this if you are not!

বলজাকরি ফলস্‌ দেখে প্রায় বিকেল চারটে নাগাদ আমরা বেরোলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ।

রিজ পার্ক ফ্লাওয়ার এক্সিবিশন সেন্টার - বনজাকরি ওয়াটার ফলস্‌ থেকে ঘন্টাখানেক গাড়িতে চলার পর আমরা পৌঁছলাম রিজ পার্কে ফ্লাওয়ার এক্সিবিশন সেন্টার বা পুষ্প প্রদর্শনী কেন্দ্রে । ঢোকার টিকিট মাথাপিছু ২০/- টাকা - বাচ্চাদের টিকিট লাগেনা ।

রিজ পার্ক ফ্লাওয়ার এক্সিবিশন সেন্টার
পুষ্প প্রদর্শনী কেন্দ্রটা খুবই সুন্দর । ভেতরের জায়গাটা গোলাকার, তার মাঝখানে একটা রেলিং ঘেরা জায়গা যার মধ্যে অনেক ফুলের গাছ রয়েছে । আবার গোলাকার ঘরটার দেওয়ার বরাবরও একটা রেলিং চলে গেছে আর তার ওদিকেও অনেক ফুলের গাছ । এর মাঝখান দিয়ে চলে গেছে দর্শকদের জন্য পায়ে চলার রাস্তা । ফুল সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত তাই প্রদর্শনীতে দেখা বেশিরভাগ ফুলেরই নাম বলতে পারব না । কিন্তু নানা রঙের, নানা আকারের, নানা সাইজের, নানা ধরনের, নানা পাটেকরের ফুল দেখে অবাক ও মুগ্ধ হয়ে গেলাম ।

ফ্লাওয়ার এক্সিবিশন সেন্টার থেকে বেরিয়েই একজায়গায় এখানকার পোষাক পরে ছবি তোলার ব্যবস্থা আছে । কথা, কলি আর মিঙ্কা সেই পোষাক পরে ছবি তুলল ।

আমাদের গ্যাংটকের সাইট সিয়িং এখানেই শেষ । এছাড়া আরও বেশ কয়েকটা দেখার জায়গা আছে যেগুলো সময়ের অভাবে দেখার সুযোগ হয়নি । কিন্তু তাতে আফসোস করার কিছু নেই । সবকিছুই যদি একবারে দেখে ফেলি তাহলে পরেরবার আসব কিসের টানে ?

গাড়ি ফেরার সময়ে আমাদের হোটেলের সামনে নামিয়ে দিল । আগেই বলেছি আমাদের হোটেলটা একেবারে ম্যালের ওপরে । সাড়ে ছটা নাগাদ হোটেলে ফিরে আমরা ম্যালে গেলাম । সেখানে একটা দোকান থেকে চিকেন রোল কিনে খাওয়া হল ।

রাতে ম্যালের ভিউ
গ্যাংটকের ম্যাল জায়গাটা আমার অসাধারণ লাগে । এর আগে ছবি দেখেছি, কিন্তু স্বচক্ষে দেখা হয়নি । শুনেছি ক্রিসমাসের সময়ে এরা জায়গাটাকে খুব সুন্দর করে সাজায় । তাই সেই সময়ে এখানে এলে খুব ভালো লাগবে । কিন্তু তাই বলে মার্চ মাসে আমাদেরও খারাপ লাগছিল না । ম্যালের রাস্তায় গাড়ি চলে না, শুধু হাঁটা যায় । পুরো রাস্তাটা মসৃণ কালো পাথর দিয়ে ঢাকা । অল্প অল্প ব্যবধানে সুন্দর বসার জায়গা । জায়গায় জায়গায় ফোয়ারা আর সেইসঙ্গে গাছপালা লাগানো । পুরো জায়গাটা আলোয় আলোকিত, তার মধ্যে রাস্তার আলো ছাড়াও সৌন্দর্য্যায়নের আলোও রয়েছে । রাস্তার দু'পাশে সারিবদ্ধ দোকান আর সেখানে পাওয়া যায় না এরকম জিনিস নেই । সন্ধ্যেবেলা থেকে এখানে ভীড়ও হয় খুব, দোকানপাট রাস্তা বসার জায়গা সবই লোকে ভর্তি ।

আমরা ঘন্টা দুয়েক ঘুরে রাতের খাবার কিনে নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম । মেনু আগেরদিনের মতোই - খরচ হল ৯১০/- টাকা ।

৩১শে মার্চ, ২০১৮ শনিবার - আমার জীবনের একটা বিশেষ স্মরণীয় দিন ! আজ পর্যন্ত্য যতবার যত জায়গায় বেড়াতে গেছি, এইদিনের মতো অভিজ্ঞতা আমার খুব কমই হয়েছে । মুগ্ধতা, বিস্ময়, আনন্দ, উত্তেজনা সবমিলিয়ে এই দিনটা সত্যজিৎ রায়ের ভাষায় 'আমার জীবনে একটা লালদাগ মার্কা তারিখ' হয়ে রইল । কেন, কিভাবে সেটা এবার বলি ।

এইদিনটা আমাদের ছাঙ্গুলেক আর বাবা মন্দির যাওয়ার দিন । এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি ছাঙ্গু লেক এবং বাবা মন্দির যাওয়ার জন্য পার্মিশন লাগে । জিনিসটা পাওয়া দুঃসাধ্য কিছু নয়, তবে তার জন্য নিজের দু'কপি করে ফোটো আর একটা সচিত্র পরিচয়পত্র সঙ্গে থাকা বাধ্যতামূলক । আমরা আগেরদিন এইসব জিনিস আমাদের ট্রাভেল এজেন্সির এখানকার অফিসে জমা দিয়েছিলাম এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ৩১শে মার্চ সকালে যাওয়ার পার্মিট পেলাম । জিনিসটা গাড়ির ড্রাইভারের কাছে থাকে, যাওয়ার সময়ে সেইই যা করার করে । হোটেল থেকে ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়েছিলাম, পার্মিট সংগ্রহ করে যখন আমরা যাত্রা শুরু করলাম ছাঙ্গু লেকের উদ্দেশ্যে তখন সকাল সাড়ে নটা ।

ছাঙ্গুর পথে - চা পানের বিরতি
গ্যাংটকের উচ্চতা ৫,৪০০ ফুট আর ছাঙ্গু লেকের উচ্চতা ১২,৩০০ ফুট, অর্থাৎ গ্যাংটকের দ্বিগুণেরও বেশি । তাই গ্যাংটক থেকে ছাঙ্গু লেকের দূরত্ব মাত্র ৩৭ কিলোমিটার হলেও এই পথটা যেতে প্রায় দু'ঘন্টা সময় লাগে । আমরা রাস্তায় এক জায়গায় দাঁড়ালাম চা-টা খাওয়ার জন্য । সকাল থেকে মেঘ করে থাকার কারণে রোদ খুব একটা ওঠেনি, তাই ঠান্ডাটাও বেশ অনুভব করছিলাম ।


পাহাড়ের গা বেয়ে বরফ নেমে আসা
চা খাওয়ার পর আমরা আবার এগিয়ে চললাম । পথে মোট তিন জায়গায় চেকিং হল । এত নিরাপত্তার কারণ ছাঙ্গু লেক ভারত আর চিন অধিকৃত তিব্বতের বর্ডারের খুব কাছে । উচ্চতা বাড়ছে আর সেইসঙ্গে বাড়ছে ঠান্ডা । আমরা কাচ তুলে দিয়ে গাড়ির মধ্যে বসে আছি বলে ঠান্ডাটা একটু কম লাগছে । একসময়ে উপরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম পাহাড়ের গায়ের গাছপালার মধ্যে দিয়ে সাদা রঙের কি যেন ওপর থেকে নিচের দিকে স্রোতের মতো নেমে আসছে । আমাদের ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করাতে বলল - বরফ । পাহাড়ের উপরের দিকে তুষারবৃষ্টি হচ্ছে আর সেই বরফ গা বেয়ে নিচের দিকে নেমে আসছে ! আমি কোনওদিন তুষারবৃষ্টি দেখিনি, তখনও যে দেখতে পাচ্ছিলাম তা নয়, কিন্তু পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা বরফ দেখেই যথেষ্ট উত্তেজনা অনুভব করছিলাম !

ছাঙ্গু লেক ফেলে আমরা এগিয়ে চলেছি
উত্তেজনার যে তখনও কিছুই হয়নি, সেটা বুঝলাম ছাঙ্গুর কাছাকাছি পৌঁছে । তখন ওই অঞ্চলে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, তুষারপাত দেখার জন্য আর পাহাড়ের ওপর দিকে তাকানোর দরকার হচ্ছে না । ছাঙ্গুতে পৌঁছে দেখলাম ভালোই ভিড় । আমাদের গাড়িটা সামনে ছিল আর অন্য গাড়িটা বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল বলে আমরা চাইছিলাম ওখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে । এখানে মোবাইল ফোন কাজ করে না তাই গাড়িটার অবস্থান জানার কোনও উপায় নেই । কিন্তু ড্রাইভার আমাদের কথা না শুনে গাড়ি আরও এগিয়ে নিয়ে চলল । সেই মূহুর্তে ব্যাপারটার জন্য ওর ওপর একটু বিরক্ত লাগলেও পরে বুঝেছিলাম এতে, অন্ততঃ আমাদের, ভালোই হয়েছে ।

লোকজনের বরফ নিয়ে খেলা
আমরা এগিয়ে চললাম 'বাবা মন্দির'-এর দিকে । ছাঙ্গু থেকে এর দূরত্ব আরও ১৬ কিলোমিটার আর উচ্চতা ১৩,১০০ ফুট । ঝিরঝির করে তুষারপাত হচ্ছে, হয়েই চলেছে । ছাঙ্গু লেকটা ক্রমশঃ নিচে নেমে যাচ্ছে । বাইরে যেদিকে তাকাচ্ছি, সবকিছুই সাদা । ফেলুদার 'বাক্স রহস্য' উপন্যাস থেকে জটায়ুর কথা ধার করে বলি "রাস্তায় বরফ, গাছে বরফ, পাহাড়ে বরফ - চতুর্দিক তুষারে তুষারময় !" (আমাদের রাস্তায় যদিও কোনও গাছ ছিল না)  একজায়গায় দেখলাম পাহাড়ের গায়ে পুরু বরফের চাদরের ওপর লোকজন লাফালাফি করছে, বরফের গোলা বানিয়ে ছোঁড়াছুঁড়ি করছে - মানে এককথায় বরফ নিয়ে খেলছে ! আমাদের ড্রাইভারকে গাড়ি দাঁড় করাতে বলতে সে কোনও ভ্রুক্ষেপই করল না । প্রায় আধঘন্টা এইভাবে বরফে প্রায় ঢাকা রাস্তার ওপর দিয়ে চলে আমরা পৌঁছে গেলাম 'বাবা হরভজন সিং-এর মন্দির'-এ ।

বাবা হরভজন সিং-এর মন্দির
এখানেও বেশ ভিড় তবে ছাঙ্গুর মতো নয় । গাড়ি থেকে নেমে যেটা টের পেলাম সেটা হল ঠান্ডা ।  তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে তবে কত সেটা জানি না । সেইসঙ্গে একটানা তুষারপাত হয়ে চলেছে । জিনিসটা একেবারেই বৃষ্টির মতো তবে পার্থক্য হল জলের বদলে কুচি কুচি বরফ । আরেকটা পার্থক্য হল এর কোনও আওয়াজ নেই । চতুর্দিক সাদা হয়ে রয়েছে, একেবারে সামনের পাহাড়গুলো ছাড়া আর কোনওদিকেই কিছু দেখা যাচ্ছে না । আমরা বাবার মন্দিরটা দেখতে গেলাম । হরভজন সিং ছিলেন ভারতীয় আর্মির একজন জওয়ান যিনি ১৯৬৮ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে নাথুলাতে ভারত আর চিনের যুদ্ধে মারা যান । এই ঘটনার পর থেকে নানাকারণে এখানে পোস্টেড ভারতীয় জওয়ানদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মায় যে ওনার আত্মা আজও এই অঞ্চলে তাদের রক্ষা করেন । (আমি খুব বিস্তারিত লিখছি না, ইন্টারনেটে সার্চ করলে এই বিষয়ে বিশদে জানতে পারা যাবে) সেই থেকেই উনি 'বাবা হরভজন সিং' আর ওনার নামে এই মন্দির । এখানে ওনার থাকার ঘর, অফিস সবই আছে আর সেইসঙ্গে নিয়মিত ওনার পুজোও হয় । পুজোর প্রসাদটা বেশ ইন্টারেস্টিং - কাজু, কিসমিস আর বাদাম । প্রসাদ পেতে গেলে পুজো দিতেই হবে এরকম কোনও কথা নেই, হাত পাতলেই একজন জওয়ান প্রসাদ দেয় । আমি বেশ কিছুটা সংগ্রহ করে গাড়িতে ফিরে এলাম ।

এখানে বলে রাখা দরকার এই উচ্চতায় অক্সিজেনের ঘাটতি হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে । যাঁদের হার্টের সমস্যা আছে, তাঁদের বাবামন্দির পর্যন্ত্য না যাওয়াই ভালো । যাঁদের বেশি উঁচুতে উঠলে শ্বাসকষ্ট হয়, তাঁদের উচিৎ উপযুক্ত ব্যবস্থা (ইনহেলার, ওষুধ ইত্যাদি) সঙ্গে রাখা । বয়স্ক লোকেদের ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েই যাওয়া উচিৎ । আমাদের গাড়িতে ছিলাম আমি, অমৃতা, বাবা, মা, কথা, কলি আর ঋজু । গাড়ি থেকে নামার সময়েই ড্রাইভার আমাদের বলে দিয়েছিল যেন এখানে বেশি সময় না নিই । কিন্তু কথা-কলি ঘুমিয়ে পড়ায় আমাদের যাওয়াটা দু'দফায় করতে হল । আমরা ওদের ইচ্ছে করেই জাগাইনি কারণ ভেবেছিলাম তিনবছর বয়সের বাচ্চাদের শ্বাসকষ্ট হতে পারে । কিন্তু পরে জেনেছিলাম উচ্চতার কারণে এই শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছোট বাচ্চাদের কখনওই হয়না কারণ তাদের হার্ট বড়দের থেকে অনেক কম অক্সিজেনে কাজ করতে পারে ।

ফেরার পথে ছাঙ্গু লেক
বাবা মন্দির থেকে আমরা ফেরার পথ ধরলাম । আবার বরফের রাস্তা । একটা জিনিস খেয়াল করলাম আমাদের ফেরার সময়ে সামনের দিক থেকে কোনও গাড়ি আসছে না । আসার সময়েও আমাদের পিছনে মাত্র একটা কি দু'টো গাড়িই এসেছিল । ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করাতে বলল - তুষারপাত হওয়ার কারণে রাস্তা বরফে ঢেকে যাওয়ায় মিলিটারির লোকেরা ছাঙ্গুর পরে গাড়ি আসা বন্ধ করে দিয়েছে । এটা হবে সে আগেই জানত আর তাই ছাঙ্গুতে গাড়ি না দাঁড় করিয়ে আমাদের সোজা বাবা মন্দিরে নিয়ে এসেছিল । আমাদের দলের কিছু লোকের বাবা মন্দির দেখা হল না ঠিকই কিন্তু ড্রাইভারের উপস্থিত বুদ্ধির জোরে আমাদের কয়েকজনের দেখা হয়ে গেল বলে তার প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞ বোধ করলাম !

এই অঞ্চলে ছাঙ্গু লেক, বাবা মন্দির ছাড়াও আরেকটা জিনিস দেখার আছে - সেটা হল নাথুলা পাস । এই জায়গাটা ভারত আর চিন অধিকৃত তিব্বতের সংযোগস্থল অর্থাৎ এই রাস্তা দিয়ে ভারত থেকে তিব্বত যাওয়া যায় । তবে এখানে যাওয়ার জন্য আলাদা পার্মিট লাগে আর বছরের বেশিরভাগ সময়ে বরফ বা অন্য কোনও কারণে জায়গাটা বন্ধই থাকে । আমরা আগে থেকেই জানতাম যে এটা বন্ধ আছে, তাই আমাদের দেখার সুযোগ হয়নি । গ্যাংটক থেকে ছাঙ্গু আর বাবা মন্দির গেলে নাথুলার ব্যাপারে একবার খোঁজ নিয়ে নেওয়া ভালো, যদি খোলা পাওয়া যায় তাহলে দেখে আসাটা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হবে ।

ছাঙ্গুতে ফিরে এলাম তখন দুপুর সোয়া দু'টো । কিছুক্ষণের চেষ্টায় আমাদের অন্য গাড়িটা খুঁজে পাওয়া গেল । ছাঙ্গুতে আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছবিটবি তুললাম । বাবা মন্দিরের তুলনায় ছাঙ্গুর তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি (তাই বলে গরম লাগছিল না !)। লেকে এখন জলই দেখা যাচ্ছে তবে শীতকালে নাকি এই জল বরফে পরিণত হয় । এখানে ইয়াক বা চমরি গাই ভাড়া করে তাদের পিঠে চড়ে ছবি তোলা যায়, একটু আধটু ঘোরাও যায় । এছাড়া এখানে বরফের ওপরে হাঁটার জুতোও ভাড়া পাওয়া যায় । আমাদের ড্রাইভার বলল - আবহাওয়া খুব একটা ভালো নয়, তাই সময় থাকতে থাকতে নিচে নেমে যাওয়াই ভালো হবে । আমাদেরও সবকিছু দেখা হয়ে গিয়েছিল, তাই আর সময় নষ্ট করলাম না ।

এখানে একটা ঘটনা বলি । এটা আমাদের ঘোরার অংশ না হলেও আমার মনে হয় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক আর শিক্ষণীয় । ঘটনাটা ১৯৯৭ সালের । আমার ছোটমামা আর তার কয়েকজন বন্ধু সপরিবারে গ্যাংটকে বেড়াতে এসেছিল আর সেখান থেকে ছাঙ্গুতে এসেছিল । ছাঙ্গুতে তখন এরকমই ঠান্ডা, কিছু বেশিকম হতে পারে । আমার মামাতো বোন তন্নির বয়স তখন সাড়ে তিন । তখন সুমো চলত না, বড় সাইজের জিপেই ঘুরতে হত । ছাঙ্গুতে এসে সবাই গাড়ি থেকে নেমে এদিক-ওদিক ঘুরছে আর ছোটমামা তন্নিকে নিয়ে জিপের পিছনে বসে আছে । হঠাৎ খেয়াল করল তন্নি কিরকম নেতিয়ে পড়েছে । ছোটমামার কোলে শুয়ে তার কিরকম একটা ঝিমধরা ভাব । এরকম হচ্ছে কেন ? স্বাভাবিকভাবেই ছোটমামা একটু ভয় পেয়ে যায় । কি করবে বুঝতে পারছে না, সঙ্গে থাকা জলের বোতল থেকে তন্নির চোখেমুখে জল দিচ্ছে, হাতের কাছে থাকা মোটা জ্যাকেট দিয়ে আরও জড়িয়ে ধরছে । কিন্তু তন্নির অবস্থার কোনও উন্নতি হচ্ছে না, মেয়ে প্রায় অজ্ঞান । মিনিট কয়েক এরকম চলার পরে গাড়ি থেকে নেমে পাশের একটা দোকানে অসহায়ের মতো গিয়ে বলে - মেরি বেটি কে লিয়ে থোড়া পানি মিলেগা ?
দোকানদার সেটা দিয়ে নিজে ব্যাপারটা কি দেখতে এগিয়ে আসে । ছোটোমামা তখন গাড়ির পিছনে শুয়ে থাকা মেয়েকে জল খাওয়াতে যাচ্ছে । দোকানদার জিজ্ঞেস করে - কেয়া হুয়া উসকো ?
- পতা নেহি । ক্যায়সে চুপ হো গয়ী হ্যায় ... এই বলে আবার জল খাওয়াতে চেষ্টা করে ।
দোকানদার 'হাঁ হাঁ' করে ওঠে । বলে - ঠান্ডা পানি মাৎ পিলাইয়ে উসকো !
এই বলে সে দ্রুত নিজের দোকানে ফিরে যায় । ঝটপট সাত-আটটা কাঁচালঙ্কা কুচি কুচি করে কেটে ফেলে । আর সেগুলো একটা কেটলির গরম জলের মধ্যে ফেলে দেয় । তারপর সেই জলটা একটা গ্লাসে ঢেলে ছোটমামাকে দিয়ে বলে - ইয়ে পিলাইয়ে উসকো ।
প্রায় অজ্ঞান মেয়েকে কোনওমতে কয়েকঢোক জল খাওয়াতে পারে ছোটমামা । আর তার ফল হয় ম্যাজিকের মতো ! পাঁচমিনিটের মধ্যে তন্নি লাফিয়ে উঠে জিপ থেকে নেমে গায়ের জ্যাকেট ফ্যাকেট খুলে দৌড়দৌড়ি করতে শুরু করে ! আনন্দে চোখে জল এসে যায় ছোটমামার (এটা ঘটেছিল কিনা আমি জানি না, শেষটা একটু নাটকীয় করার জন্য লিখলাম) !
ব্যাপারটা কি হল ? অতিরিক্ত ঠান্ডায় রক্ত চলাচলের বেগ কমে গিয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে যায় । এর ফলে তন্নির শরীর অবশ হয়ে গিয়েছিল । এইসময়ে ঠান্ডা জল খাওয়ালে কোনও ফল হয় না । দোকানদার দিয়েছিল গরম জল আর সেইসঙ্গে পাহাড়ী লঙ্কা ! শরীরকে মূহুর্তের মধ্যে গরম করার জন্য অব্যর্থ পাহাড়ী টোটকা । ফলাফল - হাতেনাতে !

নামার পথে তুষারপাতটা আস্তে আস্তে কমে গিয়ে একসময়ে বন্ধ হয়ে গেল । আমাদের কারুরই দুপুরে খাওয়া হয়নি, কিন্তু এই রাস্তায় সেরকম খাবারের কোনও দোকানও নেই । গাড়ির ড্রাইভার আমাদের বলল একেবারে গ্যাংটকে গিয়েই খাবারের দোকান পাওয়া যাবে । আমরা গ্যাংটক পৌঁছলাম তখন প্রায় বিকেল চারটে । গাড়ি আমাদের হোটেলের কাছে এক জায়গায় নামিয়ে দিল । সেখানে আমরা একটা কাছাকাছি বাঙালী রেস্ট্যুরেন্টে ঢুকে খেয়ে নিলাম । ভাত, ডাল, মাছ, চিকেন, চাউমিন, চিকেন মাঞ্চুরিয়ান মিলিয়ে খরচ হল ২,০৮৫/- টাকা ।

এখান থেকে আমরা হেঁটে হোটেলে পৌঁছে গেলাম । হোটেলে ঢুকতেই ম্যানেজার জিজ্ঞেস করল আমরা ছাঙ্গুতে গিয়ে বরফ পেয়েছি কিনা । আমরা "হ্যাঁ" বলাতে সে বলল - "আপলোগ বহোৎ লাকি হো সার ! ইস সাল ইঁহা ইৎনা আচ্ছা স্নোফল আজ পহলিবার হুয়া !"

সন্ধ্যেবেলা আমাদের আর কিছু করার ছিল না । ম্যালেও আর গেলাম না কারণ পরেরদিন আমাদের ফেরার দিন তাই গোছগাছ করে নেওয়ার ছিল । রাত ন'টা নাগাদ বেরিয়ে ডিনার নিয়ে এলাম একটা অন্য দোকান থেকে । এই দোকানটা ম্যালের একেবারে শেষপ্রান্তে । চাউমিন আর চিলি চিকেন - খরচ হল ১,২৬০/- টাকা ।

হোটেলের ছাদ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ
পরেরদিন ১লা এপ্রিল, ২০১৮ আমাদের ফেরার দিন । সকালে উঠে ছাদে যেতেই মেঘ আমাকে 'এপ্রিল ফুল' করে সরে গিয়ে বেশ পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিল - কাঞ্চনজঙ্ঘা !







ব্রেকফাস্টের জায়গা থেকে পাহাড়ের ভিউ
হোটেল থেকে চেক্‌ আউট করে বেরোলাম আটটা নাগাদ । গ্যাংটক থেকে নিউ জলপাইগুড়ি ঘন্টাতিনেক লাগে তবে ব্রেকফাস্টের জন্য দাঁড়াতে হবে বলে তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়লাম । আর সকালে কোথাও ঘোরার না থাকলে পাহাড় থেকে সকাল সকাল নেমে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ কারণ কোনও কারণে রাস্তায় কোথাও আটকে পড়লে ট্রেন মিস্‌ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় । সাড়ে নটা নাগাদ এক জায়গায় আমাদের গাড়ি থামল । সেখানে আমরা পরোটা আর তরকারী দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম । খরচ হল ৭১০/- টাকা ।

গাড়ি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন পৌঁছল দুপুর বারোটার একটু পরে । স্টেশনের IRCTC-র ক্যান্টিন থেকে ভাত ডাল মাছের ঝোল দিয়ে লাঞ্চ করে নিলাম । আমরা নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ফেরার সরাসরি টিকিট পাইনি, তাই দুপুর ২ঃ৪০ মিনিটের ক্যাপিটাল এক্সপ্রেসে ধরে বিকেল ৫ঃ১৫ মিনিটে পৌঁছলাম বারসোই । বারসোই থেকে সন্ধ্যে ৭ঃ১০ মিনিটের রাধিকাপুর এক্সপ্রেস ধরলাম । ডিনার আমরা নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকেই কিনে নিয়েছিলাম, রাতে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম । ট্রেন আমাদের কলকাতা স্টেশনে এসে পৌঁছে দিল পরেরদিন সোমবার ২রা এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ৬ টায় । ভ্রমণ শেষ !

সারসংক্ষেপঃ

১. পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিকে দার্জিলিঙ বাদ দিলে সবচেয়ে পরিচিত বেড়ানোর জায়গা সিকিমের গ্যাংটক । ভারতের পরিচ্ছন্নতম রাজ্যের রাজধানী এই জায়গা সারা বছরই পর্যটকদের আকর্ষণ করে থাকে ।
২. গ্যাংটকের উচ্চতা ৫,৪০০ ফুট যা দার্জিলিঙের থেকে প্রায় ১,৩০০ ফুট কম । তাই এখানে ঠান্ডাও তুলনামূলকভাবে কম ।
৩. নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি বা বাগডোগরা থেকে গাড়ি নিয়ে গ্যাংটক যেতে হয় । ঘন্টা চারেক সময় লাগে ।
৪. গ্যাংটকে থাকার প্রচুর হোটেল আছে, তবে এম জি মার্গের ওপরে কোনও হোটেলে থাকতে পারলে ভালো । আমাদের হোটেল 'ব্রাদার্স গেস্ট হাউস' খুবই সুন্দর আর এদের ভাড়াও খুব একটা বেশি নয় । এদের নিজস্ব ওয়েবসাইট নেই, আমরা https://www.goibibo.com/ থেকে এদের বুকিং করেছিলাম । এছাড়া অন্যান্য ওয়েবসাইট থেকেও বুকিং করা যায় । হোটেলের ফোন নম্বরঃ 03592202091, 03452398111, 9933091115, 9564000767.
৫. এই হোটেলে ব্রেকফাস্ট, ইভনিং স্ন্যাক্স বা চায়ের ব্যবস্থা থাকলেও লাঞ্চ বা ডিনারের ব্যবস্থা নেই । তবে বাইরে থেকে খাবার নিয়ে এসে এদের ডাইনিং রুমে খাওয়া যেতে পারে বা ঘরে বসেও খাওয়া যেতে পারে - সেক্ষেত্রে এরা বাসনপত্র দেয় ।
৬. এই হোটেলটা একেবারে ম্যালের ওপরেই । এখানে কাছাকাছি অনেক খাবার দোকান আছে আর একাধিক বাঙালী রেস্ট্যুরেন্টও আছে ।
৭. গ্যাংটকের ম্যাল সন্ধ্যের পরে সময় কাটানোর জন্য একটা অসাধারণ জায়গা । অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাজানো এই ম্যালের চারপাশ ঘিরে রয়েছে প্রচুরসংখ্যক দোকান যেখান থেকে নানারকম দরকারী বা অদরকারী জিনিস কেনা যেতে পারে ।
৮. গ্যাংটকের সাইট সিয়িং-এর মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত হল রুমটেক মনাস্ট্রি । গ্যাংটক গেলে সিকিম রাজ্যের সবথেকে বড় এই মনাস্ট্রিতে অবশ্যই যাওয়া উচিৎ ।
৯. অন্যান্য সাইট সিয়িং এর মধ্যে বনজাকরি ওয়াটার ফলস্‌ আর রিজ পার্ক ফ্লাওয়ার এক্সিবিশন সেন্টারও খুব সুন্দর । এছাড়া আরও অনেক ঘোরার জায়গা আছে যেগুলোর সম্পর্কে ইন্টারনেটে জেনে নেওয়া যেতে পারে বা এখানকার হোটেলের থেকেও জানা যেতে পারে ।
১০. গ্যাংটক থেকে ডে-ট্রিপে ছাঙ্গু বা আর বাবা হরভজন সিং-এর মন্দির অবশ্যই দেখতে হবে । এখানকার উচ্চতা গ্যাংটকের দ্বিগুণেরও বেশি তাই হৃদযন্ত্র বা ফুসফুসের সমস্যা থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েই যাওয়া উচিৎ ।
১১. এই দুটো জায়গায় গেলে নাথুলা পাস খোলা আছে কিনা জেনে নেওয়া দরকার । যদি থাকে তাহলে নাথুলাও দেখে আসতে হবে ।
১২. এই জায়গাগুলো দেখার জন্য মিলিটারির পার্মিট লাগে । এই পার্মিট পাওয়ার জন্য নিজের দু'কপি করে ফোটো আর সচিত্র পরিচয়পত্র সঙ্গে থাকতে হবে । পার্মিট জোগাড় করতে সাধারণতঃ একদিন সময় লাগে, তাই যেদিন গ্যাংটকে পৌঁছনো হচ্ছে তার পরেরদিনই এখানে যাওয়ার পরিকল্পনা না করাই ভালো ।
১৩. গ্যাংটকের তুলনায় ছাঙ্গুর তাপমাত্রা অনেক কম । বছরের মধ্যে ছ'মাস তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে থাকে । তাই উপযুক্ত গরম পোষাক সঙ্গে রাখা দরকার ।
১৪. খুব শীতের সময়ে ছাঙ্গু লেক বরফে ঢেকে যায়, সে দৃশ্যও চমৎকার । কিন্তু অনেক সময়ে রাস্তায় খুব বরফ পড়লে মিলিটারির লোকেরা এখানে যাওয়ার অনুমতি দেয় না । সেই বিষয়গুলো আগে থেকে খোঁজ নিয়ে যাওয়াই ভাল ।

উপসংহারঃ

গ্যাংটক !
যদি পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে আর সেইসঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যের দাবী থাকে তাহলে গ্যাংটক হচ্ছে একেবারে আদর্শ জায়গা । পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে যে জায়গাগুলো যাওয়া যায় তার মধ্যে জনপ্রিয়তার দিক থেকে দার্জিলিঙের পরেই গ্যাংটকের স্থান আর এখানে তুলনায় ভিড় কম হয় । গ্যাংটক সিকিমের রাজধানী, তাই অসম্ভব পরিচ্ছন্ন হবে তাতে আশ্চর্য্য হওয়ার কিছু নেই । কিন্তু জায়গার সঙ্গে সঙ্গে পরিচ্ছন্ন এখানকার মানুষের মন । এদের জীবনযাত্রা সচ্ছল আর তাই অন্য অনেক জায়গার মতো নোংরামি জিনিসটা এখানে একেবারেই নেই । সিকিমের আয়ের একটা প্রধান উৎস ট্যুরিজম আর সেটা এখানকার মানুষ খুব ভালোভাবে জানে । তাই এদের আতিথেয়তায় কখনও কোনও ত্রুটি দেখা যায় না । আর এই আতিথেয়তা শুধু মানুষের কাছ থেকে নয়, তার সমান প্রকাশ প্রকৃতির মধ্যেও বর্তমান । অসাধারণ সিনিক বিউটি অবারিত দ্বার খুলে প্রকৃতি যেন এখানে পর্যটকদের চুম্বকের মতো টানে । প্রকৃতি আর সভ্যতার যুগপত সেই টান অনুভব করা সম্ভব যেকোনও প্রান্ত থেকেই - শুধু নিজের মধ্যে থাকতে হবে সেই টান অনুভব করতে পারার ক্ষমতা । তাই নিজে যদি লোহা হতে পারা যায়, তাহলে এই চুম্বকের টানকে উপেক্ষা না করে বেরিয়ে পড়তে হবে পাহাড়ের চূড়া - গ্যাংটকের উদ্দেশ্য !

গ্যাংটক ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.