আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Thursday, October 10, 2019

কামারপুকুর জয়রামবাটী ভ্রমণ

ভ্রমণপথঃ

বুধবার ৯ই অক্টোবর, ২০১৯ঃ সকাল ৭ঃ৩০ মিনিটে কলকাতা - সকাল ১১ টা কামারপুকুর - কামারপুকুরে রাত্রিবাস
বৃহস্পতিবার ১০ই অক্টোবর ২০১৯ঃ সকাল ৯ টা কামারপুকুর - সকাল ১০ টা জয়রামবাটী - কোয়ালপাড়া - আনুড় - বিকেল ৫ঃ৩০ মিনিটে কলকাতা

ঠারো বছর বয়সে একজন মানুষ সাবালক হয় । আর তখন থেকেই সে নিজের জীবনের পথ নিজের মতো করে তৈরি করে নেওয়ার ছাড়পত্রও পায় । কিন্তু এই আঠারো বছর বয়স শুধু যে মানুষ বা অন্যান্য জীবের হয় তা নয়, প্রতিজ্ঞারও হয় । সেই প্রতিজ্ঞা যা একটা আঠারো বছরের ছেলে করেছিল আজ থেকে প্রায় আঠারো বছর আগের একটা সকালে ।

দিনটা ছিল ১০ই নভেম্বর, ২০০১ । কয়েকঘন্টা হল ছেলেটা শ্মশান থেকে ফিরেছে তার ভীষণ নিজের 'ঠাম্‌মা'কে দাহ করে । কোনও একটা অলিখিত নিয়মে দাদু-ঠাম্‌মার সঙ্গে নাতি-নাতনীদের আত্মিক বন্ধন সাধারণতঃ খুব গভীর হয় । আর এই ছেলেটার বড় হয়ে ওঠার পিছনে তার ঠাম্‌মার ভূমিকা অপরিসীম । ছেলেটার জীবনের ইমারত নির্মিতই হয়েছে ছোটবেলা থেকে ঠাম্‌মার তৈরি করা মূল্যবোধের ভিতের ওপর । 'নাতি' বলতে তিনিও অজ্ঞান ছিলেন, নাতিকে প্রাণাধিক ভালোবাসতেন, কিন্তু কখনও আস্কারা দিতেন না । সেই ঠাম্‌মা ৭৮ বছর বয়সে পড়ে গিয়ে পায়ের হাড় ভাঙলেন ২০০১ সালের আগস্ট মাসে । হাড় আর জোড়া লাগল না । মাসতিনেক শয্যাশায়ী থেকে অবশেষে ৯ই নভেম্বর সন্ধ্যেবেলা চলে গেলেন । রেখে গেলেন একমাত্র ছেলে, ছেলের বউ, আদরের নাতি আর - একটা অতৃপ্ত ইচ্ছেকে । এই ইচ্ছেটা ওনার নিজের ভাষাতেই লিখছি - "একবার জয়রামবাটী-কামারপুকুর দেখে আসব ।" শ্মশান থেকে ফিরে এসে ছেলেটা প্রতিজ্ঞা করল ঠাম্‌মাকে সে জয়রামবাটী-কামারপুকুর দেখাতে নিয়ে যাবে ।

দেহের মৃত্যু হয়, আত্মার হয় না । ঠাম্‌মাও কোনওদিনই তাঁর আদরের নাতির থেকে দূরে যেতে পারবেন না, তাই ঠামমাকে ঘোরানোর জন্যই ছেলেটা কামারপুকুর-জয়রামবাটী যাওয়ার পরিকল্পনা করল । সঙ্গে থাকল মা-বাবা, স্ত্রী অমৃতা, কথা-কলি আর বড়মাসি ।

আমি আমার কোনও লেখা কখনও কাউকে উৎসর্গ করিনি । আজ করতে ইচ্ছে করছে । তোমার জন্য আমার বড় হয়ে ওঠাটা এত সুন্দর । তোমার কাছে শেখার ফলে নিজের হাতের লেখা নিয়ে আজও আমার গর্ব আছে । তোমার কাছেই প্রথম আঁকা শেখা । ইস্কুলের সব গল্পের তুমিই অক্লান্ত শ্রোতা । আজ ব্লগ লেখার সুবাদে যেটুকু লিখতে পারি, সেটা তোমার কাছ থেকেই শেখা । কামারপুকুর-জয়রামবাটী তোমার জন্যই যাওয়া । তাই এই ভ্রমণ আর ভ্রমণকাহিনী - তোমাকেই উৎসর্গ করছি ।

বৃষ্টিভেজা পথে
৯ই অক্টোবর, ২০১৯ বুধবার - তিথি হিসেবে দেখতে গেলে দুর্গাপুজোর একাদশী । সকাল সাড়ে সাতটার সময়ে আমরা আমাদের গাড়ি নিয়ে বেরোলাম । বলা বাহুল্য, চালক আমি । কলকাতা থেকে যেতে গেলে কামারপুকুর আগে পড়ে আর তার দূরত্ব একশ' কিলোমিটারের মতো । যেতে ঘন্টাতিনেকের বেশি লাগার কথা নয়, তবে আমাদের একটা ঘুরে যেতে হবে কারণ বড়মাসিকে তার বাড়ি থেকে তুলতে হবে । রাস্তা মোটামুটি জানাই ছিল আর সেইসঙ্গে Google Map এর সাহায্য নিয়ে যেতে কোনও অসুবিধেই হল না । যাওয়ার পথে যেটা উপরি পাওনা সেটা হল তুমুল বৃষ্টি যেটা লঙ-ড্রাইভে একটা অসাধারণ উপভোগ্য জিনিস । রাস্তার দু'পাশে কখনও শহর, কখনও শহরতলী, কখনও গ্রাম আর কখনও শুধু ধানক্ষেত - এইসবের মাঝখান দিয়ে বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালিয়ে যেতে দুর্দান্ত লাগছিল ।

প্রাতঃরাশ বিরতি
গাড়ি প্রথমবার থামল ব্রেকফাস্টের জন্য আরামবাগ পৌঁছনোর কিছুটা আগে । দোকানটার নাম 'কৈলাশ হোটেল ও গেস্ট হাউস' ।  নামটা এইজন্যই উল্লেখ করলাম যে এখানকার খাবার বেশ ভালো এবং দামও খুব বেশি নয় । আর সেইসঙ্গে ভালো মালিকের আতিথেয়তা । আমরা এখানে পাঁউরুটি আর ওমলেট খেয়ে নিলাম । কামারপুকুর যাওয়া আসার সময়ে চাইলে এখানে খাওয়াদাওয়া করে নেওয়া যেতে পারে । রেস্টুরেন্টের যোগাযোগের নম্বর - ৭০০১৮২৩৯৪৪ ।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য এই দোকানে মাত্র কয়েকদিন আগে এসেছিলেন স্বয়ং পি সি সরকার (জুনিয়র) । এখানে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেন এবং খাওয়াদাওয়া করেন । হোটেলের মালিক স্বাভাবিকভাবেই ওনার সঙ্গে সপরিবারে ছবিটবি তোলেন । পি সি সরকার ওনাকে যাওয়ার আগে কয়েকটা ম্যাজিক শিখিয়ে দিয়ে যান যার একটা উনি আমাদের দেখালেন । ওনার হোটেলে ঢোকার আগে আমাদের পকেটে যা টাকা ছিল, সবাই মিলে ব্রেকফাস্ট করে বেরোনোর পরে দেখলাম তার থেকে ২৬৫/- টাকা কম আছে !

এখান থেকে কামারপুকুর আরও ২০ কিলোমিটারের মতো রাস্তা আর আমাদের পৌঁছতে লাগল আরও চল্লিশ মিনিট । সকাল এগারোটা নাগাদ পোঁছে আমাদের প্রথমেই যে কাজটা করতে হল সেটা হচ্ছে রামকৃষ্ণ মিশনের ভোগের টিকিট সংগ্রহ করা । ভোগের মূল্য মাথাপিছু ৪০/- টাকা । যদি মঠে ভোগ খাওয়ার ইচ্ছে থাকে তাহলে সাড়ে এগারোটার মধ্যে এই টিকিট সংগ্রহ করতে হবে । আমরা টিকিট কাটার পরে সুবিশাল হলঘরে ঢুকে খেতে বসলাম । এখানে ছেলে আর মেয়েদের আলাদা বসার ব্যবস্থা ।

খাবারের বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছি না আর ভোগের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেই বলছি, এখানকার খাবার অতি অখাদ্য ! নিরামিষ রান্না কিন্তু সেটা আমার অপছন্দের প্রধান কারণ নয় । চাইলে নিরামিষ রান্নাও একটা পর্যায় পর্যন্ত্য সুস্বাদু করা সম্ভব । কিন্তু এদের খাবার খেয়ে মনে হয় এরা যেন চেষ্টা করেই রান্নাটা অখাদ্য খেতে করে । রাস্তার ধারের যেকোনও সাধারণ ভাতের হোটেলে এদের থেকে সুস্বাদু রান্না করতে পারে ।

পরমপুরুষ হোটেলের ঘর
খাওয়া (বা বলা ভালো আবর্জনা দিয়ে গর্ত বোজানো) শেষ করে আমরা গেলাম আমাদের 'হোটেল পরমপুরুষ'-এ । পীক সিজন্‌ না হলে এখানে হোটেল আগে থেকে বুকিং না করে গেলেও চলে । মঠ অফিসের একজন ভদ্রলোকের কাছ থেকে আমরা এই হোটেলের সন্ধান পেলাম । মঠ থেকে গাড়িতে মিনিট পাঁচেক, হেঁটে গেলেও দশমিনিটের বেশি লাগার কথা নয় । হোটেলটা বেশ ভালোই । আমরা দু'টো ডাবল বেড ঘর নিলাম । ভাড়া ঘরপিছু ৫০০/- টাকা ।

সত্যি বলতে কি, পরমপুরুষ হোটেলকে হোটেল না বলে বাড়ি বলাই ভালো । বাড়ির মালিক নিজে থাকেন একতলায় আর দোতলা, তিনতলাটা হোটেল হিসেবে ভাড়া দেন । ঘরগুলো বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, বাথরুমে গিজার সবই আছে । আমরা দুপুরে ঘরে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নিলাম । তারপর বিকেল চারটে নাগাদ বেরোলাম ।

যারা জানে না তাদের জন্য বলছি , কামারপুকুর হল শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জন্মস্থান । আর জয়রামবাটী সারদামণির জন্মস্থান । এখানে একটা কথা লেখা দরকার বহু মানুষকে বিভিন্নসময়ে দেখেছি শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে 'ঠাকুর' আর সারদামণিকে 'মা' বলে সম্বোধন করতে । আমি কিন্তু এটা করি না আর তাই আমার লেখায় শ্রীরামকৃষ্ণকে 'শ্রীরামকৃষ্ণ' বা কখনও কখনও 'রামকৃষ্ণ' বলেই উল্লেখ থাকবে । একইভাবে সারদামণিকে আমি 'সারদা মা' বা কখনও কখনও শুধু 'সারদা'ও লিখব । এতে কারুর ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত লাগলে আমি আমার হৃদয়ের অন্তরতম বিন্দু থেকে তাদের জানাচ্ছি যে - আমার তাতে কিচ্ছু এসে যায় না । স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণের অনুরাগীদের বলেছিলেন - আপনারা ওনাকে (রামকৃষ্ণকে) মানুষই থাকতে দিন, দয়া করে ওনাকে ভগবান বানাবেন না !

কামারপুকুর ভ্রমণঃ

কামারপুকুর মঠের ঠিক উল্টোদিকে বেশ বড় একটা পার্কিং লট আছে, সেখানে গাড়ি রেখে মঠের ভিতরে ঢোকা যায় । মঠের খোলাবন্ধের সময় নিম্নরূপ -
এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর ঃ ভোর ৫ঃ৩০ থেকে বেলা ১১ঃ৩০ পর্যন্ত্য ও বিকেল ৪ টে থেকে রাত ৮ঃ৩০ পর্যন্ত্য ।
অক্টোবর থেকে মার্চ ঃ সকাল ৬ টা থেকে বেলা ১১ঃ৩০ পর্যন্ত্য ও বিকেল ৩ঃ৩০ থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত্য ।
আমরা মঠের ভিতরে ঢুকে দেখা শুরু করলাম । এখানে ভিতরে ফোটো তোলা বারণ, সেটা বিভিন্ন জায়গায় লেখা আছে আর সেইসঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীরা সেই বিষয়ে কড়া নজর রাখে । এরকম পরিস্থিতিতে কিছু লোকজনের লুকিয়ে চুরিয়ে ছবি তোলার অভ্যেস থাকলেও সেটা আমার নেই, তাই এই লেখার সঙ্গে ভিতরের ছবি দেওয়া গেল না ।

শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের গেটের ঠিক ভিতরে
শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ - মঠের মেইন গেট দিয়ে ঢুকে ভিতরে ঢোকার সময়ে একটা আমগাছ দেখা যায়, যেটা শ্রীরামকৃষ্ণের লাগানো । এই গাছ বেঁচেও আছে  আর ফলও দেয় । এটা এখন মানুষের কাছে একটা ধর্মীয় জিনিস, এর গায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করে লোকজন পুণ্য সঞ্চয় করে । মঠ কর্তৃপক্ষ তাই এর পাশে একটা লোহার জাল লাগিয়ে দিয়েছে যেটা ভেদ করে গাছের গায়ে হাত দেওয়া কিঞ্চিৎ কষ্টসাধ্য ।

ভিতরে দ্বিতীয় দ্রষ্টব্য হল রামকৃষ্ণের মন্দির । এই মন্দিরে রামকৃষ্ণের মূর্তি আছে । এই জায়গাটার বৈশিষ্ট্য হল আজ থেকে ১৮৩ বছর আগে ঠিক এই জায়গাতেই শ্রীরামকৃষ্ণ জন্মেছিলেন । এই জায়গাটা সেইসময়ে ছিল ওনাদের বাড়িরই একটা অংশ ।

এই মন্দিরের সঙ্গে প্রায় লাগোয়া রামকৃষ্ণের বাড়ি । আগেকার দিনে গ্রামবাংলায় যেরকম বাড়ি দেখা যেত, একেবারে সেই জিনিস । খড়ের চাল দিয়ে ঢাকা মাটির কুঁড়েঘর । এরকম কয়েকটা কুঁড়েঘর আর মাঝখানে উঠোন নিয়ে ছিল রামকৃষ্ণের পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি । এখানে রামকৃষ্ণের ঘর আর ওনার দাদার ঘর ছাড়াও দেখা যায় ওনাদের গৃহদেবতা রঘুবীরের মন্দির । শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরটাকে বর্তমানে বইপত্র রাখার কাজে ব্যবহার করা হয় আর ভিতরে সাধারণ দর্শনার্থীদের ঢুকতে দেয় না । আমরা বাইরে থেকে দেখে চলে এলাম ।

মঠের ভিতরে এছাড়া দেখা যায় মঠ কার্যালয়, কিন্তু সেখানে দেখার কিছু নেই । এটা বাদ দিয়ে আর একটা জিনিসই দেখার ছিল সেটা হল যুগি শিবের মন্দির । যুগিবংশীয় রামানন্দ যুগি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । এর বৈশিষ্ট্য হল শ্রীরামকৃষ্ণ জন্মানোর আগে নাকি ওনার মা চন্দ্রামণি দেবী এই শিবের থেকে স্বপ্ন পান ইত্যাদি ইত্যাদি । আমি সেইসমস্ত গপ্প এখানে বিস্তারিত লিখছি না, যদি জানার ইচ্ছে থাকে কামারপুকুর সম্পর্কে ইন্টারনেটে একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে । আর খুব ইচ্ছে থাকলে কামারপুকুর চলে যাওয়াই হবে উপযুক্ত কাজ !

হালদার পুকুর
হালদার পুকুর - সন্ধ্যে হয়ে আসছিল আর মঠের ভিতরে আর কিছু দেখারও নেই, তাই আমরা বেরিয়ে এলাম । মঠের গেটের ঠিক উল্টোদিকে একটা পুকুর আছে, সেটার নাম হালদারপুকুর । এই পুকুরে রামকৃষ্ণ চান করতেন । পুকুরটার একটা বৈশিষ্ট্য হল এর আকৃতি চৌকো, সাধারণতঃ এরকম আকারের পুকুর খুব একটা দেখা যায় না । আমরা পুকুরের পাশে কিছুক্ষণ বসে ছবি টবি তুলে চলে এলাম ।

কামারপুকুরে আরও কয়েকটা জায়গা আছে, সেগুলো গাড়ি করে দেখা সম্ভব নয় । তার কারণ একেকটা জায়গা এমনই সরু গলির মধ্যে যে সেখানে গাড়ি ঢুকবে না । কোনও জায়গাই বিশাল কিছু দূর নয় যে হেঁটে ঘোরা অসম্ভব, তবে সঙ্গে বাচ্চা বা বয়স্ক লোক থাকলে সেটা না করাই ভালো । মঠের গেটের সামনে টোটো পাওয়া যায় যারা এই সবক'টা জায়গা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেয় । ভাড়া ১০০ টাকা । আমাদের দলে পাঁচজন বড় আর দু'জন বাচ্চা তাই আমাদের একটা টোটোতেই হয়ে গেল ।

লক্ষ্মণ পাইনের বাড়ির লাগোয়া মন্দির
লক্ষ্মণ পাইনের বাড়ি - টোটো প্রথমে আমাদের নিয়ে গেল লক্ষ্মণ পাইনের বাড়ি । এই বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ ছোটবেলায় যেতেন । এখানে রামায়ণ - মহাভারত ইত্যাদি পাঠ হত আর সেখানে রামকৃষ্ণ ভাবাবেশে উপস্থিত হতেন (এটা এই বাড়ির গায়ে লেখা আছে) । এই বাড়ির লাগোয়া একটা মন্দির গোছের আছে, পাঠ সেখানেই হত ।




দুর্গাদাস পাইনের বাড়ি - লক্ষ্মণ পাইনের বাড়ি থেকে ফেরার পথে টোটোওয়ালা আরেকটা বাড়ি দেখালো, সেটা দুর্গাদাস পাইনের । কামারপুকুরে এসে রামকৃষ্ণের পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় প্রথম কিছুদিন এনার বাড়িতেই বাস করেন । এই বাড়িতে এখন দুর্গাদাস পাইনের বংশধররা থাকেন বলে এই বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখা যায় না ।

লাহাবাবুদের মন্দির
লাহাবাবুদের বিষ্ণুমন্দির - এরপর লাহাবাবুদের বিষ্ণুমন্দির । ধর্মদাস লাহা ছিলেন এই বাড়ির মালিক । এনার সঙ্গে ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল । এই মন্দিরটা দোতলা । এর নিচে বিষ্ণুর মন্দির আর উপরে দুর্গার মন্দির ।














রামকৃষ্ণের পাঠশালা
রামকৃষ্ণের পাঠশালা - লাহাবাবুদের বিষ্ণুমন্দিরের লাগোয়া হল পাঠশালা যেখানে রামকৃষ্ণ পড়তে যেতেন । রামকৃষ্ণ নাকি পাঠশালায় পড়তে না গিয়ে এই মন্দিরে এসে মা-কালীর মূর্তি আঁকতেন আর ধ্যান করতেন (খুবই অমনোযোগী ছাত্র ছিলেন আর কি !)। মন্দিরের লাগোয়া পাঠশালাটা বেশ সুন্দর । পাঠশালা জিনিসটা সাধারণতঃ সিনেমাতেই দেখেছি, সত্যিকারের পাঠশালা কেমন দেখতে হয় সেটা আগে কখনও দেখিনি । বেশ ভালোই লাগছিল । পাঠশালার ঠিক পাশে একটা রাসমন্দির আছে যেখানে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি রয়েছে ।

গোপেশ্বর শিবমন্দির
গোপেশ্বর শিবমন্দির - এরপর পথে পড়ল গোপেশ্বর শিবমন্দির । এখানে আমরা নামিনি, টোটোওয়ালা মন্দির দেখিয়ে বলল এখানে রামকৃষ্ণের মা চন্দ্রামণি দেবী আসতেন । আমরা এগিয়ে চললাম ।








ভবতারিণী মন্দির
ভবতারিণী মন্দির - পরবর্তী গন্তব্য ভবতারিণী মন্দির । রামকৃষ্ণের জন্মদাত্রী ধাইমা ধোনী কামারনির মন্দির যিনি তৈরি করেন, সেই রাধাচরণ দাসের ঠাকুরবাড়ি হল এই ভবতারিণীর মন্দির ।














ধোনী কামারনির মন্দির
ধোনী কামারনির মন্দির ও বাড়ি - এরপর ধোনী কামারনির মন্দির এবং তাঁর বাড়ি । আগেই বলেছি ধোনী কামারনি ছিলেন রামকৃষ্ণের ধাইমা । সেইসঙ্গে উপনয়ন (পৈতে)-এর সময়ে তিনি রামকৃষ্ণের ভিক্ষামা-ও ছিলেন । ধোনী কামারনি ছিলেন অব্রাহ্মণ আর সেইযুগে অব্রাহ্মণদের ভিক্ষামা হওয়া ছিল রীতিবিরুদ্ধ (সেই নিয়ম আজও অপরিবর্তিত আছে)। কিন্তু রামকৃষ্ণ চেয়েছিলেন তাঁর জন্মদাত্রী ধাইমা-ই তাঁর ভিক্ষামা হোন । রামকৃষ্ণের দাদা রামকুমার এর তীব্র বিরোধিতা করলেও শেষপর্যন্ত্য রামকৃষ্ণেরই জয় হয় । অব্রাহ্মণ ধোনী কামারনি হয়ে যান রামকৃষ্ণের ভিক্ষামা ।

যাঁরা রামকৃষ্ণকে 'ঠাকুর' বলে সম্বোধন করেন আর তাঁর তথাকথিত অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ শুনে অশ্রুবিগলিত হয়ে পড়েন, তাঁদের মধ্যে এরকম কতজন আছেন যাঁরা তাঁদের নিজেদের বা পরিচিতদের পরিবারে এরকম একটা আবহমানকাল ধরে চলে আসা অবান্তর নিয়মের বিরোধিতা করে সেটাকে বন্ধ করতে পারেন ? বন্ধ করা তো দূরের কথা, করার সাহস দেখাতে পারেন ? তিনি রামকৃষ্ণ বলে এটা করতে পারেননি, করতে পেরেছিলেন বলে তিনি রামকৃষ্ণ । আমি তাঁকে এই কারণেই শ্রদ্ধা করি - এই কারণেই তিনি আমার কাছে ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব !

'কামারপুকুর'
কামারপুকুর - এরপর আমরা গেলাম 'কামারপুকুর' দেখতে । এটা একটা পুকুর আর এই পুকুরের নামেই গ্রামের নাম । পুকুরটার কোনও আলাদা বৈশিষ্ট্য নেই, এখনও এর জল স্বাভাবিক জনজীবনে ব্যবহার হয় । রাতের অন্ধকারে আমরা পুকুরটা বিশেষ দেখতে পেলাম না, তাই পরেরদিন সকালে গেলাম আরেকবার দেখতে । পরেরদিন সকালে তোলা ছবিটাই এখানে লেখার সঙ্গে দেওয়া হল ।

চিনু শাঁখারির বাড়ির পাঁচিল
চিনু শাঁখারির বাড়ি - আমাদের শেষ গন্তব্য চিনু শাঁখারির বাড়ি । এই ব্যক্তিই নাকি রামকৃষ্ণকে প্রথমবার ঈশ্বররূপে দেখতে পান । রামকৃষ্ণ এনাকে বলেন ব্যাপারটা গোপন রাখতে কিন্তু সে চতুর্দিকে সেটা রাষ্ট্র করে বেড়ায় । এরফলে রামকৃষ্ণের অভিশাপে (যদিও অভিশাপ জিনিসটা রামকৃষ্ণের ভাবমূর্তির সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না) সে নির্বংশ হয়ে যায় । এই কারণে চিনু শাঁখারির বাড়ি আজ আর নেই, বাড়ির এলাকাটা মঠের সম্পত্তি আর তারা এটা পাঁচিল দিয়ে ঘিরে রেখেছে । এই জায়গাটাও আমরা রাতের অন্ধকারে ভালোভাবে দেখতে পাইনি, পরেরদিন সকালে আবার দেখলাম ।

আমাদের কামারপুকুর দেখা শেষ । টোটো আমাদের মঠের সামনে নামিয়ে দিল । আমরা সন্ধ্যের টিফিনের জন্য কিছু খাবার কিনে হোটেলে ফিরে এলাম । আমাদের হোটেলে গাড়ি রাখার কোনও জায়গা নেই, এইজাতীয় হোটেলে সেটা আশা করাও ঠিক নয় । হোটেলের মালিকের পরামর্শে আমরা গাড়ি রাখলাম হোটেল থেকে অনতিদূরে রাস্তার পাশে একটা ফাঁকা জায়গায় ।

রাতের রুটি আর ডিমের কারি হোটেল থেকেই নেওয়া হল আর বাইরে থেকে আনা চিকেন কারি ছিল । সবমিলিয়ে ডিনারে খরচ হল ২৯০ টাকা ।

হোটেলের ছাদ থেকে দৃশ্য
১০ই অক্টোবর, ২০১৯ বৃহস্পতিবার । সকালে ঘুম থেকে উঠে চানটান করে রেডি হয়ে নিলাম । আমাদের হোটেলের ছাদটা খুব সুন্দর, সেখান থেকে আশেপাশে অনেকদূর পর্যন্ত্য দেখা যায় । এখানে পাশদিয়েই একটা রেললাইন গেছে, যদিও সেটা এখনও অসম্পূর্ণ তাই সেখান দিয়ে কোনও ট্রেন যায় না । কামারপুকুর হাওড়া-তারকেশ্বর-আরামবাগ লাইনে পড়ে, সেই পথেই এখানে ট্রেনে আসা যায় ।


সকাল ন'টা নাগাদ হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম । যাওয়ার পথে কামারপুকুর আর চিনু শাঁখারির বাড়িটা আরেকবার দেখে নিলাম ।

মানিক রাজার প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ
মানিক রাজার প্রাসাদ - কামারপুকুর থেকে আমাদের গন্তব্য জয়রামবাটী । কামারপুকুর থেকে জয়রামবাটীর দূরত্ব ৫.৫ কিলোমিটারের মতো তবে পথে আরেকটা দেখার মতো জায়গা আছে । সেটা হল মানিক রাজার প্রাসাদ । কামারপুকুর থেকে কামারপুকুর-জয়রামবাটী রোড ধরে ১.৫ কিলোমিটার মতো গিয়ে একজায়গায় মেইন রোড ছেড়ে একটা মাটির রাস্তা ধরে ৭০০ মিটার মতো গিয়ে একজায়গায় আমরা গাড়ি রাখলাম । এই মাটির রাস্তাটা একেক জায়গায় বেশ সরু আর বর্ষার সময়ে কাদা থাকলে এ'পথে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো । গাড়ি একজায়গায় রেখে আমরা বাকি পথটা হেঁটে গেলাম মানিক রাজার প্রাসাদ দেখতে ।

মানিক রাজা ছিলেন এই অঞ্চলের জমিদার এবং একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি । এনার বাড়িতে রামকৃষ্ণের যাতায়াত ছিল । বাড়ি বলতে এখন আর কিছুই নেই, একটা বড় বাড়ির ভগ্নাবশেষ । তবে মাঠের মাঝখানে রাজবাড়ির মূলফটকটা আজও দাঁড়িয়ে আছে । জায়গাটা কোনওভাবে সংরক্ষণও করা হয় না, কাজের এর ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে পারলাম না ।

জয়রামবাটী ভ্রমণঃ

মানিক রাজার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা ধরলাম জয়রামবাটীর পথ । রাস্তাটা বেশ সুন্দর আর রোদের তেজ সেরকম বেশি না থাকায় বেশ আরামদায়ক একটা অনুভূতি হচ্ছিল । সকাল প্রায় দশটা নাগাদ আমরা জয়রামবাটীতে পৌঁছলাম ।

জয়রামবাটীতেও কামারপুকুরের মতো একটা বড় পার্কিং লট আছে, সেখানে গাড়ি রেখে আমরা কচুরি-তরকারি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম । তারপর মিনিট পাঁচেক হেঁটে পৌঁছলাম মাতৃ মন্দিরে ।

জয়রামবাটীর মাতৃমন্দিরের বাইরে
মাতৃমন্দির - কামারপুকুরের মতো জয়রামবাটীতেও মাতৃমন্দিরের ভিতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ । জয়রামবাটীতে সারদা মা যেখানে জন্মগ্রহণ করেন, সেই জায়গায় মাতৃমন্দির তৈরি করা হয়েছে । ঠিক যে জায়গায় সারদা মা জন্মগ্রহণ করেন, সেখানে তাঁর একটা শ্বেতপাথরের মূর্তি রয়েছে । কামারপুকুরের মতো এখানেও সেই মূর্তির সামনে একটা বেশ বড় হলঘরের মতো রয়েছে যেখানে বসে সবাই প্রার্থনা বা ধ্যান করতে পারে । আমরা মন্দিরটা কিছুক্ষণ ঘুরে বেরিয়ে এলাম ।

পুন্যিপুকুর - মাতৃমন্দিরের ঠিক সামনেই পুন্যিপুকুর । সারদা মা এই পুকুর ব্যবহার করতেন । পুকুরটা বিশাল বড়, এবং চারদিক রেলিং দিয়ে ঘেরা ।

নতুন বাড়ি - মাতৃমন্দিরের বাঁদিক দিয়ে কিছুটা হেঁটে গেলে একটা পাঁচিল ঘেরা জায়গার ভিতরে সারদা মায়ের নতুন বাড়ি । ১৯১৫ সাল থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত্য তিনি এখানে থাকতেন । রামকৃষ্ণের বাড়ির মতো এখানেও কয়েকটা খড়ের চাল দিয়ে ঢাকা মাটির কুঁড়েঘর আর একটা উঠোন রয়েছে ।

পুরনো বাড়ি - মাতৃমন্দিরের মূল ফটক থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে পড়ে সারদা মায়ের পুরনো বাড়ি । এখানে ১৯১৫ সালের আগে পর্যন্ত্য তিনি থাকতেন । নতুন বাড়ির মতো এখানেও খড়ের চাল দিয়ে ঢাকা কয়েকটা মাটির বাড়ি রয়েছে ।

জয়রামবাটী ভ্রমণ এখানে শেষ, আমাদের এখানে আর কিছু দেখার নেই । জয়রামবাটীর যেদিকে কামারপুকুর তার বিপরীত দিকে আরও ৭.৫ কিলোমিটার গেলে পড়ে কোয়ালপাড়া আশ্রম । জয়রামবাটী থেকে আমরা রওনা দিলাম এই আশ্রমের উদ্দেশ্যে ।

কোয়ালপাড়া আশ্রম
কোয়ালপাড়া আশ্রম - জয়রামবাটী থেকে কলকাতা আসার সময়ে এখানে সারদা মা বিশ্রাম করতেন । আমরা যখন এখানে পৌঁছলাম তখন বেলা ১১ঃ৫০ আর ততক্ষণে মন্দির বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । আমরা মন্দিরের ভিতরে ঢুকতে না পারলেও আশ্রমের ভিতরে ঢুকে কিছুক্ষণ কাটালাম । এখানে একটা সাইনবোর্ড থেকে জানতে পারলাম যে স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে এই আশ্রম বিশেষ ভূমিকা পালন করে । এই আশ্রমে সারদা মায়ের উদ্যোগ চরকা কেটে কাপড় বোনার কাজ শুরু হয় ।

আশ্রম থেকে বেরোনোর সময়ে দেখলাম এখানে একটা আমগাছ আছে, যেটা সারদা মায়ের আম খেয়ে ফেলে দেওয়া আঁটি থেকে তৈরি হয়েছে ।

এবার আমরা ফেরার পথ ধরলাম । ফেরার পথে আবার জয়রামবাটী আশ্রমের রাস্তা পড়ল । সেটা পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম । কামারপুকুর মঠ থেকে ১ কিলোমিটার দূরে আমরা বাঁদিকে ঢুকে গেলাম । এবারে আমাদের গন্তব্য আনুড় বিশালাক্ষী মন্দির ।

বিশালাক্ষী মন্দির
আনুড় বিশালাক্ষী মন্দির - কামারপুকুর-জয়রামবাটী রোড থেকে ২.৮ কিলোমিটার ভিতরে গেলে পড়ে আনুড় বিশালাক্ষী মন্দির । এই মন্দিরে রামকৃষ্ণ আসতেন । মন্দিরটা খুব একটা বড় নয় তবে চারপাশটা খুব সুন্দর । আমরা এখানে কিছুক্ষণ থেকে আবার ফেরার পথ ধরলাম ।





বিশালাক্ষী মন্দির থেকে বেরোলাম তখন দুপুর ১২ঃ৩০ । এখান থেকে আমরা ফেরার পথে আবার গেলাম 'কৈলাশ হোটেল ও গেস্ট হাউস' । আগেই ফোন করে লাঞ্চের অর্ডার দেওয়া ছিল, আমরা গিয়ে চিকেন কারি আর এগ কারি দিয়ে ভাত খেয়ে নিলাম । খরচ হল ৫৪৫/- টাকা ।

এরপর আর দাঁড়াইনি । যাওয়ার পথেই ফিরলাম আর ফেরার পথে বড়মাসিকে বাড়িতে নামিয়ে দিলাম । বিকেলে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন প্রায় সাড়ে পাঁচটা ।

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে শ্রীরামকৃষ্ণ আর সারদা মায়ের জন্মস্থান হুগলী জেলায় কামারপুকুর আর বাঁকুড়া জয়রামবাটী । কলকাতা থেকে গেলে কামারপুকুর প্রথমে পড়ে আর জয়রামবাটী পরে পড়ে ।
২. কলকাতা থেকে কামারপুকুর গাড়ি করে যাওয়া যায় । এছাড়া ধর্মতলা থেকে সরাসরি কামারপুকুর যাওয়ার জন্য বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি বাস আছে ।
৩. হাওড়া থেকে লোক্যাল ট্রেনে করেও কামারপুকুর যাওয়া যায় । কামারপুকুরের সবথেকে কাছের স্টেশন হল গোঘাট, সেখান থেকে টোটো বা ভ্যানে করে কামারপুকুর যাওয়া যায় ।
৪. গোঘাটের ট্রেন খুব কম, তাই আরামবাগ বা তারকেশ্বর লোক্যালে করে যাওয়া সুবিধেজনক । এই দুই স্টেশন থেকেই কামারপুকুরের বাস ছাড়ে ।
৫. কামারপুকুর আর জয়রামবাটী মন্দিরের খোলা-বন্ধের নির্দিষ্ট সময় আছে । সেইসময়মতো যাওয়াটাই শ্রেয় ।
৬. দুটো জায়গা ভালোভাবে দেখার জন্য একটা রাত এখানে থাকতে পারলে ভালো । তবে সেই সময় হাতে না থাকলে দুটো জায়গা একদিনেও দেখে নেওয়া যায় ।
৭. কামারপুকুরে থাকার জন্য এখানে কিছু কিছু হোটেল আছে যার মধ্যে 'পরমপুরুষ হোটেল' বেশ ভালো । এদের যোগাযোগ নম্বরঃ ৯৪৭৫৩৫৫৮৮৩ । এখানে খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলেও অনুরোধ করলে রান্না করে দেয় । এছাড়া মঠের কাছে খাবারের একাধিক দোকান আছে ।
৮. থাকার জন্য এখানে রামকৃষ্ণ মিশনের যাত্রীনিবাস আছে । তবে মিশনের লোকই জানাল সেটা সপরিবারে থাকার পক্ষে একেবারেই উপযুক্ত নয় । তাই পরিবারের লোকজন নিয়ে গেলে হোটেলই শ্রেয় ।
৯. কামারপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ প্রধান দেখার জায়গা । এছাড়া আশেপাশে আরও কতগুলো দেখার জায়গা আছে যেগুলো দেখার জন্য টোটো সবথেকে ভালো অপশন ।
১০. কামারপুকুর থেকে জয়রামবাটীর দূরত্ব ৭.৫ কিলোমিটারের মতো । দু'জায়গাতেই গাড়ি পার্কিং-এর সুবন্দোবস্ত আছে । টোটো বা বাসে করেও কামারপুকুর থেকে জয়রামবাটী যাওয়া যায় ।
১১. জয়রামবাটীতে মাতৃমন্দির ছাড়া আর সেরকম কিছু দেখার নেই । এখানেও খাবারের জন্য একাধিক দোকান আছে ।
১২. জয়রামবাটী থেকে অনতিদূরে কোয়ালপাড়া আশ্রম আছে । কলকাতা যাতায়াতের সময়ে এখানে সারদা দেবী বিশ্রাম করতেন । পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে এই আশ্রম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে ।
১৩. কামারপুকুরের খুব কাছে আনুড় বিশালাক্ষী মন্দির আছে । রামকৃষ্ণ ছোটবেলায় এখানে যাতায়াত করতেন ।

উপসংহারঃ

কামারপুকুর
ঈশ্বরে ভক্তি থাকুক বা না থাকুক, শ্রীরামকৃষ্ণ আর সারদা মাকে আস্তিক-নাস্তিক সকলেই বেশ পছন্দ করে এটা আমি বিভিন্ন সময়ে দেখেছি । আমার ধারণা এর প্রধান কারণ এনাদের অনাড়ম্বর জীবনযাপন আর সেইসঙ্গে মানুষের মধ্যে অবস্থান । শ্রীরামকৃষ্ণ একদিকে যেমন প্রচলিত আচার-বিচার মানতেন না, সেইসঙ্গে তাঁর মধ্যে খুব কঠিন তাত্ত্বিক কথা খুব সরলভাবে গল্পের মাধ্যমে বলতে পারার একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল । ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই তাঁর শিষ্য হতে পারত । এই সহজ-সরল মাটির স্বাভাবিক টানটা তাঁদের জন্মস্থানে গেলে আজও কিছুটা অনুভব করা যায় । হয়তো এই কারণেই মঠ বা অন্যান্য জায়গাগুলোর কোনওটাতেই ব্যবসায়িক লেনদেনের ব্যাপারটা একেবারেই চোখে পড়ে না । তাই ঈশ্বরের ভক্তদের কাছে ঈশ্বর, রামকৃষ্ণের ভক্তদের কাছে তাঁদের প্রিয় 'ঠাকুর', তীর্থযাত্রীদের কাছে তীর্থস্থান আর ভ্রমণপিপাসুদের কাছে দ্রষ্টব্যস্থল - সবধরনের মানুষের কাছে তাদের চাহিদাপূরণ করার জন্য দুই অনবদ্য পীঠস্থান কামারপুকুর আর জয়রামবাটী !

কামারপুকুর-জয়রামবাটী ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.