আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Monday, March 15, 2021

বরন্তি ভ্রমণ

বিশেষ সতর্কীকরণ ঃ

১. এই ভ্রমণে আমরা জনবহুল স্থানে, বিশেষতঃ স্টেশনে, ট্রেনে ইত্যাদি জায়গায় সারাক্ষণ মাস্ক পরে থেকেছি এবং দূরত্ববিধি যথাসম্ভব মেনে চলার চেষ্টা করেছি । সেইসঙ্গে প্রয়োজনমতো হ্যান্ড স্যানিটাইজারও ব্যবহার করেছি ।

২. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও অবস্থাতেই কোনও পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার করিনি । অর্থাৎ প্লাস্টিকের ব্যবহার না করেও এই ভ্রমণ অনায়াসে করা যায় ।

৩. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও কাগজ ব্যবহার বা নষ্ট করিনি । হোটেল বুকিং-এর রশিদ-এর প্রিন্ট আউট ব্যবহারের কোনও প্রয়োজন হয় না ।

৪. এই পুরো ভ্রমণে আমাদের দলের কেউ ধূমপান করেনি । ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর ।

আমার ব্লগের সমস্ত পাঠকদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে করোনা ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করার জন্য সরকারী বিধিনিষেধ মেনে চলার জন্য । সেইসঙ্গে অনুরোধ করছি প্লাস্টিক, অপ্রয়োজনীয় কাগজের ব্যবহার আর ধূমপান বর্জন করার জন্য ।

ভ্রমণপথ ঃ

শনিবার ১৩ই মার্চ, ২০২১ঃ হাওড়া থেকে সকাল ৮ টায় হাওড়া নিউ দিল্লী স্পেশাল ট্রেন - সকাল ১০ঃ৪০ মিনিটে আসানসোল । আসানসোল থেকে একঘন্টা গাড়িতে বরন্তি । বরন্তিতে রাত্রিবাস ।

রবিবার ১৪ই মার্চ, ২০২১ঃ বরন্তির লোক্যাল সাইট সিয়িং । বরন্তিতে রাত্রিবাস ।

সোমবার ১৫ই মার্চ, ২০২১ঃ বরন্তি থেকে গাড়িতে আসানসোল । আসানসোল থেকে সকাল ১০ঃ৪৩ মিনিটে পাটনা হাওড়া স্পেশাল ট্রেন - দুপুর ১ঃ১০ মিনিটে হাওড়া ।

রন্তি (স্থানীয় মানুষের উচ্চারণে বড়ন্তিও বলা যেতে পারে, কিন্তু কোনওভাবেই বারান্তি নয় !)। কলকাতা থেকে ঘন্টা তিনেকের দূরত্বে পুরুলিয়া জেলায় পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একটা গ্রাম । করোনার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সুদীর্ঘদিন বাড়িতে বসে থাকার পরে ট্রেনে করে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা যখনই করলাম, এই জায়গাটার কথা মাথায় এল । তার একটা কারণ এখানে যাতায়াতটা বেশ সহজসাধ্য, আর অন্য কারণ হল জায়গাটা ফাঁকা ফাঁকা । এই বরন্তিতে দু'দিনের অভিজ্ঞতা নিয়েই আমার ব্লগের এবারের পোস্ট ।

কলকাতা থেকে বরন্তির দূরত্ব ২৪০ কিলোমিটারের মতো  - গাড়িতে ঘন্টা চারেক । টানা গাড়িতেও যাওয়া যায় (যেটা অনেকেই করেন) আবার ট্রেনেও যাওয়া যায় । আমরা অবশ্য ট্রেনেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম । কাঁটায় কাঁটায় সকাল আটটার সময়ে হাওড়া থেকে হাওড়া - নিউ দিল্লী স্পেশাল ট্রেন যখন ছাড়ল, তখন সত্যিই ভালো লাগছিল । ভাইজ্যাগ-আরাকু ভ্রমণের দীর্ঘ দু'বছর পাঁচ মাস পরে আমরা আবার ট্রেনে করে কোথাও গেলাম । আমরা বলতে আমরা ছ'জন অর্থাৎ আমি, অমৃতা, বাবা, মা, কথা-কলি । ট্রেনে এই প্রথমবার কথা-কলির টিকিট লেগেছে - ওরা নিজেদের আলাদা বসার সিট্‌ পেয়েছে, এতে ওরাও খুব খুশি ।

বৃষ্টির মধ্যে আসানসোল স্টেশন
ট্রেন বর্ধমান পেরোনোর পর থেকেই আকাশের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করল । সূর্যকে আর দেখা গেল না বরং আকাশ বেশ মেঘলা হয়ে গেল । দুর্গাপুর পেরোনোর পরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হল যেটা আমরা আসানসোলে পৌঁছনোর পরেও থামল না । আসানসোল স্টেশন থেকে বরন্তি যাওয়ার গাড়ি হোটেলের সাহায্যে আগেই বুক করা ছিল । স্টেশনে পৌঁছে বৃষ্টির মধ্যে মালপত্র নিয়ে গাড়িতে উঠে বরন্তির দিকে রওনা হওয়ার সময়ে আমরা সবাইই অল্পবিস্তর ভিজে গেলাম ।

দামোদর নদ

আসানসোল স্টেশন থেকে বরন্তি গাড়িতে ঘন্টাখানেক লাগে - ভাড়া ১,১০০/- টাকা । ছোট বা বড় সব গাড়ির ভাড়াই সমান - আমাদের লোকসংখ্যা ৬ হওয়ায় আমাদের একটা স্কর্পিও গাড়ি নেওয়া হয়েছিল । পশ্চিম বর্ধমান আর পুরুলিয়ার জেলার সীমারেখা নির্ধারণ করে বয়ে চলেছে দামোদর নদ । তার উপরের ব্রীজ পেরোনোর সময়ে একটা পুলিশের চেক্‌ পয়েন্ট আছে যেখানে পুলিশ গাড়ির ভিতরে ব্যাগ খুলিয়ে সবকিছু ভালোভাবে চেক্‌ করে (যারা বেআইনি অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে যাতাযাত করে, তাদের জন্য বলছি এই জায়গাটায় কিন্তু খুব সাবধান !)। দামোদর ব্রীজটা খুব সুন্দর আর আকাশ মেঘলা থাকায় দৃশ্য আরও সুন্দর লাগছিল । পুলিশ যতক্ষণ আমাদের গাড়ি চেকিং করল, আমি সেই সময়ে গাড়ি থেকে নেমে ব্রীজের উপর থেকে বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম ।

ঝোড়ো হাওয়ায় বরন্তি লেক
আরও কিছুক্ষণ চলার পরে রাস্তার শহুরে ব্যাপারটা কমে গিয়ে গ্রাম্য ব্যাপারটা শুরু হল । দু'পাশে গাছপালা পুকুর খাল ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে কিছু ছোট ছোট পাহাড় দেখতে পাওয়া গেল । মাঝে মাঝে মাটির বাড়ি - গরু গোয়াল এসবও চোখে পড়ছিল । বৃষ্টি কিছুক্ষণ আগেই থেমে গেছে, পরিবেশটা ভীষণ মনোরম হয়ে রয়েছে । একটা মোড় ঘুরে আমাদের গাড়িটা একটা সুবিশাল জলাশয়ের পাশ দিয়ে চলতে লাগল - এটাই বরন্তি লেক । বরন্তি লেকের বিস্তারিত বিবরণ পরে দেব, আপাতত বলি এর পাশ দিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা । বৃষ্টি থেমে গেলেও যথেষ্ট জোরে বাতাস বইছে আর তাতে লেকের জলে সমুদ্রের মতো ছোট ছোট ঢেউ উঠছে । এই দৃশ্য দেখতে খুবই ভালো লাগছিল ।

আরণ্যক বননিবাস
লেক পেরিয়ে অল্পদূর গিয়েই পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্য 'আরণ্যক রিসর্ট'-এ । রিসর্টটা বেশ সুন্দর - একটা একতলা আর একটা দোতলা কটেজ নিয়ে তৈরি । এছাড়া রয়েছে একটা রান্না এবং খাওয়ার জায়গা আর সেইসঙ্গে বাকি জায়গাটা জুড়ে একটা সুবিশাল বাগান । সেই বাগানে নানারকম ফুল ও ফলের গাছ আর সেইসঙ্গে রয়েছে নানারকম সব্জীর গাছ । পুরো জায়গাটাই যাকে বলে পরিপাটিভাবে সাজানো ।


আমরা চেক্‌ইন করে চানটান করে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম । এখানে জানিয়ে রাখি বরন্তি একটা প্রত্যন্ত গ্রাম - এখানে ত্রিসীমানার মধ্যে কোনও দোকানপাট নেই । তাই রিসর্টের বাইরে খাওয়া দাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না । এখানে সব রিসর্টেই খাওয়ার প্যাকেজ পাওয়া যায় - সকালের চা, ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, সন্ধ্যের চা ও স্ন্যাক্স আর রাতের ডিনার । 'আরণ্যক রিসর্ট' - এ এই প্যাকেজের মূল্য মাথাপিছু ৪৫০/- টাকা । দুপুরের লাঞ্চের মেনু ভাত, ডাল, আলুভাজা, আলুপোস্ত, মাছের ঝোল, চাটনি, পাঁপড় । এখানকার রান্না একেবারেই ঘরোয়া আর সেইসঙ্গে অত্যন্ত সুস্বাদু । 

লাঞ্চ করে আমরা দুপুর ২ঃ১৫ নাগাদ গাড়ি নিয়ে বেরোলাম । বৃষ্টি একেবারেই থেমে গেছে, অল্প রোদও উঠেছে । আমাদের গন্তব্য শুশুনিয়া ও বিহারীনাথ পাহাড় । বরন্তি থেকে এগুলো ঘুরে আসতে ঘন্টা চারেক লাগে - গাড়িভাড়া ১,৭০০/- টাকা । আমাদের প্রথম গন্তব্য শুশুনিয়া পাহাড় । বরন্তি থেকে দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটারের মতো আর যেতে লাগে একঘন্টা ।

৩০০ মিটার উচ্চতায় খুদে চ্যাম্পিয়ন !
শুশুনিয়া পাহাড়ে পৌঁছে দেখলাম এখানে ট্রেকিং করে উপরে ওঠার ব্যবস্থা রয়েছে । পাহাড়ের গায়ে পাথরের উপর দিয়ে সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে উপরে ওঠা যায়, তবে কাজটা যে সহজ তা বলব না । আমাদের ছ'জনের মধ্যে আমি, কথা আর কলি কিছুদূর ওঠার পরে কলিও আর উঠতে চাইল না । শেষপর্যন্ত আমি আর কথা উপরে উঠলাম । শুশুনিয়া পাহাড়ের উচ্চতা প্রায় ৪৫০ মিটার । আমরা ৩০০ মিটার পর্যন্ত উঠে আর না ওঠার সিদ্ধান্ত নিলাম (আমরা মানে এক্ষেত্রে আমি । কথার আরও ওঠার ইচ্ছে ছিল)। পুরো রাস্তাটা কথা একাই উঠেছে, আমার সাহায্য ছাড়াই । সত্যি বলতে আমি একেবারেই আশা করিনি ও এইটুকু বয়সে এতটা উঠতে পারবে । উপরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছবি তুলে আমরা আবার নিচের দিকে রওনা দিলাম । ওঠানামার পথে অনেককেই উঠতে নামতে দেখলাম যদিও ৩০০ মিটার পর্যন্ত প্রায় কেউই যায়নি । আর যারা ওঠানামা করছিল, তাদের কারুরই বয়স কথার ধারেকাছেও নয় - এটা জোর দিয়ে বলতে পারি !

বিহারীনাথ পাহাড়ের সামনে
নিচে নেমে আইসক্রিম খেয়ে আমরা আবার গাড়িতে উঠে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বিহারীনাথ পাহাড়ের দিকে । শুশুনিয়া থেকে বিহারীনাথের দূরত্ব প্রায় ৩২ কিলোমিটার আর পৌঁছতে লাগে প্রায় একঘন্টা । বিহারীনাথে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য্যাস্ত হয়ে গেছে । বিহারীনাথের উচ্চতা শুশুনিয়ার মতোই যদিও এর উপরে ওঠার ইচ্ছে বা সময় কোনওটাই আমাদের ছিল না । সেইসঙ্গে দেখলাম বিহারীনাথের উপরে ওঠার রাস্তাটা বন্ধ করে রাখা রয়েছে (তবে এটা সবসময় থাকে কিনা জানি না)।

বিহারীনাথ মন্দির
বিহারীনাথ পাহাড়ের পাশেই বিহারীনাথ মন্দির । মন্দিরের পাশে একটা মেলা বসেছে । আমরা মন্দিরটা ঘুরে দেখে নিলাম । নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে - এটা আসলে শিবের মন্দির । মন্দিরের চাতালে তারস্বরে নামসংকীর্তন চলছে, তাই নিজেদের কানের স্বার্থেই মন্দির দেখতে বেশিক্ষণ সময় ব্যয় করলাম না ।



বিহারীনাথ পাহাড় থেকে রিসর্টের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার - আমাদের ফিরতে লাগল ৪৫ মিনিটের মতো । যখন ফিরলাম তখন অন্ধকার হয়ে গেছে । বরন্তিতে রাস্তায় আলোর কোনও ব্যবস্থা নেই, রাস্তার উপর কিছু দূরে দূরে একেকটা রিসর্ট রয়েছে, যা আলো শুধু সেখানেই আছে । রিসর্টে ফেরার পরে আমাদের চা ও সন্ধ্যের জলখাবার মুড়ি-চানাচুর-আলুর চপ দিল (যারা ভাবছে আমার মতো আমিষাশী এগুলো কিকরে খেল তাদের জানিয়ে রাখি আমি এগুলোর সবই খাই এবং পরিস্থিতিবিশেষে ভালোওবাসি !)।

আরণ্যক রিসর্টের ফুলের বাগান
সন্ধ্যের পরে বরন্তিতে কিছু করার নেই, তবে এখানে বারান্দায় বসে থাকতেই বেশ ভালো লাগে । এই সময়ে আমাদের পরিচয় হল রিসর্টের মালিক মিঃ মুকুল দাসের সঙ্গে । ভদ্রলোক কলকাতার বেহালায় থাকেন, মাঝে মাঝে বরন্তিতে যাতায়াত করেন । ওনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম । ভদ্রলোকের নিজের খুব গাছের শখ - বিভিন্ন জায়গা থেকে গাছের চারা এনে এখানে বসিয়েছেন । শীতকালে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকোলি ইত্যাদি নানারকম সব্জী হয় ওনার বাগানে । তাছাড়া পালংশাক, লালশাক প্রভৃতিও হয় । এখানে যে সব্জী হয় সেগুলো দিয়েই এখানে অতিথিদের জন্য তরকারি রান্না হয় । সব্জী ছাড়াও অনেকরকম ফুল ও ফলের গাছ আছে এই বাগানে যার বেশ কিছু আমরা নিজের চোখেই দেখেছি । অত্যন্ত সুন্দরভাবে যে উনি এই বাগানের এবং রিসর্টের পরিচর্যা করেন, সেটা ওনার কথা শুনেও বোঝা যায় ।

রিসর্টের ভাড়ার ব্যাপারে বললেন এখানে উনি শুধুমাত্র ফ্যামিলি হলে তবেই ভাড়া দেন । বুকিং-এর সময়ে বারবার জিজ্ঞেস করে সেটা ভালোভাবে জেনে নেন এবং কিছুমাত্র সন্দেহ হলে তখন আর তাদের ভাড়া দেন না । বরন্তির মতো জায়গায় এই বিধিনিষেধটা আরোপ করে উনি যে একটা বেশ বড়সংখ্যক কাস্টমার হারান, সেটা উনি নিজেও জানেন কিন্তু এটাই ওনার বিজনেস এথিক্স, কাজেই এতে কারুর কিছু বলার থাকতে পারে না । তবে অতিথিদের প্রতি ওনার এবং ওনার কর্মচারীদের ব্যবহার বিশেষভাবে প্রশংসা করার মতো । আমরা ছাড়াও আরেকটি পরিবার এখানে ছিল, তাঁরাও এঁদের আতিথেয়তার বিশেষ প্রশংসা করছিলেন । আমার ব্লগের পাঠকদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি বরন্তিতে পরিবারের সঙ্গে গেলে 'আরণ্যক রিসর্ট'-এই ওঠার জন্য । দায়িত্ব নিয়ে বলছি এখানে থাকলে খুব ভালো লাগবে (না, এগুলো লেখার জন্য মিঃ মুকুল দাস বা অন্য কেউ আমাদের ঘুষ দেননি বা অন্য কোনও বিশেষ পরিষেবা দেননি । খুব ভালো ব্যবহার পেলে নিজের থেকেই এগুলো অন্যদের বলতে ইচ্ছে করে, যেমন বলেছিলাম মুর্শিদাবাদ বা পাঁচমারির হোটেলের সম্পর্কে ।)

রাতে ডিনারের মেনু ছিল ভাত/রুটি, তরকারি আর চিকেন কারি । রান্না অত্যন্ত সুস্বাদু । খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম ।

মাঠের ওপর সূর্য্যোদয়
পরেরদিন রবিবার ১৪ই মার্চ, ২০২১ । সকাল ছ'টার সময়ে রিসর্টের পিছন দিকে মাঠের উপর সূর্য্যোদয়ের দৃশ্য দেখতে পেলাম । দৃশ্যটা অত্যন্ত সুন্দর আর সকাল সকাল এই দৃশ্য দেখে মন ভরে যায় ।





আরণ্যকের ভিতরে
আগে ঠিক ছিল এ'দিন আমরা গড়পঞ্চকোট, মাইথন, পাঞ্চেৎ, কল্যাণেশ্বরী মন্দির ইত্যাদি দেখতে যাব, কিন্তু পরে আমরা সেই পরিকল্পনা বাতিল করলাম । এর কারণ এই জায়গাগুলোর সবগুলোই বরন্তি থেকে বেশ কিছুটা দূরে আর এগুলো অন্য সময়েও যাওয়া যায় । বরন্তিতে এসে বরন্তিটা ভালো করে দেখলে সেটাই হবে সবথেকে বড় প্রাপ্তি । তবে এটা ঠিক বরন্তিতে বরন্তি লেক ছাড়া আর বিশেষ কিছু দেখার নেই, কিন্তু আগেই বলেছি এখানে রিসর্টের বারান্দায় বসে থাকাটাই একটা ভীষণ ভালো অভিজ্ঞতা ।

সকালে চায়ের পরে ব্রেকফাস্টে লুচি আর তরকারি দিল । সেগুলো খেয়ে মা-বাবা, কথা-কলি রিসর্ট থেকে বেরিয়ে একবার বরন্তি লেকটা ঘুরে এল । দুপুরে লাঞ্চের মেনু আগেরদিনের মতোই । খাওয়ার পরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেল ৪ঃ১৫ নাগাদ সবাই মিলে বেরোলাম বরন্তি লেকের উদ্দেশ্যে ।

বরন্তি লেকের উপর সূর্য্যাস্ত (প্যানোরমিক ভিউ)
আরণ্যক রিসর্ট থেকে বরন্তি লেকের দূরত্ব ১.২ কিলোমিটার, কিন্তু তাও হেঁটে আমাদের প্রায় আধঘন্টা লাগল । লেকের দৃশ্য অনবদ্য । ঘন্টাখানেকের মধ্যে লেকের জলের ওপর সূর্য্যাস্ত হবে তাই এইসময়ে লেকের ধারের রাস্তায় ট্যুরিস্টের ভীড় চোখে পড়ার মতো । শুধুমাত্র যারা বরন্তিতে এসেছে তারাই নয়, অন্যান্য জায়গা থেকেও গাড়ি করে লোকজন বরন্তি লেক দেখতে এসেছে । লেকের একদিকে একটা নাতিউচ্চ পাহাড় (পাহাড় না বলে টিলা বলাই ভালো) এবং লেকের জলে তার ছায়া লেকের দৃশ্যকে আরও সুন্দর করে তুলেছে । আমাদের চোখের সামনে সেই অভিপ্রেত সূর্য্যাস্ত হল । আজ গড়পঞ্চকোট ইত্যাদি জায়গায় না যাওয়ার যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম, সেটার জন্য মনে মনে বেশ আত্মশ্লাঘা অনুভব করছিলাম কারণ গেলে এই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হত না ।

সূর্য্যাস্তের পরে ফেরার পথ ধরলাম । পথে একজায়গায় খেজুর গুড় বিক্রি হচ্ছিল, সেখান থেকে আমরা কিছুটা গুড় কিনলাম । এখানকার দাম কলকাতার থেকে বেশি তবে এর বৈশিষ্ট্য হল এতে কোনও চিনির ভেজাল নেই । বরন্তিতে গণপরিবহনের খুব অভাব - রিক্সা, ভ্যান, টোটো খুব কম চলে । তবে আমাদের বিশেষ কিছু ক্লান্তি নেই, ফিরতি পথে আধঘন্টা হেঁটে আবার রিসর্টে পৌঁছে গেলাম । আজকের সন্ধ্যের জলখাবারও গতকালেরই মতো তফাৎ শুধু আলুর চপের বদলে পিঁয়াজী । মিঃ মুকুল দাস ও তাঁর স্ত্রী গত তিনসপ্তাহ একটানা বরন্তিতে থাকার পরে আজ দুপুরে কলকাতা চলে গেছেন, কাজেই সন্ধ্যেবেলা তাঁর সঙ্গে গল্প করার সুযোগ আর নেই । আমরা বাকি সময়টা যথারীতি বারান্দায় বসেই কাটিয়ে দিলাম । রাতের মেনুও গতকালেরই মতো, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম ।

ফেরার পথে আসানসোল স্টেশন
সোমবার ১৫ই মার্চ, ২০২১ - আমাদের বাড়ি ফেরার দিন । সকালে চা খেয়ে তৈরি হয়ে নিলাম । আমাদের ফেরার ট্রেন আসানসোল থেকে সকাল ১০ঃ৪৩ মিনিটে, তাই আমরা বরন্তি থেকে সাড়ে আটটায় বেরোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম । এত সকালে ব্রেকফাস্ট করাটা একটু চাপের, তাই ব্রেকফাস্টটা প্যাকিং করে সঙ্গে নিয়ে নেওয়া হল । ঠিক সাড়ে আটটায় বরন্তি থেকে বেরিয়ে আসানসোল স্টেশনে পৌঁছলাম তখন সকাল দশটা । তারপর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে সঙ্গে থাকা লুচি তরকারিগুলোর সদ্ব্যবহার করে ফেললাম ।

ফেরার পথে পাটনা হাওড়া স্পেশাল ট্রেন কাঁটায় কাঁটায় সকাল ১০ঃ৩৯ মিনিটে আসানসোল স্টেশনে এল আর কাঁটায় কাঁটায় ১০ঃ৪৩ মিনিটে ছাড়ল । ট্রেনের হাওড়া পৌঁছনোর কথা দুপুর ১ঃ২৫ মিনিটে আর ট্রেন নির্ধারিত সময়ের পনেরো মিনিট আগে আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিল । স্টেশন থেকে ট্যাক্সি করে বাড়ি !

সারসংক্ষেপ ঃ

১. কলকাতা থেকে ২-৩ দিনের ঘোরার জন্য একটা দূর্দান্ত জায়গা পুরুলিয়া জেলার বরন্তি । এখানকার প্রধান আকর্ষণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ।

২. বরন্তি যাওয়ার জন্য হাওড়া, শিয়ালদহ বা কলকাতা থেকে ট্রেনে আসানসোল পর্যন্ত্য গিয়ে সেখান থেকে গাড়িতে যেতে হয় । আসানসোল থেকে বরন্তির দূরত্ব ৩৭ কিলোমিটারের মতো, যেতে ঘন্টাখানেক সময় লাগে ।

৩. গাড়ির রাস্তায় কলকাতা থেকে বরন্তির দূরত্ব ২৪০ কিলোমিটার - টানা গাড়িতে গেলে ঘন্টা চারেক লাগে । রাস্তা জানা না থাকলে যাওয়ার জন্য গুগ্‌ল্‌ ম্যাপের সাহায্য নেওয়াই সুবিধেজনক ।

৪. বরন্তিতে থাকার অনেক হোটেল বা রিসর্ট আছে তবে 'আরণ্যক বননিবাস'-এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এখানকার ঘরভাড়া এবং খাবার খরচ বেশ কম এবং পরিষেবা অত্যন্তু উন্নতমানের । আরণ্যকের ওয়েবসাইট http://aaronnok.in/ থেকে এখানকার সম্পর্কে আরও তথ্য জানা যেতে পারে । যোগাযোগের নম্বর - 9830024052 / 8240283452 / 9836099007 / 8910398217.

৫. এখানে আলাদাভাবে খাবারের কোনও জায়গা নেই, হোটেল/রিসর্টের খাবারের উপরেই নির্ভর করতে হবে । এখানে প্রায় সব হোটেলেই প্যাকেজ সিস্টেমে সারাদিনের খাবার পাওয়া যায় ।

৬. বরন্তিতে ঘোরাঘুরির জন্য কোনও গাড়ির ব্যবস্থা করা দুষ্কর, তাই হোটেল থেকেই গাড়ির ব্যবস্থা করা শ্রেয় । কাছাকাছি যাতায়াতের জন্য টোটো বা রিক্সাও এখানে সহজে পাওয়া যায় না ।

৭. এখানে সেভাবে কোনও দোকানপাট নেই তাই সাধারণ দরকারি জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে যাওয়াই ভালো । এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক বেশ ভালো, 4G-ও দিব্যি কাজ করে ।

৮. বরন্তিতে দেখবার একমাত্র জায়গা বরন্তি লেক । বিকেলের দিকে গেলে লেকের ওপরে সূর্য্যাস্তের দৃশ্য দেখতে খুবই ভালো লাগবে ।

৯. এখান থেকে গাড়ি নিয়ে শুশুনিয়া ও বিহারীনাথ পাহাড় দেখতে যাওয়া যেতে পারে । এই দু'টো পাহাড়েরই উপর পর্যন্ত্য হেঁটে ওঠা যায় ।

১০. বরন্তি থেকে ডে-আউটে গড়পঞ্চকোট, পাঞ্চেৎ, মাইথন, কল্যাণেশ্বরী মন্দির দেখে আসা যেতে পারে । তবে জায়গাগুলো কোনওটাই বরন্তি থেকে খুব কাছে নয় ।

১১. বরন্তি যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হল শীতকাল, তাছাড়া বর্ষাকালে গেলেও ভালোই লাগবে । গরমের সময়ে না যাওয়াই ভালো।

উপসংহার ঃ

বরন্তি
কলকাতা থেকে দু'দিনের জন্য ঘুরে আসার পক্ষে বরন্তি একটা অত্যন্ত সুন্দর জায়গা । কলকাতা থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত পুরুলিয়া জেলার এই গ্রামটার প্রধান আকর্ষণ হল এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ । চারপাশে পাহাড়, অদূরে বরন্তি লেক, গাছপালা, বনজঙ্গল, পাখির ডাক - এইসব মিলিয়ে এখানকার শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ আমাদের মতো শহুরে মানুষদের কাছে একটা বিরাট পাওনা । যারা বেড়াতে গিয়ে বিশেষ হৈ চৈ কোলাহল পছন্দ করে না, বরন্তি তাদের জন্য । যারা বেড়াতে গিয়ে নির্ঝঞ্ঝাটভাবে নিজের সঙ্গে দু'দন্ড সময় কাটাতে চায়, বরন্তি তাদের জন্য । যারা বেড়াতে গিয়ে এ'দোকান সে'দোকান ঘুরে কেনাকাটা করতে পছন্দ করে না, বরন্তি তাদের জন্য । কিন্তু তার মানে এই নয় যে বাকিদের বরন্তি গেলে ভালো লাগবে না । আসলে এই জায়গাটার বৈশিষ্ট্যই হল যে এখানে গেলে ভালো লাগতে বাধ্য । তাই যদি দিনতিনেকের জন্য কোথাও ঘুরে আসার জন্য মনটা উড়ু উড়ু করে, তাহলে বরন্তি নিঃসন্দেহে একটা দূর্দান্ত অপশন !

বরন্তি ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.