আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Monday, October 29, 2018

ভাইজ্যাগ-আরাকু ভ্রমণ

বিশেষ সতর্কীকরণঃ

১. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও অবস্থাতেই কোনও পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার করিনি । অর্থাৎ প্লাস্টিকের ব্যবহার না করেও এই ভ্রমণ অনায়াসে করা যায় ।

২. এই পুরো ভ্রমণে শুধুমাত্র হোটেল বুকিং-এর প্রিন্টআউট ছাড়া আমরা কোনও কাগজ ব্যবহার বা নষ্ট করিনি । হোটেল বুকিং-এর হার্ড কপি না বের করে সফট্‌ কপিতেও সহজেই কাজ চালানো যায় ।

৩. এই পুরো ভ্রমণে আমাদের দলের কেউ ধূমপান করেনি । ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর ।

আমার ব্লগের সমস্ত পাঠকদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি প্লাস্টিক, অপ্রয়োজনীয় কাগজের ব্যবহার আর ধূমপান বর্জন করার জন্য ।

ভ্রমণপথঃ

বুধবার ২৪শে অক্টোবর, ২০১৮ঃ সাঁত্রাগাছি - বিকেল ৪ঃ১৮ মিনিটে শালিমার সাঁত্রাগাছি এসি সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ।
বৃহস্পতিবার ২৫শে অক্টোবর, ২০১৮ঃ সকাল ৫ঃ৪৫ মিনিটে বিশাখাপত্তনম । বিশাখাপত্তনমে রাত্রিবাস ।
শুক্রবার ২৬শে অক্টোবর, ২০১৮ঃ বিশাখাপত্তনমে লোক্যাল সাইট সিয়িং । বিশাখাপত্তনমে রাত্রিবাস ।
শনিবার ২৭শে অক্টোবর, ২০১৮ঃ বিশাখাপত্তনম - সকাল ৬ঃ৫০ মিনিটে বিশাখাপত্তনম কিরন্ডুল  প্যাসেঞ্জার । সকাল ১১ টা আরাকু । আরাকুতে রাত্রিবাস ।
রবিবার ২৮শে অক্টোবর, ২০১৮ঃ আরাকুতে গাড়ি করে লোক্যাল সাইট সিয়িং - বোরা কেভস্‌ - বিশাখাপত্তনম । রাত্রি ৮ঃ৫৫ মিনিটে চেন্নাই সাঁত্রাগাছি এসি সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ।
সোমবার ২৯শে অক্টোবর, ২০১৮ঃ দুপুর ১ টা - সাঁত্রাগাছি ।

"ভারতবর্ষের কোথায় পাহাড় আর সমুদ্র একসঙ্গে দেখতে পাওয়া যায় ?" ক্যুইজের এই প্রশ্নের উত্তরে সবার মনে প্রথম যে জায়গাটা আসে সেটা হল 'গোয়া' । এই প্রশ্নের অন্য উত্তর হল 'ভাইজ্যাগ' বা 'বিশাখাপত্তনম' । অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যে সমুদ্রের ধারে অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অধিকারী এই শহর ভ্রমণপিপাসুদের এক প্রধান আকর্ষণ । আমাদের দেশে বেড়াতে যাওয়ার জন্য যে কয়েকটা খুব ঘ্যাম জায়গা আছে, ভাইজ্যাগ তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য । আর এর সঙ্গে যার নাম স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে সেটা হল আরাকু ভ্যালি - ভাইজ্যাগ থেকে ১১৫ কিলোমিটার দূরে একটা পাহাড় ঘেরা শহর । এই ভাইজ্যাগ আর আরাকু ভ্রমণ নিয়ে আমার ব্লগের এবারের পোস্ট ।

সাঁত্রাগাছি স্টেশনে আমরা
বুধবার ২৪শে অক্টোবর, ২০১৮ লক্ষ্মীপূজোর দিন আমাদের যাত্রা শুরু । আমরা বলতে আমি, আমার স্ত্রী অমৃতা, বাবা, মা, কথা, কলি । আমাদের ট্রেন ছিল সাঁত্রাগাছি স্টেশন থেকে । এর আগে একবারই আমরা সাঁত্রাগাছি থেকে ট্রেন ধরেছি - মুকুটমণিপুর যাওয়ার সময়ে । আমাদের ট্রেন শালিমার সাঁত্রাগাছি এসি সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ছাড়ল নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় ১০ মিনিট পরে ।


এসি-তে গেলে জার্নিটা আরামদায়ক হয় ঠিকই, কিন্তু সেইসঙ্গে বাইরের দৃশ্য বিশেষ ভালোভাবে দেখা যায় না । তবে অক্টোবরের শেষে বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই অন্ধকার হয়ে যায়, তাই বাইরে বিশেষ কিছু দেখাও যাচ্ছিল না । রাতে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা রুটি আর চিলি চিকেন দিয়ে আমরা ডিনার করে নিলাম ।

বিশাখাপত্তনম স্টেশনে
পরেরদিন সকাল ৫ঃ৪৫ মিনিটে আমাদের বিশাখাপত্তনম পৌঁছনোর কথা আর ট্রেন একেবারেই লেট না করে আমাদের পৌঁছে দিল । বিশাখাপত্তনম স্টেশনের বাইরের দৃশ্য দেখে খুব সুন্দর লাগল । আগেই জানতাম ভাইজ্যাগ পাহাড়ী শহর নয়, পাহাড় দিয়ে ঘেরা একটা প্রায় সমতলভূমি । সেই দৃশ্যের প্রতিফলন স্টেশনের বাইরে থেকেই দেখতে পাওয়া শুরু হল । এখানকার তাপমাত্রা ঠান্ডা বলা যায় না, তবে সকালের দিক হওয়াতে বেশ আরাম লাগছিল । আমরা স্টেশন থেকে একটা বড় অটো নিয়ে হোটেলে চলে গেলাম ।

রুষিকোন্ডা বীচে সূর্য্যোদয়ের পরে
ভাইজ্যাগে অন্ধ্রপ্রদেশ ট্যুরিজমের দু'টো রিসর্ট আছে - একটা রামকৃষ্ণ বীচে আর অন্যটা রুষিকোন্ডা বীচে (হ্যাঁ নামটা রুষিকোন্ডা, ঋষিকোন্ডা নয় !) । দুটোরই নাম হরিথা বীচ রিসর্ট । রামকৃষ্ণ বীচটা ভাইজ্যাগ শহরের মধ্যে আর স্টেশন থেকে কাছে । রুষিকোন্ডা বীচটা স্টেশন থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে আর শহরের থেকে একটু বাইরে । রুষিকোন্ডা বীচের রিসর্টের ভাড়াও তুলনামূলকভাবে বেশি । তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের দিক থেকে রুষিকোন্ডা অনেক বেশি আকর্ষণীয়, তাই আমরা এটাই পছন্দ করেছিলাম । অটো করে যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় সকাল ৭ টা । সূর্য্য সবেমাত্র উঠেছে । রিসর্টটা পাহাড়ের উপরে আর সামনে দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র । সবমিলিয়ে মনে হল ভাইজ্যাগে এসে এখানে না থাকলে একটা আফসোস চিরদিন থেকে যেত (তবে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হওয়া এখানেই শেষ নয় । মুগ্ধতার দ্বিতীয় পর্য্যায়ের কথা যথাসময়ে লিখব) ।

ডাইনিং স্পেশের লাগোয়া ছাদ
আমাদের ঘরের চেক-ইন টাইম সকাল ১০ টা, তাই ঘর খালি হতে একটু সময় লাগল । সেই সময়ের মধ্যে আমরা ব্রেকফাস্ট করে নিলাম । রিসর্টের খাওয়ার জায়গাটাও খুব সুন্দর - তিনদিক কাচ দিয়ে ঘেরা । একটা বড় ঘর । আবার চাইলে লাগোয়া ছাদে বসেও খাওয়াদাওয়া করা যায় । দিনের বেলা সেটা খুব আরামদায়ক না হলেও রাত্রিবেলা সেটা বেশ মনোরম অভিজ্ঞতা হবে বলেই মনে হল । আমরা পুরি-তরকারি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম । খরচ হল ৩৮৪/- টাকা । ভাইজ্যাগের ঘরের সঙ্গে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট আছে, কিন্তু সেটা চেক-ইন করার পরেই পাওয়া সম্ভব অর্থাৎ আমরা সেটা পরেরদিন পাব । তাই প্রথমদিনের খাওয়াটা নিজেদের টাকা দিয়েই খেতে হল ।

হরিথা বীচ রিসর্ট (রুষিকোন্ডা) এর ঘর
আগেই ঠিক করা ছিল প্রথমদিনটা কোথাও ঘুরতে যাব না, বিশেষ করে ভাইজ্যাগ শহরটা ঘোরার জন্য হাতে একটা গোটা দিন থাকলেই হয় । তাই ঘরে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নিলাম । এখানকার সব ঘরই এসি আর ঘরগুলো বেশ বড় । ঘরের লাগোয়া বাথরুমে যেতে গেলে চারধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয় । একেকটা আলাদা আলাদা কটেজের মতো বাড়ি আর সেখানে দোতলা আর তিনতলায় দুটো করে ঘর । একটা কটেজের দোতলায় দুটো ঘর আমাদের দিয়েছিল ।

আমাদের ব্যালকনি থেকে
দুটো ঘরের লাগোয়া একটা ব্যালকনি আছে যেখান থেকে সমুদ্রের অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায় । ব্যালকনিতে চেয়ারও আছে, আর এখানে বসে বসে অনায়াসে সময় কাটানো যায় ।

রুষিকোন্ডা বীচে স্নান





একটু বেলা হলে আমরা সমুদ্রে গেলাম । কটেজগুলো পাহাড়ের ওপরে আর সেখান থেকে সমুদ্রে যেতে গেলে সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা নেমে যেতে হয় । নামার সময়ে অসুবিধে না হলেও বেশ বুঝতে পারছিলাম ফেরার সময়ে হালুয়া টাইট হয়ে যাবে । ভাইজ্যাগের সমুদ্র বঙ্গোপসাগর হলেও এখানে খুব বেশি ঢেউ নেই আর সমুদ্রের নাব্যতাও ('নাব্যতা' কি মনে না পড়লে আমি বলব না, কাছাকাছি ক্লাস সেভেনের কোনও ছাত্র/ছাত্রী বা কোনও ভূগোলের শিক্ষক/শিক্ষিকাকে জিজ্ঞেস করতে পার) কম তাই চান করাটা দুর্দান্ত কিছু অভিজ্ঞতা নয় । তবে সমুদ্রে চান জিনিসটা আমার খুব পছন্দের, তাই যতটা পারলাম উপভোগ করলাম ।

ঘরে ফিরে আরেকদফা চান করে দুপুরে খেতে গেলাম খাওয়া জায়গায় । রিসর্ট পুরো ভর্তি, পূজোর ছুটিতে লোকজন ভাইজ্যাগ বেড়াতে চলে এসেছে ! কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমরা বসার জায়গা পেলাম । লাঞ্চে ভাত ডাল ডিম চিকেন নেওয়া হল । খরচ হল ৭৮২/- টাকা ।

ব্যালকনির অন্য কোণ থেকে
দুপুরে ঘরেই থাকলাম । বিকেলবেলা বারান্দায় বসে সমুদ্রের দৃশ্য দেখলাম । আমার মতে ভাইজ্যাগ গেলে একটা দিন শুধুমাত্র রিসর্টে বসে কাটানোর জন্য রাখা ভালো, কারণ পাহাড়ের ওপরে বসে সমুদ্রের ওপর প্রকৃতির আলোর খেলা দেখার সুযোগ অন্ততঃ ভারতবর্ষে খুব বেশি পাওয়া যায় না । সকালে আমাদের সামনে দিয়ে সূর্য্যোদয় হয়েছে, তাই সূর্য্যাস্ত হবে আমাদের পিছনে । তাই সমুদ্রের ওপরে সূর্য্যাস্তের দৃশ্য না দেখতে পেলেও আমাদের ব্যালকনিতে বসে যা দেখতে পেলাম তাও অসাধারণ !

রাতের ভাইজ্যাগের দৃশ্য
সন্ধ্যে ছ'টা নাগাদ আমরা আবার পাহাড় থেকে নেমে সমুদ্রের ধারে এলাম । প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে, সমুদ্রের বাঁধানো পাড়ে বসে থাকতে ভালোই লাগছিল । হাল্কা একটা হাওয়া সারাক্ষণই দিচ্ছিল । আমরা কিছুক্ষণ বসে তারপর উঠে পড়লাম । সমুদ্রের ধারে অনেক দোকান আছে সেখানে খাবার থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর জিনিস সবই পাওয়া যায় । রুষিকোন্ডা বীচের রিসর্টে না থাকলেও এই বীচটা ভাইজ্যাগ সিটি ট্যুরের মধ্যে পড়ে তাই ভাইজ্যাগে যারা বেড়াতে আসে তারা প্রায় সকলেই এখানে একবার করে আসে । আমরা দোকানে ঘুরে টুরে ডাব, চাট, আইসক্রিম ইত্যাদি খেলাম । তারপর আবার ফেরার পথ ধরে রিসর্টে ফিরে এলাম ।

দিনের বেলার থেকে রাত্রে ডাইনিং রুমে স্বাভাবিকভাবেই বেশি ভিড় । তাই আমরা ডিনারের খাবার প্যাক করে ঘরে নিয়ে চলে এলাম । এখানে ঘরে খাবারের সব ব্যবস্থাই আছে, তাই খেতে কোনও অসুবিধে হল না । রুটি, চিকেন আর এগকারি নিয়ে খরচ হল ৫২০/- টাকা ।

সিটি ট্যুরে বেরনোর আগে
পরেরদিন ২৬শে অক্টোবর, ২০১৮ - আমাদের ভাইজ্যাগ ঘোরার দিন । ভাইজ্যাগ ঘোরার জন্য এ পি ট্যুরিজমের একাধিক প্যাকেজ ট্যুর আছে । এগুলো এ পি ট্যুরিজমের ওয়েবসাইট থেকে দেখা যায় বা আমাদের হোটেলের থেকেও জানতে পারা যায় । তবে বুকিং অনেকটাই নির্ভর করে সিজনের ওপর । প্যাকেজ ট্যুরগুলোর মধ্যে ভাইজ্যাগ সিটি ট্যুর ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার প্যাকেজ আছে । আমাদের পরিকল্পনা শুধুমাত্র ভাইজ্যাগ ঘোরাই ছিল । সিটি ট্যুরের জন্য বাস চলে তবে আমরা হিসেব করে দেখলাম বাসের থেকে সামান্য বেশি টাকায় আমরা একটা গাড়ি বুক করতে পারি আর তাতে সুবিধে হল আমরা নিজেদের ইচ্ছেমতো ঘুরতে পারব । তাই আমরা সেটাই করলাম ।

বেরোনোর আগে আমরা ডাইনিং রুম থেকে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট করে নিলাম । ব্রেকফাস্টের মেনু ইডলি, ধোসা, বড়া ইত্যাদি আর সেইসঙ্গে চা ও কফি । খাবার যত ইচ্ছে খাওয়া যায় ঠিকই তবে এই খাবার বেশি খাওয়া যায় না । খেয়েদেয়ে আমরা ঘুরতে বেরোলাম সকাল ১০ টা নাগাদ । আমাদের বাহন একটা চারজন বসার সিডান ।

রামা নাইডু স্টুডিও - আমাদের প্রথম গন্তব্য রামা নাইডু স্টুডিও । হরিথা বীচ রিসর্ট থেকে এর দূরত্ব ৫.৫ কিলোমিটারের মতো । যাওয়ার পথটার অনেকটাই সমুদ্রের একেবারে পাশ দিয়ে । হুবহু না হলেও রাস্তাটা অনেকটা মুম্বই-এর মেরিন ড্রাইভের কথা মনে করিয়ে দেয় । স্টুডিওটা একটা পাহাড়ের ওপরে । পাহাড়ের গায়ের জিগজ্যাগ রাস্তা দিয়ে একেবারে স্টুডিওর গেট পর্যন্ত্য গাড়ি যায় । ভিতরে ঢোকার চার্জ মাথাপিছু ৫০/- টাকা আর বাচ্চাদের ফ্রি । ক্যামেরা নিয়ে গেলে আলাদা চার্জ লাগে তবে মোবাইল ক্যামেরায় কোনও সমস্যা নেই । আমরা ভিতরে ঢুকে দেখা শুরু করলাম ।

হাভেলির বারান্দায় 'ঠাকুরসাহাব' দর্শন দিচ্ছেন
রামা নাইডু স্টুডিওতে এখন আর কোনও ছবির শুটিং না হলেও একসময়ে এটা নাকি বেশ ভালো একটা স্টুডিও ছিল । আমি কখনও কোনও স্টুডিওর ভিতরে ঢুকিনি, এখানে ঢুকে বিভিন্ন ধরনের সেট্‌ সাজানোর বাড়িগুলো কেমন দেখতে হয় দেখলাম । একটা থানা, তার ভিতরে লক্‌আপ, একাধিক দোকান, বন্ধ শাটার, সাধারণ বাড়ি, জমিদার বাড়ি (যাকে হিন্দী ছবির ভাষায় বলে 'হাভেলি') এই সবই আছে । এখানে যেহেতু ছবির শুটিং হয়না তাই জিনিসগুলোকে দারুণভাবে মেন্টেইন করার বিশেষ তাগিদ আছে বলে মনে হয় না, তবে আমাদের মতো লোকজন এখানে বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে বসে অভিনেতাদের মতো পোজ দিয়ে ছবি তোলে । এখানে একটা মিউজিয়াম গোছের আছে সেখানে পুরনো দিনে ব্যবহার হওয়া ক্যামেরা আর অন্যান্য ছবি তোলার সরঞ্জাম রয়েছে । এছাড়া একটা ফোটো গ্যালারি আছে যেখানে বিভিন্ন দক্ষিণ ভারতীয় ও বলিউডের অভিনেতা/অভিনেত্রীদের ছবি রয়েছে যাঁরা রামা নাইডু স্টুডিওতে তাঁদের ছবির শুটিং করেছেন ।

ভিউ পয়েন্ট থেকে ভিউ
এখানে একটা ভিউ পয়েন্ট আছে যেখান থেকে সমুদ্রের অসাধারণ ভিউ পাওয়া যায় । আমরা এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছবি তুলে চলে এলাম ।









নরসিমা স্বামী মন্দির - রামা নাইডু স্টুডিওর পাহাড় থেকে নেমে আমরা এগিয়ে গেলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য নরসিমা স্বামী মন্দিরের দিকে । এই জায়গাটা আরেকটা পাহাড়ের ওপরে । মজার ব্যাপার আমাদের দর্শনীয় জায়গাগুলো একেকটা পাহাড়ের ওপরে আর সেখানে যাওয়ার জন্য একেকবার পাহাড় থেকে নেমে সমতলে চলতে হয় । রামা নাইডু স্টুডিও থেকে নরসিমা স্বামী মন্দির গাড়িতে প্রায় একঘন্টা লাগে । নরসিমার পাহাড়ে ওঠার সময়ে একজায়গায় গাড়ির জন্য ৩০/- টাকা টোল ট্যাক্স দিতে হল ।

নরসিমা মন্দিরের গেট
নরসিমা মন্দিরের কাছে পার্কিং-এ গাড়ি রেখে আমরা গেলাম মন্দিরে । এখানে মন্দিরে জুতো খুলে যেতে হয় আর ক্যামেরা নিয়ে ঢোকার অনুমতিও নেই (না, মোবাইল নিয়েও ঢোকা চলবে না) । মন্দিরের প্রধান ফটকটা টিপিক্যাল দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরের ফটকের মতো - বিশাল ঢ্যাঙা উঁচু আর তার গায়ে একগাদা মূর্তি-টুর্তি বসানো । মন্দিরটা এখানে বেশ বিখ্যাত সেটা বোঝা যাচ্ছিল এতে ঢোকার রেলিং আর নিয়মের বহর দেখে । অনেক এদিক-সেদিক ঘুরে শেষে যদিও বা আমরা মন্দিরের মূল দরজার সামনে পোঁছলাম কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলাম ভিতরে ঢুকতে আবার টিকিট লাগবে । আমরা ঠাকুর দেখার জন্য টিকিট কাটার পক্ষপাতী নই তাই এ'যাত্রায় নরসিমা স্বামী আমাদের দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেলেন ! রোদের মধ্যে এতটা হাঁটাহাঁটি করে বেশ তেষ্টা পেয়ে গিয়েছিল, লস্যি বিক্রি হচ্ছে দেখে কিনলাম । খেয়ে দেখলাম জিনিসটা লস্যিই, তবে উপাদানটা দই হলেও স্বাদটা একেবারেই মিষ্টি নয়, নোনতা । খেতে খুব একটা ভালো না লাগলেও একচুমুকে খেয়ে নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম ।

কৈলাশগিরি পাহাড় - নরসিমা স্বামী মন্দির থেকে আধঘন্টা লাগল পরের জায়গা কৈলাশগিরি পাহাড়ে পৌঁছতে । বলা বাহুল্য, নরসিমা মন্দিরের পাহাড়ের ওপর থেকে সমতলে নেমে আমাদের আবার আরেকটা পাহাড়ের ওপরে উঠতে হল । পরে শুনেছিলাম এ পি ট্যুরিজমের বাস নাকি এই পাহাড়ের ওপরে ওঠে না । সেক্ষেত্রে রোপওয়ে চড়ে পাহাড়ের নিচ থেকে ওপরে উঠতে হয়, আবার একইরকমভাবে নামতে হয় । আমাদের গাড়ি অবশ্য সোজা পাহাড়ের ওপরেই আমাদের নিয়ে হাজির হল ।

টাইটানিক ভিউ পয়েন্ট থেকে
কৈলাশগিরি পাহাড় হচ্ছে ভাইজ্যাগের যাকে বলে সবথেকে বড় আকর্ষণ । এটা ভাইজ্যাগের সবথেকে উঁচু জায়গা । এখানে ঢোকার মুখে একটা রেলিং ঘেরা জায়গা আছে যেটাকে 'টাইটানিক ভিউ পয়েন্ট' বলা হয় । রেলিং-এর কোণটা একেবারে টাইটানিক জাহাজের সামনের রেলিং-এর মতো আর এখান থেকে সমুদ্রের অসাধারণ ভিউ পাওয়া যায় (যারা 'টাইটানিক' দেখেছে তাদের মধ্যে প্রায় সকলেই একবাক্যে স্বীকার করবে রেলিং-এর ওপর দাঁড়িয়ে জ্যাক আর রোজের সমুদ্রের দৃশ্য দেখার এই সিনটাই ছবির শ্রেষ্ঠ সিন)। চাইলে রেলিং-এর ওপর দাঁড়িয়ে টাইটানিক পোজে ছবিও তোলা যায় !

কৈলাশগিরিতে কথা-কলির সঙ্গে শিব ও দূর্গা
এরপর আমরা পাহাড়ের অন্যদিকটায় গেলাম । এখানে একটা বড় গেট আছে, সেটা দিয়ে মূল জায়গাটায় ঢুকতে হয় । কৈলাশগিরি পাহাড়ের ওপরে শিব আর দূর্গার দুটো বিশাল সাইজের মূর্তি আছে, সেই থেকেই এই পাহাড়ের নাম কৈলাশগিরি । পাহাড়ের ওপরটা খুব সুন্দর করে সাজানো, পায়ে চলার রাস্তা, বাগান, মূর্তি ইত্যাদি অনেক কিছু আছে । পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখতে সময় লাগে আবার ভালোও লাগে । জায়গায় জায়গায় বসার জায়গা করা আছে, সেখানে বসে বিশ্রাম নেওয়া যেতে পারে । রোদ থাকলেও পাহাড়ের ওপরে একটা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল সেই জন্য খুব গরম লাগছিল না । আমরা ভালো করে সবজায়গাটা ঘুরে দেখলাম ।

কৈলাশগিরির টয়ট্রেন
এখানে পাহাড়ের ওপরে একটা টয়ট্রেন চলে যেটা পাহাড়ের ওপরটাকে একটা চক্কর দেয় । ট্রেনের টিকিট বড়দের মাথাপিছু ৪০/- টাকা আর ছোটদের মাথাপিছু ৩০/- টাকা । এরকম একটা দারুণ জিনিস না চড়ার কোনও মানেই হয় না, তাই টিকিট কেটে আমরা চড়ে বসলাম । এই টয়ট্রেন কলকাতার অটো আর লোক্যাল ট্রেনের কম্বিনেশন - নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়ার ব্যাপারে কোনও মাথাব্যাথা নেই আর ভর্তি না হলে ছাড়ে না !

টয়ট্রেন থেকে ভাইজ্যাগ শহর







যাই হোক, শেষ পর্যন্ত্য ভর্তি হল আর ছাড়ল নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় ২০ মিনিট পরে । ট্রেনে করে ঘুরে দারুণ লাগল । ট্রেন থেকে পাহাড়ের চারপাশে পুরো ভাইজ্যাগ শহরটা দেখা যায় আর সমুদ্রের দিকটাও দেখা যায় । অসাধারণ দৃশ্য ! ভাইজ্যাগ গেলে এই একটা জিনিস কোনওমতেই মিস্‌ করা চলবে না । একটা সাজেশন দিচ্ছি - এই ট্রেনে সবসময়ে ডানদিকের সিটে বসার চেষ্টা করা উচিৎ, তাহলেই এই দৃশ্য উপভোগ করা সম্ভব । যদি ট্রেনে ওঠার সময়ে দেখা যায় ডানদিকের সিট ভর্তি হয়ে গেছে, সেক্ষেত্রে পরের ট্রেনে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ (পরের ট্রেন বলতে এই ট্রেনের পরের ট্রিপ কারণ এই লাইনে এই একটাই ট্রেন চলে)। আমাদের ২০ মিনিটব্যাপী টয়ট্রেন ভ্রমণ শেষ হল তখন দুপুর ২ঃ৫০ মিনিট ।

স্টেশনের পাশেই একাধিক রেস্ট্যুরেন্ট আছে । তারই একটা থেকে আমরা মিক্সড ফ্রাইড রাইস আর চিকেন মাঞ্চুরিয়ান খেলাম । খরচ হল ৩৪০/- টাকা ।

এয়ারক্র্যাফট মিউজিয়ামের ভেতরে মডেল
এয়ারক্র্যাফ্‌ট মিউজিয়াম - আমাদের পাহাড়ের ওপরের দেখার জায়গা শেষ, এরপর যা দেখার সবই সমতলে । আমাদের গাড়ি এরপর আমাদের নিয়ে গেল এয়ারক্র্যাফ্‌ট মিউজিয়ামে । এটা একেবারে সমুদ্রের ধারে । কৈলাশগিরি পাহাড় থেকে এখানে যেতে লাগল মিনিট কুড়ি । এখানে ঢোকার টিকিট মাথাপিছু ৭০/- টাকা আর বাচ্চাদের টিকিট লাগে না । মিউজিয়ামটা খুবই সুন্দর । এখানে বিভিন্ন যাত্রীবিমান, যুদ্ধবিমানের নানারকম যন্ত্রাংশ ইত্যাদি রাখা আছে । যন্ত্রপাতিগুলো কিভাবে কাজ করে, বিমানের মধ্যে কিভাবে কম জায়গায় অনেক সরঞ্জাম রাখা যায় সেই সম্পর্কে প্রচুর তথ্য নানারকম মডেলের মাধ্যমে দেখানো আছে । মিউজিয়ামটা বিশাল কিছু বড় নয় আর ভেতরটা খুব সুন্দর ।

আসল যুদ্ধবিমান
মিউজিয়ামের বেরোনোর গেটে একটা সত্যিকারের গোটা যুদ্ধবিমান রাখা আছে এবং সেটার ভিতরে ঢুকে সবটা দেখার জন্য ব্যবস্থা করা আছে । সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্লেনের ভিতরে ঢুকে আমরা ভালো করে সব দেখে নিলাম । এই জিনিস সিনেমায় অনেকবার দেখেছি (যেগুলোর পিছনটা খুলে যায় আর সেখান থেকে সৈন্যরা টপাটপ ঝাঁপ দেয়), তবে সেটা সামনাসামনি দেখার সুযোগ এই প্রথমবার পাওয়া গেল ।

সাবমেরিন মিউজিয়াম - এয়ারক্র্যাফ্‌ট মিউজিয়ামের সামনে বীচ রোড আর সেটা পেরিয়ে সমুদ্রের ধারে সাবমেরিন মিউজিয়াম । এখানে ঢোকার টিকিট মাথাপিছু ৪০/- টাকা আর এখানেও বাচ্চাদের টিকিট লাগে না । এটা একটা সত্যিকারের আস্ত সাবমেরিন । এর নাম আই এন এস কুরসুরা । এখানেও সিঁড়ি দিয়ে উঠে সাবমেরিনে ঢুকে ভিতরটা দেখতে হয় । এই জিনিসও হলিউডের সিনেমায় দেখেছি তবে সামনাসামনি এই প্রথম । সাবমেরিনের ভিতরটা একটা দেখবার মতো জিনিস । আমরা ছাড়াও আরও অনেক দর্শক ছিল আর কর্তৃপক্ষ পুরো দলের জন্য একজন গাইড দেয়, সেই আমাদের সব দেখিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিল ।

সাবমেরিন
একটা ছোট জায়গার ভিতরে যে কি অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে সবকিছুর ব্যবস্থা করা আছে, সেটা নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যায় না । এই সাবমেরিনে একসঙ্গে চব্বিশজন লোক থাকতে পারে, তাদের মধ্যে পালা করে আটজন ঘুমোতে পারে । তাদের শোওয়ার ব্যবস্থা, খাওয়ার ব্যবস্থা, স্নানাদির ব্যবস্থা, বিনোদনের ব্যবস্থা সবই করা আছে এই সাবমেরিনের মধ্যে । হঠাৎ প্রয়োজন পড়লে যাতে তারা যেকোনও পরিস্থিতিতে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে পারে সেই ব্যবস্থাও করা আছে এর ভিতরে । এখানে ভিতরে ফোটো তোলার নিয়ম নেই, তাই শুধু বাইরে থেকে তোলা ছবি দেওয়া গেল ।

সাবমেরিন মিউজিয়ামের পাশের পার্ক
সাবমেরিন মিউজিয়ামের বেরোনোর গেটের পাশে একটা ছোট পার্ক গোছের আছে, সেখানে বসার জায়গা, বাচ্চাদের ঢেঁকি ইত্যাদি আছে । আমরা অবশ্য সেখানে সময় নষ্ট না করে এগিয়ে গেলাম আমাদের দিনের শেষের গন্তব্যগুলোর দিকে ।





রামকৃষ্ণ বীচ
রামকৃষ্ণ বীচ - সাবমেরিন মিউজিয়ামের থেকে ২ মিনিট গাড়িতে গেলে শুরু হয়ে যায় রামকৃষ্ণ বীচ । এই বীচের খুব কাছেই আছে এখানকার রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম, সেই থেকেই বীচের নাম । যারা ভাইজ্যাগে এসে রামকৃষ্ণ বীচে থাকে, তাদের জন্য রুষিকোন্ডা বীচ একটা ভিউ পয়েন্ট আর যারা রুষিকোন্ডা বীচে থাকে, তাদের জন্য রামকৃষ্ণ বীচ একটা ভিউ পয়েন্ট । আর যারা এই দুটোর কোনওটাতেই থাকে না তাদের জন্য দুটোই ভিউ পয়েন্ট !

রামকৃষ্ণ বীচের সামনের রাস্তা
আমরা রামকৃষ্ণ বীচের পাশে রাস্তার পাঁচিলের ওপর কিছুক্ষণ বসে রইলাম । বিকেল ৫ঃ৩০ বাজে, বীচে লোকজনের বেশ ভিড় । বীচটা খুব সুন্দর এটা বলতেই হবে । খুব সুন্দর হাওয়া দিচ্ছিল, বসে থাকতে বেশ ভালো লাগছিল । এখানেও বীচের ওপর ঘোড়া চলে, বীচের ওপর দোকান বসে । সবমিলিয়ে আমাদের পরিচিত আর পাঁচটা জনবহুল বীচের সঙ্গে বিশেষ পার্থক্য নেই, আর সেই কারণেই হয়তো বসে থাকাটা বেশ উপভোগ করছিলাম । বীচে বসে কিছু খাব না, এটা হতেই পারে না তাই কুলফি খাওয়া হল । সারাদিন ঘোরার পর সেটা বেশ একটা উপাদেয় জিনিস !

কালীমন্দির
কালী মন্দির - রামকৃষ্ণ আছেন আর কালী ঠাকুর নেই তা কি হয় ? রামকৃষ্ণ বীচে আমরা যেখানে বসেছিলাম তার ঠিক উল্টোদিকেই রাস্তা পেরিয়ে এখানকার কালীমন্দির । মন্দিরটার বৈশিষ্ট্য হল এটা দেখতে একেবারে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের মতো, তবে কিছুটা আকারে ছোট । মন্দিরের ভেতরে ঢুকতে গেলে আবার জুতো খোলার হ্যাপা আছে, তাই আমরা সেটা উপেক্ষা করলাম । মন্দিরের পাশেই আমাদের গাড়ি রাখা ছিল, সেটায় উঠে এবার আমরা ফেরার পথ ধরলাম ।

রামকৃষ্ণ বীচ থেকে রুষিকোন্ডা বীচে আমাদের রিসর্টে ফিরতে সময় লাগল আধঘন্টা । গাড়ি আমাদের রিসর্টের দরজায় নামিয়ে দিয়ে তার প্রাপ্য ২,৩০০/- টাকা নিয়ে চলে গেল ।

আমাদের ভাইজ্যাগ ঘোরা শেষ । এটা বলব না যে আমরা ভাইজ্যাগের সবকটা দেখার জায়গাই দেখে ফেলেছি, কিন্তু এটা ঠিক যে আমরা বেশিরভাগ ভালো জায়গাগুলোই দেখতে পেরেছি । যেকোনও জনপ্রিয় ঘোরার জায়গাতেই এরকম অনেকগুলো দেখার পয়েন্ট থাকে । কিন্তু শুধু সংখ্যার বিচারে সবকটা জায়গা দেখার আমি কোনও যৌক্তিকতা খুঁজে পাইনা । আমার মতে, তার থেকে অনেক ভালো হচ্ছে যে ক'টা জায়গা দেখব, সেগুলো ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখব । সেই বিচারে আমরা ভাইজ্যাগে যা দেখেছি, তা খুব ভালোভাবেই দেখেছি ।

দ্বিতীয়বার অবাক হওয়া !
ঘরে ফিরলাম তখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা । আমরা ব্যালকনিতে বসে রয়েছি, আকাশে চাঁদ উঠেছে । দিনটা কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার মাত্র দুদিন পরে, তাই চাঁদের আলোর জৌলুস দেখার মতো । সেই চাঁদের জ্যোৎস্না সমুদ্রের ওপর প্রতিফলিত হয়ে এক অসামান্য আলোকোদ্ভাসিত দৃশ্যপটের সৃষ্টি করেছে ! আগেও বলেছি, সমুদ্রের পাশে এসে পাহাড়ের ওপর থেকে সমুদ্র দেখার সুযোগ সচরাচর পাওয়া যায় না আর এই উচ্চতা থেকে সমুদ্রের জলে পূর্ণচন্দ্রের প্রতিফলনের সৌন্দর্য্য যে কতখানি, তা লিখে বোঝানো সম্ভব নয় । বাইরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রকৃতির এই অকৃপণ দানে নিজেকে ঋণী বলে মনে হচ্ছিল (লেখার মধ্যে কাব্য বেশি হয়ে যাওয়ার জন্য দুঃখিত !)। রুষিকোন্ডা বীচে থাকার পরিপ্রেক্ষিতে এই আমার দ্বিতীয়বার মুগ্ধ হওয়া ।

কাব্য জিনিসটা খারাপ নয়, তবে খালি পেটে বেশিক্ষণ ভালো লাগে না ! রাতে রুটি, চিকেন, এগকারী নেওয়া হল । খরচ হল ৬৫৮/- টাকা ।

পরেরদিন শনিবার ২৭শে অক্টোবর, ২০১৮ - আমাদের আরাকু যাওয়ার দিন । আমাদের ট্রেন সকাল ৬ঃ৫০ মিনিটে বিশাখাপত্তনম স্টেশন থেকে, তাই সকাল ৬ টা নাগাদ আমরা মালপত্র নিয়ে চেক-আউট করে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম । সকালের কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টটা আমাদের পাওনা ছিল, কিন্তু ব্রেকফাস্ট কাউন্টার খোলে সকাল ৭ টায়, তাই ওই ব্রেকফাস্টের মায়া ত্যাগ করা ছাড়া উপায় ছিল না । আসার দিনের মতোই একটা অটো নেওয়া হল তবে আসার দিনের চেয়ে ৫০/- টাকা বেশি দিতে হল । প্রায় সাড়ে ছটা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম স্টেশনে ।

এখানে একটা দরকারী তথ্য দিয়ে রাখি । ভাইজ্যাগ থেকে আরাকু যাওয়ার জন্য এ পি ট্যুরিজমের একটা রেল কাম রোড ট্রিপ ছিল । এই ট্রিপে ট্রেনে করে ভাইজ্যাগ থেকে আরাকু নিয়ে যাওয়া হত আর গাড়ি বা বাসে করে আরাকু থেকে ভাইজ্যাগ ফেরৎ নিয়ে আসা হত । ভাইজ্যাগের বুকিং করার সময়ে আমরা এ পি ট্যুরিজমের কলকাতার অফিসে গিয়ে এই ব্যাপারে খোঁজ করেছিলাম । ওরা জানাল এই রেল কাম রোড ট্রিপ ওরা কয়েকবছর আগে বন্ধ করে দিয়েছে । এখন যেটা আছে সেটা শুধুই রোড ট্রিপ অর্থাৎ গাড়িতে যাওয়া আর গাড়িতেই ফেরা । অথচ ভাইজ্যাগ থেকে আরাকু যাওয়ার প্রধান আকর্ষণই হল এই ট্রেনজার্নি, তাই আমরা এ পি ট্যুরিজমের কাছে বুকিং না করে আলাদা করে নিজেদের মতো করেছিলাম ।

পাহাড়ে ওঠার আগে
ভাইজ্যাগ থেকে আরাকু যাওয়ার তিনটে ট্রেন আছে, তার মধ্যে সকালে সবথেকে আগে ছাড়ে কিরন্ডুল প্যাসেঞ্জার । আমরা এখানে সেকেন্ড ক্লাস সিটিং-এর টিকিট কেটেছিলাম কারণ আর কোনও ক্লাসের টিকিট পাওয়া যায়নি । এই ট্রেনে একটা ক্লাস আছে, এক্সিকিউটিভ এ সি চেয়ার কার । এই কামরার বৈশিষ্ট্য হল এর জানালা বিশাল বিশাল কাচের আর ছাদটাও কাচের । স্বাভাবিকভাবেই এই কামরার ভিউ অত্যন্ত সুন্দর । কিন্তু এর বুকিং পাওয়া সহজ নয় । ভাইজ্যাগ থেকে আরাকু পৌঁছতে ট্রেনে চারঘন্টার মতো লাগে । সকাল ৬ঃ৫০ মিনিটে বিশাখাপত্তনম স্টেশন আমাদের ট্রেন রওনা দিল আরাকুর উদ্দেশ্যে । শুরু হল ভারতবর্ষের প্রথম দশটা সবথেকের দুর্দান্ত ট্রেনজার্নির মধ্যে অন্যতম সেরাটা !

সেই বিখ্যাত বাঁকগুলোর একটা
ট্রেনজার্নির প্রথমদিকে সেরকম কোনও বিশেষত্ব নেই । প্রায় সমতলের ওপর দিয়ে ট্রেন চলছে, চারপাশে সাধারণ মাঠ রাস্তা চাষের জমি ইত্যাদি । ঘন্টা দেড়েক পর থেকে আস্তে আস্তে আরম্ভ হল পাহাড় । আর ট্রেন ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠতে শুরু করল । কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরের দৃশ্যের আকর্ষণ এরকম বাড়তে লাগল যে ট্রেনের সিটে বসে থাকার চেয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকাই যাত্রীদের কাছে বেশি আগ্রহজনক বলে মনে হতে লাগল । যতই পাহাড়ের উচ্চতা বাড়ে, ততই বাড়ে বাইরের দৃশ্যের আকর্ষণ । সেই সঙ্গে একের পর এক টানেল । আগেই জানতাম ভাইজ্যাগ থেকে আরাকুর মধ্যে ছোটবড় মিলিয়ে মোট ৫৮ টা টানেল আছে, যদিও সেই সংখ্যাটা সঠিক কিনা সেটা আমি ভেরিফাই করার চেষ্টা করিনি !

ট্রেন থেকে অসাধারণ সিনিক বিউটি
বেশ কিছু ছবি তুললাম কিন্তু বেশিরভাগ লোকের মতো ছবি তোলাটাকেই মুখ্য কাজ বলে মনে করিনি । সত্যি বলতে কি ইন্টারনেটে সার্চ করলে এই জার্নির অনেক ছবি পাওয়া যায় আর ইউটিউবে সার্চ করলে প্রচুর ভিডিও-ও পাওয়া যায় । তাই ছবি বা ভিডিও না তুলে যেটা করা যায় সেটাই করেছি - মন ভরে প্রাণ ভরে ট্রেনজার্নির এই রূপসুধা পান করেছি (এটা বোধহয় যথাযথ হল না, কিন্তু সাহিত্যিক নই বলে উপযুক্ত অলঙ্কারের অভাব আমার সবসময়েই থাকে) ।

পাহাড়ের ওপর ছোট্ট বোরা গুহালু স্টেশন
ঘন্টাতিনেক চলার পর 'বোরা গুহালু' বলে একটা স্টেশন পড়ে - নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এটা 'বোরা কেভ' বা 'বোরা গুহা'র স্টেশন । এটা একটা দর্শনীয় স্থান, তাই এখানে কিছু লোক ট্রেন থেকে নেমে গেল । আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা আরাকু থেকে ফেরার পথে এটা দেখব, তবে চাইলে যাওয়ার পথেও দেখে নেওয়া যেতে পারে । সেক্ষেত্রে গুহা দেখে গাড়ি করে আরাকু যেতে হবে কারণ গুহা দেখা শেষ হওয়ার পরে আর কোনও ট্রেন পাওয়া যাবে না ।

বোরা গুহালু থেকে আরও একঘন্টা পাহাড়ী পথে চলার পর ট্রেন পৌঁছল আমাদের গন্তব্য 'আরাকু ভ্যালি' স্টেশনে । স্টেশনটা বেশ ছিমছাম আর খুব একটা বড় নয় । স্টেশনের চারপাশে পাহাড় আর রেললাইনটা এখান থেকে ঘুরে গেছে বলে আমাদের ট্রেনটা অনেক দূর পর্যন্ত্য দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল । আমি ছবি তুলছিলাম কিন্তু স্টেশনের একজন মিলিটারি ব্যক্তি এসে আমাকে বললেন এখানে ছবি তোলা বারণ । তাই ছবিটা এখানে লেখার সঙ্গে দিলাম না ।

স্টেশন থেকে আমাদের হোটেল ৮০০ মিটার, কিন্তু তাই বলে মালপত্র নিয়ে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয় । একটা টাভেরা আমাদের ৫০/- টাকার বিনিময়ে হোটেলে পৌছে দিল ।

কৃষ্ণ তারা কমফর্টস
আরাকুতে আমাদের হোটেলের নাম 'কৃষ্ণ তারা কমফর্টস' । যখন বুকিং করেছিলাম তখনও ছবি দেখেছিলাম আর পৌঁছে হোটেলটা আরও ভালো লাগল । আমরা যত জায়গায় যত হোটেলে থেকেছি, এই হোটেল তাদের মধ্যে ওপরের দিকে থাকবে । হোটেলটা বেশ নতুন, এখনও সব জায়গা তৈরির কাজ শেষ হয়নি । পুরো জায়গাটা দারুণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । কম্পাউণ্ডের দুদিকে দুটো বিল্ডিং আর মাঝখানে একটা বাচ্চাদের পার্ক নিয়ে পুরো হোটেলটা ।

কৃষ্ণ তারা কমফর্টসে আমাদের ঘর
একদিকের বিল্ডিং-এর তিনতলায় আমাদের দুটো ঘর দিল । ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ব্যালকনি আর সেখান দিয়ে অসাধারণ সিনিক বিউটি দেখা যায় । আরাকু হচ্ছে ভ্যালি বা উপত্যকা অর্থাৎ পাহাড় দিয়ে ঘেরা প্রায় সমতলভূমি । হোটেলের ব্যালকনি থেকে চারদিকের পাহাড় দেখা যায় আর দূরে রেললাইনও দেখা যায় । জায়গাটা আমাদের মধ্যপ্রদেশ ভ্রমণের পাঁচমারির কথা মনে করিয়ে দেয়, যদিও এখানে পাঁচমারির থেকে লোকসংখ্যা অনেক কম । বেশিরভাগ লোকই ভাইজ্যাগ থেকে আরাকু ডে-ট্রিপ করে চলে যায়, আমরা সেই স্রোতে গা না ভাসানোয় নিজেদের ভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছিল । আরাকুর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯১০ মিটার, তাই অক্টোবরের শেষে দুপুর ১২ টার সময়ে গরম তো লাগছিলই না, বরং বলা যেতে পারে ঠান্ডা ঠান্ডা আরামদায়ক আবহাওয়া ।

হোটেলের একটা আলাদা ডাইনিং স্পেস আছে কিন্তু বোধহয় যথেষ্ট সংখ্যক কর্মচারীর অভাবে এরা ঘরে এসে খাবার দিয়ে যাওয়াটাই প্রেফার করে । খাবারের সঙ্গে থালা গ্লাস চামচ সবই দিয়ে যায় । আমরা লাঞ্চে ভাত, ডাল, আলুভাজা, চিকেন মশালা, চিকেন কারি নিলাম । এখানকার রান্না বিশেষ করে চিকেনটা খুবই ভালো খেতে । খরচ হল ৮০০/- টাকা ।

পাহাড়ের ওপর সূর্য্যাস্ত
দুপুরে আমরা ঘরে শুয়ে বিশ্রাম করলাম । আরাকু ভ্যালি জায়গাটায় আলাদা করে অনেক কিছু দেখার নেই, যেগুলো আছে সেগুলো আরাকু থেকে ভাইজ্যাগ ফেরার পথে দেখে নিতে হয় । বিকেলে আমরা হাঁটতে বেরোলাম । কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে হাঁটছিলাম না, তবে এরকম একটা জায়গায় এরকম শান্ত, প্রায় নিস্তব্ধ পরিবেশে হাঁটতেও ভালো লাগে । হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের ওপরে সূর্য্যাস্তও দেখার সৌভাগ্য হয়ে গেল ।

আমরা হাঁটছিলাম আরাকু-বিশাখাপত্তনম রোড দিয়ে স্টেশনের বিপরীত দিকে । রাস্তার লোকের থেকে জানতে পারলাম অল্প হাঁটলেই কাছাকাছির মধ্যে আছে আরাকু ভ্যালির 'ট্রাইবাল মিউজিয়াম' ।

ট্রাইবাল মিউজিয়ামের ভেতরে মডেল
ট্রাইবাল মিউজিয়াম - নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে ভেতরে জিনিসটা কি থাকতে পারে । ঢোকার টিকিট মাথাপিছু ৪০/- টাকা আর বাচ্চাদের টিকিট লাগে না । এই অঞ্চলের ট্রাইবাল বা আদিবাসীদের জীবনযাত্রা নিয়ে তৈরি এই মিউজিয়াম । ভেতরটা বেশ বড় আর বেশ সুন্দর । বিশাল এলাকা জুড়ে তৈরি এই মিউজিয়ামটার বৈশিষ্ট্য হল এটা কোনও একটা বিরাট আকারের সংগ্রহশালা নয়, আলাদা আলাদা জায়গায় ছোট ছোট বাড়ির মধ্যে বিভিন্ন মডেল তৈরি করা হয়েছে । আমরা ঢুকেছি তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা, পুরোটা ভালোভাবে দেখতে ঘন্টাখানেক লাগে । এরই মাঝখানে আবার এখানে মাদল বাজিয়ে নাচগান শুরু হল । একইরকম পোষাক পরা কিছু আদিবাসী মহিলা নাচ দেখাল আর সেইসঙ্গে দর্শকরাও তাদের সঙ্গে কোমর মেলালো । সবমিলিয়ে বেশ একটা ছন্দময় ব্যাপার !

ট্রাইবাল মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে আমরা একটা অটো ধরে হোটেলে ফিরে এলাম । রাস্তাটা বেশি নয়, অটোয় লাগল ৫ মিনিট, কিন্তু ফেরার সময়ে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল আর ঠান্ডাও লাগছিল বলে আর হেঁটে ফেরার চেষ্টা করলাম না । অটো আমাদের হোটেলের রাস্তার মুখে নামিয়ে দিল । এখানে কয়েকটা খাবারের দোকান আছে, সেখান থেকে আমরা পরোটা আর আলুর দম খেয়ে নিলাম । খরচ হল ১৯০/- টাকা ।

রাতের খাবার যথারীতি ঘরে বসেই খাওয়া হল । রুটি, চিকেন, ডিম ইত্যাদি নিয়ে খরচ হল ৫৪০/- টাকা । এখানে রাতে ভালোই ঠান্ডা পড়ে । ঘরে কম্বল আছে আর শোওয়ার সময়ে সেটার সদ্ব্যবহারও করলাম ।

পাহাড়ের ওপরে সূর্য্যোদয়
পরেরদিন রবিবার ২৮শে অক্টোবর, ২০১৮ - আমাদের আরাকু থেকে ভাইজ্যাগ ফেরার দিন আর সেইসঙ্গে ভাইজ্যাগ থেকে বাড়ি ফেরারও দিন । সকালে উঠে পাহাড়ের ওপর সূর্য্যোদয় দেখলাম । আরাকু জায়গাটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা আর আমাদের ঘর তিনতলায় হওয়ার জন্যই এটা সম্ভব হল । সে এক অসাধারণ দৃশ্য ! হয়তো দৃশ্যটার মধ্যে নতুনত্ব নেই, যেকোনও পাহাড়ী অঞ্চলে গেলেই এরকম দেখা যায় কিন্তু যেকোনও কারণেই হোক সূর্য্যোদয় জিনিসটা আমার কাছে কখনও পুরনো হয় না । সূর্য্যোদয় মানেই নতুন একটা দিন, নতুন একটা সম্ভাবনা, নতুন করে বাঁচা, নতুন করে ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়া করা ইত্যাদি ইত্যাদি !

এই হোটেলেও কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট আছে । ইডলি, ধোসা, বঢ়া ইত্যাদি । এই জিনিসগুলো খুব উপাদেয় হয় না, তবে পেট ভরানোর পক্ষে যথেষ্ট । ব্রেকফাস্ট করে ন'টার একটু পরে আমরা চেক-আউট করে বেরিয়ে পড়লাম । গাড়ি আগেরদিনই ঠিক করা ছিল । এই গাড়ি আমাদের আরাকু থেকে ভাইজ্যাগ পৌঁছে দেবে আর রাস্তায় সব দেখার জায়গাগুলো দেখাবে ।

গাড়ির প্রথম দেখানোর জায়গা ট্রাইবাল মিউজিয়াম যেটা আমরা আগেরদিনই দেখে ফেলেছি । তাই গাড়ি আমাদের নিয়ে গেল ট্রাইবাল মিউজিয়ামের লাগোয়া 'কফি মিউজিয়াম'এ ।

কফি মিউজিয়ামের ভেতরে
কফি মিউজিয়াম - শুধুমাত্র কফি বস্তুটার ওপর যে একটা মিউজিয়াম হতে পারে সে'বিষয়ে আমার কোনও ধারণা ছিল না । তাই মাথাপিছু ১০/- টাকার টিকিট (বাচ্চাদের ফ্রি) কেটে ভিতরে ঢুকে নানাভাবে সমৃদ্ধ হলাম । আমরা বাড়িতে সাধারণতঃ নেস্‌ক্যাফে খাই, কেউ কেউ ব্রু এর কফিও খেয়ে থাকে । সেই থেকে আমার ধারণা ছিল ওই নেসক্যাফের টেস্টটাই কফির টেস্ট । কিন্তু কফি জিনিসটা যে বিভিন্ন রকমের হয়, চায়ের মতো কফিরও আলাদা আলাদা স্বাদ আছে এবং কফি তৈরির পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে তার স্বাদ, গন্ধ আর রঙ আলাদা হতে পারে সেটাও আমার ধারণা ছিল না । কফির একটা বড় গুণ হল কফি খেলে নেশা হয় না, যেটা চায়ে হয় । চায়ের সঙ্গে কফির প্রধাণ পার্থক্য চা হল গাছের পাতা আর কফি হল বীজ । দাক্ষিণাত্যের এই নীলগিরি পার্বত্য এলাকায় কফির প্রচুর চাষ হয় এটা তো ছোটবেলাতেই পড়েছি, আর সেই কারণেই এখানে এই কফি মিউজিয়াম । এখানে গাছ থেকে কফি তোলা থেকে শুরু করে কাপে কফি পরিবেশন করা পর্যন্ত্য পুরো পদ্ধতিটা অনেকগুলো মডেলের সাহায্যে দেখানো আছে । হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে অনেকবার ভ্রমণ করার সুবাদে চা কিভাবে তৈরি হয় সে'সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা থাকলেও কফির ব্যাপারে এই অভিজ্ঞতা একেবারেই নতুন । সাধে কি আর কথায় বলে 'ভ্রমণে মনের প্রসার বাড়ে' !

কফি গাছ
কফি মিউজিয়ামে কফি সম্পর্কিত তথ্য ছাড়াও কিছু ঘরসাজানোর জিনিসের দোকান আছে । আর আছে কিছু কফি গাছ । আমি আগে কখনও কফি গাছ দেখিনি, এখানে দেখলাম সেগুলো কিরকম দেখতে হয় আর ডাল থেকে কিরকম ফল ঝোলে । এছাড়া এখানে ছোট্ট একটা পার্ক গোছের আছে । জায়গাটা সবমিলিয়ে খুব বড় না হলেও খুব সুন্দর করে সাজানো ।


শ্যুটিং স্পট
শ্যুটিং স্পট - মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে মিনিট কুড়ি পাহাড়ি পথে চলার পর একটা জায়গা দেখিয়ে ড্রাইভার বলল এটা শ্যুটিং স্পট । জায়গাটার আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য নেই, তবে ছবি বা সিরিয়ালের শ্যুটিং হয় বলে পরিচিত (না, আমরা কোনও ছবির শ্যুটিং দেখতে পাইনি)।




আমরা পাহাড়ী পথে এগিয়ে চললাম । রাস্তাটা খুবই সুন্দর এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই । ঠান্ডা লাগছিল না, আবার গরমও লাগছিল না ।

গালিকোন্ডা ভিউ পয়েন্ট থেকে
গালিকোন্ডা ভিউ পয়েন্ট - আরও মিনিট দশেক চলার পর আমাদের ড্রাইভার একজায়গায় গাড়ি দাঁড় করালো - জায়গাটার নাম গালিকোন্ডা ভিউ পয়েন্ট । এখান থেকে বিস্তীর্ণ পাহাড়ের সারি দেখা যায় । ভিউ পয়েন্টে একটা রেলিং দিয়ে ঘেরা প্ল্যাটফর্ম করা আছে, সেখানে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হতে হয় । এরকম দৃশ্য যে আগে কখনও দেখিনি এমন নয়, কিন্তু আমার কাছে প্রাকৃতিক দৃশ্য কখনও একঘেয়ে বা রিপিটিটিভ বলে মনে হয় না ।

ব্যাম্বু চিকেন প্রস্তুত প্রণালী
এই গালিকোন্ডা ভিউ পয়েন্ট থেকে আমরা একটা জিনিস কিনলাম, তার নাম 'ব্যাম্বু চিকেন' । ভাইজ্যাগে এসে পর্যন্ত্য এই জিনিসটার নাম বেশ কয়েকবার শুনেছি কিন্তু চেখে দেখার সুযোগ হয়নি । মুরগীর মাংস ছোট ছোট করে কেটে মশলা মাখিয়ে একটা ফুটখানেক লম্বা বাঁশের ফুটোর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে সেই বাঁশটাকে আগুনে পুড়িয়ে তৈরি হয় এই ব্যাম্বু চিকেন । ভিউ পয়েন্টের পাশেই কয়েকটা ছোট ছোট দোকানে এগুলো পাওয়া যাচ্ছিল । জিনিসটা ওজনে বিক্রি হয়, আমরা ৫০০ গ্রাম কিনলাম ১৫০/- টাকা দিয়ে । খেতে অপূর্ব, অসাধারণ ! (সাধারণতঃ বাঁশ জিনিসটাকেই একটা বিশেষ জায়গায় ঢোকানো হয় । কিন্তু সেই বাঁশের মধ্যে কিছু ঢুকিয়ে যে এরকম অসাধারণ একটা খাবার জিনিস তৈরি করা সম্ভব, সে'ব্যাপারে আমার কোনও ধারণা ছিল না !)

গালিকোন্ডা ভিউ পয়েন্ট থেকে আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে । আরও মিনিট পনেরো চলার পর পড়ল আমাদের পরবর্তী দেখার জায়গা ।

আরাকু কফি গার্ডেন
আরাকু কফি গার্ডেন - রাস্তার ধারে একজায়গায় কফি গার্ডেনটা রয়েছে । মূল রাস্তা থেকে পাহাড়ের গায়ে পায়ে চলার মতো ধাপ তৈরি হয়েছে, সে ধাপেই কফির গাছ । কফি গাছ চা গাছের মতো সবকটা সমান আকারের বা অত ঘন হয় না, তবে চা বাগানের মতো এখানেও কফি গাছের মাঝে মাঝে অন্য বড় গাছ আছে । কফি গাছের উচ্চতা খুব বেশি হলে একজন মানুষের মতো হয় আর আপাতদৃষ্টিতে দেখলে গাছটাকে অন্য গাছের মধ্যে চেনাও সহজ নয় । যদি গাছ থেকে ফল ঝোলে সেটা দেখে বোঝা যায় । আমরা কিছুক্ষণ বাগানের মধ্যে থেকে আবার উপরে রাস্তায় উঠে এলাম ।

এখানে রাস্তায় কফি বিক্রি হয় । এককাপ কফি ১০/- টাকা । খেয়ে দেখলাম স্বাদটা যে শুধু ভালো তাইই নয়, স্বাদটা আমাদের চেনা কফির থেকে অনেকটাই আলাদা । রঙটাও একেবারে বাদামী নয়, একটা হাল্কা সবুজের ভাব রয়েছে । আমরা এখান থেকে এক প্যাকেট কফি কিনে নিলাম বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য ।

টাটিগুড়া ফল্‌স্‌ - কফি গার্ডেন থেকে আরও মিনিট কুড়ি চলার পর আমাদের পরবর্তী ভিউ পয়েন্ট - টাটিগুড়া জলপ্রপাত । এতক্ষণ আমরা আরাকু-বিশাখাপত্তনম রোড ধরেই যাচ্ছিলাম, এই ফলসে আসার জন্য সেই রাস্তা থেকে একটা গ্রাম্য পথে ঢুকতে হল । সেই পথে মিনিট দশেক চলার পর একজায়গায় গাড়ি দাঁড়াল । সেখান থেকে মিনিট পাঁচেক হেঁটে আমরা পৌঁছলাম ভিউ পয়েন্টে ।

টাটিগুড়া ফল্‌স্‌
ভিউ পয়েন্ট থেকে ফলস্‌টা বেশ ভালো দেখা যায় । তবে অক্টোবরের শেষ ফল্‌সে বিশেষ জল নেই । ভিউ পয়েন্টের পাশ দিয়ে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে, সেটা দিয়ে ফল্‌সের একেবারে পাশে চলে যাওয়া যায় । আমি সেখানে নেমে গেলাম যদিও সেখান থেকে খুব বেশি কিছু দেখা গেল না । যে পাহাড়টার গা-বেয়ে ফল্‌স্‌টা নামছে সেটার বেশিরভাগ জায়গাই শুকনো, শুধু দু'টো জায়গা দিয়ে দু'টো ক্ষীণ জলের ধারা নেমে আসছে । এর পাশে পাহাড়ের ধাপে ধাপে ছোট ছোট চাষের জমি রয়েছে, সেগুলো দেখতে বেশ সুন্দর ।

বোরা কেভস্‌ - টাটিগুড়া ফল্‌স্‌ থেকে প্রায় একঘন্টা চলার পর আমাদের পরবর্তী তথা শেষ গন্তব্য বোরা কেভস্‌ বা বোরা গুহাগুলি । আরাকু থেকে ভাইজ্যাগের মধ্যে যে দেখার জায়গাগুলো আছে, তাদের মধ্যে বোরা কেভস্‌ হচ্ছে সবথেকে বেশি ঘ্যাম । এখানে ঢোকার টিকিট বড়দের মাথাপিছু ৬০/- টাকা আর ছোটদের মাথাপিছু ৪৫/- টাকা । এছাড়া ক্যামেরার চার্জ আলাদা ।

বোরা কেভসে প্রবেশপথ
বোরা কেভসে বেশ ভীড়, আগের জায়গাগুলোর মতো ফাঁকা ফাঁকা নয় । এখানে ঢোকার ঠিক মুখে একটা বড় সাইনবোর্ডে এই গুহার সম্পর্কে অনেক তথ্য দেওয়া আছে । সেটা থেকে জানলাম ১৮০৭ সালে ব্রিটীশ ভূতাত্বিক উইলিয়াম কিং এই গুহা আবিষ্কার করেন । অনুমান করা হয় এই গুহা পনেরো কোটি বছরের পুরনো । ভেতরটা সুবিশাল আর রঙপরিবর্তনশীল আলো দিয়ে আলোকিত করা । তাই অন্ধকার বা প্রায়ান্ধকারে গুহার ভেতরটা এক্সপ্লোর করার রোমাঞ্চ এখানে পাওয়ার সম্ভাবনা কম ।

আলোকোদ্ভাসিত বোরা কেভসে মানুষের ঢল
বোরা কেভসের ভেতরে স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইট দুটোই দেখতে পাওয়া যায় । ভেতরে অনেক চড়াই-উৎরাই আছে, বয়স্ক লোকদের পুরোটা যাওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো । প্রথমে বেশ অনেকটাই সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়, তারপর সমতল, তারপর আবার নামা আর শেষের কিছুটা ওঠা । লোকজন বলল একেবারে শেষে একটা মন্দির আছে যেটা আমরা আর যাইনি । বাইরের আলো ভেতরে ঢোকার প্রশ্নই ওঠে না, আর ভেতরে বিভিন্ন জলা জায়গা থাকার জন্য পুরো এলাকাটা স্যাঁতসেঁতে । ভেতরে একটা জায়গা আছে যেখানে ইস্ট কোস্ট রেলওয়ে একটা ফলক বসিয়ে রেখেছে । ফলকটায় ইংরিজীতে লেখাঃ
১. ঠিক এই জায়গার ১৭৮ ফুট উপর দিয়ে কোট্টাভালাসা কিরন্ডুল রেলওয়ের লাইন চলে যাচ্ছে । রেললাইনের নিচের পাথর এই জায়গায় ১০০ ফুট মোটা ।
২. আপনি এখানে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,১৮২ ফুট উপরে রয়েছেন ।
৩. ইস্ট কোস্ট রেলওয়ে আপনাকে শুভ ভ্রমণ জানাচ্ছে ।
প্রথম পয়েন্টটা আমার বেশ মজার লাগল । আগেরদিন সকালে আমরা ট্রেনে করে যে জায়গা দিয়ে এসেছি, আজ তার ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে আছি ভাবতে বেশ ভালো লাগছিল ।

বাঁদরের আইসক্রিম খাওয়া
গুহার ঠিক বাইরে বাঁদরের বেশ উৎপাত আছে । একটু অন্যমনস্ক হলেই এই বাঁদররা বাঁদরামি করে লোকজনের হাত থেকে জিনিস ছিনিয়ে নেয় । একবার নিলে সেটা ফেরৎ পাওয়ার সম্ভাবনা কম কারণ এখানে কেউ ওদেরকে সুপারভাইজ করে না । আমাদের চোখের সামনেই একটা বাঁদর একজন ভদ্রমহিলার থেকে তাঁর কোন আইসক্রিমটা ছিনিয়ে নিয়ে খেতে লাগল (দৃশ্যটা আপাতদৃষ্টিতে বেদনাদায়ক হলেও বিস্ময়উদ্রেককারী কারণ আমি এর আগে কখনও কোনও বাঁদরকে আইসক্রিম খেতে দেখিনি !)

আগেই বলেছি বোরা কেভস্‌ এর কাছে 'বোরাগুহালু' স্টেশন আছে । তাই বোরা কেভস্‌ থেকে বেরিয়ে কিছুটা ওপরে তাকালে রেললাইন দেখতে পাব, এতে আশ্চর্য্য হওয়ার কিছু নেই । তবে যেটা দেখতে ভালো লাগে ওপরে রেললাইনটা পাহাড়ের গা দিয়ে গোল করে ঘুরে চলে গেছে আর আমাদের সৌভাগ্যক্রমে সেইসময়ে একটা ট্রেনও দেখতে পেয়ে গেলাম ।

আমাদের দেখার জায়গা এখানেই শেষ, দুপুর হয়ে গিয়েছিল তাই ড্রাইভার আমাদের খাওয়ার দোকানে নিয়ে গেল । বোরা কেভসের একেবারে কাছেই কোনও খাবারের দোকান নেই, ১ কিলোমিটার দূরে যেতে হয় । দোকানটা অতি সাধারণ । এখানে ভাত, ডাল আর ডিমের কারি খেয়ে পেট ভরাতে হল । খরচ হল ৪৬০/- টাকা ।

এই জায়গায় আমাদের ভ্রমণপথ নির্ধারণে একটা ভুল করেছিলাম, যেটা না করলে আমাদের জার্নি আরও আরামদায়ক আর কম খরচসাপেক্ষ হতো । বোরা কেভস্‌ দেখে আমরা বেরোলাম তখন দুপুর ২ঃ১৫ মিনিট । সেখান থেকে বেরিয়ে লাঞ্চ শেষ হল তখন ৩ঃ১৫ মিনিট । যেখানে লাঞ্চ করলাম, বোরা গুহালু স্টেশনটা তার খুবই কাছে । আমাদের গাড়ির সঙ্গে কথা ছিল সে আমাদের ভাইজ্যাগ পর্যন্ত্য পৌঁছে দেবে । সেটা না করে আমরা অনায়াসে এখানে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বিশাখাপত্তনমের ট্রেন ধরতে পারতাম । দুপুর ৩ঃ২৫ মিনিট আর বিকেল ৪ঃ৫০ মিনিটে বোরা গুহালু থেকে বিশাখাপত্তনমের ট্রেন পাওয়া যায় । যদি কেউ আমাদের ভ্রমণপথ অনুসরণ করে (যেটা নিঃসন্দেহে একটা অসাধারণ ভ্রমণপথ !) তাহলে তাকে এই ছোট্ট পরিবর্তনটা করে নিতে বলব ।

লাঞ্চের পরে গাড়ি আমাদের নিয়ে রওনা দিল বিশাখাপত্তনমের উদ্দেশ্যে । রাস্তা খুবই ভালো, আর ঘন্টাখানেক চলার পর গাড়ি সমতলে এসে গিয়ে আরও স্পীড বাড়াল । সন্ধ্যে ছ'টার একটু পরে আমরা পৌঁছে গেলাম বিশাখাপত্তনম স্টেশনে । গাড়ি আমাদের কাছ থেকে নিল ৫,০০০/- টাকা ।

বিশাখাপত্তনম থেকে আমাদের ফেরার ট্রেন চেন্নাই সাঁত্রাগাছি এসি সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস রাত ৮ঃ৫৫ মিনিটে । ট্রেন এল আধঘন্টা দেরিতে । রাতে ট্রেনে খাওয়ার জন্য স্টেশন থেকে আলুর পরোটা কেনা হয়েছিল, তাই খেলাম ।

পরেরদিন সোমবার ২৯শে অক্টোবর, ২০১৮ - ট্রেন সাঁত্রাগাছি পৌঁছনোর কথা ছিল দুপুর ১ টায়, পৌঁছলো প্রায় আড়াইটে । সেখান থেকে উবের ধরে বাড়ি !

সারসংক্ষেপঃ

১. ভাইজ্যাগ যাওয়ার সবথেকে ভালো সময় হচ্ছে অক্টোবর-নভেম্বর বা ফ্রেব্রুয়ারী-মার্চ । এই সময়ে এখানকার আবহাওয়া সবথেকে মনোরম থাকে ।
২. হাওড়া থেকে ভাইজ্যাগ বা বিশাখাপত্তনম যাওয়ার একাধিক ট্রেন আছে । তার মধ্যে সাঁত্রাগাছি থেকে শালিমার সাঁত্রাগাছি এ সি সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস সবথেকে কম সময়ে ভাইজ্যাগ পৌঁছয় ।
৩. ভাইজ্যাগে থাকার বহু হোটেল থাকলেও রুষিকোন্ডা বীচে অন্ধ্রপ্রদেশ ট্যুরিজমের হরিথা বীচ রিসর্টে থাকার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত সুন্দর । জায়গাটা একটু খরচসাপেক্ষ হলেও খরচ করাটা যুক্তিযুক্ত । অন্ধ্রপ্রদেশ ট্যুরিজমের ওয়েবসাইট https://tourism.ap.gov.in/home থেকে বুকিং করা যায় আবার এদের অফিস থেকেও বুকিং করা যায় । এদের কলকাতার অফিসের ফোন নম্বরঃ 03322813679, 9433044584.
৪. হরিথা বীচ রিসর্টে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট আছে । তবে ব্রেকফাস্টটা চেক্‌-ইন করা হলে তবেই পাওয়া যাবে ।
৫. রুষিকোন্ডায় থাকলে একটা দিন শুধুমাত্র রিসর্টে বসে কাটানোর জন্য রাখা ভালো । এখানে সবঘর থেকেই সমুদ্রের ভিউ পাওয়া যায় আর ব্যালকনিতে বসে সেই দৃশ্য উপভোগ করাটা একটা বিশেষ অভিজ্ঞতা ।
৬. রুষিকোন্ডা বীচে স্নান করা যেতে পারে । বঙ্গোপসাগর হলেও এখানে সমুদ্রের তেজ খুব একটা বেশি নয় ।
৭. রুষিকোন্ডা বীচে থাকলে খাওয়ার জন্য হরিথা বীচ রিসর্টের ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই কারণ এখানে কাছাকাছির মধ্যে আর কোনও খাবারের দোকান নেই । এখানকার খাবারের মান বেশ ভালো ।
৮. ভাইজ্যাগে লোক্যাল সাইট সিয়িং-এর জন্য এ পি ট্যুরিজমের প্যাকেজ ট্যুর আছে, তবে চাইলে নিজস্ব গাড়ি ভাড়া করেও ঘোরাঘুরি করা যায় । হরিথা বীচ রিসর্ট থেকে এই প্যাকেজ ট্যুর বুকিং করা যায় ।
৯. ভাইজ্যাগের লোক্যাল সাইট সিয়িং-এর মধ্যে কৈলাশগিরি পাহাড়, এয়ারক্র্যাফট্‌ মিউজিয়াম আর সাবমেরিন মিউজিয়াম দেখা অবশ্য কর্তব্য । কৈলাশগিরি পাহাড়ের টয়ট্রেনটাও অবশ্যই চড়া উচিৎ ।
১০. ভাইজ্যাগ গেলে পূর্ণিমা দেখে যেতে পারলে ভালো হয় । রুষিকোন্ডা বীচের রিসর্টের ব্যালকনি থেকে সমুদ্রের ওপর চাঁদের আলোর দৃশ্য দেখলে সারাজীবন মনে থাকবে ।
১১. ভাইজ্যাগ থেকে আরাকু ভ্যালি গাড়িতেও যাওয়া যায় আবার ট্রেনেও যাওয়া যায় । তবে ট্রেনে গেলে কিছু দুর্দান্ত দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা হয় যেটা গাড়িতে সম্ভব নয় । ট্রেনে গেলে চেষ্টা করা দরকার ট্রেনের ডানদিকের জানালার ধারে বসার ।
১২. পীক্‌ সিজনে গেলে অবশ্যই ট্রেনের বুকিং খোলার মূহুর্তেই টিকিট কাটতে হবে । তা না হলে টিকিট পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে ।
১৩. ভাইজ্যাগ-আরাকুর মধ্যে চলা কিরন্ডুল প্যাসেঞ্জারের একটা ক্লাস হল এক্সিকিউটিভ এ সি চেয়ার কার । ট্রেনে এরকম একটাই কামরা আছে আর এর বৈশিষ্ট্য হল এর বিশাল বিশাল কাচের জানালা আর ছাদটাও কাচের । এর বুকিং করতে চাইলেও খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে ।
১৪. ভাইজ্যাগ থেকে আরাকু একদিনের মধ্যেই গিয়ে ফিরে আসা যায় । তবে আরাকুতে একটা দিন থাকতে পারলে ভালো লাগবে ।
১৫. আরাকুতেও অন্ধ্রপ্রদেশ ট্যুরিজমের একাধিক থাকার জায়গা রয়েছে যদিও আমরা এর কোনওটাতেই বুকিং পাইনি । প্রত্যেকটা রিসর্টই খুব ভালো লোকেশনে তাই সিজনের সময়ে এখানে থাকতে চাইলে আগে থেকে বুকিং করতে হবে ।
১৬. অন্ধ্রপ্রদেশ ট্যুরিজমের রিসর্ট ছাড়াও আরাকুতে অনেক প্রাইভেট হোটেল আছে, যার মধ্যে 'কৃষ্ণ তারা কমফর্টস' খুব ভালো হোটেল । এদের নিজস্ব কোনও ওয়েবসাইট নেই, তবে https://www.makemytrip.com/ থেকে এদের বুকিং করা যায় । এদের ফোন নম্বরঃ 8008000855.
১৭. আরাকু ভ্যালির একটা সমস্যা হল এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না ।
১৮. আরাকু ভ্যালিতে সেরকম কিছু দেখার নেই, ট্রাইবাল মিউজিয়াম আর কফি মিউজিয়াম ছাড়া । এগুলো আরাকু থেকে ভাইজ্যাগ ফেরার পথে দেখে নেওয়া যায় ।
১৯. যারা কফি ভালোবাসে তাদের এখানকার কফি চেখে দেখা আর সেইসঙ্গে পারলে সংগ্রহ করা উচিৎ । এছাড়া এখানকার ব্যাম্বু চিকেনও খেয়ে দেখা উচিৎ ।
২০. আরাকুর সাইট সিয়িং-এর মধ্যে বোরা কেভ্‌স্‌ অবশ্য দ্রষ্টব্য । ঢোকা থেকে বেরোনো পর্যন্ত্য ভালোভাবে দেখতে প্রায় ঘন্টাদুয়েক সময় লাগে, তাই এই সময়টা হাতে রাখা দরকার ।
২১. বোরা কেভস্‌ এ বাঁদরের খুব উৎপাত আছে, এরা ট্যুরিস্টদের থেকে ছোঁ মেরে জিনিস নিয়ে নেয় ।তাই ছোটোখাটো জিনিস, খাবার এগুলো হাতে না রাখাই ভালো আর ব্যাগ মোবাইল ক্যামেরা পার্স সানগ্লাস এগুলো শক্ত করে ধরে রাখা দরকার ।
২২. বোরা কেভ্‌সের ঠিক সামনেই কোনও খাবারের দোকান নেই, কেভ্‌স্‌ থেকে এক কিলোমিটার দূরে আছে । এখানকার সব দোকানেরই খাবারের মান চলনসই ।
২৩. বোরা কেভস্‌ দেখে গাড়ি করে ভাইজ্যাগ ফেরার কোনও মানে হয় না, এখানকার বোরাগুহালু স্টেশন থেকে ট্রেন ধরা যায় । সেক্ষেত্রে আগে থেকে ট্রেনের বুকিং করে রাখতে হবে ।

উপসংহারঃ

ভাইজ্যাগ
পাহাড় আর সমুদ্রের সঙ্গমস্থল অন্ধ্রপ্রদেশ জেলার ভাইজ্যাগ আর তার থেকে অনতিদূরে আরাকু ভ্যালি । একটু খরচসাপেক্ষ হলেও এই জায়গাদুটো ভারতের বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থানের মধ্যে পড়ে । একদিকে প্রকৃতি যেমন তার অকৃপণ দানে এই জায়গাকে সমৃদ্ধ করেছে, অন্যদিকে মানুষ সেই দান শুধু গ্রহণ করেই নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকেনি, প্রদত্ত বস্তুর ওপর নিজের বুদ্ধি আর পরিশ্রম দিয়ে সুবিশাল ট্যুরিজম ইমারত গড়ে তুলেছে । সেইজন্য প্রতিবছর ভাইজ্যাগ আর আরাকুর ভ্রমণকারীদের কাছ থেকে এখানকার মানুষের বিপুল পরিমাণ আয় হয় । অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য যেমন একদিকে ভাইজ্যাগ-আরাকুর মূল আকর্ষণ তেমনই ভালো এখানকার মানুষজনের আতিথেয়তা । তবে ভাইজ্যাগ বা আরাকুতে যেতে গেলে যে জিনিসটা ভালোভাবে করতেই হবে সেটা হল নিখুঁত পরিকল্পনা । সবমিলিয়ে জায়গাগুলো ঘুরতে দিনচারেকের বেশি লাগে না কিন্তু এই সময়টাকেই কি করে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, সেটা আগে থেকে ঠিক করে নিতে হবে । আর এখনকার ইন্টারনেটের যুগে সেটা করা বিশেষ কিছু পরিশ্রমসাধ্য নয় । তাই পকেট যদি বিরাট বাধা হয়ে না দাঁড়ায় তাহলে দেরি না করে তাড়াতাড়ি 'ভাইজ্যাগ-আরাকু' ঘুরে আসাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ !

ভাইজাগ-আরাকু ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

Tuesday, October 2, 2018

ডায়মন্ড হারবার ভ্রমণ

মার ব্লগের প্রথম পোস্ট হল বক্‌খালি ভ্রমণ । আজ থেকে ৮ বছর আগে যখন বক্‌খালি গিয়েছিলাম, তখন যাওয়ার পথে ডায়মন্ড হারবারে কিছুক্ষণের জন্য চা-বিরতি নেওয়া হয়েছিল । সময়টা ছিল ২০১০ সালের আগস্ট মাস - বর্ষাকাল - তখন ডায়মন্ড হারবারে নদীর রূপ দেখে আমাদের সকলেরই খুব ভালো লেগেছিল । যে পাঁচজন বন্ধুর সঙ্গে বক্‌খালি গিয়েছিলাম, কালের নিয়মে তাদের অনেকের সঙ্গেই আজ আর সেভাবে যোগাযোগ নেই । কিন্তু যেটা থেকে গেছে সেটা হল ডায়মন্ড হারবারকে ভালো লাগার সেই রেশটা - যেটাকে সম্বল করেই আমার এই তৃতীয়বার ডায়মন্ড হারবার পাড়ি দেওয়া (প্রথমবার গিয়েছিলাম বাবার সঙ্গে ২০০৪ সালে, তখন ব্লগ লিখতাম না)।

২রা অক্টোবর, ২০১৮ সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ গাড়ি নিয়ে বেরোলাম আমি আর অমৃতা । ডায়মন্ড হারবার আমাদের বাড়ি থেকে দু'ভাবে যাওয়া যায় । এক, বাইপাস - মা ফ্লাইওভার - হেস্টিংস - ডায়মন্ড হারবার রোড, এই পথে দূরত্ব ৫৮ কিলোমিটারের মতো । দুই, বাইপাস - এক্সটেন্ডেড বাইপাস - বারুইপুর আমতলা রোড - আমতলা মোড় - ডায়মন্ড হারবার রোড, এই পথে দূরত্ব ৬৭ কিলোমটারের মতো । রাস্তা বেশি হলেও আমরা এই দ্বিতীয়টাই পছন্দ করলাম কারণ এই রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম কম হয় । আমতলার মোড়টা একটু জ্যাম হয়, তবে সেটা পেরোনোর পর গাড়ির স্পীড নামানোর আর বিশেষ দরকার পড়ে না ।

সাগরিকার জানালা থেকে নদীর দৃশ্য
ডায়মন্ড হারবার যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর প্রায় একটা বাজে । আমরা সবথেকে আগে লাঞ্চ করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম । ডায়মন্ড হারবারে হোটেল রেস্ট্যুরেন্ট অনেক আছে, তাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন দপ্তরের 'সাগরিকা'র লোকেশন বেশ ভালো । আমরা এখানে ঢুকে লাঞ্চ সেরে নিলাম । চিকেন বিরিয়ানি, ফ্রাইড রাইস আর চিকেন কারি নিয়ে মোট খরচ পড়ল ৪৩১/- টাকা ।

দাঁড়ানোর জায়গা
লাঞ্চ করে আমরা নদীকে ডানদিকে রেখে গাড়ি নিয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে গেলাম । নদীর পাড়টা খুব সুন্দর করে বাঁধানো, অনেক বসার জায়গাও আছে কিন্তু দুপুর রোদে সেখানে বসতে যাওয়াটা তসরিফের পক্ষে খুব আরামদায়ক হবে না, তাই সেটা আর করলাম না । (তসরিফ শব্দের মানে আমি জানি না । তবে উর্দুতে একটা কথা আছে 'তসরিফ রাখিয়ে' যার মানে 'বসুন' । তার থেকে তসরিফের যা মানে দাঁড়াচ্ছে, সেটাই এখানে ব্যবহার করলাম) রাস্তটা যেখানে নদীর ধার থেকে একটু ভিতরের দিকে ঢুকে গেছে, সেখান থেকে আরেকটা সরু রাস্তা নদীর পাড়ের দিকে এগিয়ে গেছে । আমরা এই রাস্তা ধরে কিছুটা চলে গেলাম । রাস্তাটা তিনশ' মিটার মতো গিয়ে মাঠের মধ্যে শেষ হয়ে গেছে । একটা গাছের ছায়ায় গাড়িটা রেখে আমরা নদীর ধারে গেলাম । এখানেও রোদ তবে বেশ কিছু গাছ থাকার জন্য তার ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ ভালো লাগছিল । আমরা এখানে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম ।

নদীর উপর জাহাজ চলা
ডায়মন্ড হারবার জায়গাটা হুগলী নদীর ধারে । বৃটীশ আমলে যখন হুগলী নদী দিয়ে জাহাজ চলাচল করত, তখন সমুদ্রে পড়ার আগে এখানে জাহাজ শেষবারের মতো বিশ্রাম নিত । এই অঞ্চলে হুগলী নদী প্রায় ৪.৫ কিলোমিটার চওড়া - খালি চোখে শুধু অন্যপারের সীমারেখাটা দেখা যায় আর ক্যামেরার জুম লেন্সের সাহায্যে অন্যপারের কিছু কারখানার চিমনি ইত্যাদি দেখা যায় । অন্যপারটা হল পূর্ব মেদিনীপুর জেলা । হুগলী নদী ধরে ডায়মন্ড হারবার থেকে উত্তর দিকে গেলে রায়চক্‌ আর আরও উত্তরে গেলে গঙ্গা আর রূপনারায়ণের মিলনস্থল যার তিন পাড়ে তিনটে ছোট ছোট ট্যুরিস্ট স্পট - নূরপূর, গাদিয়াড়া আর গেঁওখালি । (এই তথ্যগুলো সাধারণ জ্ঞান বাড়ানোর জন্য দিচ্ছি, এর আর কোনও উদ্দেশ্য নেই বা আমাদের ডায়মন্ড হারবার ভ্রমণের সঙ্গেও বিশেষ সম্পর্ক নেই)

পিকনিক স্পট
ডায়মন্ড হারবারের একটা প্রধান খ্যাতি হল পিকনিক স্পট হিসেবে । শীতকালে যখন পিকনিকের সিজ্‌ন চলে, তখন ছুটির দিনে এখানে পিকনিক স্পটে জায়গা পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে । আমরা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির শোভা উপভোগ করছিলাম, সেইসব জায়গাই লোকে গিজগিজ করে । আপাতত কিছু ছাগল, কিছু লোক্যাল ছেলে ছোকরা আর আইসক্রিমওয়ালা ছাড়া বিশেষ কেউ নেই । আমরা আইসক্রিমওয়ালার কাছ থেকে আইসক্রিম খেলাম ।

আর কিছু দেখার নেই, তাই ঘরে ফেরার পথে পা বাড়ালাম । ফেরার সময়েও একই রাস্তা আর সেই রাস্তা ধরে বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বাড়ি !

সারসংক্ষেপ ঃ

১. কলকাতার দক্ষিণে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায় ডায়মন্ড হারবার । কলকাতা থেকে দূরত্ব ৬০ কিলোমিটারের মতো ।
২. কলকাতার বিভিন্ন জায়গা থেকে ডায়মন্ড হারবার যাওয়ার প্রচুর বাস পাওয়া যায় । তাছাড়া শিয়ালদহ থেকে প্রত্যেক এক ঘন্টা অন্তর ডায়মন্ড হারবার লোক্যাল পাওয়া যায় যাতে করে ডায়মন্ড হারবার যেতে পৌনে দু'ঘন্টা মতো লাগে । ডায়মন্ড হারবার স্টেশন থেকে নদীর ধারের দূরত্ব অতি সামান্য যা অনায়াসে হেঁটেই যাওয়া যায় ।
৩. ডায়মন্ড হারবারে প্রচুর সংখ্যক খাবার হোটেল আর রেস্ট্যুরেন্ট আছে যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন বিভাগের সাগরিকা উল্লেখযোগ্য । এখানকার খাবারের মান বেশ ভালো এবং দামও বেশি নয় ।
৪. ডায়মন্ড হারবারে রাত্রিযাপনের খুব একটা মানে হয় না, তবে থাকতে চাইলে পূর্ণিমার রাতে থাকা শ্রেয় আর নদীর ধারের কোনও হোটেল বা রিসর্টে থাকতে পারলে ভালো । নদীর জলে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার প্রতিফলনের দৃশ্য চিত্তাকর্ষক হওয়া উচিৎ ।
৫. ডায়মন্ড হারবারে একটা পুরানো কেল্লার ভগ্নাবশেষ আছে যেখানে দেখতে গেলে শুধুই ভগ্ন - অবশেষ বিশেষ কিছুই নেই । এটা দেখতে যাওয়ার জন্য টাকা খরচ করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না ।
৬. এখানে একটা পরিত্যক্ত লাইট হাউস আছে যেটা দেখতে যাওয়া যেতে পারে । এছাড়া এখানে দেখবার সেরকম কিছুই নেই ।
৭. দুপুরের রোদের তেজ কমে যাওয়ার পর নদীর ধারে বসে থাকতে ভালো লাগবে । এখানে প্রায় ৫০০ মিটার নদীর পাড়ে বসার ব্যবস্থা করা আছে যা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় ।
৮. দুপুরের দিকে গেলে সূর্য্যাস্তের আগে ফিরে আসাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না । নদীর ওপরে সূর্য্যাস্তের দৃশ্য অবশ্যই দর্শনীয় ।

উপসংহার ঃ

ডায়মন্ড হারবার !
কলকাতা থেকে খুব কাছাকাছি ঘোরার জায়গা যেগুলো আছে, ডায়মন্ড হারবার তার মধ্যে বেশ বিখ্যাত এবং চর্চিত । পিকনিক স্পট হিসেবে বা সপ্তাহান্তে ঘুরতে যাওয়ার জায়গা হিসেবে ডায়মন্ড হারবারের কথা জানে না, এরকম বাঙালি পাওয়া কঠিন । কিন্তু সেইসঙ্গে আবার 'ডায়মন্ড হারবারে আবার দেখার কি আছে !' এরকম একটা উন্নাসিকতাও দেখা যায় অনেক লোকজনের মধ্যে । না, ডায়মন্ড হারবার কোনও ট্যুরিস্ট প্লেস নয় । এখানে 'ফাইভ পয়েন্ট', 'সেভেন পয়েন্ট' দেখার জায়গা নেই । এখানে যেটা আছে সেটাই এখানকার ইউ এস পি । চোখের সামনে দিগন্তবিস্তৃত ভাগীরথী-হুগলী নদী যে তার ২,৬০০ কিলোমিটারের যাত্রা শেষ করে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে মিলিত হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই । এই বিশালত্বের সামনে গিয়ে পড়লে একটা বিশেষ অনুভূতিটা হয় সেটা লিখে বোঝানো বেশ মুস্কিল । এই অনুভূতির টানেই গিয়ে পড়া । সৌন্দর্য্য দৃশ্যের উপর নির্ভর করে না, দর্শকের দৃষ্টির উপর নির্ভর করে - বহুল প্রচলিত এই প্রবাদটার সত্যতা ডায়মন্ড হারবারে গেলে উপলব্ধি করা যায় । খ্যাপা সারা পৃথিবী ঘুরে পরশপাথর খুঁজে ফেরে যেখানে সত্যিকারের হীরে আমাদের মুঠোর মধ্যেই পাওয়া সম্ভব !

ডায়মন্ড হারবার ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.