আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Thursday, October 10, 2019

কামারপুকুর জয়রামবাটী ভ্রমণ

ভ্রমণপথঃ

বুধবার ৯ই অক্টোবর, ২০১৯ঃ সকাল ৭ঃ৩০ মিনিটে কলকাতা - সকাল ১১ টা কামারপুকুর - কামারপুকুরে রাত্রিবাস
বৃহস্পতিবার ১০ই অক্টোবর ২০১৯ঃ সকাল ৯ টা কামারপুকুর - সকাল ১০ টা জয়রামবাটী - কোয়ালপাড়া - আনুড় - বিকেল ৫ঃ৩০ মিনিটে কলকাতা

ঠারো বছর বয়সে একজন মানুষ সাবালক হয় । আর তখন থেকেই সে নিজের জীবনের পথ নিজের মতো করে তৈরি করে নেওয়ার ছাড়পত্রও পায় । কিন্তু এই আঠারো বছর বয়স শুধু যে মানুষ বা অন্যান্য জীবের হয় তা নয়, প্রতিজ্ঞারও হয় । সেই প্রতিজ্ঞা যা একটা আঠারো বছরের ছেলে করেছিল আজ থেকে প্রায় আঠারো বছর আগের একটা সকালে ।

দিনটা ছিল ১০ই নভেম্বর, ২০০১ । কয়েকঘন্টা হল ছেলেটা শ্মশান থেকে ফিরেছে তার ভীষণ নিজের 'ঠাম্‌মা'কে দাহ করে । কোনও একটা অলিখিত নিয়মে দাদু-ঠাম্‌মার সঙ্গে নাতি-নাতনীদের আত্মিক বন্ধন সাধারণতঃ খুব গভীর হয় । আর এই ছেলেটার বড় হয়ে ওঠার পিছনে তার ঠাম্‌মার ভূমিকা অপরিসীম । ছেলেটার জীবনের ইমারত নির্মিতই হয়েছে ছোটবেলা থেকে ঠাম্‌মার তৈরি করা মূল্যবোধের ভিতের ওপর । 'নাতি' বলতে তিনিও অজ্ঞান ছিলেন, নাতিকে প্রাণাধিক ভালোবাসতেন, কিন্তু কখনও আস্কারা দিতেন না । সেই ঠাম্‌মা ৭৮ বছর বয়সে পড়ে গিয়ে পায়ের হাড় ভাঙলেন ২০০১ সালের আগস্ট মাসে । হাড় আর জোড়া লাগল না । মাসতিনেক শয্যাশায়ী থেকে অবশেষে ৯ই নভেম্বর সন্ধ্যেবেলা চলে গেলেন । রেখে গেলেন একমাত্র ছেলে, ছেলের বউ, আদরের নাতি আর - একটা অতৃপ্ত ইচ্ছেকে । এই ইচ্ছেটা ওনার নিজের ভাষাতেই লিখছি - "একবার জয়রামবাটী-কামারপুকুর দেখে আসব ।" শ্মশান থেকে ফিরে এসে ছেলেটা প্রতিজ্ঞা করল ঠাম্‌মাকে সে জয়রামবাটী-কামারপুকুর দেখাতে নিয়ে যাবে ।

দেহের মৃত্যু হয়, আত্মার হয় না । ঠাম্‌মাও কোনওদিনই তাঁর আদরের নাতির থেকে দূরে যেতে পারবেন না, তাই ঠামমাকে ঘোরানোর জন্যই ছেলেটা কামারপুকুর-জয়রামবাটী যাওয়ার পরিকল্পনা করল । সঙ্গে থাকল মা-বাবা, স্ত্রী অমৃতা, কথা-কলি আর বড়মাসি ।

আমি আমার কোনও লেখা কখনও কাউকে উৎসর্গ করিনি । আজ করতে ইচ্ছে করছে । তোমার জন্য আমার বড় হয়ে ওঠাটা এত সুন্দর । তোমার কাছে শেখার ফলে নিজের হাতের লেখা নিয়ে আজও আমার গর্ব আছে । তোমার কাছেই প্রথম আঁকা শেখা । ইস্কুলের সব গল্পের তুমিই অক্লান্ত শ্রোতা । আজ ব্লগ লেখার সুবাদে যেটুকু লিখতে পারি, সেটা তোমার কাছ থেকেই শেখা । কামারপুকুর-জয়রামবাটী তোমার জন্যই যাওয়া । তাই এই ভ্রমণ আর ভ্রমণকাহিনী - তোমাকেই উৎসর্গ করছি ।

বৃষ্টিভেজা পথে
৯ই অক্টোবর, ২০১৯ বুধবার - তিথি হিসেবে দেখতে গেলে দুর্গাপুজোর একাদশী । সকাল সাড়ে সাতটার সময়ে আমরা আমাদের গাড়ি নিয়ে বেরোলাম । বলা বাহুল্য, চালক আমি । কলকাতা থেকে যেতে গেলে কামারপুকুর আগে পড়ে আর তার দূরত্ব একশ' কিলোমিটারের মতো । যেতে ঘন্টাতিনেকের বেশি লাগার কথা নয়, তবে আমাদের একটা ঘুরে যেতে হবে কারণ বড়মাসিকে তার বাড়ি থেকে তুলতে হবে । রাস্তা মোটামুটি জানাই ছিল আর সেইসঙ্গে Google Map এর সাহায্য নিয়ে যেতে কোনও অসুবিধেই হল না । যাওয়ার পথে যেটা উপরি পাওনা সেটা হল তুমুল বৃষ্টি যেটা লঙ-ড্রাইভে একটা অসাধারণ উপভোগ্য জিনিস । রাস্তার দু'পাশে কখনও শহর, কখনও শহরতলী, কখনও গ্রাম আর কখনও শুধু ধানক্ষেত - এইসবের মাঝখান দিয়ে বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালিয়ে যেতে দুর্দান্ত লাগছিল ।

প্রাতঃরাশ বিরতি
গাড়ি প্রথমবার থামল ব্রেকফাস্টের জন্য আরামবাগ পৌঁছনোর কিছুটা আগে । দোকানটার নাম 'কৈলাশ হোটেল ও গেস্ট হাউস' ।  নামটা এইজন্যই উল্লেখ করলাম যে এখানকার খাবার বেশ ভালো এবং দামও খুব বেশি নয় । আর সেইসঙ্গে ভালো মালিকের আতিথেয়তা । আমরা এখানে পাঁউরুটি আর ওমলেট খেয়ে নিলাম । কামারপুকুর যাওয়া আসার সময়ে চাইলে এখানে খাওয়াদাওয়া করে নেওয়া যেতে পারে । রেস্টুরেন্টের যোগাযোগের নম্বর - ৭০০১৮২৩৯৪৪ ।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য এই দোকানে মাত্র কয়েকদিন আগে এসেছিলেন স্বয়ং পি সি সরকার (জুনিয়র) । এখানে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেন এবং খাওয়াদাওয়া করেন । হোটেলের মালিক স্বাভাবিকভাবেই ওনার সঙ্গে সপরিবারে ছবিটবি তোলেন । পি সি সরকার ওনাকে যাওয়ার আগে কয়েকটা ম্যাজিক শিখিয়ে দিয়ে যান যার একটা উনি আমাদের দেখালেন । ওনার হোটেলে ঢোকার আগে আমাদের পকেটে যা টাকা ছিল, সবাই মিলে ব্রেকফাস্ট করে বেরোনোর পরে দেখলাম তার থেকে ২৬৫/- টাকা কম আছে !

এখান থেকে কামারপুকুর আরও ২০ কিলোমিটারের মতো রাস্তা আর আমাদের পৌঁছতে লাগল আরও চল্লিশ মিনিট । সকাল এগারোটা নাগাদ পোঁছে আমাদের প্রথমেই যে কাজটা করতে হল সেটা হচ্ছে রামকৃষ্ণ মিশনের ভোগের টিকিট সংগ্রহ করা । ভোগের মূল্য মাথাপিছু ৪০/- টাকা । যদি মঠে ভোগ খাওয়ার ইচ্ছে থাকে তাহলে সাড়ে এগারোটার মধ্যে এই টিকিট সংগ্রহ করতে হবে । আমরা টিকিট কাটার পরে সুবিশাল হলঘরে ঢুকে খেতে বসলাম । এখানে ছেলে আর মেয়েদের আলাদা বসার ব্যবস্থা ।

খাবারের বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছি না আর ভোগের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেই বলছি, এখানকার খাবার অতি অখাদ্য ! নিরামিষ রান্না কিন্তু সেটা আমার অপছন্দের প্রধান কারণ নয় । চাইলে নিরামিষ রান্নাও একটা পর্যায় পর্যন্ত্য সুস্বাদু করা সম্ভব । কিন্তু এদের খাবার খেয়ে মনে হয় এরা যেন চেষ্টা করেই রান্নাটা অখাদ্য খেতে করে । রাস্তার ধারের যেকোনও সাধারণ ভাতের হোটেলে এদের থেকে সুস্বাদু রান্না করতে পারে ।

পরমপুরুষ হোটেলের ঘর
খাওয়া (বা বলা ভালো আবর্জনা দিয়ে গর্ত বোজানো) শেষ করে আমরা গেলাম আমাদের 'হোটেল পরমপুরুষ'-এ । পীক সিজন্‌ না হলে এখানে হোটেল আগে থেকে বুকিং না করে গেলেও চলে । মঠ অফিসের একজন ভদ্রলোকের কাছ থেকে আমরা এই হোটেলের সন্ধান পেলাম । মঠ থেকে গাড়িতে মিনিট পাঁচেক, হেঁটে গেলেও দশমিনিটের বেশি লাগার কথা নয় । হোটেলটা বেশ ভালোই । আমরা দু'টো ডাবল বেড ঘর নিলাম । ভাড়া ঘরপিছু ৫০০/- টাকা ।

সত্যি বলতে কি, পরমপুরুষ হোটেলকে হোটেল না বলে বাড়ি বলাই ভালো । বাড়ির মালিক নিজে থাকেন একতলায় আর দোতলা, তিনতলাটা হোটেল হিসেবে ভাড়া দেন । ঘরগুলো বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, বাথরুমে গিজার সবই আছে । আমরা দুপুরে ঘরে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নিলাম । তারপর বিকেল চারটে নাগাদ বেরোলাম ।

যারা জানে না তাদের জন্য বলছি , কামারপুকুর হল শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জন্মস্থান । আর জয়রামবাটী সারদামণির জন্মস্থান । এখানে একটা কথা লেখা দরকার বহু মানুষকে বিভিন্নসময়ে দেখেছি শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে 'ঠাকুর' আর সারদামণিকে 'মা' বলে সম্বোধন করতে । আমি কিন্তু এটা করি না আর তাই আমার লেখায় শ্রীরামকৃষ্ণকে 'শ্রীরামকৃষ্ণ' বা কখনও কখনও 'রামকৃষ্ণ' বলেই উল্লেখ থাকবে । একইভাবে সারদামণিকে আমি 'সারদা মা' বা কখনও কখনও শুধু 'সারদা'ও লিখব । এতে কারুর ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত লাগলে আমি আমার হৃদয়ের অন্তরতম বিন্দু থেকে তাদের জানাচ্ছি যে - আমার তাতে কিচ্ছু এসে যায় না । স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণের অনুরাগীদের বলেছিলেন - আপনারা ওনাকে (রামকৃষ্ণকে) মানুষই থাকতে দিন, দয়া করে ওনাকে ভগবান বানাবেন না !

কামারপুকুর ভ্রমণঃ

কামারপুকুর মঠের ঠিক উল্টোদিকে বেশ বড় একটা পার্কিং লট আছে, সেখানে গাড়ি রেখে মঠের ভিতরে ঢোকা যায় । মঠের খোলাবন্ধের সময় নিম্নরূপ -
এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর ঃ ভোর ৫ঃ৩০ থেকে বেলা ১১ঃ৩০ পর্যন্ত্য ও বিকেল ৪ টে থেকে রাত ৮ঃ৩০ পর্যন্ত্য ।
অক্টোবর থেকে মার্চ ঃ সকাল ৬ টা থেকে বেলা ১১ঃ৩০ পর্যন্ত্য ও বিকেল ৩ঃ৩০ থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত্য ।
আমরা মঠের ভিতরে ঢুকে দেখা শুরু করলাম । এখানে ভিতরে ফোটো তোলা বারণ, সেটা বিভিন্ন জায়গায় লেখা আছে আর সেইসঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীরা সেই বিষয়ে কড়া নজর রাখে । এরকম পরিস্থিতিতে কিছু লোকজনের লুকিয়ে চুরিয়ে ছবি তোলার অভ্যেস থাকলেও সেটা আমার নেই, তাই এই লেখার সঙ্গে ভিতরের ছবি দেওয়া গেল না ।

শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের গেটের ঠিক ভিতরে
শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ - মঠের মেইন গেট দিয়ে ঢুকে ভিতরে ঢোকার সময়ে একটা আমগাছ দেখা যায়, যেটা শ্রীরামকৃষ্ণের লাগানো । এই গাছ বেঁচেও আছে  আর ফলও দেয় । এটা এখন মানুষের কাছে একটা ধর্মীয় জিনিস, এর গায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করে লোকজন পুণ্য সঞ্চয় করে । মঠ কর্তৃপক্ষ তাই এর পাশে একটা লোহার জাল লাগিয়ে দিয়েছে যেটা ভেদ করে গাছের গায়ে হাত দেওয়া কিঞ্চিৎ কষ্টসাধ্য ।

ভিতরে দ্বিতীয় দ্রষ্টব্য হল রামকৃষ্ণের মন্দির । এই মন্দিরে রামকৃষ্ণের মূর্তি আছে । এই জায়গাটার বৈশিষ্ট্য হল আজ থেকে ১৮৩ বছর আগে ঠিক এই জায়গাতেই শ্রীরামকৃষ্ণ জন্মেছিলেন । এই জায়গাটা সেইসময়ে ছিল ওনাদের বাড়িরই একটা অংশ ।

এই মন্দিরের সঙ্গে প্রায় লাগোয়া রামকৃষ্ণের বাড়ি । আগেকার দিনে গ্রামবাংলায় যেরকম বাড়ি দেখা যেত, একেবারে সেই জিনিস । খড়ের চাল দিয়ে ঢাকা মাটির কুঁড়েঘর । এরকম কয়েকটা কুঁড়েঘর আর মাঝখানে উঠোন নিয়ে ছিল রামকৃষ্ণের পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি । এখানে রামকৃষ্ণের ঘর আর ওনার দাদার ঘর ছাড়াও দেখা যায় ওনাদের গৃহদেবতা রঘুবীরের মন্দির । শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরটাকে বর্তমানে বইপত্র রাখার কাজে ব্যবহার করা হয় আর ভিতরে সাধারণ দর্শনার্থীদের ঢুকতে দেয় না । আমরা বাইরে থেকে দেখে চলে এলাম ।

মঠের ভিতরে এছাড়া দেখা যায় মঠ কার্যালয়, কিন্তু সেখানে দেখার কিছু নেই । এটা বাদ দিয়ে আর একটা জিনিসই দেখার ছিল সেটা হল যুগি শিবের মন্দির । যুগিবংশীয় রামানন্দ যুগি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । এর বৈশিষ্ট্য হল শ্রীরামকৃষ্ণ জন্মানোর আগে নাকি ওনার মা চন্দ্রামণি দেবী এই শিবের থেকে স্বপ্ন পান ইত্যাদি ইত্যাদি । আমি সেইসমস্ত গপ্প এখানে বিস্তারিত লিখছি না, যদি জানার ইচ্ছে থাকে কামারপুকুর সম্পর্কে ইন্টারনেটে একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে । আর খুব ইচ্ছে থাকলে কামারপুকুর চলে যাওয়াই হবে উপযুক্ত কাজ !

হালদার পুকুর
হালদার পুকুর - সন্ধ্যে হয়ে আসছিল আর মঠের ভিতরে আর কিছু দেখারও নেই, তাই আমরা বেরিয়ে এলাম । মঠের গেটের ঠিক উল্টোদিকে একটা পুকুর আছে, সেটার নাম হালদারপুকুর । এই পুকুরে রামকৃষ্ণ চান করতেন । পুকুরটার একটা বৈশিষ্ট্য হল এর আকৃতি চৌকো, সাধারণতঃ এরকম আকারের পুকুর খুব একটা দেখা যায় না । আমরা পুকুরের পাশে কিছুক্ষণ বসে ছবি টবি তুলে চলে এলাম ।

কামারপুকুরে আরও কয়েকটা জায়গা আছে, সেগুলো গাড়ি করে দেখা সম্ভব নয় । তার কারণ একেকটা জায়গা এমনই সরু গলির মধ্যে যে সেখানে গাড়ি ঢুকবে না । কোনও জায়গাই বিশাল কিছু দূর নয় যে হেঁটে ঘোরা অসম্ভব, তবে সঙ্গে বাচ্চা বা বয়স্ক লোক থাকলে সেটা না করাই ভালো । মঠের গেটের সামনে টোটো পাওয়া যায় যারা এই সবক'টা জায়গা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেয় । ভাড়া ১০০ টাকা । আমাদের দলে পাঁচজন বড় আর দু'জন বাচ্চা তাই আমাদের একটা টোটোতেই হয়ে গেল ।

লক্ষ্মণ পাইনের বাড়ির লাগোয়া মন্দির
লক্ষ্মণ পাইনের বাড়ি - টোটো প্রথমে আমাদের নিয়ে গেল লক্ষ্মণ পাইনের বাড়ি । এই বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ ছোটবেলায় যেতেন । এখানে রামায়ণ - মহাভারত ইত্যাদি পাঠ হত আর সেখানে রামকৃষ্ণ ভাবাবেশে উপস্থিত হতেন (এটা এই বাড়ির গায়ে লেখা আছে) । এই বাড়ির লাগোয়া একটা মন্দির গোছের আছে, পাঠ সেখানেই হত ।




দুর্গাদাস পাইনের বাড়ি - লক্ষ্মণ পাইনের বাড়ি থেকে ফেরার পথে টোটোওয়ালা আরেকটা বাড়ি দেখালো, সেটা দুর্গাদাস পাইনের । কামারপুকুরে এসে রামকৃষ্ণের পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় প্রথম কিছুদিন এনার বাড়িতেই বাস করেন । এই বাড়িতে এখন দুর্গাদাস পাইনের বংশধররা থাকেন বলে এই বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখা যায় না ।

লাহাবাবুদের মন্দির
লাহাবাবুদের বিষ্ণুমন্দির - এরপর লাহাবাবুদের বিষ্ণুমন্দির । ধর্মদাস লাহা ছিলেন এই বাড়ির মালিক । এনার সঙ্গে ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল । এই মন্দিরটা দোতলা । এর নিচে বিষ্ণুর মন্দির আর উপরে দুর্গার মন্দির ।














রামকৃষ্ণের পাঠশালা
রামকৃষ্ণের পাঠশালা - লাহাবাবুদের বিষ্ণুমন্দিরের লাগোয়া হল পাঠশালা যেখানে রামকৃষ্ণ পড়তে যেতেন । রামকৃষ্ণ নাকি পাঠশালায় পড়তে না গিয়ে এই মন্দিরে এসে মা-কালীর মূর্তি আঁকতেন আর ধ্যান করতেন (খুবই অমনোযোগী ছাত্র ছিলেন আর কি !)। মন্দিরের লাগোয়া পাঠশালাটা বেশ সুন্দর । পাঠশালা জিনিসটা সাধারণতঃ সিনেমাতেই দেখেছি, সত্যিকারের পাঠশালা কেমন দেখতে হয় সেটা আগে কখনও দেখিনি । বেশ ভালোই লাগছিল । পাঠশালার ঠিক পাশে একটা রাসমন্দির আছে যেখানে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি রয়েছে ।

গোপেশ্বর শিবমন্দির
গোপেশ্বর শিবমন্দির - এরপর পথে পড়ল গোপেশ্বর শিবমন্দির । এখানে আমরা নামিনি, টোটোওয়ালা মন্দির দেখিয়ে বলল এখানে রামকৃষ্ণের মা চন্দ্রামণি দেবী আসতেন । আমরা এগিয়ে চললাম ।








ভবতারিণী মন্দির
ভবতারিণী মন্দির - পরবর্তী গন্তব্য ভবতারিণী মন্দির । রামকৃষ্ণের জন্মদাত্রী ধাইমা ধোনী কামারনির মন্দির যিনি তৈরি করেন, সেই রাধাচরণ দাসের ঠাকুরবাড়ি হল এই ভবতারিণীর মন্দির ।














ধোনী কামারনির মন্দির
ধোনী কামারনির মন্দির ও বাড়ি - এরপর ধোনী কামারনির মন্দির এবং তাঁর বাড়ি । আগেই বলেছি ধোনী কামারনি ছিলেন রামকৃষ্ণের ধাইমা । সেইসঙ্গে উপনয়ন (পৈতে)-এর সময়ে তিনি রামকৃষ্ণের ভিক্ষামা-ও ছিলেন । ধোনী কামারনি ছিলেন অব্রাহ্মণ আর সেইযুগে অব্রাহ্মণদের ভিক্ষামা হওয়া ছিল রীতিবিরুদ্ধ (সেই নিয়ম আজও অপরিবর্তিত আছে)। কিন্তু রামকৃষ্ণ চেয়েছিলেন তাঁর জন্মদাত্রী ধাইমা-ই তাঁর ভিক্ষামা হোন । রামকৃষ্ণের দাদা রামকুমার এর তীব্র বিরোধিতা করলেও শেষপর্যন্ত্য রামকৃষ্ণেরই জয় হয় । অব্রাহ্মণ ধোনী কামারনি হয়ে যান রামকৃষ্ণের ভিক্ষামা ।

যাঁরা রামকৃষ্ণকে 'ঠাকুর' বলে সম্বোধন করেন আর তাঁর তথাকথিত অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ শুনে অশ্রুবিগলিত হয়ে পড়েন, তাঁদের মধ্যে এরকম কতজন আছেন যাঁরা তাঁদের নিজেদের বা পরিচিতদের পরিবারে এরকম একটা আবহমানকাল ধরে চলে আসা অবান্তর নিয়মের বিরোধিতা করে সেটাকে বন্ধ করতে পারেন ? বন্ধ করা তো দূরের কথা, করার সাহস দেখাতে পারেন ? তিনি রামকৃষ্ণ বলে এটা করতে পারেননি, করতে পেরেছিলেন বলে তিনি রামকৃষ্ণ । আমি তাঁকে এই কারণেই শ্রদ্ধা করি - এই কারণেই তিনি আমার কাছে ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব !

'কামারপুকুর'
কামারপুকুর - এরপর আমরা গেলাম 'কামারপুকুর' দেখতে । এটা একটা পুকুর আর এই পুকুরের নামেই গ্রামের নাম । পুকুরটার কোনও আলাদা বৈশিষ্ট্য নেই, এখনও এর জল স্বাভাবিক জনজীবনে ব্যবহার হয় । রাতের অন্ধকারে আমরা পুকুরটা বিশেষ দেখতে পেলাম না, তাই পরেরদিন সকালে গেলাম আরেকবার দেখতে । পরেরদিন সকালে তোলা ছবিটাই এখানে লেখার সঙ্গে দেওয়া হল ।

চিনু শাঁখারির বাড়ির পাঁচিল
চিনু শাঁখারির বাড়ি - আমাদের শেষ গন্তব্য চিনু শাঁখারির বাড়ি । এই ব্যক্তিই নাকি রামকৃষ্ণকে প্রথমবার ঈশ্বররূপে দেখতে পান । রামকৃষ্ণ এনাকে বলেন ব্যাপারটা গোপন রাখতে কিন্তু সে চতুর্দিকে সেটা রাষ্ট্র করে বেড়ায় । এরফলে রামকৃষ্ণের অভিশাপে (যদিও অভিশাপ জিনিসটা রামকৃষ্ণের ভাবমূর্তির সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না) সে নির্বংশ হয়ে যায় । এই কারণে চিনু শাঁখারির বাড়ি আজ আর নেই, বাড়ির এলাকাটা মঠের সম্পত্তি আর তারা এটা পাঁচিল দিয়ে ঘিরে রেখেছে । এই জায়গাটাও আমরা রাতের অন্ধকারে ভালোভাবে দেখতে পাইনি, পরেরদিন সকালে আবার দেখলাম ।

আমাদের কামারপুকুর দেখা শেষ । টোটো আমাদের মঠের সামনে নামিয়ে দিল । আমরা সন্ধ্যের টিফিনের জন্য কিছু খাবার কিনে হোটেলে ফিরে এলাম । আমাদের হোটেলে গাড়ি রাখার কোনও জায়গা নেই, এইজাতীয় হোটেলে সেটা আশা করাও ঠিক নয় । হোটেলের মালিকের পরামর্শে আমরা গাড়ি রাখলাম হোটেল থেকে অনতিদূরে রাস্তার পাশে একটা ফাঁকা জায়গায় ।

রাতের রুটি আর ডিমের কারি হোটেল থেকেই নেওয়া হল আর বাইরে থেকে আনা চিকেন কারি ছিল । সবমিলিয়ে ডিনারে খরচ হল ২৯০ টাকা ।

হোটেলের ছাদ থেকে দৃশ্য
১০ই অক্টোবর, ২০১৯ বৃহস্পতিবার । সকালে ঘুম থেকে উঠে চানটান করে রেডি হয়ে নিলাম । আমাদের হোটেলের ছাদটা খুব সুন্দর, সেখান থেকে আশেপাশে অনেকদূর পর্যন্ত্য দেখা যায় । এখানে পাশদিয়েই একটা রেললাইন গেছে, যদিও সেটা এখনও অসম্পূর্ণ তাই সেখান দিয়ে কোনও ট্রেন যায় না । কামারপুকুর হাওড়া-তারকেশ্বর-আরামবাগ লাইনে পড়ে, সেই পথেই এখানে ট্রেনে আসা যায় ।


সকাল ন'টা নাগাদ হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম । যাওয়ার পথে কামারপুকুর আর চিনু শাঁখারির বাড়িটা আরেকবার দেখে নিলাম ।

মানিক রাজার প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ
মানিক রাজার প্রাসাদ - কামারপুকুর থেকে আমাদের গন্তব্য জয়রামবাটী । কামারপুকুর থেকে জয়রামবাটীর দূরত্ব ৫.৫ কিলোমিটারের মতো তবে পথে আরেকটা দেখার মতো জায়গা আছে । সেটা হল মানিক রাজার প্রাসাদ । কামারপুকুর থেকে কামারপুকুর-জয়রামবাটী রোড ধরে ১.৫ কিলোমিটার মতো গিয়ে একজায়গায় মেইন রোড ছেড়ে একটা মাটির রাস্তা ধরে ৭০০ মিটার মতো গিয়ে একজায়গায় আমরা গাড়ি রাখলাম । এই মাটির রাস্তাটা একেক জায়গায় বেশ সরু আর বর্ষার সময়ে কাদা থাকলে এ'পথে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো । গাড়ি একজায়গায় রেখে আমরা বাকি পথটা হেঁটে গেলাম মানিক রাজার প্রাসাদ দেখতে ।

মানিক রাজা ছিলেন এই অঞ্চলের জমিদার এবং একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি । এনার বাড়িতে রামকৃষ্ণের যাতায়াত ছিল । বাড়ি বলতে এখন আর কিছুই নেই, একটা বড় বাড়ির ভগ্নাবশেষ । তবে মাঠের মাঝখানে রাজবাড়ির মূলফটকটা আজও দাঁড়িয়ে আছে । জায়গাটা কোনওভাবে সংরক্ষণও করা হয় না, কাজের এর ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে পারলাম না ।

জয়রামবাটী ভ্রমণঃ

মানিক রাজার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা ধরলাম জয়রামবাটীর পথ । রাস্তাটা বেশ সুন্দর আর রোদের তেজ সেরকম বেশি না থাকায় বেশ আরামদায়ক একটা অনুভূতি হচ্ছিল । সকাল প্রায় দশটা নাগাদ আমরা জয়রামবাটীতে পৌঁছলাম ।

জয়রামবাটীতেও কামারপুকুরের মতো একটা বড় পার্কিং লট আছে, সেখানে গাড়ি রেখে আমরা কচুরি-তরকারি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম । তারপর মিনিট পাঁচেক হেঁটে পৌঁছলাম মাতৃ মন্দিরে ।

জয়রামবাটীর মাতৃমন্দিরের বাইরে
মাতৃমন্দির - কামারপুকুরের মতো জয়রামবাটীতেও মাতৃমন্দিরের ভিতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ । জয়রামবাটীতে সারদা মা যেখানে জন্মগ্রহণ করেন, সেই জায়গায় মাতৃমন্দির তৈরি করা হয়েছে । ঠিক যে জায়গায় সারদা মা জন্মগ্রহণ করেন, সেখানে তাঁর একটা শ্বেতপাথরের মূর্তি রয়েছে । কামারপুকুরের মতো এখানেও সেই মূর্তির সামনে একটা বেশ বড় হলঘরের মতো রয়েছে যেখানে বসে সবাই প্রার্থনা বা ধ্যান করতে পারে । আমরা মন্দিরটা কিছুক্ষণ ঘুরে বেরিয়ে এলাম ।

পুন্যিপুকুর - মাতৃমন্দিরের ঠিক সামনেই পুন্যিপুকুর । সারদা মা এই পুকুর ব্যবহার করতেন । পুকুরটা বিশাল বড়, এবং চারদিক রেলিং দিয়ে ঘেরা ।

নতুন বাড়ি - মাতৃমন্দিরের বাঁদিক দিয়ে কিছুটা হেঁটে গেলে একটা পাঁচিল ঘেরা জায়গার ভিতরে সারদা মায়ের নতুন বাড়ি । ১৯১৫ সাল থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত্য তিনি এখানে থাকতেন । রামকৃষ্ণের বাড়ির মতো এখানেও কয়েকটা খড়ের চাল দিয়ে ঢাকা মাটির কুঁড়েঘর আর একটা উঠোন রয়েছে ।

পুরনো বাড়ি - মাতৃমন্দিরের মূল ফটক থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে পড়ে সারদা মায়ের পুরনো বাড়ি । এখানে ১৯১৫ সালের আগে পর্যন্ত্য তিনি থাকতেন । নতুন বাড়ির মতো এখানেও খড়ের চাল দিয়ে ঢাকা কয়েকটা মাটির বাড়ি রয়েছে ।

জয়রামবাটী ভ্রমণ এখানে শেষ, আমাদের এখানে আর কিছু দেখার নেই । জয়রামবাটীর যেদিকে কামারপুকুর তার বিপরীত দিকে আরও ৭.৫ কিলোমিটার গেলে পড়ে কোয়ালপাড়া আশ্রম । জয়রামবাটী থেকে আমরা রওনা দিলাম এই আশ্রমের উদ্দেশ্যে ।

কোয়ালপাড়া আশ্রম
কোয়ালপাড়া আশ্রম - জয়রামবাটী থেকে কলকাতা আসার সময়ে এখানে সারদা মা বিশ্রাম করতেন । আমরা যখন এখানে পৌঁছলাম তখন বেলা ১১ঃ৫০ আর ততক্ষণে মন্দির বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । আমরা মন্দিরের ভিতরে ঢুকতে না পারলেও আশ্রমের ভিতরে ঢুকে কিছুক্ষণ কাটালাম । এখানে একটা সাইনবোর্ড থেকে জানতে পারলাম যে স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে এই আশ্রম বিশেষ ভূমিকা পালন করে । এই আশ্রমে সারদা মায়ের উদ্যোগ চরকা কেটে কাপড় বোনার কাজ শুরু হয় ।

আশ্রম থেকে বেরোনোর সময়ে দেখলাম এখানে একটা আমগাছ আছে, যেটা সারদা মায়ের আম খেয়ে ফেলে দেওয়া আঁটি থেকে তৈরি হয়েছে ।

এবার আমরা ফেরার পথ ধরলাম । ফেরার পথে আবার জয়রামবাটী আশ্রমের রাস্তা পড়ল । সেটা পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম । কামারপুকুর মঠ থেকে ১ কিলোমিটার দূরে আমরা বাঁদিকে ঢুকে গেলাম । এবারে আমাদের গন্তব্য আনুড় বিশালাক্ষী মন্দির ।

বিশালাক্ষী মন্দির
আনুড় বিশালাক্ষী মন্দির - কামারপুকুর-জয়রামবাটী রোড থেকে ২.৮ কিলোমিটার ভিতরে গেলে পড়ে আনুড় বিশালাক্ষী মন্দির । এই মন্দিরে রামকৃষ্ণ আসতেন । মন্দিরটা খুব একটা বড় নয় তবে চারপাশটা খুব সুন্দর । আমরা এখানে কিছুক্ষণ থেকে আবার ফেরার পথ ধরলাম ।





বিশালাক্ষী মন্দির থেকে বেরোলাম তখন দুপুর ১২ঃ৩০ । এখান থেকে আমরা ফেরার পথে আবার গেলাম 'কৈলাশ হোটেল ও গেস্ট হাউস' । আগেই ফোন করে লাঞ্চের অর্ডার দেওয়া ছিল, আমরা গিয়ে চিকেন কারি আর এগ কারি দিয়ে ভাত খেয়ে নিলাম । খরচ হল ৫৪৫/- টাকা ।

এরপর আর দাঁড়াইনি । যাওয়ার পথেই ফিরলাম আর ফেরার পথে বড়মাসিকে বাড়িতে নামিয়ে দিলাম । বিকেলে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন প্রায় সাড়ে পাঁচটা ।

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে শ্রীরামকৃষ্ণ আর সারদা মায়ের জন্মস্থান হুগলী জেলায় কামারপুকুর আর বাঁকুড়া জয়রামবাটী । কলকাতা থেকে গেলে কামারপুকুর প্রথমে পড়ে আর জয়রামবাটী পরে পড়ে ।
২. কলকাতা থেকে কামারপুকুর গাড়ি করে যাওয়া যায় । এছাড়া ধর্মতলা থেকে সরাসরি কামারপুকুর যাওয়ার জন্য বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি বাস আছে ।
৩. হাওড়া থেকে লোক্যাল ট্রেনে করেও কামারপুকুর যাওয়া যায় । কামারপুকুরের সবথেকে কাছের স্টেশন হল গোঘাট, সেখান থেকে টোটো বা ভ্যানে করে কামারপুকুর যাওয়া যায় ।
৪. গোঘাটের ট্রেন খুব কম, তাই আরামবাগ বা তারকেশ্বর লোক্যালে করে যাওয়া সুবিধেজনক । এই দুই স্টেশন থেকেই কামারপুকুরের বাস ছাড়ে ।
৫. কামারপুকুর আর জয়রামবাটী মন্দিরের খোলা-বন্ধের নির্দিষ্ট সময় আছে । সেইসময়মতো যাওয়াটাই শ্রেয় ।
৬. দুটো জায়গা ভালোভাবে দেখার জন্য একটা রাত এখানে থাকতে পারলে ভালো । তবে সেই সময় হাতে না থাকলে দুটো জায়গা একদিনেও দেখে নেওয়া যায় ।
৭. কামারপুকুরে থাকার জন্য এখানে কিছু কিছু হোটেল আছে যার মধ্যে 'পরমপুরুষ হোটেল' বেশ ভালো । এদের যোগাযোগ নম্বরঃ ৯৪৭৫৩৫৫৮৮৩ । এখানে খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলেও অনুরোধ করলে রান্না করে দেয় । এছাড়া মঠের কাছে খাবারের একাধিক দোকান আছে ।
৮. থাকার জন্য এখানে রামকৃষ্ণ মিশনের যাত্রীনিবাস আছে । তবে মিশনের লোকই জানাল সেটা সপরিবারে থাকার পক্ষে একেবারেই উপযুক্ত নয় । তাই পরিবারের লোকজন নিয়ে গেলে হোটেলই শ্রেয় ।
৯. কামারপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ প্রধান দেখার জায়গা । এছাড়া আশেপাশে আরও কতগুলো দেখার জায়গা আছে যেগুলো দেখার জন্য টোটো সবথেকে ভালো অপশন ।
১০. কামারপুকুর থেকে জয়রামবাটীর দূরত্ব ৭.৫ কিলোমিটারের মতো । দু'জায়গাতেই গাড়ি পার্কিং-এর সুবন্দোবস্ত আছে । টোটো বা বাসে করেও কামারপুকুর থেকে জয়রামবাটী যাওয়া যায় ।
১১. জয়রামবাটীতে মাতৃমন্দির ছাড়া আর সেরকম কিছু দেখার নেই । এখানেও খাবারের জন্য একাধিক দোকান আছে ।
১২. জয়রামবাটী থেকে অনতিদূরে কোয়ালপাড়া আশ্রম আছে । কলকাতা যাতায়াতের সময়ে এখানে সারদা দেবী বিশ্রাম করতেন । পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে এই আশ্রম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে ।
১৩. কামারপুকুরের খুব কাছে আনুড় বিশালাক্ষী মন্দির আছে । রামকৃষ্ণ ছোটবেলায় এখানে যাতায়াত করতেন ।

উপসংহারঃ

কামারপুকুর
ঈশ্বরে ভক্তি থাকুক বা না থাকুক, শ্রীরামকৃষ্ণ আর সারদা মাকে আস্তিক-নাস্তিক সকলেই বেশ পছন্দ করে এটা আমি বিভিন্ন সময়ে দেখেছি । আমার ধারণা এর প্রধান কারণ এনাদের অনাড়ম্বর জীবনযাপন আর সেইসঙ্গে মানুষের মধ্যে অবস্থান । শ্রীরামকৃষ্ণ একদিকে যেমন প্রচলিত আচার-বিচার মানতেন না, সেইসঙ্গে তাঁর মধ্যে খুব কঠিন তাত্ত্বিক কথা খুব সরলভাবে গল্পের মাধ্যমে বলতে পারার একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল । ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই তাঁর শিষ্য হতে পারত । এই সহজ-সরল মাটির স্বাভাবিক টানটা তাঁদের জন্মস্থানে গেলে আজও কিছুটা অনুভব করা যায় । হয়তো এই কারণেই মঠ বা অন্যান্য জায়গাগুলোর কোনওটাতেই ব্যবসায়িক লেনদেনের ব্যাপারটা একেবারেই চোখে পড়ে না । তাই ঈশ্বরের ভক্তদের কাছে ঈশ্বর, রামকৃষ্ণের ভক্তদের কাছে তাঁদের প্রিয় 'ঠাকুর', তীর্থযাত্রীদের কাছে তীর্থস্থান আর ভ্রমণপিপাসুদের কাছে দ্রষ্টব্যস্থল - সবধরনের মানুষের কাছে তাদের চাহিদাপূরণ করার জন্য দুই অনবদ্য পীঠস্থান কামারপুকুর আর জয়রামবাটী !

কামারপুকুর-জয়রামবাটী ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

Friday, May 31, 2019

মহিষাদল রাজবাড়ি ভ্রমণ

এ'কথা অনস্বীকার্য্য যে নির্ঝঞ্ঝাট সুষ্ঠু ভ্রমণের জন্য নিখুঁত পরিকল্পনার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে । আবার সেইসঙ্গে এটাও ঠিক যে কোনও কোনও ভ্রমণের মাধুর্য্য তার পরিকল্পনাহীনতায় । সেক্ষেত্রে একমাত্র সম্বল বেরিয়ে পড়ার একটা অদম্য ইচ্ছে । কিন্তু পরিস্থিতি, পারিপার্শ্বিকতা ইত্যাদি কয়েকটা শব্দ আমাদের জীবনে থাকেই, ফলে সেই বিধিনিষেধের বেড়াজালের বাইরে বেরোনো সমীচীনও নয়, অভিপ্রেতও নয় । যদি একান্তই বেরোতে হয়, ফেরার পথও খোলা রাখতে হয় । এই অবস্থায় 'ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া' যতদূর যাওয়া সম্ভব, ততদূর যাওয়াই অনুমোদনযোগ্য যাতে সন্ধ্যের আগে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসতে পারে ! এই কথাগুলো মাথায় রেখেই আমাদের এবারের ভ্রমণস্থল 'মহিষাদল রাজবাড়ি' । কলকাতা থেকে দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার - গাড়িতে ঘন্টা তিনেক ।

(আগের প্যারাগ্রাফের ভাষাটা আমার স্বাভাবিক ভাষা নয় । ঠিক যেরকম পরিকল্পনাবিহীন ভ্রমণও আমার স্বাভাবিক ভ্রমণ নয় । ওই ভাষা আর এই ভ্রমণ দু'টোরই অভিসন্ধি এক - স্বাদবদল ! যদি খটোমটো লাগে বা বুঝতে অসুবিধে হয়, দ্বিতীয়বার পড়ার দরকার নেই । ওই প্যারাগ্রাফে এমন কোনও দরকারী তথ্য নেই যেটা না পড়লে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে !)

শুক্রবার ৩১শে মে, ২০১৯ - সকাল দশটা নাগাদ বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে বেরোলাম আমি আর অমৃতা । কোনও পরিকল্পনা ছিল না, উদ্দেশ্য লঙ ড্রাইভে যাওয়া । তবে মহিষাদল রাজবাড়ি যাওয়া যেতে পারে, এরকম ভেবে রেখেছিলাম । জায়গাটা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হলদীয়া মহকুমার মধ্যে পড়ে এটা জানা ছিল, কিন্তু কোলাঘাটের পরে আর রাস্তা চিনতাম না । ভরসা গুগ্‌ল ম্যাপ । কোলাঘাট - মেচেদা পেরিয়ে ১১৬ নং জাতীয় সড়ক ধরে ২৭ কিলোমিটার মতো গেলে নন্দকুমার-এর মোড় । এখানে আমরা একটা বিরিয়ানির হোটেল থেকে লাঞ্চ সেরে নিলাম । বীফ্‌ বিরিয়ানি আর বীফ্‌ ভুনা । খরচ হল ১৬০/- টাকা । নন্দকুমার থেকে বাঁদিকে ঘুরে ৪ নং রাজ্যসড়ক হয়ে ৮ কিলোমিটার গেলে মহিষাদল রাজবাড়ি । আমরা পৌঁছলাম তখন দুপুর ১ঃ১৫ মিনিট ।

মহিষাদল রাজবাড়ির প্রধান প্রবেশপথ
মেইন গেটের বাইরে গাড়ি পার্কিং করে আমরা ভিতরে ঢুকলাম । এখানে ঢোকার টিকিট লাগে, মাথাপিছু ১০/- টাকা । ভিতরে একটা বিশাল জমির ওপর প্রকান্ড রাজবাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে । চন্দ্রকেতুগড়ের মতো এখানেও ঢোকার আগে জায়গাটা সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে রাখি । এই তথ্যের সূত্র মহিষাদল রাজবাড়ির দেওয়ালে লাগানো একটি সূচনা ।



মহিষাদল রাজপরিবারের বংশতালিকা
ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে উত্তর প্রদেশ থেকে জনার্দন উপাধ্যায় এই অঞ্চলে বাণিজ্য করতে এসে এখানে একটি জমিদারী কিনে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন । এই জনার্দন উপাধ্যায়ই মহিষাদল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা । তিনি মোঘল সম্রাট আকবরের সনন্দমূলে মহিষাদলাধিপতির স্বীকৃতি পান । পরবর্তীকালে জনার্দন উপাধ্যায়ের বংশধর মন্থরা দেবীর পুত্র গুরুপ্রসাদ গর্গ এই রাজবংশের রাজা হন । এই সময় থেকেই এই রাজবংশ উপাধ্যায়দের জায়গায় গর্গদের নামে হয়ে যায় । ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত্য এই গর্গ বংশ এখানকার রাজা ছিলেন । বর্তমানে এই বংশের বংশধররা কলকাতায় থাকেন এবং ব্যবসাবাণিজ্য করেন ।

এই রাজপরিবার এই অঞ্চলে বহু জনহিতকর কাজকর্ম করেছে । বিভিন্ন সময়ে এঁরা মোট তিনটি রাজবাড়ি তৈরি করেন । এগুলোর মধ্যে একটা অবলুপ্ত হয়ে গেছে, দ্বিতীয় 'রঙ্গীবসান রাজবাটী' নবাবদের আমলে তৈরি হয় । এটির অবস্থাও বর্তমানে খুব একটা ভালো নয় । তৃতীয় 'ফুলবাগ রাজবাটী' ইংরেজ আমলে তৈরি হয় আর এটাই পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত । এই রাজবাড়িতেই গর্গ পরিবার মহিষাদল রাজবাড়ির সংগ্রহশালাটি তৈরি করেছে ।

রাজবাড়িতে ঢোকার দরজা
ফটক দিয়ে ঢুকে আমরা প্রথমে গেলাম মূল বাড়িটাতে । বাড়ির ভিতরে জুতো খুলে ঢুকতে হয় । এগারো ধাপ সিঁড়ি উঠে (এটা তখন গুনিনি, পরে ছবি দেখে গুনেছি) বাড়ির ভিতরে ঢুকে সামনেই যে সুবিশাল হলঘরটা রয়েছে, সেটা যে এককালে বৈঠকখানা ছিল সে আর বলে দিতে হয় না । এই বৈঠকখানা ঘরের মধ্যে সোফা, শ্বেতপাথরের টেবিল, আলমারি ইত্যাদি অনেক আসবাবপত্র রয়েছে । উপাধ্যায় তথা গর্গ রাজবংশের অবস্থা যে বেশ উঁচুদরের ছিল, সেটা এখান থেকে ভালোই বোঝা যায় । এই ঘরের সামনে একজন ভদ্রলোক বসেছিলেন, যিনি বোধহয় এখানকার কেয়ারটেকার । ঢোকার সময়েই আমাদের বললেন সব ঘরের ভিতরেই ফোটো তোলা বারণ, তাই আমরা এখানে কোনও ছবি তুলিনি ।

বৈঠকখানা ঘর থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে গেলে বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে যে ঘরটা রয়েছে সেটাকে লাইব্রেরী ঘর বলা চলে । ঘরটা বিরাট বড় না হলেও এখানে বেশ কয়েকটা আলমারি রয়েছে আর সেগুলোয় বই ঠাসা । এর মধ্যে কোনও দুষ্প্রাপ্য বই আছে কিনা জানি না, তবে বইগুলো যে সযত্নেরক্ষিত সে'কথা বলা চলে না । হয়তো নিয়মিত ঝাড়পোঁছ করা হয়, কিন্তু সজ্জিতকরণের অভাব । এখানে আমাদের চেনাজানা কয়েকটা বইও দেখতে পেলাম ।

লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে পুবদিকের বারান্দা দিয়ে গেলে প্রথমে শিকারের ঘর । এখানে বিভিন্ন আকারের, বিভিন্ন ধরনের অনেকগুলো বন্দুক, রাইফেল, রিভলভার, পিস্তল ইত্যাদি রাখা রয়েছে । এর পাশের একটা ঘরে শিকার করা জানোয়ারদের মাথা, দেহ ইত্যাদি স্টাফ করে রাখা আছে । সেখান থেকে বেরোলে আরেকটা ঘরে একগাদা বাদ্যযন্ত্র রাখা আছে । সবমিলিয়ে দেখে বোঝা যায় যেকোনও বড় রাজপরিবারের মতো মহিষাদল রাজবাড়িতেও বিভিন্ন সময়ে সঙ্গীত, শিকার ইত্যাদির বিশেষ প্রচলন ছিল ।

বাড়ির পিছন দিকে একটা অপেক্ষাকৃত চওড়া বারান্দা । সেখানে একটা বিশাল শ্বেতপাথরের গোল টেবিল আর তার চারদিকে চারটে চেয়ার । চাইলে এখানে কিছুক্ষণ বসাও যেত, কিন্তু দু'টো চেয়ারে দু'জন লোক বসেছিল (বোধহয় বাড়ির দেখাশোনা করে), তাই আর বসলাম না । এনাদের জিজ্ঞেস করলাম দোতলায় দেখার কিছু আছে কিনা । উত্তরে জানলাম দোতলাটা সাধারণ লোককে দেখতে দেওয়া হয়না কারণ সেখানে বাসযোগ্য ঘর আছে আর গর্গ পরিবারের লোকজন এখানে এলে ঐ ঘরগুলোতেই থাকেন । একতলায় উত্তরপূর্ব কোণে একটা শোওয়ার ঘর আছে, আমরা সেটায় ঢুকলাম ।

ঘরটা বেশ বড়, প্রায় মাঝখানে একটা ছত্রিবিশিষ্ট খাট । খাটটা মেঝে থেকে বেশ কিছুটা উঁচু বলে ওঠার জন্য একটা রেলিংবিশিষ্ট কাঠের সিঁড়ি রয়েছে । বড় খাটটা ছাড়াও দেওয়ালের পাশে আরেকটা ছোট খাট আছে যেটা সম্ভবতঃ বাচ্চা শোওয়ানোর জন্য ব্যবহার হত । এছাড়া ঘরে একটা ড্রেসিং টেবিল, একটা আলমারি, একটা পিয়ানো ইত্যাদি রয়েছে ।

বারান্দায় রাখা পালকি
ঘর থেকে বেরিয়ে আমরা আবার বাড়ির সামনের দিকে চলে এলাম । আগেই দেখেছিলাম সামনের বারান্দায় একটা পালকি রাখা রয়েছে । এখানে ছবি তোলার কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই বলে এটার ছবি তুললাম ।







মহিষাদল রাজবাড়ির একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য অংশ হল বাড়ির সামনের বিশাল গোলাকৃতি বাগান । এখানে বেশ কিছু চেয়ার, বেঞ্চি ইত্যাদি রাখা রয়েছে । মে মাসের দুপুরে গরম যথেষ্ট, কিন্তু সেটা এখানে ততটাও লাগছিল না কারণ দিগন্তবিস্তৃত মাঠের ওপর দিয়ে খুব মনোরম হাওয়া দিচ্ছিল । বেশ বুঝতে পারছিলাম গরমকালে সন্ধ্যেবেলা আর শীতকালের দুপুরবেলা এখানে বসে থাকতে দিব্যি লাগবে । এই গোল বাগানটাকে ঘিরে আবার একটা ফুলের বাগান, সেখানে একাধিক গাছপালা রয়েছে । দেখে বোঝা যায় বাগানটার বেশ ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় ।

সতীপ্রসাদ গর্গের মূর্তি
বাড়ির দক্ষিণ দিকে মাঠের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা পথে কিছুটা গেলে একটা শ্বেতপাথরের মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়, সেটা রাজা সতীপ্রসাদ গর্গের । ১৯১৩ সালে ইনি ব্রিটীশ সরকারের কাছ থেকে 'রাজাবাহাদুর' খেতাব পান । মূর্তির নিচের ফলক থেকে জানলাম গর্গমশাই ২৭শে ডিসেম্বর ১৮৮২ থেকে ১৯শে মার্চ ১৯২৬ পর্যন্ত্য বেঁচেছিলেন ।











গোপাল জেউ মন্দির
আমাদের ফুলবাগ রাজবাটী দেখা শেষ, তাই আমরা হাঁটা লাগালাম রঙ্গীবসান রাজবাটীর দিকে । দুপুরবেলা পুরো এলাকায় বিশেষ লোকজন নেই, তাই খুঁজে পেতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছিল । একজন আইসক্রিমওয়ালার থেকে পথের হদিস জানতে পারলাম (হ্যাঁ, সেইসঙ্গে ম্যাঙ্গো স্টিক আইসক্রিমও খেলাম !)। হেঁটে যাওয়ার পথটা বেশ সুন্দর, একটা পুকুর, আমবাগান ইত্যাদি দেখা যায় । একেবারে গ্রাম আর কি ! যাওয়ার পথে একটা মন্দির পড়ে, সেটার নাম গোপাল জিউ মন্দির । মন্দিরের আদলটা একেবারে দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর মন্দিরের মতো । দুপুরবেলা মন্দিরের গেট বন্ধ, তাই বাইরে থেকে দেখেই খুশি থাকতে হল ।


পুরনো রাজবাড়ির সিংহদুয়ার
মন্দিরের সামনের রাস্তা ধরে আরও মিনিট তিনেক হাঁটলে পুরনো রাজবাড়িটা দেখতে পাওয়া যায় । বাড়ির চারদিকে লোহার ভারা আর টিনের পাঁচিল - দেখেই বোঝা যায় সংস্কারের কাজ চলছে । বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে গেলে বাড়ির প্রধান ফটক বা সিংহদুয়ার । এটার উপরের তলায় লোকজন থাকে । আমরা সিংহদুয়ার দিয়ে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবার ফুলবাগ রাজবাড়ির দিকে চলে এলাম কারণ আমাদের গাড়ি ওখানেই রাখা আছে ।

হেঁটে আসার পথে একটা ঘটনা ঘটল যেটা আমাদের দু'জনকেই খুব আপ্লুত করল । একজন ভদ্রলোক বরফ দেওয়া লেবুর সরবৎ বিক্রি করছিলেন । গরমের দুপুরের ঘন্টাদেড়েক হাঁটাহাঁটি করার পর এর থেকে উপাদেয় জিনিস আর হয়ই না । আমরা একগ্লাস করে খাওয়ার পরে তিনি নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলেন আমরা কোথা থেকে আসছি ইত্যাদি । তারপর ওনার ঝোলা থেকে একটা পাকা আম বের করে আমাদের দিলেন । এটা এখানকার আমবাগানের আম, অনুরোধ করলেন আমরা যেন বাড়ি গিয়ে সেটা খাই । ভদ্রলোককে বিদায় জানিয়ে আমরা চলে এলাম । এই আন্তরিকতা সচরাচর শহরাঞ্চলের অপরিচিত মানুষের মধ্যে দেখা যায় না, সেই বিষয়ে আমরা দু'জনেই একমত ।

এবার ফেরার পথ ধরলাম । যেপথে গিয়েছিলাম, আবার সেই পথেই ফিরে এলাম । ফেরার পথে আর কোথাও দাঁড়াইনি । সন্ধ্যে ছটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে গেলাম !

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে ডে-আউট ট্রিপে ঘোরার জন্য অন্যতম অপ্শ‌ন্‌ হল মহিষাদল রাজবাড়ি । পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হলদীয়া মহকুমার মধ্যে অবস্থিত এই রাজবাড়ি দেখার জায়গা হিসেবে বেশ সুন্দর ।
২. কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে মহিষাদল যেতে ঘন্টাতিনেক লাগে । এছাড়া হাওড়া স্টেশন থেকে হলদীয়া লোক্যালে সতীশ সামন্ত হল্ট স্টেশনে নেমেও এখানে যাওয়া যায় । স্টেশন থেকে টোটো বা রিক্সায় মহিষাদল রাজবাড়ি যেতে মিনিট পনেরো লাগে ।
৩. বর্তমানের প্রধান রাজবাড়িটা হচ্ছে সংগ্রহশালা । এখানে বিভিন্ন ঘরে বিভিন্ন দেখার জিনিস আছে ।
৪. মূল রাজবাড়ির কাছে একটা পুরনো রাজবাড়ি আছে যেটা বর্তমানে সংস্কার চলছে । সংস্কার হয়ে গেলে এটাও হয়তো একটা দেখার জায়গা হবে ।
৫. দুই রাজবাড়ির মাঝে একটা গোপালের মন্দির আছে । মন্দিরটা দুপুরবেলা বন্ধ থাকে, তাই বিকেলের দিকে গেলে মন্দির খোলা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে ।
৬. এখানে বছরের যেকোনও সময়েই যাওয়া যেতে পারে তবে বর্ষাকালটা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো । রাস্তাঘাট অনেকাংশেই মাটির, তাই বর্ষাকালে চলাচলের পক্ষে অনুকূল নাও থাকতে পারে ।
৭. রাজবাড়ির একেবারে কাছে কোনও দোকানপাট নেই । তবে মহিষাদল বাজার বা কলেজ এলাকায় বেশি কিছু দোকানপাট এবং সেইসঙ্গে খাবারের দোকান আছে ।

উপসংহারঃ

মহিষাদল রাজবাড়ি
রাজতন্ত্র জিনিসটা আমাকে চিরকালই বেশ আকর্ষণ করে । ইংরেজ আমল শুরু হওয়ার আগে প্রধানতঃ জমিদারদেরই রাজা বলা হত, এই মহিষাদল রাজবাড়ি সেরকমই একটা রাজবাড়ি । ব্রিটীশরা রাজাদের ক্ষমতা অনেকটাই কেড়ে নিলেও প্রজাবৎসল ভালো রাজার প্রতি প্রজাদের আনুগত্য তাতে কমেনি । আমরা এই রাজবংশের ইতিহাস যতটা জানতে পেরেছি, সেটা এঁদের নিজেদেরই প্রকাশ করা তাই তার থেকে কয়েনের ও'পিঠের ছবিটা দেখতে পাওয়া সম্ভব নয় । সত্যি বলতে কি, না পেলে বিশেষ কিছু আসে যায়ও না । রাজা নেই, রাজতন্ত্রও নেই কাজেই সেই রাজা কেমন ছিলেন সে'প্রশ্ন অবান্তর । যেটা ভালো লাগল যে এই বংশের বংশধররা আজও চেষ্টা করে যাচ্ছেন এই বংশের ইতিহাসকে ধরে রাখতে আর সেটা পর্যটকদের সামনে তুলে ধরতে । আর সেই চেষ্টায় প্রয়োজন পর্যটকদেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ । বিশাল কিছু দেখতে পাওয়ার প্রত্যাশা নয়, প্রয়োজন আমাদের খুব কাছে অবস্থিত প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো রাজপরিবারের কীর্তিকলাপ নিজের চোখে দেখার ইচ্ছে । আছে ? তাহলে আরে কি, বেরিয়ে পড়তে হবে !

মহিষাদল রাজবাড়ি ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

Tuesday, January 1, 2019

চন্দ্রকেতুগড় ভ্রমণ

মার ব্লগে আজ পর্যন্ত্য যতগুলো জায়গায় ঘোরা নিয়ে পোস্ট করেছি, তার মধ্যে চন্দ্রকেতুগড়ের নাম সবথেকে কম লোক শুনেছে এটা আমি হলফ্‌ করে বলতে পারি ! গড় শুনে কেল্লা বা ওইজাতীয় কিছু মনে হলেও জায়গাটা আসলে একটা ধ্বংসাবশেষ আর দেখার জন্য বেশি দূরেও যাওয়ার দরকার হবে না । কলকাতা থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বেড়াচাঁপা এলাকায় অবস্থিত এই জায়গা । নতুন বছরের প্রথম দিনে এখানে একটা ডে-আউট ট্রিপ দিয়ে শুরু করছি আমার ব্লগের এবারের পোস্ট ।

সঙ্গে থাকা খাবার
বছরের প্রথমদিন কোথায় যাওয়া যায় ? কয়েকদিন ধরে এই বিষয়ে ভাবছিলাম । ভিড়ের জন্য কলকাতার মধ্যে যেকোনও জায়গাতেই যাওয়া প্রায় অসম্ভব - ভিক্টোরিয়া, নিক্কো পার্ক, ইকো পার্ক এইসব জায়গায় এত ভিড় হয় যে একটা গেট দিয়ে একজন লোক ঢুকলে সেই ঠেলায় অন্য গেট দিয়ে আরেকজন লোক বেরিয়ে পড়ে ! শেষ পর্যন্ত্য মাথায় এল চন্দ্রকেতুগড়ের নাম । জায়গাটার সম্পর্কে বিশেষ কিছু ধারণা ছিল তা নয়, তবে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ার পক্ষে মন্দ নয় এটা জানা ছিল । সেইমতো সকাল দশটা নাগাদ আমি, অমৃতা, বাবা, মা, কথা, কলি আমাদের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম চন্দ্রকেতুগড়ের উদ্দেশ্যে । সঙ্গে থাকল রাস্তায় খাওয়ার মতো লুচি, আলুর দম, মোয়া, মিষ্টি । রাস্তায় বেরোলে এমনিতেই খিদে বেশি পায় আর যদি সঙ্গে এইসব লোভনীয় খাবার থাকে, তখন খিদে দমন করে রাখার মানে হয় না । তাই ঘন্টাখানেক চলার পরে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে খাবারগুলোর সদ্ব্যবহার করে ফেলা হল ।

গাড়ি পার্কিং করে ভিতরে ঢোকার আগে
কলকাতা থেকে চন্দ্রকেতুগড় যাওয়ার অনেকগুলো রাস্তা আছে । আমরা গিয়েছিলাম নিউটাউন হয়ে রাজারহাট মেইন রোড ধরে । একটু পরে সেই রাস্তার নাম বদলে হয়ে গেল খড়িবাড়ি রোড যেটা একসময়ে কলকাতা-বসিরহাট-টাকি রোডের (SH 2) সঙ্গে মিলিত হল । এই রাস্তা ধরে আরও ১০ কিলোমিটার চলার পরে বেড়াচাঁপার মোড় । সেখান থেকে বাঁদিকে ঘুরে হাড়োয়া রোড ধরে ১ মিনিট চললেই পোঁছনো যায় চন্দ্রকেতুগড়ে । আমরা পৌঁছলাম তখন দুপুর ১ টা ।

চন্দ্রকেতুগড়ের পাশে একটা ছোট মাঠে গাড়ি পার্কিং করে আমরা লোহার গ্রিল দেওয়া পাঁচিলের ভিতরে ঢুকলাম । টিকিটের কোনও প্রশ্ন নেই । ভিতরে ঢুকে কি দেখলাম সেটা লেখার আগে এখানকার সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে রাখি ।

খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০ থেকে ৩০০ শতকের মধ্যে প্রাক্‌মৌর্য্যযুগে চন্দ্রকেতুগড় নির্মিত হয় । এরপর কুষাণ বংশ, গুপ্ত বংশের পরে অবশেষে ১২০০ খ্রীষ্টাব্দে বাংলায় পাল-সেন বংশের শাসনকাল পর্যন্ত্য এর অস্তিত্বের কথা জানা যায় । কোনও কোনও ঐতিহাসিক মনে করেন চন্দ্রকেতুগড় আসলে ঐতিহাসিক শহর 'গঙ্গারিদাই' - যার কথা গ্রীক দার্শনিক টলেমি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'জিওগ্রাফিয়া'তে উল্লেখ করেছেন । এর থেকে অনুমান করা হয় এই শহরের সঙ্গে সেই যুগে রোমের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল ।

১৯০৭ সালে এখানকার ডাক্তার তারকনাথ ঘোষ প্রথম এই জায়গায় কিছু ঐতিহাসিক দ্রব্যের সন্ধান পান । তিনি তৎক্ষণাৎ ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের (আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ্‌ ইন্ডিয়া) কাছে বিষয়টি জানান । পুরাতত্ত্ব বিভাগ চন্দ্রকেতুগড়ে এসে কিছু না পেলেও এর দু'বছর পর স্বনামধন্য ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে এসে বেশ কিছু পোড়ামাটির জিনিস পান । এর অনেক পরে ১৯৫৬ সাল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালা চন্দ্রকেতুগড়ে প্রায় দশ বছর ধরে দীর্ঘ খননকার্য্য চালায় । তার ফলে ঐতিহাসিক যুগের বুদ্ধমূর্তি, পোড়ামাটির ফলক, শীলমোহর, মুদ্রা ইত্যাদি পাওয়া যায় । সেই সময়েই চন্দ্রকেতুগড়ের সম্পর্কে বেশিরভাগ তথ্য জানা যায় । এরপর ২০০০ সালে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ মাত্র এক বছরের জন্য এখানে খননকার্য্য চালায় । সেইসময়ে এখানে একটি  ইঁটের বহুকোণবিশিষ্ট উত্তরমুখী মন্দির ও একটি তোরণের উপস্থিতির কথা জানা যায় ।

চন্দ্রকেতুগড়ের নামকরণ নিয়েও অনেক মতান্তর আছে । স্থানীয় মানুষের মতে, এখানকার রাজা চন্দ্রকেতুর নামে এই জায়গার নাম চন্দ্রকেতুগড় কিন্তু বাংলার ইতিহাসে এই নামের কোনও রাজার উল্লেখ পাওয়া যায় না । তাই কোনও কোনও ঐতিহাসিক মনে করেন চন্দ্রকেতুগড় নাম হয়েছে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের নাম থেকে - গ্রীক ইতিহাসে যাঁকে বলা হয়েছে 'সান্দ্রোকোটাস' ।

পাঁচিলের ভিতরে চন্দ্রকেতুগড়ের অংশ
লোহার গ্রিলের ভিতরে যে জায়গাটা দেখা যায় সেটার বিবরণ দেওয়া ভারী কঠিন । সাধারণভাবে বলতে গেলে বিশাল চওড়া ইঁটের দেওয়াল আর তার মাঝেখানে সমতল জায়গা । সেইসব জায়গায় ঘাস গজিয়ে রয়েছে । দেওয়ালগুলো যাদের ঘিরে রয়েছে সেগুলো হয়তো কোনও সময়ে ঘর ছিল, আবার সেটা নাও হতে পারে । আমি ইতিহাসের ছাত্র নই, তাই কোনটা আসলে কি সেটা অনুধাবন করার ক্ষমতা আমার নেই । আর এখানে কোনও ফলকও নেই যার থেকে এগুলোর সম্পর্কে বিশেষ জানা যায় । তবে এটা ঠিক পুরো জায়গাটা হেঁটে ঘুরে দেখতে বেশ ভালো লাগে আর দেখতে বড়জোর আধঘন্টা লাগতে পারে । ১লা জানুয়ারী বলে এখানে কিছু লোকজন এসেছে আর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে খাওয়াদাওয়াও করছে । এরকম ঐতিহাসিক জায়গায় সাধারণতঃ পিক্‌নিক করার নিষেধাজ্ঞা থাকে কিন্তু এখানে সেটা পালন হচ্ছে কিনা দেখার মতোও কোনও লোক নেই । ব্যাপারটা বেশ অযত্নরক্ষিত এটা বলতেই হবে ।

খনা-মিহিরের ঢিপি
গড়ের একদিকে একটা উঁচু ঢিপি আছে যেটার নাম খনা-মিহিরের ঢিপি বা বরাহমিহিরের ঢিপি । এটা গড়ের সবথেকে উঁচু জায়গা । কথিত আছে এই ঢিপির উপরে গিয়ে দাঁড়ালে নাকি মূহুর্তের মধ্যে প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী হওয়া যায় ! (আমিও দাঁড়ালাম তবে যেহেতু আমি এমনিতেই একজন সবিশেষ জ্ঞানী ব্যক্তি, তাই নতুন জ্ঞানের আহরণটা বিশেষ অনুভব করলাম না । ইনফিনিটি + ইনফিনিটি = ইনফিনিটি !)


চন্দ্রকেতুগড়ের কাছাকাছির মধ্যে একটা 'চন্দ্রকেতুগড় সংগ্রহশালা' আছে কিন্তু সেটা আপাতত বন্ধ । আমাদের ঘোরা শেষ তাই আমরা চন্দ্রকেতুগড় থেকে বেরিয়ে পড়লাম । বেড়াচাঁপার মোড়ে এসে ডানদিকে বসিরহাট-কলকাতা রোডে না এসে হাড়োয়া রোড ধরে আরেকটু এগিয়ে গেলাম । এখানে কয়েকটা খাবারের দোকান আছে তারই মধ্যে 'নিউ আরসালান' থেকে বিরিয়ানি আর চিকেন চাপ খেয়ে নেওয়া হল । খরচ হল ৩০০/- টাকা ।

ফেরার সময়ে একই পথ ধরে ফিরে এলাম । বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বাড়ি !

সারসংক্ষেপঃ

১. ডে-আউট ট্রিপে ঘুরে আসার জন্য কলকাতা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ চন্দ্রকেতুগড় । খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০ শতকের প্রাক্‌ মৌর্য্যযুগ থেকে ১২০০ খ্রীষ্টাব্দের পাল-সেন বংশের রাজত্বকাল পর্যন্ত্য এই জায়গার অস্তিত্ব ছিল ।
২. কলকাতা থেকে গাড়িতে চন্দ্রকেতুগড় ঘন্টাদুয়েক লাগে । এছাড়া এস্‌প্ল্যানেড বা উল্টোডাঙা থেকে বেড়াচাঁপার বাস পাওয়া যায় যেটা করে বেড়াচাঁপার মোড়ে নামতে হয় । তাছাড়া শিয়ালদহ থেকে হাসনাবাদ লোক্যালে হাড়োয়া রোড স্টেশনে নেমেও চন্দ্রকেতুগড় যাওয়া যেতে পারে । স্টেশন থেকে এখানে যাওয়ার জন্য টোটো বা অটো পাওয়া যায় ।
৩. চন্দ্রকেতুগড় যাওয়ার আগে কিছুটা পড়াশোনা করে নিতে পারলে ভালো হয় । সেক্ষেত্রে এখানে গিয়ে দেখতে ভালো লাগবে ।
৪. বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই জায়গাটার রক্ষণাবেক্ষণ করে । তবে এখানে ঢুকতে কোনও টিকিট লাগে না বা নিরাপত্তারও কোনও ব্যবস্থা নেই ।
৫. পুরো জায়গাটা দেখতে সবমিলিয়ে আধঘন্টার বেশি লাগার কথা নয় । সারা বছরের যে কোনও সময়েই এখানে যাওয়া চলতে পারে ।
৬. এখান থেকে পাওয়া বিভিন্ন পোড়ামাটির জিনিস, বুদ্ধমূর্তি ইত্যাদি নিয়ে কাছাকাছির মধ্যে একটা সংগ্রহশালা আছে । সেটা খোলা আছে কিনা আগে থেকে জানা থাকলে ভালো হবে ।
৭. এখানে খাওয়াদাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই তবে বেড়াচাঁপার মোড়ের কাছে অনেক খাবারের দোকান আছে । সেখানে সবধরনের খাবারই পাওয়া যায় ।

উপসংহারঃ

চন্দ্রকেতুগড়
ইতিহাসকে উপেক্ষা করা যে আমাদের একটা বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তার একটা জলজ্যান্ত নিদর্শন চন্দ্রকেতুগড় । খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০ শতকে তৈরি একটা জায়গা যার ভগ্নাবশেষ এখনও বর্তমান, সেটা নিয়ে হেলদোল নেই - এ'বোধহয় আমাদের পক্ষেই সম্ভব । এখানে ঘোরার সময়ে আমাদের কালুক ভ্রমণের সময়ে দেখা রাবডেংস্‌ রুইনসের কথা ভীষণভাবে মনে পড়ছিল । তার অবস্থাও চন্দ্রকেতুগড়ের থেকে খুব কিছু ভালো নয় কিন্তু শুধুমাত্র যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের জোরে এই জায়গা পেলিং এর একটা সাইটসিয়িং পয়েন্টে পরিণত হয়েছে । চন্দ্রকেতুগড়ের ইতিহাস যথেষ্ট শক্তিশালী - প্রায় পনেরশো বছর ধরে এই জায়গা বহু বংশের রাজত্বকালের সাক্ষী । এর নামের উৎস সত্যিই সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য কিনা, এই শহর সত্যিই টলেমিবর্ণিত গঙ্গারিদাই কিনা, এর সঙ্গে রোমের সত্যিই প্রত্যক্ষ বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল কিনা - আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে এগুলো জানা অসম্ভব নয় বলেই আমার বিশ্বাস । কিন্তু তার জন্য থাকা দরকার জানার চেষ্টা আর গবেষণার উৎসাহের । সেইসঙ্গে দরকার সংরক্ষণের পৃষ্ঠপোষকতার । রাজনৈতিকভাবে নির্ভুল না হয়েই বলতে চাই শহরকে আলোকিত করতে যে বিপুল পরিমাণ আলোর ব্যবহার হয়, তার কিছুটা আলো যদি এই ইতিহাসের উপরেও ফেলা যায় তাহলে হয়তো এই মৃতপ্রায় ইতিহাসকে পুনর্জীবিত করে একে দিয়েও কথা বলানো সম্ভব হবে !

চন্দ্রকেতুগড় ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

কৃতজ্ঞতা স্বীকার - চন্দ্রকেতুগড়ের সম্পর্কে পড়াশোনা করার জন্য ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে নিচের সাইটটি থেকে অনেক কিছু জানতে পেরেছি । অকুন্ঠভাবে স্বীকার করছি আমার লেখার কিছু তথ্য এখান থেকেই সংগ্রহ করা । সাইটটির লেখকের কাছে এ'জন্য আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ ।
https://www.livehistoryindia.com/amazing-india/2019/07/15/chandraketugarh-an-enigma-in-bengal