আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Monday, November 1, 2021

বিষ্ণুপুর ভ্রমণ

বিশেষ সতর্কীকরণঃ

১. এই ভ্রমণে আমরা জনবহুল স্থানে, বিশেষতঃ স্টেশনে, ট্রেনে ইত্যাদি জায়গায় সারাক্ষণ মাস্ক পরে থেকেছি এবং দূরত্ববিধি যথাসম্ভব মেনে চলার চেষ্টা করেছি। সেইসঙ্গে প্রয়োজনমতো হ্যান্ড স্যানিটাইজারও ব্যবহার করেছি।

২. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও অবস্থাতেই কোনও পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার করিনি। অর্থাৎ প্লাস্টিকের ব্যবহার না করেও এই ভ্রমণ অনায়াসে করা যায়।

৩. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও কাগজ ব্যবহার বা নষ্ট করিনি। হোটেল বুকিং-এর রশিদ-এর প্রিন্ট আউট ব্যবহারের কোনও প্রয়োজন হয় না।

৪. এই পুরো ভ্রমণে আমাদের দলের কেউ ধূমপান করেনি। ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।

আমার ব্লগের সমস্ত পাঠকদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে করোনা ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করার জন্য সরকারী বিধিনিষেধ মেনে চলার জন্য। সেইসঙ্গে অনুরোধ করছি প্লাস্টিক, অপ্রয়োজনীয় কাগজের ব্যবহার আর ধূমপান বর্জন করার জন্য।

ভ্রমণপথঃ

শনিবার ৩০শে অক্টোবর, ২০২১ঃ শালিমার স্টেশন থেকে সকাল ৭ঃ৪৫ মিনিটে শালিমার ভজুডিহি স্পেশাল ট্রেন - সকাল ১১ঃ১০ মিনিটে বিষ্ণুপুর। একইসঙ্গে গাড়িতে সকাল ৭ঃ৩০ মিনিটে শালিমার স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে দুপুর ১২ টায় বিষ্ণুপুর। বিষ্ণুপুরে রাত্রিবাস।

রবিবার ৩১শে অক্টোবর, ২০২১ঃ বিষ্ণুপুরে লোক্যাল সাইট সিয়িং। বিষ্ণুপুরে রাত্রিবাস।

সোমবার ১লা নভেম্বর, ২০২১ঃ বিষ্ণুপুর থেকে দুপুর ৩ঃ২২ মিনিটে ভজুডিহি শালিমার স্পেশাল ট্রেন - সন্ধ্যে ৭ টায় শালিমার। একইসঙ্গে গাড়িতে দুপুর ১ঃ৪০ মিনিটে বিষ্ণুপুর স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে সন্ধ্যে ৬ঃ৪৫ মিনিটে শালিমার স্টেশন।

বিষ্ণুপুর। আমাদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মোটামুটি পশ্চিমদিকে অবস্থিত বাঁকুড়া জেলার সদর এই শহর মূলতঃ পোড়ামাটির কাজ বা টেরাকোটার জন্য বিখ্যাত। রয়েছে ডজনখানেকের বেশি মন্দির যার সবগুলোই এই পোড়ামাটি দিয়ে তৈরি। সতেরোশো আর আঠারোশো খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে মল্লরাজাদের আমলে এইসব মন্দিরগুলো তৈরি করা হয়  (আমি অবশ্য এই মল্লরাজাদের নাম বিষ্ণুপুর যাওয়ার আগে কখনও শুনিনি)। পোড়ামাটির তৈরি এই মন্দিরগুলো দেখার জন্যই আমাদের এবারের ভ্রমণ।

বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টির সামনে আমরা
বিষ্ণুপুরে আমরা এবারে যেভাবে গেছিলাম, সেভাবে এর আগে কখনও কোথাও যাইনি। এবারে আমাদের দল আটজনের - আমরা ছ'জন, সোনামাসি আর টুটুন। শেষেরজন আমাদের প্রতিবেশী ঊনবিংশবর্ষীয় তরুণ। আমাদের গাড়িতে ছ'জন পূর্ণবয়স্ক লোক ঠেসেঠুসে বসা যায় ঠিকই, কিন্তু সেটা অল্পদূরত্বের জন্য - সেইভাবে বিষ্ণুপুর যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। সেজন্য বাবা ট্রেনে গেল। মজার ব্যাপারটা হল - আমরা গাড়ি করে বাবাকে শালিমার স্টেশনে পৌঁছে দিলাম আর বিষ্ণুপুরে হোটেলে পৌঁছে আবার বাবার সঙ্গে দেখা হল। শালিমার স্টেশনে বাবাকে নামিয়ে দিয়ে গুগ্‌ল ম্যাপ দেখে ১৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে আমরা পৌঁছলাম 'বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টি'তে (ভূতপূর্ব বিষ্ণুপুর ট্যুরিস্ট লজ)। পথে একবার মিনিট কুড়ির জন্য দাঁড়িয়েছিলাম - সঙ্গে থাকা স্যান্ডউইচ্‌ ইত্যাদির সদ্ব্যবহার করার জন্য।

আমাদের ঘর
বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন বিভাগের অন্তর্গত। এদের ওয়েবসাইট থেকে আমরা দু'টো ডাবল্‌ বেড ঘর বুক করেছিলাম। ওখানে পৌঁছে একটা ঘরে একটা অতিরিক্ত খাট নেওয়া হল। এখানকার নিয়ম হল অতিরিক্ত ব্যক্তির জন্য ঘরভাড়ার ২০% দিতে হয়। যদি অতিরিক্ত ব্যক্তির জন্য খাট লাগে, তাহলে সেটা ঘরভাড়ার ৩০% হয়ে যায়। ঘরগুলো মোটামুটি বড় - বাথরুমে গরমজলের ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে সবসময়েই যে গরমজলের কল থেকে গরমজল পড়ে, তা নয়। আমাদের দু'টো ঘরের একটায় একটা নিস্ক্রিয় ইন্টারকম ফোন ছিল, অন্যটায় কিছুই ছিল না। এইসব কিছু ত্রুটি উপেক্ষা করতে পারলে ঘরগুলো মোটের উপর মন্দ নয়।

আমরা ঘরে ঢুকে স্নানটান সেরে নিলাম। তারপর হোটেলের ডাইনিং রুমে গিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। ভাত ডাল আলুভাজা মাছ চিকেন নিয়ে খরচ হল ১,২২৪/- টাকা (সার্ভিস ট্যাক্স যোগ করে)। এখানে বলে রাখি থাকার জন্য বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টি রেকমেন্ড করলেও খাওয়ার জন্য এই জায়গাটা আমি একেবারেই রেকমেন্ড করব না। বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টির রান্নার মান খুবই সাধারণ আর দাম একটু বেশির দিকেই।

    
ব্যালকনি থেকে রিসর্টের ভিতরের পার্ক

খাওয়ার পরে আমরা ঘরে এসে বিশ্রাম করলাম। ঘরগুলোর লাগোয়া একটা করে ছোট ব্যালকনি আছে, যেখান থেকে রিসর্টের ভিতরের পার্কটা খুব সুন্দরভাবে দেখা যায়। এখানে পার্কটা খুব সুন্দরভাবে সাজানো, একটা দোলনাও আছে। বিকেলে কিছুক্ষণ পার্কে সবাইমিলে ঘোরাঘুরি করা হল। রাতের দিকে এখানে হাল্কা একটা ঠান্ডাভাব অনুভব করা যায় কারণ এখানকার তাপমাত্রা কলকাতার থেকে সামান্য হলেও কম। রাত্রিবেলা এখান থেকেই ভাত ডাল ডিম আর মাছ দিয়ে ডিনার করা হল। খরচ হল ৬৯৫/- টাকা (মা আর সোনামাসি কিছুই খায়নি)।

বিষ্ণুপুরের দেওয়ালে বিষ্ণুপুরের ম্যাপ
রবিবার ৩১শে অক্টোবর, ২০২১ - আমাদের বিষ্ণুপুর ঘোরার দিন। প্রথমেই জানিয়ে রাখি পুরো বিষ্ণুপুর শহরটা ঘুরে দেখতে ঘন্টাতিনেকের বেশি লাগার কথা নয় (যদি না ইতিহাস বা পোড়ামাটির স্থাপত্যের ব্যাপারে অগাধ জ্ঞান অথবা আগ্রহ থাকে !)। এবং সঙ্গে গাড়ি থাকলে বিষ্ণুপুর গাড়িতে খুবই ভালোভাবে ঘোরা যায়। গাড়ি না থাকলে ভরসা টোটো আর সেটাও না চাইলে পায়ে হেঁটেও ঘোরা যেতে পারে। বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টিকে মাঝখানে রাখলে দেখার জায়গাগুলোকে মোটামুটি দুটো দলে ভাগ করা যায় আর জায়গাগুলোর কোনওটাই এখান থেকে হেঁটে মিনিট কুড়ির বেশি লাগে না। আমরা আগেই ঠিক করেছিলাম খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টিকে বয়কট করব, তাই সকাল ন'টা নাগাদ হোটেল থেকে বেরিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম। এই এলাকায় অনেক ছোট ছোট খাবার হোটেল আছে, আর সেখানে ডিম টোস্ট থেকে শুরু করে, লুচি তরকারি, ছোলে বাটুরে সবই পাওয়া যায়। সেইভাবেই ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে আমরা এগোলাম বিষ্ণুপুর দেখতে - পদব্রজে।

রাসমঞ্চ - বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টি থেকে মিনিট তিনেক হাঁটাপথে আমাদের প্রথম গন্তব্য রাসমঞ্চ। এই রাসমঞ্চ বিষ্ণুপুরের অন্যতম বিখ্যাত দর্শনীয় জায়গা - বিষ্ণুপুরের পরিচায়ক বলা যেতে পারে। বিষ্ণুপুরের প্রায় সব মন্দিরই ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ রক্ষণাবেক্ষণ করে । এখানে ঢোকার সময়ে টিকিট কাটতে হয়, মাথাপিছু ২০/- টাকা (১৪ বছরের নিচে লাগে না)। টিকিটের কোনও কাউন্টার নেই, মোবাইলের সাহায্যে কিউআর কোড স্ক্যান করে টিকিট কাটতে হয়। কাটা হয়ে গেলে মোবাইলে একটা পিডিএফ ফাইল ডাউনলোড হয়ে যায় আর সেটাই ঢোকার সময়ে গেটে দেখাতে হয়। দেখানো হয়ে গেলেই কিন্তু ফাইলটা ডিলিট করা চলবে না কারণ এই একই টিকিটে শ্যামরায় মন্দির আর জোড়বাংলা মন্দির দেখা যাবে। অর্থাৎ বাই ওয়ান গেট টু অফার !

    
রাসমঞ্চ
টিকিট কাটা হয়েছে ? এবার রাসমঞ্চটা দেখা যাক। একটা উঁচু বেদীর মতো জায়গার উপরে একটা মন্দিরের মতো জায়গা যার চারদিকে তিনসারি থামবিশিষ্ট বারান্দার মতো আছে। থামগুলো বেশ চওড়া - দেখে লুকোচুরি খেলার কথা মনে হয় (আমাদের শুধু মনে হয়নি, খেলেওছি !)। বীর হাম্বীর ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। মল্লরাজাদের যুগে রাস উৎসবের সময়ে কাছাকাছি সব মন্দিরের বিগ্রহ এখানে নিয়ে আসা হত সাধারণ মানুষের দর্শনের জন্য। বর্তমানে এখানে কোনও বিগ্রহ নেই আর সেই কারণে রাসমঞ্চের উপরে জুতো পরে ওঠারও কোনও বিধিনিষেধ নেই। জায়গাটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। রাসমঞ্চের সংলগ্ন একটা মাঠ আছে সেটাও যথেষ্ট রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। প্রায় চল্লিশ মিনিট এখানে কাটিয়ে প্রচুর ছবি তুলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

শ্যামরায় মন্দির
শ্যামরায় মন্দির - রাসমঞ্চ থেকে বেরিয়ে প্রায় মিনিট কুড়ি হেঁটে আমরা পৌঁছলাম আমাদের দ্বিতীয় গন্তব্য - শ্যামরায় মন্দিরে। এখানে আমাদের আগের কাটা টিকিট চেকিং হল। শ্যামরায় মন্দিরের বৈশিষ্ট্য হল এটার পাঁচটা চালা। ১৬৪৩ খ্রীষ্টাব্দে মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ এটি তৈরি করেন। এই মন্দিরের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল এর গায়ের পোড়ামাটির কাজ। এখানে আমরা মিনিট পনেরো কাটিয়ে এগোলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।

গুমঘর বা গুমগড় - শ্যামরায় মন্দির থেকে বেরিয়ে জোড়বাংলা মন্দিরের দিকে যাওয়ার পথে এই গুমঘর বা গুমগড় দেখতে পাওয়া যায়। এটা একটা চারদিক উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা জায়গা। অনেকের মতে অপরাধীদের এর মধ্যে ফেলে দিয়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হত। কেউ কেউ মনে করেন এটা মল্লরাজাদের শস্যাগার ছিল। আবার কাছাকাছির মধ্যে কিছু পোড়ামাটির জলের পাইপ দেখা যায় বলে বেশিরভাগ ঐতিহাসিক মনে করেন এটা আসলে জলাধার ছিল।

    
মহাপ্রভু জীউ-এর মন্দির
মহাপ্রভু জীউ-র মন্দির - জোড়বাংলা মন্দিরের দিকে আরেকটু এগোলে এই মন্দিরটা দেখতে পাওয়া যায়। এর ভিতরে ঢোকা যায় না কারণ বাইরে বোর্ড টাঙানো আছে যে রাজপরিবারের অনুমতি ছাড়া এই মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ (আমার মনে হয় আসলে লেখা উচিৎ ছিল "রাজপরিবারের অনুমতি থাকলে এবং সাপের ভয় না থাকলে এই মন্দিরে প্রবেশ করা যেতে পারে")।






জোড়বাংলা মন্দির
জোড়বাংলা মন্দির - শ্যামরায় মন্দির থেকে মিনিট দশেক হেঁটে আমরা পৌঁছলাম জোড়বাংলা মন্দিরে। এই জোড়বাংলা মন্দির বিষ্ণুপুরের আরেকটা প্রধান দর্শনীয় জায়গা। এখানে ঢোকার সময়ে আমাদের শেষবারের মতো টিকিট দেখাতে হল (এবার চাইলে পিডিএফ ফাইলটা ডিলিট করে দেওয়া যেতে পারে)। মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ ১৬৫৫ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরি করেন। এই মন্দিরের বৈশিষ্ট্য হল একই চালা বা ছাদের নিচে দু'টো আলাদা আলাদা মন্দির। এর মধ্যে একটা রাধার আর অন্যটা কৃষ্ণের। এখানে মন্দিরে বিগ্রহ আছে তাই চাতালের উপরে জুতো পরে ওঠা যায় না। মন্দিরের গায়ে নানারকম পৌরাণিক ঘটনা পোড়ামাটির সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে।

এই জোড়বাংলা মন্দিরের একেবারে পাশেই রয়েছে আরও অনেকগুলো দর্শনীয় জায়গা যেগুলো আমরা পরপর দেখলাম।

    
রাধেশ্যাম মন্দির
রাধেশ্যাম মন্দির - মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ ১৭৫৮ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরি করেন। এই মন্দিরের চূড়া গম্বুজাকৃতি এবং এর গায়ে পৌরাণিক ঘটনার মূর্তি তৈরি করা আছে। এই মন্দিরের ভিতরেও ঠাকুর আছে - এখানে রাধাশ্যাম, গৌরনিতাই আর জগন্নাথের পুজো হয়। মন্দিরের ঢোকার গেটটাও খুব সুন্দর।

মৃন্ময়ী মন্দির
মৃন্ময়ী মন্দির - রাধেশ্যাম মন্দিরের ঠিক বিপরীত দিকেই রয়েছে মৃন্ময়ী মন্দির। মল্লরাজ জগৎমল্ল ৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরি করেন। এই মন্দিরটা বাকি মন্দিরগুলোর থেকে আলাদা আর ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ এর রক্ষণাবেক্ষণও করে না। এই মন্দিরে নিয়মিত পুজো হয় আর মন্দিরটা দেখেই বোঝা যায় এর নিয়মিত সংস্কার হয়। মল্লরাজাদের সময় থেকে এখনও পর্যন্ত্য এখানে দুর্গাপুজো হয় এবং অষ্টমীর সন্ধিপুজোর সময়ে তোপধ্বনি হয়। মন্দিরের ঠিক সামনে একাধিক ঝুরিবিশিষ্ট একটা বটগাছ আছে যার চতুর্দিকে বসার জায়গা আছে।

মৃন্ময়ী মন্দির থেকে বেরিয়ে পাশেই একটা দোকান থেকে আমরা লেবুর সরবত খেলাম। সময়টা অক্টোবর মাসের শেষ হলেও দুপুরে সূর্য যখন মাথার উপরে তখন গরম বেশ ভালোই লাগে। আর এই গরমে হাল্কা ঠান্ডা লেবুর সরবতও ভালো লাগে। আমি দু'গ্লাস খেয়ে ফেললাম।

রাজবাড়ি - মৃন্ময়ী মন্দির থেকে বেরিয়েই দেখতে পাওয়া যায় রাজবাড়ি - প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। আর তারই লাগোয়া নতুন বাড়ি। এখানে রাজপরিবারের মানুষজন এখনও বাস করেন। পুরো জায়গাটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আর সেখানে স্পষ্টভাবে লেখা আছে 'প্রবেশ নিষেধ' (সেটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে যাঁরা এখানে বাস করেন তাঁরা কেউ রাজা নন, আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ। বাইরের যেকোনও লোক যদি যখন তখন আমাদের বাড়িতে এসে বাড়িটা ঘুরে দেখতে চায়, সেটা আমাদের কাছে যথেষ্ট বিরক্তি উদ্রেককারী বিষয় হবে না কি ?)।

    
লালজী মন্দির
লালজী মন্দির - রাজবাড়ি থেকে সামান্য এগিয়ে পরবর্তী গন্তব্য লালজী মন্দির। মল্লরাজ দ্বিতীয় বীরসিংহ ১৬৫৮ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরি করেন। এই মন্দিরে বর্তমানে বিগ্রহ নেই কিন্তু স্থানীয় লোকেদের অনুরোধে চত্বরের উপরে জুতো পরে ওঠা গেল না। মন্দিরের পূর্বদিকে ইঁটের তৈরি একটা জায়গা আছে সেটা যে কি, তা কোথাও লেখা নেই আর সেটা দেখে মনে হয় ... আসলে কিছুই মনে হয় না !

বড় পাথর দরজা

বড় পাথর দরজা - লালজী মন্দির থেকে বাইরে বেরিয়ে সামান্য এগোলেই দেখা যায় বড় পাথর দরজা। এই দরজাই ছিল বিষ্ণুপুরের প্রাচীন দূর্গের উত্তরদিকের প্রবেশপথ। এখানে দ্বাররক্ষী সৈন্যদের অস্ত্র নিয়ে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা ছিল।




    
ছোট পাথর দরজা
ছোট পাথর দরজা - বড় পাথর দরজা থেকে সামান্য দূরে দেখতে পাওয়া যায় ছোট পাথর দরজা। মহাষ্টমীর সন্ধিপুজোর সময়ে যে তোপধ্বনি হয়, সেটা আসলে এই দরজার পাশেই হয়।








পাথর দরজার এলাকা
বড় পাথর দরজা আর ছোট পাথর দরজার এলাকাটার প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব সুন্দর। এখানে একটা ছোট জলাশয় রয়েছে, তার পাশে একটা গাছ আর উঁচু ঢিপি। তার পাশ দিয়ে চলে গেছে লালমাটির রাস্তা। সবমিলিয়ে বেশ ছবির মতো সুন্দর একটা নৈস্বর্গিক দৃশ্য।




আগেই বলেছি দেখার জায়গাগুলোকে দুটো দলে ভাগ করা যায়। ছোট পাথর দরজা দেখার পর আমাদের একটা দলের প্রায় সবকটা জায়গা দেখা হয়ে গেল (বাকি রইল শুধু পাথরের রথ, যেটা আমরা পরেরদিন দেখেছি), তাই আমরা একটা টোটো করে হোটেলে ফিরে এলাম।

হোটেলে চানটান করে আমরা বেরোলাম লাঞ্চ করতে। এখানে দুপুরে খাওয়ার হোটেল অনেক আছে, সেরকমই একটা হোটেল থেকে ভাত মাছ চিকেন ডিম বিরিয়ানি খেয়ে নেওয়া হল। খরচ হল ৬৪০/- টাকা।

খাওয়ার পরে আমরা বেরোলাম বিষ্ণুপুরের অন্যদিকটা দেখতে। এবারে আর পদব্রজে নয় - গাড়ি নিয়ে।

    
রাধামাধব মন্দির
রাধামাধব মন্দির - হোটেল থেকে মিনিট পাঁচেক গাড়িতে করে আমরা পৌঁছলাম রাধামাধব মন্দিরে। মল্লরাজ কৃষ্ণ সিংহের পত্নী রাণী চূড়ামণিদেবী ১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরি করেন। এই মন্দিরের গায়ে যথারীতি নানারকম পুরাণের ঘটনার ছবি আছে।



কালাচাঁদ মন্দির
কালাচাঁদ মন্দির - রাধামাধব মন্দিরের কম্পাউন্ডের মধ্যেই আরেকটু এগিয়ে গেলে রয়েছে কালাচাঁদ মন্দির। এই মন্দির মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ ১৬৫৬ খ্রীষ্টাব্দে তৈরি করেন। এখানেও নানারকম পুরানের ঘটনা খোদাই করা রয়েছে।

এখানে একটা দরকারী তথ্য দিয়ে রাখি। এই মন্দিরগুলোর যিনি সিকিউরিটি গার্ড, তিনি আমাদের ডেকে বললেন আমরা যেন মন্দির সংলগ্ন মাঠ দিয়ে হাঁটাচলা যতদূর সম্ভব না করার চেষ্টা করি। আমি ভাবছিলাম হাঁটাচলার কারণে মাঠের ঘাস এবং ফুলগাছের ক্ষতি হতে পারে বলে কথাগুলো উনি বলছেন কিন্তু আসলে তা নয়। ভদ্রলোক বললেন - এখানে মাঠের এখানেওখানে, ঝোপঝাড়ের মধ্যে অনেক সাপ আছে। প্রকৃতপক্ষে এত গাছপালা, ইঁটের তৈরি মন্দির, কাছাকাছির মধ্যে জলাশয় এইসবকিছুর উপস্থিতির কারণে এখানে সাপ না থাকাটাই অস্বাভাবিক। ইঁদুর আর ব্যাঙের প্রাচুর্য্যও সাপ থাকার আরেকটা কারণ।এ'দিন সকালবেলাই ওই মাঠের মধ্যে একটা প্রায় ছ'ফুট লম্বা সাপের খোলস পাওয়া গেছে (উনি নিজের মোবাইলে সেটার ছবিও দেখালেন আমাদের)। আর এই তথ্যটা শুধু কালাচাঁদের মন্দিরে নয়, বিষ্ণুপুরের যেকোনও মন্দিরের জন্যই সত্য।

রাধামাধব আর কালাচাঁদের মন্দিরদুটোই আমাদের হোটেল থেকে সবথেকে বেশি দূরে তাই আগেই ওখানে চলে গিয়েছিলাম। এবার ফিরতি পথে বাকি দেখার জায়গাগুলো দেখে নিলাম।

    
রাধাগোবিন্দ মন্দির
রাধাগোবিন্দ মন্দির - রাধামাধবের মন্দির থেকে ফেরার পথে সামান্য দূরে রাধাগোবিন্দর মন্দির। মল্লরাজ কৃষ্ণ সিংহ ১৭২৯ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরি করেন। কোনও অজ্ঞাত কারণে মন্দিরের কম্পাউন্ডের গেট বন্ধ থাকায় আমরা বাইরে থেকেই মন্দির দেখে চলে এলাম।



নন্দলাল মন্দির
নন্দলাল মন্দির - ফিরতি পথে আরেকটু এসে ডানদিকে নন্দলাম মন্দির। এর নির্মাণকাল সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ।







জোড় মন্দির - নন্দলাল মন্দির থেকে সামান্য এগিয়ে বাঁদিকে জোড় মন্দির। মল্লরাজ গোপাল সিংহ ১৭২৬ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরি করেন। দুটো বড় আকারের আর একটা ছোট আকারের মন্দির নিয়ে এই জায়গাটার নাম হয়েছে জোড় মন্দির।

    
ছিন্নমস্তা মন্দির
ছিন্নমস্তা মন্দির - বিষ্ণুপুরের বেশিরভাগ মন্দিরেই ঠাকুরের মূর্তি নেই বা থাকলেও মন্দির বলতে মূর্তি পুরোহিত ঘন্টা পুজো ফুল প্রসাদ দক্ষিণা - এইসব মিলিয়ে আমাদের চোখে সামনে যে চেনা ছবিটা ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে মিল নেই। ছিন্নমস্তার মন্দির বিষ্ণুপুরের অন্যান্য মন্দিরের থেকে একেবারেই আলাদা আর এটা আমাদের পরিচিত আর পাঁচটা মন্দিরের মতোই। এটা কোনও মল্লরাজার তৈরি নয় আর এই মন্দিরের গায়ে কোনও পোড়ামাটির কাজও নেই। মন্দিরটা ফেরার পথে আমাদের হোটেলের কাছেই। যথারীতি এখানে মন্দির ঘিরে নানারকম জিনিসের দোকান গজিয়ে উঠেছে আর এই মন্দিরে ভীড়ও বাকি যেকোনও মন্দিরের থেকে বেশি। আমরা যখন গেছি তখন প্রায় সন্ধ্যে হবে, ভিতরে পুজো হচ্ছিল। আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে এলাম।

দলমাদল কামান
দলমাদল কামান - ছিন্নমস্তার মন্দিরের একেবারে পাশে একটা লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা জায়গায় রয়েছে দলমাদল কামান। এর আসল নাম দলমর্দ্দন। ১৭৪২ সালে বর্গীদের তাড়ানোর জন্য এই কামান ব্যবহার করা হয়। ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে বৃটিশ সরকার সাধারণের দর্শনের জন্য এই কামানটি এখানে রাখার ব্যবস্থা করে। এই কামানের দৈর্ঘ্য ৩.৮ মিটার আর ব্যাস প্রায় ৩০ সেমি। এর ওজন ১১.২ টন।


আমাদের বিষ্ণুপুর ভ্রমণ মোটামুটি শেষ - অন্ততঃ আমাদের হোটেলের কাছাকাছি যে জায়গাগুলো আছে সেগুলো সবই দেখা হয়ে গেছে। যে দুটো জায়গা বাকি রয়েছে, সেগুলো আমরা পরেরদিনের জন্য রেখে দিলাম।

    
তাঁতীর বাড়িতে তাঁতযন্ত্রে বালুচরী শাড়ী বোনা
হোটেলে ফিরে এসে আরেকবার বেরোনো হল। বিষ্ণুপুর শহর প্রধানতঃ মন্দিরের জন্য বিখ্যাত হলেও এর খ্যাতির আরেকটা কারণ হল বিষ্ণুপুরী বালুচরী শাড়ী। মা-মাসিদের প্রবল আগ্রহের কারণে একজন স্থানীয় পথনির্দেশকের সাহায্য নিয়ে সন্ধ্যেবেলা আমরা গেলাম 'তাঁতীর বাড়ি'। বলা বাহুল্য, শাড়ী কেনার আগ্রহ আমার বিশেষ ছিল না, কিন্তু যন্ত্রের সাহায্যে কিভাবে তাঁতী এই শাড়ী বোনে সেটা দেখার কৌতুহল খুবই ছিল। তাঁতীর বাড়িতে গিয়ে সেই জিনিস দেখলাম এবং দেখে এককথায় মুগ্ধ হলাম। হস্তচালিত তাঁতের সাহায্যে শাড়ী তৈরি আমি আগেও দেখেছি কিন্তু এতরকম সূক্ষাতিসূক্ষ সুতো নিয়ে বালুচরী শাড়ী তৈরি আগে কখনও দেখিনি। সুতোগুলো এতটাই সরু যে খালি চোখে একটা সুতো দেখতে পাওয়া অসম্ভব। মোটামুটি কয়েকশ' সুতো একসঙ্গে করলে সেটা একটা বাচ্চার কড়ে আঙুলের সমান হতে পারে। যাঁর বাড়ি, তিনি এবং তাঁর স্ত্রী এই ব্যবসাটা চালান। ওনাদের অনেকগুলো তাঁতযন্ত্র আছে এবং সেগুলোয় শাড়ী বোনার কর্মচারী আছে। একটা বালুচরী শাড়ী বুনতে মোটামুটি তিন থেকে চারদিন লাগে আর এর দাম ৬,০০০ টাকা থেকে শুরু। মা-মাসি-অমৃতার শাড়ী 'দেখা' হয়ে গেলে আমরা তাঁতীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।

রাতে হোটেলের বাইরে গিয়ে ডিনার করলাম (মা আর সোনামাসি আবার কিছু খেল না)। খরচ হল ২৬৬/- টাকা।

পরেরদিন ১লা নভেম্বর, ২০২১ - আমাদের ফেরার দিন। সকালে হোটেলের বাইরে থেকে ব্রেকফাস্ট করে ঘরে এসে চানটান করে হোটেল থেকে চেক্‌আউট করলাম। এখানে চেক্‌আউটের সময় সকাল ১১টা। হোটেলের ঘরভাড়া আমরা বুকিং-এর সময়ে দিয়ে থাকলেও এখানে ঘরভাড়ার উপর ১২% জিএসটি নেয়, যেটা চেক্‌আউটের সময়ে দিতে হল। হোটেল থেকে বেরিয়ে আমরা প্রথমে গেলাম আমাদের বাকি থাকা দ্রষ্টব্য জায়গাগুলো দেখে ফেলতে।

মদনমোহন মন্দিরটা আমাদের হোটেল থেকে তুলনামূলকভাবে দূরে আর এখানে যাওয়ার রাস্তাটাও চরম সরু। যাওয়ার পথে বাজার গরু বস্তি - সবই পড়ে। গাড়ির চালকের আসনে বিশেষ সুদক্ষ ড্রাইভার না থাকলে এই মন্দির দেখতে যাওয়া জন্য টোটোই ভাল।

মদনমোহন মন্দির
মদনমোহন মন্দির - ঘিঞ্জি রাস্তা দিয়ে একবার পৌঁছতে পারলে এখানে মন্দিরের সামনে যথেষ্ট চওড়া জায়গা আছে যেখানে সচ্ছন্দে গাড়ি পার্কিং করা যায়। মদনমোহন মন্দির ১৬৯৪ খ্রীষ্টাব্দে মল্লরাজ দুর্জন সিংহ তৈরি করেন। এখানেও মন্দিরের গায়ে পৌরাণিক দৃশ্য, যুদ্ধের দৃশ্য রয়েছে। এই মন্দিরে ঠাকুরের মূর্তি আছে এবং এখানে নিয়মিত পুজো হয়।



    
পাথরের রথ
পাথরের রথ - মদনমোহন মন্দির থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম পাথরের রথ দেখতে - যেটা গতকাল দেখা বাকি থেকে গিয়েছিল। পাথরের রথ ছোট পাথরের দরজা থেকে খুবই কাছে। একটা লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা জায়গায় এই রথটা রয়েছে। এটা আনুমানিক সপ্তদশ খ্রীষ্টাব্দে তৈরি করা হয়েছিল। রথটা দোতলা এবং রথের উপরের দিকটার সঙ্গে বিষ্ণুপুরের মন্দিরের মিল আছে।






বিষ্ণুপুর দর্শন শেষ। দুপুর সাড়ে বারোটা বাজে। আমরা এবার রওনা দিলাম স্টেশনের দিকে। বাবাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আমরা গাড়ি নিয়ে ফেরার পথ ধরব।

স্টেশন সংলগ্ন একটা ভাতের হোটেল থেকে দুপুরের খাবার সেরে নেওয়া হল। তারপর বাবা চলে গেল প্ল্যাটফর্মের দিকে আর আমরা এগোলাম কলকাতার দিকে। ফেরার পথে সোনামাসিকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আবার গেলাম শালিমার স্টেশন। সেখান থেকে বাবাকে নিয়ে বাড়ি !

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে সড়কপথে ১৫০ কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক শহর বিষ্ণুপুর। বিভিন্ন মল্লরাজাদের আমলে তৈরি পোড়ামাটির মন্দিরগুলি এখানকার প্রধান আকর্ষণ।

২. কলকাতা থেকে বিষ্ণুপুর গাড়ি নিয়ে গেলে ডানকুনি থেকে প্রথমে এস এইচ পনেরো ও তারপরে এস এইচ দুই ধরে যেতে হয়। ট্রেনে গেলে হাওড়া বা সাঁত্রাগাছি থেকে বিষ্ণুপুরের যাওয়া যায়। 

৩. বিষ্ণুপুরে বেশ কিছু হোটেল আছে, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন বিভাগের বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টি (ভূতপূর্ব বিষ্ণুপুর ট্যুরিস্ট লজ) উল্লেখযোগ্য। এদের ওয়েবসাইট https://wbtdcl.wbtourismgov.in/home থেকে বুকিং করা যায় অথবা কলকাতার বুকিং অফিস থেকেও বুকিং করা যেতে পারে। এখানে গাড়ি পার্কিং-এর সুবন্দোবস্ত আছে।

৪. থাকার জন্য বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টি রেকমেন্ড করলেও খাবার এদের কাছ থেকে না নেওয়াই ভালো। এদের খাবার ওভারপ্রাইসড এবং রান্নাও অতি সাধারণ মানের। খাওয়ার জন্য এর আশেপাশেই অনেকগুলো হোটেল বা রেস্ট্যুরেন্ট আছে।

৫. বিষ্ণুপুরের প্রধান আকর্ষণ পোড়ামাটি বা টেরাকোটার মন্দির। মোটামুটি ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৭৪২ খ্রীষ্টাব্দের বিভিন্ন মল্লরাজাদের সময়ে নির্মিত এই মন্দিরগুলোর খ্যাতি মূলতঃ এদের গায়ের পোড়ামাটির কাজের জন্য।

৬. বিষ্ণুপুরের প্রায় সব মন্দিরই ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ রক্ষণাবেক্ষণ করে। এর মধ্যে শুধুমাত্র রাসমঞ্চ, শ্যামরায় মন্দির আর জোড়বাংলা মন্দিরে ঢোকার জন্য টিকিট লাগে।

৭. রাসমঞ্চ, শ্যামরায় মন্দির আর জোড়বাংলা মন্দির - এই তিনটে জায়গা মিলিয়ে মাথাপিছু ২০/- টাকা করে টিকিট কাটতে হয়। টিকিট কাটার কোনও কাউন্টার নেই, মোবাইলের সাহায্যে কিউআর কোড স্ক্যান করে কাটতে হয়।

৮. বিষ্ণুপুরের সবকটা মন্দিরই খুব কাছাকাছি জায়গায়। নিজেদের গাড়ি থাকলে গাড়িতে, না থাকলে টোটোয় এমনকি হেঁটেও সবকটা জায়গা আনায়াসে ঘোরা যেতে পারে।

৯. পুরো বিষ্ণুপুর ঘুরে দেখতে ঘন্টা তিনচারেকের বেশি লাগে না। তাই চাইলে বিষ্ণুপুর ডে-আউট বা 1N/2D ট্রিপও করা যেতে পারে।

১০. বিষ্ণুপুরের বালুচরী শাড়ী খুবই বিখ্যাত। এখানে তৈরি শাড়ী সারা দেশে এমনকি বিদেশেও রপ্তানী হয়। তাঁতীর বাড়িতে গিয়ে হস্তচালিত তাঁতযন্ত্রের সাহায্যে এই শাড়ী বোনা দেখা যেতে পারে।

১১. বিষ্ণুপুরের আরেকটা বিখ্যাত জিনিস হল এখানকার পোড়ামাটির ঘোড়া। এখানে বিভিন্ন আকারের পোড়ামাটির ঘোড়া পাওয়া যায় যা ঘর সাজানোর জন্য সংগ্রহ করা যেতে পারে।

১২. বিষ্ণুপুর যাওয়ার সবথেকে ভালো সময় হল অক্টোবর থেকে মার্চ, কিন্তু তার মানে এই নয় যে অন্য সময়ে যাওয়া যায় না। তবে যেহেতু রোদে ঘুরে মন্দির দেখতে হবে, তাই গরমকালটা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।

উপসংহারঃ

পোড়ামাটির ঘোড়া
কলকাতা থেকে মাত্র দেড়শো কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক শহর বিষ্ণুপুর। মল্লরাজাদের যুগে তৈরি পোড়ামাটির মন্দির এখানকার প্রধান আকর্ষণ। খুবই অল্প জায়গায় কাছাকাছির মধ্যে ডজনখানেকের বেশি মন্দির দেখে বোঝা যায় মল্লরাজাদের কীর্তিকলাপ মূলতঃ এইসব জায়গাতেই ছিল। একটা মন্দির দেখে দু'পা হাঁটতেই আরেকটা মন্দির - আবার সেটার থেকে চোখ ফেরাতেই আরেকটা মন্দির। দেখতে দেখতে 'সোনার কেল্লা'র মন্দার বোসের মতো করে বলতে ইচ্ছে করে - "এরা তো দেখছি যেখানে ফাঁক পেয়েছে, সেখানেই একটা করে মন্দির গুঁজে রেখেছে !" মল্লরাজারা ছিলেন কৃষ্ণের পূজারী, তাই প্রায় সব মন্দিরগুলোই কৃষ্ণ বা বিষ্ণুর। আর সেই থেকেই জায়গার নাম বিষ্ণুপুর। মন্দিরগুলোর আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল এগুলো প্রায় একইরকম দেখতে। এইসব মন্দির আধ্যাত্মিক দিক থেকে সমৃদ্ধ নয়, এর সমৃদ্ধি শৈল্পিক। পৌরাণিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এর গুরুত্ব ঐতিহাসিক। আর্থিক দিক থেকে জমকালো নয়, এর জাঁকজমক নেহাৎই সাদামাটা। আর এগুলোই এখানকার আকর্ষণ। আমার বিষ্ণুপুর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে এই আকর্ষণ যদি কিছুটা হলেও অনুভব করা যায়, তাহলে বাঁকুড়া জেলার এই শহরে একটা ছোট্ট ট্রিপ করে আসা অবশ্যকর্তব্য !

বিষ্ণুপুর ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.