আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Monday, November 1, 2021

বিষ্ণুপুর ভ্রমণ

বিশেষ সতর্কীকরণঃ

১. এই ভ্রমণে আমরা জনবহুল স্থানে, বিশেষতঃ স্টেশনে, ট্রেনে ইত্যাদি জায়গায় সারাক্ষণ মাস্ক পরে থেকেছি এবং দূরত্ববিধি যথাসম্ভব মেনে চলার চেষ্টা করেছি। সেইসঙ্গে প্রয়োজনমতো হ্যান্ড স্যানিটাইজারও ব্যবহার করেছি।

২. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও অবস্থাতেই কোনও পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার করিনি। অর্থাৎ প্লাস্টিকের ব্যবহার না করেও এই ভ্রমণ অনায়াসে করা যায়।

৩. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও কাগজ ব্যবহার বা নষ্ট করিনি। হোটেল বুকিং-এর রশিদ-এর প্রিন্ট আউট ব্যবহারের কোনও প্রয়োজন হয় না।

৪. এই পুরো ভ্রমণে আমাদের দলের কেউ ধূমপান করেনি। ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।

আমার ব্লগের সমস্ত পাঠকদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে করোনা ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করার জন্য সরকারী বিধিনিষেধ মেনে চলার জন্য। সেইসঙ্গে অনুরোধ করছি প্লাস্টিক, অপ্রয়োজনীয় কাগজের ব্যবহার আর ধূমপান বর্জন করার জন্য।

ভ্রমণপথঃ

শনিবার ৩০শে অক্টোবর, ২০২১ঃ শালিমার স্টেশন থেকে সকাল ৭ঃ৪৫ মিনিটে শালিমার ভজুডিহি স্পেশাল ট্রেন - সকাল ১১ঃ১০ মিনিটে বিষ্ণুপুর। একইসঙ্গে গাড়িতে সকাল ৭ঃ৩০ মিনিটে শালিমার স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে দুপুর ১২ টায় বিষ্ণুপুর। বিষ্ণুপুরে রাত্রিবাস।

রবিবার ৩১শে অক্টোবর, ২০২১ঃ বিষ্ণুপুরে লোক্যাল সাইট সিয়িং। বিষ্ণুপুরে রাত্রিবাস।

সোমবার ১লা নভেম্বর, ২০২১ঃ বিষ্ণুপুর থেকে দুপুর ৩ঃ২২ মিনিটে ভজুডিহি শালিমার স্পেশাল ট্রেন - সন্ধ্যে ৭ টায় শালিমার। একইসঙ্গে গাড়িতে দুপুর ১ঃ৪০ মিনিটে বিষ্ণুপুর স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে সন্ধ্যে ৬ঃ৪৫ মিনিটে শালিমার স্টেশন।

বিষ্ণুপুর। আমাদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মোটামুটি পশ্চিমদিকে অবস্থিত বাঁকুড়া জেলার সদর এই শহর মূলতঃ পোড়ামাটির কাজ বা টেরাকোটার জন্য বিখ্যাত। রয়েছে ডজনখানেকের বেশি মন্দির যার সবগুলোই এই পোড়ামাটি দিয়ে তৈরি। সতেরোশো আর আঠারোশো খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে মল্লরাজাদের আমলে এইসব মন্দিরগুলো তৈরি করা হয়  (আমি অবশ্য এই মল্লরাজাদের নাম বিষ্ণুপুর যাওয়ার আগে কখনও শুনিনি)। পোড়ামাটির তৈরি এই মন্দিরগুলো দেখার জন্যই আমাদের এবারের ভ্রমণ।

বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টির সামনে আমরা
বিষ্ণুপুরে আমরা এবারে যেভাবে গেছিলাম, সেভাবে এর আগে কখনও কোথাও যাইনি। এবারে আমাদের দল আটজনের - আমরা ছ'জন, সোনামাসি আর টুটুন। শেষেরজন আমাদের প্রতিবেশী ঊনবিংশবর্ষীয় তরুণ। আমাদের গাড়িতে ছ'জন পূর্ণবয়স্ক লোক ঠেসেঠুসে বসা যায় ঠিকই, কিন্তু সেটা অল্পদূরত্বের জন্য - সেইভাবে বিষ্ণুপুর যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। সেজন্য বাবা ট্রেনে গেল। মজার ব্যাপারটা হল - আমরা গাড়ি করে বাবাকে শালিমার স্টেশনে পৌঁছে দিলাম আর বিষ্ণুপুরে হোটেলে পৌঁছে আবার বাবার সঙ্গে দেখা হল। শালিমার স্টেশনে বাবাকে নামিয়ে দিয়ে গুগ্‌ল ম্যাপ দেখে ১৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে আমরা পৌঁছলাম 'বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টি'তে (ভূতপূর্ব বিষ্ণুপুর ট্যুরিস্ট লজ)। পথে একবার মিনিট কুড়ির জন্য দাঁড়িয়েছিলাম - সঙ্গে থাকা স্যান্ডউইচ্‌ ইত্যাদির সদ্ব্যবহার করার জন্য।

আমাদের ঘর
বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন বিভাগের অন্তর্গত। এদের ওয়েবসাইট থেকে আমরা দু'টো ডাবল্‌ বেড ঘর বুক করেছিলাম। ওখানে পৌঁছে একটা ঘরে একটা অতিরিক্ত খাট নেওয়া হল। এখানকার নিয়ম হল অতিরিক্ত ব্যক্তির জন্য ঘরভাড়ার ২০% দিতে হয়। যদি অতিরিক্ত ব্যক্তির জন্য খাট লাগে, তাহলে সেটা ঘরভাড়ার ৩০% হয়ে যায়। ঘরগুলো মোটামুটি বড় - বাথরুমে গরমজলের ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে সবসময়েই যে গরমজলের কল থেকে গরমজল পড়ে, তা নয়। আমাদের দু'টো ঘরের একটায় একটা নিস্ক্রিয় ইন্টারকম ফোন ছিল, অন্যটায় কিছুই ছিল না। এইসব কিছু ত্রুটি উপেক্ষা করতে পারলে ঘরগুলো মোটের উপর মন্দ নয়।

আমরা ঘরে ঢুকে স্নানটান সেরে নিলাম। তারপর হোটেলের ডাইনিং রুমে গিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। ভাত ডাল আলুভাজা মাছ চিকেন নিয়ে খরচ হল ১,২২৪/- টাকা (সার্ভিস ট্যাক্স যোগ করে)। এখানে বলে রাখি থাকার জন্য বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টি রেকমেন্ড করলেও খাওয়ার জন্য এই জায়গাটা আমি একেবারেই রেকমেন্ড করব না। বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টির রান্নার মান খুবই সাধারণ আর দাম একটু বেশির দিকেই।

    
ব্যালকনি থেকে রিসর্টের ভিতরের পার্ক

খাওয়ার পরে আমরা ঘরে এসে বিশ্রাম করলাম। ঘরগুলোর লাগোয়া একটা করে ছোট ব্যালকনি আছে, যেখান থেকে রিসর্টের ভিতরের পার্কটা খুব সুন্দরভাবে দেখা যায়। এখানে পার্কটা খুব সুন্দরভাবে সাজানো, একটা দোলনাও আছে। বিকেলে কিছুক্ষণ পার্কে সবাইমিলে ঘোরাঘুরি করা হল। রাতের দিকে এখানে হাল্কা একটা ঠান্ডাভাব অনুভব করা যায় কারণ এখানকার তাপমাত্রা কলকাতার থেকে সামান্য হলেও কম। রাত্রিবেলা এখান থেকেই ভাত ডাল ডিম আর মাছ দিয়ে ডিনার করা হল। খরচ হল ৬৯৫/- টাকা (মা আর সোনামাসি কিছুই খায়নি)।

বিষ্ণুপুরের দেওয়ালে বিষ্ণুপুরের ম্যাপ
রবিবার ৩১শে অক্টোবর, ২০২১ - আমাদের বিষ্ণুপুর ঘোরার দিন। প্রথমেই জানিয়ে রাখি পুরো বিষ্ণুপুর শহরটা ঘুরে দেখতে ঘন্টাতিনেকের বেশি লাগার কথা নয় (যদি না ইতিহাস বা পোড়ামাটির স্থাপত্যের ব্যাপারে অগাধ জ্ঞান অথবা আগ্রহ থাকে !)। এবং সঙ্গে গাড়ি থাকলে বিষ্ণুপুর গাড়িতে খুবই ভালোভাবে ঘোরা যায়। গাড়ি না থাকলে ভরসা টোটো আর সেটাও না চাইলে পায়ে হেঁটেও ঘোরা যেতে পারে। বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টিকে মাঝখানে রাখলে দেখার জায়গাগুলোকে মোটামুটি দুটো দলে ভাগ করা যায় আর জায়গাগুলোর কোনওটাই এখান থেকে হেঁটে মিনিট কুড়ির বেশি লাগে না। আমরা আগেই ঠিক করেছিলাম খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টিকে বয়কট করব, তাই সকাল ন'টা নাগাদ হোটেল থেকে বেরিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম। এই এলাকায় অনেক ছোট ছোট খাবার হোটেল আছে, আর সেখানে ডিম টোস্ট থেকে শুরু করে, লুচি তরকারি, ছোলে বাটুরে সবই পাওয়া যায়। সেইভাবেই ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে আমরা এগোলাম বিষ্ণুপুর দেখতে - পদব্রজে।

রাসমঞ্চ - বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টি থেকে মিনিট তিনেক হাঁটাপথে আমাদের প্রথম গন্তব্য রাসমঞ্চ। এই রাসমঞ্চ বিষ্ণুপুরের অন্যতম বিখ্যাত দর্শনীয় জায়গা - বিষ্ণুপুরের পরিচায়ক বলা যেতে পারে। বিষ্ণুপুরের প্রায় সব মন্দিরই ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ রক্ষণাবেক্ষণ করে । এখানে ঢোকার সময়ে টিকিট কাটতে হয়, মাথাপিছু ২০/- টাকা (১৪ বছরের নিচে লাগে না)। টিকিটের কোনও কাউন্টার নেই, মোবাইলের সাহায্যে কিউআর কোড স্ক্যান করে টিকিট কাটতে হয়। কাটা হয়ে গেলে মোবাইলে একটা পিডিএফ ফাইল ডাউনলোড হয়ে যায় আর সেটাই ঢোকার সময়ে গেটে দেখাতে হয়। দেখানো হয়ে গেলেই কিন্তু ফাইলটা ডিলিট করা চলবে না কারণ এই একই টিকিটে শ্যামরায় মন্দির আর জোড়বাংলা মন্দির দেখা যাবে। অর্থাৎ বাই ওয়ান গেট টু অফার !

    
রাসমঞ্চ
টিকিট কাটা হয়েছে ? এবার রাসমঞ্চটা দেখা যাক। একটা উঁচু বেদীর মতো জায়গার উপরে একটা মন্দিরের মতো জায়গা যার চারদিকে তিনসারি থামবিশিষ্ট বারান্দার মতো আছে। থামগুলো বেশ চওড়া - দেখে লুকোচুরি খেলার কথা মনে হয় (আমাদের শুধু মনে হয়নি, খেলেওছি !)। বীর হাম্বীর ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। মল্লরাজাদের যুগে রাস উৎসবের সময়ে কাছাকাছি সব মন্দিরের বিগ্রহ এখানে নিয়ে আসা হত সাধারণ মানুষের দর্শনের জন্য। বর্তমানে এখানে কোনও বিগ্রহ নেই আর সেই কারণে রাসমঞ্চের উপরে জুতো পরে ওঠারও কোনও বিধিনিষেধ নেই। জায়গাটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। রাসমঞ্চের সংলগ্ন একটা মাঠ আছে সেটাও যথেষ্ট রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। প্রায় চল্লিশ মিনিট এখানে কাটিয়ে প্রচুর ছবি তুলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

শ্যামরায় মন্দির
শ্যামরায় মন্দির - রাসমঞ্চ থেকে বেরিয়ে প্রায় মিনিট কুড়ি হেঁটে আমরা পৌঁছলাম আমাদের দ্বিতীয় গন্তব্য - শ্যামরায় মন্দিরে। এখানে আমাদের আগের কাটা টিকিট চেকিং হল। শ্যামরায় মন্দিরের বৈশিষ্ট্য হল এটার পাঁচটা চালা। ১৬৪৩ খ্রীষ্টাব্দে মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ এটি তৈরি করেন। এই মন্দিরের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল এর গায়ের পোড়ামাটির কাজ। এখানে আমরা মিনিট পনেরো কাটিয়ে এগোলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।

গুমঘর বা গুমগড় - শ্যামরায় মন্দির থেকে বেরিয়ে জোড়বাংলা মন্দিরের দিকে যাওয়ার পথে এই গুমঘর বা গুমগড় দেখতে পাওয়া যায়। এটা একটা চারদিক উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা জায়গা। অনেকের মতে অপরাধীদের এর মধ্যে ফেলে দিয়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হত। কেউ কেউ মনে করেন এটা মল্লরাজাদের শস্যাগার ছিল। আবার কাছাকাছির মধ্যে কিছু পোড়ামাটির জলের পাইপ দেখা যায় বলে বেশিরভাগ ঐতিহাসিক মনে করেন এটা আসলে জলাধার ছিল।

    
মহাপ্রভু জীউ-এর মন্দির
মহাপ্রভু জীউ-র মন্দির - জোড়বাংলা মন্দিরের দিকে আরেকটু এগোলে এই মন্দিরটা দেখতে পাওয়া যায়। এর ভিতরে ঢোকা যায় না কারণ বাইরে বোর্ড টাঙানো আছে যে রাজপরিবারের অনুমতি ছাড়া এই মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ (আমার মনে হয় আসলে লেখা উচিৎ ছিল "রাজপরিবারের অনুমতি থাকলে এবং সাপের ভয় না থাকলে এই মন্দিরে প্রবেশ করা যেতে পারে")।






জোড়বাংলা মন্দির
জোড়বাংলা মন্দির - শ্যামরায় মন্দির থেকে মিনিট দশেক হেঁটে আমরা পৌঁছলাম জোড়বাংলা মন্দিরে। এই জোড়বাংলা মন্দির বিষ্ণুপুরের আরেকটা প্রধান দর্শনীয় জায়গা। এখানে ঢোকার সময়ে আমাদের শেষবারের মতো টিকিট দেখাতে হল (এবার চাইলে পিডিএফ ফাইলটা ডিলিট করে দেওয়া যেতে পারে)। মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ ১৬৫৫ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরি করেন। এই মন্দিরের বৈশিষ্ট্য হল একই চালা বা ছাদের নিচে দু'টো আলাদা আলাদা মন্দির। এর মধ্যে একটা রাধার আর অন্যটা কৃষ্ণের। এখানে মন্দিরে বিগ্রহ আছে তাই চাতালের উপরে জুতো পরে ওঠা যায় না। মন্দিরের গায়ে নানারকম পৌরাণিক ঘটনা পোড়ামাটির সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে।

এই জোড়বাংলা মন্দিরের একেবারে পাশেই রয়েছে আরও অনেকগুলো দর্শনীয় জায়গা যেগুলো আমরা পরপর দেখলাম।

    
রাধেশ্যাম মন্দির
রাধেশ্যাম মন্দির - মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ ১৭৫৮ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরি করেন। এই মন্দিরের চূড়া গম্বুজাকৃতি এবং এর গায়ে পৌরাণিক ঘটনার মূর্তি তৈরি করা আছে। এই মন্দিরের ভিতরেও ঠাকুর আছে - এখানে রাধাশ্যাম, গৌরনিতাই আর জগন্নাথের পুজো হয়। মন্দিরের ঢোকার গেটটাও খুব সুন্দর।

মৃন্ময়ী মন্দির
মৃন্ময়ী মন্দির - রাধেশ্যাম মন্দিরের ঠিক বিপরীত দিকেই রয়েছে মৃন্ময়ী মন্দির। মল্লরাজ জগৎমল্ল ৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরি করেন। এই মন্দিরটা বাকি মন্দিরগুলোর থেকে আলাদা আর ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ এর রক্ষণাবেক্ষণও করে না। এই মন্দিরে নিয়মিত পুজো হয় আর মন্দিরটা দেখেই বোঝা যায় এর নিয়মিত সংস্কার হয়। মল্লরাজাদের সময় থেকে এখনও পর্যন্ত্য এখানে দুর্গাপুজো হয় এবং অষ্টমীর সন্ধিপুজোর সময়ে তোপধ্বনি হয়। মন্দিরের ঠিক সামনে একাধিক ঝুরিবিশিষ্ট একটা বটগাছ আছে যার চতুর্দিকে বসার জায়গা আছে।

মৃন্ময়ী মন্দির থেকে বেরিয়ে পাশেই একটা দোকান থেকে আমরা লেবুর সরবত খেলাম। সময়টা অক্টোবর মাসের শেষ হলেও দুপুরে সূর্য যখন মাথার উপরে তখন গরম বেশ ভালোই লাগে। আর এই গরমে হাল্কা ঠান্ডা লেবুর সরবতও ভালো লাগে। আমি দু'গ্লাস খেয়ে ফেললাম।

রাজবাড়ি - মৃন্ময়ী মন্দির থেকে বেরিয়েই দেখতে পাওয়া যায় রাজবাড়ি - প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। আর তারই লাগোয়া নতুন বাড়ি। এখানে রাজপরিবারের মানুষজন এখনও বাস করেন। পুরো জায়গাটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আর সেখানে স্পষ্টভাবে লেখা আছে 'প্রবেশ নিষেধ' (সেটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে যাঁরা এখানে বাস করেন তাঁরা কেউ রাজা নন, আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ। বাইরের যেকোনও লোক যদি যখন তখন আমাদের বাড়িতে এসে বাড়িটা ঘুরে দেখতে চায়, সেটা আমাদের কাছে যথেষ্ট বিরক্তি উদ্রেককারী বিষয় হবে না কি ?)।

    
লালজী মন্দির
লালজী মন্দির - রাজবাড়ি থেকে সামান্য এগিয়ে পরবর্তী গন্তব্য লালজী মন্দির। মল্লরাজ দ্বিতীয় বীরসিংহ ১৬৫৮ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরি করেন। এই মন্দিরে বর্তমানে বিগ্রহ নেই কিন্তু স্থানীয় লোকেদের অনুরোধে চত্বরের উপরে জুতো পরে ওঠা গেল না। মন্দিরের পূর্বদিকে ইঁটের তৈরি একটা জায়গা আছে সেটা যে কি, তা কোথাও লেখা নেই আর সেটা দেখে মনে হয় ... আসলে কিছুই মনে হয় না !

বড় পাথর দরজা

বড় পাথর দরজা - লালজী মন্দির থেকে বাইরে বেরিয়ে সামান্য এগোলেই দেখা যায় বড় পাথর দরজা। এই দরজাই ছিল বিষ্ণুপুরের প্রাচীন দূর্গের উত্তরদিকের প্রবেশপথ। এখানে দ্বাররক্ষী সৈন্যদের অস্ত্র নিয়ে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা ছিল।




    
ছোট পাথর দরজা
ছোট পাথর দরজা - বড় পাথর দরজা থেকে সামান্য দূরে দেখতে পাওয়া যায় ছোট পাথর দরজা। মহাষ্টমীর সন্ধিপুজোর সময়ে যে তোপধ্বনি হয়, সেটা আসলে এই দরজার পাশেই হয়।








পাথর দরজার এলাকা
বড় পাথর দরজা আর ছোট পাথর দরজার এলাকাটার প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব সুন্দর। এখানে একটা ছোট জলাশয় রয়েছে, তার পাশে একটা গাছ আর উঁচু ঢিপি। তার পাশ দিয়ে চলে গেছে লালমাটির রাস্তা। সবমিলিয়ে বেশ ছবির মতো সুন্দর একটা নৈস্বর্গিক দৃশ্য।




আগেই বলেছি দেখার জায়গাগুলোকে দুটো দলে ভাগ করা যায়। ছোট পাথর দরজা দেখার পর আমাদের একটা দলের প্রায় সবকটা জায়গা দেখা হয়ে গেল (বাকি রইল শুধু পাথরের রথ, যেটা আমরা পরেরদিন দেখেছি), তাই আমরা একটা টোটো করে হোটেলে ফিরে এলাম।

হোটেলে চানটান করে আমরা বেরোলাম লাঞ্চ করতে। এখানে দুপুরে খাওয়ার হোটেল অনেক আছে, সেরকমই একটা হোটেল থেকে ভাত মাছ চিকেন ডিম বিরিয়ানি খেয়ে নেওয়া হল। খরচ হল ৬৪০/- টাকা।

খাওয়ার পরে আমরা বেরোলাম বিষ্ণুপুরের অন্যদিকটা দেখতে। এবারে আর পদব্রজে নয় - গাড়ি নিয়ে।

    
রাধামাধব মন্দির
রাধামাধব মন্দির - হোটেল থেকে মিনিট পাঁচেক গাড়িতে করে আমরা পৌঁছলাম রাধামাধব মন্দিরে। মল্লরাজ কৃষ্ণ সিংহের পত্নী রাণী চূড়ামণিদেবী ১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরি করেন। এই মন্দিরের গায়ে যথারীতি নানারকম পুরাণের ঘটনার ছবি আছে।



কালাচাঁদ মন্দির
কালাচাঁদ মন্দির - রাধামাধব মন্দিরের কম্পাউন্ডের মধ্যেই আরেকটু এগিয়ে গেলে রয়েছে কালাচাঁদ মন্দির। এই মন্দির মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ ১৬৫৬ খ্রীষ্টাব্দে তৈরি করেন। এখানেও নানারকম পুরানের ঘটনা খোদাই করা রয়েছে।

এখানে একটা দরকারী তথ্য দিয়ে রাখি। এই মন্দিরগুলোর যিনি সিকিউরিটি গার্ড, তিনি আমাদের ডেকে বললেন আমরা যেন মন্দির সংলগ্ন মাঠ দিয়ে হাঁটাচলা যতদূর সম্ভব না করার চেষ্টা করি। আমি ভাবছিলাম হাঁটাচলার কারণে মাঠের ঘাস এবং ফুলগাছের ক্ষতি হতে পারে বলে কথাগুলো উনি বলছেন কিন্তু আসলে তা নয়। ভদ্রলোক বললেন - এখানে মাঠের এখানেওখানে, ঝোপঝাড়ের মধ্যে অনেক সাপ আছে। প্রকৃতপক্ষে এত গাছপালা, ইঁটের তৈরি মন্দির, কাছাকাছির মধ্যে জলাশয় এইসবকিছুর উপস্থিতির কারণে এখানে সাপ না থাকাটাই অস্বাভাবিক। ইঁদুর আর ব্যাঙের প্রাচুর্য্যও সাপ থাকার আরেকটা কারণ।এ'দিন সকালবেলাই ওই মাঠের মধ্যে একটা প্রায় ছ'ফুট লম্বা সাপের খোলস পাওয়া গেছে (উনি নিজের মোবাইলে সেটার ছবিও দেখালেন আমাদের)। আর এই তথ্যটা শুধু কালাচাঁদের মন্দিরে নয়, বিষ্ণুপুরের যেকোনও মন্দিরের জন্যই সত্য।

রাধামাধব আর কালাচাঁদের মন্দিরদুটোই আমাদের হোটেল থেকে সবথেকে বেশি দূরে তাই আগেই ওখানে চলে গিয়েছিলাম। এবার ফিরতি পথে বাকি দেখার জায়গাগুলো দেখে নিলাম।

    
রাধাগোবিন্দ মন্দির
রাধাগোবিন্দ মন্দির - রাধামাধবের মন্দির থেকে ফেরার পথে সামান্য দূরে রাধাগোবিন্দর মন্দির। মল্লরাজ কৃষ্ণ সিংহ ১৭২৯ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরি করেন। কোনও অজ্ঞাত কারণে মন্দিরের কম্পাউন্ডের গেট বন্ধ থাকায় আমরা বাইরে থেকেই মন্দির দেখে চলে এলাম।



নন্দলাল মন্দির
নন্দলাল মন্দির - ফিরতি পথে আরেকটু এসে ডানদিকে নন্দলাম মন্দির। এর নির্মাণকাল সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ।







জোড় মন্দির - নন্দলাল মন্দির থেকে সামান্য এগিয়ে বাঁদিকে জোড় মন্দির। মল্লরাজ গোপাল সিংহ ১৭২৬ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরি করেন। দুটো বড় আকারের আর একটা ছোট আকারের মন্দির নিয়ে এই জায়গাটার নাম হয়েছে জোড় মন্দির।

    
ছিন্নমস্তা মন্দির
ছিন্নমস্তা মন্দির - বিষ্ণুপুরের বেশিরভাগ মন্দিরেই ঠাকুরের মূর্তি নেই বা থাকলেও মন্দির বলতে মূর্তি পুরোহিত ঘন্টা পুজো ফুল প্রসাদ দক্ষিণা - এইসব মিলিয়ে আমাদের চোখে সামনে যে চেনা ছবিটা ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে মিল নেই। ছিন্নমস্তার মন্দির বিষ্ণুপুরের অন্যান্য মন্দিরের থেকে একেবারেই আলাদা আর এটা আমাদের পরিচিত আর পাঁচটা মন্দিরের মতোই। এটা কোনও মল্লরাজার তৈরি নয় আর এই মন্দিরের গায়ে কোনও পোড়ামাটির কাজও নেই। মন্দিরটা ফেরার পথে আমাদের হোটেলের কাছেই। যথারীতি এখানে মন্দির ঘিরে নানারকম জিনিসের দোকান গজিয়ে উঠেছে আর এই মন্দিরে ভীড়ও বাকি যেকোনও মন্দিরের থেকে বেশি। আমরা যখন গেছি তখন প্রায় সন্ধ্যে হবে, ভিতরে পুজো হচ্ছিল। আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে এলাম।

দলমাদল কামান
দলমাদল কামান - ছিন্নমস্তার মন্দিরের একেবারে পাশে একটা লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা জায়গায় রয়েছে দলমাদল কামান। এর আসল নাম দলমর্দ্দন। ১৭৪২ সালে বর্গীদের তাড়ানোর জন্য এই কামান ব্যবহার করা হয়। ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে বৃটিশ সরকার সাধারণের দর্শনের জন্য এই কামানটি এখানে রাখার ব্যবস্থা করে। এই কামানের দৈর্ঘ্য ৩.৮ মিটার আর ব্যাস প্রায় ৩০ সেমি। এর ওজন ১১.২ টন।


আমাদের বিষ্ণুপুর ভ্রমণ মোটামুটি শেষ - অন্ততঃ আমাদের হোটেলের কাছাকাছি যে জায়গাগুলো আছে সেগুলো সবই দেখা হয়ে গেছে। যে দুটো জায়গা বাকি রয়েছে, সেগুলো আমরা পরেরদিনের জন্য রেখে দিলাম।

    
তাঁতীর বাড়িতে তাঁতযন্ত্রে বালুচরী শাড়ী বোনা
হোটেলে ফিরে এসে আরেকবার বেরোনো হল। বিষ্ণুপুর শহর প্রধানতঃ মন্দিরের জন্য বিখ্যাত হলেও এর খ্যাতির আরেকটা কারণ হল বিষ্ণুপুরী বালুচরী শাড়ী। মা-মাসিদের প্রবল আগ্রহের কারণে একজন স্থানীয় পথনির্দেশকের সাহায্য নিয়ে সন্ধ্যেবেলা আমরা গেলাম 'তাঁতীর বাড়ি'। বলা বাহুল্য, শাড়ী কেনার আগ্রহ আমার বিশেষ ছিল না, কিন্তু যন্ত্রের সাহায্যে কিভাবে তাঁতী এই শাড়ী বোনে সেটা দেখার কৌতুহল খুবই ছিল। তাঁতীর বাড়িতে গিয়ে সেই জিনিস দেখলাম এবং দেখে এককথায় মুগ্ধ হলাম। হস্তচালিত তাঁতের সাহায্যে শাড়ী তৈরি আমি আগেও দেখেছি কিন্তু এতরকম সূক্ষাতিসূক্ষ সুতো নিয়ে বালুচরী শাড়ী তৈরি আগে কখনও দেখিনি। সুতোগুলো এতটাই সরু যে খালি চোখে একটা সুতো দেখতে পাওয়া অসম্ভব। মোটামুটি কয়েকশ' সুতো একসঙ্গে করলে সেটা একটা বাচ্চার কড়ে আঙুলের সমান হতে পারে। যাঁর বাড়ি, তিনি এবং তাঁর স্ত্রী এই ব্যবসাটা চালান। ওনাদের অনেকগুলো তাঁতযন্ত্র আছে এবং সেগুলোয় শাড়ী বোনার কর্মচারী আছে। একটা বালুচরী শাড়ী বুনতে মোটামুটি তিন থেকে চারদিন লাগে আর এর দাম ৬,০০০ টাকা থেকে শুরু। মা-মাসি-অমৃতার শাড়ী 'দেখা' হয়ে গেলে আমরা তাঁতীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।

রাতে হোটেলের বাইরে গিয়ে ডিনার করলাম (মা আর সোনামাসি আবার কিছু খেল না)। খরচ হল ২৬৬/- টাকা।

পরেরদিন ১লা নভেম্বর, ২০২১ - আমাদের ফেরার দিন। সকালে হোটেলের বাইরে থেকে ব্রেকফাস্ট করে ঘরে এসে চানটান করে হোটেল থেকে চেক্‌আউট করলাম। এখানে চেক্‌আউটের সময় সকাল ১১টা। হোটেলের ঘরভাড়া আমরা বুকিং-এর সময়ে দিয়ে থাকলেও এখানে ঘরভাড়ার উপর ১২% জিএসটি নেয়, যেটা চেক্‌আউটের সময়ে দিতে হল। হোটেল থেকে বেরিয়ে আমরা প্রথমে গেলাম আমাদের বাকি থাকা দ্রষ্টব্য জায়গাগুলো দেখে ফেলতে।

মদনমোহন মন্দিরটা আমাদের হোটেল থেকে তুলনামূলকভাবে দূরে আর এখানে যাওয়ার রাস্তাটাও চরম সরু। যাওয়ার পথে বাজার গরু বস্তি - সবই পড়ে। গাড়ির চালকের আসনে বিশেষ সুদক্ষ ড্রাইভার না থাকলে এই মন্দির দেখতে যাওয়া জন্য টোটোই ভাল।

মদনমোহন মন্দির
মদনমোহন মন্দির - ঘিঞ্জি রাস্তা দিয়ে একবার পৌঁছতে পারলে এখানে মন্দিরের সামনে যথেষ্ট চওড়া জায়গা আছে যেখানে সচ্ছন্দে গাড়ি পার্কিং করা যায়। মদনমোহন মন্দির ১৬৯৪ খ্রীষ্টাব্দে মল্লরাজ দুর্জন সিংহ তৈরি করেন। এখানেও মন্দিরের গায়ে পৌরাণিক দৃশ্য, যুদ্ধের দৃশ্য রয়েছে। এই মন্দিরে ঠাকুরের মূর্তি আছে এবং এখানে নিয়মিত পুজো হয়।



    
পাথরের রথ
পাথরের রথ - মদনমোহন মন্দির থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম পাথরের রথ দেখতে - যেটা গতকাল দেখা বাকি থেকে গিয়েছিল। পাথরের রথ ছোট পাথরের দরজা থেকে খুবই কাছে। একটা লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা জায়গায় এই রথটা রয়েছে। এটা আনুমানিক সপ্তদশ খ্রীষ্টাব্দে তৈরি করা হয়েছিল। রথটা দোতলা এবং রথের উপরের দিকটার সঙ্গে বিষ্ণুপুরের মন্দিরের মিল আছে।






বিষ্ণুপুর দর্শন শেষ। দুপুর সাড়ে বারোটা বাজে। আমরা এবার রওনা দিলাম স্টেশনের দিকে। বাবাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আমরা গাড়ি নিয়ে ফেরার পথ ধরব।

স্টেশন সংলগ্ন একটা ভাতের হোটেল থেকে দুপুরের খাবার সেরে নেওয়া হল। তারপর বাবা চলে গেল প্ল্যাটফর্মের দিকে আর আমরা এগোলাম কলকাতার দিকে। ফেরার পথে সোনামাসিকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আবার গেলাম শালিমার স্টেশন। সেখান থেকে বাবাকে নিয়ে বাড়ি !

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে সড়কপথে ১৫০ কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক শহর বিষ্ণুপুর। বিভিন্ন মল্লরাজাদের আমলে তৈরি পোড়ামাটির মন্দিরগুলি এখানকার প্রধান আকর্ষণ।

২. কলকাতা থেকে বিষ্ণুপুর গাড়ি নিয়ে গেলে ডানকুনি থেকে প্রথমে এস এইচ পনেরো ও তারপরে এস এইচ দুই ধরে যেতে হয়। ট্রেনে গেলে হাওড়া বা সাঁত্রাগাছি থেকে বিষ্ণুপুরের যাওয়া যায়। 

৩. বিষ্ণুপুরে বেশ কিছু হোটেল আছে, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন বিভাগের বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টি (ভূতপূর্ব বিষ্ণুপুর ট্যুরিস্ট লজ) উল্লেখযোগ্য। এদের ওয়েবসাইট https://wbtdcl.wbtourismgov.in/home থেকে বুকিং করা যায় অথবা কলকাতার বুকিং অফিস থেকেও বুকিং করা যেতে পারে। এখানে গাড়ি পার্কিং-এর সুবন্দোবস্ত আছে।

৪. থাকার জন্য বিষ্ণুপুর ট্যুরিজম প্রপার্টি রেকমেন্ড করলেও খাবার এদের কাছ থেকে না নেওয়াই ভালো। এদের খাবার ওভারপ্রাইসড এবং রান্নাও অতি সাধারণ মানের। খাওয়ার জন্য এর আশেপাশেই অনেকগুলো হোটেল বা রেস্ট্যুরেন্ট আছে।

৫. বিষ্ণুপুরের প্রধান আকর্ষণ পোড়ামাটি বা টেরাকোটার মন্দির। মোটামুটি ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৭৪২ খ্রীষ্টাব্দের বিভিন্ন মল্লরাজাদের সময়ে নির্মিত এই মন্দিরগুলোর খ্যাতি মূলতঃ এদের গায়ের পোড়ামাটির কাজের জন্য।

৬. বিষ্ণুপুরের প্রায় সব মন্দিরই ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ রক্ষণাবেক্ষণ করে। এর মধ্যে শুধুমাত্র রাসমঞ্চ, শ্যামরায় মন্দির আর জোড়বাংলা মন্দিরে ঢোকার জন্য টিকিট লাগে।

৭. রাসমঞ্চ, শ্যামরায় মন্দির আর জোড়বাংলা মন্দির - এই তিনটে জায়গা মিলিয়ে মাথাপিছু ২০/- টাকা করে টিকিট কাটতে হয়। টিকিট কাটার কোনও কাউন্টার নেই, মোবাইলের সাহায্যে কিউআর কোড স্ক্যান করে কাটতে হয়।

৮. বিষ্ণুপুরের সবকটা মন্দিরই খুব কাছাকাছি জায়গায়। নিজেদের গাড়ি থাকলে গাড়িতে, না থাকলে টোটোয় এমনকি হেঁটেও সবকটা জায়গা আনায়াসে ঘোরা যেতে পারে।

৯. পুরো বিষ্ণুপুর ঘুরে দেখতে ঘন্টা তিনচারেকের বেশি লাগে না। তাই চাইলে বিষ্ণুপুর ডে-আউট বা 1N/2D ট্রিপও করা যেতে পারে।

১০. বিষ্ণুপুরের বালুচরী শাড়ী খুবই বিখ্যাত। এখানে তৈরি শাড়ী সারা দেশে এমনকি বিদেশেও রপ্তানী হয়। তাঁতীর বাড়িতে গিয়ে হস্তচালিত তাঁতযন্ত্রের সাহায্যে এই শাড়ী বোনা দেখা যেতে পারে।

১১. বিষ্ণুপুরের আরেকটা বিখ্যাত জিনিস হল এখানকার পোড়ামাটির ঘোড়া। এখানে বিভিন্ন আকারের পোড়ামাটির ঘোড়া পাওয়া যায় যা ঘর সাজানোর জন্য সংগ্রহ করা যেতে পারে।

১২. বিষ্ণুপুর যাওয়ার সবথেকে ভালো সময় হল অক্টোবর থেকে মার্চ, কিন্তু তার মানে এই নয় যে অন্য সময়ে যাওয়া যায় না। তবে যেহেতু রোদে ঘুরে মন্দির দেখতে হবে, তাই গরমকালটা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।

উপসংহারঃ

পোড়ামাটির ঘোড়া
কলকাতা থেকে মাত্র দেড়শো কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক শহর বিষ্ণুপুর। মল্লরাজাদের যুগে তৈরি পোড়ামাটির মন্দির এখানকার প্রধান আকর্ষণ। খুবই অল্প জায়গায় কাছাকাছির মধ্যে ডজনখানেকের বেশি মন্দির দেখে বোঝা যায় মল্লরাজাদের কীর্তিকলাপ মূলতঃ এইসব জায়গাতেই ছিল। একটা মন্দির দেখে দু'পা হাঁটতেই আরেকটা মন্দির - আবার সেটার থেকে চোখ ফেরাতেই আরেকটা মন্দির। দেখতে দেখতে 'সোনার কেল্লা'র মন্দার বোসের মতো করে বলতে ইচ্ছে করে - "এরা তো দেখছি যেখানে ফাঁক পেয়েছে, সেখানেই একটা করে মন্দির গুঁজে রেখেছে !" মল্লরাজারা ছিলেন কৃষ্ণের পূজারী, তাই প্রায় সব মন্দিরগুলোই কৃষ্ণ বা বিষ্ণুর। আর সেই থেকেই জায়গার নাম বিষ্ণুপুর। মন্দিরগুলোর আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল এগুলো প্রায় একইরকম দেখতে। এইসব মন্দির আধ্যাত্মিক দিক থেকে সমৃদ্ধ নয়, এর সমৃদ্ধি শৈল্পিক। পৌরাণিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এর গুরুত্ব ঐতিহাসিক। আর্থিক দিক থেকে জমকালো নয়, এর জাঁকজমক নেহাৎই সাদামাটা। আর এগুলোই এখানকার আকর্ষণ। আমার বিষ্ণুপুর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে এই আকর্ষণ যদি কিছুটা হলেও অনুভব করা যায়, তাহলে বাঁকুড়া জেলার এই শহরে একটা ছোট্ট ট্রিপ করে আসা অবশ্যকর্তব্য !

বিষ্ণুপুর ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

Tuesday, September 21, 2021

দীঘা ভ্রমণ

গেও বলেছি বাঙালীর তিনটে ঘোরার জায়গা দী-পু-দা সম্পর্কে আমার ব্লগে কখনও লিখব না। পু অর্থাৎ পুরী আর দা অর্থাৎ দার্জিলিঙ এর আগেই হয়ে গেছে, বাকি ছিল শুধু দী অর্থাৎ দীঘা। দীঘা আমি এর আগেও চারবার গেছি, কিন্তু শেষবার যখন গেছি তখনও ব্লগ লিখতাম না। এবারেও দীঘায় গিয়ে সেরকম নতুন এমন কিছুই দেখিনি যা জানানোর জন্য একটা পূর্ণদৈর্ঘ্যের ব্লগ লেখার দরকার হতে পারে। তাই পুরী আর দার্জিলিঙের মতো দীঘা ভ্রমণেও থাকছে শুধুমাত্র ভ্রমণপথ, ভ্রমণের সারসংক্ষেপ আর উপসংহার।

বিশেষ সতর্কীকরণঃ

১. এই ভ্রমণে আমরা জনবহুল স্থানে, বিশেষতঃ স্টেশনে, ট্রেনে ইত্যাদি জায়গায় সারাক্ষণ মাস্ক পরে থেকেছি এবং দূরত্ববিধি যথাসম্ভব মেনে চলার চেষ্টা করেছি। সেইসঙ্গে প্রয়োজনমতো হ্যান্ড স্যানিটাইজারও ব্যবহার করেছি।

২. এই ভ্রমণে আমরা কোনও অবস্থাতেই কোনও পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার করিনি। অর্থাৎ প্লাস্টিকের ব্যবহার না করেও এই ভ্রমণ অনায়াসে করা যায়।

৩. এই ভ্রমণে আমরা কোনও কাগজ ব্যবহার বা নষ্ট করিনি। হোটেল বুকিং-এর রশিদ-এর প্রিন্ট আউট ব্যবহারের কোনও প্রয়োজন হয় না।

৪. এই ভ্রমণে আমাদের দলের কেউ ধূমপান করেনি। ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।

আমার ব্লগের সমস্ত পাঠকদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে করোনা ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করার জন্য সরকারী বিধিনিষেধ মেনে চলার জন্য। সেইসঙ্গে অনুরোধ করছি প্লাস্টিক, অপ্রয়োজনীয় কাগজের ব্যবহার আর ধূমপান বর্জন করার জন্য।

ভ্রমণপথঃ

রবিবার ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ঃ হাওড়া স্টেশন থেকে সকাল ৬ঃ৫০ মিনিটে হাওড়া দীঘা স্পেশাল ট্রেন - সকাল ১০ঃ১০ মিনিটে দীঘা। নিউ দীঘায় রাত্রিবাস।

সোমবার ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ঃ নিউ দীঘা থেকে ওল্ড দীঘায় গিয়ে ঘন্টাখানেক ঘোরা। নিউ দীঘায় রাত্রিবাস।

মঙ্গলবার ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ঃ দীঘা থেকে দুপুর ১২ঃ৩০ মিনিটে দীঘা হাওড়া স্পেশাল ট্রেন (সঠিক সময় সকাল ১০ঃ৩৫ মিনিট) - দুপুর ৩ঃ৩০ মিনিটে সাঁত্রাগাছি (ট্রেনটা সাঁত্রাগাছি থেকে হাওড়া পর্যন্ত বাতিল হয়ে গিয়েছিল)।

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে সড়কপথে নিউ দীঘার দূরত্ব ১৮৫ কিলোমিটারের মতো। ওল্ড দীঘার দূরত্ব এর থেকে ১.৫ কিলোমিটার কম।

২. কলকাতার বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন সময়ে দীঘা যাওয়ার জন্য বাস ছাড়ে। বাসে দীঘা যেতে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা সময় লাগে।

৩. দীঘা যাতায়াতের জন্য হাওড়া থেকে দৈনিক দু'টো করে ট্রেন চলে। যেতে ৩ঃ২০ ঘন্টার মতো সময় লাগে।

৪. দীঘা স্টেশনটা প্রকৃতপক্ষে নিউ দীঘায়। স্টেশনের কাছাকাছির মধ্যেই অনেকগুলো হোটেল আছে। স্টেশন থেকে টোটো করে অথবা হেঁটে হোটেলে যাওয়া যায়।

৫. দীঘায় আমরা যে হোটেলে ছিলাম তার নাম 'হোটেল আমার দীঘা'। এদের ওয়েবসাইট http://www.hotelamardigha.com/ থেকে বুকিং করা যায় অথবা https://www.makemytrip.com/ থেকেও বুকিং করা যায়। হোটেলের যোগাযোগের নম্বরঃ 9874778528.

৬. 'হোটেল আমার দীঘা' খুবই ভালো একটা হোটেল। এর ঘর থেকে সমুদ্র দেখা না গেলেও এখান থেকে সমুদ্র হেঁটে মিনিট পাঁচেকের বেশি লাগে না। হোটেলের পরিষেবা এবং খাবার খুবই উন্নত মানের।

৭. দীঘার সমুদ্রের পাড় বাঁধানো আর এখানে বসে বসে সমুদ্রের শোভা উপভোগ করা যায়। জোয়ারের সময়ে জলের টান বেশি থাকলে অবশ্য এখানে পুলিশ বসতে দেয় না।

৮. দীঘা থেকে কাছাকাছির মধ্যে তালসারিতে ঘুরে আসা যায়। যাতায়াতের পথে চন্দনেশ্বর মন্দির পড়ে, সেটাও দেখে নেওয়া যেতে পারে। এই দু'টো জায়গাই উড়িষ্যার মধ্যে।

৯. দীঘা স্টেশনের একেবারে কাছে রয়েছে অমরাবতী লেক ও পার্ক। এখানে বোটিং, রোপওয়ের ব্যবস্থা আছে।

১০. নিউ দীঘার বিচের কাছে একটা মার্কেট আছে, এখানে সবধরনের জিনিসই পাওয়া যায়। এখান থেকে প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় নানারকম জিনিস কেনা যেতে পারে।

১১. নিউ দীঘার বীচের একেবারে পাশেই সরকারী লিজ নেওয়া একটা রেস্ট্যুরেন্ট আছে। এখানে সস্তায় অত্যন্ত ভালো মানের খাবার পাওয়া যায়।

১২. দীঘার সমুদ্রে জোয়ারের জলোচ্ছাস দেখার আগ্রহ থাকলে অবশ্যই পূর্ণিমা বা অমাবস্যায় যাওয়া উচিৎ। অমাবস্যায় জলোচ্ছাসের মাত্রা পূর্ণিমার থেকে বেশি ঠিকই, কিন্ত পূর্ণিমার সন্ধ্যে থেকে রাত পর্যন্ত জলের উপর চাঁদের আলোর সৌন্দর্যও কিছু কম আকর্ষক দৃশ্য নয়।

উপসংহারঃ

দীঘার সমুদ্রসৈকত
বাঙালীদের মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় ঘোরার জায়গা যদি পুরী হয়, তাহলে দীঘা নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। দীঘা যাতায়াতের খরচ পুরীর থেকে কম কিন্তু দীঘায় সেরকম কোনও বড় মন্দির না থাকায় এর কোনও ঐশ্বরিক আকর্ষণ নেই। একসময়ে দীঘার খ্যাতি ছিল হানিমুনের জন্য, আজকাল মূলতঃ সপ্তাহান্তের ঘোরার জায়গায় পরিণত হয়েছে। দীঘা যাওয়ার জন্য কোনও প্রস্তুতি লাগে না, ট্রেনের বুকিং অথবা বাসের টিকিট সহজেই পাওয়া যায়। নিজের গাড়ি নিয়ে গেলেও সহজেই যাওয়া যায়। দীঘায় আগে থেকে বুকিং না করে গেলে ঘর পেতেও কোনও অসুবিধে হয় না। কম খরচে নির্ঝঞ্ঝাটে সমুদ্রসৈকতে দু'তিনদিন কাটানোর জন্য দীঘা একেবারে আদর্শ জায়গা। পুরী বা দার্জিলিঙের মতো দীঘাও বছরের যেকোনও সময়ে যাওয়া যায় আর এখানে সবকিছুই খুব সহজে পাওয়া যায়। পুরীর মতো এখানেও "ঘুরে খুব ভালো লাগল" এটা আমি কখনও কারুর মুখে যেমন শুনিনি, তেমনই "দূর দূর, দীঘা আবার একটা যাওয়ার মতো জায়গা হল ?" এরকম বলতেও কাউকে শোনা যায় না। তাই জীবনে কখনও দীঘায় না গিয়ে থাকলে (যেটার সম্ভাবনা খুবই কম) অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য একবার যেতে সব বাঙালিকেই অনুরোধ করব।

দীঘা ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

Sunday, September 12, 2021

কলকাতা ভ্রমণ : পর্ব - ৫ (নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম)

লকাতা ভ্রমণের প্রথম পর্ব চিড়িয়াখানা ভ্রমণের পোস্টে লিখেছিলাম "কলকাতার চিড়িয়াখানা প্রায় সব্বাই ছোটবেলায় একবার করে যায় আর বহু লোকের ক্ষেত্রে দেখেছি বড় হয়ে আর কিছুতেই যাওয়া হয়ে ওঠে না"। কলকাতার নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামের ক্ষেত্রেও বোধহয় একই কথাই প্রযোজ্য, যদিও চিড়িয়াখানায় যত লোক ছোটবেলায় যায় তত লোক বোধহয় নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামে যায় না। আমি  এখানে ছোটবেলায় বারদুয়েক গেছি আর তারপর বড় হয়ে কখনও যাওয়া হয়নি। এবারে গেলাম - প্রধানতঃ আমার দুই কন্যাকে তাদের ছোটবেলার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করাতে (যাতে বড় হয়ে ওরাও একই ধরনের কথা বলতে পারে !)। কলকাতা ভ্রমণের এই পর্বে থাকছে সেই নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামে আমাদের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।

১২ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ - রবিবার আমরা নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম পৌঁছলাম দুপুর চারটে পনেরো নাগাদ। নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে (সোমবার বন্ধ)। এবারে আমরা সাতজন - আমরা ছ'জন ছাড়া আমাদের সঙ্গে টুটুন। নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামের অবস্থান জওহরলাল নেহেরু রোডে - এক্সাইডের মোড় থেকে এস্‌প্ল্যানেডের দিকের রাস্তা অর্থাৎ জওহরলাল নেহেরু রোড ধরে মিনিট খানেক হাঁটলে বাঁদিকে মিউজিয়ামটা পড়ে। এখানে রাস্তার উপরেই গাড়ি পার্কিং করা যায়।

নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামের ঢোকার টিকিট বড়দের মাথাপিছু ২০/- টাকা আর ছোটদের (১৬ বছরের নিচে) মাথাপিছু ১০/- টাকা। টিকিট কেটে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। পুরো বাড়িটা ছ'তলা যদিও দেখার জিনিস শুধুমাত্র দোতলা, তিনতলা আর চারতলায়। এখানকার দেখার জিনিসগুলোকে মোটামুটি চারভাগে ভাগ করা যায় - পুতুলের গ্যালারি, গণেশের গ্যালারি, রামায়ণ আর মহাভারত। এর মধ্যে পুতুলের গ্যালারি সবতলাতেই আছে, মহাভারত আছে তিনতলায় আর রামায়ণ আর গণেশ চারতলায়।

পুতুলের গ্যালারি
পুতুলের গ্যালারি -
 নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামের পুতুলের গ্যালারিতে পুতুলের সম্ভার দেখে তাজ্জব বনে যেতে হয় ! ঘরের চারদিকের দেওয়ালে এবং মাঝখানে বিশাল কাচের শোকেসে এই পুতুলগুলো রাখা হয়েছে। দেশ-বিদেশের নানারকমের পুতুল রয়েছে এই গ্যালারিতে। বিভিন্ন আকারের, বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়ানো বসা শোওয়া এইসব পুতুলগুলো বিভিন্ন দেশের বা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের শিল্পকলার অসাধারণ নিদর্শন। দুর্গার মূর্তি থেকে ইংরেজ বণিক, ব্রাহ্মণ পুরোহিত থেকে মিজোরামের রাজকন্যা, জার্মান থেকে রাশিয়ার পুতুল - সবই রয়েছে এইসব পুতুলের ঘরগুলোতে। একটা একটা করে সবকটা পুতুল দেখা সম্ভব নয়, তবে প্রত্যেকটা পুতুলই দেখতে যে খুবই সুন্দর - সেটা বলতেই হবে। এখানে চাইলে নিজের কাছে থাকা পুতুল দিয়েও দেওয়া যায়, এরা সেগুলো এই সংগ্রহের মধ্যে রেখে দেবে। বিভিন্ন দেশের সরকার থেকে এখানে বিভিন্ন পুতুল উপহার দেওয়া হয়েছে, সেগুলো এখানে লেখাও রয়েছে।

অর্জুনের লক্ষ্যভেদ
মহাভারত -
 দোতলা আর তিনতলার পুতুলের গ্যালারির পরে আমরা গেলাম তিনতলার মহাভারত গ্যালারি দেখতে। এখানে একটা বিশাল ঘরের মধ্যে মহাভারতের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনার মডেল তৈরি করে কাচের শোকেসের মধ্যে রাখা রয়েছে। শোকেসের সামনে দেওয়ালের উপরদিকে সেই ঘটনার বিবরণ লেখা হয়েছে। এইসব ঘটনার মধ্যে পাশা খেলা, পান্ডবদের বনবাস, অর্জুনের লক্ষ্যভেদ, মহাভারতের যুদ্ধ, ভীষ্মের শরসজ্জা ইত্যাদি অনেক কিছুই রয়েছে। আমার মতে মহাভারত সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য - এর মতো এত ঘটনাবহুল কাব্যগ্রন্থ পৃথিবীতে আর আছে বলে আমার জানা নেই। সেই মহাভারতের ঘটনাবলীর এত সুন্দর মডেল দেখতে খুবই ভালো লাগছিল। শুধু আমরা বড়রা নই, মহাভারতের বিস্তারিত গল্প কথা-কলিও জানে, তাই ওরাও মডেলগুলো দেখে নিজেরাই কোনটা কি বলে যাচ্ছিল।

রাবণের সীতাহরণ
রামায়ণ -
 চারতলায় রামায়ণ গ্যালারি। মহাভারতের মতো এখানেও বিশেষ বিশেষ ঘটনাবলীর মডেল তৈরি করে কাচের শোকেসে রাখা রয়েছে। রামের হরধনু ভঙ্গ, রাবণের সীতাহরণ, হনুমানের লঙ্কাকান্ড ইত্যাদি নানারকম ঘটনার মডেল রয়েছে এখানে। ব্যক্তিগতভাবে আমার রামায়ণ যদিও সেরকম কিছু ভালো লাগে না (বলতে চাইছি পোষায় না), কিন্তু তাও গ্যালারিটা খুবই ভালো লাগল।









গণেশের গ্যালারি
গণেশ গ্যালারি -
 চারতলায় রামায়ণ গ্যালারি থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার আগে বাঁদিকে গণেশের গ্যালারি। এখানে অনেকগুলো ছোট ছোট নানাধরনের গণেশের মূর্তি রয়েছে। অনেকগুলোই বেশ মজাদার, যেমন - ফুটবলার গণেশ, ব্রাহ্মণ গণেশ, স্কুলবয় গণেশ, পুলিশ গণেশ ইত্যাদি। এছাড়া কয়েকটা চিরাচরিত গনেশের মূর্তিও রয়েছে। এইসব দেখে আমরা নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে এলাম।

উপসংহারঃ

মিউজিয়ামের পুতুলের সামনে আমার দুই পুতুল !
কলকাতা শহরে ছোটদের দেখার মতো যে কয়েকটা জায়গা রয়েছে, তার মধ্যে নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এখনকার দিনের মা-বাবারা বাচ্চাদের এখানে কতটা নিয়ে যান জানি না, তবে গেলে বাচ্চাদের ভালো লাগারই কথা। আমার ছোটবেলায় আমার ভালো লাগত, কথা-কলির ছোটবেলায় ওদেরও ভালো লেগেছে। পুরো মিউজিয়ামটা দেখতে ঘন্টাদেড়েকের মতো লাগে, তাই কোনও একটা ছুটির দিনে এখানে গেলে সময়টা ভালোই কাটবে। নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামে শুধুমাত্র চারধরনের গ্যালারি ছাড়াও ছোটদের আঁকা, আবৃত্তি, নাচ, গান, ম্যাজিক, নাটক শেখানো হয়। কেউ নিজের ছেলেমেয়েকে এসব শেখাতে চাইলে এখানে যোগাযোগ করতে পারেন (নাও পারেন, আপনার ইচ্ছে !)। তবে ছোটবড় নির্বিশেষে এই মিউজিয়ামটা একবার দেখে আসার জন্য সবাইকেই অনুরোধ করছি।

নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

কলকাতা ভ্রমণ : পর্ব - ৪ (জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি)

লকাতা শহরের প্রথম পাঁচটা দ্রষ্টব্য জায়গা কি কি - এই প্রশ্নের উত্তরে যে যাইই বলুক, তার মধ্যে যে নামটা থাকবেই সেটা হল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মস্থান ও বাসস্থান হিসেবে ঐতিহাসিক ও পর্যটনের দিক থেকে এই বাড়ির গুরুত্ব অপরিসীম। ছোটবেলা থেকে অনেকবার বিভিন্ন সময়ে এখানে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হলেও শেষ পর্যন্ত আমার আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাই এই করোনা পরিস্থিতিতে নিজের শহরটাকে দেখে নেওয়ার যে প্রকল্প আমরা শুরু করেছি, তার মধ্যে এবারে সংযোজন হল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি।

যাওয়ার দিন ১২ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ - আমরা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি পৌঁছলাম তখন দুপুর ১২ টা। ঠাকুরবাড়ি সোমবার বন্ধ থাকে। বাকি দিনগুলো সকাল ১০ঃ৩০ মিনিট থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জন্য খোলা থাকে। এবারে আমাদের দল সাতজনের - আমরা ছ'জন ছাড়া আমাদের সঙ্গে টুটুন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ভৌগোলিক অবস্থান জানেনা এরকম মানুষ বোধহয় কলকাতায় নেই, তবে আমার ব্লগের কলকাতার বাইরের (বা পশ্চিমবঙ্গের বাইরের বা ভারতবর্ষের বাইরের !) পাঠক/পাঠিকাদের জন্য জানাচ্ছি জায়গাটা গণেশটকি বা সিংহীবাগান অঞ্চলে আর গিরীশপার্ক মেট্রো স্টেশন থেকে খুবই কাছে। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ঢোকার দরজাটা চিৎপুর রোডের উপরে। এখানে গাড়ি পার্কিং-এর জায়গাও আছে। তবে ভীড়ের দিনে গেলে পার্কিং-এর জায়গা পাওয়া সহজ হবে না কারণ এখানে জায়গা সীমিত।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। গেটের পাশে টিকিট কাউন্টার। মাথাপিছু ২০/- টাকা করে টিকিট কেটে (বাচ্চাদের লাগে না) আমরা ভিতরে ঢুকলাম। এখানে জানিয়ে রাখি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ছবি তুলতে গেলে তার জন্য আলাদা করে টাকা দিতে হয়। আর এঁরা সেই ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। ভিতরে কোথাও লুকিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করাও উচিৎ নয় কারণ সর্বত্র সি সি ক্যামেরা লাগানো আছে। আমরা ভিতরে কোনও ছবি তুলিনি, কারণ আমরা টাকা দিইনি।

ঠাকুরবাড়িতে ঢোকার আগে
টিকিট কেটে আমরা প্রথমে গেলাম টিকিট কাউন্টারের ঠিক পিছনে ঠাকুরবাড়ির গ্যারেজের দিকে। এখানে রবীন্দ্রনাথ ব্যবহৃত ১৯৩৩ সালের হাম্বার সিডান গাড়িটা রাখা আছে। গাড়ি দেখার পর ভিতরের বিশাল মাঠের পাশ দিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম লাল রঙের মূল বাড়িটার দিকে। বাড়িতে ঢোকার মুখে একটা সিঁড়ি আছে, সেখানে সবাইকে জুতো খুলতে হয়। তারপর আমরা প্রবেশ করলাম এই ঐতিহ্যমন্ডিত ঠাকুরবাড়ির ভিতরে।

ঠাকুরবাড়ির একতলায় কিছু দেখার নেই, সব দর্শনীয় জায়গাগুলো দোতলা আর তিনতলায়। তাছাড়া চারতলার ছাদেও যাওয়া যায়, যদিও সেখানে দেখার কিছু নেই। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে আমরা একের পর এক ঘরগুলো দেখতে থাকলাম। ঠাকুরবাড়ি প্রকৃতপক্ষে একটা অত্যন্ত ধনী জমিদারবাড়ি, তাই এখানে তাঁদের ব্যবহৃত সবকিছুর মধ্যেই আভিজাত্য ও বিলাসিতার ছাপ সুস্পষ্ট। কোনঘরে গিয়ে কি দেখলাম সেটা আর আলাদা করে লিখছি না, তবে এটা বলতেই হবে যে বিশ্বভারতী এখানকার সবকিছু অত্যন্ত সুন্দরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করে। রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর, শোওয়ার ঘর, বসার ঘর ইত্যাদি দেখে আমরা একটা ঘরে ঢুকলাম যেখানে রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল (ডাক্তারদের মধ্যে ছিলেন স্বয়ং বিধানচন্দ্র রায়)।

ভিতরের বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আরও কয়েকটা ঘর দেখলাম যেখানে নানারকম ছবি ইত্যাদি সংগ্রহ করা হয়েছে। তারপর আরও কয়েকটা ঘর দেখলাম যেখানে একটা ঘরের মধ্যে দিয়ে আরেকটা ঘরে যেতে হয়, সেটার ভিতর দিয়ে আরেকটা ঘরে যাওয়া যায় আর সেটার ভিতরে দিয়ে আরেকটা ঘরে যাওয়া যায়। সত্যি বলতে কি, বাড়িটা এতটাই বড় আর সেইসঙ্গে ভিতরের ম্যাপটাও বেশ জটিল। হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই, কিন্তু ভিতরে ঢুকে "কোন ঘরটা দেখলাম আর কোনটা বাকি রয়ে গেল" এটা হিসেব রাখা সহজ নয়। এই শেষের ঘরগুলো রবীন্দ্রনাথের বিদেশভ্রমণ সংক্রান্ত। রবীন্দ্রনাথ বেশ অনেকবার বিদেশে গিয়েছিলেন - এই ঘরগুলোতে প্রধানতঃ তাঁর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ভ্রমণের সময়কার ছবি ও তথ্য রাখা আছে। সব ছবির লাগোয়া সবলেখা পড়া সম্ভব হয়নি, কারণ গেটে ঢোকার সময়ে আমাদের বলা হয়েছে একঘন্টার মধ্যে পুরোটা দেখে নেমে আসতে।

এরপর আমরা গেলাম একটা ঘরে সেখানে ঠাকুরবাড়ি বিভিন্ন ব্যক্তিদের পূর্ণ তৈলচিত্র আঁকা রয়েছে। আর এখানেই দেখতে পেলাম সেই মহান ব্যক্তির তৈলচিত্র - যিনি ঠাকুরবাড়িতে আমার আসার মূল অনুপ্রেরণা। তিনি এই বাড়ির নির্মাতা না হলেও আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট বাড়িটিকে তিনিই সুবিশাল জমিদারবাড়ির আকার দিয়েছিলেন। একজন সাধারণ জমিদার হিসেবে জীবন শুরু করে আজ থেকে প্রায় দু'শো বছর আগে যিনি বাঙালিদের মধ্যে তো বটেই, সম্ভবতঃ ভারতবর্ষেরও সবথেকে ধনী ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিলেন। জমিদারী, কয়লা, ব্যাঙ্কিং, ইন্সিওরেন্স, চটকল, চা, আফিম, জাহাজ ইত্যাদি আরও নানারকম জিনিসের ব্যবসা করে সেই যুগে যাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল কোটি টাকার উপরে (আজকালকার দিনের টাটা-আম্বানীদের থেকেও বেশি !)। যিনি রাজা রামমোহন রায়ের প্রায় সমস্ত সমাজসংস্কারমূলক কাজে ছিলেন তাঁর ছায়াসঙ্গী। যিনি মেডিক্যাল কলেজ, হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠার মতো যেকোনও উন্নয়নমূলক আর সৃজনশীল কাজে সবসময়ে অকাতরে অর্থব্যয় করেছেন কিন্তু নিজে থেকেছেন প্রচারবিমুখ। যিনি ব্রাহ্মসমাজের শুরু থেকে ছিলেন তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। যিনি পরাধীন দেশের একজন নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও ইংল্যান্ডে স্বয়ং মহারাণী ভিক্টোরিয়ার আমন্ত্রণে তাঁর প্রাসাদে গিয়ে তাঁর আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন - যে সম্মান সেই যুগে খোদ ইংল্যান্ডের বহু অভিজাত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরাও পেতেন না। যিনি ছিলেন ফ্রান্সের সম্রাটের বন্ধু ও প্রিয়পাত্র। আমার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি যাওয়ার প্রধান কারণ সেই ব্যক্তির বাসস্থান দর্শন করা - তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর - এমন একজন 'প্রিন্স' যাঁর বাবা কোনও 'কিং' ছিলেন না !

এই শেষ লাইনটার জন্য আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই রাজা ভট্টাচার্য রচিত 'দ্বারকানাথ' বইটির নাম। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর সম্পর্কে কিছু তথ্য আমি জানতে পারি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সেই সময়' উপন্যাসে। মাস ছয়েক আগে রাজা ভট্টাচার্যের এই 'দ্বারকানাথ' বইটা থেকে আমি দ্বারকানাথ ঠাকুর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি। 'সেই সময়' পড়ে যে মানুষটির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা জন্মেছিল, 'দ্বারকানাথ' পড়ে তাঁকে মনে মনে ঠাকুরের আসনে বসিয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথ কারুর কারুর কাছে ঠাকুর, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কারুর কারুর কাছে ঠাকুর। ঠিক সেভাবেই প্রিন্স দ্বারকানাথ আমার কাছে ঠাকুর - 'বাঙালির দ্বারা ব্যবসা হয়না' প্রচলিত এই ধারণার গালে যিনি নিজেই একটি সপাট চড় ! আমার ব্লগের পাঠক/পাঠিকাদের মধ্যে যাঁদের বই পড়ার একটুআধটু অভ্যেস আছে, রাজা ভট্টাচার্যের 'দ্বারকানাথ' বইটা অবশ্যই পড়ার জন্য তাঁদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। অত্যন্ত যত্নসহকারে পড়ে অক্ষত অবস্থায় ফেরৎ দেওয়ার অঙ্গীকার করলে আমি বইটা ধার দিতেও রাজী আছি।

দ্বারকানাথের তৈলচিত্র আর তাঁর ব্যবহৃত কিছু জিনিস দেখার পরে বাকি সবকিছু কেমন ফিকে লাগছিল। এরপর আমরা দোতলা থেকে তিনতলায় গিয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পকলার কিছু নমুনা দেখলাম। তিনতলার বারান্দা থেকে সামনের মাঠের দৃশ্য দেখতে বেশ সুন্দর লাগে। ঠাকুরবাড়ির একটা অংশে কিছু লোকজন থাকে আর কিছু অংশে বিশ্বভারতীর কাজকর্ম হয় বলে সেই অংশগুলোতে সাধারণ মানুষকে যেতে দেওয়া হয় না। আমরা ছাদটা একবার দেখে নিয়ে নিচে নেমে এলাম।

বাড়ির ভিতরের উঠোন
বাড়ির ভিতরের উঠোনে একটা নাটমন্দির গোছের আছে, যেখানে চাইলে ছবি তোলা যেতে পারে। এই জায়গাতেই প্রতিবছর পঁচিশে বৈশাখ বিচিত্রানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এখানে এমনিতে দেখার সেরকম কিছু নেই, তাই আমরা কিছুক্ষণ বসে দু'একটা ছবি তুলে বেরিয়ে এলাম। ঠাকুরবাড়ির গেটের কাছ থেকে পুরো বাড়িটার ছবি তোলা যেতে পারে, যদিও এখানকার লোকজন সেটা ভালোভাবে নেয় না। যাই হোক আমাদের সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাই আমরা এবার বেরিয়ে এলাম জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে।

উপসংহারঃ

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে বিভিন্ন সময়ে অনেক বিশিষ্ট মানুষেরা জন্ম নিয়েছেন। প্রিন্স দ্বারকানাথের জ্যেষ্ঠপুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বাবার মতো ব্যবসায়ী না হলেও ছিলেন ধনী জমিদার ও ব্রাহ্মসমাজের প্রাণপুরুষ। তাঁর পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন দার্শনিক ও কবি। আরেক পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ প্রথম ভারতীয় যিনি সিভিল সার্ভিসে চাকরি পেয়েছিলেন। আরেক পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর বাবার সঙ্গে জমিদারীর দেখাশোনা ছাড়াও নিজে একটি জাহাজ চালাতেন। অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ শিল্পকলা ও ছবি আঁকায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ঠাকুরবাড়ির মহিলা সন্তানদের মধ্যেও অনেক কৃতী সন্তান জন্মেছেন। আর সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ - যাঁর সম্পর্কে যে কোনও কথাই সর্বজনবিদিত, তাই আলাদা করে আর কিছু লিখছি না। এঁদের সবার বাড়ি - জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। এই বাড়ির প্রতিটি কোণায় রয়েছে এইসমস্ত স্বনামধন্য মানুষদের কীর্তিকলাপের নিদর্শন। এঁদের সম্পর্কে আমরা বইতে যাইই পড়ে থাকি, এই বাড়িতে গিয়ে সেগুলো চাক্ষুস দেখার অভিজ্ঞতাই আলাদা। তাই এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য অবশ্য গন্তব্য জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি !

Monday, March 15, 2021

বরন্তি ভ্রমণ

বিশেষ সতর্কীকরণ ঃ

১. এই ভ্রমণে আমরা জনবহুল স্থানে, বিশেষতঃ স্টেশনে, ট্রেনে ইত্যাদি জায়গায় সারাক্ষণ মাস্ক পরে থেকেছি এবং দূরত্ববিধি যথাসম্ভব মেনে চলার চেষ্টা করেছি । সেইসঙ্গে প্রয়োজনমতো হ্যান্ড স্যানিটাইজারও ব্যবহার করেছি ।

২. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও অবস্থাতেই কোনও পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার করিনি । অর্থাৎ প্লাস্টিকের ব্যবহার না করেও এই ভ্রমণ অনায়াসে করা যায় ।

৩. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও কাগজ ব্যবহার বা নষ্ট করিনি । হোটেল বুকিং-এর রশিদ-এর প্রিন্ট আউট ব্যবহারের কোনও প্রয়োজন হয় না ।

৪. এই পুরো ভ্রমণে আমাদের দলের কেউ ধূমপান করেনি । ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর ।

আমার ব্লগের সমস্ত পাঠকদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে করোনা ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করার জন্য সরকারী বিধিনিষেধ মেনে চলার জন্য । সেইসঙ্গে অনুরোধ করছি প্লাস্টিক, অপ্রয়োজনীয় কাগজের ব্যবহার আর ধূমপান বর্জন করার জন্য ।

ভ্রমণপথ ঃ

শনিবার ১৩ই মার্চ, ২০২১ঃ হাওড়া থেকে সকাল ৮ টায় হাওড়া নিউ দিল্লী স্পেশাল ট্রেন - সকাল ১০ঃ৪০ মিনিটে আসানসোল । আসানসোল থেকে একঘন্টা গাড়িতে বরন্তি । বরন্তিতে রাত্রিবাস ।

রবিবার ১৪ই মার্চ, ২০২১ঃ বরন্তির লোক্যাল সাইট সিয়িং । বরন্তিতে রাত্রিবাস ।

সোমবার ১৫ই মার্চ, ২০২১ঃ বরন্তি থেকে গাড়িতে আসানসোল । আসানসোল থেকে সকাল ১০ঃ৪৩ মিনিটে পাটনা হাওড়া স্পেশাল ট্রেন - দুপুর ১ঃ১০ মিনিটে হাওড়া ।

রন্তি (স্থানীয় মানুষের উচ্চারণে বড়ন্তিও বলা যেতে পারে, কিন্তু কোনওভাবেই বারান্তি নয় !)। কলকাতা থেকে ঘন্টা তিনেকের দূরত্বে পুরুলিয়া জেলায় পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একটা গ্রাম । করোনার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সুদীর্ঘদিন বাড়িতে বসে থাকার পরে ট্রেনে করে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা যখনই করলাম, এই জায়গাটার কথা মাথায় এল । তার একটা কারণ এখানে যাতায়াতটা বেশ সহজসাধ্য, আর অন্য কারণ হল জায়গাটা ফাঁকা ফাঁকা । এই বরন্তিতে দু'দিনের অভিজ্ঞতা নিয়েই আমার ব্লগের এবারের পোস্ট ।

কলকাতা থেকে বরন্তির দূরত্ব ২৪০ কিলোমিটারের মতো  - গাড়িতে ঘন্টা চারেক । টানা গাড়িতেও যাওয়া যায় (যেটা অনেকেই করেন) আবার ট্রেনেও যাওয়া যায় । আমরা অবশ্য ট্রেনেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম । কাঁটায় কাঁটায় সকাল আটটার সময়ে হাওড়া থেকে হাওড়া - নিউ দিল্লী স্পেশাল ট্রেন যখন ছাড়ল, তখন সত্যিই ভালো লাগছিল । ভাইজ্যাগ-আরাকু ভ্রমণের দীর্ঘ দু'বছর পাঁচ মাস পরে আমরা আবার ট্রেনে করে কোথাও গেলাম । আমরা বলতে আমরা ছ'জন অর্থাৎ আমি, অমৃতা, বাবা, মা, কথা-কলি । ট্রেনে এই প্রথমবার কথা-কলির টিকিট লেগেছে - ওরা নিজেদের আলাদা বসার সিট্‌ পেয়েছে, এতে ওরাও খুব খুশি ।

বৃষ্টির মধ্যে আসানসোল স্টেশন
ট্রেন বর্ধমান পেরোনোর পর থেকেই আকাশের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করল । সূর্যকে আর দেখা গেল না বরং আকাশ বেশ মেঘলা হয়ে গেল । দুর্গাপুর পেরোনোর পরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হল যেটা আমরা আসানসোলে পৌঁছনোর পরেও থামল না । আসানসোল স্টেশন থেকে বরন্তি যাওয়ার গাড়ি হোটেলের সাহায্যে আগেই বুক করা ছিল । স্টেশনে পৌঁছে বৃষ্টির মধ্যে মালপত্র নিয়ে গাড়িতে উঠে বরন্তির দিকে রওনা হওয়ার সময়ে আমরা সবাইই অল্পবিস্তর ভিজে গেলাম ।

দামোদর নদ

আসানসোল স্টেশন থেকে বরন্তি গাড়িতে ঘন্টাখানেক লাগে - ভাড়া ১,১০০/- টাকা । ছোট বা বড় সব গাড়ির ভাড়াই সমান - আমাদের লোকসংখ্যা ৬ হওয়ায় আমাদের একটা স্কর্পিও গাড়ি নেওয়া হয়েছিল । পশ্চিম বর্ধমান আর পুরুলিয়ার জেলার সীমারেখা নির্ধারণ করে বয়ে চলেছে দামোদর নদ । তার উপরের ব্রীজ পেরোনোর সময়ে একটা পুলিশের চেক্‌ পয়েন্ট আছে যেখানে পুলিশ গাড়ির ভিতরে ব্যাগ খুলিয়ে সবকিছু ভালোভাবে চেক্‌ করে (যারা বেআইনি অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে যাতাযাত করে, তাদের জন্য বলছি এই জায়গাটায় কিন্তু খুব সাবধান !)। দামোদর ব্রীজটা খুব সুন্দর আর আকাশ মেঘলা থাকায় দৃশ্য আরও সুন্দর লাগছিল । পুলিশ যতক্ষণ আমাদের গাড়ি চেকিং করল, আমি সেই সময়ে গাড়ি থেকে নেমে ব্রীজের উপর থেকে বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম ।

ঝোড়ো হাওয়ায় বরন্তি লেক
আরও কিছুক্ষণ চলার পরে রাস্তার শহুরে ব্যাপারটা কমে গিয়ে গ্রাম্য ব্যাপারটা শুরু হল । দু'পাশে গাছপালা পুকুর খাল ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে কিছু ছোট ছোট পাহাড় দেখতে পাওয়া গেল । মাঝে মাঝে মাটির বাড়ি - গরু গোয়াল এসবও চোখে পড়ছিল । বৃষ্টি কিছুক্ষণ আগেই থেমে গেছে, পরিবেশটা ভীষণ মনোরম হয়ে রয়েছে । একটা মোড় ঘুরে আমাদের গাড়িটা একটা সুবিশাল জলাশয়ের পাশ দিয়ে চলতে লাগল - এটাই বরন্তি লেক । বরন্তি লেকের বিস্তারিত বিবরণ পরে দেব, আপাতত বলি এর পাশ দিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা । বৃষ্টি থেমে গেলেও যথেষ্ট জোরে বাতাস বইছে আর তাতে লেকের জলে সমুদ্রের মতো ছোট ছোট ঢেউ উঠছে । এই দৃশ্য দেখতে খুবই ভালো লাগছিল ।

আরণ্যক বননিবাস
লেক পেরিয়ে অল্পদূর গিয়েই পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্য 'আরণ্যক রিসর্ট'-এ । রিসর্টটা বেশ সুন্দর - একটা একতলা আর একটা দোতলা কটেজ নিয়ে তৈরি । এছাড়া রয়েছে একটা রান্না এবং খাওয়ার জায়গা আর সেইসঙ্গে বাকি জায়গাটা জুড়ে একটা সুবিশাল বাগান । সেই বাগানে নানারকম ফুল ও ফলের গাছ আর সেইসঙ্গে রয়েছে নানারকম সব্জীর গাছ । পুরো জায়গাটাই যাকে বলে পরিপাটিভাবে সাজানো ।


আমরা চেক্‌ইন করে চানটান করে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম । এখানে জানিয়ে রাখি বরন্তি একটা প্রত্যন্ত গ্রাম - এখানে ত্রিসীমানার মধ্যে কোনও দোকানপাট নেই । তাই রিসর্টের বাইরে খাওয়া দাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না । এখানে সব রিসর্টেই খাওয়ার প্যাকেজ পাওয়া যায় - সকালের চা, ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, সন্ধ্যের চা ও স্ন্যাক্স আর রাতের ডিনার । 'আরণ্যক রিসর্ট' - এ এই প্যাকেজের মূল্য মাথাপিছু ৪৫০/- টাকা । দুপুরের লাঞ্চের মেনু ভাত, ডাল, আলুভাজা, আলুপোস্ত, মাছের ঝোল, চাটনি, পাঁপড় । এখানকার রান্না একেবারেই ঘরোয়া আর সেইসঙ্গে অত্যন্ত সুস্বাদু । 

লাঞ্চ করে আমরা দুপুর ২ঃ১৫ নাগাদ গাড়ি নিয়ে বেরোলাম । বৃষ্টি একেবারেই থেমে গেছে, অল্প রোদও উঠেছে । আমাদের গন্তব্য শুশুনিয়া ও বিহারীনাথ পাহাড় । বরন্তি থেকে এগুলো ঘুরে আসতে ঘন্টা চারেক লাগে - গাড়িভাড়া ১,৭০০/- টাকা । আমাদের প্রথম গন্তব্য শুশুনিয়া পাহাড় । বরন্তি থেকে দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটারের মতো আর যেতে লাগে একঘন্টা ।

৩০০ মিটার উচ্চতায় খুদে চ্যাম্পিয়ন !
শুশুনিয়া পাহাড়ে পৌঁছে দেখলাম এখানে ট্রেকিং করে উপরে ওঠার ব্যবস্থা রয়েছে । পাহাড়ের গায়ে পাথরের উপর দিয়ে সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে উপরে ওঠা যায়, তবে কাজটা যে সহজ তা বলব না । আমাদের ছ'জনের মধ্যে আমি, কথা আর কলি কিছুদূর ওঠার পরে কলিও আর উঠতে চাইল না । শেষপর্যন্ত আমি আর কথা উপরে উঠলাম । শুশুনিয়া পাহাড়ের উচ্চতা প্রায় ৪৫০ মিটার । আমরা ৩০০ মিটার পর্যন্ত উঠে আর না ওঠার সিদ্ধান্ত নিলাম (আমরা মানে এক্ষেত্রে আমি । কথার আরও ওঠার ইচ্ছে ছিল)। পুরো রাস্তাটা কথা একাই উঠেছে, আমার সাহায্য ছাড়াই । সত্যি বলতে আমি একেবারেই আশা করিনি ও এইটুকু বয়সে এতটা উঠতে পারবে । উপরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছবি তুলে আমরা আবার নিচের দিকে রওনা দিলাম । ওঠানামার পথে অনেককেই উঠতে নামতে দেখলাম যদিও ৩০০ মিটার পর্যন্ত প্রায় কেউই যায়নি । আর যারা ওঠানামা করছিল, তাদের কারুরই বয়স কথার ধারেকাছেও নয় - এটা জোর দিয়ে বলতে পারি !

বিহারীনাথ পাহাড়ের সামনে
নিচে নেমে আইসক্রিম খেয়ে আমরা আবার গাড়িতে উঠে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বিহারীনাথ পাহাড়ের দিকে । শুশুনিয়া থেকে বিহারীনাথের দূরত্ব প্রায় ৩২ কিলোমিটার আর পৌঁছতে লাগে প্রায় একঘন্টা । বিহারীনাথে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য্যাস্ত হয়ে গেছে । বিহারীনাথের উচ্চতা শুশুনিয়ার মতোই যদিও এর উপরে ওঠার ইচ্ছে বা সময় কোনওটাই আমাদের ছিল না । সেইসঙ্গে দেখলাম বিহারীনাথের উপরে ওঠার রাস্তাটা বন্ধ করে রাখা রয়েছে (তবে এটা সবসময় থাকে কিনা জানি না)।

বিহারীনাথ মন্দির
বিহারীনাথ পাহাড়ের পাশেই বিহারীনাথ মন্দির । মন্দিরের পাশে একটা মেলা বসেছে । আমরা মন্দিরটা ঘুরে দেখে নিলাম । নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে - এটা আসলে শিবের মন্দির । মন্দিরের চাতালে তারস্বরে নামসংকীর্তন চলছে, তাই নিজেদের কানের স্বার্থেই মন্দির দেখতে বেশিক্ষণ সময় ব্যয় করলাম না ।



বিহারীনাথ পাহাড় থেকে রিসর্টের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার - আমাদের ফিরতে লাগল ৪৫ মিনিটের মতো । যখন ফিরলাম তখন অন্ধকার হয়ে গেছে । বরন্তিতে রাস্তায় আলোর কোনও ব্যবস্থা নেই, রাস্তার উপর কিছু দূরে দূরে একেকটা রিসর্ট রয়েছে, যা আলো শুধু সেখানেই আছে । রিসর্টে ফেরার পরে আমাদের চা ও সন্ধ্যের জলখাবার মুড়ি-চানাচুর-আলুর চপ দিল (যারা ভাবছে আমার মতো আমিষাশী এগুলো কিকরে খেল তাদের জানিয়ে রাখি আমি এগুলোর সবই খাই এবং পরিস্থিতিবিশেষে ভালোওবাসি !)।

আরণ্যক রিসর্টের ফুলের বাগান
সন্ধ্যের পরে বরন্তিতে কিছু করার নেই, তবে এখানে বারান্দায় বসে থাকতেই বেশ ভালো লাগে । এই সময়ে আমাদের পরিচয় হল রিসর্টের মালিক মিঃ মুকুল দাসের সঙ্গে । ভদ্রলোক কলকাতার বেহালায় থাকেন, মাঝে মাঝে বরন্তিতে যাতায়াত করেন । ওনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম । ভদ্রলোকের নিজের খুব গাছের শখ - বিভিন্ন জায়গা থেকে গাছের চারা এনে এখানে বসিয়েছেন । শীতকালে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকোলি ইত্যাদি নানারকম সব্জী হয় ওনার বাগানে । তাছাড়া পালংশাক, লালশাক প্রভৃতিও হয় । এখানে যে সব্জী হয় সেগুলো দিয়েই এখানে অতিথিদের জন্য তরকারি রান্না হয় । সব্জী ছাড়াও অনেকরকম ফুল ও ফলের গাছ আছে এই বাগানে যার বেশ কিছু আমরা নিজের চোখেই দেখেছি । অত্যন্ত সুন্দরভাবে যে উনি এই বাগানের এবং রিসর্টের পরিচর্যা করেন, সেটা ওনার কথা শুনেও বোঝা যায় ।

রিসর্টের ভাড়ার ব্যাপারে বললেন এখানে উনি শুধুমাত্র ফ্যামিলি হলে তবেই ভাড়া দেন । বুকিং-এর সময়ে বারবার জিজ্ঞেস করে সেটা ভালোভাবে জেনে নেন এবং কিছুমাত্র সন্দেহ হলে তখন আর তাদের ভাড়া দেন না । বরন্তির মতো জায়গায় এই বিধিনিষেধটা আরোপ করে উনি যে একটা বেশ বড়সংখ্যক কাস্টমার হারান, সেটা উনি নিজেও জানেন কিন্তু এটাই ওনার বিজনেস এথিক্স, কাজেই এতে কারুর কিছু বলার থাকতে পারে না । তবে অতিথিদের প্রতি ওনার এবং ওনার কর্মচারীদের ব্যবহার বিশেষভাবে প্রশংসা করার মতো । আমরা ছাড়াও আরেকটি পরিবার এখানে ছিল, তাঁরাও এঁদের আতিথেয়তার বিশেষ প্রশংসা করছিলেন । আমার ব্লগের পাঠকদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি বরন্তিতে পরিবারের সঙ্গে গেলে 'আরণ্যক রিসর্ট'-এই ওঠার জন্য । দায়িত্ব নিয়ে বলছি এখানে থাকলে খুব ভালো লাগবে (না, এগুলো লেখার জন্য মিঃ মুকুল দাস বা অন্য কেউ আমাদের ঘুষ দেননি বা অন্য কোনও বিশেষ পরিষেবা দেননি । খুব ভালো ব্যবহার পেলে নিজের থেকেই এগুলো অন্যদের বলতে ইচ্ছে করে, যেমন বলেছিলাম মুর্শিদাবাদ বা পাঁচমারির হোটেলের সম্পর্কে ।)

রাতে ডিনারের মেনু ছিল ভাত/রুটি, তরকারি আর চিকেন কারি । রান্না অত্যন্ত সুস্বাদু । খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম ।

মাঠের ওপর সূর্য্যোদয়
পরেরদিন রবিবার ১৪ই মার্চ, ২০২১ । সকাল ছ'টার সময়ে রিসর্টের পিছন দিকে মাঠের উপর সূর্য্যোদয়ের দৃশ্য দেখতে পেলাম । দৃশ্যটা অত্যন্ত সুন্দর আর সকাল সকাল এই দৃশ্য দেখে মন ভরে যায় ।





আরণ্যকের ভিতরে
আগে ঠিক ছিল এ'দিন আমরা গড়পঞ্চকোট, মাইথন, পাঞ্চেৎ, কল্যাণেশ্বরী মন্দির ইত্যাদি দেখতে যাব, কিন্তু পরে আমরা সেই পরিকল্পনা বাতিল করলাম । এর কারণ এই জায়গাগুলোর সবগুলোই বরন্তি থেকে বেশ কিছুটা দূরে আর এগুলো অন্য সময়েও যাওয়া যায় । বরন্তিতে এসে বরন্তিটা ভালো করে দেখলে সেটাই হবে সবথেকে বড় প্রাপ্তি । তবে এটা ঠিক বরন্তিতে বরন্তি লেক ছাড়া আর বিশেষ কিছু দেখার নেই, কিন্তু আগেই বলেছি এখানে রিসর্টের বারান্দায় বসে থাকাটাই একটা ভীষণ ভালো অভিজ্ঞতা ।

সকালে চায়ের পরে ব্রেকফাস্টে লুচি আর তরকারি দিল । সেগুলো খেয়ে মা-বাবা, কথা-কলি রিসর্ট থেকে বেরিয়ে একবার বরন্তি লেকটা ঘুরে এল । দুপুরে লাঞ্চের মেনু আগেরদিনের মতোই । খাওয়ার পরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেল ৪ঃ১৫ নাগাদ সবাই মিলে বেরোলাম বরন্তি লেকের উদ্দেশ্যে ।

বরন্তি লেকের উপর সূর্য্যাস্ত (প্যানোরমিক ভিউ)
আরণ্যক রিসর্ট থেকে বরন্তি লেকের দূরত্ব ১.২ কিলোমিটার, কিন্তু তাও হেঁটে আমাদের প্রায় আধঘন্টা লাগল । লেকের দৃশ্য অনবদ্য । ঘন্টাখানেকের মধ্যে লেকের জলের ওপর সূর্য্যাস্ত হবে তাই এইসময়ে লেকের ধারের রাস্তায় ট্যুরিস্টের ভীড় চোখে পড়ার মতো । শুধুমাত্র যারা বরন্তিতে এসেছে তারাই নয়, অন্যান্য জায়গা থেকেও গাড়ি করে লোকজন বরন্তি লেক দেখতে এসেছে । লেকের একদিকে একটা নাতিউচ্চ পাহাড় (পাহাড় না বলে টিলা বলাই ভালো) এবং লেকের জলে তার ছায়া লেকের দৃশ্যকে আরও সুন্দর করে তুলেছে । আমাদের চোখের সামনে সেই অভিপ্রেত সূর্য্যাস্ত হল । আজ গড়পঞ্চকোট ইত্যাদি জায়গায় না যাওয়ার যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম, সেটার জন্য মনে মনে বেশ আত্মশ্লাঘা অনুভব করছিলাম কারণ গেলে এই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হত না ।

সূর্য্যাস্তের পরে ফেরার পথ ধরলাম । পথে একজায়গায় খেজুর গুড় বিক্রি হচ্ছিল, সেখান থেকে আমরা কিছুটা গুড় কিনলাম । এখানকার দাম কলকাতার থেকে বেশি তবে এর বৈশিষ্ট্য হল এতে কোনও চিনির ভেজাল নেই । বরন্তিতে গণপরিবহনের খুব অভাব - রিক্সা, ভ্যান, টোটো খুব কম চলে । তবে আমাদের বিশেষ কিছু ক্লান্তি নেই, ফিরতি পথে আধঘন্টা হেঁটে আবার রিসর্টে পৌঁছে গেলাম । আজকের সন্ধ্যের জলখাবারও গতকালেরই মতো তফাৎ শুধু আলুর চপের বদলে পিঁয়াজী । মিঃ মুকুল দাস ও তাঁর স্ত্রী গত তিনসপ্তাহ একটানা বরন্তিতে থাকার পরে আজ দুপুরে কলকাতা চলে গেছেন, কাজেই সন্ধ্যেবেলা তাঁর সঙ্গে গল্প করার সুযোগ আর নেই । আমরা বাকি সময়টা যথারীতি বারান্দায় বসেই কাটিয়ে দিলাম । রাতের মেনুও গতকালেরই মতো, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম ।

ফেরার পথে আসানসোল স্টেশন
সোমবার ১৫ই মার্চ, ২০২১ - আমাদের বাড়ি ফেরার দিন । সকালে চা খেয়ে তৈরি হয়ে নিলাম । আমাদের ফেরার ট্রেন আসানসোল থেকে সকাল ১০ঃ৪৩ মিনিটে, তাই আমরা বরন্তি থেকে সাড়ে আটটায় বেরোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম । এত সকালে ব্রেকফাস্ট করাটা একটু চাপের, তাই ব্রেকফাস্টটা প্যাকিং করে সঙ্গে নিয়ে নেওয়া হল । ঠিক সাড়ে আটটায় বরন্তি থেকে বেরিয়ে আসানসোল স্টেশনে পৌঁছলাম তখন সকাল দশটা । তারপর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে সঙ্গে থাকা লুচি তরকারিগুলোর সদ্ব্যবহার করে ফেললাম ।

ফেরার পথে পাটনা হাওড়া স্পেশাল ট্রেন কাঁটায় কাঁটায় সকাল ১০ঃ৩৯ মিনিটে আসানসোল স্টেশনে এল আর কাঁটায় কাঁটায় ১০ঃ৪৩ মিনিটে ছাড়ল । ট্রেনের হাওড়া পৌঁছনোর কথা দুপুর ১ঃ২৫ মিনিটে আর ট্রেন নির্ধারিত সময়ের পনেরো মিনিট আগে আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিল । স্টেশন থেকে ট্যাক্সি করে বাড়ি !

সারসংক্ষেপ ঃ

১. কলকাতা থেকে ২-৩ দিনের ঘোরার জন্য একটা দূর্দান্ত জায়গা পুরুলিয়া জেলার বরন্তি । এখানকার প্রধান আকর্ষণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ।

২. বরন্তি যাওয়ার জন্য হাওড়া, শিয়ালদহ বা কলকাতা থেকে ট্রেনে আসানসোল পর্যন্ত্য গিয়ে সেখান থেকে গাড়িতে যেতে হয় । আসানসোল থেকে বরন্তির দূরত্ব ৩৭ কিলোমিটারের মতো, যেতে ঘন্টাখানেক সময় লাগে ।

৩. গাড়ির রাস্তায় কলকাতা থেকে বরন্তির দূরত্ব ২৪০ কিলোমিটার - টানা গাড়িতে গেলে ঘন্টা চারেক লাগে । রাস্তা জানা না থাকলে যাওয়ার জন্য গুগ্‌ল্‌ ম্যাপের সাহায্য নেওয়াই সুবিধেজনক ।

৪. বরন্তিতে থাকার অনেক হোটেল বা রিসর্ট আছে তবে 'আরণ্যক বননিবাস'-এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এখানকার ঘরভাড়া এবং খাবার খরচ বেশ কম এবং পরিষেবা অত্যন্তু উন্নতমানের । আরণ্যকের ওয়েবসাইট http://aaronnok.in/ থেকে এখানকার সম্পর্কে আরও তথ্য জানা যেতে পারে । যোগাযোগের নম্বর - 9830024052 / 8240283452 / 9836099007 / 8910398217.

৫. এখানে আলাদাভাবে খাবারের কোনও জায়গা নেই, হোটেল/রিসর্টের খাবারের উপরেই নির্ভর করতে হবে । এখানে প্রায় সব হোটেলেই প্যাকেজ সিস্টেমে সারাদিনের খাবার পাওয়া যায় ।

৬. বরন্তিতে ঘোরাঘুরির জন্য কোনও গাড়ির ব্যবস্থা করা দুষ্কর, তাই হোটেল থেকেই গাড়ির ব্যবস্থা করা শ্রেয় । কাছাকাছি যাতায়াতের জন্য টোটো বা রিক্সাও এখানে সহজে পাওয়া যায় না ।

৭. এখানে সেভাবে কোনও দোকানপাট নেই তাই সাধারণ দরকারি জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে যাওয়াই ভালো । এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক বেশ ভালো, 4G-ও দিব্যি কাজ করে ।

৮. বরন্তিতে দেখবার একমাত্র জায়গা বরন্তি লেক । বিকেলের দিকে গেলে লেকের ওপরে সূর্য্যাস্তের দৃশ্য দেখতে খুবই ভালো লাগবে ।

৯. এখান থেকে গাড়ি নিয়ে শুশুনিয়া ও বিহারীনাথ পাহাড় দেখতে যাওয়া যেতে পারে । এই দু'টো পাহাড়েরই উপর পর্যন্ত্য হেঁটে ওঠা যায় ।

১০. বরন্তি থেকে ডে-আউটে গড়পঞ্চকোট, পাঞ্চেৎ, মাইথন, কল্যাণেশ্বরী মন্দির দেখে আসা যেতে পারে । তবে জায়গাগুলো কোনওটাই বরন্তি থেকে খুব কাছে নয় ।

১১. বরন্তি যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হল শীতকাল, তাছাড়া বর্ষাকালে গেলেও ভালোই লাগবে । গরমের সময়ে না যাওয়াই ভালো।

উপসংহার ঃ

বরন্তি
কলকাতা থেকে দু'দিনের জন্য ঘুরে আসার পক্ষে বরন্তি একটা অত্যন্ত সুন্দর জায়গা । কলকাতা থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত পুরুলিয়া জেলার এই গ্রামটার প্রধান আকর্ষণ হল এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ । চারপাশে পাহাড়, অদূরে বরন্তি লেক, গাছপালা, বনজঙ্গল, পাখির ডাক - এইসব মিলিয়ে এখানকার শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ আমাদের মতো শহুরে মানুষদের কাছে একটা বিরাট পাওনা । যারা বেড়াতে গিয়ে বিশেষ হৈ চৈ কোলাহল পছন্দ করে না, বরন্তি তাদের জন্য । যারা বেড়াতে গিয়ে নির্ঝঞ্ঝাটভাবে নিজের সঙ্গে দু'দন্ড সময় কাটাতে চায়, বরন্তি তাদের জন্য । যারা বেড়াতে গিয়ে এ'দোকান সে'দোকান ঘুরে কেনাকাটা করতে পছন্দ করে না, বরন্তি তাদের জন্য । কিন্তু তার মানে এই নয় যে বাকিদের বরন্তি গেলে ভালো লাগবে না । আসলে এই জায়গাটার বৈশিষ্ট্যই হল যে এখানে গেলে ভালো লাগতে বাধ্য । তাই যদি দিনতিনেকের জন্য কোথাও ঘুরে আসার জন্য মনটা উড়ু উড়ু করে, তাহলে বরন্তি নিঃসন্দেহে একটা দূর্দান্ত অপশন !

বরন্তি ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

Sunday, January 31, 2021

ক্ষীরাই ভ্রমণ

ক্ষীরাই জায়গাটার নাম বছরখানেক আগেও জানতাম না। বারবার লক্‌ডাউন আর আন্‌লকের অনিশ্চয়তার জেরে ৩-৪ দিনের বেড়ানোর পরিকল্পনা করা যখন খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন কাছাকাছির মধ্যে কোথায় ডে-আউট ট্রিপ করা যায় সেটা খুঁজতে গিয়ে ইউটিউবে ক্ষীরাই-এর সম্পর্কে একটা ভিডিও পেলাম। ক্ষীরাই পূর্ব মেদিনীপুর জেলার একটা গ্রাম যেখানে ফুলের চাষ হয়। এখানে বহুসংখ্যক সুবিশাল আকৃতির ক্ষেত আছে, যে ক্ষেতের ফুল পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানী করা হয়। ভিডিওটা বেশ তথ্যসমৃদ্ধ আর সবটা ভালো করে দেখে এবং সেইসঙ্গে নিজে ইন্টারনেটে কিছুটা ঘাঁটাঘাঁটি করে জায়গাটা সম্পর্কে মোটামুটি জেনে ফেললাম। তারপর প্ল্যান করা আর সেই প্ল্যানের এক্সিকিউশন। গন্তব্য ক্ষীরাই - আমার ব্লগের এবারের পোস্ট।

৩১শে জানুয়ারী, ২০২১ রবিবার - সকাল ৮টা নাগাদ গাড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোলাম আমরা ছ'জন অর্থাৎ আমি, অমৃতা, বাবা, মা, কথা, কলি। যাওয়ার পথে সোনামাসিকেও তুলে নিলাম। আমাদের যাত্রাপথ বিদ্যাসাগর সেতু - কোনা এক্সপ্রেসওয়ে - এন এইচ ১৬ - পাঁশকুড়া পুরাতন বাজার রোড - বাকিটা জিজ্ঞেস করে অথবা গুগ্‌ল্‌ ম্যাপ দেখে। বিদ্যাসাগর সেতু থেকে মোট রাস্তা ৮৫ কিলোমিটার। ধুলাগোড়ীর কাছে একটা পাঞ্জাবী রেস্ট্যুরেন্ট থেকে আলুর পরোটা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম।

দুপুর সাড়ে বারোটার একটু পরে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে আমরা অবশেষে ক্ষীরাই পৌঁছলাম। এখানে জানিয়ে রাখি, ক্ষীরাই বলতে কিন্তু বিশেষ কোনও একটা জায়গা বা ফুলের ক্ষেতকে বোঝায় না। এখানে অনেক জায়গাতেই এই ক্ষেত দেখা যায়, তবে সবথেকে বেশি বিখ্যাত যে জায়গাটা সেটা হল রেলব্রীজের নিচে। শেষের পথটা বেশ সরু, দু'টো গাড়ি পাশাপাশি চলতে বেশ অসুবিধে হয়। যাই হোক, উঁচুনীচু পথ দিয়ে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে ... একটা বড় ধাক্কা খেলাম !

রেলব্রীজের নিচে গাড়ির মেলা
এর আগে ক্ষীরাই সম্পর্কে যা জানা ছিল তাতে জানতাম জায়গাটায় খুব বেশি লোক যায় না। আমরা গিয়ে দেখলাম হাজার হাজার লোক ! জানলাম জানুয়ারী মাসের একটা রবিবারের আনন্দবাজার পত্রিকায় ক্ষীরাই সম্পর্কে একটা লেখা বেরিয়েছে আর তাতেই অনেকে জায়গাটার সম্পর্কে জানতে পেরেছে। আর আমাদেরই মতো এই লক্‌ডাউনে দূরে কোথাও যেতে না পেরে এখানে এসে জুটেছে। যতদূর চোখ যায়, ফুলগাছের চেয়ে মানুষের সংখ্যা বেশি। রেলব্রীজের নিচে যেন মেলা বসেছে। মেলা যে শুধু মানুষের তাইই নয়, গাড়িরও। পুরো জায়গাটায় যত গাড়ি এসে উপস্থিত হয়েছে তত গাড়ি শুধু রবিবার বিকেলে কলকাতার শপিং মলের পার্কিং লটেই দেখা যায় ! আর এখানে পার্কিং ম্যানেজ করার কেউ নেই, যে যার সুবিধেমতো গাড়ি রাখছে। আমরাও সেরকমই করলাম। ব্যতিক্রমই যেখানে নিয়ম, সেখানে আলাদা করে নিয়ম মানার চেষ্টা করা বৃথা (এটা দারুণ দিলাম, তাই না ? এটা একেবারে মৌলিক - আমার নিজস্ব - কপিরাইট প্রোটেক্টেড !)।

রেলব্রীজের পাশে গাঁদাফুলের ক্ষেত
রেলব্রীজটা আসলে কংসাবতী নদীর উপরে যদিও এখন নদীতে জল নেই। নদীর উপরেও অনেকে গাড়ি পার্কিং করেছে, ফেরিওয়ালারা নানারকম জিনিস নিয়ে বসে গেছে। রেলব্রীজের নিচ দিয়ে ব্রীজটা পেরিয়ে গেলে কয়েকটা বিশাল গাঁদাফুলের ক্ষেত রয়েছে, কিন্তু ভীড় দেখে আমরা আর সেদিকে এগোলাম না। বরং স্থানীয় লোকের কাছে জানা গেল এখান থেকে মিনিট দশেকের টোটো দূরত্বে আরেকটা এরকম বড় ক্ষেত রয়েছে, সেখানে চাইলে যাওয়া যেতে পারে। আমরা হেঁটে নদী পেরিয়ে ওপারে গিয়ে একটা টোটো ধরে গেলাম সেই ক্ষেতে।

চন্দ্রমল্লিকার ক্ষেত
এই ক্ষেতটা বিশেষ করে চন্দ্রমল্লিকার। সাদা হলুদ কমলা সবুজ ইত্যাদি নানারঙের চন্দ্রমল্লিকার দিগন্তবিস্তৃত ক্ষেত। এর মধ্যে সাদাটাই বেশি। দেখে মনে হয় সুবিশাল মাঠের মধ্যে যেন বরফ পড়েছে। এই ক্ষেতের মধ্যে ঢুকে গিয়ে ফুলের গায়ে হাত দিতে বারণ নেই, তবে সেটা না দেওয়াই ভালো। ক্ষেতের মধ্যে বাঁশের বেড়া দিয়ে পাঁচিল করা রয়েছে, তার মধ্যে দিয়ে হাঁটার পথ। আমরা হেঁটে হেঁটে ক্ষেতের অনেকটা ভিতরে চলে গেলাম। এখানেও লোকজনের সংখ্যা খুব কম নয়, তবে অনেকটা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ফুলের ক্ষেতের মধ্যে কয়েকটা স্থানীয় বাচ্চা ছেলেমেয়ে ফুলের মুকুট বিক্রি করছে। সরু তার দিয়ে ফুল গেঁথে তৈরি, দাম ১০/- টাকা। আমরা কয়েকটা কিনলাম।

ফুলের ক্ষেতে ফুলের মুকুট পরে ফুলেরা আর ফুলকি
ফুলের ক্ষেতে আমরা আরও কিছুক্ষণ কাটালাম, তবে এর বিবরণ আলাদা করে দেওয়ার আর কিছু নেই। ক্ষেতগুলো সব একইরকম, ফুলগুলো আলাদা। আরও কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে একজায়গায় দেখলাম ক্ষেতের মধ্যেই একটা ছাউনি ধরনের করে সেখানে একটা অস্থায়ী ভাতের হোটেল খুলে ফেলেছে। ক্ষীরাই এর ফুলের ক্ষেতের মধ্যে খাবারের ব্যবস্থা কিছুই নেই, তাই আমরা এখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। রান্না বেশ ভালো। ভাত, ডাল, ডিমের কারি, চিকেন ইত্যাদি নিয়ে খরচ হল ৩৫০/- টাকা।

রেললাইনের উপরে
খাওয়ার পরে আমরা আরও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে টোটো ধরে রেলব্রীজের নিচ পর্যন্ত ফিরে এলাম। এই রাস্তাটায় কিছু গাড়ি নিয়ে চলাচল করা একেবারেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না কারণ এখানে রাস্তা পিচের নয় আর একটামাত্র গাড়িই চলাচল করতে পারে। উল্টোদিক থেকে একটা বাইক এসে গেলেও রাস্তায় যানজট হয়ে যাবে। রেলব্রীজের নিচে পৌঁছে আমি, কথা আর কলি একবার ব্রীজের উপরটা ঘুরে এলাম। এখানে পাশেই দক্ষিণপূর্ব রেলওয়ের ক্ষীরাই স্টেশন। এই লাইনে বেশ ঘনঘন ট্রেন চলাচল করে, কয়েকটা ট্রেন দেখারও সুযোগ হয়ে গেল।

দুপুর সাড়ে তিনটে বাজে, ক্ষীরাইতে আর কিছু করার নেই তাই আমরা গাড়ি নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। যে পথে যাওয়া, সেই পথেই ফেরা। ফেরার পথে কোলাঘাট পেরোনোর একটু পরে একজায়গায় দাঁড়িয়ে একটু চা খেয়ে নেওয়া হল। তারপর আবার বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম।

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় পাঁশকুড়ার কাছে একটা গ্রাম ক্ষীরাই। ফুলচাষ ও ফুলের রপ্তানীর জন্য এই গ্রাম বিখ্যাত।
২. ক্ষীরাই যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হল ফ্রেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি থেকে মার্চের মাঝামাঝি। এই সময়ে এখানকার ক্ষেতে অন্যান্যফুলের সঙ্গে গোলাপও দেখা যায়।
৩. গাড়ি করে যাওয়ার রাস্তা হল বিদ্যাসাগর সেতু - কোনা এক্সপ্রেসওয়ে - এন এইচ ১৬ - পাঁশকুড়া পুরাতন বাজার রোড। শেষের পথটা গুগ্‌ল্‌ ম্যাপ দেখে বা স্থানীয় লোককে জিজ্ঞেস করে যেতে হবে। 
৪. ট্রেনে গেলে হাওড়া থেকে দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের লোক্যাল ট্রেন ধরে (এক্সপ্রেস ট্রেন এখানে থামে না) পাঁশকুড়ার পরের স্টেশন ক্ষীরাইতে নামতে হবে। হাওড়া থেকে ক্ষীরাই ট্রেনে ১ঃ৫০ মিনিট সময় লাগে।
৫. গাড়ি অথবা ট্রেন যাতেই যাওয়া হোক, ঘুরে ঘুরে ফুলের ক্ষেত দেখার জন্য টোটো ভাড়া করে নেওয়াই ভালো। তাতে আরেকটা সুবিধে এই যে টোটোর ড্রাইভাররা ফুলের ক্ষেতের জায়গাগুলো ভালোভাবে চেনে।
৬. ক্ষীরাইতে নানারকম ফুলের বাগান আছে, যার মধ্যে গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিকার প্রাধান্য বেশি। এখানে বিভিন্ন ফুলগাছের চারা বিক্রিও হয়।
৭. ক্ষীরাইতে খাওয়াদাওয়ার বিশেষ কোনও জায়গা নেই, তাই সঙ্গে অবশ্যই কিছু শুকনো খাবার রাখা উচিৎ। ছুটির দিনে ভিড় বেশি হলে এখানে কিছু অস্থায়ী খাবারের ব্যবস্থা হয় ঠিকই, কিন্তু তার উপর নির্ভর না করাই ভালো।

উপসংহারঃ

ক্ষীরাই
কলকাতার বেশ কাছে একটা ছোটখাটো ডে-আউট প্ল্যানের জন্য ক্ষীরাই বেশ ভালো একটা জায়গা। নানারকমের ফুলের ক্ষেতের সমারোহে জায়গাটায় একটা নয়নাভিরাম ব্যাপার আছে, সেটা বলতেই হবে। দিগন্তবিস্তৃত জমিতে যতদূর দু'চোখ যায়, মনে হয় নানারঙের চাদর বিছানো রয়েছে। যদিও এখানকার সৌন্দর্য প্রকৃতির স্বাভাবিক সৃষ্টি নয়, বরং বলা যায় প্রকৃতির দাক্ষিণ্যে মানুষের সৃষ্টি, কিন্তু তাও এখানকার সৌন্দর্য বিশেষ মনোরম। ক্ষীরাইতে অনেককিছু দেখার আছে তা নয়, তবে ঘোরাঘুরি করে সারাদিনটা বেশ কেটে যায়। গাড়িতে বা ট্রেনে যেভাবেই যাওয়া হোক, যাতায়াতের রাস্তাটাও বেশ সুন্দর। করোনার লক্‌ডাউনের মধ্যে বাড়িতে বসে থাকার একঘেয়েমি কাটানোর জন্য এখানে যাওয়া যেতেই পারে। আর করোনা পরবর্তী সময়েও এখানে একটা দিন কাটাতে ভালো লাগবে বলেই আমার ধারণা। তবে রবিবার বা ছুটির দিনগুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করাই ভালো, কারণ 'মানুষ' জীবটা যতই প্রকৃতির সৃষ্টি হোক, ফুলের ভীড়ের মাঝে তাদের ভীড়টা শুধু অনভিপ্রেতই নয়, বিরক্তির উদ্রেককারীও বটে !

ক্ষীরাই ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.