আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Thursday, January 27, 2022

কার্সিয়ং ও সিটং ভ্রমণ

 বিশেষ সতর্কীকরণঃ

১. এই ভ্রমণে আমরা জনবহুল স্থানে, বিশেষতঃ স্টেশনে, ট্রেনে ইত্যাদি জায়গায় সারাক্ষণ মাস্ক পরে থেকেছি এবং দূরত্ববিধি যথাসম্ভব মেনে চলার চেষ্টা করেছি । সেইসঙ্গে প্রয়োজনমতো হ্যান্ড স্যানিটাইজারও ব্যবহার করেছি ।

২. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও অবস্থাতেই কোনও পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার করিনি । অর্থাৎ প্লাস্টিকের ব্যবহার না করেও এই ভ্রমণ অনায়াসে করা যায় ।

৩. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও কাগজ ব্যবহার বা নষ্ট করিনি । হোটেল বুকিং-এর রশিদ-এর প্রিন্ট আউট ব্যবহারের কোনও প্রয়োজন হয় না ।

৪. এই পুরো ভ্রমণে আমাদের দলের কেউ ধূমপান করেনি । ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর ।

আমার ব্লগের সমস্ত পাঠকদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে করোনা ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করার জন্য সরকারী বিধিনিষেধ মেনে চলার জন্য । সেইসঙ্গে অনুরোধ করছি প্লাস্টিক, অপ্রয়োজনীয় কাগজের ব্যবহার আর ধূমপান বর্জন করার জন্য ।

ভ্রমণপথঃ

শনিবার ২২শে জানুয়ারী, ২০২২ঃ হাওড়া থেকে রাত্রি ১০টায় দীঘা নিউ জলপাইগুড়ি এক্সপ্রেস ট্রেন ।

রবিবার ২৩শে জানুয়ারী, ২০২২ঃ (সাড়ে পাঁচ ঘন্টা লেট করে !) দুপুর ৩টে - নিউ জলপাইগুড়ি - কার্সিয়ং - কার্সিয়ঙে রাত্রিবাস ।

সোমবার ২৪শে জানুয়ারী, ২০২২ঃ কার্সিয়ঙে লোক্যাল সাইট সিয়িং - কার্সিয়ঙে রাত্রিবাস ।

মঙ্গলবার ২৫শে জানুয়ারী ২০২২ঃ সকাল ১০ঃ৩০ মিনিটে চেক্‌ আউট - গাড়িতে সিটং - সিটং-এ রাত্রিবাস।

বুধবার ২৬শে জানুয়ারী ২০২২ঃ সকাল ১০টায় চেক্‌ আউট - সিটং-এর লোক্যাল সাইট সিয়িং - নিউ জলপাইগুড়ি - রাত্রি ৮টায় দার্জিলিং মেল।

বৃহস্পতিবার ২৭শে জানুয়ারী ২০২২ঃ ভোর ৬টায় শিয়ালদহ।

জানুয়ারী মাসের এই ২৩-২৬ এর ছুটিতে পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার একটা সুবিধে হল হয়তো ঠান্ডার কারণেই এই সময়ে পাহাড়ের জায়গাগুলো তুলনামূলকভাবে ফাঁকা থাকে। ফলে একদিকে যেমন হোটেল, গাড়ি ইত্যাদি সস্তায় পাওয়া যায় তেমনই অন্যদিকে ভীড় কম থাকায় ঘুরতেও ভালো লাগে। কয়েকবছর আগে দার্জিলিঙে গিয়ে এই সুবিধেটা বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিলাম বলে এবারেও পাহাড়ে যাওয়ারই ঠিক করা হল। দার্জিলিং আগে গিয়েছি আর তাকদা ভ্রমণের সময়ে কালিম্পং আর ডেলোটাও ঘোরা হয়ে গেছে। কিন্তু কার্সিয়ং কখনও যাইনি, প্রতিবারই দার্জিলিং যাওয়ার সময়ে কার্সিয়ং পেরিয়ে চলে গিয়েছি। তাই এবারে আর পেরিয়ে চলে গেলাম না - দু'দিন কার্সিয়ং আর একদিন সিটং ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়েই আমার ব্লগের এবারের পোস্ট।

এবারে আমরা সাতজন অর্থাৎ আমি, অমৃতা, মা, বাবা, কথা, কলি আর সোনামাসি। শনিবার ২২শে জানুয়ারী, ২০২২ হাওড়া স্টেশন থেকে রাত দশটার সময়ে দীঘা নিউ জলপাইগুড়ি এক্সপ্রেস ট্রেনে আমাদের যাত্রা শুরু হল। এবারে একটা বেশ অবাক করার মতো ঘটনা হল ট্রেনটা ছিল বেশ ফাঁকা। কথা-কলির এখন হাফ্‌ টিকিট লাগে আর সেই কারণে বার্থ ছিল না কিন্তু ট্রেনটা ফাঁকা থাকায় আমরা অনায়াসে একটা কুপের আটটা বার্থই ব্যবহার করার সুযোগ পেয়ে গেলাম।

এখানে জানিয়ে রাখি ভারতীয় রেলের এখনকার নিয়ম হল পাঁচ থেকে বারো বছরের বাচ্চাদের জন্য যদি হাফ্‌ টিকিট কাটা হয় তাহলে বার্থ পাওয়া যাবে না। আর যদি বার্থ নিতে হয় তাহলে ফুল টিকিট কাটতে হবে। ০৬/০৩/২০২০ থেকে এই নিয়ম চালু হয়েছে।

ট্রেনে শোওয়া বসার অসুবিধে না হলেও সেটা নিয়ে অসুবিধে হল সেটা হল ট্রেনটার চলা। এর আগে রিশপ ও কোলাখাম ভ্রমণের সময়ে এই ট্রেনে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছিল আর আমি নিজেই লিখেছিলাম "রাতের কোনও ট্রেনে একান্তই বুকিং পাওয়া না গেলে তবেই পাহাড়িয়া এক্সপ্রেসে যাওয়া উচিৎ, না হলে নয়"। এবারেও আমরা অন্য কোনও ট্রেনে বুকিং না পেয়ে বাধ্য হয়ে এই ট্রেনের টিকিট কেটেছিলাম। আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছি না, শুধু তথ্যের খাতিরে এইটুকু জানাচ্ছি লেট্‌ করা ব্যাপারটাকে একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে ট্রেন সকাল ৯ঃ৩০ এর জায়গায় আমাদের নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে দিল বিকেল ৩টেয় ! এই ট্রেনে আবার প্যান্ট্রি নেই, ফলে সঙ্গে যথেষ্ট খাবার না থাকলে আমাদের বেশ অসুবিধের মধ্যেই পড়তে হত।

কার্সিয়ঙের পথে
নিউ জলপাইগুড়িতে নেমে আমরা আর ভাতের হোটেলের খোঁজ করলাম না, বরং সঙ্গে থাকা খাবার সম্বল করেই একটা গাড়ি ধরে কার্সিয়ঙের দিকে রওনা দিলাম। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে কার্সিয়ং যাওয়ার একটা শর্টকাট রাস্তা আছে (এরা যেটাকে বলে বাইপাস) যেটা দিয়ে গেলে অনেকটা সময় কম লাগে। কার্সিয়ঙে গিয়ে এই রাস্তা হিলকার্ট রোডের সঙ্গে মিলিত হয় আর তারপর হিলকার্ট রোড ধরে দার্জিলিং যাওয়া যায়। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে কার্সিয়ং যাওয়ার পথের দৃশ্যটা খুবই উপভোগ্য - সমতলে চলতে চলতে গাড়িটা হঠাৎ করেই পাহাড়ে উঠতে শুরু করে দেয়। রাস্তার দু'পাশে বিস্তীর্ণ চা-বাগান আর পিছনে তাকালে সমতলের উপর শিলিগুড়ি শহর দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে কার্সিয়ং পৌঁছতে আমাদের একঘন্টা মতো লাগল। গাড়িভাড়া লাগল ১,৮০০/- টাকা।

আমাদের ঘর
কার্সিয়ঙে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন বিভাগের 'রৌদ্রছায়া ট্যুরিজম প্রপার্টি'তে আমাদের ঘর বুকিং করা ছিল। এই জায়গাটার অবস্থান খুব সুন্দর - একেবারে হিলকার্ট রোডের উপরে। এই রাস্তার উপর দিয়েই দার্জিলিং পর্যন্ত চলে গেছে টয়ট্রেনের লাইন (বর্তমান নাম দার্জিলিং-হিমালয়ান রেলওয়ে)। এখানে আমাদের দু'টো ডাবল্‌ বেড রুম নেওয়া ছিল। ঘরগুলো খুব বড় না হলেও বেশ সুন্দর - ছিমছাম। ঘরের দেওয়াল মেঝে ওয়ার্ডরোব ইত্যাদি সবই কাঠের তৈরি। বাথরুমে গিজার আছে। আমরা ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।

বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে আর ইতিমধ্যেই এখানকার শীতটা বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছিলাম। ঘরে রুম হিটারের ব্যবস্থা নেই, মনে হচ্ছিল থাকলে মন্দ হত না। বিছানার সঙ্গে লেপ-কম্বল ইত্যাদি বেশ ভালো পরিমাণেই দেওয়া আছে আর সেগুলো একটুও বাড়াবাড়ি বলে মনে হয় না। এখানকার নিয়ম হল রাত আটটার সময়ে ডিনার করতে ডাইনিং রুমে যেতে হয়। ডাইনিং রুমে গিয়ে অনুভব করলাম ঘরে যে ঠান্ডাটা লাগছিল সেটা আসলে কিছুই না ! ডাইনিং রুমটা পুরোটাই কাঠের তৈরি আর সেইসঙ্গে কাচের জানালা। গরম জামাকাপড়, কানঢাকা টুপি, দস্তানা মোজা পরে এমনিতে খুব ঠান্ডা না লাগলেও কেউ কোনও কারণে রুমের দরজাটা খুললে ঠান্ডা বেশ ভালোভাবেই মালুম পাওয়া যাচ্ছিল। যাই হোক, ভাত রুটি চিকেন ডিম ইত্যাদি দিয়ে ডিনার সেরে নেওয়া হল। খরচ হল ৭৫৬/- টাকা। ডাইনিং রুমের লাগোয়া একটা বেসিন আছে কিন্তু সেখানকার কল থেকে গরমজল পড়ে না বলে হোটেলের লোকেরা আমাদের বলল ঘরে গিয়ে হাত ধুতে, আমরা সেটাই করলাম (জলটা আসলে কতটা ঠান্ডা সেটা আমি পরেরদিন রাতে একবার পরীক্ষা করতে গিয়েছিলাম। পাঠকদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য শুধু এটাই বলব "দিজ অ্যাকশনস্‌ আর পারফর্মড বাই এক্সপার্টস্‌। ডু নট ট্রাই দিস ইভেন ফর এক্সপেরিমেন্টিং" !)।

কার্সিয়ং স্টেশন
সোমবার ২৪শে জানুয়ারী, ২০২২ আমাদের কার্সিয়ং ঘোরার দিন। কোনও নতুন জায়গায় গেলে আমার সাধারণতঃ বেশ সকাল সকালই ঘুম ভেঙ্গে যায় আর তারপর সেই জায়গাটায় হেঁটে ঘোরাঘুরি করাটা আমার একটা বাতিকের মধ্যে পড়ে। কার্সিয়ঙে সকাল সাড়ে সাতটার সময়ে আমি হোটেল থেকে বেরিয়ে হিলকার্ট রোড ধরে নিচের দিকে নামা শুরু করলাম। আগেরদিন আসার সময়ে দেখেছি আমাদের হোটেল থেকে কার্সিয়ং স্টেশনটা খুব একটা দূরে নয়, তাই সেদিকেই হাঁটতে শুরু করলাম। এমনিতেই ট্রেন, স্টেশন এই জিনিসগুলোর প্রতি আমার আকর্ষণ প্রায় বাচ্চাদের পর্যায়ের ফেলা চলে, আর এক্ষেত্রে সেটা টয়ট্রেন - আরও বেশি আগ্রহের বস্তু। সকালবেলা রাস্তা বেশ ফাঁকা, হাঁটতে ভালোই লাগছিল। উৎরাইয়ে হিলকার্ট রোড ধরে কার্সিয়ং স্টেশন পৌঁছতে লাগল মিনিট কুড়ি। সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ফাঁকা ট্রেনের বগি, স্টেশনের ছবি তুলে আবার ফেরার পথ ধরলাম।

ডাইনিং রুম থেকে বাইরের দৃশ্য
হোটেলে ফিরে ব্রেকফাস্ট করতে গেলাম। এখানে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট দেয়। মেনু - লুচি তরকারি অথবা পাঁউরুটি টোস্ট আর ওমলেট। সেইসঙ্গে চা-কফি ইত্যাদি। খাবারের পরিমাণ পর্যাপ্ত। ডাইনিং রুম থেকে দিনের বেলা বেশ সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়।

রৌদ্রছায়া ট্যুরিজম প্রপার্টির সামনে




সকাল সাড়ে দশটার সময়ে আমরা গাড়ি নিয়ে বেরোলাম কার্সিয়ং ঘুরতে। এই গাড়ির সঙ্গে আমাদের বন্দোবস্ত করা ছিল। গাড়ি প্রথমদিন আমাদের কার্সিয়ং ঘোরাবে, দ্বিতীয়দিন কার্সিয়ং থেকে সিটং নিয়ে যাবে আর সেখানেই থাকবে এবং তৃতীয়দিন সিটং থেকে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে দেবে আর পথে সিটং এর সাইট সিয়িং করিয়ে দেবে। এর জন্য আমাদের মোট দিতে হবে ৮,২০০/- টাকা।

ঈগল্‌স্‌ ভিউ পয়েন্ট
ঈগল্‌স্‌ ভিউ পয়েন্টঃ হোটেল থেকে বেরিয়ে মিনিট কুড়ি গাড়ি চলার পরে আমরা পৌঁছলাম ঈগল্‌স্‌ ভিউ পয়েন্টে। এখানে একটা টাওয়ার আছে যার উপরে উঠে এই ভিউ পয়েন্টের দৃশ্য দেখতে হয় কিন্তু বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির জন্য এটা বন্ধ আছে। তাই আমাদের ড্রাইভার আমাদের ঢালু পথ বেয়ে কিছুটা নিচে নিয়ে গেল। সেখান থেকেও দৃশ্য একইরকম চমৎকার। এখানে রাস্তাটা এঁকেবেঁকে অনেক নিচ পর্যন্ত চলে গেছে আর পাহাড়ের ধাপে ধাপে চা-বাগান। নিচে, বহু নিচে দেখা যায় শিলিগুড়ি শহরের দৃশ্য (এখান থেকে নাকি কাঞ্চনজঙ্ঘাও দেখা যায়, কিন্ত আকাশ পরিষ্কার না থাকায় আমরা দেখতে পাইনি)। আমরা এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছবি তুলে গাড়িতে উঠে বসলাম।

হনুমান স্ট্যাচু
হনুমান স্ট্যাচুঃ ভিউ পয়েন্ট থেকে আমাদের গাড়ি উপরে উঠতে শুরু করল। কার্সিয়ঙের উচ্চতা ৪,৮৬৪ ফুট, ড্রাইভার বলল আমরা সাড়ে ছ'হাজার ফুট পর্যন্ত উঠব। মিনিট পনেরো এইভাবে ওঠার পর আমরা পৌঁছলাম হনুমান স্ট্যাচুর কাছে। পাহাড়ের একটা বাঁকে কিছুটা সমতল জায়গায় ৪০ ফুট উঁচু এই মূর্তি তৈরি হয়েছে। এর সামনে পাহাড়ের গায়ে বিরাট বড় করে HOLLYWOOD স্টাইলে 'I 💗 KURSEONG' লেখা আছে (এই জিনিসটা ইদানীং দেখছি অনেক জায়গাতেই হচ্ছে। দার্জিলিঙেও 'I 💗 DARJEELING' আছে। কিছুদিন আগে দেখলাম কলকাতার ডানলপের মোড়েও 'I 💗 BARANAGAR' লাগানো হয়েছে !)।

ডাইহিল হন্টেড হাউস
ডাউহিল হন্টেড হাউসঃ হনুমান স্ট্যাচু থেকে পনেরো মিনিট ধরে আরও বেশ কিছুটা উপরে উঠে ডাউহিল। এই যাওয়ার রাস্তাটা ভীষণ সুন্দর। দু'দিকে পাহাড়ের মধ্যে গভীর জঙ্গল আর তার মধ্যে দিয়ে রাস্তা এগিয়ে চলেছে। জঙ্গলের গভীরতা এখানে এতই বেশি যে দিনের বেলাতেও বেশ অন্ধকার থাকে। ডাউহিলে একটা চার্চ আছে, যেটাকে এরা বলে ভৌতিক চার্চ। এই চার্চের গেট সবসময়েই বন্ধ থাকে এবং চার্চের সংলগ্ন মাঠেও কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। চার্চটা দেখেও মনে হয় এখানে ভূত থাকা কিছুই অস্বাভাবিক নয়। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের ফলে চার্চ জিনিসটা আমরা সাধারণতঃ বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দেখতেই অভ্যস্ত। কিন্তু ডাউহিলের চার্চের সম্পর্কে এই কথাটা বলা যায় না। বরং বহুদিন না ব্যবহারের ফলে একটা পরিত্যক্ত চার্চের ছাপ পড়েছে গায়ে। এই চার্চের সম্পর্কে বহু ভৌতিক কাহিনী প্রচলিত আছে। এখানকার পরিবেশটা সবমিলিয়ে একটা ভৌতিক চার্চ হওয়ার মতো জায়গা বটে !

বটানিক্যাল গার্ডেনে
বটানিক্যাল গার্ডেনঃ ডাউহিল থেকে মিনিট দশেক যাওয়ার পরে আমরা পোঁছলাম এখানকার বটানিক্যাল গার্ডেনে। পাহাড়ের গায়ে সমতল জায়গায় নানারকম গাছ লাগিয়ে এই বটানিক্যাল গার্ডেন তৈরি করা হয়েছে। এর ভিতর দিয়ে একটা বাঁধানো হাঁটার রাস্তা আছে, সেটা হেঁটে দিয়ে ভিতরের পুরোটা দেখে আসা যায়। বিভিন্ন সাইজের বিভিন্ন প্রজাতির অগণিত গাছ যার বেশিরভাগগুলোই আমাদের অচেনা। অনেকগুলো গাছের গায়ে বোর্ড টাঙিয়ের সেটার নাম আর কি কাজে লাগে সেটা লেখা আছে। ভিতরের পুরোটা ঘুরে দেখতে আমাদের আধঘন্টা মতো লাগল।

গাড়ি মোটামুটি ছ'হাজার ফুট পর্যন্ত উঠে গেছে, এবার নামার পথ ধরল। মিনিট পাঁচেক নেমে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়ানো হল। সেখানে চা-এর সঙ্গে ভেজ মোমোও খেলাম (না, চিকেন মোমো পাওয়া যায় না, গেলে সেটাই খেতাম) আর সেইসঙ্গে আরেকটা নতুন জিনিস খেলাম তার নাম মিমি। গরম সুপের মধ্যে একটা নুডুলস্‌ জাতীয় জিনিস আর উপরে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে সার্ভ করে। জিনিসটা খেতে খুবই ভালো। খিদেও ভালোই পেয়েছিল, মিমি আর মোমো দিয়ে খাওয়াটাও হল বেশ তৃপ্তিকর।

পাইন ফরেস্ট
পাইন ফরেস্টঃ খাওয়ার পরে আমরা আরও নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম। আমরা যে পথ দিয়ে উঠেছিলাম, সেই পথ দিয়ে নামছিলাম না। এই পথে কিছুদূর নামার পরে রাস্তার দু'পাশে ঘন জঙ্গল শুরু হল - পাইনের জঙ্গল। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। ঘন জঙ্গলের মধ্যে বেশিদূরে চোখ যায় না, যতদূর যায় শুধুই পাইন গাছ। প্রত্যেকটা গাছই যাকে বলে গগনচুম্বী। চলতে চলতে আমাদের গাড়ি এক জায়গায় থামল আর ড্রাইভার বলল আমি চাইলে পাহাড়ের গা বেয়ে কিছুটা নেমে গিয়ে ভালোভাবে জঙ্গলের ছবি তুলতে পারি। কথা-কলিও আমার সঙ্গে যেতে চাইছিল, কিন্তু ড্রাইভার ওদের নিয়ে যেতে বারণ করল। তার কারণ এখানে পাহাড়ের জঙ্গলে নাকি বন্য জানোয়ার থাকে, বাচ্চাদের না যাওয়াই ভালো। কি জানোয়ার জিজ্ঞেস করাতে যখন উত্তর পেলাম 'ভালু আউর চিতা' তখন আমার নিজের যাওয়ার ইচ্ছেটাও যে ষোলো আনাই বজায় থাকল সেটা জোর দিয়ে বলতে পারি না। যাই হোক, তাও পাহাড়ের গা বেয়ে জঙ্গলের ভিতরে নেমে গেলাম। কিছুদূর নামার পরে জলের কুলকুল শব্দ কানে এল। সেটার উদ্দেশ্যে আরও বেশ কিছুটা নিচে নেমে যেতেই দেখতে পেলাম পাহাড়ী খরস্রোতা ছোট্ট নদীটাকে। অপূর্ব দৃশ্য ! আমার বাঁদিক থেকে এসে নদীটা আমাদের পায়ের সামনে দিয়ে ডানদিকে আরও নিচে নেমে যাচ্ছে। আমি পুরোটার একটা ভিডিও করে ফেরার পথ ধরলাম। পাহাড়ের গা বেয়ে প্রায় ৫০ ফুট নেমে এসেছিলাম, তাই ওঠার সময়ে বেশ বেগ পেতে হল। ওঠার সময়ে বারবার এটাও মনে হচ্ছিল ভালুক আশেপাশেই রয়েছে, এক্ষুণি আমার সামনে এসে দাঁড়াবে আর তক্ষুণি আমাকে ছোটবেলায় পড়া সেই গল্পের ছেলেটার মতো নিশ্বাস বন্ধ করে শুয়ে পড়তে হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর দর্শনের সৌভাগ্য দূর্ভাগ্য হয়নি !

গুডরিক্‌ টী ডেক্‌
গুডরিক্‌ টী পটঃ পাইন ফরেস্ট থেকে আরও কিছুটা নেমে আসার পর রাস্তাটা আবার হিলকার্ট রোডে এসে পড়ল। মিনিট পনেরো চলার পরে আমরা এসে পৌঁছলাম আমাদের শেষ গন্তব্যে - গুডরিক টী পট। এটা গুডরিক নামক বিখ্যাত চা-কোম্পানীর একটা রেস্ট্যুরেন্ট। পাহাড়ের গায়ে একটা ঝুলন্ত রেস্ট্যুরেন্ট যেখানে চায়ের সঙ্গে স্যান্ডউইচ, স্ন্যাক্স ইত্যাদি পাওয়া যায়। এর ব্যালকনিটা খুব সুন্দর। সেখান থেকে অনেক দূরের দৃশ্য দেখা যায়। চাইলে এখান থেকে চা কেনাও যায়। এখানে একটা দামের লিস্ট দেওয়া আছে। সেই লিস্ট অনুযায়ী এদের সবচেয়ে দামী চা হল 'মার্গারেট হোপ টী ২০২১' এর আর দাম ৪০,০০০/- টাকা প্রতি কিলো (না শূণ্য লিখতে কোনও ভুল হয়নি)। যাই হোক, আমরা চা অত কিছু ভালোবাসিনা, তাই আর কিনলাম না।

আমাদের সাইট সিয়িং শেষ, তাই গাড়ি আমাদের কার্সিয়ং মার্কেটের কাছে নামিয়ে দিল। কার্সিয়ঙের সাইট সিয়িং-এর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য জায়গা হল 'নেতাজী মিউজিয়াম', কিন্তু সেটা করোনা পরিস্থিতির জন্য বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। দুপুর আড়াইটে বাজে, আমরা একটা খাবারের হোটেলে ঢুকে লাঞ্চ সেরে নিলাম। ভাত, চিকেন, ডিম, স্যুপ ইত্যাদি নিয়ে খরচ পড়ল ৭০০/- টাকা।

মনাস্ট্রী
খাওয়ার পরে আমি, কথা আর কলি হোটেলের দিকে এগোলাম আর বাকিরা মার্কেটে থেকে গেল। কি আবার করতে, মার্কেটিং করতে ! মার্কেট জায়গাটা কার্সিয়ং স্টেশনের কাছে অর্থাৎ এখান থেকে আমাদের হোটেল হেঁটে মিনিট কুড়ি। আমাদের হোটেলের পাশেই একটা মনাস্ট্রী আছে, আমরা হোটেলে ফেরার পথে সেটা দেখতে গেলাম। সিঁড়ি দিয়ে ধাপে ধাপে অনেটা নেমে গিয়ে দেখতে হল। মনাস্ট্রীটা দেখতে খুবই সুন্দর আর যথারীতি খুবই রঙচঙে। বৌদ্ধধর্মের এই এক মজার জিনিস - এতরকমের রঙ কোনও মন্দির, মসজিদ বা চার্চে সাধারণতঃ দেখা যায় না। মনাস্ট্রীটা এমনিতে বন্ধ ছিল, তবে লামা আমাদের জন্য খুলে দিলেন আর ভিতরটা ভালোভাবে ঘুরে দেখালেনও। এঁরা খুবই অতিথিবৎসল হন, সেটা আগেও দেখেছি। যাই হোক, মনাস্ট্রীটা ভালোভাবে ঘুরে দেখে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম।

হোটেলে ফিরে এসে বিকেলে আর সন্ধ্যেবেলা সেরকম কিছু করার থাকে না। আর সত্যি বলতে কি, প্রচন্ড ঠান্ডার জন্য কিছটা জবুথুবুও লাগে। যাই হোক, রাতে আবার আটটার সময়ে ডিনার খেতে গেলাম। সেই গরম জামাকাপড়, কানঢাকা টুপি, দস্তানা, মোজা, সেই ডাইনিং রুমের দরজা খুললে হাড়কাঁপানো শীত আর সেই ভাত, রুটি, ডিম, চিকেন। খরচ হল ৮১৯/- টাকা। খাওয়ার পরে আমি সেই হরেন্ডাস্‌ এক্সপেরিমেন্টটা করলাম যেটার কথা আগেই লিখেছি। আবারও বলছি "দিজ অ্যাকশনস্‌ আর পারফর্মড বাই এক্সপার্টস্‌"।

চার্চ
মঙ্গলবার ২৫শে জানুয়ারী সকালে উঠে আমি আবার আগেরদিনের মতোই হাঁটতে বেরোলাম। একই পথে গেলাম, তবে এবার আর স্টেশন পর্যন্ত না গিয়ে মার্কেটে গেলাম কারণ মার্কেট কখন খোলে জানার ছিল। এখানে জানিয়ে রাখি এই মার্কেটের এলাকায় অনেকগুলো এ টি এম আছে। হেঁটে ফিরে আসার পথে আমাদের হোটেলের ঠিক সামনেই একটা চার্চ আছে, সেটা দেখে এলাম। ভিতরে ঢুকতে পারা গেল না কারণ এত সকালে চার্চ খোলেনি। হোটেলে ফিরে এসে জিনিসপত্র গুছিয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। তারপর চেক্‌ আউট করে এগারোটা নাগাদ গাড়ি করে রওনা দিলাম আমাদের দ্বিতীয় গন্তব্য সিটং-এর দিকে।

সিটং যাওয়ার পথে
কার্সিয়ং থেকে সিটং যেতে ঘন্টা দেড়েক মতো লাগে। যাওয়ার পথে প্রথমে কিছুক্ষণ উপরে উঠতে হয় আর তারপরে নামতে হয়।  মাঝের কিছুটা জায়গায় রাস্তা বেশ খারাপ, সেটা বাদ দিলে বাকিটা মন্দ নয়। আমাদের যাওয়ার পথে আবার ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হল, যেটা সিটং পৌঁছনোর আগে আর থামল না। সিটং-এর উচ্চতা ৪,০০০ ফুটের মতো অর্থাৎ কার্সিয়ঙের থেকে কম। ঠান্ডা এখানে তুলনামূলক কম হলেও বৃষ্টির জন্য সেটা সেভাবে বোঝা যাচ্ছিল না।

বিসেস হোম স্টে-তে আমাদের ঘর
আমাদের বুকিং ছিল 'বিসেস হোম স্টে'-তে। আমরা চেক্‌ ইন করে ঘরে ঢুকলাম। এখানে থাকা-খাওয়া মিলিয়ে মাথাপিছু টাকা নেয়। আমাদের লোকসংখ্যা সাত বলে এরা আমাদের দু'টো ট্রিপল্‌ বেড রুম দিল। ঘরগুলো বেশ বড়। বাথরুমে গিজার আছে। হোম স্টে-টা বেশ বড় এবং খুব সুন্দরভাবে সাজানো। এরা পুরো হোম স্টে জুড়ে প্রচুর গাছ লাগিয়েছে, তার মধ্যে অনেক অর্কিডও আছে।  অনেক বসার জায়গা করা আছে, যেখানে বসে বসে সামনের পাহাড়ের দৃশ্য দেখতে দিব্যি লাগে। সিটং জায়গাটা ফাঁকা ফাঁকা, নিরিবিলি, এখানকার পরিবেশ খুবই শান্ত।

বিসেস হোম স্টে
এখানকার ডাইনিং রুমে লাঞ্চ দেওয়া হয় দুপুর একটার সময়ে। লাঞ্চের মেনু ভাত, ডাল, আলুর তরকারী, সয়াবিনের তরকারী, ডিমের কারি আর পাঁপড়। খাবারের সিস্টেম হল ব্যুফে অর্থাৎ যে যত ইচ্ছে খেতে পারে। হ্যাঁ, এটা ডিমের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এবং খাবারের মান অত্যন্ত ভালো। জীবনে ভালো রান্না খাওয়াটাকে যারা অগ্রাধিকার দেয় (যেমন আমি দিই), তাদের বিশেষ করে অনুরোধ করব বিসেস হোম স্টে-তে থাকার জন্য। বেড়াতে গিয়ে এত ভালো মানের রান্না আমি সত্যিই খুব বেশি খাইনি।

ফুলের বাগানের পথে
খাওয়ার কিছুক্ষণ পরে আমরা গেলাম হোম স্টে-র পিছনের রাস্তা ধরে একটা ফুলের বাগান দেখতে। বাগানটা পাহাড়ের ধাপে ধাপে তৈরি হয়েছে। সেখানে কিছুক্ষণ ঘুরে আমরা কিছুটা নেমে এলাম। এখানে আরেকটা রাস্তা ধরে পৌঁছলাম একজনের বাড়িতে। মালিক নিজে উপস্থিত ছিলেন, তিনিই ঘুরে ঘুরে তাঁর নিজস্ব পোলট্রী, বাগান এসব দেখালেন। ভদ্রলোকের নিজের গাড়ির ব্যবসা। বাগানের শেষ প্রান্তে উনি নিজে একটা শিবের মন্দির তৈরি করেছেন। এখানকার মানুষজনের মধ্যে আন্তরিকতা জিনিসটা সবসময়েই লক্ষ্য করার মত, এই ভদ্রলোকের কাছ থেকেও সেটা একইভাবে পেলাম।

রাতের ঠান্ডায়
ঘোরাঘুরি করে আবার হোম স্টে-তে ফিরে এলাম। বিকেল হয়ে গেছে, আস্তে আস্তে ঠান্ডা বাড়ছে তাই এবার ঘরেই ঢুকে বসে রইলাম। সন্ধ্যে ছটার সময়ে এরা ঘরে ঘরে চা আর পেঁয়াজের পকোড়া দিয়ে গেল। সেগুলো খেয়েদেয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করে সময় কাটালাম। সিটং-এর ঠান্ডা কার্সিয়ঙের থেকে কম ঠিকই, কিন্তু কার্সিয়ঙে খেতে যাওয়ার সময় ছাড়া ঠান্ডার মধ্যে বেরোনোর দরকার হত না। সিটং-এ কিন্তু পাশের ঘরে যাওয়ার জন্যও বারান্দা দিয়ে যেতে হয় যেটার সামনের দিকটা খোলা। তাই ঠান্ডা খুবই লাগছিল। রাত ন'টার সময়ে এরা ডিনার দেয়। মেনু ভাত, রুটি, ডাল, সয়াবীনের তরকারী আর চিকেন। এটাও অপরিমিত - হ্যাঁ, চিকেনও। এবং চিকেন কারির মান অত্যন্ত ভালো। আবার বলছি, শুধুমাত্র ভালো খাওয়ার জন্যই একবার বিসেস হোম স্টে-তে গিয়ে থাকা যেতে পারে।

সিটং-এর পথে শোর্তেন
২৬শে জানুয়ারী, ২০২২ - আমাদের ফেরার দিন। সকালে আমি হাঁটতে বেরোলাম সাড়ে সাতটা নাগাদ। সিটং জায়গাটা খুবই ছোট, বিসেস হোম স্টে থেকে যেকোনওদিকে মিনিট পনেরো হাঁটলেই গ্রামটা শেষ হয়ে যায়। তখন আর পাঁচটা পাহাড়ী রাস্তার সঙ্গে কোনও পার্থক্য নেই। এইরকম ছোট ছোট পাহাড়ী গ্রামের দোকানগুলো আমার বেশ মজার লাগে, প্রায় সব দোকানেই সবকিছুই পাওয়া যায়। ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে আমি আবার ফিরে এলাম।

বিসেস হোম স্টে-র সামনে
এখানে ব্রেকফাস্ট দেয় সকাল ন'টায়। মেনু লুচি, ছোলার তরকারী আর আলুর তরকারী। সেইসঙ্গে চা। বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ আমরা চেক্‌ আউট করলাম। চেক্‌ আউটের সময়ে এখানকার রীতি অনুযায়ী আমাদের গলায় একটা করে সাদা সিল্কের স্কার্ফ পরিয়ে দিল। আর সেইসঙ্গে আমাদের দলের তিনজন মহিলার (মা, অমৃতা আর সোনামাসি) হাতে এক প্যাকেট করে চা দিল। এটা এদের নিজেদের বাগানের হার্বাল টী। আমরা অত্যন্ত আপ্লুত বোধ করলাম। এদের বারবার "ফির মিলেঙ্গে"র উত্তরে নিজেদের মুখ থেকে স্বতস্ফূর্তভাবেই কথাটার প্রতিধ্বনি হতে থাকল। এবং এটা শুধু আপ্তবাক্য নয়, আমরা ঠিক করলাম দু'এক বছরের মধ্যে আমরা সিটং-এ আরেকবার অবশ্যই আসব।

নামথিং পোখারি
নামথিং পোখারিঃ হোম স্টে থেকে বেরিয়ে আধঘন্টা মতো চলার পরে আমরা পৌঁছলাম একটা জায়গায় যার নাম নামথিং পোখারি বা নামথিং লেক। এখন শীতকালে লেকে অবশ্য জল নেই। লেকের পাশে পাহাড়ের মধ্যে একটা অপেক্ষাকৃত সমতল জায়গায় সিঙ্কোনা গাছের চাষ করা হয়। একেবারে ভিতর পর্যন্ত গাড়ি যায় না, শেষের মিনিট পাঁচেক হেঁটে গিয়ে দেখতে হয়। এখানে কাছাকাছি স্যালাম্যান্ডার দেখতে পাওয়া যায়, যদিও আমরা দেখতে পাইনি। খুব ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল, তাই তাড়াতাড়ি ঘুরে আমরা আবার গাড়িতে গিয়ে উঠলাম।

অহলদাড়া ভিউ পয়েন্টে ওঠার পথ
অহলদাড়া ভিউ পয়েন্টঃ গাড়ি মিনিট পাঁচেক চলার পরে পোঁছলাম অহলদাড়া ভিউ পয়েন্টের গেটে। এখানে গাড়ি ঢোকার জন্য ৫০/- টাকা করে লাগে। গেট দিয়ে ঢোকার পরে কিছুটা গিয়ে একটা পার্কিং-এর জায়গা আছে, সেখানে ছোট গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে আর বাকিটা হেঁটে উঠতে হয়। কারণ এই শেষের পথটা মাটির এবং সেইসঙ্গে এতটাই খাড়া আর এবড়োখেবড়ো যে সুমো, ইনোভা বা স্কর্পিও ছাড়া অন্য কোনও গাড়ির পক্ষে ওঠা অসম্ভব। আর সেইসঙ্গে চাই বিশেষ দক্ষ ড্রাইভার। কারণ ওঠার সময়ে যদি একবার গাড়ির চাকা পিছনদিকে হড়কায়, তাহলে গাড়িকে আর কিছুতেই সেখানে দাঁড় করিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের সুমো আর দক্ষ ড্রাইভার দুটোই ছিল, তাই নিজেদের আর হেঁটে উঠতে হল না।

অহলদাড়া ভিউ পয়েন্টে
অহলদাড়া ভিউ পয়েন্ট ৩৬০ ডিগ্রী ভিউ দেখতে পাওয়ার জন্য বিখ্যাত। এটা একটা পাহাড়ের একেবারে মাথা এবং আশেপাশে আরে কোনও উঁচু পাহাড় নেই। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার পুরো শ্রেণীটা যেমন দেখা যায়, তেমনই তিস্তানদী এবং দূরে আবছা শিলিগুড়ি শহরও দেখতে পাওয়া যায়। এই স্বর্গীয় দৃশ্যের জন্য কাছাকাছি কোথাও এলে এখানে আসা অবশ্য কর্তব্য। দুর্ভাগ্যক্রমে আকাশে ঘন সাদা মেঘ থাকায় আমরা এই স্বর্গীয় দৃশ্যের কিছুই দেখতে পেলাম না। এখানে পাহাড়ের গায়ে চা-বাগান আছে, সেসব দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হল। এখানে ঠান্ডাও বেশ বেশি আর চারদিক খোলা হওয়ায় প্রচন্ড হাওয়া চলাচল করে। আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছবিটবি তুলে নেমে এলাম।

হামরো হোম স্টে
এখানে জানিয়ে রাখি, অহলদাড়া ভিউ পয়েন্টে একেবারে পাহাড়ের উপরেই একটা হোম স্টে আছে, নাম হামরো হোম স্টে। এদের পাঁচটা আলাদা কটেজ আছে, ভিতরে দু'জন বা তিনজন করে থাকা যেতে পারে। যদি ১০-১৫ জনের মতো বড় দল নিয়ে যাওয়া যায়, এখানে দু'একদিন থাকতে ভালোই লাগবে।

অরেঞ্জ গার্ডেন


অরেঞ্জ গার্ডেনঃ অহলদাড়া ভিউ পয়েন্ট থেকে আমরা এবার নামতে শুরু করলাম। মিনিট দশেক চলার পরে পৌঁছলাম অরেঞ্জ গার্ডেন-এ। রাস্তার দুদিকে সারি সারি কমলালেবু গাছ আর সেই গাছে শয়ে শয়ে কমলালেবু ঝুলছে। এর আগে তাক্‌দা ভ্রমণের সময়ে ছোটা মাঙ্গোয়ায় অরেঞ্জ গার্ডেন দেখেছিলাম কিন্তু তখন সিজন ছিল না বলে গাছে কমলালেবু সেভাবে দেখতে পাইনি। এখানে শুধু দেখলাম না, কিনলামও। এখানকার লেবুগুলো আকারে ছোট - দামেও কম। একটা প্যাকেটে ২০টা লেবু, প্যাকেটের দাম ১০০/- টাকা। আমরা দু'টো প্যাকেট কিনলাম। খেয়ে দেখলাম আশ্চর্যরকম মিষ্টি।

তিস্তা নদী
তিস্তা নদীঃ গাড়ি আরও নামতে শুরু করল। নামতে নামতে একসময়ে আমাদের চেনা রাস্তা সেভক রোডে এসে পৌঁছল। কিছুক্ষণ চলার পরে নদীর ধারে এক জায়গায় ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করালো - এটাও একটা ভিউ পয়েন্ট। আমরা যারা এই পথ দিয়ে অনেকবার যাতায়াত করেছি, তাদের কাছে এই দৃশ্য নতুন না হলেও আগ্রহজনক তাই গাড়ি থেকে নেমে ছবি তুলে নিলাম।

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে
আমাদের ভ্রমণ শেষ। দুপুর প্রায় দুটো বাজে, তাই লাঞ্চ করার জন্য দাঁড়ালাম সেভক রোডের উপরে তিস্তা নদীর ধারে। এই অঞ্চলের দোকানে আমরা আগে বেশ কয়েকবার খাওয়াদাওয়া করেছি। লাঞ্চে ভাত চিকেন আর মোমো খাওয়া হল। খরচ হল ৮৬০/- টাকা। তারপর আরও ঘন্টাখানেক গাড়ি চলার পরে বিকেল চারটে নাগাদ পৌঁছে গেলাম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে।


স্টেশনে পৌঁছে ড্রাইভারকে তাঁর পাওয়া মিটিতে দেওয়া হল। ড্রাইভারের নাম প্রদীপ (পদবী জানা হয়নি) এবং ভদ্রলোক খুবই ভালো। গত তিনদিনে অনেকটা সময় উনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন এবং আমাদের সঙ্গে অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছিল। সারা রাস্তায় আমরা ওনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পেরেছি, উনি বিভিন্নভাবে আমাদের অনেক সাহায্যও করেছেন। কার্সিয়ঙের বটানিক্যাল গার্ডেনে চড়াই-উৎরাই পথে মা আর সোনামাসিকে হাত ধরে নিয়ে যাওয়া, অহলদাড়া ভিউ পয়েন্টে ওদের জন্য গাড়িটা কষ্ট করে উপরে তোলা এইসবই উনি নিজে থেকেই করেছেন। আমাদের কাছে কখনওই কিছু চাননি এমনকি গাড়ির তেলের টাকাও না, সেটার পুরোটাই আমরা দিয়েছি স্টেশনে পৌঁছে। সেইসঙ্গে আমরা আলাদা করে ওনাকে কিছু টিপ্ও‌ দিয়েছি। এই অঞ্চলে গাড়ির দরকার হলে ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। মোবাইল নম্বর - 8145562910.

আমাদের ফেরার ট্রেন ছিল দার্জিলিঙ মেল রাত আটটায়। মাঝের সময়টা আমরা ওয়েটিং রুমে বসে কাটালাম। আর সেইসঙ্গে রাতের ডিনারের জন্য খাবার কিনে নেওয়া হল।

দার্জিলিঙ মেল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে এসে পৌঁছলো তখন সাড়ে সাতটা। উঠে ট্রেনটা আসার ট্রেনের থেকেও বেশি ফাঁকা। নির্ধারিত সময়ে ট্রেন থামল আর পরেরদিন সকাল ঠিক ছ'টায় শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে দিল। সাতটা নাগাদ বাড়ি পৌঁছে গেলাম।

সারসংক্ষেপ ঃ

১. পশ্চিমবঙ্গের হিল স্টেশনের মধ্যে দার্জিলিঙ বাদ দিলে প্রথমেই যে দুটো নাম মনে পড়ে তার মধ্যে একটা হল কার্সিয়ং। দার্জিলিঙের থেকে কম উচ্চতায় পাহাড়ের গায়ে তৈরি এই শহর দু'তিনদিন বেড়াতে যাওয়ার পক্ষে খুবই উপযোগী।

২. নিউ জলপাইগুড়ি থেকে কার্সিয়ঙের দূরত্ব ৪৩ কিলোমিটারের মতো। গাড়িতে যেতে ঘন্টাখানেক লাগে।

৩. কার্সিয়ঙে অনেক হোটেল আছে, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন বিভাগের ।রৌদ্র ছায়া ট্যুরিজম প্রপার্টি (ভূতপূর্ব কার্সিয়ং ট্যুরিস্ট লজ) উল্লেখযোগ্য। এদের ওয়েবসাইট https://wbtdcl.wbtourismgov.in/home থেকে বুকিং করা যায় অথবা কলকাতার বুকিং অফিস থেকেও বুকিং করা যেতে পারে।

৪. কার্সিয়ং ট্যুরিস্ট লজের খাওয়াদাওয়া বেশ ভালো। এখানকার খাবার না খেতে চাইলে খুব কাছাকাছির মধ্যে সেরকম কোনও খাবার জায়গায় নেই, সবচেয়ে কাছে যেটা আছে সেখানে যেতে গেলেও মিনিট পনেরো হাঁটতে হবে।

৫. কার্সিয়ঙে ঘোরার বেশ অনেকগুলো জায়গা আছে। তার মধ্যে হনুমান স্ট্যাচু (স্ট্যাচুটা নয়, এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য) এবং পাইন ফরেস্ট অবশ্য দ্রষ্টব্য।

৬. কার্সিয়ঙের যা সাইট সিয়িং আছে, তারজন্য হাতে ঘন্টা তিনচারেক রাখাই যথেষ্ট। যদি দু'রাতের বেশ এখানে থাকা হয়, তাহলে এখান থেকে বাতাসিয়ালুপ, দার্জিলিং এইসব জায়গাগুলোও ঘুরে আসা যেতে পারে। কার্সিয়ং থেকে দার্জিলিঙের দূরত্ব ৩০ কিলোমিটারের মতো আর যেতে ঘন্টাখানেকের বেশি লাগে না।

৭. জানুয়ারী মাসে কার্সিয়ঙে বেশ ভালোরকম ঠান্ডা পড়ে। এইসময়ে যদি এখানে আসার পরিকল্পনা করা হয়, তাহলে যথেষ্ট গরম জামাকাপড় সঙ্গে রাখতে হবে।

৮. কার্সিয়ং থেকে সিটং-এর দূরত্ব প্রায় ২৪ কিলোমিটার হলেও যেতে ঘন্টা দেড়েক সময় লাগে কারণ রাস্তা একেকজায়গায় বেশ খারাপ। সিটং-এর উচ্চতা কার্সিয়ঙের থেকে কম, ঠান্ডাও কম।

৯. সিটং-এ হোটেল সেভাবে নেই, বেশিরভাগই হোম স্টে। আমাদের বিসেস হোম স্টে-টা খুবই সুন্দর এবং এখানকার খাওয়াদাওয়াও অত্যন্ত উন্নতমানের। এদের ওয়েবসাইট https://www.biseshhomestay.com/ এবং যোগাযোগের নম্বর 7076060266 / 9382025312.

১০. হোম স্টে-র ভাড়া থাকা এবং খাওয়া মিলিয়ে মাথাপিছু হিসেবে হয়। খাওয়ার মধ্যে এরা ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ইভনিং স্ন্যাক্স আর ডিনার দেয়।

১১. সিটং জায়গাটায় সেভাবে দেখার কিছু নেই, তবে দু'একদিনের জন্য এখানে গিয়ে থাকতে খুবই ভালো লাগবে। কাছাকাছির মধ্যে অহলদাড়া ভিউ পয়েন্ট একটা দেখার জায়গা। তাছাড়া অল্প কিছুটা দূরে মংপু আছে যেখানে রবীন্দ্রনাথের বাড়ি একটা দর্শনীয় জায়গা।

১২. শীতকালে গেলে সিটং-এর অরেঞ্জ গার্ডেনে অবশ্যই যাওয়া উচিৎ। এখানকার কমলালেবু অত্যন্ত ভালো মানের।

উপসংহার ঃ

কার্সিয়ং
পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে পুরনো হিল স্টেশনগুলোর মধ্যে অন্যতম হল কার্সিয়ং - পাহাড়ের গায়ে একটা শহর। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে মাত্র ঘন্টাখানেকের দূরত্বে এই শহরের ঘুরতে যাওয়ার সুবিধে হল উত্তরবঙ্গে এবং সিকিমে গত কয়েকবছরে ঘোরার অনেকগুলো নতুন নতুন জায়গা হওয়ায় কার্সিয়ঙে এখন লোকের ভীড় কমই থাকে। জায়গাটা উপভোগ্য - কাছাকাছির ঘোরার জায়গাগুলোও সুন্দর। সিটং-এর কথা বলতে গেলে শুধু এটাই বলব এখানে অন্ততঃ দু'রাত থাকতে পারলে ভালো। নিজেরা বড় দল নিয়ে যেতে পারলে এখানে যাওয়াটা সবথেকে বেশি আনন্দদায়ক হবে। সিটং-এ সেভাবে ঘোরার কোনও জায়গা নেই, দরকারও নেই। শুধু হোম স্টে-র বারান্দায় বসে সামনের পাহাড়ের গায়ের দৃশ্য দেখেই এখানে অনায়াসে সময় কেটে যাবে। আর বিসেস হোম স্টে-তে থাকলে এখানকার খাবার খেয়েও খুব ভালো লাগবে। কার্সিয়ং গেলে সিটং যে যেতেই হবে এমন কোনও কথা নেই, তবে জায়গাদু'টো পরস্পরের খুব একটা দূরে নয় বলে একসঙ্গে যাওয়াও যেতে পারে। দু'টো জায়গার সৌন্দর্য দু'রকম - তুলনা করার চেষ্টা করা বোকামি। তবে এটা জোর দিয়ে বলতে পারি দু'টো জায়গাতেই গিয়ে খুব ভালো লাগবে। লেখা শেষ করছি সেই সতর্কীকরণ দিয়েই - দীঘা নিউ জলপাইগুড়ি এক্সপ্রেস বা পাহাড়ীয়া এক্সপ্রেসে ট্রেন 'নৈব নৈব চ' !

কার্সিয়ং ও সিটং ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.