আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Sunday, January 1, 2023

ঝাড়গ্রাম ও জামশেদপুর ভ্রমণ

বিশেষ সতর্কীকরণঃ

১. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও অবস্থাতেই কোনও পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার করিনি। অর্থাৎ প্লাস্টিকের ব্যবহার না করেও এই ভ্রমণ অনায়াসে করা যায়।

২. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও কাগজ ব্যবহার বা নষ্ট করিনি। হোটেল বুকিং-এর রশিদ-এর প্রিন্ট আউট ব্যবহারের কোনও প্রয়োজন হয় না।

৩. এই পুরো ভ্রমণে আমাদের দলের কেউ ধূমপান করেনি। ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।

আমার ব্লগের সমস্ত পাঠকদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি প্লাস্টিক, অপ্রয়োজনীয় কাগজের ব্যবহার আর ধূমপান বর্জন করার জন্য।

ভ্রমণপথঃ

বুধবার ২৮শে ডিসেম্বর, ২০২২ঃ সকাল ৬ঃ৪০ মিনিটে কলকাতা থেকে গাড়িতে যাত্রা করে দুপুর ১১ঃ৩০ মিনিটে ঝাড়গ্রাম - ঝাড়গ্রামে রাত্রিবাস।

বৃহস্পতিবার ২৯শে ডিসেম্বর, ২০২২ঃ সকাল ৯টায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে বেলপাহাড়ী - ঝাড়গ্রামে রাত্রিবাস।

শুক্রবার ৩০শে ডিসেম্বর, ২০২২ঃ সকাল ৯ঃ৩০ মিনিটে ঝাড়গ্রাম থেকে বেরিয়ে পথে সাইট সিয়িং - সন্ধ্যে ৭ঃ৩০ মিনিটে জামশেদপুর - জামশেদপুরে রাত্রিবাস ।

শনিবার ৩১শে ডিসেম্বর, ২০২২ঃজামশেদপুরে সাইট সিয়িং - জামশেদপুরে রাত্রিবাস।

রবিবার ১লা জানুয়ারী, ২০২৩ঃ সকাল ৯টায় জামশেদপুর থেকে বেরিয়ে পথে সাইট সিয়িং - দুপুর ২টোয় খড়্গপুরে মনসামন্দির - বিকেল ৪টেয় খড়্গপুর থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যে ৬ঃ৩০ মিনিটে কলকাতা।

মাদের পশ্চিমবঙ্গ জেলার পশ্চিমে নবনির্মিত জেলা ঝাড়গ্রাম। এই জেলার সদর হল ঝাড়গ্রাম শহর। ঝাড় অর্থাৎ ঘন জঙ্গল - সেই থেকে গ্রামের নাম ঝাড়গ্রাম। ঝাড়গ্রাম জেলা মোটামুটি পশ্চিমবঙ্গ আর ঝাড়খন্ডের সীমানায় আর সীমানা পেরিয়ে কিছুদূর গেলে ঝাড়খন্ড জেলার সবথেকে বড় এবং সবথেকে বেশি জনবসতিপূর্ণ শহর জামশেদপুর। ইংরিজির বর্ষশেষের কয়েকদিন ধরে এই ঝাড়গ্রাম আর জামশেদপুরে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়েই আমার ব্লগের এবারের পোস্ট।

বছরের শেষের দিনগুলোয় ঘুরতে যাওয়ার প্রধান সমস্যা হল এই সময়ে যেকোনও পরিচিত জায়গাতেই প্রচন্ড ভীড় হয় যার ফলে হোটেল, ট্রেনের বুকিং ইত্যাদির পাওয়া মুশকিল হয়। হোটেলের ভাড়া, ঘোরার গাড়িভাড়া, খাবারের দাম সবই বছরের অন্যান্য সময়ের থেকে বেশ কিছুটা বেশি হয়। ভীড়ের কারণে জায়গাগুলো ভালোভাবে ঘোরাও যায় না। এইসব মাথায় রেখে এই সময়ে ঘোরার জন্য আমরা সাধারণতঃ তুলনামূলকভাবে অপরিচিত বা কম বিখ্যাত জায়গা খুঁজে বের করি। আমাদের গাড়ি নিয়ে শেষ গিয়েছিলাম গত মার্চ মাসে বরন্তি ও গড়পঞ্চকোটে, তাই যখন ঝাড়গ্রাম আর জামশেদপুর যাওয়ার কথা হল, তখন গাড়ি নিয়ে যাওয়াই স্থির করলাম।

ব্রেকফাস্ট ব্রেক
২৮শে ডিসেম্বর, ২০২২ - বুধবার সকাল ৬ঃ৪০ মিনিটে আমরা বেরোলাম আমাদের গাড়ি নিয়ে। এবারে আমরা আটজন - আমি, অমৃতা, বাবা, মা, কথা, কলি, সোনামাসি আর মশাই। কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রামের দূরত্ব ১৮০ কিলোমিটারের মতো - যেতে ঘন্টা চারেক লাগার কথা। যাত্রাপথ কলকাতা - বিদ্যাসাগর সেতু পেরিয়ে কোনা এক্সপ্রেসওয়ে - ১৬ নং জাতীয় সড়ক - ৪৯ নং জাতীয় সড়ক - ৫ নং রাজ্য সড়ক - ঝাড়গ্রাম । আমরা কোলাঘাটের কাছে একটা দোকান থেকে লুচি তরকারি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম (না, শের-ই-পাঞ্জাব নয়)। খরচ হল ৩৫০/- টাকা। এছাড়া রাস্তায় আরেকবার দাঁড়িয়েছিলাম চা খাওয়ার জন্য। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্য - ঝাড়গ্রামের সোমানি ইন্‌-এ।

সোমানি ইন্‌-এর ঘর
সোমানি ইন্‌ হোটেলটা বেশ বড়। একটা কম্পাউন্ডের মধ্যে দুদিকে দুটো আলাদা বিল্ডিং আর মাঝখানে একটা বড় চত্বর। এখানে গাড়ি পার্কিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের দুটো ঘর নেওয়া ছিল - একটা ডাব্‌ল্‌ বেড আর একটা ফোর বেড। ঘরগুলো বেশ বড়, প্রত্যেকটা ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ব্যালকনি। আমরা স্নানটান করে নিয়ে ডাইনিং রুমে গেলাম। ডাইনিং রুমটাও বেশ বড় - একসঙ্গে অন্ততঃ সত্তর-আশিজন বসে খেতে পারে। আমরা মাছ থালি, ডিম থালি আর নিরামিষ থালি মিলিয়েমিশিয়ে নিলাম। খরচ হল ১,৩৪০/- টাকা।

লাঞ্চ করে গাড়ি নিয়ে আমরা কাছাকাছি জায়গাগুলো ঘুরতে বেরোলাম।

ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি
ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি - আমাদের হোটেল থেকে ৪.৫ কিলোমিটার দূরে ঝাড়গ্রাম শহরের মধ্যেই ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি। এখানে পৌঁছে গাড়ি বাইরে রেখে আমরা একটা ফটক দিয়ে হেঁটে ঢুকলাম। কিছুটা হাঁটার পর আরেকটা লোহার গেট আর সেটা বন্ধ। মূল রাজবাড়িতে প্রবেশ নিষেধ, এই গেটের বাইরে থেকেই রাজবাড়িটা দেখতে হয়। এই রাজবাড়ি বর্তমানে হোটেল হিসেবে ব্যবহার হয় অর্থাৎ কেউ চাইলে এখানে থাকতে পারে। আর এই কারণেই বুকিং না থাকলে বাইরের কাউকে এখানে ঢুকতে দেওয়া হয় না। আমরা লোহার গেটের বাইরে থেকেই যা দেখার দেখে নিলাম। বাড়িটা দেখতে খুবই সুন্দর আর সেইসঙ্গে এর আয়তনও বিশাল। এটা অবশ্য নতুন রাজবাড়ি যা ১৯৩১ সালে তৈরি হয়। এই বাড়িতে সিনেমার শ্যুটিং হয় এটা আগেই জানতাম। যেমন 'টিনটোরেটোর যীশু'তে নিয়োগী বাড়ি বা 'দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন' ছবিতে ডাম্বলদের বাড়ির শ্যুটিং এই বাড়িতেই হয়েছে। নতুন বাড়ির পিছনে পুরনো রাজবাড়িটা এখনও আছে, যদিও সেটা বাইরে থেকে দেখা যায় না। আমরা এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছবি তুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র
প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র - ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি থেকে ১.৫ কিলোমিটার দূরে ঝাড়গ্রাম প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র। এটা প্রকৃতপক্ষে একটা রিসর্ট। আমাদের আসার পথে যে ৫ নং রাজ্য সড়ক পড়েছিল এটা তারই পাশের জঙ্গলের মধ্যে। এটাই এর বৈশিষ্ট্য। রিসর্ট একটা দেখার মতো কিছু নয়, তাই আমরা এখানে আর গাড়ি থেকে নামলাম না, যেটুকু দেখার সেটা দেখে চলে এলাম।

সাবিত্রী মন্দির
সাবিত্রী মন্দির - প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র থেকে ঝাড়গ্রাম শহরের দিকে ফেরার পথে ১ কিলোমিটার গেলে সাবিত্রী মন্দির। এটাও রাস্তার ধারে। মন্দিরটা সেরকম কিছু বড় নয়, তবে বেশ পরিপাটি। এটা সাবিত্রী দেবীর মন্দির যাঁকে এখানে দুর্গা ধ্যানে পুজো করা হয়। মূল মন্দিরের মাথাটা গম্বুজাকৃতি। চত্বরটা মার্বেল দিয়ে বাঁধানো। ভিতরে একটা বাগান রয়েছে, সেখানে টবে নানারঙের ফুলের রকমারি গাছের বাহার। আমরা এখানে কিছুক্ষণ থেকে এগিয়ে গেলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।

মিনি জু-এর ভিতরে
ঝাড়গ্রাম মিনি জু - সাবিত্রী মন্দির থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ঝাড়গ্রাম শহরের সবথেকে বড় আকর্ষণ - ঝাড়গ্রাম মিনি চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখলাম এখানে বেশ ভালোই ভিড় হয়েছে। এটা খুবই স্বাভাবিক কারণ শীতকালের এই সময়টা চিড়িয়াখানা দেখার পক্ষে একেবারে আদর্শ (কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানাতেও এই সময়ে প্রচন্ড ভিড় হয়)। নির্ধারিত জায়গায় গাড়ি পার্কিং করে আমরা টিকিট কেটে চিড়িয়াখানায় ঢুকলাম তখন বিকেল ৩ঃ৪৫। টিকিটের মূল্য বড়দের মাথাপিছু ২৫/- টাকা আর ছোটদের (৩ থেকে ১২ বছর) মাথাপিছু ১০/- টাকা।

মিনি জু-এ চিতা
ঝাড়গ্রাম জায়গাটা জঙ্গলমহলের মধ্যে পড়ে। তাই এই চিড়িয়াখানার নাম 'জঙ্গল মহল জুলজিক্যাল পার্ক'। চিড়িয়াখানার পরিসরটা বেশ বড়। পুরো জায়গাটা একটা অসমতল ভূমির উপর আর সেইসঙ্গে গাছপালা ঘেরা। ফলে বেশ একটা জঙ্গল জঙ্গল অনুভূতি হয়। এই জঙ্গলের মধ্যেই খাঁচা দিয়ে ঘেরা অনেকগুলো জায়গা আছে আর তার ভিতরে রয়েছে বিভিন্ন জানোয়ার আর পাখি। জানোয়ারের মধ্যে হরিণ নীলগাই কচ্ছপ গোসাপ খরগোশ ভাল্লুক চিতা হায়না বাঁদর ইত্যাদি আরও নানা চেনা অচেনা প্রজাতি আছে। পাখিদের মধ্যে রয়েছে এমু উটপাখি ময়ূর ইত্যাদি। তাছাড়া একটা সাপের ঘরও আছে। শীতকালে সাধারণতঃ সাপের দেখা পাওয়া যায় না কিন্তু চিড়িয়াখানার সাপ থাকে কাচের ঘরের ভিতরে তাই এখানে আমরা গোখরো অজগর ইত্যাদি বেশ কয়েকটা সাপকেই দেখতে পেলাম। ঢোকার সময়ে পুরো চিড়িয়াখানাটা যতটা বড় বলে মনে হয়েছিল, বাস্তবে সেটা তার থেকে অনেকটাই বড়, তাই দেখতে দেখতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল।

চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে আমরা হোটেলে ফেরার পথ ধরলাম। রাস্তায় একজায়গায় চা-টা খেয়ে নেওয়া হল। হোটেলে ফিরে আর কিছু করার নেই, তাই গল্প করে আর টিভি দেখে সময় কাটিয়ে দিলাম। রাতে ডিনারটা আমরা ঘরে বসেই করলাম। ভাত, ডাল, রুটি, তড়কা, পনীর ইত্যাদি নিয়ে খরচ হল ৫৫৪/- টাকা।

২৯শে ডিসেম্বর, ২০২২ বৃহস্পতিবার - আমাদের বেলপাহাড়ী যাওয়ার দিন। সকাল নটা নাগাদ আমরা হোটেল থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে একটা দোকান থেকে পরোটা, ঘুগনি আর ওমলেট দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম। এই দোকানের পরোটাটা বিশেষ ভালো। সবমিলিয়ে খরচ পড়ল ১৮০/- টাকা। এরপর আমরা বেলপাহাড়ী রওনা দিলাম।

ঝাড়গ্রাম থেকে বেলপাহাড়ী যেতে হলে যে ৫ নং রাজ্য সড়ক দিয়ে আমরা এসেছি, সেটা ধরেই আরও ৫০ কিলোমিটার এগিয়ে যেতে হয়। বেলপাহাড়ী পোঁছে জাতীয় সড়ক থেকে ডানদিকে একটা সরু রাস্তা ধরে ৫ কিলোমিটার গিয়ে আমরা পৌঁছলাম আমাদের প্রথম গন্তব্য - ঘাগরা জলপ্রপাতে।

ঘাগরা জলপ্রপাত
ঘাগরা জলপ্রপাত - জায়গাটায় পৌঁছে দেখলাম এখানে রীতিমতো পিকনিক হচ্ছে ! তবে পিকনিকের মতোই জায়গাও বটে। গাড়ি পার্কিং করে আমরা জলপ্রপাতের দিকে নেমে গেলাম। নদীর নাম তারাফেণি। বলা বাহুল্য, এই নদী বরফগলা জলে পুষ্ট নয়, বৃষ্টির জলে পুষ্ট তাই শীতকালে এতে স্রোত আশা করা বৃথা। নদীর সরু ধারা এখানে কিছু অনুচ্চ পাথরের উপর থেকে নিচে পড়ছে। জলপ্রপাত সেভাবে না দেখতে পেলেও জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনস্বীকার্য। আমরা পাথরের উপরে পা-দিয়ে নদীর অন্যপারের উঁচু জায়গাগুলোয় গেলাম আর সেখান থেকে আবার আরেকটা দিক দিয়ে হেঁটে ফিরে এলাম। দিনের বেলা সূর্য মাথার উপরে তাই বেশ গরম লাগছিল। ঘাগরা জলপ্রপাত দেখে আমরা আবার এগিয়ে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।

তারাফেণি বাঁধ
তারাফেণি বাঁধ - ঘাগরা জলপ্রপাত থেকে ভিতরের সরু রাস্তা দিয়ে আরও ৫ কিলোমিটার গেলে তারাফেণি বাঁধ। এখানে কিন্ত নদীর আকার বেশ বড় আর জলের পরিমাণও অনেক বেশি। এই জল লক্‌গেটের সাহায্যে আটকে রেখেই এখানে জলাধার তৈরি হয়েছে। লক্‌গেটের দুটো দিক দেখতে বেশ মজা লাগে - একদিকে সুগভীর জল আর অন্যদিকে খটখটে শুকনো। সবজায়গায় এটা এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়না। আমরা দুটো দিক বেশ ভালোভাবে দেখে ছবিটবি তুলে নিলাম।

গুড় জাল
তারাফেণি বাঁধের পাশেই একজায়গায় দেখলাম গুড় জাল দেওয়া হচ্ছে। এখানে রাস্তায় অনেক জায়গাতেই গুড় বিক্রি হয় সেটা আগেও দেখেছি। আমি নিজে গুড় জাল দেওয়া ব্যাপারটা কোনওদিন দেখিনি। মাটির মধ্যে গর্ত করে উনুন আর তার উপরে একটা বেশ বড় সাইজের চওড়া ট্রের মতো জিনিসে খেজুরের রস জাল দেওয়া হচ্ছে। এই রস জাল দিয়ে ঘন হবে আর সেটাই পাতলা গুড়ে পরিণত হবে। সেই পাতলা গুড় জমিয়ে আবার পাটালি তৈরি হবে। যে এই গুড় তৈরি করছে, পাশেই তার বাড়ি - সেখানে গুড় বিক্রিও হচ্ছে। দাম বেশ সস্তা। একটু চেখে দেখলাম, গুড়টা বেশ ভালো। তারপর বাড়ির জন্য আমরা এক কিলো গুড় কিনে নিলাম।

ঝাড়গ্রামের এ ডি এফ ও-র সঙ্গে আমরা
তারাফেণি বাঁধ থেকে আমরা আবার ৫ নং রাজ্য সড়কে ফিরে এলাম। অমৃতার কলেজের বন্ধু পার্থ মুখার্জীর সঙ্গে এখানে আমাদের দেখা হল । পার্থ বর্তমানে ঝাড়গ্রাম জেলার এ ডি এফ ও (অ্যাডিশনাল ফরেস্ট ডেভেলপ্‌মেন্ট অফিসার বা অতিরিক্ত বন আধিকারিক)। ও একটা সরকারী কাজে বেলপাহাড়ীতে এসেছে, সেই সুযোগে আমাদের সঙ্গে দেখা করে নিল। মিনিট দশেক আমরা দাঁড়িয়ে কথা বললাম আর তার মধ্যে ওর কাছ থেকে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য জানলাম। কথাগুলো যেভাবে হয়েছিল, আমার ব্লগের পাঠক/পাঠিকাদের জন্য সেভাবেই লিখছি ঃ

অমৃতা ঃ এখানে চারদিকে জঙ্গল, তোকে তো সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকতে হয়।

পার্থ ঃ সে আর বলতে। ঝাড়গ্রামের চারপাশে জঙ্গলের মধ্যে নানারকম জন্তু-জানোয়ার রয়েছে। আমাদের সারাক্ষণই ছুটে বেড়াতে হয়। অন্য সব জন্তুকে কন্ট্রোল করা যায়, কিন্তু সবচেয়ে বেশি চাপ হয় হাতিকে নিয়ে।

অমৃতা ঃ হাতি কি যখন তখনই বেরিয়ে পড়তে পারে ?

পার্থ ঃ যেকোনও সময়ে। তোরা যেখানে আছিস, অর্থাৎ সোমানি ইনে, তার ৫ কিলোমিটারের মধ্যে দিয়ে হাতি ঘোরাফেরা করে। কিছুদিন আগে তোদের হোটেলের ঠিক সামনের রাস্তা দিয়ে হাতির পাল চলে গেছে। ওখানে একটা স্কুলের পাঁচিল হাতির ধাক্কায় ভেঙে গেছে।

অমৃতা ঃ ও বাবা !

পার্থ ঃ আমাদের এইভাবেই চলে ! তোরা চিড়িয়াখানাটা দেখেছিস ? ওখানে যে চিতাটা আছে, গতবছর ওটা চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়েছিল।

অমৃতা আর আমি একসঙ্গে ঃ পালিয়েছিল ? কিকরে ?

পার্থ ঃ (নির্লিপ্তভাবে) খাঁচা টপকে।

অমৃতা ঃ অত উঁচু খাঁচা টপকাতে পারল ?

পার্থ ঃ (নির্লিপ্তভাবে সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে) হ্যাঁ। পালিয়ে গিয়ে সে জঙ্গলে ঢুকে গিয়েছিল। তারপর অনেক খোঁজাখুঁজি করে শেষ পর্যন্ত তাকে পাওয়া যায়। তারপর ট্রায়াঙ্কুলাইজার দিয়ে ধরা হয়।

অমৃতা ঃ (কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে) এখানে তোর নানারকম অভিজ্ঞতা হয়। শুনতেও বেশ ভালো লাগে। আমরা তো আজ জঙ্গলে যাব ঠিক করেছি, আমাদের কি কোনও জন্তু জানোয়ার দেখার সম্ভাবনা আছে ?

পার্থ ঃ তোরা তো যাবি কাঁকড়াঝোর ফরেস্ট, ওখানে জানোয়ার দেখার চান্স কম। হয়তো জঙ্গলের মধ্যে হরিণের পাল দেখতে পেতে পারিস।

অমৃতা ঃ যাঃ, আর অন্য কিছুই দেখা যাবে না ?

পার্থ ঃ সম্ভবতঃ না। আর না দেখতে পাওয়াই ভালো !

পার্থর এই শেষের কথাটা আমি চূড়ান্তভাবে সমর্থন করলাম। আমার মতে জানোয়ার দেখতে হলে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে দেখাই শ্রেয় এবং আমার আর জানোয়ারের মধ্যে একটা অনতিক্রম্য দেওয়াল (খাঁচা বা ওইজাতীয় কিছু) থাকাটা অবশ্য প্রয়োজনীয়। অর্থাৎ, হয় জানোয়ার খাঁচার মধ্যে আর আমি খাঁচার বাইরে অথবা জানোয়ার খাঁচার বাইরে আর আমি খাঁচার মধ্যে। জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা দিয়ে গাড়ি করে যেতে যেতে হঠাৎ যদি দেখি একপাল হাতি রাস্তা পার হচ্ছে বা একটা বাঘ রাস্তার উপরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, সেই অভিজ্ঞতা আমার কাছে মোটেই রোমাঞ্চকর হবে না। তার মানে এই নয় যে আমি এদের ভালোবাসি না। আমি জানোয়ার খুবই ভালোবাসি - কিন্তু সেটা একটা নির্দিষ্ট ব্যবধান থেকে। এই ব্যবধান তৈরি করার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষরা ওদের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে হাজার হাজার বছর ধরে লড়াই করেছে। আর আমি এই ব্যবধানটা কমাতে চাই না।

পার্থর থেকে বিদায় নিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য গদ্রসিনি পাহাড়ের দিকে। রাজ্য সড়ক ছেড়ে একটা গাছপালা ঘেরা মেঠো পথ ধরে সাত কিলোমিটার মতো চলার পরে আমরা পৌঁছলাম আমাদের দিনের তৃতীয় গন্তব্যে।

১০০ মিটার উচ্চতায় বাসুদেবের মন্দির
গদ্রসিনি পাহাড় - গদ্রসিনি পাহাড়ের উচ্চতা ২০০ মিটারের মতো। উপরে একটা শিবমন্দির আছে। ট্রেকিং করে উঠতে হয়। ওঠার রাস্তাটা একেবারেই শুশুনিয়া পাহাড়ের মতো অর্থাৎ পাথুরে এবড়োখেবড়ো। বরন্তি ভ্রমণের সময়ে কথা-কলি ৪৫০ মিটার উঁচু শুশুনিয়া পাহাড়ের মাথায় উঠেছিল, তাই এই গদ্রসিনি পাহাড় ওদের কাছে যাকে বলে 'বাচ্চাদের কাজ'। কথা কলি আর আমি উঠতে শুরু করলাম পাহাড়ের মাথায়। এখানেও বেশ ভীড়, অনেকেই পাহাড়ে চড়ছে। ১০০ মিটারের উপরে এখানে একটা বাসুদেবের মন্দির আছে - সম্ভবতঃ যারা ২০০ মিটার চড়তে পারবে না তাদের জন্য। আমরা এখানে একটু দাঁড়িয়ে আরও উপরে ওঠা শুরু করলাম।

গদ্রসিনি পাহাড়ের উপরে
বাকি পথটা বলতে গেলে পাহাড়ের পিছন দিক দিয়ে। এখানে ওঠার সময়ে পাহাড়ের পিছনের অনন্যসাধারণ দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। যতদূর চোখ যায় দিগন্তবিস্তৃত জঙ্গল - ঘন সবুজ গাছের ফাঁকে কোথাও কোথাও কিছুটা ন্যাড়া জমি। এরপর আরও কিছুটা ওঠার পরে আমরা পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের একেবারে মাথায়। শিবমন্দিরটাও দেখতে পেলাম তবে মন্দিরে ঢুকতে গেলে আবার জুতো খুলতে হবে বলে আর সেদিকে গেলাম না। বরং উপর থেকে নিচের দৃশ্য প্রাণভরে উপভোগ করলাম।

এবার নামার পালা। ওঠার সময়ে লেগেছিল পনেরো মিনিটের মতো, নামার সময়েও ওইরকমই লাগল। আগেও দেখেছি এইধরণের পাহাড়ে উঠতে নামতে প্রায় একই সময় লাগে। ওঠার সময়ে প্রয়োজন হয় দমের আর নামার সময়ে প্রয়োজন হয় ব্যালেন্সের।

দুপুর দুটো বেজে গেছে আর খিদেও পেয়েছে। গদ্রসিনি পাহাড় থেকে ফেরার পথে গ্রামের মধ্যেই একটা হোটেল পেয়ে গেলাম - নাম পবিত্র হোম স্টে। এখানে খাওয়াদাওয়া আর থাকার ব্যবস্থাও আছে। ভাত ডাল আলুভাজা তরকারি মাছ সবমিলিয়ে খরচ হল ১,১০০/- টাকা।

খাঁদারাণী লেকের পথে
লাঞ্চের পরে আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য - খাঁদারাণী লেকের দিকে। গদ্রসিনি পাহাড় থেকে ভিতরের রাস্তা দিয়ে খাঁদারাণী লেকের দূরত্ব মাত্র ২ কিলোমিটার আর যেতে মিনিট দশেকের বেশি লাগে না কিন্তু আমরা খাওয়ার জন্য কিছুটা এগিয়ে এসেছিলাম বলে আমাদের একটু ঘুরে যেতে হল। আমরা খাঁদারাণী লেক যখন পৌঁছলাম, ঘড়িতে তখন বিকেল পৌনে চারটে।

খাঁদারাণী লেক
খাঁদারাণী লেক - লেকটা বেশ বড়। এটা একটা প্রাকৃতিক হ্রদ। দেখতে বেশ সুন্দর। বিশেষ করে চারদিকে বেশ কিছু পাহাড়ের মধ্যে (তার মধ্যে গদ্রসিনিও আছে) এই লেকের সৌন্দর্য যেন আরও বেশি করে চোখে পড়ছিল। আমরা উপরের রাস্তা থেকে নিচে একেবারে লেকের পাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। বিকেল প্রায় হয়ে গেছে আর কিছুক্ষণ পরেই সূর্যাস্ত হবে, এই সময়ে লেকের দৃশ্য আরও সুন্দর লাগছিল। লেকের উপরে একটা সরু ব্রীজ আছে যেটা দিয়ে একটা গাড়িই যেতে পারে। এই রাস্তা দিয়ে লেকের ওপারে গিয়ে কিছুটা গেলে গদ্রসিনি পাহাড়ে যাওয়ার রাস্তা পাওয়া যায়।

খাঁদারাণী লেকে কিছুক্ষণ থেকে আমরা এবার রওনা দিলাম আমাদের দিনের শেষ গন্তব্য - কাঁকড়াঝোর ফরেস্টের দিকে। আমাদের গন্তব্য ফরেস্টের নির্দিষ্ট কোনও জায়গা নয়, প্রকৃতপক্ষে ফরেস্টের ভিতরের রাস্তাটা দিয়ে যাওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য। খাঁদারাণী লেক থেকে ২.৫ কিলোমিটার মেঠো পথে এসে আবার আমরা ৫ নং রাজ্য সড়কে উঠলাম। তারপর রাজ্য সড়ক দিয়ে ১৪ কিলোমিটার এগিয়ে গিয়ে চাকাডোবা বলে একটা জায়গা থেকে রাজ্য সড়ক ছেড়ে বাঁদিকে ঘুরে আমরা কাঁকড়াঝোর রোড ধরলাম।

কাঁকড়াঝোর ফরেস্ট - কাঁকড়াঝোর রোডটা প্রথমদিকে লোকালয়ের মধ্যে দিয়ে হলেও একটু পরে শুরু হল জঙ্গল। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য ! দুদিকের শালগাছের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বাঁধানো রাস্তা এগিয়ে চলেছে। ঘড়ি বলছে পৌনে পাঁচটা - শীতকাল হওয়ায় দিনের আলো বেশ কমে এসেছে। আর চারপাশে জঙ্গল হওয়ায় আলো এমনিতেই আরও কম। এই আলোআঁধারি পরিবেশের মধ্যে জঙ্গলের ভিতরের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি। সামনে পিছনে যতদূর চোখ যায়, দ্বিতীয় কোনও গাড়ির উপস্থিতি চোখে পড়ছে না। রাস্তাটা ক্রমাগত দিকপরিবর্তন করছে বলে গাড়ির গতি মাঝেমাঝেই কমাতে হচ্ছে আর সেইসময়ে জঙ্গলের মধ্যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে দেখা হচ্ছে কোনও জানোয়ার চোখে পড়ে কিনা। জঙ্গল কোনও কোনও জায়গায় একটু পাতলা হয়ে এসেছে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ঘন হয়ে যাচ্ছে। শেষপর্যন্ত যখন একটা দু'টো করে বাড়ি চোখে পড়তে পড়তে একটা লোকালয় শুরু হয়ে গেল, তখন বুঝলাম আমরা জঙ্গলটা পেরিয়ে এসেছি। জঙ্গলের মধ্যে গাড়ি করে যাওয়ার একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা হল এটা বলতেই হবে আর গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে এই পথে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা আমার বাড়তি পাওনা। আমার মতো যারা গাড়ি চালাতে ভালোবাসে, তাদের বিশেষভাবে অনুরোধ করব এই পথে একবার গাড়ি নিয়ে ভ্রমণ করার জন্য। পার্থ আমাদের বলেছিল পারলে এই পথ দিয়ে বিকেল-সন্ধ্যে নাগাদ যেতে আর ঘটনাচক্রে আমরা সেটাই করেছি। এই দূর্দান্ত সময়ের পরামর্শটা দেওয়ার জন্য মনে মনে পার্থকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারলাম না।

কাঁকড়াঝোর
যারা কাঁকড়াঝোর ফরেস্ট দেখতে যাবে, তাদের কথা মাথায় রেখে ফরেস্টের কোনও ছবি ইচ্ছাকৃতভাবেই দিলাম না। এই সৌন্দর্যটা প্রথমবার দেখার আনন্দটা আমি আগে থেকে ছবি দেখিয়ে নষ্ট করে দিতে চাই না। তবে লেখার সঙ্গে ছবি থাকলে লেখাটা পড়তে বেশি ভালো লাগে, তাই কাঁকড়াঝোর ফরেস্টের শেষের দিকের রাস্তার একটা ছবি দিলাম। সূর্যাস্ত কিছুক্ষণ আগে হয়েছে, সামনের গাছগুলোর সিল্যুয়েট দেখা যাচ্ছে - সবমিলিয়ে একটা অপার্থিব সৌন্দর্য।

আমাদের দ্বিতীয় দিনের সাইট সিয়িং শেষ। আমরা কাঁকড়াঝোর থেকে একটা রাস্তা ধরলাম যেটা ধরে ২১ কিলোমিটার গিয়ে আবার রাজ্য সড়কে পৌঁছলাম। এখান থেকে ঝাড়গ্রাম আরও ৩৮ কিলোমিটার। আমরা আরও কিছুটা এগিয়ে একটা দোকান থেকে চা, সিঙ্গাড়া, তেলেভাজা, মিষ্টি ইত্যাদি খেয়ে নিলাম। হোটেলে ফিরে আর কিছু করার থাকে না। রাতের ডিনার আগেরদিনের মতো ঘরে আনিয়েই খাওয়া হল। মেনুও প্রায় আগেরদিনেরই। খরচ হল ৫৩৩/- টাকা।

পরেরদিন অর্থাৎ ৩০শে ডিসেম্বর ২০২২ শুক্রবার সকালে হোটেল থেকে চেক্‌আউট করে আমরা রওনা দিলাম জামশেদপুরের উদ্দেশ্যে। আমাদের ঝাড়গ্রামে দুটো জায়গা দেখা বাকি আছে সেগুলো আমরা যাওয়ার পথে দেখে নেব। ব্রেকফাস্ট করলাম আগেরদিনের দোকানটা থেকেই। তারপর রওনা দিলাম আমাদের দিনের প্রথম গন্তব্য - কনকদুর্গার মন্দিরের উদ্দেশ্যে।

কনকদুর্গা মন্দির যাওয়ার পথে
কনকদুর্গা মন্দির - ঝাড়গ্রাম শহর থেকে চিল্কিগড় জামবনি রোড ধরে ১৬ কিলোমিটার গেলে চিল্কিগড়ে একটা ছোট্ট জঙ্গলের মধ্যে কনকদুর্গার মন্দির। অবশ্য জঙ্গল বলতে যেটা মনে হয়, এটা ঠিক সেরকম নয়। জঙ্গলের মধ্যে গাছপালা কেটে একটা জায়গা পরিষ্কার করা হয়েছে আর সেখানে গাড়ি পার্কিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর তার থেকে যা হয়, এখানে রীতিমতো দোকান বসে গেছে। বেশিরভাগই খাবারদাবারের দোকান। পার্কিং-এর জায়গা থেকে জঙ্গলের মধ্যের বাঁধানো রাস্তা দিয়ে ৫০০ মিটার হেঁটে গিয়ে মন্দির।

কনকদুর্গা মন্দির
মন্দিরটা বেশ সুন্দর - সামনে বাঁধানো নাটমন্দির। মন্দিরের দুর্গার মূর্তিটা সোনার, সেই থেকেই নাম কনকদুর্গা। মন্দিরের চত্বরটা বেশ বড়। একপাশে কিছু দোকান। দোকানগুলো সব একই ধরনের আর প্রত্যেকটাতেই একইরকম পুজোর সামগ্রী পাওয়া যায়। মন্দিরের চত্বরের সবথেকে বেশি যেটা চোখে পড়ে সেটা হল বাঁদর। এখানে বাঁদরদের যে বিশেষ উৎপাত আছে তা মনে হয় না, এরা নিজেদের মতোই থাকে। বেশ কয়েকটা বাঁদরের বাচ্চাও দেখতে পেলাম। বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের মা-বাবাদেরও দেখা গেল। মানুষ ছাড়া বাঁদরই হচ্ছে একমাত্র প্রাণী যাদের বাবারাও বাচ্চাদের সঙ্গে থাকে। যাই হোক, মন্দিরে বেশ ভীড় (মানুষের) ছিল বলে সেই ভীড় ঠেকে ঠাকুরের কাছে পর্যন্ত আর গেলাম না।

ডুলুং নদী
মন্দিরের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা নেমে গেছে যেটা দিয়ে মিনিটখানেক গেলে ডুলুং নদী দেখতে পাওয়া যায়। নদীটা বেশ সুন্দর - গ্রামের নদী বলতে যে দৃশ্যটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ঠিক সেরকমই। নদীর দু'ধার উঁচু এবং পাড়টা ঢালু। দু'দিকেই হাল্কা জঙ্গলের মতো গাছপালা। নদীটা বেশ সরু তবে একেবারে পায়ের পাতাডোবা জল নয়। নদীর মাঝে জায়গায় জায়গায় পাথর রয়েছে যেগুলোর সাহায্যে কিছুটা কসরৎ করে নদী পারাপার করা যায়। আমরা অবশ্য সেই চেষ্টা করিনি। নদীর পাড়ে বসে থাকতে বেশ ভালো লাগছিল, তাই কিছুক্ষণ বসে আবার মন্দিরের কাছে ফিরে এলাম।

চিল্কিগড় রাজবাড়ি - কনকদুর্গা মন্দির থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে ১.৫ কিলোমিটার দূরে চিল্কিগড় রাজবাড়ি। রাজবাড়ির মাঠটা একটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আর তার মাঝখানে একটা বড় ফটক। এই ফটক দিয়ে ঢুকে ভিতরের মাঠে গাড়ি পার্কিং করা যায় আর পার্কিং-এর জন্য কোনও টাকা লাগে না।

চিল্কিগড় রাজবাড়ি (পাঁচিলের পিছনে)
ফটক দিয়ে ঢুকে যে দোতলা জমিদার বাড়ির মতো বাড়িটা চোখে পড়ে, সেটা কিন্তু আসলে রাজবাড়ি নয় (সেটার সামনে লেখা আছে জামবনি আই সি ডি এস প্রজেক্ট), যদিও ইন্টারনেটে সবাই এটাকেই রাজবাড়ি বলে উল্লেখ করে। এই বাড়িটার পাশে একটা লোহার গেট আছে আর আসল রাজবাড়িটা সেই গেটের পিছনদিকে। রাজবাড়ির দোতলাটা মাঠ থেকে দেখা যায় কিন্তু রাজবাড়িতে ঢোকা যায় না। আসলে এখানে এখন রাজাদের বর্তমান প্রজন্মের লোকেরা থাকে তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা এখানে কাউকে ঢুকতে দেয় না। নিজের বাড়ি বাইরের লোকের পর্যটনস্থল হয়ে উঠলে সেই অভিজ্ঞতা যেকোনও মানুষের পক্ষেই বিরক্তিকর। মাঠের একপাশে একটা মন্দির আছে, যেটার রঙ দেখে বোঝা যায় যে সেটা অল্পকিছুদিন আগেই সংস্কার করা হয়েছে। এছাড়া মাঠের একপাশে একটা গেট দিয়ে ঢুকে একটা রাধাকৃষ্ণর মন্দির দেখা যায়। আমরা এই সবকিছু দেখে নিয়ে আবার রওনা দিলাম।

আমাদের ঝাড়গ্রাম ভ্রমণ শেষ - এবার আমরা রওনা দিলাম জামশেদপুরের উদ্দেশ্যে। যাত্রাপথ চিল্কিগড় রোড - ৯ নং রাজ্য সড়ক - বেন্ড রোড (এই বেন্ড রোড ধরে যাওয়ার সময়েই পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে ঝাড়খন্ডে ঢুকে যেতে হয়) - ধলভুমগড় রোড - ১৮ নং জাতীয় সড়ক - জামশেদপুর। চিল্কিগড় থেকে জামশেদপুরের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারের মতো। আমরা অবশ্য সরাসরি জামশেদপুর যাব না, যাওয়ার পথে পড়বে ঘাটশিলা আর আমরা যাওয়ার সময়ে এখানকার কয়েকটা দেখার জায়গা দেখে তারপরে জামশেদপুর যাব।

১৮ নং জাতীয় সড়কে উঠে কিছুটা চলার পরে রাস্তার ধারের একটা ধাবা থেকে আমরা লাঞ্চ করে নিলাম। এখানকার রান্না বেশ ভালো আর দাম অনুযায়ী পরিমাণও বেশ ভালো। ভাত রুটি ডাল চিকেন এগকারী ইত্যাদি নেওয়া হল। অমৃতা আবার একটা বিখ্যাত পাঞ্জাবী আইটেম খেল - মকাই-দি-রোটি আর সেইসঙ্গে সরষোঁ-দা-সাগ। ওর বেশ ভাল লেগেছে কিন্তু আমি ওর থেকে নিয়ে একটু চেখে দেখলাম ও জিনিস আমার পোষাবে না। পাঞ্জাবী ডিশের মধ্যে রুটি-তড়কা জিনিসটা আমার মন্দ লাগে না তবে চিকেন তন্দুরির নিচে বিশেষ কিছু আমি ভাবতে চাই না।

বুরুডি লেক
বুরুডি লেক - বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ আমরা ঘাটশিলায় পৌঁছে জাতীয় সড়ক ছেড়ে ডানদিকে বুরুডি রোড ধরলাম। রাস্তাটা জাতীয় সড়কের মতো মসৃণ নয় আর সেইসঙ্গে বেশ সরু এবং আঁকাবাঁকা। ফলে গাড়ি কখনওই জোরে চালানো যায়না। এই রাস্তা ধরে ৭ কিলোমিটার মতো গেলে বুরুডি লেক। পার্কিং-এ গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমরা গেলাম লেকের পাশে।

লেকটা বিশাল বড়। এটা দশটা ছোট ছোট পাহাড় দিয়ে ঘেরা (সেই থেকেই লেকের নামকরণ - স্থানীয় ভাষায় বুরুডি শব্দের অর্থ পাহাড়ে ঘেরা জলাশয়। এই তথ্যটা সিরিয়াসলি নেওয়ার দরকার নেই, এটা আমার নিজস্ব সংযোজন !)। এখানেও পিকনিক হচ্ছে - লোকজন গিজগিজ করছে। সেইসঙ্গে চলছে তারস্বরে মাইক। লেকের পাড়ে যথারীতি প্রচুর দোকানপাট আর এই সবকিছু এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করে ফেলেছে। কিছু করার নেই, তাই আমরা লেকের জলের একেবারে পাশে চলে গিয়ে এখানকার সৌন্দর্য যতদূর সম্ভব উপভোগ করার চেষ্টা করলাম।

বিকেল সাড়ে চারটে বাজে, সূর্য পশ্চিমদিকে ঢলে পড়েছে। পাহাড়ের উপরে সূর্যাস্ত একটু আগেই হবে আর অন্ধকার হয়ে যাবে, তাই আমরা রওনা দিলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।

যে রাস্তা দিয়ে বুরুডি লেকে এসেছিলাম সেই রাস্তা দিয়ে পাহাড়ী পথে আরও এগোতে লাগলাম। আমাদের গন্তব্য ধারাগিরি ফল্‌স্‌ যেটা বুরুডি লেক থেকে আরও ৬ কিলোমিটার দূরে। এই রাস্তাটা যাকে বলে আন্ডার কনস্ট্রাকশন আর সেই কারণে অত্যন্ত এবড়োখেবড়ো। পাহাড়ী পথে গাছপালার মধ্যে দিয়ে রাস্তা, ত্রিসীমানার মধ্যে কাউকে দেখা যাচ্ছে না, ভরসা একমাত্র গুগ্‌ল্‌ম্যাপ। এখানে আবার মোবাইলের নেটওয়ার্কেরও বেশ সমস্যা। যাই হোক, কিছুটা ম্যাপ আর কিছুটা নিজের বিচারবুদ্ধির সাহায্যে ফলসের কাছে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্যকে আর দেখা যাচ্ছে না। যেখানে পৌঁছলাম সেখানে আরও দুটো গাড়ি দাঁড়িয়েছিল, তাদের মধ্যে একটা গাড়ির লোকজন সবেমাত্র ফল্‌স্‌টা দেখে এসেছে। তাঁরা বললেন এখান থেকে ফল্‌স্‌টা হেঁটে আরও মিনিট পনেরো আর এটা দেখতে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। ফল্‌সে জল একেবারেই নেই, একটা সরু নালার মতো জলের ধারা। ওনাদের কথা শুনে আমরা দেখতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার সময়ে বুরুডি রোড একেবারেই অন্ধকার ফলে গাড়ির গতি আগের চেয়েও কমাতে হল। শেষপর্যন্ত আমরা ১৮ নং জাতীয় সড়কে যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যে ছটা।

আমাদের আর কিছু দেখার নেই, এবার সোজা জামশেদপুর। মাঝে রাস্তার ধারের একটা দোকান থেকে চা-পকোড়া ইত্যাদি খেয়ে নেওয়া হল। শেষপর্যন্ত জামশেদপুরের সাক্চি‌ মার্কেটে আমাদের হোটেল হলিডে ইন্‌-এ যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা।

হলিডে ইন্‌-এর ঘর
হলিডে ইন্‌ হোটেলটা সাক্চি‌ মার্কেটের একেবারে ভিতরে। হোটেলে গাড়ি পার্কিং-এর আলাদা কোনও ব্যবস্থা নেই, রাস্তার উপরেই রাখতে হয়। হোটেলের ঘরগুলো বেশ ছোট, হাঁটাচলার জায়গা খুব কম। জামশেদপুর এমনিতে খুব সুন্দর জায়গা হলেও এটা প্রধানতঃ ব্যবসাবাণিজ্য বা লোকজনের কর্মক্ষেত্রের জায়গা, তাই ট্যুরিস্ট এখানে খুব বেশি আসে না। আমি এর আগে ২০০৯ সালে একবার এখানে এসেছিলাম, তখন আমার জামাইবাবু কর্মসূত্রে সপরিবারে এখানে থাকতেন। এখানে কয়েকটা দেখার জায়গা আছে আর সেগুলো আমার খুব ভালো লেগেছিল। আমাদের আটজনের মধ্যে একমাত্র অমৃতা আর কথা-কলি কখনও জামশেদপুরে আসেনি, তাই মূলতঃ ওদের জন্যই এখানে আসার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। হলিডে ইন্‌-এর খাবারের দাম বেশ বেশি। আমরা ভাত ডাল রুটি চিকেন নিয়ে ডিনার করলাম।

হয় হলিডে ইন্‌-এর খাবারে কোনও সমস্যা ছিল অথবা এখানে আসার পথে যে দোকান থেকে চা-পকোড়া খাওয়া হয়েছিল, তার খাবারে সমস্যা ছিল। মোটকথা জামশেদপুরে প্রথমরাত থেকেই আমাদের সবারই কমবেশি পেটের সমস্যা দেখা দিল। এই কারণে পরেরদিন শনিবার ৩১শে ডিসেম্বর সকালে কেউই ঘুম থেকে উঠে বেরোতে পারলাম না।

আমরা বেরোলাম দুপুর বারোটা নাগাদ। সকালে ব্রেকফাস্টও করা হয়নি, তাই প্রথমে গেলাম একটা কাছাকাছি ফুড স্টলে - নাম ভোলা মহারাজ। এখান থেকে ধোসা, ইডলি, ছোলে বাটুরে ইত্যাদি দিয়ে ব্রেকফাস্ট কাম লাঞ্চ করে নেওয়া হল। সবমিলিয়ে খরচ হল ৮৩০/- টাকা।

জামশেদপুরে দেখার জায়গা মূলতঃ চারটে - ডিমনা লেক, দো-মোহানি, জুবিলি পার্ক সেইসঙ্গে জুলজিক্যাল পার্ক আর ভুবনেশ্বরী মন্দির। এছাড়া আরও কয়েকটা ছোটখাটো দেখার জায়গা আছে। শরীর ঘোরাঘুরির জন্য যথেষ্ট ফিট না থাকায় আমরা শুধু ডিমনা লেকটাই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

ডিমনা লেক
ডিমনা লেক - জামশেদপুর থেকে ১৮ নং জাতীয় সড়ক পেরিয়ে ৮ কিলোমিটার গেলে দেখা যায় ডিমনা লেক। লেকটা সুবিশাল - একপাশে একটা ড্যাম আছে, নাম ডিমনা ড্যাম। এই ড্যামের জায়গাটা থেকেই পুরো লেকটা বেশ ভালোভাবে দেখা যায়। আমরা এখানে গিয়ে দেখলাম - এখানেও পিকনিকের দল চলে এসেছে। তাছাড়া আরও কিছু অস্থায়ী দোকানও গজিয়ে উঠেছে। আমরা ড্যামের নিচের দিকের রাস্তাটা দিয়ে গিয়েছিলাম বলে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে লেকটা দেখতে হল। মিনিট দশেক এখানে কাটিয়ে আমরা আবার হোটেলে ফিরে এলাম।

সারা সন্ধ্যে হোটেলের ঘরে বসে গল্পটল্প করে কাটিয়ে দেওয়া হল। রাতে আর হোটেলের খাবার না খেয়ে কাছাকাছি একটা ভাতের হোটেলে গিয়ে ভাত রুটি তরকা দিয়ে ডিনার করে নিলাম।

রবিবার ১লা জানুয়ারী ২০২৩ - আমার ব্লগের সমস্ত পাঠকদের জানাই হ্যাপি নিউ ইয়ার ! আজ আমাদের বাড়ি ফেরার দিন। সকাল নটা নাগাদ হোটেল থেকে চেক্‌আউট করে বেরিয়ে পড়লাম। এখান থেকে কলকাতার দূরত্ব ২৯০ কিলোমিটার - টানা গেলে সাড়ে পাঁচ ঘন্টার মতো লাগার কথা। জামশেদপুর থেকে রওনা হওয়ার আগে আমরা দো-মোহানিটা দেখে নিলাম।

দো-মোহানি
দো-মোহানি - সাক্‌চি মার্কেটে আমাদের হোটেল থেকে দো-মোহানির দূরত্ব ৭ কিলোমিটারের মতো, যেতে মিনিট কুড়ি লাগল। দো-মোহানিতে খড়কাই নদী সুবর্ণরেখা নদীর সঙ্গে মিশেছে। এই জায়গার বৈশিষ্ট্য হল এখানে দুটো নদীর জলের রঙ সম্পূর্ণ আলাদা - একটা গাঢ় সবুজ আর অন্যটা কালচে। যেখানে এই দুটো নদী একসঙ্গে মিলিত হয়, সেখানেও এই জলের রঙের তফাৎটা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। এখানে নদীর পাড়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নিচে নেমে জলের একেবারে কাছে যাওয়া যায়। এত সকালে এখানে সেরকম ভিড় হয়নি কিন্তু ছুটির দিনে দুপুর বা বিকেলের দিকে এখানে ভালোই লোকসমাগম হয়। আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর রওনা দিলাম।

দো-মোহানি থেকে ১১৮ নং জাতীয় সড়ক দিয়ে কিছুটা এসে ১৮ নং জাতীয় সড়কে উঠতে হয়। আমরা এখানে রাস্তার ধারের একটা স্টল থেকে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম। ইডলি ধোসা বঢ়া নিয়ে খরচ হল ১৮০/- টাকা।

১৮ নং জাতীয় সড়কে ওঠার পরে ফিরতি পথে আরও ৩০ কিলোমিটার এসে একটা জায়গা থেকে আমরা ডানদিকে ঢুকে গেলাম। এই রাস্তা দিয়ে আরও ১.৫ কিলোমিটার গেলে আমাদের শেষ দ্রষ্টব্য - গালুডি ব্যারেজ ও ড্যাম।

গালুডি ব্যারেজ
গালুডি ব্যারেজ ও ড্যাম - গালুডি ড্যামটা আসলে ঘাটশিলার সাইট সিয়িং-এর মধ্যে পড়ে। এটা দেখার পরিকল্পনা আমাদের জামশেদপুর আসার দিনই ছিল, কিন্তু সময়াভাবে সম্ভব হয়নি। এখানে সুবর্ণরেখা নদীর উপরে একটা ব্যারেজ আছে আর ব্যারেজের উপরে ব্রীজ। এই ব্রীজের উপর দিয়ে গাড়ি চলাচল করে। আমরা ব্রীজটা পেরিয়ে ওপারে গিয়ে নদীর পাড়ে দাঁড়ালাম। তারপর হেঁটে গিয়ে ব্যারেজটা ভালোভাবে দেখলাম। জায়গাটা কিছুটা কুয়াশা মতো হয়ে রয়েছে আর এই কুয়াশা শীতকালে দিনের কোনও সময়েই কমবে না। যাই হোক, আমরা এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার ফেরার পথ ধরলাম।

আর কোথাও দাঁড়ানোর নেই। আমাদের ফেরার পথ ১৮ নং জাতীয় সড়ক - ৪৯ নং জাতীয় সড়ক - ১৬ নং জাতীয় সড়ক - কোনা এক্সপ্রেসওয়ে - বিদ্যাসাগর সেতু পেরিয়ে কলকাতা। মাঝখানে খড়্গপুরের কাছে জকপুরের মনসামন্দিরে আমরা একটু দাঁড়িয়েছিলাম আর ওখানেই লাঞ্চ করেছি। সেটার বিস্তারিত বিবরণ আর এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় সংযোজন করছি না। মোটকথা সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ আমরা বাড়ি পৌঁছে গেলাম।

সারসংক্ষেপ ঃ

১. কলকাতা থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে নবনির্মিত ঝাড়গ্রাম জেলার সদর ঝাড়গ্রাম। দুতিনদিন ঘোরার পক্ষে ঝাড়গ্রাম খুবই উপযোগী।

২. ঝাড়গ্রাম ট্রেনে যেতে হলে হাওড়া থেকে টাটানগরগামী ট্রেনে যাওয়া যায়। ট্রেনে যেতে ঘন্টাদুয়েক লাগে।

৩. কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রামের বাস পাওয়া যায় অথবা সড়কপথে গাড়ি নিয়েও যাওয়া যায়। রাস্তা খুবই সুন্দর, কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রাম ঘন্টাচারেকের মতো লাগে।

৪. ঝাড়গ্রাম পর্যটনের জন্য মোটামুটি বিখ্যাত, তাই এখানে অনেক হোটেল আছে। আমাদের হোটেল সোমানি ইন্‌-তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ঘরগুলো খুবই সুন্দর এবং এদের খাবারের মান বেশ ভালো। MakeMyTrip বা অন্যান্য বুকিং সাইট থেকে এদের বুকিং করা যায়। এদের যোগাযোগের নম্বরঃ 9733614354.

৫. ঝাড়গ্রামের সাইট সিয়িং-এর মধ্যে ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি, সাবিত্রী মন্দির আর ঝাড়গ্রাম মিনি জু আছে। এগুলো একেবারে শহরের মধ্যেই, তাই গাড়িভাড়া না করে টোটো ভাড়া করেও দেখা যেতে পারে।

৬. ঝাড়গ্রাম থেকে ৫০ কিলোমিটারের মতো দূরে বেলপাহাড়ী। এখানে বেশ কয়েকটা ভালো দেখার জায়গা আছে যার মধ্যে গদ্রসিনি পাহাড় ও খাঁদারাণী লেক অবশ্য দ্রষ্টব্য।

৭. বেলপাহাড়ী মোটামুটিভাবে একটা সারাদিনের ঘোরার জায়গা, তাই সঙ্গে কিছু খাবারদাবার রাখা ভালো। এখানকার সাইটসিয়িং-এর জায়গাগুলোর কোনওটার কাছেই সেরকম কোনও খাবারের দোকান নেই, তাই দুপুরের খাবার বেলপাহাড়ী শহর থেকেই খেয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

৮. কাঁকড়াঝোর ফরেস্টে আলাদা করে কিছু দেখার নেই, তবে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে রাস্তাটাই খুব সুন্দর। এখানে বিকেলের পড়ন্ত আলোয় যেতে পারলে জঙ্গলের সৌন্দর্য কিছুটা বেশি করে উপলব্ধি করা যাবে। আমার মতে এটাও অবশ্য দ্রষ্টব্য।

৯. ঝাড়গ্রাম থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে কনকদুর্গা মন্দির ও চিল্কিগড় রাজবাড়ি। কনকদুর্গা মন্দিরের লাগোয়া ডুলুং নদীটাও বিশেষ দ্রষ্টব্য।

১০. ঝাড়গ্রাম যাওয়ার পক্ষে সবচেয়ে ভালো সময় হল অক্টোবর থেকে মার্চ। গরমকালে এখানে গরম খুব বেশি আর বর্ষাকাল এইসব জায়গা ঘোরার পক্ষে একেবারেই উপযোগী নয়।

১১. কলকাতা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে ঝাড়খন্ড রাজ্যের বাণিজ্যিক প্রধান শহর জামশেদপুর। ঝাড়গ্রামের মতো জামশেদপুরও দু'দিন থাকার পক্ষে বেশ ভালো।

১২. হাওড়া থেকে ট্রেনে জামশেদপুর (স্টেশনের নাম টাটানগর) যেতে লাগে সাড়ে তিন ঘন্টা মতো। সড়কপথে যেতে লাগে ঘন্টা পাঁচেক।

১৩. জামশেদপুর প্রধানতঃ শিল্প শহর বলে এখানে পর্যটনের ব্যাপারটা সেরকম জনপ্রিয় নয়। এখানকার বেশিরভাগ হোটেলই সাক্‌চি-তে - যেটা এখানকার প্রধান মার্কেট। তবে ঘুরতে গেলে সাক্‌চিতে হোটেল না নেওয়াই শ্রেয়।

১৪. আমাদের হোটেল হলিডে ইন মোটের উপর খারাপ নয়, যদিও এদের খাবারের দাম বেশ বেশি। MakeMyTrip থেকে এদের বুকিং করা যেতে পারে। হোটেলের যোগাযোগের নম্বর - 6200075778, 7070093188, 9334340004.

১৫. জামশেদপুরের সাইট সিয়িং-এর মধ্যে প্রধান হল ডিমনা লেক, দো-মোহানি, জুবিলি পার্ক ও জুলজিক্যাল পার্ক আর ভুবনেশ্বরী মন্দির এবং এই সবকটা জায়গাই অবশ্য দ্রষ্টব্য। এগুলোর কোনওটাই শহর থেকে দূরে নয়, তাই একটা আধবেলা হাতে থাকলেও এগুলো সব দেখা হয়ে যাবে।

১৬. জামশেদপুর ঘুরতে যাওয়ার জন্য অক্টোবর থেকে মার্চই সবথেকে ভালো। ৩রা মার্চ জামশেদজী টাটার জন্মদিন, ওইসময়ে এখানে বিরাট উৎসব হয় - সারা শহর সাজানো হয়। এইসময়ে এখানে গেলে খুবই ভালো লাগবে।

উপসংহার ঃ

ঝাড়গ্রামের প্রকৃতি
ঝাড়গ্রামে মাওবাদীদের সমস্যা নেই। এটা উল্লেখ করতে হল কারণ পশ্চিম মেদিনীপুরের বেশ কিছু জায়গা সম্পর্কে অনেকের মনেই এখনও এই সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কিছুটা ভীতি কাজ করে। ঝাড়গ্রাম ঘুরতে যাওয়ার জন্য বেশ ভালো এবং নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে এখানে ঘোরাঘুরি করা যেতে পারে। ঝাড়গ্রাম একটা আদ্যন্ত শহর হলেও তার সীমানা ছাড়িয়ে বেলপাহাড়ীর দিকে গেলে চোখে পড়বে প্রকৃতির আসল সৌন্দর্য। আর তার মাঝে মাঝে ছোট্ট ছোট্ট গ্রামে বসবাসকারী সহজসরল মানুষগুলোকে। এঁরা যেন প্রকৃতিরই সন্তান। এঁদের জীবনে অভাব আছে, দারিদ্র্য আছে কিন্তু উচ্চাভিলাষ নেই আর তাই জীবনযাত্রাও অত্যন্ত অনাড়ম্বর, শান্তিপূর্ণ ও শিথিল।  আবার এরই সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি দেখা যায় জামশেদপুরে। টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজী টাটার নামাঙ্কিত এই শহরে সর্বদাই চোখে পড়ে কর্মব্যস্ততা। এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা গতিপূর্ণ কিন্তু শৃঙ্খলাবদ্ধ। টাটা গ্রুপ এই শহরের একটা বড় অংশের রক্ষণাবেক্ষণ করে আর সেই অংশের পরিচ্ছন্নতা আর নিয়মানুবর্তিতা চোখে পড়ার মতো। টাটাদের সম্পর্কে আমি চিরকালই শ্রদ্ধাশীল আর শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যাওয়া ব্যাপারটা জামশেদপুরে গেলে ভীষণভাবে অনুভব করা যায় !

ঝাড়গ্রাম ও জামশেদপুর ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

No comments:

Post a Comment